আন্ ফ্রাঙ্ক

আন্ ফ্রাঙ্ক

অনেকেই জিগ্যেস করেন, নাৎসি পার্টির কি কোনও গুণ ছিল না, তারা কি সুন্দুমাত্র পাপাচারই করেছেএর উত্তরে একটি ক্লাসিক্যাল নীতিবাক্য সংবলিত ছোট্ট কাহিনী মনে আসে। এক দরিদ্র গ্রাম্য পাদ্রি গিয়েছেন শহরে বিশপের সঙ্গে দেখা করতে, সকালবেলা বিশপ তার চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন, বেচারির পেটে তখনও কিছু পড়েনি। বাটলারকে হুকুম দিলে সে রুটি মাখন আর একটি ডিম-সেদ্ধ নিয়ে এল। পাদ্রি মৃদু আপত্তি জানিয়ে খেতে আরম্ভ করলে হঠাৎ বিশপের নাকে গেল পচা ডিমের গন্ধ। চশমার উপর দিকে অর্ধোনুক্ত পচা ডিম ও পাদ্রির দিকে যুগপৎ তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, আপনাকে একটা পচা ডিম দিয়েছে। পাদ্রি সাহেব তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে বললেন, না হুজুর না, ইট ইজ অলরাইট তার পর একটু থেমে বললেন, — অ্যাট প্লেসে অর্থাৎ কোনও কোনও জায়গায়।

তাই পাদ্রি সাহেবের ডিম বলতে বোঝায়, পৃথিবীতে কি এমন কোনও পচা ডিম পাওয়া যাবে, যার সর্বশেষ অণুটুকুও পচে গিয়েছে তেমন করে খুঁজলে অন্তত দু-একটি পরমাণু পাওয়া যাবে, যেগুলো সম্পূর্ণ পচে যায়নি।

নির্গলিতাৰ্থ : ইহভুবনে এমন কোনও ব্যক্তি, বস্তু, প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না যার ভিতর নেই কোনও গুণ, শুধু কপালে আগুন।

বস্তৃত হিটলার তথা নাৎসি পাটির অনেক গুণই ছিল, এবং আমার ব্যক্তিগত বিষাস, গত বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত শোন-মশানে পরিণত জর্মনি যে বছর-পাচেকের ভিতর আপন পায়ে দাঁড়াতে পারল, তার জন্য কিছুটা ধন্যবাদ পাবেন হিটলার ও তার নাৎসি পার্টি। সবদ্ধ হয়ে কঠোর তপস্যা দ্বারা কী প্রকারে একটা দেউলে দেশকে (১৯৩৩-এর জর্মনি) মাত্র পাঁচটি বৎসরের ভিতর পরিপূর্ণ শক্তিমান বিত্তবান করা যায় (১৯৩৮-এর জর্মনি) সেই ভানুমতীর খেল দেখিয়েছিলেন স্বয়ং হিটলার। সেই সঘবদ্ধ তপস্যালব্ধ চরিত্রবল বহুলাংশে প্রয়োগ করে যুদ্ধশেষে বিধ্বংসিত-জর্মনি পুনরায় শ্রী-সমৃদ্ধি লাভ করে।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভুললে চলবে না, নাৎসিরা পঞ্চাশ লক্ষ ইহুদিকে নিহত করে।

আবার তার পর এটা ভুলে গেলে আরও একটা মারাত্মক প্ৰম করা হবে যে, হিটলারের দৃষ্টান্ত থেকে বিশ্বমানবের মোশ্চম শিক্ষালাভ হয়ে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। বস্তুত রবের্গের মোকদ্দমার সময় যে-সেরা মার্কিন মনোসমীক্ষণবি, ডাক্তার কেলি প্রধান প্রধান আসামি গ্যোরিঙ, রিবেনট্রেপ, কাইটেল ইত্যাদির মনোসমীক্ষণ (সাইকো-অ্যানালেসিস) দীর্ঘকাল ধরে করেন, হিটলার সম্বন্ধে নানা দ্ব্যর্থহীন তত্ত্ব ও তথ্য এদের কাছ থেকে সগ্রহ করেন (আসামিদের সকলেই হিটলারকে বহু বৎসর ধরে অব্যবহিত অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন) এই ডাক্তার কেলি আপন সোনার দেশ, ইহলোকে গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভূ মার্কিন মুলুকে ফিরে গিয়ে প্রামাণিক পুস্তক মারফত বলেন, এই মার্কিন মুলুকেই যে কোনও দিন এক নয়া-হিটলার নয়া-তাণ্ডব নৃত্য নাচাতে পারে, নাচতে পারে।

কেলি তার পুস্তক প্রকাশ করেন সম্ভবত ১৯৪৭-৪৮-এ। তার পর দীর্ঘ একুশ বৎসর পরে, খবরের কাগজে পড়লুম, এক গণ্যমান্য মার্কিন অধ্যাপক অস্ট্রেলিয়াতে বক্তৃতা-প্রসঙ্গে বলেন, (কাটিং রাখিনি, মোদ্দাটা সাদামাটা ভাষায় বলছি) এখনও বিস্তর হিটলার রয়েছে; তারা সুযোগ পেলেই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।

এই মোক্ষম হক বাক্যটি আমরা যেন কখনও না ভুলি।

.

অনেকেই জিগ্যেস করেন, হিটলার কি শুধু ইহুদি এবং তার জর্মন-বৈরীদেরই (যেমন আমার সখা কার্ল, তথা কবীর-সখা ট্রটসু জলস) নির্যাতন করেছেন? দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে, শুধু তাই নয়। পোলিশ, চেকশ্লোভাক-বুদ্ধিজীবী, যুদ্ধে বন্দি রাশান অফিসার আরও বহুবিধ লোক তার দীর্ঘ হস্ত থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। এমনকি, কয়েক হাজার নিতান্ত নিরীহ বেদের পালও কনসানট্রেশন ক্যাম্পে, গ্যাস-চেম্বারে প্রাণ দেয়; কী-এক অজ্ঞাত অখ্যাত ককেশাস না কোন এক অঞ্চলে ধৃত এক অতিশয় ক্ষুদ্র উপজাতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তারা স্লাভ

আর্য? জর্মন তথা বিশ্বের সর্ব বিশ্বকোষ এদের সম্বন্ধে কোনও খবর দেয় না। শেষটায় হিটলারের খাস-প্যারা হিমলার-চিত্রপ্ত–যিনি কনসানট্রেশন-নরকের কার্ড ইনডেক্‌সিং-এর চিফ সেক্রেটারি–তিনি রায় দিলেন, আল্লায় মালুম কোন দলিলদস্তাবেজ বিদ্যাবুদ্ধির ওপর নির্ভর করে যে, এরা স্লাভ, অর্থাৎ নাৎসি ধর্মানুযায়ী, বেকসুর বধ্য। ওরা মরে। যুদ্ধ শেষে তাবৎ খবর পাওয়ার পর বিশ্বপণ্ডিতরা নাকি ফতোয়া দিয়েছেন এরা আর্যদেরই কোন এক নাম-না-জানা উপজাতি। এবং কেউ কেউ বলেন, এই উপজাতি সমূলে নির্বংশ হয়েছে, কেউ কেউ বলেন, না, দু-একটা উটকো হেথা-হোথা বেঁচে আছে এবং বংশরক্ষার জন্য বন্ধু খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি সঠিক জানিনে।

কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইহুদিরাই-সুদ্ধমাত্র ইহুদি পরিবারে জন্ম নেবার অপরাধ-এর ফলেই– প্রাণ দিয়ে খেসারত দেয় সর্বাধিক।

এ বাদে অন্যতম উল্কষ্ট দলিল সৌভাগ্যক্রমে বাংলা ভাষাতেই উকষ্টরূপে অনূদিত হয়েছে। একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের ইহুদি মেয়ের ডাইরি বা রোজনামচা। যুদ্ধের সময় লেখা। বাংলাতে বইখানির নাম আন্ ফ্রাঙ্কের ডায়ারি, অনুবাদক শ্রীঅরুণকুমার সরকার ও শ্রীলংশুকুমার চট্টোপাধ্যায়। আমি মেয়েটির রোজনামচা থেকে কিছুটা তুলে দিচ্ছি; পরে সুযোগ পেলে সবিস্তার আলোচনা হবে। ডাইরিকে উদ্দেশ্য করে মেয়েটি লিখছে–

শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ১৯৪২
আজ তোমাকে কেবল খারাপ খবর শোনাব। আমাদের ইহুদি বন্ধুদের দলে দলে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এইসব হতভাগ্য ইহুদিদের সাথে গেস্টাপো পুলিশ যে কী নির্দয় ব্যবহার করছে, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এদের গরু-ছাগলের গাড়িতে বোঝাই করে ড্রেন্টের (Drente) ওয়েস্টারবর্ক (Westerbark) বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওয়েস্টারবর্কের নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। একশো লোকের জন্য মাত্র একটি হাত-মুখ ধোবার কল। পায়খানা নেই বললেই চলে। স্ত্রী, পুরুষ ও শিত্তদের একই জায়গায় শোবার ব্যবস্থা। এর ফলে, ব্যাপকভাবে নরনারীর চরিত্রস্থলন হচ্ছে। বহুসংখ্যক স্ত্রীলোক, এমনকি অল্পবয়সী মেয়েরাও গর্ভবতী হয়ে পড়ছে।

বন্দিশালা থেকে পালানো অসম্ভব। বন্দিশালার অধিবাসীর মার্কা হিসেবে এদের সকলের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। খাস হল্যান্ডেই যখন এই অবস্থা তখন দূরদেশে স্থানান্তরিত করে এদের ওপর যে কী অমানুষিক অত্যাচার করা হচ্ছে, তা সহজেই কল্পনা করা যায়। আমাদের বিশ্বাস যে, তাদের অধিকাংশকে হত্যা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ রেডিও থেকে বলা হচ্ছে যে, তাদের গ্যাস দিয়ে মারা হচ্ছে।

বোধ করি, এইটিই হত্যা করার সবচেয়ে সহজ পন্থা। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি। মিয়েপের মুখে এইসব ভয়ঙ্কর গল্প শোনার সময়, আমার রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছিল, অথচ না শুনেও পারছিলাম না।

সম্প্রতি একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক তার বাড়ির দরজার সামনে বসে ছিল। হঠাৎ পুলিশের গাড়ি তার বাড়ির সামনে এসে থামল, আর গাড়ি থেকে গেস্টাপো পুলিশ নেমে তাকে হুকুম করল, গাড়িতে উঠে এস। পঙ্গু হতভাগিনী চলতে পারে না, কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে চাকার তলায় পড়ে গেল। জর্মনরা তার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে তাকে পিষে মেরে ফেলল।

জর্মনদের আর একরকম অত্যাচারের নাম হল প্রতিশোধমূলক হত্যা। ব্যাপারটা এইরকম নিরীহ নাগরিকদের জামিনস্বরূপ জেলে পুরে রাখা হয়। যখনই হল্যান্ডের কোথাও জর্মনদের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়, তখনই তার প্রতিশোধস্বরূপ, নির্দিষ্ট সংখ্যক লোককে জেল থেকে টেনে বের করে গুলি করা হয়। তার পর তাদের মৃত্যুসংবাদ কাগজে ছাপানো হয়। এই হল হিটলারতন্ত্রের আসল রূপ। এরা আবার নিজেদের আর্য বলে গর্ব করে।
—তোমারই আন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *