ন্যাকামো
প্রতি বৎসর আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়ম্বর প্রাথমিক শিক্ষা, পাঠশালার মাস্টারমশাইদের দুরবস্থা, দেশ থেকে কেন নিরক্ষরতা দূর হচ্ছে না এই নিয়ে বিরাট বিরাট মিটিং হয়, বিস্তর চেল্লাচেল্পি হয়, ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলা হয়। তার পর সারা বসর নিশ্চুপ।
এ যেন কস শ্বশুরের জামাইষষ্ঠী করার মতো। নিতান্ত না করলেই নয় বলে। তার পর পরিপূর্ণ একটি বৎসর কিপ্টে শ্বশুর নিশ্চিন্দি।
উহু! তুলনাটা টায়-টায় মিলল না। শ্বশুর যতই হাড়ে টক শাইলক হোক না কেন, এবং জামাই যতই হতভাগ্য দুঃখী হোক না কেন, সে বেচারি অন্তত একবেলার মতো পেট ভরে খেতে পায় এবং শুনেছি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে একখানা কাপড়ও পায়। আমি সঠিক বলতে পারব না কারণ আমি মুসলমানি বিয়ে করেছি। যদ্যপি সম্পর্কে তার এক বারে কনিষ্ঠ ভ্রাতা এই কলকাতা শহরেই পুরুষ্টু পাঁঠাটার মতো ঘোঁত ঘোত করে ঝাঁ-চকচকে একাধিক মোটর দাবড়ে বেড়ায় তবু শালা… আমি অশ্রাব্য অছাপা গালিগালাজ করছিনে(১)– স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ব্যাটা সম্পর্কে আমার বড়কুটুম (শ্যালক আমাকে জামাইষষ্ঠীর দিনে স্মরণ করে না। কারণ তার পিতা আমার ঈশ্বর স্বর মহাশয় তাঁর সাধনোচিত ধামে চলে যাওয়ার পর এই শ্যালকটি তার পিতার তাবৎ সব গ্রহণ করেছেন নৃত্য করতে করতে। (সত্যের খাতিরে অনিচ্ছায় বলছি দাভাকর্ণ শ্বশুরমশাই বিশেষ কিছু রেখে যাননি, এবং সামান্য যেটুকু জ্ৰাসন রঙপুরে রেখে গিয়েছিলেন সেটুকুও পার্টিশনের ফলে শ্যালকের হস্তচ্যুত হয়। (বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে!!) কিন্তু পিতৃদেবের দায়দায়িত্ব বেবাক এড়িয়ে গেছে। তাই সে জামাইষষ্ঠীর একমাস আগের থেকে এড়িয়ে চলে। হিন্দু কায়দাকানুন আমি জানিনে, কিন্তু আমি যে অঞ্চলের মুসলমান সেখানে রীতি, স্বর গত হওয়ার পরেই তার পুত্র জামাইয়ের শ্বশুর হয়ে যান। হয়তো হিন্দুদের ভিতর এ রেওয়াজ নেই। আমি জানব কী করে? কিন্তু আমাদের এই হিন্দু-মুসলমান, ভারতীয় ঐক্যবিধান নিয়ে যখন সব্বাই মাথা ঘামাচ্ছেন তখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিঞ্চিৎ লেনদেন গিভূ-অ্যান্ড-টেক করা উচিত নয়।
এই দেখুন না, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সময় আমার দু-তিনটি হিন্দু বোন আমাকে নেমন্তন্ন জানায়– নেমন্তন্ন কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। আমাকে তখন তারা ডাক দেয়-হক্কা হিসেবে, অ্যাজ এ ম্যাটার অব রাইট। আমি তখন বিশ-পঁচিশ টাকার শাড়ি নিয়ে যাই।
কিন্তু আমার জ্যেষ্ঠপুত্র, প্রিন্স অব ওয়েলস, ফিরোজ মিঞা বড়ই ঘোর আত্মাভিমানী। সে নিমন্ত্রণ পায় তার তিন-চার হিন্দু বোনদের কাছ থেকে। আমি বিলক্ষণ বুঝি সেই সরলা হিন্দু কুমারীরা মনে মনে ভাবে, সব হিন্দু ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পরব করছে আর এই ছোট ভাইটি একা একা দিন গোয়াবে তদুপরি একথাও তো সত্য, এই কুমারীদের কোনও কোনও হিন্দু ভাই মুসলমান ফিরোজের চেয়ে কোনও গুণে শ্রেষ্ঠতর নয়। আমার মনে পড়ল, ওই ফিরোজই তার কোনও এক দিদির জন্মদিনে তার প্রিয় ফুল কেয়া আনতে গিয়ে শান্তিনিকেতনের দক্ষিণ দিকে গোয়ালপাড়ার কেয়াবনের মধ্যিখানে গোখরো সাপের ছোবল খেতে খেতে বেঁচে যায়।
অতএব বাবু ফিরোজ আমাকে বললেন, আব্ব, আমি ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় যাচ্ছি। কিন্তু তার পূর্বে দিদিদের জন্য কিছু শাড়ি কিনতে হবে। আমি দালাল কোম্পানিতে যাচ্ছি।
সর্বনাশ! দালাল কোম্পানি অকাতরে সব দেবে। অবশ্য, বাচ্চা ফিরোজ কেন, ওরা কাউকেই ঠকায় না। তবে কি না আমি ওদের একবার ঠকিয়েছি।
কত টাকার বিল এনেছিল জানেন? ১৮০ টাকা!
পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমি কী নিয়ে আরম্ভ করেছিলুম, আর কোথায় এসে পৌঁছলুম। বুঝিয়ে বলি। এ লেখাটি যখন আরম্ভ করি তখন ভীষণ রৌদ্র, দারুণ গরম। তারই সঙ্গে তাল রেখে আমি রুদ্র তথা ব্যঙ্গরসের অবতারণা করি। কিন্তু দু লহমা লেখার পূর্বেই হঠাৎ অন্ধকার করে নামল ঝমাঝম বৃষ্টি। তার পর মোলায়েম রিমঝিম। তার পর ইলশেগুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্ররসের অন্তর্ধান। বাসনা হল আপনাদের সঙ্গে দু-দণ্ড রসালাপ করি, একটুখানি জমজমাট আড্ডা জমাই।
ইতোমধ্যে আবার চচ্চড়ে রোদ উঠেছে। ফিরে যাই রুদ্ররসে।
.
আমাকে যদি কেউ শুধোয়, আমি কোন জিনিসে সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করি, তবে নির্ভয়ে বলব, শিক্ষা।
কোন শিক্ষা?
প্রাইমারি স্কুল, অর্থাৎ পাঠশালা।
তার পর?
হাইস্কুল। তার পর কলেজ, বি,এ, এম.এ,। তার পর? পি.এইচ.ডি.। আমার মনে সবচেয়ে বিরক্তির সঞ্চার হয়, যখন ডক্টরেট করার জন্য কেউ আমার কাছে এসে সাহায্য চায়।
পাঠক অপরাধ নেবেন না যদি এস্থলে আমি কিঞ্চিৎ আত্মজীবন প্রকাশ করি।
বঙ্গসাহিত্যে আমার যেটুকু সামান্য লাস্ট বেঞ্চের আসন জুটেছে (অর্থাৎ আমার প্রথম পুস্তক দেশে বিদেশে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে আমি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি, মরহুম হুমায়ুন কবীর সাহেবের চতুরঙ্গে ১৯৪৮ সালে। প্রবন্ধটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলুম, যে-যাই বলুক না কেন, আখেরে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলাই হবে। কিন্তু এহ বাহ্য। আমি তখন প্রাইমারি এডুকেশনের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে বলি :
আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাইদের কিছু কিছু জমিজমা মাঝে-মধ্যে থাকে, কিন্তু সে অতি সামান্য, নগণ্য। কেউ কেউ হালও ধরে থাকেন। এবং তৎসত্ত্বেও তারা যে কী নিদারুণ দারিদ্র্যের ভিতর দিয়ে জীবনযাপন করেন সে নির্মম কাহিনী বর্ণনা করার মতো ভাষা ও শৈলী আমার নেই। লেখাপড়া শিখেছেন বলে এবং অনেক স্থলেই উত্তম বিদ্যার্জন করেছেন, যেটা আমরা শহরে বসে সঠিক বুঝিনে গ্রামের আর পাঁচজনের তুলনায় এদের সূহ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা এবং আত্মসম্মানজ্ঞান হয় অনেক বেশি। মহাজনের রূঢ় বাক্য, জমিদার জোতদারের রক্তচক্ষু এদের হৃদয়-মনে আঘাত দেয় ঢের ঢের বেশি। এবং উচ্চশিক্ষা কী বস্তু তার সন্ধান তারা কিছুটা রাখেন বলে মেধাবী পুত্রকে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা না দিতে পারাটা এদের জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ট্র্যাজেডি। ইত্তিহাদ আজাদ (পশ্চিমবঙ্গের বেলায় বলব, আনন্দবাজার দেশ- এটা এখানে জুড়ে দিচ্ছিলেখক মাঝে মাঝে এদের হস্তগত হয় বলে এরা জানেন যে যক্ষ্মরোগী স্বাস্থ্যনিবাসে বহুক্ষেত্রে। নিরাময় হয়, হয়তো তার সবিস্তর আশাবাদী বর্ণনাও কোনও রবিবাসরীয়তে তারা পড়েছেন এবং তার পর অন্নাভাবে চিকিৎসাভাবে পুত্র অথবা কন্যা যখন যক্ষ্মারোগে চোখের সামনে তিলে তিলে মরে তখন তারা কী করেন, কী ভাবেন, আমার জানা নেই। বাইবেলি ভাষায় বলতে ইচ্ছা যায়, ধন্য যাহারা অজ্ঞ, কারণ তাহাদের দুঃখ কম। পাঠশালার গুরুমশাইয়ের তুলনায় গাঁয়ের আর পাঁচজন যখন জানে না, স্বাস্থ্যনিবাস (সেনেটরিয়াম) সাপ না ব্যাঙ না কী, তখন তারা যক্ষ্মারোগকে কিস্যুতের গর্দিশ বলে মেনে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে। হতভাগা পণ্ডিত পারে না।
কিন্তু প্রশ্ন, প্রবন্ধের গোড়াতেই জামাইষষ্ঠীর কথা তুলেছিলুম কেন?
শুনেছি, সঠিক বলতে পারব না, গায়ের পণ্ডিতদের নিমন্ত্রণ করে বছরে একদিন শহরে এনে ওই যে বিরাট বিরাট সভা করা হয়, ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলা হয় তখন জামাইষষ্ঠীর দিনের মতো তাদেরকে একপেট খেতেও দেওয়া হয় না।
এবং তৎপর ৩৬৪ দিনের গোরস্তানের নীরবতা।
.
এই শেষ নয়। দাঁড়ান না। সুযোগ পেলে আরেকদিন আরেক হাত আমি নেবই নেব।
স্বামী বিবেকানন্দকে গুরু মেনে, সাক্ষী মেনে।
———-
১. আমার প্রতি অকারণ সহৃদয় পাঠক, যারা আশকথা-পাশকথা শুনতে ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে অবান্তর একটি ঘটনার উল্লেখ। আমার বৃদ্ধ পিতা তখন ছোট একটি মহকুমার অনারারি হাকিম। একদিন আদালত থেকে ফিরে আমায় বললেন, সিতু, আজ আদালতে কী হয়েছিল, জানিস? এক মূর্ব আরেক গাধার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা এনেছে ওই দোসরাটা নাকি তাকে সদর রাস্তায় শালা বলে গালাগালি দিয়েছে (এতদিন পরে আমার মনে নেই সেটা এবুজিত ল্যানইজ না ডিফেমেশন ছিল– লেখক)। তার পর বাবা বললেন, আসামি পক্ষে মোক্তারের বক্তব্য, যাকে সে শালা বলেছে সে সম্পর্কে সত্যিই তার শালা; অতএব কোনও অপরাধ হয়নি। বিপক্ষ কিন্তু বলছে, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আসামি যখন শালা বলেছে তখন মধুভরা সোহাগ-পোরা সে শালা বলেনি; বলেছে অপমান করার জন্য। ইতোমধ্যে বাবার মগরিবের (সন্ধ্যার নামাজের জন্য অজুর জল এসে গিয়েছে। আমি তাই তাড়াতাড়ি শুধোলুম, আপনি কী রায় দিলেন? বাবা বললেন, দুই পক্ষকে আদালত থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলুম। বললুম, মশকরা করার জায়গা পাওনি!… আমার মনে এখন সন্দেহ জাগে, বাবার এই হুকুম ঠিক আইনসম্মত হয়েছিল কি না। তবে একথা জানি, দুই পক্ষই কোনও প্রতিবাদ না জানিয়ে সুড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল। কারণ বাবা ছিলেন রাশভারী, আচারনিষ্ঠ বৃদ্ধ। আসামি ফরিয়াদি মোক্তার সবাইকে দেখেছেন উলঙ্গাবস্থায় আমাদের বাড়ির আঙিনায় বেলাধুলো করতে।