ত্রিমূর্তি

ত্রিমূর্তি

প্রখ্যাত রুশ ঐতিহাসিক মিখাইল গুস্ একটি বড় খাঁটি তত্ত্বকথা বলেছেন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলির কথা আজ আমরা স্মরণ করি এজন্য যে, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য আমরা তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। এরকম একটা শিক্ষা হল যে, আমাদের যুগে বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের যে কোনও রকম দাবি এক সামগ্রিক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। হিটলারের পদানুসরণ যারা করতে চায়, তাদের সকলের প্রতি এ হল এক গুরুতর হুশিয়ারি। (১)

কমরেড পণ্ডিত গুসের কথার পিঠ-পিঠ আমি কোনও মন্তব্য করার দস্তু ধরিনে। আমি অন্য এক মনস্তত্ত্ববিদের একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে নরনবের্গ শহরে যখন গ্যোরিঙ, হে, কাইটেল প্রভৃতি জনা বিশেকের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চলছিল তখন প্রখ্যাত মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ডাক্তার কেলি দিনের পর দিন হাজতে ওদের মনঃসমীক্ষণ করার পর দেশে ফিরে গিয়ে বলেন, হিটলারের মতো ডিক্টেটর এবং নাসি পার্টির মতো পার্টি পৃথিবীর যে কোনও দেশে যে কোনও সময়ে পুনরায় দেখা দিতে পারে। তাই আমার মনে ভয় লাগে, কমরেড় গুসের গুরুতর হুশিয়ারি সত্ত্বেও এ গর্দিশ পুনরায় যে কোনও দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তবু যদি রুশ তরিশ গুস্-এর এ হুশিয়ারি (অস্তরজ্বননা!) মেনে নেন তবে ক্রমে ক্রমে চীন এমনকি মার্কিনও হয়তো রুশের সৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন এরকম একটা আশা করা যেতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইয়োরোপের পঞ্চপ্রধান ছিলেন, হিটলার স্তালিন মুসসোলিনি রোজোভেন্ট এবং চার্চিল। এদের প্রথম তিনজন ছিলেন কট্টর ডিক্টেটর; বাকি দুজন গণতন্ত্রের প্রতিভূ। প্রথম তিনজন রণাঙ্গ(২)নে নামেননি বটে, কিন্তু তাবং যুদ্ধের নীতি পদ্ধতি ইত্যাদি (স্ট্র্যাটেজি; মাঝে-মধ্যে ট্যাটিক পর্যন্ত) সম্বন্ধে তারা পরিষ্কার, কঠিন নির্দেশ দিতেন রণাঙ্গনে অবতীর্ণ জঙ্গিলাটদের। রোজোভেল্ট চার্চিল সেরকম করেননি। এরা তাদের জঙ্গিলাটদের যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য এবং নীতি সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়ে বাদবাকি সবকিছু ওদেরই হাতে ছেড়ে দিতেন। তবে বলা হয়, রণাঙ্গনে যুদ্ধে লিপ্ত জঙ্গিলাটদের রুটিন কর্মে নাক গলাতেন (ইনটারফিয়ার করতেন) ডিক্টেটরদের ভিতর হিটলার প্রচুরতম ও গণতন্ত্রের প্রতিভূ চার্চিল অনেকখানি।

এই পঞ্চপ্রধানের যে তিন জঙ্গিলাট খ্যাতি অর্জন করলেন তারা মার্কিন আইজেনহাওয়ার, ইংরেজ মন্টগামেরি। ডিক্টেটররা সর্বদাই সর্বকৃতিতু সম্পূর্ণ পেতে চান বলে তাদের সৈন্যবাহিনীর কোনও সর্বময় কর্তা নিযুক্ত করতে চাইতেন না। তৎসত্ত্বেও ডিক্টেটরের অধীনে থেকেও যিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন তিনি রুশের জঙ্গিলাট মার্শাল গ্রিগরি জুক।

এই তিন জঙ্গিলাট সম্মুখসগ্রামে নেমেছিলেন। এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিয়কাল পরেই মার্কিন আইজেনহাওয়ার ও ইংরেজ মন্টগামেরি যুদ্ধক্ষেত্রে আপন আপন অভিজ্ঞতা সবিস্তর বর্ণনা করে গ্রন্থ লেখেন। তৃতীয় বীর জুকফু এ-তাবৎ কিছু লেখেননি। (হয়তো স্তালিন চাননি যে জুক কোনওকিছু লেখেন যাতে করে তার কৃতিত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। আমার মনে হয় সেখানে তিনি করেছিলেন ভুল। সেকথা পরে হবে।

এই তিনজনেই হিটলারের সৈন্যবাহিনীকে সম্মুখসগ্রামে পরাজিত করেন। এবং একাধিক মার্কিন, ইংরেজ (ফরাসিও) যদ্যপি স্বীকার করতে রাজি হন না, আমার নিজের বিশ্বাস, হিটলারকে পরাজিত করার প্রধান কৃতিত্ব রুশ জনগণ, স্তালিন ও মার্শাল জুফের। সুতরাং গত বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন-ইতিহাস জুফের বিবরণীহীন ইতিহাস যেন হামলেটকে বাদ দিয়ে হ্যামলেট নাটক! স্তালিনের মৃত্যুর পর জুকফ অবশ্যই তার গ্রন্থ লিখতে পারতেন। কিন্তু তখন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে স্তালিনের চরিত্রের ওপর কলঙ্ক-লেপন। রুশের বড় কর্তারা তখন যে-প্রোপাগান্ডা আরম্ভ করলেন তার মূল বক্তব্য, স্তালিন ছিল সংগ্রামনীতিতে একটা আস্ত বুন্ধু। তার ভ্রান্ত নির্দেশের ফলেই লক্ষ লক্ষ রুশ সে যুদ্ধে মারা যায়। নইলে যুদ্ধ অনেক পূর্বেই খতম হয়ে যেত।

যুদ্ধের পর স্তালিন যদিও জুকফকে নানাপ্রকার নিপীড়ন করেন তবু তিনি এই প্রোপাগান্ডাতে সায় দিতে পারেননি। স্তালিনকে তিনি তার ন্যায্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করতে চাননি। তাই সে সময়েও তিনি কোনওকিছু লিখলেন না।

এর পর স্তালিন-স্মৃতিবিরোধীরাও গদিচ্যুত হলেন।

ধীরে ধীরে স্তালিন সম্বন্ধে রাখার জনসাধারণেরও ধারণা বদলাতে লাগল।

তাই যুদ্ধের চব্বিশ বৎসর পর জুকফ ভার স্মৃতিচারণ ও প্রতিচিন্তা প্রকাশ করেছেন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। (এক নম্বর ফুটনোট দ্রষ্টব্য)

যুদ্ধশেষের এই সুদীর্ঘ চব্বিশ বৎসর পর আইজেনহাওয়ার, মন্টগামেরি ও জুকফ এই ত্রিমূর্তির কল্যাণে এখন যুদ্ধক্ষেত্রে হাতেকলমে এরা কোন কোন রণনীতি রণকৌশল অবলম্বন করে অবশেষে জয়লাভ করলেন তার পূর্ণতর ইতিহাস লেখা সম্ভবপর হবে– কোনও যুদ্ধেরই পূর্ণতম ইতিহাস এ পর্যন্ত লেখা হয়নি, এ বেলাও হবে না।

জুকফের মূল গ্রন্থ বা তার পূর্ণ অনুবাদ আমার হাতে কখনও পৌঁছবে না। ইতোমধ্যে রুশ মার্শাল ভাসিলেফস্কি এই গ্রন্থের যে পরিচিতি অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত সারাংশ দিয়েছেন একমাত্র তারই ওপর নির্ভর করে–কথায় বলে অভাবে পড়লে স্বয়ং শয়তানও মাছি ধরে ধরে খায়–ঘরমুখো বাঙালিকে রণমুখো সেপাইয়ের অভিজ্ঞতা শোনাবার চেষ্টা দেব। একেবারে নিষ্ফল হব না। কারণ রণমুখো না হলেও বাঙালি যে ইতোমধ্যে বেশ মারমুখো হয়ে উঠেছে সে তত্ত্ব কি কলকাতা কি মফঃস্বল সর্বত্রই স্বপ্ৰকাশ। শুনতে পাই এর পর তারা নাকি রণমুখো হয়ে লড়াই লড়ে এদেশে প্রলেতারিয়া রাষ্ট্র প্রবর্তন করবে। কিন্তু সেটা আ লা রুস্ (রুশ পদ্ধতিতে রান্না স্যালাড) না, আ লা শিন (চীন পদ্ধতিতে রান্না ফ্রাইড রাইস) হবে সেটি নিয়ে মতভেদ আছে।

রুশ রাজনীতি তথা চীন রাজনীতি সম্বন্ধে আমার কোনওই জ্ঞানগম্যি নেই।

কিন্তু বিস্তর রসানুভূতি আছে উভয়ের সরেস খাদ্যাদি সম্বন্ধে।

তাই ভালোবাসি রাশান স্যালাড, রাশান কাভিয়ার, রাশান বর্শসুপ, রাশান পানীয় (আমি কড়া ভোদকা সইতে পারিনে; পছন্দ করি এবং স্তালিনও ওই খেতেন–উত্তম ওয়াইন, তা সে স্তালিনের জন্মভূমি জর্জিয়ারই হোক বা ককেশাসেরই হোক)।

সঙ্গে সঙ্গে পছন্দ করি চীনা ফ্রাইড রাইস (চীনা হোটেল-বয় বলে ফ্রাইড লাইস অর্থাৎ ভাজা উকুন), স্প্রিং চিকিন, ব্যাঙের ছাতার অমলেট ইত্যাদি।

.

কলকাতার রুশপন্থী কম্যুনিস্টরা একটা মারাত্মক ভুল করছেন। ওঁদের উচিত এ শহরে অন্তত দু গণ্ডা রাশান রেস্তোরাঁ বসানো।

কারণ Love does not go through heart, but through stomach- প্রেম হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় না, সঞ্চারিত হয় উদরে–আপ্তবাক্যটি বলেছেন একটি ফরাসিনী সুরসিকা নাগরিক।

———-

১. ভারতে অবস্থিত বিদেশি একাধিক দূতাবাস একাধিক ভাষায় বিস্তর প্রোপাগান্ডা লেখেন প্রকাশ করেন, আমার মতো স্বল্পজ্ঞাত লোকও খান-দশেক পায়। এগুলো পড়তে হলে অনেকখানি ধৈর্যের প্রয়োজন কারণ এদের অধিকাংশই বড় একঘেয়ে।…এরই মধ্যে হঠাৎ একখানি উত্তম চটি পুস্তিকা আমাদের হৃদয়মনকে বড়ই আলোড়িত করেছে। সোভিয়েত সমীক্ষা ৯,৯.৬৯ সংখ্যা, সম্পাদক কোলোকোলো, যুগ্ম সম্পাদক প্রদ্যোৎ গুহ, সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের কলিকাতাস্থিত দূতস্থানে প্রকাশিত।

এই সংখ্যায় আছে দুটি সুলিখিত রচনা :১. মিখাইল গুস কর্তৃক ইতিহাসের শিক্ষা এবং ২, সোভিয়েট ইউনিয়নের জনৈক মার্শাল কর্তৃক সোভিয়েত সৈন্যের উদ্দেশে (মার্শাল জুকভের গ্রন্থ স্মৃতিচারণ ও প্রতিচিন্তার সমালোচনা)। বলা বাহুল্য, আমি যে সব সময় এদের সঙ্গে একমত হতে পেরেছি তা নয়। সান্ত্বনা নিই এই ভেবে যে দেশে-বিদেশের একাধিক কমরেডও হয়তো কোনও কোনও স্থলে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। বাংলা অনুবাদ কে বা কারা করেছেন তাঁদের নাম নেই। অনুবাদ স্থলে স্থলে ঈষৎ আড়ষ্ট হলেও অতিশয় বিদগ্ধ উচ্চাঙ্গের।

২. মাত্র কয়েকদিন পূর্বে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড (৩ অক্টোবর ৬৯)-এ জেনারেল শ্রীযুক্ত চৌধুরীর ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি শিরোনামায় লিখিত একটি অতুলনীয় অনবদ্য রচনা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, এটির বাংলা অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। অনেকে হয়তো বলবেন, সাধারণজন, (সিভিলিয়ানরা) যতই সগ্রামশাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হবে ততই সে মারমুখো হয়ে পদে পদে লড়াই করতে চাইবে– জিঙ্গোইস্ট বনে যাবে। আমি ভিন্নমত পোষণ করি। আমার বিশ্বাস রাজনীতি কোথায় সমরনীতিতে পরিণত হয়, এ জ্ঞান সাধারণজনের যতই বাড়বে ততই যুদ্ধ সম্বন্ধে তার দায়িত্ববোধও বাড়বে। ঐতিহাসিক মাত্রই জানেন, এ দুনিয়ায় কত-শত বার সিভিলিয়ান পলিটিশিয়ানরা লড়াই করার জন্য যখন হন্যে হয়ে উঠেছে, তখন সেনাবাহিনীর জঙ্গিলাট জাদরেলরা (প্রফেশনাল সোলজাররা) তাদেরকে ঠেকিয়ে সগ্রাম ঘোষণা করতে দেয়নি এবং পরে দেখা গেল ওই করে জঙ্গিলাট জাদরেল দেশকে সর্বনাশ থেকে বাঁচিয়েছেন। অথচ সাধারণজন ভাবে, এরা কথায় কথায় লড়াই শুরু করে দিয়ে পদোন্নতি, মেডেলের জন্য মুখিয়ে আছেন।

৩, কয়েকজন জর্মন জেনারেল লিখেছেন বটে, কিন্তু এদের কেউই সব রণাঙ্গনের পূর্ণাধিকার কখনও পাননি। আর ইতালিয়ান জাদরেলদের সম্বন্ধে নীরবতা হিরন্ময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *