ভাষা
আমার আর একটি প্রশ্ন আছে :
এই যে লাকসমবার্গের মতো ক্ষুদে রাষ্ট্র কিংবা জনবিরল ফিনল্যান্ড, কিংবা ওই ধরনের ছোট-বড় নানারকমের রাষ্ট্র রয়েছে, কোনখানে দেশটা সে দেশের ভাষায় না চালিয়ে অন্য কোনও বিজাতীয় ভাষায় চালানো হচ্ছে?
সুইজারল্যান্ডের লোক তিন অঞ্চলের তিন ভাষায় কথা বলে। জর্মন, ফরাসি এবং ইতালীয়। রোমানুশ ভাষায় এত কম লোক কথা বলে যে সেটার কথা না হয় না-ই তুললুম। এদের সকলের পক্ষে দিশিই হোক আর বিদেশিই হোক– কাজ চালাতে যে বিস্তর সুবিধা হত সে বিষয়ে কী সন্দেহ? কত পয়সা খরচ করে তিন-তিনটে ভাষায় সরকারি-বেসরকারি বিস্তর জিনিস ছাপাতে হয়, তিন ভাষায় লোকে বক্তৃতা দেয় বলে পার্লামেন্টের কাজ দ্রুতগতিতে এগোয় না, এক অঞ্চলের জিনিস অন্য অঞ্চলে বেচতে হলে তার জন্য আলাদা বিজ্ঞাপন, আলাদা এজেন্ট রাখতে হয়, এবং আরও কত যে ঝামেলা তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ওরা হাসিমুখে সবকিছুই মেনে নিয়েছে।
তার কারণ মাত্র একটি, এবং সে কারণ পৃথিবীর সর্বত্রই প্রযোজ্য।
মাতৃভাষা ছাড়া আর অন্য কোনও ভাষায় কাজ চালানো যায় না।
অবশ্য আজ যদি বাঙলা দেশ চালানোর জন্য একজন রাজা, তার জন্য পঁচিশ মনসবদার এবং একটি পুরুষ্টু সৈন্যদল থাকলেই যথেষ্ট হত তা হলে ইংরেজি-হিন্দি যে কোনও ভাষা দিয়েই অল্পায়াসেই কাজ চালিয়ে নেওয়া যেত। যেমন ধরুন একটা চা-বাগানের ইংরেজ ম্যানেজার, গুটিকয়েক কেরানিতে ইংরেজির মারফতে দিব্যি কাজ চালিয়ে নেয়। কিন্তু আজ পৃথিবী অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে, আজ বাঙলা দেশের গ্রামে গ্রামে সাড়া পড়ে গিয়েছে যে, রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যেক গ্রামবাসীর যেমন কর্তব্য আছে, তেমনি কতকগুলি হক্ক এবং দাবিও আছে। এরা প্রত্যেকেই যে শহরে এসে মন্ত্রী হতে চায় তা নয়, কিন্তু আস্তে আস্তে এদের মনে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, গা-গতর খাটানোর পর যদি দু মুঠো না খেতে পায় তবে রাষ্ট্র অবিচার করছে।
গণতন্ত্রের সামনে এই-ই বড় পরীক্ষা।
এবং আমি এর ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চাই।
গ্রামবাসীর সক্রিয়, সতেজ এবং দরদী সহযোগিতা না পেলে বাঙলার কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
কিন্তু প্রশ্ন, নেতারা, সমাজপতিরা এদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করবেন কোন ভাষার মাধ্যমে? ইংরেজির কথা পূর্বেই আলোচনা করেছি; এইবার হিন্দিতে আসি।
প্রথমেই একটা সাফাই গেয়ে নিই। আমি হিন্দি-প্রেমী এবং ওই ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়। হিন্দি বাংলার বুকের উপর চেপে বসে একদিন হিন্দি ইমপিরিয়ালিজম কায়েম করবে এ দুর্ভাবনা আমার মনের কোণেও আসে না। বস্তুত স্বরাজ লাভের পর কলকাতা তথা বাঙলা দেশে হিন্দি প্রচারের যেটুকু ব্যবস্থা হয়েছে তাতে আমি আদৌ সন্তুষ্ট নই– এর চেয়ে ঢের ব্যাপকতর চেষ্টার প্রয়োজন হবে কিন্তু সে কথা পরে হবে, উপস্থিত ফের গ্রামে ফিরে যাই।
গ্রামে গ্রামে পাঠশালে পাঠশালে হিন্দি শেখাতে হলে যে কতখানি রেস্তোর প্রয়োজন হবে সেটা একবার শিক্ষামন্ত্রীকে জিগ্যেস করে দেখুন। এ নিয়ে দীর্ঘ বাগাড়ম্বর করতে চাইনে– জিনিসটা এতই সরল এবং স্বতঃসিদ্ধ।
দ্বিতীয়ত, যে দেশের লাখের মধ্যে একজন গ্রামবাসীও আপন প্রদেশের বাইরে যায় না, তার পক্ষে ভিন্ন ভাষা শেখার প্রয়োজন নেই।
সবসুদ্ধ মিলিয়ে দেখা গেল, নেতারা তা হলে এদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করবেন বাঙলার মারফতেই।
কিন্তু নেতারা যদি পরিপুষ্ট হন হিন্দি চর্চা করে, তা হলে ইংরেজ আমলে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে–তাঁরা জানতেন ইংরেজি, শ্রোতারা জানত বাঙলা, দুজনার চিন্তাজগৎ, অনুভূতি ক্ষেত্র ভিন্ন। শেষটায় নেতারা যে অতিকষ্টে বাঙলা শিখে কাজ চালালেন, সে তো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলুম।
ওদিকে ভারতীয় ঐক্য, জাতীয় সংহতি তো চাই। এই যে প্রদেশে প্রদেশে দ্বন্দ্ব, একই প্রদেশের ভিতর সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর অবিচার, এ তো ক্রমাগতই বেড়ে চলছে, এর বিরুদ্ধে তো কিছু-একটা করা চাই।
এর সরল সহজ রাস্তা নেই।
ভাষা এক না করেও সংহতি হয় যেমন সুইজারল্যান্ডে, বেলজিয়ামে আছে এবং ভাষ্য এক হলেও সংহতি না হতে পারে যেমন নাসের, কাসেম, মক্কার বাদশা, কুয়েতের শেখ সক্কলেরই ভাষা আরবি কিন্তু এদের ভিতর দ্বন্দ্ব-কলহের অন্ত নেই। এই যে এত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সংযুক্ত আরবরাষ্ট্র (UAR) করা হল তার সূতিকাগৃহ তো শুশানশয্যায় পরিণত হতে চলল।
মহাআজিকে এক ইংরেজ সাংবাদিক শুধিয়েছিল, তোমরা আপসে এত লড়ো কেন? মহাত্মাজি বলেন, ইংরেজ লড়ায় বলে। ফের প্রশ্ন– ইংরেজ লড়তে চাইলেই তোমরা লড়ো কেন? উত্তর হল, আমরা মূর্খ বলে!
সেই হল মুখ্য কথা! আমরা মূর্খ।
এখন তো আর ইংরেজ নেই, কেউ ওস্কাচ্ছে না, আমরা তবু লড়ে মরছি!
তা হলে প্রশ্ন– এই মূর্খতা ঘুচাই কী করে?
বিদ্যাদান করে, ধর্মবুদ্ধি জাগ্রত করে, রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য সম্বন্ধে তাকে সচেতন করে।
এইখানেই অধীনের সবিনয় নিবেদন– সেটি মাতৃভাষার মারফতেই করতে হবে, অন্য কোনও পন্থা নেই, নেই, নেই।