বিশ্বভারতী প্রাগ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীর জন্য এদেশে বিশ্ববিখ্যাত একাধিক পণ্ডিত আনিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন অধ্যাপক মরিৎস্ ভিটারনিস। একে এদের অনেক সংস্কৃতপণ্ডিত চিনতে পারবেন। ১৯০৯ থেকে ১৯২২ জুড়ে জর্মন ভাষায় প্রকাশিত হয় তার ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস। এরই ইংরেজি অনুবাদ বেরোয় এদেশে ১৯২৭ থেকে ১৯৩২। এছাড়া আছে, গৃহ্যসূত্র প্রাচীন ভারতে বিবাহ অনুষ্ঠান ভারতীয় ধর্মে রমণী ইত্যাদি তার প্রচুর গ্রন্থরাজি।
এ সবকটি বই-ই পণ্ডিতদের জন্য।
কিন্তু তিনি আমাদের মতো সাধারণজনদের একখানি পুস্তিকা লিখে গিয়েছেন–কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে। এ-পুস্তিকা সম্বন্ধে ইতোপূর্বে, অন্য অবকাশে, আমি দু-একটি কথা বলেছি। এস্থলে পুনরায় বলি, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত যত লেখা বেরিয়েছে তার ভিতরে আমি এটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করি। তার প্রধান কারণ অধ্যাপকের সমস্ত জীবন কাটে বেদ, উপনিষদ, সংস্কৃত কাব্য নিয়ে। এদেরই ভেতর দিয়ে যে ঐতিহ্য ভারতবর্ষে চলে আসছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কতখানি সংযুক্ত, কতখানি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার ধর্মমত কীভাবে গড়ে উঠেছিল এ সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বলার অধিকার ছিল অধ্যাপক তিনটারনিৎসেরই। তিনি বাংলা ভাষা জানতেন।
বইখানি অতিশয় সরল জর্মন ভাষায় রচিত। ইংরেজি বা বাংলায় এর অনুবাদ হয়েছে বলে শুনিনি। হওয়া উচিত। বইখানি একখণ্ড শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ ভবনে আছে।
চেকোস্লোভাকিয়ার জনসাধারণ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীয় জর্মন এবং পরবর্তী যুগে খাস জর্মনির জর্মনগণ দ্বারা নিপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও তাদের কৃষ্টি-সভ্যতার অনেকখানি জন সভ্যতার কাছে ঋণী। তাছাড়া অনেক জর্মনও চেকোস্লোভাকিয়ায় বাস করত।
অধ্যাপক ভিনটারনিৎস চেক নন। তিনি জন্মেছিলেন দক্ষিণ অস্ট্রিয়ায় ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি যখন টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন তার জন্মভূমি পড়ে নবনির্মিত রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়ার প্রত্যন্ত প্রদেশে, অবশ্য অস্ট্রিয়াই (হিটলারেরও জন্ম এই অঞ্চলে এবং তার ধমনীতে নাকি কিঞ্চিৎ চেক রক্তও ছিল; মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, চেকদের যে তিনি সর্বনাশ করতে চেয়েছিলেন তার কারণ, ওই করে তিনি তাঁর চেক রক্ত অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, সেইটে আসল কথা নয়। তিনি ভালোবাসতেন প্রাগ শহরকে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সেখানে তিনি অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে চেকোস্লোভাকিয়া জন্মগ্রহণ করে মাত-উদর থেকে যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন তিনি ইচ্ছে করলেই ভিয়েনা (এইমাত্র বলেছি, তার মাতৃভূমি পড়েছিল অস্ট্রিয়ায় এবং অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা তখন প্রাগ ইত্যাদি শহর থেকে তার আপনজনকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে) বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতে পারতেন কিন্তু তিনি যাননি।
অধ্যাপক ভিটানিস ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বরাবর ১৯৩৭–তার পরলোকগমন অবধি আগেই থেকে যান।
তিনি ছিলেন জাতে, ধর্মে ইহুদি।(১) ইহুদিরা কোনও জায়গায় পত্তন জমালে সেখানে যেসব ইহুদি পরিবার আছে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে এমনই এক হয়ে যায় যে পরে ভিন্ন জায়গায় উৎকৃষ্ট সুযোগ-সুবিধা পেলেও এদের ত্যাগ করাটা নিমকহারামি বলে মনে করে। এই একই কারণে ইজরায়েলের শত ক্রন্দনরোদন সত্ত্বেও আমেরিকার লক্ষ লক্ষ ইহুদি পরিবার-সমাজ-দেশ ছেড়ে ওই দেশে যেতে চায় না।(২)
প্রাগ শহর বড় বিচিত্র শহর। সেখানে চেক আছে, জর্মন আছে, ইহুদি আছে, আরও কত জাত-বেজাতের লোক আছে এবং বড় মিলেমিশে থাকে।
আর, পূর্বেই বলেছি, শহরটি বাস্তবিকই বড় সুন্দর।
মধ্যিখান দিয়ে মলডাও নদী চলে গিয়েছে। ঠিক যেরকম ভিয়েনার মাঝখান দিয়ে ড্যানুয়ব, প্যারিসের মধ্যিখান দিয়ে শেন, বুড়াপেস্ট-এর মাঝখান দিয়ে ড্যানুয়ব।
অধ্যাপক ভিনটারনিৎসকে নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাব।
হোটেলওলাকে শুধোলুম, হোথায় কোন ট্রামে বা বাসে যেতে হয়।
সেদিন কী-একটা পরব ছিল। ভিড়ে ভিড়ে হুজুন।
অতএব বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয় বন্ধ। কিন্তু একটা স্কেলিটেন স্টাফ থাকবে তো! তারা নিশ্চয়ই অধ্যাপকের বাড়ির ঠিকানা দিতে পারবে।
ইতোমধ্যে এই হুজুম না কাটা পর্যন্ত ট্রাম-বাস তো চলবে না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাত দিয়ে ঘাড়ের বাঁ দিকটা চুলকোচ্ছি, এমন সময়ে এক অপরূপ সুন্দরী এসে আমাকে শুধোল, আপনার কি কোনও সাহায্যের প্রয়োজন?
এ শুধু প্রাগেই সম্ভবে!
অন্য দেশের মেয়েরা পুরুষকে মদত দেবার জন্য এরকম এগিয়ে আসে না।
———-
১, আমি শুনেছি তিনি যখন শান্তিনিকেতনে ভিজিটিং প্রফেসাররূপে ছিলেন তখন কলকাতার ইহুদি সম্প্রদায়ের নিমন্ত্রণে সেখানকার ইহুদি ধর্মমন্দিরে তাদের বাৎসরিক পূজায় উপস্থিত থাকেন।
২. অন্য কারণও হয়তো আছে। ১৯৩৪ সালে যখন আমি প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের কেন্দ্রভূমি তেল আভিভ শহরে যাই তখন এক ইহুদি আমাকে বলেন– মশকরা করে, না কি, বলা কঠিন– কাকে কাকের মাংস খায় না। সব ইহুদি, সব কাক, এক জায়গায় জড় হলে তো উপবাসে মরতে হবে। দুনিয়ার কুল্লে জাত স্বজাতের সঙ্গে থাকতে চায়। আমরা ব্যত্যয়।