ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা

ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা

শুধু এ দেশে নয়, সব দেশেই ধর্ম তার তালুক-মুলুক হারায় যখন তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায়। আসলে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা তার প্রকৃত পরিচয় বাতলায় না। ধর্মনিরপেক্ষ আমরা সেকুলার শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ হিসেবে নিয়েছি, এবং সেই সেকুলার শব্দের অন্য অর্থ প্রোফেন- হিরেটিক্যালও বলা যেতে পারে। অর্থাৎ সেকুলার শিক্ষাপদ্ধতি ধৰ্মবৈরী, এমনকি ধর্মাঘ্নও হতে পারে।

কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যায়তন ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে না। করলে বরঞ্চ ভালো হত। ধর্ম তা হলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়তো-বা জিতে যেত। কিন্তু সে সুযোগ ধর্ম পায় না–তার জয়াশা অতি অত্যল্প হলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, সে ধর্মকে তাচ্ছিল্য করে, অবহেলা করে, এমনকি তার অস্তিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করে না। তার ভাবখানা অনেকটা এই : ধর্ম বাদ দিয়ে শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুই হয়, ছাত্রেরা পরীক্ষা পাসের পর যদি কাজকর্ম করে দু-পয়সা কামাতে পারে তবে ধর্ম অপ্রয়োজনীয় অবান্তর।

এক ইয়োরোপীয় বৈজ্ঞানিক যখন আঁক কষে ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দিলেন সৌরজগৎটা কীভাবে চলে তখন কে এক ধার্মিকজন শুধাল, কিন্তু তোমার সিস্টেমে তো ভগবান নেই।–উত্তরে বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন, ওঁকে বাদ দিয়েই যখন সিস্টেমটা নিটোল ত্রুটিহীন, তখন তাকে লাগাবার কী প্রয়োজন? কিন্তু ওই বৈজ্ঞানিকটি ব্যক্তিগত জীবনে কিঞ্চিৎ ধর্মভীরু ছিলেন বলে আস্তে আস্তে যোগ করলেন, কিন্তু দরকার হলে তাকে টেনে আনতাম বইকি। সে দরকার অদ্যাবধি হয়নি। সেকুলার শিক্ষাপদ্ধতি ধর্মের সেই কাল্পনিক প্রয়োজনীয়তাটুকু স্বীকার করে না।

বেদের বড় বড় দেবতা ইন্দ্র-বরুণ, এরা যে লোপ পেলেন তার কারণ এ নয় যে, কোনও বিশেষ যুগে এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে ধর্ম-সংস্কারকগণ জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আসলে মানুষ আস্তে আস্তে দেখতে পেল, প্রকৃতি তার নিয়ম অনুযায়ী চলেছে। বৃষ্টি-বর্ষণ, ফসল উৎপাদন, গোধনবৃদ্ধি ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজন এঁদের না ডেকেও সমাধান হয়। তবে বিশ্বাসীজনের কথা স্বতন্ত্র। দীর্ঘদিনব্যাপী অনাবৃষ্টি হলে এখনও তারা হোমযজ্ঞাদি করে থাকেন, বিশ্বাসী মুসলমান এখনও মোকদ্দমা জেতার জন্য মৌলা আলীর দর্গায় গিয়ে ধর্না দেয়*।[দক্ষিণ মিশরে ক্রমাগত কয়েক বৎসর বৃষ্টি না হওয়াতে একবার বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়। শহরের কাজি (চিফ জাস্টিস) সে নামাজের ইমাম (প্রধান) হবেন। ইনি ছিলেন মারাত্মক ঘুষখোর। নামাজে যাবার পথে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। কাজি যখন আল্লাকে শুকরিয়া (ধন্যবাদ) জানাবার জন্য মিম্বরে (পুলপিটে) উঠলেন তখনই, সঙ্গে সঙ্গে, বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। টীকাকার বলছেন, টিটকারির ভয়ে কাজি মসজিদের পিছনের দরজা দিয়ে পালালেন।] ভলটেয়ারকে কে যেন শুধিয়েছিল, মন্ত্রোচ্চারণ করে একপাল ভেড়া মারা যায় কি না? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, অবশ্যই যায়। তবে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক খাইয়ে দিলে সন্দেহের আর কোনও অবকাশই থাকে না।

তা হলে প্রশ্ন উঠতে পারে, ইন্দ্র-বরুণ চলে যাওয়ার পরে কালী-হনুমান এলেন কী করে? কুরান হদীসে যখন স্পষ্ট লেখা রয়েছে, আল্লা, মানুষকে তার ন্যায্য হক্কাহ (হ+ন+হ, অ+হক) ইনসাফের সঙ্গে বিতরণ করেন, মধ্যস্থতা করার জন্য উকিল ধরে কোনও লাভ নেই, তখন মানুষ নৌকা ছাড়ার পূর্বে বদরপীর কিংবা পুত্রলাভের জন্য সোনা গাজীর শরণাপন্ন হয় কেন?

উত্তরে পণ্ডিতেরা বলেন, অনার্যদের স্বধর্মে আকর্ষণ করার জন্য আর্যরা অনার্যদের অনেক দেবদেবীকে আপন ধর্মে স্থান করে দেন। অনার্যরা অনুন্নত। তারা ওইসব দেবীর সহায়তায় তখনও বিশ্বাস করে। যারা করে করুক, ক্ষতিটা কী? বদর পীর মৌলাআলীর বেলাও তাই। এবং সবচেয়ে মোক্ষম যুক্তি–পুরুত-মোল্লাদেরও তো খেয়ে বাঁচতে হবে। পরমে ব্রহ্মণি যোজিত চিত্তঃ তো আর পূজাপাটা করেন না, আল্লাকে যে-সাধক নূর বা জ্যোতিরূপে অনুভব করে আপন ক্ষীণ জ্যোতি-শিখা তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন–কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃসমুদ্রেই তিনি তো আর মোল্লা ডেকে শিরনি চড়ান না। তাই ঘেঁটু-মনসা মৌলাআলী সোনা গাজীর দরকার। সত্যপীর তো আরও শহর-পসন্দ, জনপদবল্লভ–উভয় ধর্মেরই বিশ্বাসীজনকে পাওয়া যায়। মোল্লা-পুরুত দুজনারই সুবিধা।

সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে এস্থলে আরেকটি প্রশ্ন তুলি। তবে কি আজ আর বেদাধ্যয়নের কোনও প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। ঋষি কবিরূপে বেদে যে মধুর এবং ওজস্বিনী ভাষায় তার উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন সেটি বড়ই মূল্যবান। বুদ্ধি দিয়ে যেটা বুঝেছি সেইটে কবিমনীষীর প্রসাদাৎ তখন হৃদয় দিয়ে অনুভব করে সম্যক অনুপ্রাণিত হই। অনুভূতির হৃদয়াবেগ তখন ধ্যানলোকে অগ্রসর হওয়ার শক্তি সঞ্চারিত করে।

এরই তুলনায়– যদিও এর চেয়ে অনেক নিম্নস্তরের একটি উদাহরণ দিই। তিক্ত অভিজ্ঞতার পর বুদ্ধি দিয়ে বুঝলুম, দুরাশা করে শুধু বঞ্চিত হতে হয়। তখন যদি কেউ এসে আবৃত্তি করে–

আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়, তাই ভাবি মনে।

তখন কেমন যেন সেই নিরাশার মাঝখানেও অনেকখানি সান্তুনা লাভ করি।

ফ্রান্স যখন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য দৃঢ়সংকল্প, তখন মাসে ইয়েজ গীতি কী অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণাই না তাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করেছিল।

অনেকখানি দাগা খাওয়ার পর যখন মাইকেল আশার ছলনার কথা ভাবছেন তখন যদি কুরান শরীফের উষস্ সুরা পড়তেন তবে কি অনেকখানি সান্ত্বনা পেতেন না?

৯৩ অধ্যায়

ঊষস্

(অদ-দুহা)

 মক্কায় অবতীর্ণা

(একাদশ পঙক্তি)

আল্লার নামে আরম্ভ–

তিনি করুণাময়, দয়ালু
ঊষালগনের আলোর দোহাই,
নিশির দোহাই ওরে,
 প্রভু তোরে ছেড়ে যাননি কখনো
ঘৃণা না করেন তোরে।
অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো
রয়েছে ভবিষ্যৎ
একদিন তুই হবি খুশি লভি
তাঁর কৃপা সুমহৎ।
অসহায় যবে আসিলি জগতে
তিনি দিয়েছেন ঠাঁই
 তৃষ্ণা ও ক্ষুধা দুঃখ যা ছিল
মুছায়ে দেছেন তাই।
 পথ ভুলেছিলি তিনিই সুপথ।
দেখায়ে দেছেন তোরে।
 সে কৃপার কথা স্মরণ রাখিস।
অসহায় জন, ওরে–
 –দলিস নে কভু। ভিখারি-আতুর
বিমুখ যেন না হয়।
 তাঁর করুণার বারতা যেন রে
ঘোষিস জগন্ময় ॥
—সত্যেন দত্তের অনুবাদ

সত্যেন দত্তের অনুবাদে আরম্ভ, মধ্য দিনের আলোর দোহাই নিশির দোহাই ওরে। অথচ আরবিতে অদ-দুহা অর্থ উষা। ইংরেজি অনুবাদের সর্বত্রই আর্লি আওয়ার অব দি মর্নিং। হয়তো সত্যেন দত্ত ভেবেছিলেন আরবের মধ্যাহ্নসূর্য অতুলনীয়। আল্লা যদি কোনও নৈসর্গিক বস্তুকে সাক্ষী ধরে দোহাই দেন, তবে তিনি মধ্যাহ্ন-সূর্যকেই নেবেন। আমাদের মনে হয় ঊষা নেওয়া হয়েছিল এই অর্থে যে, রাত্রির অন্ধকার যতই সৃচিভেদ্য এবং নৈরাশ্যজনক হোক না কেন, ঊষার আলো প্রভাসিত হবেই হবে। আল্লা এস্থলে বলেছেন, সেটা যে রকম সত্য, আমার বাক্যও তেমনি ধ্রুব।

যারা কুরান শরীফকে মেটাফরিকালি ও সিম্বলিকালি (অর্থাৎ দ্বিতীয় পক্ষে) রূপকে ব্যাখ্যা করেন (যেমন পরবর্তী ওমর খৈয়ামের মদকে ভগবৎপ্রেম অর্থে ধরেন, কিংবা ভারতচন্দ্র চৌরপঞ্চাশিকা কালী-পক্ষেও অনুবাদ করেছেন। তাঁরা বলেন এখানে প্রভাতসূর্য (ঊষস্, অ-দুহা) হজরত মুহম্মদের (দ) প্রেরিত-পুরুষরূপে আগমনের সূচনা করেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান কিন্তু কুরান শরীফকে এ রকম রূপক অর্থে নেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *