অল-মসজিদ-উল-আকসা

অল-মসজিদ-উল-আকসা

আজকের দিনে বিশ্ব মুসলিম প্রধানত তিনটি তীর্থ দর্শনে যান। মক্কায় আল্লার ঘর কাবাতে, মদিনায় পয়গম্বরের কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এবং তৃতীয় জেরুজালেমে– যেখানে ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম তিন ধর্মের সমন্বয় হয়।

প্রকৃত শাস্ত্র বিধান অনুযায়ী কিন্তু বিশ্ব মুসলিমকে যে তিনটি পুণ্যভূমি স্বীকার করতে হয় তার একটি মক্কার কাবা এবং তার পর যে পুণ্যস্থানের উল্লেখ করা হয়েছে তার দুইটিই জেরুজালেমে। এর প্রথমটি একাধিক নামে পরিচিত। ইংরেজিতে একে ডোম অব দি রক্ (রক = প্রস্তরের উপর নির্মিত ডোম = গুম্বুজ, ঐতিহাসিক ভ্রান্তিবশত ওমর মও বলা হয়; আরবিতে এটিকে কুব্বতুস্ সখরা (কুৎ–ডোম; স = প্রস্তর বলা হয়)। এটিকে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেই সম্মান প্রদর্শন করে। কারণ এই তিন ধর্মেরই সম্মানিত রাজা সুলেমানের প্রসিদ্ধ মন্দির একদা এস্থলেই দণ্ডায়মান ছিল। এই সলমনের টেম্পল একাধিকবার বিনষ্ট হয় এবং সর্বশেষে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানদের দ্বারা। ভগ্নস্তূপের উপর তাবৎ শহরের ময়লা স্তূপীকৃত হতে থাকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বৎসর ধরে। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর খ্রিষ্টানদের হাত থেকে জেরুজালেম অধিকার করে জঞ্জাল সরিয়ে একটি ক্ষুদ্র মসজিদ নির্মাণ করেন এবং এর পঞ্চাশ বত্সর পর আমাদের শাজাহানের মতো বিত্তশালী ও স্থাপত্যে সুরুচিসম্পন্ন খলিফা আব্দুল মালিক যেখানে যে পৃথিবীর অন্যতম অনবদ্য ইমারত নির্মাণ করেন সেইটিই ১২০০ বৎসর ধরে সেখানে অটুট অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে বিশ্বজনের সৌন্দর্যস্তৃতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করছে। আমি যতদিন জেরুজালেমে ছিলুম তার প্রায় প্রতিদিন একবার না একবার একা একা ঘুরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর বিরাট আরকিটেক্টনিকাল বৈভব থেকে ক্ষুদ্রতম অলঙ্করণ দেখে মুগ্ধ হতুম।

১, কাবা, ২. উপরে উল্লিখিত এই মসজিদ–তার পরেই আসে ৩. মসজিদ-উল-আসা, সংক্ষেপে আসা মসজিদ। এই আক্র উল্লেখ কুরান শরিফে আছে (সূরা ১৭:১)।

এস্থলে কিঞ্চিৎ ইতিহাসের প্রয়োজন।

আরব ও ইহুদি একই সেমিতি বংশ (রেস) জাত, একই রক্ত ধারণ করে। আরবি ও হিব্রু (ইহুদিদের এই ভাষাতেই তাদের বাইবেল রচিত) ভাষা দুই ভগ্নী, অর্থাৎ কগৃনেট। এবং সবচেয়ে বড় কথা বাইবেলে বর্ণিত ইহুদি প্রফেটগণ যথা, আব্রাহম, দায়ুদ, সুলেমান ইত্যাদি কুরান শরীফেও স্বীকৃতিলাভ করেছেন। হজরত নবী তাই যখন ইসলাম প্রচার করেন তখন তিনি ইহুদি আরবের কেন্দ্রভূমি জেরুজালেমের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু হজরতের মদিনা শহরে বসতি স্থাপন করার দুই বৎসর পর আল্লার আদেশে মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন এবং আজও সে রীতি প্রচলিত আছে। এরই ফলে জেরুজালেমের সলমন-মন্দিরভূমি মুসলিম জগতে দ্বিতীয় স্থান পেল বটে তবু কোনও কোনও জাত্যাভিমানী আরব সেটিকে বহু শতাব্দী ধরে প্রথম স্থানেই রেখেছিলেন– বিশেষত উম্মই (ওমাইয়া খলিফারা। অদ্যকার দিনে কিন্তু মুসলিম জাহান প্রথম স্থান দেয় মক্কার কাবা শরিফকে এবং দ্বিতীয় স্থান জেরুজালেমের সলমন মন্দিরকে যার উপর প্রতিষ্ঠিত আব্দুল মালিক নির্মিত এমারতের বয়ান এইমাত্র দিয়েছি এবং এর পরই বলেছি, তৃতীয় পুণ্যক্ষেত্র–মসজিদ-উল-আকসা।

কিন্তু তৃতীয় হলে কী হয়, এই আত্সার সঙ্গে বিজড়িত আছে বিশ্ব মুসলিমের রোমহর্ষক উত্তেজনাদায়ী ঐতিহ্য, পরমাত্মার সঙ্গে মানবাত্মার সম্মিলিত হবার অবিস্মরণীয় অভিযান এবং তার চরম ফলপ্রাপ্তি-নজাৎ, মোক্ষ, মহা পরিনির্বাণ, যা-খুশি বলতে পারেন।

কুরান শরিফে এ অভিযানের যে বয়ান লেখা আছে, হদিসে তার যে টীকা-টিপ্পনী আছে (কুরান হিন্দুদের বেদস্থানীয় শ্রুতি; হদিসকে স্মৃতিশাস্ত্রের সঙ্গে সচরাচর তুলনা করা হয়, আশাকরি কোনও মুসলমান এ তুলনার জন্য অপরাধ নেবেন না)। বস্তৃত ইয়োরোপীয় কাব্যের ইতিহাসে ইসলামের এই অনুচ্ছেদটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। দান্তের মহাকাব্য ডিভাইন কমেডি এর কাছে ঋণী–অপর্যাপ্ত ইয়োরোপীয় আরবি তথা ইতালিয়ান ভাষা-সাহিত্যের গুণীজ্ঞানী আলঙ্কারিক পণ্ডিত এই মত পোষণ করেন।

কুরানে আছে, পয়গম্বর সাহেব মক্কাতে ইসলাম প্রচার আরম্ভ করার কিছুকালের মধ্যেই স্বয়ং আল্লাতালা তাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান এবং পরম সত্যধর্মের নিগুঢ়তম তত্ত্বে দীক্ষিত করার জন্য তার প্রধান ফেরেশতা (দেবদূত ইংরেজিতে আর্কেঞ্জেল জিবরাইল = গেব্রিয়েলকে) পাঠান মুহম্মদকে (দ.) তার সমীপে নিয়ে আসতে।(১) কুরান শরিফে স্পষ্টাক্ষরে বলা হয়েছে,

সেই (ব্যক্তিই) ধন্য যিনি এক রাত্রেই তাঁর অনুচরসহ মসজিদ-উল-হারাম (অর্থাৎ মক্কার কাবা) থেকে একই রাত্রে মসজি-উ-আক্সা (জেরুজালেম) পর্যন্ত ভ্রমণ করেন, যার চতুর্দিক আমরা পূত করেছি। এবং যাতে করে আমরা তাকে আমাদের চিহ্ন দেখাতে পারি। (কুরান শরিফ; সূরা ১৭:১)

অন্বয় এবং টীকা : সেই ব্যক্তি হজরত। একই রাত্রে– তখনকার দিনে যানবাহন যা ছিল তাতে করে মক্কা থেকে জেরুজালেম পৌঁছতে অন্তত (উটে চড়েও) পনেরো দিন লাগার কথা। এটা আমার অনুমান মাত্র। কম তো হতে পারে না; বেশিই হবে।

আমাদের চিহ্ন দেখাতে পারি–অর্থাৎ আল্লাতালা স্বয়ং তাঁকে সত্যধর্মের গভীর তত্ত্বে দীক্ষিত করবেন– পূর্বোক্ত নজাৎ মোক্ষ ইত্যাদি।

এস্থলে প্রশ্ন, মসজিদ-উল-আকসা কোন স্থলে অধিষ্ঠিত মুসলিম-অমুসলিম (অমুসলিম এই কারণে বলছি, প্রচলিতাৰ্থে অহিন্দু মাক্সমুলার যেরকম বেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন, ঠিক সেই জিনিসই করেছেন একাধিক ইয়োরোপীয় অমুসলিম পণ্ডিত কুরান-হদিস নিয়ে) সকলেই তার অধিষ্ঠান জেরুজালেমে ছিল বলে স্থিরনিশ্চয়– তাই আমি অনুবাদ এবং টীকাতে একই রাত্রে মক্কা থেকে জেরুজালেম ভ্রমণের কথা বলছি।

পণ্ডিতদের বক্তব্য, মক্কা শরিফের বাইরে এমন এক জায়গা যেটি আল্লা স্বয়ং পূতপবিত্র করেছেন, সে শুধু জেরুজালেমই হতে পারে। কারণ ইসলামের প্রথম অ্যুদয়ের সময়ই হজরত ওইদিকে মুখ করে নামাজ পড়েছিলেন। অতএব সেই জেরুজালেমের সলমনের মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত ভূমিতেই আছে মসজিদ-উল্-আক্সা।

পূর্বেই বলেছি খলিফা ওমর সলমন মন্দিরের সেই ভগ্নস্তূপ পরিষ্কার করে নির্মাণ করেন একটি মসজিদ এবং পরবর্তীকালে আব্দুল মালিক নির্মাণ করেন ডোম অব দি রক এবং তারই অতি কাছে আরেকটি বৃহত্তম বিরাট মসজি-উ-আক্সা।

ডোম অব দি রক একটা পাথরের চতুর্দিকে গড়া হয়েছিল বলে স্থপতি সেটাকে হাজার হাজার নমাজার্থী মুসলমানের জন্য বিরাট কলেবর দিতে পারেননি। তাই তিনি সেটিকে করেছিলেন সুন্দর, মধুর। অবশ্য মসজিদের চতুর্দিকে দিয়েছিলেন প্রশস্ততম অঙ্গন (এদেশের মন্দিরে সঙ্কীর্ণ গর্ভগৃহের চতুর্দিকে যেরকম বিস্তীর্ণ অঙ্গন রাখা হয়, কিন্তু গ্রীষ্মকালে, জেরুজালেমের দ্বিপ্রহর রৌদ্রে সেখানকার অনাচ্ছাদিত মুক্তাঙ্গনে– যেখানে মস্তকোপরি সূর্যের প্রতাপের চেয়ে পদতলের পাষাণ ঢের বেশি পীড়াদায়ক– সেখানে জুম্মা নামাজ পড়া অহেতুক পীড়াদায়ক হবে বলে তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তার প্রাণ যা চায় সেই পরিমাণে বিস্তৃত, মসজিদ-উল্-আকসা।

কিন্তু এহ বাহ্য।

আসলে বিশ্ব মুসলিমের কাছে মসজি-উ-আসা তাবৎ পুণ্যভূমির মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর।

কুরান হদিসের সঙ্গে যে মুসলিমের সামান্যতম পরিচয় আছে, সে-ই আপন মনে কল্পনা করে, সেই সুদূর মক্কা থেকে আল্লা তার প্রিয় নবীকে রাতারাতি নিয়ে এলেন মসজি-উ আসাতে (শব্দার্থে মক্কা থেকে সবচেয়ে দূরে পুণ্যক্ষেত্রে), সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, বুর নামক পক্ষিরাজ অশ্ব এবং তার মুখ মানবীর ন্যায় সেই অশ্বে সোয়ার হয়ে নবীজি পৌঁছলেন বেহেশতের দ্বারপ্রান্তে।

এই নিয়ে সে মনে মনে কত না কল্পনার জাল বোনে! স্বয়ং আল্লার সঙ্গে সশরীরে সাক্ষাৎ!

অবশ্য একথাও সত্য যে, বহু মুসলিম দার্শনিক সুফি (রহস্যবাদী ভক্ত = মিষ্টিক) এ প্রশ্ন বার বার শুধিয়েছেন, এই যে হজরতের স্বর্গারোহণ এটা বাস্তব না স্বপ্ন; তিনি কি সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন, না তাঁর আত্মা মাত্রই আল্লার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু মোলাকাত যে হয়েছিল সে সম্বন্ধে সবাই নিঃসন্দেহ।

যাই হোক, যা-ই থাক, এই মসজিদ-উল্-আক্সা থেকেই, আল্লাতালা হজরতকে দিয়ে স্থাপন করলেন মর্তভূমি ও স্বর্গভূমিতে যোগ-সেতু।

সেই সেতুর পার্থিব প্রান্ত পুড়িয়ে দিয়ে সে সেতু বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা অজ্ঞ-বিজ্ঞ যে কোনও মুসলমানকেই বিচলিত করার কথা।

———–

১. কুরান শরিফে জিব্রাইলের উল্লেখ নেই। একাধিক হদিসে সবিস্তর আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *