মরহুম অধ্যাপক ডক্টর আব্দুল হাই
(আল্লার পদপ্রান্তে)
এ লেখাটি আমাকে লিখতে হবে, এবং আজই লিখতে হবে। অথচ অন্তর্যামী জানেন, এটি লিখতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে আমার অক্ষম লেখনী কতখানি পর্যদস্ত হচ্ছে। ভাবাবেগে আমি এমনই মতিচ্ছন যে অনেক কিছু একসঙ্গে বলতে চাই, এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই বলতে পারি না।
সরল পাঠক ভাবে, সাহিত্যিকের ভাবনা কী? ভাষা তার আয়ত্তে, বেদনা হোক, আনন্দ হোক, সে সবকিছুই সহজ সরলতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারে। কথাটা ভুল নয়। কিন্তু এ বিষয়ে মাত্র একটি ব্যত্যয় আছে।
উপস্থিত আমার কথা ভুলে যান। সার্থক সাহিত্যিকদের কথাই বলব।
তার কল্পনারাজ্যে বিচরণ করে যুবক-যুবতীর মধ্যে বিরহ ঘটান, বিধবার একমাত্র শিশুপুত্রের মৃত্যু ঘটান এবং এগুলোর চেয়েও নিদারুণতর ট্র্যাজেডি নির্মাণ করেন। তার পর অতিশয় সহানুভূতিপূর্ণ স্পর্শকাতর হৃদয় দিয়ে বিরহকাতরা যুবতাঁকে, পুত্রহীনা বিধবাকে কখনও যুক্তি, কখনও অনুভূতির মারফতে সান্ত্বনা জানান।
এসব কল্পনারাজ্যের কথা।
কিন্তু যখন সার্ধক সাহিত্যিকের আপন জীবনে নিদারুণ শোক আসে তখন তিনি কী করেন। তখন তার অবস্থা হয় সত্যই শোচনীয়। একটি সামান্য দৃষ্টান্ত দিই। আমার চেয়ে অন্তত কুড়ি বছরের বড় জনৈক যশস্বী লেখক একদিন ঢুকলেন আমার ঘরে কাঁদতে কাঁদতে। আমি কোনওকিছু বলার পূর্বেই তিনি বললেন, ভাই আমার ছোট মেয়ে মাধবী কাল বিধবা হয়েছে। লক্ষ্ণৌ থেকে টেলিগ্রাম এসেছে। তুমি ভাই, আমার হয়ে একটা চিঠি লিখে দাও। আমি কী লিখব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি নে।
সেইদিনই আমি প্রথম বুঝতে পারলুম, ব্যক্তিগত বেদনায় সাহিত্যিক কী নিদারুণ অসহায়। অপরের বেদনা সে দূর থেকে দেখে কিছুদিন ধরে সেটাকে মনের ভিতর থিতোয় এবং বেশ কিছুদিন পর সেটাকে সাহিত্যরূপে প্রকাশ করে। কিন্তু নিজের বেলায় হায়, সে অসহায়। এবং সাধারণ অসাহিত্যিক জনের চেয়েও সে নিরুপায়। সাধারণ
অসাহিত্যিক-জন তখন বিধবা কন্যাকে সাদামাটা চিঠি লিখে সান্ত্বনা জানায়। মেয়েও সে চিঠি বুকে চেপে কাঁদে, সান্ত্বনা পায়।
কিন্তু সার্থক সাহিত্যিক? সে তো অনেক বেশি স্পর্শকাতর। এরকম সাদামাটা চিঠি সে তো লিখতে পারে না। তার তো সে অভ্যাস নেই।
সার্থক যশস্বী সাহিত্য-নির্মাতার যদি এই বিপাক হয়, তবে আমার মতো অতিশয় সাধারণ লেখকের কথা চিন্তা করুন।
আমি যে কী মতিচ্ছন্ন সেটি রচনারম্ভেই নিবেদন করেছি।
ভোরবেলা আমার এক চেলা ঘরে ঢুকল, আনন্দবাজার হাতে নিয়ে প্রায়ই আসে। আপন মনে খবরের কাগজ পড়ে।
আজ শুধোল, আপনি তো বাঙাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের জোর লড়নেওলা অধ্যাপক আব্দুল হাইকে আপনি চিনতেন?
আমি বললুম, চিনতুম মানে? এখনও চিনি। আমার চেয়ে বছর পনরো ছোট। তা হলে কী হয়! লোকটা অসাধারণ পণ্ডিত, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সাহিত্যরসে কী সুন্দর স্পর্শকাতরতা। তদুপরি, তুমি যা বললে, ভাষা আন্দোলনে জোর লড়নেওলা, আমার বন্ধু–
চেলা আমাকে আনন্দবাজার এগিয়ে দিল। তাতে দেখি আব্দুল হাইয়ের ছবি এবং নিচে লেখা :
ঢাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে ডক্টর হাই-এর মৃত্যু।
ভাষা ও ধ্বনিবিদ বলতে শেষ পর্যন্ত বিধাতার কৃপায় বেঁচে রইলেন পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মৌলানা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এরা উভয়েই পশ্চিম বাংলার কৃতী সন্তান।
দেশবিভাগের ফলে একজন রইলেন কলকাতায়, অন্যজন ঢাকায়। যেন গঙ্গার একভাগ জল এল ভাগীরথী দিয়ে, অন্য হিস্যার পানি চলে গেল পদ্ম দিয়ে পাকিস্তান। তার পর এই বাইশ বৎসর ধরে বিস্তর পানি জল(১) দুধারা দিয়ে বয়ে গেল।
ইতোমধ্যে শ্ৰীযুত চাটুয্যের ওপর নানাবিধ দায়িত্বপূর্ণ কাজের চাপ পড়ল। বয়সও হয়েছে। কাজেই তার প্রাণে যে কামনা ভাষাতত্ত্বের চর্চা– তার জন্য হাতে সময় থাকে অল্পই। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছি, শব্দতত্ত্বে জ্ঞানার্থীজনকে তিনি সদাসর্বদা পথনির্দেশ করে দেন। ভরতনাট্যেও বলে, একটা বিশেষ বয়সের পর তুমি আর নৃত্যগীত করবে না, তোমার শিষ্যশিষ্যাদের দেহ দিয়ে তোমার নৃত্যকলা দেখাবে।
ওদিকে, ওপারে ঘটল আরও মর্মন্তুদ ঘটনা। মৌলানা শহীদুল্লাহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বৎসর দুই পূর্বে আচম্বিতে শয্যা নিলেন(২)– বহু কাজ অসম্পূর্ণ রেখে। গত বৎসর যখন তাকে ঢাকা হাসপাতালে সেলাম দিতে যাই তখন তিনি আমাকে চিনতে পারলেন, অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে– যদ্যপি আমাদের পরিচয় গত অর্ধ শতাব্দী ধরে।
উভয় বাংলাতে আমরা সকলেই আশা করেছিলুম, আব্দুল হাই একদিন শহীদুল্লাহর আসন গ্রহণ করবেন। আমি কোনও সরকারি, বেসরকারি উচ্চপদের কথা ভাবছি না। আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল একদিন তার গবেষণা আরও বিস্তৃত সুপরিচিত হবে, তার পথনির্দেশ গৌড়জনকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।
কিস্মৎ কিস্মৎ –সবই কিস্মৎ! একটি সামান্য উদাহরণ দি :
হাই শব্দের অর্থ জীবন্ত প্রাণবন্ত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জাগ্রত ভগবান। আব্দুল হাই শব্দদ্বয়ের অর্থ ভাই জাগ্রত (জীবন্ত) ভগবানের (অনুগত) দাস।
যিনি তার নামকরণ করেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই আশা পোষণ করেছিলেন এ শিশু যেন অতি, অতিশয় দীর্ঘজীবী হয়।
সে চলে গেল পঞ্চাশে। যারা তাকে চিনতেন না, তারা হয়তো ভাবলেন, পঞ্চাশ তো খুব অল্প বয়স নয়। কিন্তু আমার মতো তাকে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ-পরিচয়ে সোনার সৌভাগ্য যাদেরই হয়েছিল তারাই শুধু জানেন পঞ্চাশেও এই লোকটি ছিলেন কী অসাধারণ প্রাণবন্ত (হাই,) বিদ্যাচর্চা রসগ্রহণে সদাজাগ্রত এমনকি মূর্তমান চাঞ্চল্য বললেও অত্যুক্তি হয় না– অবশ্য সদর্থে। এরা সকলেই একবাক্যে বলবেন, আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর মতো অকালমৃত্যু– এ শোক বিধাতা যেন দয়া করে আমাদের অত্যধিক না দেন।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অকালমৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ গভীর শোক প্রকাশ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যজীবনে যখন এক নবীন ভুবনে প্রবেশ করেছিলেন তখন তার মৃত্যু হয়। আব্দুল হাই যখন জ্ঞানান্বেষণে এক নতুন জগতের সম্মুখীন তখন তার মৃত্যু হল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের গুরু। আজ শুধু আব্দুল হাইয়ের শুরুই তার সম্বন্ধে সার্থক সর্বাঙ্গসুন্দর প্রশস্তি রচনা করতে পারবেন।
তাঁর শিষ্যসম্প্রদায়, আমি, আমরা শুধু আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে পারি।
আব্দুল হাইয়ের চরিত্রের একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য আমি এস্থলে নিবেদন করি। তার সঙ্গে পাণ্ডিত্যের বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই বলে হয়তো আব্দুল হাইয়ের চরিত্রের এ মহান্ দিকটা অধিকাংশের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। অতি সংক্ষেপে নিবেদন করি।
এ বঙ্গে আমাদের চেয়েও বেশি যদি আজ কেউ প্রিয়বিয়োগ-কাতর হয়ে থাকেন তবে তিনি যদিও আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তবু তার অবস্থার কিছুটা অনুমান করতে পারি– ডক্টর হরেন্দ্রচন্দ্র পাল, এম-এ (ট্রিপল) ডি-লিট (ক্যাল), রিপন, হুগলি মহসিন, কৃষ্ণনগর কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক। তিনি পূর্ববঙ্গের লোক, কিন্তু বহুকাল ধরে এদেশবাসী।
অধুনা তার একখানি অভিধান বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ– ডক্টর আব্দুল হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশ করেন। পূর্বতন পঞ্চতন্ত্র-এ আমি এ-গ্রন্থের উল্লেখ করেছি। কিন্তু আমার কথা থাক। এ অভিধান প্রকাশ করার সময় আব্দুল হাই একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা লেখেন। তার থেকে আমি কয়েকটি ছত্র তুলে দিচ্ছি।
হাই সাহেব ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে লিখছেন : কয়েক বছর পূর্বে ডক্টর সুকুমার সেন সাহিত্য পত্রিকায় (এ পত্রিকাটি অধ্যক্ষ আব্দুল হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমৃত্যু সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন) প্রকাশের জন্য ডক্টর হরেন্দ্রচন্দ্র পালের বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ সঙ্কলন নামে একটি প্রবন্ধ আমাকে পাঠিয়ে দেন। ডক্টর পালের এ প্রবন্ধটি আমি ১৯৬৮ সালের শীত সংখ্যা সাহিত্য পত্রিকায় সানন্দে প্রকাশ করি এবং যতদূর সম্ভব বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে অভিধান আকারে এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তাকে অনুরোধ জানাই।
ডক্টর পাল পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা পূর্ব পাকিস্তানে। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত ছিল কিন্তু অদৃষ্টচক্রে তিনি সীমান্তপারে বসবাস করছেন।(৩) তা হলেও তিনি মুসলিম জীবন ও সংস্কৃতিমূলক সাধনাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মধ্যযুগ থেকে এ কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার দেখিয়ে এ বিরাট সংকলন গ্রন্থটি প্রণয়ন করে ডক্টর পাল বাংলা-ভাষী সকলকে এবং বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে প্রথমে সাহিত্য পত্রিকায় ও পরে পুস্তকাকারে তার এ মূল্যবান গবেষণামূলক সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশ করে বাঙালি সুধী সমাজের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি আজ সত্যিই আনন্দিত।
মুহম্মদ আব্দুল হাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগ
আমি শুধু এইটুকুই নিবেদন করতে পেরেছিলুম, পণ্ডিত আব্দুল হাই নিজে, তত জ্ঞানচর্চা করেছেনই, কিন্তু তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি উৎসাহ দিয়েছেন অন্যজনকে শুধু পূর্ববঙ্গে নয়, এ বঙ্গেও।
আর, আজ যেসব যুবক জ্ঞানচর্চা গবেষণা করতে গিয়ে নানাবিধ অন্যায় অসত্য, মনুষ্যকৃত স্বার্থপ্রণোদিত নীচ-হীন প্রতিবন্ধকের সম্মুখে পদে পদে বিড়ম্বিত হচ্ছে তারা অন্তত এই ব্যত্যয়টি, উৎসাহদাতা আব্দুল হাইয়ের এই চরিত্রমূল্যটি মজ্জায় মজ্জায় অনুভব করবে। আমেন।
———–
১. জলপানি বললুম না, তার অর্থ ভিন্ন। বস্তুত আমি পানি শব্দের দুশমন নই। অতি অবশ্যই আমি জল-পাঁড়ে নামক কাল্পনিক সমাস ব্যবহার করব না। পক্ষান্তরে জজমের জল না বলে জমজমের পানি বলাই ভালো। গঙ্গা পানি কানে খারাপ শোনায়। কিন্তু সেও না হয় সয়ে নিলুম। মুশকিল হবে জলপানি নিয়ে। কেউ জলপানি পেলে সে কি পানি-পানি পায়? যদিও সে খুশিতে পানি পানি হতে পারে, তার জান ত-নৃ– হতে পারে।
২. তবে ইনি এখনও সম্পূর্ণ অচল নন। এবং তাঁর গুণগ্রাহী তথা শিষ্যজনকে সানন্দে জানাই তার তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছেন একটি তরুণ ডাক্তার চট্টগ্রামের চিরঞ্জীব বড়ুয়া। মানুষ বুঝি পিতাকেও অতখানি সেবা করে না।
৩. আব্দুল হাই মুর্শিদাবাদের লোক। অদৃষ্টচক্রে তাকেও সীমান্তপারে বসবাস করতে হল। তাই সমদুখীজনব্যথিতবেদন অনুভব করার মতো অভিজ্ঞতা ও স্পর্শকাতরতা ছিল। তার আপন দুঃখ তিনি ডক্টর পালের মারফত প্রকাশ করেছেন।