চুম্বন
ঘটনাটা সাচ্চা না গুল, হলফ করে বলতে পারব না, কিন্তু তাতে কণামাত্র যায়-আসে না। রসের বিচারে সত্য না অসত্য, ভালো না মন্দ, প্রাকৃত না অপ্রাকৃত, এসব মাপকাঠি, কষ্টিপাথর সম্পূর্ণ অবান্তর। ডানালা অশ্ব অর্থাৎ পক্ষিরাজ ঘোড়া কখনও হয়?… রাক্ষসীই হয় না, তার ওপর তার প্রাণ নাকি কোন এক সাত সাগরের অতল তলে কৌটোর ভিতর রয়েছে তোমরা রূপে। সেই ভোমরাকে চেপটে তেলে না মারা পর্যন্ত ওই রাক্ষসীর উপর যতই খঞ্জর-খাস্তার, বন্দুক-কামান চালাও না কেন, সে মরবে না। এইসব অবাস্তব ব্যাপার নিয়ে যখন ঠাকুমা রূপকথা বলেন তখন কি সর্বাঙ্গে শিহরণ কম্পন রোমাঞ্চন হয় না? মধ্যরজনী অবধি ঠাকুমাকে জাবড়ে ধরে বিনিদ্রাবস্থায় কাটে না?
হালে জনৈক পাঠক আমায় জানিয়েছেন, আমার সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসের শহর-ইয়ার নামক রমণী বঙ্গদেশের মুসলিম সমাজে কখনওই থাকতে পারে না। এ চরিত্রটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। প্রত্যুত্তরে আমার বক্তব্য অবাস্তব হলেই যে রসের পর্যায়ে পৌঁছয় না, এ হুকুম দিয়েছেন কোন রসরাজ তা হলে পূর্বোক্ত পক্ষিরাজের বাচ্চা ঘোড়া, রাক্ষসীর কৌটোতে রাখা ভোমরা প্রাণ এসব কোনওপ্রকারেরই রসসৃষ্টি করতে পারে না। ওই অকরুণ পাঠক যদি বলতেন, শহর-ইয়ার বাস্তব হোক, অবাস্তব হোক, এটা রসের পর্যায়ে পৌঁছয়নি, তা হলে আমি চাঁদপানা মুখ করে সেটা সয়ে নিতুম। কারণ এটা রুচির কথা, রসবোধের কথা। আমার আরও পাঁচজন পাঠক-পাঠিকা রয়েছেন। তারা হয়তো বলবেন, না; শহর-ইয়ার রসসৃষ্টি করেছে। অতএব এ লড়াই করবেন আমার পাঠকমণ্ডলী। আমি মুক্তি বা ঝিনুক। আমার পেটে জন্মেছে শহর-ইয়ার মুক্তো। জহুরিরা এর মূল্য বিচার করবেন। ওই অকরুণ পাঠকের মতো কেউ বলবেন, এটার মূল্য একটা কানাকড়িও নয়। আবার কেউ কেউ হয়তো বলবেন, না হে না, অত হেনস্তা করো না। মুক্তোটা তো নিতান্ত হাবিজাবি বলে মনে হচ্ছে না।
এই মতভেদের মাঝখানে দুই পক্ষের কেউই তখন বলবেন না, ওই ঝিনুকটাকে ডাকো না কেন? সেই-ই তো এটার জন্ম দিয়েছে। সে-ই বলুক, এটার দাম কত?
বিচক্ষণ পাঠক, চিন্তা করো, সেই ঝিনুক, যে ইতোমধ্যে মরে দু ফাঁক হয়ে গিয়েছে, তাকে কোন মূর্থ নিয়ে আসবে নিউমার্কেটের জউরি বাজারে, কিংবা আমস্টারডামের মণিমুক্তোর মক্কা-মদীনায়। সে এসে ফাইনাল ফৈসালা করবে, মুক্তোটির মূল্য কী হবে! তাজব কি বাৎ!!
সহজতর উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়, নেপোলিয়নকে যিনি জন্ম দিয়েছিলেন তার সে-জননীই কি নেপোলিয়নের সর্বোত্তম জীবনী লেখবার হক ধারণ করেন।
কিন্তু এসব কচকচানি থাক। যে কাহিনীটি বলতে যাচ্ছিলুম সেইটে নিবেদন করি।
ইয়োরোপের কোনও এক বিখ্যাত নগরে মোকদ্দমা উঠেছে এক চিত্রকরের বিরুদ্ধে। তিনি একটা এজিবিশনে একাধিক ছবির মধ্যে দিয়েছেন সম্পূর্ণ নগ্না এক যুবতীর চিত্র। পুলিশ মোকদ্দমা করেছে, নগ্না রমণীর চিত্র অশ্লীল, ভালগার, অসিন, পর্নগ্রাফিক। এ-ধরনের ছবি সর্বজনসমক্ষে প্রদর্শন করা বেআইনি, ক্রিমিনাল অফেন্স।
আদালতের এজলাসে বসেছেন গণ্যমান্য বৃদ্ধ জজসাহেব, এবং জুরি হিসেবে ছ জন সম্মানিত নাগরিক।
এককোণে সেই নগ্ন নারীর লাইফ সাইজ তৈলচিত্র। তাবৎ আদালত সেটি দেখতে পাচ্ছে। দুই পক্ষের উকিলদের তর্ক-বিতর্কের মাঝখানে হঠাৎ জজ-সাহেব চিত্রকরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি বলছেন, এ ছবিটা অশ্লীল নয়। আচ্ছা, তা হলে অশ্লীল ছবি কাকে বলে সেটা কি এই আদালত তথা জুরি মহোদয়গণকে বুঝিয়ে বলতে পারেন?
চিত্রকর ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে উত্তর দিলেন, নিশ্চয়ই পারি, হুজুর। তবে অনুগ্রহ করে আমাকে মিনিট-দশেক সময় দিলে বাধিত হব।
জজ-সাহেব বললেন, তথাস্তু!
চিত্রকর তার উকিলের কানে কানে ফিসফিস করে কী বললেন সেটা বাদবাকি আদালত শুনতে পেল না।
সাত-আট মিনিট যেতে-না-যেতেই উকিলের এক ছোকরা কর্মচারী চিত্রকরের হাতে ছবি আঁকার একটা রঙের বাক্স তুলে দিল। চিত্রকর সঙ্গে সঙ্গে তার নগ্না রমণীর ছবির সামনে গিয়ে রঙতুলি দিয়ে একে দিলেন নগ্নার একটি পায়ে সিল্কের একটি মোজা।
জজের দিকে তাকিয়ে বলেন, হুজুর, এ ছবিটা এখন হয়ে গেল অশ্লীল!
তাবৎ আদালত থ। জজ বললেন, সেটা কী প্রকারে হল? আপনি তো বরঞ্চ মোজাটি পরিয়ে দিয়ে নগ্নার দেহ কঞ্চিৎ আবৃত করলেন?
চিত্রকর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এই কথঞ্চিৎ আবৃত করাতেই দেওয়া হল অশ্লীলতার ইঙ্গিত। এতক্ষণ মেয়েটি ছিল তার স্বাভাবিক, নৈসর্গিক, নেচারেল নগ্নতা নিয়ে যে নগ্নতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক নরনারী পশুপক্ষীকে ইহ-সংসারে প্রেরণ করেন। এবারে একটি মোজা পরে মেয়েটা আবরণ দিয়ে অশ্লীল সাজেশন দিল তার আবরণহীনতার প্রতি। এখন যদি কেউ এ ছবিটা দেখে মনে করে, কোনও গণিকা তার গ্রাহকদের লম্পট কর্ম-প্রবৃত্তি উত্তেজিত করার জন্য একটিমাত্র মোজা পরেছে তবে আমি দর্শককে কণামাত্র দোষ দেব না।
চিত্রকরের বিবৃতিতে সম্মানিত জজ তথা জুরি-মহোদয়গণ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি না, সেকথা আমার মনে নেই, তবে আমার উনিশ বৎসর বয়সে যে-সময় কিশোর মাত্রেরই হৃদয়ানুভূতি নারী-রহস্য সম্বন্ধে কৌতূহল, কবিগুরু যা অপূর্ব ব্যঞ্জনা দিয়ে প্রকাশ করেছেন :
বালকের প্রাণে
প্রথম সে নারীমন্ত্র আগমনী গানে
ছন্দের লাগালো দোল
আধো-জাগা কল্পনার শিহরদোলায়,
আঁধার আলোর দ্বন্দে।
যে প্রদোষে মনেরে ভোলায়,
সত্য অসত্যের মাঝে
লোপ করি সীমা
দেখা দেয় ছায়ার প্রতিমা।
সে বয়সে পূর্বোক্ত চিত্রকর-কাহিনী আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তার সাত বৎসর পর কিম্মৎ আমাকে নিয়ে গেলেন প্যারিসে। কারও দোষ নেই, আমি স্বেচ্ছায় গেলুম, এ জীবনের প্রথম ক্যাবারে দেখতে।
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমার সর্বপ্রথমই মনে হয়েছিল, এ কিশোরী যুবতীরা কী অনবদ্য সুন্দর স্বাস্থ্যই না ধরে! সুডৌল পরিপূর্ণ স্তনদ্বয়, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে–মোটা-না-সৰু যুগল বাহু, নাতিক্ষীণ কটিচক্র, পুষ্টধর উরুযুগ এবং দেহের উত্তরাধের কুচদ্বয়ের সঙ্গে পরিমাণ রেখে তরঙ্গিত নিতম্বদ্বয়। আমি দীর্ঘ পাঁচ বৎসর ধরে স্বাস্থ্যবতী সাঁওতাল রমণী এবং অন্তত একটি মাস রাজপুতানী দেখেছি। এদের সঙ্গে আমি প্যারিসের ক্যাবারিনীদের সৌন্দর্যের তুলনা করছিনে। আমি করছি স্বাস্থ্যের। সেখানে প্যারিসিনীরা বিজয়িনী।…এবং আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছিলুম। প্যারিসিনীরা যখন নাচছিল তখন তাদের নাভিকুণ্ডলীর চতুর্দিকে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাংসপেশি নাভিকে কেন্দ্র করে চক্ৰাধারে ঘুরে যাচ্ছিল। নদীতে যেরকম অতি ক্ষুদ্র দয়ের চতুর্দিকে স্রোতের চাপে ঘূর্ণায়মান আবর্ত সৃষ্ট হয়। ঠিক এই অদ্ভুত সৌন্দর্যটি আমি ইতোপূর্বে দেখেছিলাম একমাত্র রাজপুতানায়। সেখানকার কুমারীরা মাথার উপর দুটো-তিনটে জলে-ভর্তি ঘড়া-কলসি চাপিয়ে বাড়ি ফেরে। ওরা তো তখন হাটে না। যেন নাচতে নাচতে এগিয়ে যায়। তাই ওদের নাভিকুণ্ডলীর চতুর্দিকে প্যারিসিয়ান নর্তকীদের মতো সৃষ্ট হয় সেই দ, সেই আবর্ত। অপূর্ব সে দৃশ্য!
নমস্য চিত্রকর নন্দলাল, এই সচল ডাইনামিক চক্রাবর্তন তুলে নিয়েছেন এক অচল স্টাটিক ছবিতে। সেখানে সেই রাজপুতানীর নাভিকুণ্ডলীর দিকে খানিকক্ষণ তাকালেই চোখে ধাঁধা লাগে; মনে হয় নাভির চতুর্দিকে যেন চর্কিবাজি ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে।… এই হল সার্থক শিল্পীর কলাদক্ষতা। সচলকে অচলতা দিয়ে, অচলকে সচলতা দিয়ে মূর্তমান করতে পারেন।
কিন্তু এ-বর্ণনা আর বাড়াব না। আমার বক্তব্য বোঝাবার জন্য নিতান্ত যেটুকু প্রয়োজন। সেইটুকুই নিবেদন করি।
ক্যাবারিনীদের পরনে ছিল উক্তমার্ধে অতি সূক্ষ্ম, প্রায় স্বচ্ছ, শরীরের মাংসের সঙ্গে রঙ-মিলিয়ে চীনাংশুকের গোলাপি ব্রাসিয়ের। অধমার্ধে ছিল কটিসূত্র–সোজা বাংলায় যাকে বলে ঘুনসি। সেই ঘুনসি থেকে নেবে গিয়েছে চার আঙুল চওড়া, ঠিক, আমাদের পালোয়ানদের নেঙট, অবশ্য সাইজে তিনগুণের একগুণ, আকারে ত্রিকোণ, এবং সেটি ঘুরে গিয়ে পিছনের কটিমধ্যে যেখানে ঘুনসির সঙ্গে গিঠ খেয়েছে সেখানে সে ঠিক ঘুনসিরই মতো একটি সূক্ষ্ম সূত্ররূপ ধারণ করেছে।
নৃত্যের সর্বশেষ দৃশ্যে ক্যাবারিনীরা তাদের ব্রাসিয়ের খুলে খুলে স্টেজের চতুর্দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ছড়াতে আরম্ভ করলেন।
এস্থলে এসে পাঠক আমাকে লম্পট ভাবুন আর যাই ভাবুন, হক কথা বলতে গাফিলি করব না। যা থাকে কুল-কপালে!
এর পর আমি ভেবেছিলুম নর্তকীরা তাদের অধমার্ধের অঙ্গবাসও খুলে ফেলবেন। তা যখন হল না, তখন আমি আমার সঙ্গীকে শুধিয়ে জানতে পারলুম, আইনানুযায়ী স্টেজে সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়া নিষিদ্ধ। অবশ্য বেআইনিভাবে গোপনে সম্পূর্ণ নগ্ননৃত্যের ব্যবস্থার অভাবও প্যারিসে নেই।
এরা যখন নাভির নিচের কাপড়টুকু খুলল না তখনই আমার মনে হল এবারে পাঠক নিশ্চয় বিস্মিত হবেন– এ নৃত্য এবারে হয়ে গেল অশ্লীল। আমার মনে হল, সেই চিত্রকরের আঁকা একটিমাত্র মোজা অশ্লীলতম ইঙ্গিত দিচ্ছিল, এখানেও হুবহু তাই, বরং বলব অশ্লীলতর, অশ্লীলতম। এরা যদি একেবারে নগ্ন হয়ে যেত তবে এরা সেই চিত্রকরের নগ্ন রমণীর মতো (একটি মোজা পরানোর পূর্বে) হয়ে যেত সরল স্বাভাবিক নৈসর্গিক নেচারেল। এদের সেই একচিলতে দক্ষিণার্ধবাস তখন দিতে লাগল অশ্লীলতম ইঙ্গিত চিত্রকরের মোজাটির ইঙ্গিত তার তুলনায় কিছু না।
তখন হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এক নেটিভ স্টেটের জনৈক মহারাজা ভাস্কর্যশিল্পের প্রকৃত সমঝদার ছিলেন। তিনি ইয়োরোপ থেকে অনেকগুলো প্রথমশ্রেণির মূর্তির প্লাস্টার-কাস্ট নিয়ে এসে তার জাদুঘরটি সত্যকার দ্রষ্টব্য প্রতিষ্ঠান করে তুলেছিলেন। কিছু কিছু মূর্তি ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন– পুরুষ রমণী দুই-ই। একদিন মহারানি গিয়েছেন সেই জাদুঘর দেখতে। তিনি তো শকড়। হুকুম দিলেন নগ্নমূর্তিগুলোর কোমরে গামছা বেঁধে দিতে? পাঠক ভাবুন, রোমান মূর্তির কোমরে (বাধিপোতার?) গামছা! সে কী বেপ দেখতে! কিন্তু এহ বাহ্য।… অজ পাড়াগাঁয়ে লোক, সে-শহরে এলে চিড়িয়াখানা এবং এই জাদুঘরটিও দেখতে আসত। এক ছুটির দিনে আমি জাদুঘরের এটা-সেটা দেখছি, এমন সময় একটি গামছা-পরা মূর্তির সম্মুখে তিনজন গামড়িয়া– চাষাই হবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমি গুঁড়িগুড়ি তাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালুম এবং নিম্নোক্ত সরেস কথোপকথন শুনতে পেলুম।
প্রথম চাষা : মূর্তিটার কোমরে গামছা কেন? (আমি বুঝলুম, ওই অঞ্চলের একাধিক মন্দিরে নগ্নমূর্তি দেখেছে বলে এ-প্রশ্নটা তুলেছে।)
দ্বিতীয় চাষা : শুনেছি, মহারানি নাকি ন্যাংটো মূর্তি আদপেই বরদাস্ত করতে পারেন না। তারই ইকুমে গামছা পরানো হয়েছে।
পূর্ণ এক মিনিটের নীরবতা। তার পর—
তৃতীয় চাষা : (ফিসফিস করে) মহারানির পাপ মন।
আমার এই অভিজ্ঞতা সমর্থন করেন, এই জাদুঘরের ধুরন্ধর পণ্ডিত জর্মন উচ্চতম কর্তা! জাদুঘরে গাইয়াদের ভিড় লাগলেই তিনি তার একাধিক কর্মচারীকে নিযুক্ত করতেন ওদের পিছনে গা-ঢাকা দিয়ে ছবিমূর্তি সম্বন্ধে ওদের টীকাটিপ্পনী শুনে তাঁকে রিপোর্ট দিতে।… এ-দেশ ছাড়ার সময় তিনি আমাকে বলেন, শহুরেদের তুলনায় এদেশের জনপদবাসীদের সরল স্পর্শকাতরতা অনেক বেশি। এরা যেমন কালীঘাটের পট দেখে আনন্দ পায়, ঠিক তেমনি ইউরোপীয় মডার্ন ছবি দেখেও সুখ পায়। এবং বললে বিশ্বাস করবেন না, গগন ঠাকুরের কিউবিস্ট ছবিও এদেরকে হকচকিয়ে দিতে পারে না। তবে এগুলো সম্বন্ধে মতামত দেবার পূর্বে এবং আকছারই লোহার উপর হাতুড়িটি মারে মোক্ষম–অনেকখানি চিন্তা করে তবে বলে। আরও একটা মোস্ট ইনট্রিসটিঙ এবং ক্যারাকটেরিস্টিক ফ্যাক্ট–এরা থ্রি-ডাইমেনশনাল, রিয়ালিস্টিক, রঙিন ফটোগ্রাফের মতো ছবি বাবদে উদাসীন (যেগুলো শহুরেরা পছন্দ করেন)। এই হল আমার কর্মচারীদের রিপোর্ট। অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কারণ, হা-হতোস্মি, এই কর্মচারীরা অন্যান্য শহুরেদের মতো পছন্দ করে রঙিন ফটোগ্রাফের মতো ছবি।
আমি শুধালুম, নিউড?
যার ডিরেক্টর তাজ মেনে বললেন, নিউড। এসব গ্রাম্য লোক সুস্থ স্বাভাবিক যৌনজীবন যাপন করে। উত্তম বলদের সঙ্গে জাতগাভীর সম্বন্ধ করায়। পথেঘাটে কুকুর-বেড়ালের সম্পর্ক দেখে ছেলেবেলা থেকেই। এদের ভিতরে তো কোনও ঢাক-ঢাক গুড়গুড় নেই। এরা তো শহুরেদের মতো সেক্সার্ভড় বা পার্ভার্স নয়। এরা নড দেখে সরলচিত্তে, রস পায় অনাবিল হৃদয়ে।
কী বলতে গিয়ে কী বলে বলে কহাঁ কহা মুলুকে চলে এলুম! কিন্তু বিচক্ষণ গ্রাম্য পাঠক অনায়াসে বুঝতে পারবেন আমার এসব আশকথা-পাশকথা আমার মূল বক্তব্যের সৎ বুনিয়াদ নির্মাণ করছে।
তা হলে ফিরে যাই ফের সেই ক্যাবারেতে; বরঞ্চ বলি, ততক্ষণে আমি সখাসহ নৃত্যশালা ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে পড়েছি। আমি পুরিটান নই, নটবরও নই। তাই এসব অশ্লীল ইঙ্গিত আমার ভালো লাগে না। ওই জর্মন পঞ্জিতের ভাষায় বলতে গেলে আমি গ্রামাঞ্চলের সাধারণ স্বাভাবিক জনপদপ্রাণী। তদুপরি আমি বুদ্ধ। আমি চট করে উত্তেজিত হইনে, ঝপৃ করে মাটির সঙ্গে মিলিয়েও যাইনে।
রাস্তায় নামার পর সখা বলল, তা হলে চলো, পুরোধাক্কা উলঙ্গ নৃত্যে।
আমি আঁতকে উঠে বললুম, সর্বনাশ! সে জায়গার টিকিটের মূল্য তো বিলেতের পঞ্চম জর্জের মুকুটের কূ-ই-নূরের চেয়ে খুব কিছু একটা কম হবে না। আমার পকেটে সে-রেও নেই।
সখা জানতেন আমি বুদ্ধু। তাই শান্তকণ্ঠে বললেন, একদম নগ্ননৃত্যের আসরে টিকিটের দাম ঢের টের কম। ওগুলো বিলকুল পপুলার নয়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলুম, যেটি এ-লেনে আমার একমাত্র বক্তব্য।
সম্পূর্ণ নগ্ননৃত্য তা অত্যন্ত স্বাভাবিক, নৈসর্গিক নেচারেল জিনিস। সেটা দেখতে যাবে কে? প্যারিসে বেড়াতে আসে সাধারণত বিদেশিরা। তাদের অনেকেই মরবিড়, নপুংসক পার্ভার্স। তারা, এবং অম্লাধিক ফরাসিরা যায় ওইসব অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ নৃত্যে। তারা তো নেচারেল নগ্ননৃত্য দেখতে চায় না। এইটেই আমার মূল বক্তব্য।
সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খোলা অতিষ্ঠ হয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সে-বিবৃতিতে তিনি একটা অশ্লীল ফিল্মের সাতিশয় ভসনাপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন। যুবক নায়ক যুবতী নায়িকা একটা টিলার সানুদেশে একে অন্যের অতিশয় পাশাপাশি লম্ববান হয়ে গড়গড়িয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছেন এবং একে অন্যের প্রতি কুৎসিততম জঘন্যতম যৌনইঙ্গিত দিচ্ছেন। এটা কেন হল, তার বিশ্লেষণ শ্ৰীযুত খোলা করেননি। বোধহয় প্রয়োজন বোধ করেননি। পাঠকদের সহৃদয়, অনুমতি নিয়ে আমি তার বিশ্লেষণ করি।
যেহেতু এ-দেশের ফিল্মে চুম্বন, আলিঙ্গন, নগ্নতা দেখানো বেআইনি তাই ফিলু-নির্মাতা রগরগে ছবি বানিয়েছেন যৌন-সম্পর্কের প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিতের আশ্রয় নিয়ে বহু যেরকম নগ্লাকে মোজা পরিয়ে, কাব্যের নৃত্যের শেষ কটিবস্ত্র উন্মোচন না করে।
আমার মনে প্রশ্ন জাগে, চুম্বন নগ্নতার বাধা-নিষেধ যদি আজ তুলে দেওয়া হয় আর্টের খাতিরে (অবশ্যই সেটা কঠিন প্রশ্ন, ফিল্মে আর্ট বলতে আমরা কী বুঝি, এ নিয়ে সুযোগ পেলে পরবর্তীকালে আলোচনা করব), তবে কি আমাদের ফিল-নির্মাতারা সঙ্গে সঙ্গে উদোম নৃত্য আরম্ভ করে তাদের ফিল্ম চুম্বনে নগ্নতায় ভরপুর, টইটম্বুর করে দেবেন?
হয়তো গোড়ার দিকে কিছুটা বাড়াবাড়ি হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তারা শিগগিরই বুঝে যাবেন যে, সাধারণ দর্শক তিন মিনিটব্যাপী চুম্বন, পাঁচ মিনিটব্যাপী নগ্নতা প্রদর্শন দেখবার জন্য অত্যধিক ব্যাকুল নয়। ঠিক যেরকম পূর্বেই নিবেদন করেছি, প্যারিসের পরিপূর্ণ নগ্ননৃত্য দেখবার জন্য মানুষ হই-হুঁল্লোড় লাগায় না।
আইন দরকার, ব্যান্-এরও আয়োজন আছে।
কিন্তু মনে রাখা উচিত, কোনও কোনও দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পরও সেসব দেশে খুনের সংখ্যা বেড়ে যায়নি।
হালে ডেনমার্কে সর্বপ্রকার অশ্লীল সাহিত্যের উপরকার ব্যান তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে কোথায় না অশ্লীল সাহিত্যের বিক্রি হুশ হুশ করে বেড়ে যাবে, রাম ব্যাপারটা উল্টো বুঝেছেন। অশ্লীল মালের পাবলিশাররা মাথায় হাত দিয়ে ফুটপাতে বসে গেছেন। তাঁদের বিক্রি শতকরা ৭০ ভাগ কমে গেছে। কারণ মানুষের লোভ নিষিদ্ধ ফলের প্রতি। ইংরেজিতে প্রবাদ : A stolen kiss is sweeter than any other.
এ বাবদে শেষ আপ্তবাক্য বলেছেন একটি সুরসিকা ফরাসি মহিলা। আমেরিকায় তখন লরেন্স মহাশয়ের লেডি চ্যাটারলি পুস্তক অশ্লীল কি না, সেই নিয়ে মোকদ্দমা চলছে। লেডি চ্যাটারলি পক্ষের উকিল (লেডি চ্যাটারলির লাভার না, লেডি চ্যাটারলির লয়ার) হুতাশনসদৃশ প্রজ্বলিত ভাষায় তাঁর বক্তৃতা শেষ করে অনুপ্রেরণিত কণ্ঠে বললেন, লেখকরাজ লরেন্স এই পুস্তক দ্বারা যৌন-সম্পর্ককে অকল্পনীয় স্বর্গীয় স্তরে (স্পিরিচুয়াল লেভেলে) তুলে ধরেছেন।
এই বিবৃতিটি পড়ে সেই ফরাসি মহিলাটি একটু দুষ্টহাসি হেসে বললেন, সর্বনাশ। এখন তা হলে যৌন-সম্পর্কের অর্ধেক আনন্দই মাঠে মারা গেল। আমি তো অ্যাদ্দিন জানতুম, এটা পাপাচার!