ব্রেন-ড্রেন
যারা এদেশে গবেষণা করার সুযোগ পান না, তাদের অনেকেই ইংলন্ডে চলে যান। আবার বিলিতি খবরের কাগজে প্রায়ই দেখতে পাবেন, সেখানেও ওই একই ব্যাপার; মেধাবী বৈজ্ঞানিক তার জুতো থেকে ইংলন্ডের ধুলো ঝেড়ে ফেলে মার্কিন মুলুকে চলে যায়। সেখানে বেশি মাইনে তো পাবেই, এবং তার চেয়েও বড় কথা, সেখানে গবেষণা করার জন্য পাবে আশাতিরিক্ত অর্থানুকুল্য। অধুনা গৌরীসেন মার্কিন সিটিজেনশিপ গ্রহণ করে সেখানেই ডলার ঢালেন।… জর্মন কাগজেও মাঝে মাঝে দেখতে পাই, ওদের তরুণ বৈজ্ঞানিকদেরও কিছু কিছু মার্কিন-মক্কায় চলে যাচ্ছে।
থাকি মফস্বলে। কলকাতায় পৌঁছলুম ল্যাটে। তবু দেখি, পাড়ায় ব্যতম রক পুরানা সায়েবের মার্কিন নাগরিকতা গ্রহণ নিয়ে সরগরম, মালুম হল, মতভেদ ক্ষুরস্য ধারার ন্যায় সুতীক্ষ্ণ। রকের পলিফে-বেঞ্চ বলছেন, যে-যেখানে কাজের সুযোগ পাবে, সে সেখানে যাবে বাংলা কথা। পক্ষান্তরে তালেবর-বেঞ্চ যুক্তিতর্কসহ সপ্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, পুরানা মহাশয়ের উচিত ছিল দেশে থেকে দেশের সেবা করা। এবং উচিত-অনুচিতের কথাই যখন উঠল তখন বলতে হবে এদেশের কর্তৃপক্ষই পয়লা নম্বরের আসামি। নিজেরা তো কিছু করবেনই না, যারা করতে চায় তাদেরও কিছু করতে দেবেন না। একেবারে উগ অ্যানড দি ম্যানেজার
তালেবর পক্ষেরই এক ব্যাক-বেঞ্চার ক্ষীণকণ্ঠে শুধোল, প্রবাদটা কি ডগ অ্যানড দি মেইনজার নয়?
আলবৎ নয়। এখন এরা সব ম্যানেজার।
এর পর কর্তাদের নিয়ে আরম্ভ হল কটুকাটব্য। আমি প্রাচীনযুগের লোক—-ডাইনে-বাঁয়ে চট করে একবার তাকিয়ে নিলুম। টেগার্ট সায়েবের প্রেতাত্মা আবার কোথাও পঞ্চভূত ধারণ করেননি তো!
খলিফে পক্ষের এক চাঁই মাথা দুলোতে দুলোতে বললেন, সেই কথাই তো হচ্ছে। কাজ করতেও দেবে না। তবে শোনো আমাদেরই এক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নীতি যদিও সেটা তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেন না ভিন্ন রাষ্ট্রের কাউকে আপন রাষ্ট্রে চাকরি দেবেন না। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও এক সাবজেক্টে ঝাড়া বিশটি বছর ধরে কেউ মাস্টার্স ডিগ্রিতে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। বুড়ো-হাবড়া অধ্যাপকরা রিটায়ার করতে চান না। এদিকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে কাউকে লেকচারার তক নেবেন না–যদি ফার্স্ট ক্লাসের হরিন্নাম তার সঙ্গে ছাপা না থাকে। এদিকে চন্দনের বাটিটি বিশটি বছর ধরে তারা ঝুলিয়ে লুকিয়ে রেখেছেন সযত্নে। শুধোলে অবশ্য বলেন, ঘোর কলিকাল মোশয়, ঘোর কলিকাল। পাষণ্ড, পাষণ্ড, পাষন্দ্রে পাল। অধ্যয়নে কি এদের কোনওপ্রকারের আসক্তি আছে? পড়েননি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থানের প্রতিবেদন–স্পষ্টাক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে ছাত্রসমাজে, বিশেষ করে ছাত্রসমাজে, মদ্যাদি সেবন দ্রুতগতিতে শনৈঃ শনৈঃ বর্ধমান!– এদের গায়ে কাটব হরিন্নামের ছাপ! মাথা খারাপ!
খলিফে পক্ষের আরেক খাজা বললেন, বিলক্ষণ! ভালুকের সব্বাঙ্গে লোম। এম-এর তেড়ি কাটবে কোথায়?
প্রথম চাঁই সোল্লাসে বললেন, বিলকুল! সে দেশের মোর পুত্রবৎ ছাত্রকে স্নাতকোত্তর করতে চায় না, সে দেবে তাকে রিসার্চ করতে! ওই আনন্দেই থাকো।
বলিফের খাজা বললেন, যথা, পিতার প্রেতাত্মা দাবড়ে বেড়াবেন বিশ্বময়, কিন্তু পুত্রকে দেবেন না– এস্তেক পিণ্ড-দাদনদানে–পি দিয়ে অশৌচ সমাপ্তি করতে।
তালেবর বেঞ্চ ঢিড খেয়ে যাবার খাবি খাচ্ছে দেখে তাদের এক ঝানু তখন ফিলিঙের শরণাপন্ন হলেন।
এস্থলে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে হয়। দরদ, সহানুভূতি, সমবেদনা, সহব্যথা, হৃদয়বেদনা এ শব্দগুলো বড়ই মোলায়েম মরমিয়া। অপিচ ফিলিঙ কথাটা ফ হরফে কট্টর জোর দিয়ে (অবশ্যই ইংরাজি F-এর মতো উচ্চারণ না করে) শব্দটা বললে তবেই না গভীর ভাবানুভূতির খানিকটে প্রকাশ পায়!(১)
সেই ফ উচ্চারণ করে ঝানু-তালেবর ভাবাবেগে বললেন pfi-লিঙ নেই, pfi-লিঙ নেই, সব ফলানা ফলানা খুরানাদের কারওরই ফিলিঙ নেই দেশের প্রতি। দেশে বসে কী রিসার্চ করা যায়–
কথা শেষ না হতেই খলিফে পক্ষের আরেক গুণীন মিনমিনিয়ে বললেন, নৌকোতে বসে কি গুন টানা যায় না!
ওই পক্ষের আরেক জাহাবাজ বললেন, কিংবা মাতৃগর্ভে শুয়ে শুয়ে দেশভ্রমণ!
.
এইবারে রকের বারোয়ারি মামা মুখ খুললেন। ইনি আমাদের রকের প্রেসিডেন্ট। এঁরই রকে আমরা দু-দণ্ড রসালাপ করি। কিন্তু ইনি থাকেন প্রাচীন দিনের একটি সোফাতে শুয়ে ঘরের ভিতরে। অনেকটা কবিগুরুর রাজা নাটকের রাজার মতো। অবরে-সবরে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু-একটি লবজো ছাড়েন।
বললেন, সেরকম নিষ্ঠা থাকলে কি দেশে থেকেই রিসার্চ করা যায় না? সেইটেই হচ্ছে মোদ্দা কথা।
বিজ্ঞানের বেলা অর্থাৎ এপ্লায়েড সায়েন্সের বেলা আজকাল বিস্তর যন্ত্রপাতি, মালমসলার প্রয়োজন। তার জন্য প্রচুর আয়োজন প্রচুরতর অর্থ না থাকলে এসব হয় না। অবশ্য, একথাও সত্য জগদীশচন্দ্র বসু, মার্কনি এবং আরও মেলা লোক এসব না থাকা সত্ত্বেও এন্তের কেরামতি দেখিয়ে গেছেন। কিন্তু সেসব দিন হয়তো গেছে। আজকের দিন স্বয়ং লেওনারদো দা ভিচিও সরকারি গৌরীসেনের সাহায্য ছাড়া এটম বম্ বানাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
কিন্তু পিওর সায়েন্স পিওর ফিজিক্স, ম্যামিটিক্স, আরও বিস্তর বিষয়বস্তু আছে যার জন্যে কোনওই যন্ত্রপাতি টাকা-পয়সার প্রয়োজন হয় না সেগুলোর বেলা কী? তা হলে শোন, একটা গল্প বলি, সত্যি-মিথ্যে জানিনে, বাবা! একদা কালিফনিয়ার এক বিরাট ইনস্টিটুটে বিরাটতর টেলিস্কোপ লাগানো উপলক্ষে মাদাম আইনস্টাইনকে নিমন্ত্রণ করা হয়। সরলা মাদাম সেই দানবপ্রমাণ যন্ত্রটা দেখে তো একেবারে স্তম্ভিত।
যেহোভার দোহাই! প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মাদাম : এ যন্তরটা লাগে কোন কাজে
বড় কর্তা হাত কচলাতে কচলাতে খুশিতে ফাটোফাটো হয়ে বললেন, মাদাম, এই যে বিরাট ব্রহ্মাণ্ড তার পরিপূর্ণ স্বরূপ (Gestalt) হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এটি অপরিহার্য। এ বাবদে আপনার স্বামী, আমাদের গুরুর অবদানও তত হেঁ, হে।
ঈষৎ ভ্রুকুঞ্চিত করে মাদাম বললেন, সে কী! আমার কর্তা তো ওয়েস্ট পেপার বাসকেট থেকে একটা পুরনো ধাম তুলে নিয়ে তার উল্টো পিঠে এসব করে থাকেন।
তবেই দেখ, হয়ও অনেক কিছুই যন্ত্রপাতি ছাড়াও।
কিন্তু এসব বাদ দাও এবং চিন্তা কর দর্শন, ন্যায়, ইতিহাস, প্রাচ্যতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, অলঙ্কার শব্দতত্ত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি এন্তের এন্তের সবজেক্ট রয়েছে যার জন্য কোনও ক্ষুদে গৌরীসেনেরও প্রয়োজন হয় না।
মামা দম নিয়ে বললেন, এবারে বাবা বল, তোমরা তো অনেক সবজেক্টে অনেক পাস দিয়েছ; গত তিরিশ বছরে এই পুণ্য বঙ্গভূমিতে কোন কোন মহাপ্রভুর দর্শন ইত্যাদি সবজেক্ট গবেষণার বিশল্যকরণী সমেত গন্ধমাদন উত্তোলন করে ভুবন তিখাতে হয়েছেন। বাঙালা দেশের কথা বিশেষ করে বলুন, কারণ একদা এদেশ হিন্দুস্থানের লিডার ছিল।
মামার চোখে-মুখে ব্যঙ্গভরা বেদনা।
এইবারে আমি মুখ খোলার একটু মোক পেয়ে বললুম, তা মামু-সায়েব-রিসার্চের জন্য কড়ি লাগুক আর না-ই লাগুক, যে লোকটা রিসার্চ করবে তার পেটে, তার সমাজের আর পাঁচজনের পেটে যদি দু মুঠো অন্ন না থাকে তবে কি রিসার্চ হয়? আজ এই কলকাতা শহরে আর সকলের পেটেই অন্ন আছে– নেই শুধু বাঙালির।
মামা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, যেন আপন মনে বিড়বিড় করে ১৮২০ থেকে ১৯২০। ওই সময়টায় কলকাতায় বাঙালি সচ্ছল ছিল। যা কিছু করেছে ওই সময়েই করেছে। আজকের দিনে দু-পাঁচটা প্রফেসরের দু-মুঠো অন্ন জোটে, একথা সত্যি। কিন্তু তার আর পাঁচটা ভাইবেরাদর, মোদ্দাকথা তার গোটা সমাজ (Gestalt) যদি নিরন্ন হয় তবে এই দু-পাঁচটা প্রফেসরও কোনওকিছু দেখার মতো করে উঠতে পারে না। সি-লেভেল থেকে আচমকা এভারেস্ট মাথা উঁচু করে খাড়া হয় না; তবে লেভেল অর্থাৎ তার সমাজ অনেকখানি উঁচু না হলে সে আকাশচুম্বী হবে কী করে?
আস্তে আস্তে মামা চোখ খুললেন। কড়া গলায় বললেন, ১৮২০ থেকে ১৯০০ কিংবা ১৯২০ পর্যন্ত কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্য– আর ওইটেই তো সমাজের সচ্ছলতা আনে– কাদের হাত থেকে কাদের হাতে গেল সেইটে একটু খুঁজে দেখ তো। হেসে বললেন, ওই নিয়ে একটা রিসার্চ কর না।
———-
১, অর্থাৎ প্রফুল্ল শব্দ আমরা যেভাবে উচ্চারণ করি সেভাবে নয়। মারওয়াড়িরা যেভাবে পর-ফু (pf) লু উচ্চারণ করেন তারই ফ।