রাবাৎ-ইনসল্ট

রাবাৎ-ইনসল্ট

প্রখ্যাত লেখক রেমার্ক-এর উপন্যাস পশ্চিম রণাঙ্গন নিপ (অল কোআএট)-এর এক জায়গায় আলোচনা হচ্ছে কয়েকজন নিতান্তু সাধারণ সেপাইয়ের মধ্যে। ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি ওপর নির্ভর করে প্রতিবেদন নিবেদন করছি। একজন সেপাই শুধোলে, লড়াই লাগে কেন? আরেকজন বলল, দূর বোকা! এক দেশ আরেক দেশকে অপমান করে। তখন লাগে লড়াই। প্রথম সেপাই তখন বলল, কিন্তু আমি তো মোটেই অপমানিত বোধ করছিনে। যারা করছে তারা প্রাণভরে লড়ুক। আমাকে আমার বাড়ি, ক্ষেতখামারে ফিরে যেতে দেয় না কেন?

রাবাৎ সম্মেলনে নাকি ভারতবর্ষ ইন্সন্টেড হয়েছেন। কই, আমি তো মোটেই অপমানিত বোধ করছিনে। তদুপরি আরেকটি তত্ত্ব এস্থলে আমার স্মরণে আসে। আমার বাল্যবয়সে আমার এক গুরুজনের সামনে বাইরের এক ব্যক্তি আমাকে অযথা কড়া কড়া কথা শোনায়। আমি তখন চটে গিয়ে বলি, আমাকে অপমান করছেন কেন? সে ব্যক্তি কোনও উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। আমার সেই মুরুব্বি তখন বলেন, এই তো করলে ব্যাকরণে– পোতোকলে– ভুল। তুমি স্বীকার করে নিলে তুমি অপমানিত হয়েছ। তার পর যে অপমান করেছে সে মাফ না চেয়ে চলে গেল। তুমি রয়ে গেলে অপমানিত। সুতরাং কখনও নিজের মুখে মেনে নিতে নেই, আমি অপমানিত হয়েছি। নিতান্তই যদি তখন তোমাকে কিছু বলতে হয়, তবে বলবে, আপনি এরকম অভদ্র আচরণ করছেন কেন? দোষটা চাপাবে তার ঘাড়ে। এবং আরও নিতান্তই যদি অপমান বোধ করে থাক তবে সেটা জোর গলায় স্বীকার না করে, চুপসে সেটা হজম করে নেবে এবং তক্কে তক্কে থাকবে কখন ব্যাটার ওপর মোক্ষম দাদ তুলতে পারবে-যদ্যপি আল্লাতালার আদেশ সবু (সহিষ্ণুতাসহ ক্ষমা– যার থেকে বাংলার সবুর কথাটা এসেছে। রাবাতের ব্যাপারটা আগাপাশতলা মুসলমানি ছিল বলে মুসলমানি শাস্ত্রের নজির দিলুম।

এর ওপর আরেকটা কথা আছে। অপমান করতে পারে কে, কাকে? আমি গেলুম আপনার বাড়িতে। আপনার চাকর আমাকে খামোখা কতকগুলি কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিল বৈঠকখানায় ঢুকতেই দিল না। এস্থলে সে আমাকে অপমান করেনি, করেছে রূঢ় ব্যবহার আমাকে অপমান করার মতো সামাজিক আসন তার কোথায়? আবার দেখুন, অন্য আরেকদিন আপনার ঠাকুরদা বসেছিলেন বারান্দায়। আমাকে দেখেই খাপ্পা হয়ে আমাকে নাহক বকতে শুরু করলেন। সেস্থলেও আমি অপমানিত নই। কারণ আমি আপনার বন্ধু। আমার পিতামহের বিলক্ষণ হক আছে আমাকে কড়া কথা বলার।… অপমান হয় সমপর্যায়ে। যেমন মনে করুন, সন্তোষ ঘোষ। তিনি লেখক, আমিও লেখক। তিনি আমাকে অপমান করতে পারেন, আমিও তাকে অপমান করতে পারি। আরেকটি নজির দিই। যদ্যপি আইনে বারণ তথাপি ইতালি প্রভৃতি কোনও কোনও দেশে ডুয়েল লড়ার প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু সেখানেও যদি আপনার ভৃত্য ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে ডুয়েলে চ্যালেন্জ করে, সে খবর জানিয়ে দুজন প্রতি চাকরের প্রতিভূদের সঙ্গে দুমিনিট আলোচনা করেই, একবাক্যে চারজনাই রায় দেবেন, এ ডুয়েল হতে পারে না। দুজনার পদমর্যাদা এক নয়। চাকরটা শুধু তার পদমর্যাদা বাড়াবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেন্‌ করেছে।

মরক্কো দেশ কোথায়, মশাই? শুনেছি সেখান থেকে মরক্কো লেদার নামক পুরু চামড়া রপ্তানি হয়। পুরু চামড়া নিশ্চয়ই। নইলে সেখানকার লোক এই সুদূর ভারতবর্ষের লোককে নিমন্ত্রণ করে তাদের অর্বাচীন ইতিহাসে (প্রাচীন ইতিহাস এদের নেই) এই বোধহয় তারা কাউকে কখনও নিমন্ত্রণ করল– এরকম পুরু চামড়ার আচরণ করবে কেন? তদুপরি শুনেছি, মরক্কো দেশকে নাকি এখনও বহু বাবতে ফ্রান্স এবং স্পেনের কথামতো চলতে হয়, এবং সর্বশেষে শুনেছি, স্পেন ও ফ্রান্সের ঝগড়ার সুযোগ দিয়েই এদেশের যেটুকু স্বাধীনতা আছে সেটুকু বেঁচেবর্তে আছে। আমার কেমন যেন সন্দেহ জাগে, মুসলিম রাষ্ট্রদের নিমন্ত্রণ করে এরা যেন সেই ইতালির ডুয়েলকামীর মতো পদমর্যাদা বাড়াতে চেয়েছিল। আমার তো মনে হয় না, আ মসজিদের আগুন মরক্কোর বুকে কোনও আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

কোথায় মরক্কো, কোথায় ভারত পদমর্যাদায় কোথায় ভারত আর কোথায় সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর টা-পেনি হে-পেনি মরক্কো! সে আমাদের ইনসল্ট করবে কী করে?

ফখরুদ্দীন সাহেব, দীনেশবাবু, আমাদের ফরেন আপিস যা করলেন সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমার দুঃখ, খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে চিঠিপত্র ছাপিয়ে এদেশের মুসলমানরা এদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন না কেন? বলেন না কেন যে, এদেরই হয়ে একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সরকার ওই একটা থার্ড ক্লাস দেশে গিয়েছিল।

যদ্যপি-বা স্বীকার করি– আমি করি না যে ভারত রাবাতে ইনসল্টেড হয়েছে তথাপি বলব, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অপমানিত হওয়াতে লজ্জার কিছু নেই। ক্ষুদ্র স্বার্থপর উদ্দেশ্য নিয়ে জয়ী হলেও উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার কিছু নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *