ধন্য অবাঙালি!
ভিন্ন ভিন্ন জাত সম্বন্ধে পৃথিবীর লোক কতকগুলি ধারণা করে বসে আছে। যেমন স্কচ্ কিপ্টে, ফরাসি দুশ্চরিত্র, জর্মন ভোতা, ইংরেজ অবিশ্বাসী, এমনকি প্রখ্যাত ফরাসি সাংবাদিক মাদাম তাবুই-এর একখানা বই আছে যার শিরোনামা লা পেরফিড আলবিয়ে (বিশ্বাসঘাতক ইংরেজ) দিয়ে আরম্ভ। (অবশ্য তিনি তার পুস্তকে প্রমাণ করার চেষ্টা দিয়েছেন যে, এ কুসংস্কারের জন্য ইংরেজ সম্পূর্ণ দায়ী নয়, ফরাসিও অনেকখানি)।
এরকম ঢালাও জাতিবিচার থেকে ওই যে ধারকর্জ দেনেওলা আমাদের নিরীহ কলকাত্তাই পাঠানও (চলতি ভাষায় কাবুলিওয়ালা) মুক্ত নয়। আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে আসত দুই ঈদের দিনে এক পাঠান। একবার কথায় কথায় বলল, আপকা কলকাত্তা শহমে বহুৎ আচ্ছা আলু, চান্না হোতা হৈ। আমরা তো অবাককলকাতা শহরের রাস্তার উপর যত লক্ষ লক্ষ গভীর গর্ত থাক না কেন, কোনওটাতেই তো আজ অবধি আলু বা চানা ফলতে দেখিনি সরকারের অধিক ফসল ফলাও কান ঝালাপালা-করা প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও! পাঠান ফের বলল, ঘর ঘর মে। আমরা তো আরও সাত হাত পানিমে। শেষটায় বোঝ গেল পাঠান আলু চান্না বলতে আলোচনা বোঝাতে চেয়েছিল।
পাঠানের এই ঢালাও জাতিবিচার কিন্তু এস্থলে ভুল নয়। রকবাজি আড্ডাবাজিতে কলকাত্তাইয়া এখনও অলিম্পিকের গোল্ড মেডেল ধারণ করে। এই যে হালে আমরা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ক্রিকেট খেললুম ঠিক তার উল্টোটি। ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলতে হলে আমাদের রক-আড্ডাবাজির টিমে আছেন চারটে রণজি, তিনটে ব্রাডম্যান, দুটো লারউড, একটা নিসার আর গুগলির জন্য ওই একটা বসাকে। তা সে-কথা থাক। পাঠান বাস করে খাঁটি বাঙালিপাড়ায়– সাম্-বাজারে। রাস্তার পর রাস্তা পেরুতে পেরুতে সুবোম নিতি নিত্যি দু-পাশে দেখে রকের পর রক–মহাসভা, কানে যায় আলু চান্না।
কিন্তু পাঠানের দ্বিতীয় জাতবিচারটা একদম ভুল বেরুল। বলল, কলকত্তেমে বহুত অচ্ছি ফারসি বোলি জাতি– হর রাস্তে পর। বলে কী? আলু আর চানা তবু না হয় বুঝি, হয়তো-বা পাঠান কলকাতার মুদির দোকানে ওই দুই বস্তু অত্যুত্তম সরেস জাতের পেয়েছিল। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় অচ্ছি ফারসি বলা হয় এটা কেমনতরঃ পাঠান বোঝাল, দিনে অন্তত একশোবার সে শুনতে পায় বহু কণ্ঠে, কিন্তু সর্বদাই অনবদ্য ফারসি উচ্চারণে বৃ-তালাশে বক্রি। এস্থলে বাঙালি পাঠককে বোঝাই বৃ = with এবং for (যেমন বৃ কলমে বকলমে শেখ ফিরোজ, বা বহাল = বহাল তবিয়ং, বমল = বমাল গ্রেফতার তালাশ = তল্লাসি; এবং বক্রি = ছাগল। অর্থাৎ কোনও লোক বক্রির তল্লাসিতে (for বক্রি) বেরিয়েছে।
এ কী কথা! আমরা তো কখনও শুনিনি।
এমন সময় বাইরে ফেরিওয়ালার হাক শোনা গেল। পাঠান লম্ফ দিয়ে সোল্লাসে বলল, ওই তো বলছে বৃ-তালাশে বক্রি।
ওমা! ইয়াল্লা! ও হরি? ফেরিওলা চেঁচাচ্ছে বোতল আছে বিক্রি!
তাই বলছিলুম, এস্থলে পাঠানের জাতবিচারে ভুল হয়ে গেল।
এগুলোর নিষ্পত্তি তত সহজেই হয়ে গেল কিন্তু অন্যগুলোর বেলা? যেমন মনে করুন, লোকে বলে ফ্রান্সের লোক অসচ্চরিত্র। এবং সেই সূত্রে বহু বহু চুটকিলা প্রচলিত আছে। তারই একটি :
এক ফরাসি নিমন্ত্রিত হয়েছে এক মার্কিন পরিবারে। বিস্তর হইহুল্লোড়। ফরাসি সঠিক বুঝতে পারেনি পরবটা কিসের। পাশে বসেছিল এক মার্কিন। তাকে কানে কানে শুধোল, ব্যাপারটা কী? মার্কিন বুঝিয়ে বলল, ওই যে দেখতে পাচ্ছেন বুড়ো-বুড়িএরা পঞ্চাশ বত্সর সুখে সহবাস করার পর আজ তাদের বিবাহের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছেন। ফরাসি বলল, অ বুঝেছি। এরা পঞ্চাশ বছর সহবাস করার পরই এই এখন বিয়ে করতে যাচ্ছেন। তার পর খানিকক্ষণ ঘাড় চুলকে বলল, তা– তা ওই নিয়ে এত তুলকালাম কাণ্ড কেন? আমরা তো আকছারই করে থাকি।
পাঠানের গল্প যেরকম জাতিবিচারের ব্যাপারে পরখ করা গেল, এখানে তো তা করা যাচ্ছে না। তবে কি সত্যিই হুদো হুদো ফরাসি ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসর সহবাস করার পর বিয়ে করে প্রধানত জারজ সন্তানদের আইনত সন্তানরূপে স্বীকৃতি দেবার জন্যে?
কিন্তু এ বিষয়ে ফরাসিদের নিয়েই এ গল্পটা তৈরি হল কেন? আমরা একটি সত্য ঘটনা জানি, এবং সেটা অস্ট্রিয়া দেশের ব্যাপার।
জনৈক অস্ট্রিয়ার লোক, যোহান গেও হিটলার যখন একটি কুমারীকে বিয়ে করলেন, তখন সেই কুমারীর একটি পাঁচ বছর বয়সের ছেলে ছিল। বিয়ের পাঁচ বছর পর ওই মহিলার মৃত্যু হয়। সঙ্গে সঙ্গে য়োহান হিটলার অস্ট্রিয়া থেকে অন্তর্ধান করলেন। তার সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসর পর তিনি আবার ফিরে এলেন মাতৃভূমিতে এবং একজন উকিল ও দুজন সাক্ষীর সামনে শপথ নিয়ে বললেন, তার বিয়ের পাঁচ বছর পূর্বে ওই যে সন্তান জন্মেছিল সে তারই ঔরসের সন্তান।
এই লোকটি জর্মনির ফুরার আডলফ হিটলারের পিতা।*[* W. Shirer; Aufsteg unid Fall in S. W. TOT 91]
.
এতক্ষণ ধরে আমি শুধু পটভূমি নির্মাণ করেছিলুম। এইবারে দেখি, সেয়ানা পাঠক, তোমার পেটে এলেম কতখানি।
মার্কিনরা চাঁদে গেছে শুনে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের আত্মসম্মানবোধ হুঙ্কার দিয়ে বলল, ভারতীয়েরাও যাবে। কিন্তু শ্ৰীযুত সত্যেন বসু এ বাবদে উদাসীন। তাই কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুল, চাদে যারা যেতে চান তারা আবেদন করুন। বিস্তর দরখাস্ত এল। শেষ পর্যন্ত মাত্র তিনজনকে ইন্টারভুর জন্য ডাকা হল, একজন বাঙালি, বাকি দুজন ভিন্ন প্রদেশের।
যে কর্তা ইন্টারভ নিচ্ছিলেন তিনি প্রথম ডেকে পাঠালেন বাঙালিকে। শুধোলেন, চাদে যাওয়ার জন্য কত টাকা চান?
পাঁচ লাখ।
অত কেন?
এজ্ঞে, বুড়ো মা-বাপ রয়েছে। বোনটির বিয়ে দিতে হবে। দুটো ছোট ভাই ইস্কুলে যায়। বিধবা পিসিও রয়েছেন। চাঁদ থেকে ফিরে না আসতে পারলে ওই টাকাতেই তাদের চলে যাবে।
কর্তা : আচ্ছা, পরে জানাব।
তার পর ডাকা হল দ্বিতীয় জনকে। সে প্রদেশের লোক, একটু ফুর্তিফার্তি করতে ভালোবাসে। বলল, দশ লাখ।
কর্তা : অত কেন?
হানজি পাঁচ লাখ দিয়ে মদ্যপানাদি, কাবারে গমন, হে হে রমণীসঙ্গ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফিরে তো না-ও আসতে পারি; তাই সর্বশেষ শখটখ। বাকি পাঁচ লাখ রেখে যাব বুড়ো মা, বাপ, অবিবাহিত ভগ্নী, দুই ভাই, বিধবা পিসির জন্য
কর্তা : আচ্ছা, পরে জানাব।
এর পর এলেন তৃতীয় এক প্রদেশের লোক। ইনি চাইলেন পনেরো লাখ।
কর্তা তাজ্জব মেনে বললেন, অত বেশি কেন?
সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ডাইনে-বাঁয়ে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে টেবিলের উপর বুকে ফিসফিস করে বলল–
বাবুজি, পনেরো লাখের পাঁচ লাখ তো তোমার। পাঁচ লাখ আমার। আর বাকি পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ওই ব্যাটা বাঙালিকে চাঁদে পাঠিয়ে দেব।
এইবারে পাঠক, বের কর তো, দোসরা আর তেসরা ওমেদার কোন কোন প্রদেশের লোক? কিন্তু সাবধান! প্রকাশককে এ বাবদে চিঠি দেবে না। তিনি ছাপাবেন না। আমাকেও লিখবে না। আম্মো উত্তর দেব না।