বনে ভূত না মনে ভূত
আমাকে অনেকেই জিগ্যেস করেন, দেশ-বিদেশ তো অনেক ঘুরলেন, বয়সও হয়েছে, অতিপ্রাকৃত অলৌকিক কিছু দেখেছেন কি? সোজা বাংলায় ভূত, প্রেত, মামদো (মানুষ মরে ভূত হয় এটা ইসলাম অস্বীকার করে কিন্তু কোনও কোনও হিন্দুর বিশ্বাস অয়, অয় রনিতি পার না। মুহম্মদি মানুষ অর্থাৎ মুসলমান মরে গিয়ে মামদো হয়– মুহম্মদি শব্দ গ্রাম্য বাংলায় হয়ে গিয়েছে মামদো। এস্থলে Zনতি কথাটা ঠিক ঠিক ব্যবহৃত হয়েছে কারণ মামদো বলুন, ভূত বলুন, এনাদের তো চট করে চোখে দেখা যায় না– অতএব এনারা আছেন, ওনারাও আছেন, শুধু আমরা Zনতি পারি না এবং অন্যান্য বিভিন্ন জাতবেজাতের ভূতের কোনও একটা আমি দেখেছি কি না?
জর্মন ভাষায় দুটি শব্দ বাংলায় বেশ চালু হয়ে গিয়েছে। একটা কিন্ডারগার্টেন আরেকটা যদিও অতখানি চালু না– রিভারপেস্ট পশুচিকিত্সক মাত্রই চেনেন। আরেকটি শব্দ প্রচলিত হওয়ার বড়ই প্রয়োজন– পটারগাইস্ট। ভুতুড়ে বাড়িতে যে দমাদ্দম ইটপাটকেল এবং মাঝেমধ্যে কচুপাতায় মোড়া নোংরা বস্তুও বর্ষিত হয় সেটি করেন পন্টারগাই। পটার ক্রিয়ার অর্থ দুদ্দাড় দুমদাম শব্দ করা আর গাইষ্ট = ইংরিজি গোস্ট (ghost)।
এর থেকে আরেকটা তত্ত্ব সুস্পষ্ট হয়। ভূত-প্রেত সম্বন্ধে দেশ-বিদেশের যেখান থেকেই হোক না কেন, কোনও গুজব, জনরব– একুনে শুজোরব– পৌঁছনোমাত্রই সরল মানুষ সঙ্গে সঙ্গে সেটা বিশ্বাস করে ফেলে এবং সেই নয়া ভূতকে অবিচারে জাতে তুলে নেয়। ইংরেজের মতো অবিশ্বাসী (অনবিলিভিং টমাস) জাতও তাই তার দুশমন জর্মন জাতের পটারগাইন্টকে আলিঙ্গন করে আপন ভাষায় স্থান দিয়েছে। বিশ্বাস না হয়, যে কোনও ইংরেজি দিকসুন্দরীর (যে সুন্দরী নারী দিক দেখিয়ে দেন, অর্থাৎ ডিশনারি) আশ্রয় গ্রহণ করে সন্দেহ ভঞ্জন করুম। প্রেসিদ্ধ কোনও কোনও গুণীন নাকি ভূতপ্রেতকে দিয়ে অনেক কিছু কাজকর্ম করিয়ে নেন। মহাত্মা কালীপ্রসন্ন তার নক্শাতে এদের সম্বন্ধে সবিস্তার তাজ্জব বয়ান দিয়েছেন। কোনও কোনও পীর সাহেবও নাকি এখনও এই অলৌকিক তিলিসমাৎ দেখাতে পারেন। শীতকালে বোম্বাই আম, যে কোনও কালে কাবুলি মেওয়া পয়দা করতে পারেন।
দুঃখের বিষয় মহাকবি গ্যোটের সেই সুন্দর কবিতাটি আমি ভুলে গিয়েছি। যদূর মনে পড়ছে তাতে এক চেলা পরিপূর্ণ ভূতসিদ্ধ হওয়ার পূর্বেই উচাটন মন্ত্রে ভূতকে আবাহন জানায়। তার পর কী একটা হুকুম করে–খুব সম্ভব জল আনতে–তার পর ভূত জল আনছে তো আছেই, জলে জলে ছয়লাপ। ওদিকে বিপদ হয়েছে কী, চেলা কিন্তু গুরুর কাছ থেকে শেষ উচাটন মন্ত্রটি যেটি দিয়ে ভূতকে ঠেকাবে, সেটি শেখার পূর্বেই চলে এসেছে। এখন বন্যার জলে ডুবে মরে আর কি!… শেষটায় কাতরকণ্ঠে সে গুরুকে স্মরণ করল। গুরু এসে এই ভূতকে অন্য হুকুম দিলেন, আমি এসব চ্যাংড়াদের গুরু। প্রথমে আমার মোক্ষম হুকুম শোন। তার পর অন্য কাজ। এই বলে তিনি ভূতকে অন্য হুকুম দিয়ে বন্যা বন্ধ করলেন।
কিন্তু এ বাবদে আমাদের দেশে প্রচলিত গল্পটি এরচেয়ে ঢের ঢের ভালো। সে গল্পের গোড়াপত্তন ওই একই। আমাদের গল্পে গুরুর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিদ্যা আয়ত্ত করার পূর্বেই চেলা তার ভূতকে আবাহন করেছে। ভূতের সঙ্গে তার কিন্তু একটা শর্ত ছিল। ভূতকে সর্বক্ষণ কোনওকিছু একটা কাজ দিতে হবে। সে বেকার থাকতে পারে না। কাজ না দিতে পারলে সে ওর ঘাড়টি মটকে দেবে।
অস্মদ্দেশীয় কাহিনীতে চেলা ভূতকে ডেকে বলল, আমার জন্য একটা রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দাও। দু-মিনিট যেতে না যেতেই রাজপ্রাসাদ চোখের সামনে তৈরি। ভূত বলল, তার পরের হুকুম চেলা তো তাজ্জব। তাড়াতাড়ি বলল, গোটা দশেক সুন্দরী রমণী। ভূত কটমটিয়ে তাকিয়ে বলল, সে তো প্রাসাদে অলরেডি রয়েছে। বুদু! হেরেম ভিন্ন প্রাসাদ হয় নাকি? চেলা বলল, তা হলে প্রাসাদের সামনে একটা হ্রদ তৈরি করে দাও। এক মিনিটে তৈরি। ভূত শুধোল, তার পরের কাজ? চেলা তখন আরও মেলাই অর্ডার দিল। সেগুলোও ঝটপট হয়ে গেল। আর প্রতিবারেই ভূত তার কাছে এসে কটমটিয়ে তাকায়। ভাবখানা সুস্পষ্ট। কাজ না দিতে পারলে শর্তানুযায়ী তোমার ঘাড়টা মটাস করে ভাঙব। চেলা তখন পড়েছে মহাসঙ্কটে। নতুন অর্ডার খুঁজে পায় না। কবি গ্যোটের চেলার মতোই সে ভূত বিদায় দিতে জানে না। তখন হন্যে হয়ে, না পেরে, কবি গ্যোটেরই চেলার মতো সে তার গুরুকে স্মরণ করল।
এইখানেই আমাদের কাহিনী গ্যোটের কাহিনীর চেয়ে ঢের সরেস।
আমাদের গুরু তার প্রাচীনতার, ফাস্ট প্রেফারেন্সের দোহাই পাড়লেন না। চেলাকে বললেন, ভূতকে হুকুম দাও একটা বাঁশ পুঁততে। সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। শুরু চেলাকে বললেন, এবারে ভূতকে হুকুম দাও, সে যেন ওই বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠে। এবং উপরে ওঠামাত্রই যেন নিচে বেয়ে নামে। ফের উপর। ফের নিচে। ফের উপর। ফের নিচ।
গুরু চেলাকে কানে কানে বললেন, ওই করুক, ব্যাটা অনন্ত কাল অবধি। অবশ্য যখন তোমার অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় তখন তাকে ওঠানামা ক্ষণতরে ক্ষান্ত দিয়ে সে কাজ করতে বলবে। তার পর ফের হুকুম দেবে, ওঠো নামো, ওঠো নামো।
কিন্তু এহ বাহ্য।
এ-গল্পের একটা গভীর অর্থ আছে।
মানুষের মন ওই ভূতের মতো। তাকে সর্বক্ষণ কোনও কর্মে নিয়োজিত না করতে পারলে সে তোমার ঘাড় মটকাবে। ইংরেজিতে তাই প্রবাদ অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। অতএব যখন যা দরকার মনকে দিয়ে তাই করিয়ে নিয়ে ফের তাকে একটা বাঁশে ওঠানামার মতো মেকানিকাল কাজে লাগিয়ে দিতে হয়। মানুষ সর্বক্ষণ মনের জন্য নতুন নতুন কাজ সৃষ্টি করতে পারে না।
এইবারে, সর্বশেষে, আমি শান্তনু পাঠকের হাতে খাবো কিল।
মহাত্মাজি চরকা কাটতেন।
রবীন্দ্রনাথ আপন লেখার কপি করতেন। গোরার মতো বিরাট গ্রন্থ তিনি তিন-তিনবার কপি করেছেন। যদিও ওই মেকানিকাল কর্ম করার জন্য আশ্রমে লোকাভাব ছিল না।
আইনস্টাইন ব্যালা বাজাতেন।