হিটলারের শেষ প্রেম
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মে রাত দশটার সময় হামবুর্গ বেতার কেন্দ্র তার উচ্চাঙ্গ সংগীত প্রোগ্রাম হঠাৎ বন্ধ করে দিয়ে ঘোষণা করলো–
আমাদের ফুরার আডলফ হিটলার বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
যে সময়ে এ নিদারুণ ঘোষণাটি করা হয়, তখন প্রোগ্রামমাফিক কথা ছিল, ইঁদুর ধ্বংস করার উপায়। এই নিয়ে হিটলার-বৈরীরা এখনও ঠাট্টা-মশকরা করেন।
যেসব জর্মন বেতার-ঘোষণাটি শুনেছিল, তাদের অনেকেই যে বিরাট শক পেয়েছিল, সে নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এদের অনেকেই সরলচিত্তে বিশ্বাস করত, আশা রাখত–যে হিটলার ক্রমাগত পঁচিশ বৎসর বহু উৎকৃষ্ট সংকটে যেন ভাগ্যবিধাতার অদৃশ্য অঙ্গুলি সংকেতে, অবলীলাক্রমে বিজয়পতাকা উড্ডীয়মান করে সেসব সংকট উত্তীর্ণ হয়েছেন, এবারেও তিনি আবার শেষ মোক্ষম ভেল্কিবাজি দেখিয়ে তাবৎ মুশকিল আসান করে দেবেন। তার অর্থ; যেসব রুশ-সৈন্য বার্লিন অবরোধ করেছে তারা স্বয়ং হিটলারচালিত আক্রমণে খাবে প্রচণ্ডতম মার, ছুটবে মুক্ত হয়ে মস্কো বাগে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন-ইংরেজ সৈন্যও পড়ি-মরি হয়ে ফিরে যাবে আপন আপন দেশে। রাহমুক্ত ফুরার পথপ্রদর্শক সর্বোচ্চ নেতা পুনরায় ইয়োরোপময় দাবড়ে বেড়াবেন।
এরা যে মোক্ষম শ পেয়েছিল সে তো বোঝা গেল। কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষমতর শক্ পেল কয়েকদিন পর, যখন বেতার ঘোষণা করল, হিটলার আত্মহত্যা করার পনেরো ঘণ্টা পূর্বে এফা ব্রাউন নামক একটি কুমারীকে বিয়ে করেন। কারণ, জর্মনির দশ লক্ষের ভিতর মাত্র একজন হয়তো জানত যে, হিটলারের একটি প্রণয়িনী আছেন এবং তার সঙ্গে তিনি স্বামী-স্ত্রীরূপে বছর বারো-তেরো ধরে জীবনযাপন করছেন। নিতান্ত অন্তরঙ্গ যে কয়েকজন এই গুপ্তি প্রেমের খবর জানতেন, তারা এ বাবদে ঠোঁট সেলাই করে কানে ক্লফর্ম ঢেলে পুরো পাক্কা নিশ্চুপ থাকতেন। কারণ হিটলারের কড়া আদেশ ছিল, তার এই গুপ্তিপ্রেম সম্বন্ধে যে-কেউ খবর দেবে বা গুজব রটাবে, তিনি তার সর্বনাশ করবেন। তার কারণও সরল। তাঁর প্রপাগান্ডা মিনিস্টার গ্যোবেলস দিনে দিনে বেতারে খবরের কাগজের মারফতে হিটলারের যে মূর্তি গড়ে তুলেছিলেন (আজকের দিনের ইংরেজিতে তার যে ইমেজ নির্মাণ করেছিলেন সেটি সংক্ষেপে এই : হিটলার আজীবন ব্রহ্মচারী, তার ধ্যানধারণাসাধনা সর্বশক্তি তিনি নিয়োগ করেন, একমাত্র জর্মনির মঙ্গলসাধনে, হিটলার স্বয়ং অন্তরঙ্গ জনকে একাধিকবার বলেছেন, জর্মনিই আমার বধু (বাগদত্তা দয়িতা)। এমনকি তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরও তত্ত্বতাবাশ করেন না। এটা সত্য, এ নিয়ে কোনও ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল না। গোড়ার দিকে তিনি তাঁর বিধবা একমাত্র সদিদিকে মিউনিকের নিকটবর্তী তার বেৰ্ষটেশগার্ডেনের বাড়ি বের্গহকে গৃহকত্রীরূপে রাখেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে সে বাড়িতে এসে পৌঁছলেন এফা ব্রাউন। যা আকছারই হয়- ননদিনী-ঠাকুরঝির সঙ্গে লাগল কোদল। হিটলারের অন্যতম বন্ধু বলেন, এস্থলে আরও আকছারই যা হয় তাই হল। পুরুষমানুষ, তায় হিটলারের মতো কর্মব্যস্ত পুরুষ, এসব মেয়েলি কোঁদলে কিছুতেই প্রবেশ করে একটা ফৈসালা করে দিতে সম্পূর্ণ নারাজ। তিনি চুপ করে বসে যাত্রাগান দেখলেন–অবশ্য অতিশয় বিরক্তিভরে। শেষটায় দিদিই হার মানলেন। হিটলার-ভবন ত্যাগ করে মিউনিকে আপন একটি ছোট্ট বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। হিটলার এর পর তাকে আর কখনও তার নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেননি। তার কিছুদিন পর সৎদিদি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। হিটলার এটাতে ভয়ঙ্কর চটে যান। কেন, তা জানা যায়নি। বিবাহ-উৎসবে উপস্থিত তো হলেনই না, সামান্য একটি প্রেজেন্টও পাঠালেন না। উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র চিরতরে সম্পূর্ণ ছিন্ন হল।
হিটলারের আপন মায়ের পেটের একটি সুন্দরী বোনও ছিল। তাঁকেও তিনি একবার তার বাড়ি বের্গহকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি ওই বাড়ির আরাম-আয়েসে এতই সুখ পেলেন যে, কাটালেন মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘকাল। হিটলার বিরক্ত হলেন এবং শেষ পর্যন্ত বোনের বিদায় নেওয়ার পর তাকে আর কখনও নিমন্ত্রণ জানাননি। এ নদীর সঙ্গে এফা ব্রাউনের কলহ হয়েছিল কি না সে বিষয়ে ঐতিহাসিকরা নীরব। ভাইবোন বলতে ইনিই হিটলারের একমাত্র মায়ের পেটের বোন। তার বিখ্যাত ভ্রাতা আডলফ হিটলারের মৃত্যুর পরও অবহেলিত এই বোন কয়েক বৎসর বেঁচে ছিলেন।
এই আপন বোন ও পূর্বে বর্ণিত সেই সংদিদি ছাড়া হিটলারের ছিলেন একটি বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, ওই সংদিদির বড় ভাই। নানা দেশে বহু কর্মকীর্তি করার পর ইনি এলেন বার্লিনে তাঁর সৎভাই জনির কর্ণধার হয়েছেন খবর শুনে। নাৎসি পার্টির দু-একজনকে চিনতেন বলে তাদের কৃপায় পারমিট জোগাড় করে খুললেন বার্লিনের উপকণ্ঠে একটা মদের দোকান বার। পার্টি-মেম্বাররা সেখানে যেতেন তো বটেই, তদুপরি বিশেষ করে সেখানে হুল্লোড় লাগাতেন দুনিয়ার যত খবরের কাগজের রিপোর্টার। ওনাদের মতলব, হিটলারের বাল্যজীবন সম্বন্ধে তস্য অগ্রজ ভ্রাতার কাছ থেকে গোপন তথ্য, রসালো চুটকিলা সংগ্রহ করে আপন আপন কাগজে টকঝাল পরিবেশন করা।
কিন্তু ব্রাদার আলওয়া হিটলার ছিলেন ঝাণ্ডু শুঁড়ি। পাছে তার কোনও বেফাঁস কথা কনিষ্ঠ ফুরার আডলফের কানে পৌঁছে যায় এবং তিনি চটেমটে তার মদের দোকানের পারমিটটি নাকচ করে দেন সেই ভয়ে তিনি ফুরার সম্বন্ধে একটিমাত্র কথা বলতে রাজি হতেন না। অনুজ যে কারণে-অকারণে ফায়ার হয়ে যান সেটা বড় বেরাদার বিলক্ষণ জানতেন।…হিটলারও তার সম্বন্ধে কখনও কোনও কৌতূহল দেখাননি।
পূর্বেই বলেছি, হিটলারের দাদা-দিদি-বোনের সঙ্গে তার যে কোনওপ্রকারের সম্পর্ক ছিল না, সেটা দিদি-বোনের পাড়াপ্রতিবেশী সখাসখী সবাই জানতেন। তাঁরাও সেটা আর পাঁচজনকে বলতেন। আহা! ফুরার জর্মনির ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনই আকণ্ঠ নিমগ্ন যে তিনি তার আত্মীয়-স্বজন সম্বন্ধেও অচেতন। ক্রমে ক্রমে, গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসঙ্গমে, এ স্থলে জর্মনির নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে সংবাদটি রটে গেল, আবাল্য ব্রহ্মচারী জিতেন্দ্রিয় প্রভু হিটলার তার সব আত্মজনকে বিসর্জন দিয়ে একমাত্র জনির জন্য আত্ম-বিসর্জন দিচ্ছেন।
প্রপাগান্ডা মন্ত্রী গ্যোবেলস ঠিক এইটেই চাইছিলেন। তিনি সেই গুজবের দাবাগ্নিতে দিলেন ঘন ঘন কুলোর বাতাস। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক এ সত্য তত্ত্ব। বিশ্বজন আগের থেকেই জানত, হিটলারের জীবনধারণ পদ্ধতি ছিল চার্চিল এবং স্তালিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। চার্চিলের মুখে জাগ্রতাবস্থায় সর্বক্ষণ অ্যাখোটা সিগার এবং বেলা-অবেলায় এক পেট খাঁটি স্কচ হুইস্কি। স্তালিনের ঠোঁটেও তদ্বৎ- তবে সিগারের বদলে খাঁটি রাশান পাপিসি (সিগারেট) এবং স্কচের বদলে তিনি অষ্টপ্রহর পান করতেন, হুইস্কির চেয়েও কড়া মাল ভোদকা শরাব। দুজনই সর্ববিধ গোশত গব গব করে গিলতেন। পক্ষান্তরে হিটলার ধূম্র এবং মদ্যপান করতেন না এবং তিনি ছিলেন ভেজিটারিয়ান। কাজেই তাকে জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারীরূপে বিশ্বজনের সম্মুখে তুলে ধরতে ড. গ্যোবেলুসের কল্পনার আশ্রয় অত্যধিক নিতে হয়নি।
হিটলারের মৃত্যুসংবাদ জর্মন জনগণকে যে শক দিয়েছিল, তার পর তারা যে মোক্ষমতর শ পেল তার সঙ্গে এটার কোনও তুলনাই হয় না।
যুদ্ধ-শেষে কয়েকদিন পর (মে ১৯৪৫) যে রুশ সেনাপতি জুকফ বার্লিন অধিকার করে তিনি প্রচার করলেন, আত্মহত্যা করবার পূর্বে হিটলার তার এক রক্ষিতাকে বিয়ে করেন।
সর্বনাশ! বলে কী! সেই জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী যিনি
দারাপুত্র পরিবার
কে তোমার তুমি কার?
কিংবা কা তব কান্তা কত্তে পুত্রঃ ধ্যানমন্ত্রস্বরূপ গ্রহণ করে সুদীর্ঘ পঞ্চবিংশ বৎসর জর্মনির জন্য বিদ্রি ত্রিযামা যামিনী যাপন করলেন তিনি কি না শেষ মুহূর্তে ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্যবশত ধর্মচ্যুত হয়ে বিবাহ করলেন একটা রক্ষিতাকে! এ যে মস্তকে সর্পদংশন।
আজ যদি শুনতে পাই (এবং এটা অসম্ভব তথা আমি মাপ চেয়ে নিয়ে বলছি) যে ডিউক অব উইনজার তার দয়িতার সঙ্গে পরিপূর্ণ মিলনার্থে অবহেলে ইংলন্ডের সিংহাসন ত্যাগ করেন, তিনি তার সেই বিবাহিতা পত্নীকে ত্যাগ করে প্যারিসের কোনও গণিকালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তবে কি সেটা পয়লা ধাক্কাতেই বিশ্বাস করব।
জর্মনির জনসাধারণ প্রথমটা এ সংবাদ বিশ্বাস করতে চায়নি।
কিন্তু ব্যাপারটা তখন দাঁড়িয়েছে এই; যতক্ষণ ম্যাজিশিয়ান তার ভানুমতি খেল দেখায় ততক্ষণ দর্শক বেবাক নির্বাক হয়ে তাই দেবে, কিন্তু যে মুহূর্তে বাজিকর গুড নাইট বলে অন্তর্ধান করে তনুহূর্তেই আরম্ভ হয় বিপুল কলরব। কী করে এটা সম্ভব হল, কী করে এটা সম্ভব হল?–তাই নিয়ে তুমুল বাক-বিতণ্ডা! এবং দু-একটি লোক যারা ম্যাজিকের সঙ্গে কিছু কিছু পরিচিত তারা অল্পবিস্তর পাকা সমাধানও তখন দেয়।
এ স্থলেও তাই হল। হিটলার ম্যাজিশিয়ান যখন তার শেষ খেল দেখিয়ে ইহলোক থেকে অন্তর্ধান করলেন তখন আরম্ভ হল তুমুলতর অট্টরোল। এবং এ স্থলেও যারা হিটলারের অন্তরঙ্গজন– হিটলারি ম্যাজিকের অর্থাৎ এফা ব্রাউনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানতেন– তারা এ বাবদে ঈষৎ ছিটেফোঁটা ছাড়তে আরম্ভ করলেন। এঁদের কাহিনী অবিশ্বাস করার উপায় ছিল না।
ইতোমধ্যে হিটলারের খাস চিকিৎসক ডাক্তার মরুল ধরা পড়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বলেন সেটা আমাদের ভাষায় বলতে গেলে, হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ- এফা ব্রাউন আর হিটলার একসঙ্গে বাস করতেন বইকি — হেঁ হেঁ হেঁ হে– এবং কিছু একটা হতে হয়তো–হেঁ হেঁ হেঁ হে।
এ সময়ে হিটলারের উইল দলিলটি আবিষ্কৃত হয়। এটি তিনি তার বিবাহের পরমুহূর্তেই ডিকটেট করে টাইপ করান এবং আপন স্বাক্ষর দেন। তাতে অন্যান্য বক্তব্যের ভিতর আছে;
যদ্যপি আমার সংগ্রামের সময় বিবাহ এবং তজ্জনিত দায়িত্ব গ্রহণ করার মতো আস্থা আমার ছিল না, তথাপি এখন, আমার মৃত্যুর পূর্বে আমি মনস্থির করে একটি রমণীকে বিবাহ করছি। আমাদের ভিতর ছিল বহু বৎসরের বন্ধুত্ব (ফ্রেন্ডশিপ = জনে ফ্রয়েন্টশফট) এবং বার্লিন যখন চতুর্দিক থেকে শত্রুসৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত তখন তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় আমার অদৃষ্টের অংশীদার হবার জন্য এখানে এসেছেন। তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় আমার স্ত্রীরূপে আমার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবেন। আমি জনসেবায় নিয়োজিত ছিলুম বলে যে ক্ষতি হয়েছিল (অর্থাৎ একে অন্যের সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলুম–অনুবাদ) তার ক্ষতিপূরণ এর দ্বারা হবে। (১)
এই এফা ব্রাউন রমণীটি কে?
আমি ইতোপূর্বে হিটলারের শেষ দশ দিবস তথা হিটলারের প্রেম সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লেখার সময় উল্লেখ করি যে আমার জানামতে হিটলার তার জীবনে সবসুদ্ধ ১/২+১ + ১/২ = দুইবার ভালোবেসেছিলেন। প্রথম হাফ প্রেমকে ইংরেজিতে কাফ লাভ বলে। বাছুরের মতো ড্যাবডেবে চোখে দয়িতার দিকে তাকানো আর উদভ্রান্ত প্রেমের মতো গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা বাঙাল দেশে যাকে বলে ঝুলে মরা। কারণ হিটলার তার হৃদয়েশ্বরীর সঙ্গে কখনও সাহসভরে আলাপচারী তো করেনইনি, এমনকি চিঠিপত্রও লেখেননি। হিটলার তখন ইংরেজিতে যাকে বলে টিনএজার। এ প্রেমটাকে সত্যকার রোমান্টিক পুতনিক প্রেম বলা যেতে পারে।
এর প্রায় বাইশ বৎসর পরে, যৌবনে, হিটলার পুরো-পাক্কা ভালোবেসেছিলেন গেলি রাউবাল নামক এক কিশোরীকে। এটিকে আমি পুরো এক নম্বর দিয়ে পূর্বোল্লিখিত হিটলারের প্রেম প্রবন্ধ রচনা করি। এটি স্থান পেয়েছে মল্লিখিত রাজা উজির পুস্তকে। এ অধম পারতপক্ষে কাউকে কখনও আমার নিজের লেখা পড়ার সলা-উপদেশ দেয় না, তবে যারা রগরগে রোমান্টিক প্রেমের গল্প ছাড়া অন্য রচনা পড়তে পারেন না, তারা এটি পড়ে দেখতে পারেন।
এই কিশোরী আত্মহত্যা করেন। হিটলারও হয়তো সেই শোকে আত্মহত্যা করতেন যদি না তার কতিপয় অন্তরঙ্গ বন্ধু–তার ফটোগ্রাফার বন্ধু, হমান প্রধানত যদি তাকে শব্দার্থে তিন দিন তিন রাত্রি চোখে চোখে রাখতেন।
এই দুটি—১/২+১ প্রেম হয়ে যাওয়ার পর হিটলার আরেক ১/২ প্রেমে পড়েন জীবনে শেষবারের মতো। এফা ব্রাউনের সঙ্গে। এটাকে আমি হাফ প্রেম বলছি এই কারণে যে, আজ পর্যন্ত উভয়ের কোনও অন্তরঙ্গজনই এদের ভিতর সঠিক কী সম্পর্ক ছিল সেটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেননি। একা ছিলেন অতিশয় নীতিনিষ্ঠ মধ্যবিত্ত ভদ্রঘরের কুমারী। হিটলার ভিন্ন অন্য কোনও পুরুষের প্রতি তিনি কদাচ আকৃষ্ট হননি। যে রমণী তার দয়িতের সঙ্গে সহমরণ বরণ করার জন্য স্বেচ্ছায় শক্ৰবেষ্টিত পুরীতে প্রবেশ করে, তাকে রক্ষিতা আখ্যা দিলে নিশ্চয়ই তার প্রতি অবিচার করা হয়।
পক্ষান্তরে এ তত্ত্বটিও নিষ্ঠুর সত্য যে, হিটলার সুদীর্ঘ বারো বৎসর ধরে একাকে বিয়ে করতে রাজি হননি। তিনি অবশ্য তার জন্য একাধিক যুক্তি দেখিয়েছিলেন। সেগুলো বিশ্বাস করা-না-করা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও রুচির ওপর নির্ভর করে। আমার মনে হয় তার সবকটা ভুয়ো নয়। এবং হিটলার সর্বদাই এ জাতীয় আলোচনার সর্বশেষে মধুরেণ সমাপয়েত করে বলতেন, জর্মনি ইজ মাই ব্রাইড = জর্মনি আমার (জীবনমরণের) বধূ। এরই ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন, তার শেষ উইল-এ।
অতএব এফা না ছিলেন হিটলারের রক্ষিতা, না ছিলেন তার বিবাহিতা স্ত্রী। সর্ব ঐতিহাসিক তাই বলেছেন, এ মোস্ট আনডিফাইন্ড স্টেট অর্থাৎ এদের ভিতর ছিল এমন এক সম্বন্ধ যেটা কোনও সংজ্ঞার চৌহদ্দিতে পড়ে না।
হিটলারের সঙ্গে এফার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। বাঘা ঐতিহাসিক (যদ্যপি আমার বিচারে তিনি ট্রেভার রোপার, বুলক, নামিরের ইত্যাদির কাছেই আসতে পারেন না) শয়রার যার নাৎসিদের সম্বন্ধে বিরাট ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে নির্মিত একটা অতিশয় রসকষহীন ফিল ১৯৬৯-এর গোড়ার দিকে কলকাতা তক পৌঁছেছিল–ইনি বলছেন, যে গেলি রাউবালের সঙ্গে হিটলারের প্রণয় হয় তার আত্মহত্যার এক বা দুই বত্সর পর হিটলারের সঙ্গে এফা ব্রাউনের পরিচয় হয়। এ তথ্যটা সম্পূর্ণ বিশ্বাস্য নয়। কারণ একাধিক ঐতিহাসিক বলেন, আত্মহত্যা করার কয়েকদিন পূর্বে গেলি তার মামা (সম্পর্কে) হিটলারের স্যুট সাফসুরো করার সময় পকেটে হিটলারকে লিখিত এফা ব্রাউনের একখানা প্রেমপত্র পেয়ে যায়। গেলি আত্মহত্যা করার পর তার মা বলেন, এই চিঠিই গেলিকে আত্মহত্যার দিকে শেষ ঠেলা দেয়–অবশ্য একথা কারুর কাছেই অবিদিত ছিল না, গেলির মা এফাকে এমনই উৎকট ঘৃণা করতেন যে পারলে তার চোখদুটো ছোবল মেরে তুলে নিয়ে, রোস্ট করে তার প্যারা কুকুরকে খেতে দিতেন।
গেলি হয়তো চিঠিখানা পেয়েছিল কিন্তু সে-চিঠি যে তার হৃদয়ে কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল সে বিশ্বাস আমার হয় না। কারণ গেলিকে যিনি সবচেয়ে বেশি চিনতেন সেই হান বলেছেন, গেলি ভালোবাসত ভিয়েনাবাসী এক কলেজের ছোকরাকে, সে প্রকৃতপক্ষে কখনও তার মামার প্রেম নিবেদনের প্রতিদান দেয়নি। তদুপরি আরেকটি কথা আছে, হিটলার তখন গেলির প্রেমে অর্ধোদি। এফার সঙ্গে এমনি গতানুগতিক আলাপ হয়েছে। সে মজে গিয়ে হিটলারকে প্রেমপত্র লিখেছে- তরুণীরা আকছারই এরকম করে থাকে এবং হিটলার এ ধরনের চিঠি পেতেন গণ্ডায় গণ্ডায় এবং নিশ্চয়ই এফার এ চিঠি সিরিয়াসলি নেননি।
হিটলারের সঙ্গে এফার প্রথম পরিচয় হল হিটলার-সখা ফটোগ্রাফার হমানের স্টুডিয়োতে। মধ্যবিত্ত সমাজের কুমারী কন্যা যতখানি লেখাপড়া করে সেইটে সেরে তিনি হফমানের স্টুডিয়োতে অ্যাসিসটেন্টের কর্ম নেন। তার কাজ ছিল, খদ্দেরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা এবং ডার্করুমে কিছুটা সাহায্য করা। সেই সূত্রে হফমান নিতান্ত প্রফেশনালি হিটলারের সঙ্গে এফার আলাপ করিয়ে দেন।
হিটলারের কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটে ভিয়েনা নগরে। সে নগরের নাগরিকরা ডানসিং, ফ্লার্টিং, প্রণয়-মিলন, পরকীয়া শিভালরিতে অনায়াসে প্যারিসের সঙ্গে পাল্লা দেয়। হিটলারও রমণীসঙ্গ খুবই পছন্দ করতেন। জর্মনির সর্বময় কর্তা হওয়ার পর তিনি তার অন্তরঙ্গজনকে একাধিকবার গল্পচ্ছলে বলেছেন, এসব বড় বড় হোটেলের গাড়োলরা যে পুরুষ ওয়েটার রাখে, তার মতো ইডিয়টিক আর কী হতে পারে! এটা তো জলের মতো স্বচ্ছ যে, সুন্দরী যুবতী ওয়েট্রেস রাখলে ঢের ঢের বেশি খদ্দের জুটবে। আমার জীবনে ট্র্যাজেডি যে, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে যখন আমি কোনও স্টেট-ব্যাঙ্গুয়েটে বসি, আমাকে বাধ্য হয়ে ডাইনে এবং বায়ে বসাতে হয় দুই বুড়ি-হাড়িকে। কারণ তাদের স্বামীরা দুই বুড়ো-হাবড়া রাষ্ট্রমন্ত্রী বা ভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি … ওহ, সে কী গযন্ত্রণা। খুশ-এখতেয়ার থাকলে তার বদলে আমি যে কোনও অবস্থায় ছোট্ট একটি নাম-নাজানা রেস্তোরাঁয় একটি উঁকি ওয়েট্রেসের সঙ্গে মেয়েদের বেতন কম বলে কন্টিনেন্টে ছোট রেস্তোরাঁই শুধু ওয়েট্রেস রাখে) দু-দণ্ড বসালাপ করতে করতে না হয় সামান্য ডাল-ভাতই (ওদের ভাষায় দুই পদী খানা) খাব–জাহান্নামে যাক স্টেট ব্যাঙ্গুয়েটের বাহান্ন পদি কোর্মা-কালিয়া, বিরয়ানি-তন্দুরি (ওদের ভাষায় শ্যাম্পেন কাভিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি)।
তাই হিটলারের অ্যারোপ্লেনে রাখা হতো খাবসুরৎ হুরি, স্টুয়ার্ডেস। কিন্তু একথা সবাই বলেছেন, হিটলার উচ্ছল চরিত্রের লোক ছিলেন না।
এস্থলে নাগর পাঠককে সবিনয় নিবেদন করি, এফা ব্রাউন ছিলেন সত্য সত্যই চিত্তহারিণী অসাধারণ সুন্দরী। কিশোরী-যুবতীর সেই মধুর সঙ্গমস্থলে। কিন্তু এ-বেরসিক লেখক নারী-সৌন্দর্য বর্ণনে এযাবৎ বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি বলে নাগর রসিক পাঠককে এস্থলে সে রস থেকে সে বঞ্চিত করতে বাধ্য হল।
এফা সুন্দরী তো ছিলেনই তদুপরি স্টুডিয়োতে যেসব খানদানি বিত্তশালিণী তরুনী যুবতী ছবি তোলাতে আসতেন, এফা তাদের আচার-আচরণ থেকে অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে তাদের বেশভূষা এবং অলঙ্কারাদি।… পরবর্তীকালে যখন তার অর্থের কোনওই অভাব ছিল না তখনও তার বেশভূষাতে রুচিহীন আড়ম্বরাতিশয্য প্রকাশ পায়নি। তাঁর অর্থবৈভব শুধু একটি অলঙ্কারে প্রকাশ পেত। তার বাঁ হাতে বাঁধা থাকত মহার্ঘ বিরল হীরেতে বসানো একটি ছোট্ট রিস্টওয়াচ। জনির মতো দেশের ফুরার যদি প্রিয়াকে তার জন্মদিনে একটি হাতঘড়ি উপহার দেন, তবে সেটি কী প্রকারের হবে, সেটা কল্পনা করার ভার আমি বিত্তশালী পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি।
গোড়ার দিকে হিটলার এফাকে খুব বেশি একটা লক্ষ করেননি।
এদিকে গেলির মৃত্যুর পর হিটলারের জীবন বড়ই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল।
সখা হফমান তখন তার চিত্তবিনোদনের জন্য সুযোগ পেলে হিটলারের প্রিয় অবসর যাপন পদ্ধতি অবলখন করতেন। হিটলারকে নিয়ে যেতেন মিউনিকের আশপাশের হ্রদবনানীতে পিকনিকে। সঙ্গে থাকতেন হমানের স্ত্রী, ফটো স্টুডিয়োর দু-একজন কর্মচারী এবং এফা ব্রাউন।
ক্রমে ক্রমে হিটলার শ্রীমতী এফা ব্রাউনের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন।
এর পর দেখা গেল, হমান যদি পক্ষাধিককাল কোনও পিকনিকের ব্যবস্থা না করতেন তবে স্বয়ং হিটলার তার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়ে বলতেন, হেঁ হেঁ, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম, তাই আপনার এখানে ঢুঁ মারলুম। তার পর কিঞ্চিৎ ইতিউতি করে বলতেন, যা ভাবছিলাম… একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করতে হয়, আপনারা তো আছেনই, আর হে হেঁ, ওই ফ্রলাইন ব্রাউনকে সঙ্গে নিয়ে এলেও মন্দ হয় না–কী বলেন?
তখনও হিটলার এফার প্রেমে নিমজ্জিত হননি এবং কখনও হয়েছিলেন কি না, সে-বাবদে আমার মনে গভীর সন্দেহ আছে। পরবর্তী কাহিনী পড়ে সুচতুর অন্তত আমার চেয়ে চতুর– পাঠক-পাঠিকা প্রেম বাবদে আপন আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত কূটবুদ্ধি দ্বারা আপন আপন সুচিন্তিত এবংকিংবা সহৃদয় অভিমত নির্মাণ করে নিতে পারবেন।
ইতোমধ্যে কিন্তু শ্রীমতী এফা হিটলার প্রেমের অতলান্ত সমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতরে বিলীন হচ্ছেন। আর হবেনই-না কেন? যদ্যপি হিটলার তখনও রাষ্ট্রনেতা হননি, তথাপি তাবৎ জর্মনির সবাই তখন জানত, রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ যে কোনও দিন তাকে ডেকে বলবেন প্রধানমন্ত্রীরূপে দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে। তদুপরি, পূর্বেই বলেছি, হিটলার ছিলেন রমণীচিত্তহরণের যাবতীয় কলাকৌশলে রপ্ত।… এবং সর্বোপরি তিনি প্রায়ই অবরোবরে এফাকে দিতেন ছোটখাটো প্রেজেন্ট। বিত্তশালীজন তার দয়িতাকে যেরকম দামি দামি ফার কোট, মোটরগাড়ি দেয়, সেরকম আদৌ ছিল না–তিনি দিতেন চকলেট, ফুল বা ভ্যানিটি কেস (আমাগো রাষ্ট্রভাষায় যারে কয় ফুটানি কি ডিবিয়া)।
সব ঐতিহাসিক বলেছেন, এফা ছিলেন রাদার এমৃটি-হেডেড অর্থাৎ সরলা বুদ্ধিহীনা। কিন্তু তাতে কী এসে-যায়? অম্মদেশীয় এক বৃদ্ধ চাটুয্যে মহারাজকে জনৈক অর্বাচীন শুধিয়েছিল প্রেমের খবর তিনি রাখেন কি, তিনি বৃদ্ধ, তার কটা দাঁত এখনও বাকি আছে? গোস্সাভরে তিনি যা বলেন তার মোন্দা– ওরে মূর্খ, প্রেম কি চিবিয়ে খাবার জিনিস যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস? প্রেম হয় হৃদয়ে। বিলকুল হক কথা। এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে পারতেন, প্রেম নামক আদিরসটি মস্তিষ্ক থেকে সঞ্চারিত হয় না।
তাই এফা ওইসব চকলেটাদি সওগাত বান্ধবী, সহকর্মীদের ফলাও করে দেখাত, পিকনিকের বর্ণনা ফলাওতর করে সবিস্তর বাখানিত এবং ভাবখানা এমন করত যে, হিটলার তার প্রেমে রীতিমতো ডগোমগোজরোজরোমরোমরো।
এস্থলে ইয়োরোপীয় সরল কুমারীরা যা সর্বত্রই করে থাকে এবং অধুনা কলকাতা-ঢাকাতে তাই হচ্ছে) একা তাই করলেন। নির্জনে একে অন্যে যখন দুই দুহ, কুহু কুহু তখন আশকথা-পাশকথার মাঝখান দিয়ে যেমন টেবিলের ফুলদানির দেখা-না-দেখার ফুলের মাঝখান দিয়ে জনে একে বলে প্রু দ্য ফ্লাওয়ারস- বিবাহ নামক সেই প্রাচীন সনাতন প্রতিষ্ঠানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা দিলেন। নিশ্চয়ই একাধিকবার।
পূর্বেই বলেছি, হিটলার কিন্তু পৈতে চুয়ে কসম খেয়ে বসে আছেন, বিবাহবন্ধন নামক উদ্বন্ধনে তিনি কাট্যা ফালাইলেও দোদুল্যমান হতে নিতান্তই অনিচ্ছক। এবং ঝাৎ ডিপ্লোমেট এই অস্বস্তিকর বাক্যালাপ কী করে এড়াতে হয়, সেটা খুব ভালো করেই জানতেন।
এটা বুঝতে সরলা, নীতিশীল পরিবারে পালিতা এফার একটু সময় লেগেছিল। ইতোমধ্যে তার রক্ষণশীল পিতামাতা এফার সঙ্গে হিটলারের ঢলাঢলির খবর পেয়ে গিয়েছে। তারা মেয়েকে বুঝিয়ে দিলেন হয় হিটলার তোমাকে বিয়ে করুক, নয় তুমি তার সঙ্গ ত্যাগ কর।
পিতামাতার প্রতি বিঘ্ৰা এই কুমারী তখন কী করে?
হঠাৎ ওই সময়ে একদিন হফমান সখা হিটলারকে টেলিফোন করলেন যদুর সম্ভব তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি চলে আসুন।
হিটলার : কেন, কী হয়েছে?
হফমান : আসুন না, সবকথা এখানে হবে। হফমান এবং হিটলার দুজনেই জানতেন তাদের টেলিফোনের কথাবার্তা পুলিশ ট্যাপ করে।
হিটলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হমানের ফ্ল্যাটে পৌঁছলেন। শুধোলেন, কী হয়েছে ব্যাপার কী?
হফমান : বড় সিরিয়াস। এফা পিস্তল দিয়ে বুকে গুলি মেরে আত্মহত্যা করার চেষ্টা নেয়। তাকে অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়–
বিদুৎস্পৃষ্টের ন্যায় হিটলার বাধা দিয়ে বললেন, কিন্তু জানাজানি হয়নি তো- তা হলেই তো সর্বনাশ!
এস্থলে লক্ষণীয় যে, হিটলার দুঃসংবাদ পাওয়ামাত্রই সর্বপ্রথম নিজের স্বার্থের কথাই ভেবেছেন। তার পার্টি এবং বিশেষ করে গ্যোবেলস সাধারণ্যে তার যে ইমেজ গড়ে তুলছিলেন, সেটা জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারীর। এখন যদি তার দুশমন কম্যুনিস্টরা জেনে যায় যে, তিনি গোপনে একটা মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করতেন এবং সেই সরলা কুমারী যখন যুক্তিসঙ্গত নীতিসম্মত পদ্ধতিতে হিটলারকে সেই ভাব-ভালোবাসার অন্তে যে প্রতিষ্ঠান থাকে, অর্থাৎ বিবাহ, সেটা প্রস্তাব করে তখন তিনি ধড়িবাজ, কাপুরুষ, বেইমানের মতো মেয়েটাকে ধাপ্পা মারেন, এবং ফলে ভগ্নহৃদয় কুমারী আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তবেই তো চিত্তির! যে নাৎসি পার্টির নেতা এরকম একটা পিশে সে পার্টির কী মূল্য এই বেইমান পার্টিতে আস্থা রাখবে কোন দ্ৰ ইমানদার জর্মন এবং তুললে চলবে না, মাত্র বছর দুই পূর্বে গেলি রাউলও আত্মহত্যা করে। যদিও সে সময় কম্যুনিস্টরা সেই সুবর্ণ সুযোগের সিকি পরিমাণ ফায়দাও ওঠাতে পারেনি, অর্থাৎ একসপ্লয়েট করতে পারেনি।
কিন্তু মাভৈঃ! কন্দর্প নির্মিত এসব সংকটে প্রায়শ তিনি বিধাতার ন্যায়নীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রেমিক-প্রেমিকার তাবৎ মুশকিল আসান করে দেন।
হফমান সঙ্গে সঙ্গে হিটলার তথা নাৎসি পার্টির জীবনমরণ সমস্যা সমাধান করে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন। জানাজানি হয়নি। কারণ এফাকে অচৈতন্য অবস্থায় যে সার্জনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তিনি আমার নিকট-আত্মীয়। তাকে এমনভাবে কড়া পাহারায় রেখেছেন যে, পুলিশ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছতে পারেনি। তিনি স্বয়ং আমাকে খবরটা জানিয়েছেন।
তখন, এই প্রথম হিটলার প্রেয়সীর অবস্থা সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। না– ফাড়াকেটে গিয়েছে, তবে এফা রক্তক্ষরণহেতু বড়ই দুর্বল।
শুধু এফার ফাঁড়া কেটে গেল তাই নয়, স্বয়ং হিটলার এবং নাৎসি পার্টিরও ফাড়া কেটে গেল। অবশ্য কিছুটা কানাঘুষো হয়েছিল, কিন্তু জানাজানি হয়নি।
ব্যক্তিগত সম্পর্কে হিটলার যে খুবএকটা নেমকহারাম ছিলেন তা নয়। এই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা থেকে হিটলার বুঝে গেলেন এফার প্রেম কতখানি গভীরবতার ব্রেন-বায়ে কিছু থাক আর না-ই থাক, তার গলা থেকে নাভিকুণ্ডলী অবধি জুড়ে বসে আছে একটা বিরাট যুদয় সেখানে না আছে ফুসফুল, না আছে লিভার সৃপ্লিন কিডনি না আছে অন্য কোনও যন্ত্রপাতি।
এ হেন হৃদয়কে তো অবহেলা করা যায় না।
এতদিন হিটলার যে প্রেম করতেন এফার সঙ্গে সেটার পদ্ধতি ছিল মোটামুটি জন কলেজ-স্টুডেন্টরা তাদের বান্ধবীর (ফ্রয়েভিন–গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে যেভাবে করে থাকে। অর্থাৎ সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর একা তার নাইটগাউন ইত্যাদি রাত্রের পোশাক একটি অতি ছোট্ট সুটকেসে পুরে চুপিসাড়ে ঢুকতেন হিটলারের ফ্ল্যাট বাড়িতে। বাড়ির পাঁচজন জেগে ওঠার পূর্বেই, ভোরবেলা, ফের চুপিসাড়ে চলে যেতেন আপন ফ্ল্যাটে।
এবার হিটলার করলেন ভিন্ন ব্যবস্থা। ততদিনে তিনি রীতিমতো বিত্তশালী হয়ে গিয়েছেন। হিটলারের আপন কর্মস্থল মনিক শহরে তিনি এষার জন্য ছোট্ট একটি ভিলা, মোটর কিনে দিলেন এবং মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিলেন।
অর্থাৎ তিনি হিটলারের একমাত্র রক্ষিতা হিসেবে হিটলারমণ্ডলীতে আসন পেলেন। এস্থলে রক্ষিতা বলাটা হয়তো ঠিক হল না। কারণ ইয়োরোপের প্রায়ই অনেকে কয়েক বৎসর পরে এই রক্ষিতাকে বিয়ে করে তাকে সমাজে তুলে নেন। এবং সমাজপতিরাও বধূর অতীত সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন তোলেন না। আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই : এদেশে যদি বিয়ের তিন-চার মাস পর কোনও রমণী বাচ্চা প্রসব করে, তবে হইচই পড়ে যায়। ইয়োরোপে আদৌ না। আমার যতদূর জানা গির্জা পর্যন্ত কোনও প্রশ্ন না তুলে বাচ্চাটাকে ব্যাপ্টিস্ট করে তাকে ধৰ্মত সমাজে তুলে নেয়।
অবশ্য হিটলার সমস্ত ব্যবস্থাটা করলেন অতিশয় গোপনে। পূর্বেই বলেছি, তার এবং এফার চাকর মেড় তথা অতিশয় অন্তরঙ্গজন হাড়ে-মাসে জানতেন তারা যদি এই প্রণয়লীলা নিয়ে সামান্যতম আলোচনা করেন–বাইরের লোককে খবরটা জানাবার তো কথাই ওঠে না তা হলে তিনি পার্টির জব্বর পাণ্ডাই হন আর জমাদারণীই হোক, তাঁরা যে তদ্দশ্বেই পদচ্যুত বহিস্কৃত হবেন তাই নয়, কপালে গুম-খুনও অনিবার্য। কারণ হিটলার বহু বিষয়ে নির্মম। এদেশের কর্ণধার হওয়ার পূর্বে এবং পরেও হিটলার- হিলার বিস্তর গুম-খুন করিয়েছেন।
ওদিকে এফার যে ধার্মিক চরিত্ৰশীল জনক-জননী হিটলারের সঙ্গে তাদের কুমারী কন্যার অন্তরঙ্গতার কঠোর কঠিনতম প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তারাও এ ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিলেন। এটাকে প্রতিরোধ করলে একওয়ে মেয়ে যদি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে, এবং যদি সফল হয়ে যায়!
আমার দুঃখ শুদ্ধ-পাঠটি আমাদের মনে নেই : মোটামুটি যে মেয়ে–
মরণেরে করিয়াছে জীবনের প্রিয়।
কারও কোনও উপদেশ কান দিবে কি ও?
এফার নিতান্ত ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গজন ছাড়া আর সবাই বিশ্বাস করত, এফা ফটোগ্রাফ দোকানে কাজ করেন। তিনি হমানের স্টুডিয়োতে প্রতিদিন হাজিরা দিতেন।
.
এর কিছুদিন পরে ১৯৩৩-এর ৩০ জানুয়ারি হিটলার হয়ে গেলেন জর্মনির কর্ণধার– প্রধানমন্ত্রী চ্যানসেলার। তাকে তখন স্থায়ীভাবে বাস করতে হল বার্লিনে–্যুনিক পরিত্যাগ করে। এখন তিনি এফাকে নিয়ে পড়লেন বিপদে। এতদিন শুধু কম্যুনিস্টরাই তাদের আধা-পাকা গোয়েন্দাগিরি করেছে হিটলারের। এবারে জুটলো তাবৎ মার্কিন খবরের কাগজের দুদে দুদে রিপোর্টার পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক শায়রারও তাদেরই একজন। এদের চোখ দু-নলা বন্দুকের মতো গভীর অন্ধকারেও এক্স-রে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে জানে শিকারের দিকে। এবং কারও যে কোনও ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেসি থাকতে পারে সেটা তাদের শাস্ত্রে-আদৌ যদি তাদের কোনও শাস্ত্র থাকে লেখে না। পাঠক শুধু স্বরণে আনুন ইংল্যান্ডের রাজা যখন মিসেস সিমনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তখন সে কেচ্ছাকে তারা কী কেলেঙ্কারির রূপ দিয়ে দিনে দিনে রসিয়ে রসিয়ে মার্কিন কাগজে প্রকাশ করেছে। তার তুলনায় হিটলার কোন ছার! ব্যাটা আপস্টার্ট যুদ্ধের সময় ছিল নগণ্য করপোরেল– তার আবার প্রাইভেট লাইফ! সেটাকেও আবার রেহাই দিতে হবে! হোঃ!
কাজেই এফাকে বার্লিনে আনা অসম্ভব।
ফলস্বরূপ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এ হিটলারের আত্মহত্যা করা পর্যন্ত সুদীর্ঘ বারোটি বৎসর কবির ভাষায় নারীজীবনের শ্রেষ্ঠ দ্বাদশ বৎসর একা পেলেন আগের তুলনায় অল্পই, এবং ক্রমশ হ্রাসমান। তাই সহমরণের বহু আগে থেকেই একা একাধিক বন্ধুবান্ধবীকে বিষণ্ণকণ্ঠে বলেছেন, ১৯৩৩-এর জানুয়ারি (অর্থাৎ হিটলার যেদিন চ্যানসেলর হন) আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা নির্মম দিবস ট্র্যাজিক ডে, ট্রাগিশা টাখ।
যেদিন মিত্রপক্ষ ফ্রান্সে অবতরণ করে কালক্রমে জমনি জয় করে সেটাকে বলা হয় ডি-ডে (DDay)। সেটা ৬ জুন ১৯৪৪। ১৯৩৩-এর ৩০ জানুয়ারিতেই কিন্তু আরম্ভ হয় অভাগিনী এফার ডি-ডে। কিন্তু এসব কথা পরে হবে।
বার্লিনে কর্মব্যস্ত হিটলার অ্যানিকে আসার সুযোগ পেতেন কমই। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মনিকে ট্রাককল করে তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলাপ করে নিতেন। এবং টেলিফোন লাইনটি এমনভাবে নির্মিত ছিল যে, এফা-হিটলার কনেকশান হয়ে যাওয়া মাত্রই দুই প্রান্তের টেলিফোন অপারেটররা কিছুই শুনতে পেত না।… এবং যে স্থলে ট্রাকলের অষ্টপ্রহরব্যাপী এহেন সুবিধা সেখানে চিঠিচাপাটির বিশেষ প্রশ্ন ওঠে না– ওদিকে আবার চিঠিপত্র লেখার ব্যাপারে হিটলার ছিলেন হাড় আলসে। (জর্মনে স্টিভঙ্কেতের শ্রাইবফাউল দুর্গন্ধময় লেখন-আলসে)। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন আক্ষরিক অর্থে হিটলারের দম ফেলার ফুরসত নেই, ক্রমাগত একটার পর আরেকটা মিলিটারি কনফারেন্স হচ্ছে–তখন তিনি তার অন্তরঙ্গতম ভ্যালে লিঙেকে বলতেন, হে লিঙে, তুমি ঝপ করে একাকে দুটি লাইন লিখে দাও না। তখন প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায় হিটলারের কোনও-না-কোনও কর্মচারী প্লেনে করে মনিক যাচ্ছে। ঘন্টা তিনেকের ভিতর চিঠি এফার হস্তগত হত।
ভ্যালে বলতে ভৃত্যও বোঝায়। কাজেই পাঠক নিশ্চয়ই মর্মাহত হয়ে শুধাবেন, কী! চাকরদের দিয়ে প্রিয়ার উদ্দেশে চিঠি লেখানোর সৎ বেআদবি তো বটেই তার চেয়ে বটতলার সচিত্র প্রেমপত্র থেকে দু-পাতা কেটে নিয়ে খামে পাঠিয়ে দেওয়া ঢের ঢের বেশি শৃঙ্গাররসসম্মত! কিন্তু পাঠককে স্বরণ করিয়ে দিই- হিটলার, এফা ও ভ্যালে লিঙে তিনজনই ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। এমনকি লিঙের সামাজিক (রাজনীতির কথা হচ্ছেনা) প্রতিষ্ঠা ছিল হিটলারের চেয়ে উচ্চতর পর্যায়ের। তদুপরি, হিটলারের হাজার হাজার খাস সেনানীর (এস-এ) মাঝখান থেকে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লিঙেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং সেনাবাহিনীতে তিনি ছিলেন প্রায় কর্নেলের কাছাকাছি। এবং সর্বশেষ বক্তব্য, হিটলার মনিকে এলেও তার অধিকাংশ সময় কাটত রাষ্ট্রকার্যে। সে সময় ঘন্টার পর ঘন্টা এফাতে-লিঙেতে সময় কাটাতেন গালগল্প করে। এফা জানতেন, পুরুষদের ভিতর লিঙেই দশ-বারো বছর ধরে হিটলারের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং হিটলারও তার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতেন। একা মেয়েদের ভিতর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তিনী। অতএব দুজনার ভিতর একটা অন্তরঙ্গতা জমে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, একা এই লিঙেকে তার হৃদয়বেদনা যতখানি খুলে বলেছেন, অন্য আর কাউকে অতখানি বলেননি।(২)
অন্যত্র সবিস্তর লিখেছি, হিটলারের মৃত্যুর পর লিঙে শহন্তে বন্দি হন এবং দীর্ঘ বসর রুশ-কারাগারের দুঃসহ ক্লেশ সহ্য করার পর জর্মনিতে ফিরে এসে হিটলার সম্বন্ধে একখানি চটিবই লেখেন। এফা সম্বন্ধে কৌতূহলী পাঠক এই পুস্তিকায়ই তার সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে বিশ্বাস্য খবর পাবেন। হিটলার সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিবিন্দু থেকে, কিন্তু এফা সম্বন্ধে লিখেছেন বড়ই দরদ-ব্র ভাষায়। তিনি ইচ্ছে করলেই হিটলার-এফার সম্পর্ক সম্বন্ধে রগরগে মার্কিনি ভাষায় কেলেঙ্কারি কেচ্ছা লিখতে পারতেন– কোনও সন্দেহ নেই তিনি রুশ দেশ থেকে পশ্চিম জর্মনিতে ফেরা মাত্রই মার্কিন রিপোর্টাররা তাকে চেপে ধরে, অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হিটলার-এফার নব বিদ্যাসুন্দরের জন্য আপ্রাণ পাম্প করেছিল কিন্তু সেসময় বিশেষ কিছু তো বলেনইনি, পরেও পুস্তিকা রচনাকালে লিখেছেন যেটুকু নিতান্তই না লিখলে সত্য গোপন করে এফার প্রতি অবিচার করা হয়। এই অন্তর্নিহিত শালীনতাবোধ ছিল বলেই হিটলার ও এফা উভয়েই তাকে বন্ধুর চোখে দেখতেন। এটা এমন কিছু সৃষ্টিছাড়া আজগুবি ব্যাপার নয়। এ দেশের পাঠান দাসবংশের ইতিহাস যারা মন দিয়ে পড়েছেন, তারাই এর সত্যতার নজির সে ইতিহাসে পাবেন এবং লিঙে তো কিছু ক্রীতদাস নন!!
তাই এফাতে-লিঙেতে এমনিতেই চিঠিপত্র চলত। হিটলার সেটা জানতেন। তাই তিনি যে কাজকর্মে আকণ্ঠ নিমগ্ন, তিনি যে কোন করার জন্য মন্ত্রণাকক্ষ ত্যাগ করে পাঁচ মিনিটের তরেও আপন খাস কামরায় যেতে পারছেন না, এটা তার গাফিলতি নয়, বস্তুত তার এই অপারগতা সম্বন্ধে তিনি নিজেকে দোষী মনে করেন এসব কথা লিঙেকে গুছিয়ে লিখতে বলতেন।
হিটলার যে এফাকে কখনও বার্লিনে আসতে দিতেন না, তা নয়। অবশ্য অতিশয় কালেকশ্বিনে। জব্বর পার্টি-পরবের স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট না থাকলে অন্তরঙ্গজন তথা এফার সঙ্গে তিনি ডিনার-লাঞ্চে বসতেন। এফাকে তার বাঁ দিকের চেয়ারে বসাতেন। এফা ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না, তার পছন্দসই খানা তৈরি হয়েছে কি না তাই নিয়ে পুতুপুতু করতেন এবং সবাই বুঝতে পারত তিনি এষাকে সর্বাপেক্ষা বেশি সম্মান দেখাচ্ছেন। কিন্তু যেদিন স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট বা বাইরের লোক খানা খেতে আসত, সেদিন এফাকে উপরের তলায় হিটলারের চারজন মহিলা সেক্রেটারি ও তার খাদ্যরন্ধনের অধিকত্রীর(৩)সঙ্গে খানা খেতে হত। অবশ্য এ ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হল, যখন হিটলারের দফতরের এক উক্ত অফিসার, ফেগেলাইন বিয়ে করলেন এফার এক বোনকে। তখন হিটলার-সমাজের একটুখানি বৃহত্তর চক্রে এফাকে পরিচয় দেওয়া হত, সম্মানিত অফিসার ফেগেলাইনের শ্যালিকারূপে? মায়ের ছেলে নয়, শাড়ির মেয়ের বর!
বিরাট বিরাট লক্ষজন পরিপূর্ণ সভাতে, যেখানে হিটলার ওজস্বিনী বস্ত্রভাষিণী খাপ্তারি লেকচার ঝাড়বেন, সেখানে তাকে বিশেষ আসন দেওয়া হত না। তার এবং হিটলারের আর পাঁচজন কর্মচারীর সঙ্গে তিনি সবার সঙ্গে মিশে গিয়ে দয়িতের জনগণমনচিত্তহারিণী বক্তৃতা শুনতেন।
হায়! একে কী বলব বড় দুঃখে সুখ বা বড় সুখে দুঃখ? আমি এবাবদে মূর্খ–আবার বিদ, সম্মানিত সখা ব্রিাম এরকম একটা মোকা পেলে ঝপ করে একটা অকল্পনীয় পান করে খ করে একটা আরও অচিন্তনীয় সুমধুর সুভাষিত ম্যাক্সিম বানিয়ে ফেলতেন পুরো দেড় গণ্ডা শব্দ ব্যবহার না করেই। এই একটা ব্যাপারে লোকটা মখি-চো কস। অভিধানের শব্দভাণ্ডার যেন ব্যাঙ্কের ভল্টে লুকানো চিত্রতারকাদের সকলের না কারও-কার ইনকাম-ট্যাক্স অফিসারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শক সম্পদ।
আমি কিন্তু দেখছি, এর ট্রাজিক দিকটা। পিতামহ ভীষ্মের পরই যে বীরকে এ ভারত সর্বসম্মত স্বীকৃতি দিয়েছে তিনি একচক্রা ভদ্রোত্তম কমান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল কর্ণ। তিনি যখন কুরুপ্রাঙ্গণে শৌর্যবীর্য দেখাচ্ছেন, তখন মাতা কুন্তী তার প্রতি-সাফল্যে কি তার মাতৃগর্ব, মাতৃশ্লাঘা প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। শাস্ত্রোদ্ধৃতি দিতে পারব না, তবে বাল্যবয়সে আমার সংস্কৃত শিক্ষার প্রথম গুরু আমাকে সঙ্গোপনে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন, মাতা কুন্তীর সর্বাপেক্ষা প্রিয়সন্তান ছিলেন কর্ণ।
এফা ব্রাউনের ওই একই ট্র্যাজেডি। সর্বজনসমক্ষে তিনিও গাইতে পারেন না– বধু তুহরি গরবে গরবিণী হয়, রূপসী তুহরি রূপে।
অভিমানিনী পাঠিকা, তুমি হয়তো শুধোবে, এ হেন ভণ্ডামির অপমানজনক পরিস্থিতি একা মেনে নিলেন কেন? এর উত্তরে আমার নিজের কোনও মন্তব্য না দিয়ে শুধু নিবেদন :
চত্রাবলি কুঞ্জে গিয়ে
সারা নিশি কাটাইয়ে
প্রভাতে এসেছ, শ্যাম,
দিতে মনোবেদনা।
———-
১. বৈদিক যুগে আমাদের ভিতর সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল কি না, তার সমাধান এখনও হয়নি। এস্থলে লক্ষণীয়, হিটলার নিজেকে আর্য বলে শ্লাঘা অনুভব করতেন। তাই হয়তো প্রথমে কিছুটা আপত্তি জানানোর পর এই সতীদাহে সম্মত হন। পাঠক এ নিয়ে চিন্তা করতে পারেন।
২. এফার সঙ্গে লিঙের আরেকটা মিল আছে। বার্লিন যখন প্রায় চতুর্দিক থেকে বেতি, শেষ পরাজয় সুনিশ্চিত, কিন্তু পালাবার পথ তখনও ছিল, সে সময় হিটলার লিঙেকে ডেকে বলেন, তুমি আপন বাড়ি চলে যাও। লিঙে অসম্মতি জানান এবং সংক্ষেপে যা বলেন তার মোদ্দা : যাকে আমি এত বৎসর ধরে সেবা করেছি তাকে তার শেষ মুহূর্তে আমি ত্যাগ করতে পারব না। এবং সবাই জানেন, এফাও হিটলারের কড়া আদেশ সত্ত্বেও তাকে ত্যাগ করেননি।
৩. ইংরেজের বারির বামনাইয়ের দুটি চূড়ান্ত বেশরম, বেহায়া উদাহরণ পাঠক এস্থলে পাবেন। হিটলার নিরামিষাশী ছিলেন ও তদুপরি তাকে বিশেষ বিশেষ খাদ্য খেতে হত; অর্থাৎ তিনি ডায়েট খেতেন। সেসব বিষয়ে রান্না বড় বড় হোটেলের শেফ রাও স্বাধতে জানে না। তাই ডাক্তারদের আদেশে তাকে নিযুক্ত কতে হয় একটি অতিশয় উচ্চশিক্ষিতা মহিলাকে। ইনি সর্বোচ্চ সম্মানসহ এম.ডি. পাস করার পর বিশেষভাবে স্পেশালাইজ করেন কীভাবে বিশেষ বিশেষ খাদ্য দিয়ে রুগীকে সারানো যায়। (আমাদের কবিরাজ ঠাকুমা দিদিমারা যা করে থাকেন) এবং যারা শীতের দেশে নিরামিষাশী তাদের খাদ্য কীভাবে তৈরি করতে হয় যাতে করে মাছ-মাংসের অভাব পরিপূরণ করা যায়। ইংরেজ এই সম্ভ্রান্ত মহিলাকে বার বার কুক, পাচিকা, রাধুনী বানী, বাবুর্চি বলে তাচ্ছিল্যভরে উল্লেখ করে ব্যঙ্গপি করেছে। তিনি প্রায়ই এর সঙ্গে ডিনার বেতেন। ভাবটা এই, ছোট জাতের হিটলার আর রাধুনী, বাবুর্চি ছাড়া কার সঙ্গে হৃদ্যতা করবে! এবং সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ ইংরেজের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং মহিলার পাণ্ডিত্যের কথা বলতে বেবাক ভুলে যায়। এবং ভুলে যায় বলতে, মহিলাতে-হিটলারেতে খেতে খেতে মোচার ঘন্টে কতখানি গুড় দিতে হয় সে নিয়ে আলোচনা হত না। আলোচনা হত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান নিয়ে।… এবং পূর্বেই বলেছি, লিঙের শিক্ষাদীক্ষা পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে ঠিক এই উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্যালে চাকর নামে তাকে হীন করার চেষ্টা করেছে। …হিটলারের আদেশ সত্ত্বেও তিনি লিঙেই মতো হিটলারকে ত্যাগ করতে সম্মত হননি। আমার যতদূর জানা, তিনি বার্লিনে নিহত হন। প্রভুভক্তির ফলস্বরূপ।
সমুদ্র ঈগল বইটা চাই। অনুরোধ রইল বাংলা লাইব্রেরীর কাছে।
Very attractive