কত না অশ্রুজল
০১.
একখানা অপূর্ব সংকলনগ্রন্থ অধীনের হাতে এসে পৌঁছেছে। পুনরায়, বার বার বলছি অপূর্ব, অপূর্ব! এ বইখানিতে আছে, মানুষের আপন মনের আপন হৃদয়ের গভীরতম আত্মপ্রকাশ। কারণ মৃত্যুর সম্মুখীন মানুষ অতি অল্প অবস্থাতেই মিথ্যা কয় বা সত্য গোপন করে। এবং একটি দেশের একজন মানুষের সুখদুঃখের কাহিনী নয়; বহু দেশের বহুজনের। ফ্রান্স, জার্মান, ভারতবর্ষ, বেলজিয়াম, হলান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা, ফিনল্যান্ড, ইংল্যান্ড, চীন, জাপান, কানাডা ইত্যাদি ইত্যাদি বস্তুত হেন দেশ প্রায় নেই যার বহু লোকের বহু কণ্ঠস্বর এই গ্রন্থে নেই।
যুদ্ধের সময় সৈন্য তো জানে না কোন মুহূর্তে তার মৃত্যু আসবে। সে যখন ওই সময় ট্রেনচে বসে আপন মা, বউ, প্রিয়া বা বোনকে চিঠি বা তাদের জন্যে ডাইরি লেখে তখনও সে মিথ্যা কথা বলছে, এ সন্দেহ করার মতো সিনিক বা ব্যঙ্গপ্রবণ অবিশ্বাসী আমি নই।
এ বইয়ে আছে গত বিশ্বযুদ্ধে যারা জড়িয়ে পড়েছিল, অর্থাৎ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সৈনিকরূপে একে-অন্যকে নিধন করতে হয়েছিল, তাদের শেষ চিঠি, ডাইরির শেষ পাতা। এ বিশ্বযুদ্ধ থেকে অল্প দেশই রেহাই পেয়েছিল সেকথা আমরা জানি। শান্তিকামী ভারত, এমনকি যুদ্ধে যোগদান না করেও নিরীহ এসৃকিমাও এর থেকে নিষ্কৃতি পায়নি।
এবং শুধু তাদেরই লেখা নেওয়া হয়েছে যারা এ যুদ্ধে নিহত হয় বা যুদ্ধে মারাত্মকরূপে আহত হওয়ার ফলে যুদ্ধের কয়েক বৎসর পরেই মারা যায় কিংবা যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে শান্তিপূর্ণ দেশে বাস করার সময় যুদ্ধের বীভৎসতা, আত্মজন বিয়োগের শোকে কাতর হয়ে আত্মহত্যা করে।
কিন্তু এত দীর্ঘ অবতরণিকা করার কণামাত্র প্রয়োজন নেই। দু-একটি চিঠির অনুবাদ পড়ে সহৃদয় পাঠক বুঝে যাবেন, এ অবতরণিকা কতখানি বেকার।
গত যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হলে পর জর্মন সৈন্যরা সেখানে কায়েম হয়ে দেশটাকে অকুপাই করে। সঙ্গে সঙ্গে বহু ছেলেমেয়ে, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা গড়ে তোলে আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট। তারা মোক পেলে জর্মন সৈন্যকে গুলি করে মারে, রেললাইন, তাদের বন্দুক-কামানের কারখানা ডাইনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং আরও কত কী! এ প্রতিষ্ঠানটি আমাদের আপন দেশেও ইংরেজদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অজানা নয়।
এই আন্দোলনে যোগদান করার ফলে একটি মোল বছরের ফরাসি বালক জর্মনদের হাতে ধরা পড়ে এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বে সে তার জনক-জননীকে একখানি চিঠি লেখে। এবারে আমি সেটি অনুবাদ করে দিচ্ছি :
…আমার প্রতি যারা সহানুভূতিশীল, বিশেষ করে আমার আত্মীয় ও বন্ধুদের আমার ধন্যবাদ জানিও; তাদের বলল যে (মাতৃভূমি) ফ্রান্সের প্রতি আমার অনন্ত বিশ্বাস। আমার হয়ে ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, কাকারা, মাসিরা ও ওদের মেয়ে আমার বোনেদের প্রগাঢ় আলিঙ্গন করো। আমার পাদ্রিসাহেবকে বলো আমি বিশেষ করে তাকে ও তাঁর আত্মজনকে স্মরণে রেখেছি; আমি মসেনার (প্রধান পাদ্রি)-কে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাকে যেভাবে গৌরবান্বিত করেছেন, আশা করি, আমি যে তার উপযুক্ত পাত্র সেটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। মৃত্যুর সময় আমি আমার স্কুলের বন্ধুদেরও আদর-সম্ভাষণ জানাই। আমার ক্ষুদ্র পুস্তক সঞ্চয়ন (লাইব্রেরিটি) পিয়েরকে,(১) আমার ইস্কুলের বই বাবাকে, আমার অন্যান্য সঞ্চয়ন আমার সবচেয়ে প্রিয় আমার মাকে দিয়ে গেলুম। আমার বাসনার ধন স্বাধীন ফরাসিভূমি এবং সুখী ফ্রান্সবাদী দস্ত্রী ফ্রান্স, পৃথিবীর সর্বাণী নেশন ফ্রান্স আমার কাম্য নয়; বরঞ্চ কর্মনিষ্ঠ ফ্রান্স,(২)-–কর্মনিষ্ঠ এবং আত্মমর্যাদাশীল ফ্রান্স। আমি প্রার্থনা করি ফ্রান্সবাসী যেন সুখী হয় সেইটেই সবচেয়ে বড় সত্য। তারা যেন শেখে জীবনে শিবকে আলিঙ্গন করতে।(৩)
আমার জন্য তোমরা কোনও চিন্তা কর না; জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আমার সাহস ও সহজ রসবোধ (গুড হিউমার) বজায় রেখে যাব; আমি যাবার সময় সেই সাঁবর-এ-ম্যজ(৪) গানটি গেয়ে যাব, যেটি তুমি, আমার আদরের মা আমাকে শিখিয়েছিলে।
পিয়েরকে(৫) শাসনে রেখ কিন্তু স্নেহের সঙ্গে। আর লেখাপড়ার কাজ চেক আপ করে নিও এবং সে যেন ঠিকমতো খাটে(৬) তার ওপর জোর দিও। তাকে আলস্য-অবহেলা করতে দিও। আমি যেন তার শ্লাঘার পাত্র হই। সেপাইরা আসছে আমাকে নিয়ে যেতে। আমার হাতের লেখা হয়তো অল্প একটু কাঁপা-কাঁপা হয়ে গেল, তার কারণ পেনসিলটি বড় ছোট্ট; মৃত্যুভয় আমার আদৌ নেই; আমার আত্মা অত্যন্ত শান্ত।
বাবা, আমি তোমাকে অতিশয় অনুরোধ জানাই, প্রার্থনা করো। শুধু এই কথাটুকু বিবেচনা করো, এই যে আমি এখানে মরতে যাচ্ছি, সেটি আমাদের সক্কলের জন্য। এরচেয়ে শ্লাঘনীয় আমার কী মৃত্যু হতে পারত? আমি স্বেচ্ছায় পিতৃভূমির জন্য মৃত্যুবরণ করছি; স্বর্গভূমিতে আমাদের চারজনাতে(৭) ফের দেখা হবে। প্রতিহিংসাকামীদের মৃত্যুর পরও তাদের অনুগামী পাবে। বিদায় বিদায়! মৃত্যু আমাকে ডাকছে। আমার চোখে ফেটা বেঁধে আমাদের গুলি করবে সে আমি চাইনে, আমাকে হাতে-পায়ে বাধতেও হবে না। আমি তোমাকে সবাইকে আলিঙ্গন করি। তৎসত্ত্বেও কিন্তু বলি, বাধ্য হয়ে মরাটা কঠিন কাজ। সহস্র চুম্বন।
ফ্রান্স– জিন্দাবাদ!
ষোড়শ বসরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত
এচ ফেরতে
হাতের লেখা আর ভুলচুকের জন্য মাফ চাইছি; আবার পড়ার সময় নেই।
পত্র-প্রেরক: আঁরি ফেরুতে, স্বর্গলোক, কেয়ার অব ভগবান।(৮)
———-
একাধিক পাঠক অনুযোগ করেছেন, অধমের রচনা ইদানীং বড্ডই টীকা কন্টকাকীর্ণ। আমার নিবেদন, টীকা না পড়লে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। যারা নিতান্ত একটু-আধটু আশকথা-পাশকথা জানতে চান কিংবা এই আক্রাগার বাজারে বই কিনেছেন বলে প্রতিটি পিঁপড়ে নিঙড়িয়ে নিঙড়িয়ে গুড় বের করতে চান– এ টীকা শুধু তাদের জন্য।
১. পিয়ের খুব সম্ভব পত্রলেখক আঁরির (Henri=Henry) ছোট ভাই। তাই পিয়েরকে তার ছোটখাটো পুস্তক সঞ্চয়ন দিয়ে যাচ্ছে।
২. ফ্রান্সে যুদ্ধ হবার পর অনেকেই বিশ্বাস করত, ফরাসিদের আলসেমিই তাদের ওই পরাজয়ের কারণ।
৩. শিবকে আলিঙ্গন- এটা মনে হচ্ছে, জর্মন কবি গ্যোটে থেকে উদ্ধৃত। পত্রলেখক আরি জর্মনদের হাতে নিহত হচ্ছে, অথচ সে বিশ্বপ্রেমিক বলে বিশ্বকবি– জর্মন-গ্যোটেকে উদ্ধৃত করছে।
৪. সাব এবং ম্য ফ্রান্সের দুই নদী। আমাদের যেরকম গঙ্গা-যমুনা। বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা তুলনীয়।
৫, এক নম্বর টীকা দ্রষ্টব্য।
৬. দুই নম্বর ও পাঁচ নম্বর দ্রষ্টব্য।
৭. স্বর্গে বাপ, মা, পিয়ের ও সে নিজে এই চারজন সম্মিলিত হবে আশা করছে।
৮. কনটিনেন্টে পত্রলেখককে তার ঠিকানা দিতে হয় (যেমন আমাদের ইনল্যান্ড-লেটার)। তাই আঁরি তার ঠিকানা দিয়েছে। এর থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন, সে যে গর্ব করেছে জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি (তার) হিউমার বজায় রেখে যাবে, সেটা কিছুমাত্র মিথ্যা দম্ভ নয়। কারণ এই-কটি শব্দই ইহজীবনে তার শেষ বাক্য।
যে-বই থেকে এই পত্রটি অনুবাদ করেছি তার নাম-ঠিকানা : Die Stimme des Menschen Briefe und Aufzeichnungen aus der ganzen Welt i 1939-1945 Gesam melt und herausgegeben von Hans Walter Baenl Piper Verlag, 1961, Muenchen.
.
০২.
এবারে একজন জাপানির চিঠি তুলে দিচ্ছি :
জিরুকু ইওয়াগায়া (Jinoku lwagaya), শিক্ষক, জন্ম ১৯২৩ সালে। ১৯৪৪ সালে ফিলিপাইন যাবার সময় যুদ্ধজাহাজডুবিতে সলিলসমাধি।
শিজুয়োকা, ১২ জুন ১৯৪৩
বুগাভিস(১) দ্বীপের কাছে যে নৌযুদ্ধ হয়ে গেল তার খবর আজ কাগজে বেরিয়েছে। প্রকাশ, একখানা বিরাট সৈন্যবাহী জাহাজ গুরুতরভাবে জখম হয়েছে ও একখানা জঙ্গি-জাহাজ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে। এভাবে মানুষ কেন সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে অতলে লীন হবে? জাপানিরা মারা গেলে শুধু জাপানিরাই, বিদেশিরা মারা গেলে শুধু বিদেশিরাই অবর্ষণ করে কেন? মানুষ শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে সম্মিলিত হয়ে অবর্ষণ করে না কেন, আনন্দের সময় সম্মিলিতভাবে আনন্দ প্রকাশ করে না কেন? এ তত্ত্বটি যে কোনও শান্তিকামী জনের চিত্র আলোড়িত করবে। যেহেতু একটা বিদেশি মরেছে অতএব জাপানিরা বেশ পরিতৃপ্ত। এটা আমার কাছে চিরকাল অবোধ্য থেকে যাবে। তিন দিন চার দিন ধরে একটা লোক সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে শেষটায় অবসন্ন হয়ে জলে ডুবে গেল এটা কী নিদারুশ! মৃত্যুর সঙ্গে আমার যদি সমুদ্রে কখনও দেখা হয় তবে কি আমি তাকে সজ্ঞানে চিনতে পারব?
৩ মার্চ ১৯৪৪
বিদায় নেবার পূর্বে আমি ক্লাসের ছেলেদের দিয়ে তাজিমামরি(২) গানটি গাওয়ালুম। আমি জানি না কেন, শুনে আমার বড় আনন্দ হল। এ গানটি আমি কখনওই ভুলব না; এটি আমাকে সবসময়ই স্মরণ করিয়ে দেবে যে আমি শিক্ষক ছিলুম।
মার্চ ১৯৪৪
আমি যুদ্ধে চললুম, কিন্তু আমি যুদ্ধ চাইনি। হয়তো আমার এ কথাটা কেউই বুঝবে না। কিন্তু কোনও মানুষকে হত্যা করার জন্য আমি কোনও তাগিদ অনুভব করি না। আমার মনে হয়, আমাকে যেন একটা দ টেনে নিয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
একাধিক জাতের বিশ্বাস এবং তারা যুদ্ধের সময় প্রোপাগান্ডা করে যে, জাপানিমাত্রই যুদ্ধের জন্য হামেহাল মারমুখো। এ চিঠি পড়ে পাঠক বুঝতে পারবেন, কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। এ ধরনের আরও চিঠি আছে। স্থানাভাবে তার অল্পাংশও তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভিন্ন টাইপের চিঠি অনুবাদ মারফত বহুবিধ মানবের চিন্তাধারা, হৃদয়ানুভূতি এবং তৎসত্ত্বেও সেগুলো সর্বজনীন– এগুলোর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
যুগোস্লাভিয়ার জনৈক নাম-না-জানা সৈনিক,
অজাত শিশুর প্রতি পত্র,
(যুদ্ধের সময়ে)
হে আমার সন্তান, এখনও তুমি অন্ধকারে ঘুমুচ্ছ এবং ভূমিষ্ঠ হবার জন্য শক্তি সঞ্চয় করছ; আমি তোমার সর্বমঙ্গল কামনা করি। তুমি এখনও তোমার প্রকৃত রূপ (Gestalt) পাওনি; তুমি এখনও শ্বাসগ্রহণ করছ না; তুমি এখনও অন্ধ। তবু, যখন তোমার সে লগ্ন আসবে, তোমার এবং তোমার মাতার সে লগ্ন আসবে (তোমার সে মাতাকে আমি সর্বহৃদয় দিয়ে ভালোবাসি) তখন তুমি বাতাস এবং আলো পাবার জন্য সংগ্রাম করার মতো শক্তিও পাবে। আলোকের জন্য অক্লান্ত সগ্রাম করার অধিকার তোমার ন্যায্য প্রাপ্য। সেই কারণেই তুমি নারীদেহ থেকে শিশুরূপে জন্মগ্রহণ করবে, অবশ্যই তুমি প্রকৃত কারণ না জেনেই জন্মগ্রহণ করবে।
বেঁচে থাকতে যে আনন্দ আছে সেটাকে তুমি রক্ষা কর, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুভয় ঝেটিয়ে বিদায় করে দিও। এই যে জীবন- এটাকে ভালোবাসা উচিত, নইলে এটা বৃথাই নষ্ট হয়, কিন্তু এটাকে মাত্রাধিক ভালোবাসা উচিত নয়।
নতুন নতুন জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য হৃদয় সর্বদা উন্মুক্ত রেখ; মিথ্যাকে ঘৃণা করার জন্য হৃদয় প্রস্তুত রেখ; অশিবকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বর্জন করার মতো শক্তি সর্বধা হৃদয়ে ধারণ কর। আমি জানি, আমাকে এখন মরতে হবে, এবং তোমাকে জন্মগ্রহণ করতে হবে এবং আমার। যতসব ভুলত্রুটির জঞ্জালের উপর তোমাকে দাঁড়াতে হবে। আমাকে ক্ষমা করো। আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত যে তোমাকে এই অরাজক আরামহীন সংসারের পিছনে রেখে চলে যাচ্ছি। কিন্তু এছাড়া তো কোনও গতি নেই। আমি কল্পনায় তোমার কপালে চুম্বন রাখছি- শেষবারের মতো তোমাকে আশীর্বাদ জানাবার জন্য। গুনাইট, বাছা আমার গুড় মরনিং এবং শুভ প্রভাতে তুমি জাগ্রত হও।
মিসাক মানুচিয়ান, তুরস্ক
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে আদি-ইয়মনে (তুর্কি– আরমেনিয়ায়) জন্ম; ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪-এ প্যারিসে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ [প্যারিস]
(আমার মৃত্যুর পর) যারা বেঁচে থাকবেন তারাই ধন্য, কারণ তারা মধুর স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে ফরাসি জাতি এবং অন্যান্য স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগ্রামী আমাদের স্মৃতিকে যথোপযুক্ত সম্মান দেবে। মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমি পরিষ্কার ভাষায় বলছি, আমি জর্মন জাতের প্রতি কোনও ঘৃণা অনুভব করি না… প্রত্যেক মানুষ তার কর্মফল অনুযায়ী তিরস্কার পাবে। জর্মন ও অন্যান্য জাত যুদ্ধশেষে শান্তিতে, ভ্ৰাতৃভাবে জীবনধারণ করবে; এ যুদ্ধ শেষ হতে আর বিলম্ব নেই। বিশ্বজন সুখী হোক।
গভীর বেদনা অনুভব করি আমি যে, আমি তোমাকে সুখী করতে পারিনি। আমি চেয়েছিলুম, তুমি আমাকে একটি সন্তান দেবে, এবং তুমিও সবসময় তাই চেয়েছিলে। তোমার প্রতি তাই আমার অনুরোধ, আমার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য যুদ্ধের পর তুমি অতি-অবশ্য পুনরায় পরিণয় করে সন্তান লাভ করবে।
আজ রোদ উঠেছে। এরকম দৃশ্য আর সুন্দর প্রকৃতির পানে তাকিয়ে আমি তোমাকে নিত্যদিন কতই না ভালোবেসেছি। তাই বিদায় বিদায়! বিদায় নিচ্ছি এ জীবনের কাছ থেকে, তোমাদের সকলের কাছ থেকে, আমার প্রিয়াপেক্ষা প্রিয়তমা পত্নীর থেকে, এবং আমার ভালোবাসার বন্ধুজনের কাছ থেকে। আমি তোমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করছি, তোমার ছোট বোনকেও এবং দূরের এবং নিকটের পরিচিত সব বন্ধুজনকে।
———–
১. সলমন দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম দ্বীপ অস্ট্রেলিয়ার অধীনে।
২. তাজিমামরি গীতটি আমি জোগাড় করতে পারিনি কোনও গুণীন পাঠক যদি সেটি সংগ্রহ করে অনুবাদসহ প্রকাশক মহাশয়কে পাঠান তবে লেখক তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
.
০৩.
একথা অনেকের কাছেই অবিদিত নয় যে, প্রাচ্যে মাতার প্রতি বয়স্ক পুত্রের যতখানি টান থাকে, পশ্চিমে বিশেষ করে ফ্রান্স জর্মনি ইংলন্ড প্রভৃতি দেশে পুত্রের টান তার চেয়ে অনেক কম। এসব দেশের কবিরা মাতার উদ্দেশে কবিতা রচেছেন অত্যল্পই। তার একটা কারণ বোধহয় এরা বিয়ে করে মার সঙ্গে বাস করে না–বউ নিয়ে আলাদা সংসার পাতে। আমাদের বড় এবং মাঝারি শহরেও এ রীতি কিছুটা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
তা সে যাই হোক, যুদ্ধের সময় অনেক সৈন্যই মাতাকে বার বার স্মরণ করে। হৃদয় খুলে তার সব কথা জানায়। তাই যুদ্ধের সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে লেখা চিঠিতে পাঠক মানব-হৃদয়ের নতুন নতুন মর্মস্পর্শী পরিচয় পাবেন।
যুদ্ধ তার রুদ্রতম নিকটতম বদন দেখায় সিভিল উয়োর বা ভ্রাতযুদ্ধের সময় এবং আশ্চর্য সেসময় মানুষের করুণাধারাও যে কীরকম উছলে পড়ে সেটা বহু চিঠিতে বহুভাবে প্রকাশ পায়।
গত বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ইতালিতে ভ্রাতৃযুদ্ধ চলেছে। এ চিঠিটা সে সময়কার।
রবেতো নানিঃ ইতালি, বলনা স্কুলের ছাত্র।
জন্ম ১৯২৮। প্যারাশুট থেকে ভূপৃষ্ঠে সংঘর্ষে ২৮ মার্চ ১৯৪৫(১) সালে নিহত।
২১ জানুয়ারি ১৯৪৫
(মাতাকে লিখিত)
আজ এই প্রথম ইউনিফর্ম পরে গিঞ্জের উপাসনায় আমি যোগ দিয়েছিলুম।(২) আর বিশ্বাস কর মা আমার হৃদয় কী অনুভূতিতেই না ভরে উঠেছিল। ছেলেবেলায় তুমি যে আমাকে সঙ্গে করে গিঞ্জেয় নিয়ে যেতে সে-সময়কার কথা ভাবছিলুম। আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যত দিন যায় মানুষের বয়স বাড়ে বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের গভীরে সে ছেলেমানুষই থেকে যায়। আমরা সমবেত কণ্ঠে অসংখ্য জনের প্রার্থনা গীতি গাইবার সময় যখন পুণ্যময়ী মাতার নাম এল তখন শুধু যে আমারই দু চোখ জলে ভিজে গেল তাই নয়, আমার বন্ধুদেরও তাই হল। তোমার কাছ থেকে চিঠি পাবার যে সুযোগ সুবিধা ও আনন্দ পাবার অধিকার আমার আছে তার মূল্য আমি তখন বুঝতে পারলুম কারণ আমার বহু সাথীর পরিবারবর্গ শক্র-অধিকৃত এলাকায় আছে বলে তারা কোনও চিঠি পায় না।
আমার বিশ্বাস, যে নাম মানুষ বিপদের মুখোমুখি হলে সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ডেকে ওঠে সে নাম মা।
শত্রুপক্ষের যাকে আমি দুবাহুতে করে ফার্স্ট এডের ঘাঁটিতে নিয়ে যাচ্ছিলুম সে চেঁচিয়ে ডেকেছিল মা। যেতে যেতে তার মনের মধ্যে শুধু ছিল একটিমাত্র চিন্তা : তার মা। কাতর হয়ে আমাকে শুধোচ্ছিল, আমরা তার মাকে কিছু করিনি তো? আমি যতই না বলছিলুম সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমাকে মিনতি জানাচ্ছিল আমি যেন সদা আমার মাকে অবশ্য অরণে রাখি, তোমার সম্বন্ধে খবর জানতে অনুরোধ করছিল, জিগ্যেস করছিল আমি তোমার কাছ থেকে চিঠি পাই কি না, তোমার কোনও ফটো আমার কাছে আছে কি না, কারণ তার আপন মায়ের কোনও ছবি তার কাছে ছিল না এবং তাই তোমার ফটোতে সে তার আপন মায়ের ছবিও দেখতে চেয়েছিল।
৮ সেপ্টেম্বর(৩) নিয়ে যারা অবহেলার সঙ্গে আলোচনা করে কণামাত্র জানে না ওইদিন আমাদের পিতৃভূমির জন্য কী দুর্ভাগ্য আর পরিপূর্ণ বিনাশ নিয়ে এসেছে। তারা যদি আমি যা এইমাত্র বর্ণনা করলুম সে দৃশ্যের সম্মুখে থাকত! কারণ, বুঝলে মা, যে লোকটাকে আমি গুলি করে আহত করতে বাধ্য হয়েছিলুম, যাতে করে সে আমার উপর আগেই গুলি না করতে পারে; সে আর আমি তো একই ভাষাতে কথা বলি, এবং মা বলে সে ডেকে উঠেছিল, এই এখন আমি তোমাকে যে নাম ধরে ডাকছি…
এবারে একটি কবিতার গদ্যানুবাদ
আমি হামজা : মালয়, রাজপরিবারজাত কবি।
জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯১১, সুমাত্রায়। যুদ্ধাবসানের অরাজকতার সময় ১৯৪৬ সালে সুমাত্রায় নিহত।
(প্রিয়মিলন তৃষ্ণা)
কী মধুর! হে সমারোহময় মেঘরাশির শোভাযাত্রা
তুমি ঢেকে নিয়েছ সুনীল আকাশের নীলাঞ্জন।
দাঁড়াও ক্ষণেক তরে এই কুটিরের ’পরে
দূরের প্রবাসী তিয়াসী এক পথিকের কুটিরের ’পরে—
এক লহমার তরে, এক পলকের তরে
আমি তোমাকে শুধু শুধদতে চাই,
তোমাকে হে মেঘ তোমাকে শুধোতে চাই
তুমি কোন দিকে যাবে মনস্থির করেছ?
কোন দেশে গিয়ে তুমি দাঁড়াবে?
হে মেঘ, আমার প্রিয়ার কাছে নিয়ে যাও আমার বিরহ ব্যথা
তাকে কানে কানে বলো আমার বিরহ বেদনা
তার তরুণ সোনালি হাঁটু দুটিকে তুমি আলিঙ্গন করো,
যেন আমি নিজে সে দুটিকে আলিঙ্গন করছি।
এ কবিতা তো আমাদের বহুদিনকার চেনা কবিতা!!
———-
১. এর ঠিক এক মাস পরে ইতালিতে যুদ্ধের অবসান হয়। তাই বলে দুঃখ হয় যে সতেরো বছরের ছেলেটির মা যখনই একথাটা ভাববে তখনই তার শোক কত না গম্ভীর হবে।
২. জর্মন ইতালির ফ্যাসি সম্প্রদায় সৈন্যদের উর্দি পরে গিঞ্জে যাওয়াটা পছন্দ করত না। তারা গির্জেকে রাষ্ট্রের শত্রুভাবে দেখত এবং উর্দি না পরে গির্জে যাওয়াটাও অতি কষ্টে বরদাস্ত করত।
৩, ওইদিনই প্রথম খবর প্রকাশ পায়, ইতালির রাজা তার মিত্রশক্তি জনিকে ত্যাগ করে মার্কিন-ইংরেজের সঙ্গে সন্ধি করে ফেলেছেন, ফলে দেশে ভ্রাতৃযুদ্ধ আরম্ভ হয়। যে সৈন্য আহত হয় সে ছিল পার্টিজান দলের। (বর্তমান লেখকের ভেন্দেত্তা দ্রষ্টব্য)।
.
০৪.
ইভান লাকফ : বুলগারিয়া।
জন্ম দ্রিয়ানভো-তে ১ জানুয়ারি ১৯১৫। মৃত্যু ২২ নভেম্বর ১৯৪৩, বুলগারিয়ার পুলিশ কর্তৃক নিহত।
২১ নভেম্বর ১৯৪৩
যে একটিমাত্র বাসনা আমার আছে সেটি বেঁচে থাকার। তোমার খাস চেপে ধরে বন্ধু করে দিল, তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল, ধীরে ধীরে তোমার চৈতন্য লোপ পেল; গারদের কুটুরি আরও ছোট হয়ে গেল, এ কুটুরিতে কখনও বাতাস ঢোকে না। তৎসত্ত্বেও বেঁচে থাকবার জন্য কী অদম্য স্পৃহা!
আর আমার ছোট ছেলেটি! এখন থেকেই সে আমার অভাব অনুভব করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। যে কথাগুলো সে আমায় বলেছিল সেগুলো এখনও আমার মনকে চঞ্চল করে তোলে : বাবা, তুমি যখন ফিরে আসবে তখন আমার জন্য একটা ট্রাম-লাইন কিনে দেবে আর ছোট একটি গাড়ি, আর একজোড়া জুতো!
আমার পুত্র আমার অনুপস্থিতি অনুভব করে। আমার আদরসোহাগ সে কামনা করে, আমার কথা ভেবে সে ব্যাকুল হয়। আমি যখন তাকে বললুম, এরা আমাকে তোর কাছে যেতে দেয় না, তখন সে আমাকে বলল, তুমি যে আমার কাছে আসতে চাও না, তার মানে তুমি আমাকে ভালোবাসো না– না বাবা? শিশুসন্তানের এ কী সরল ভালোবাসা, তার আত্মাটি কত না বিরাট ভালোবাসা ধরতে জানে!
কিন্তু এই এরা যারা আমাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন, এদের কি তবে শিশুসন্তান নেই? এঁরা কি নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন না, অন্যের প্রতি কি এদের কোনও সমবেদনা নেই? অতি অবশ্যই সর্বদাই এরা কোনও কিছু দিয়ে নিজের মনকে বোঝাতে জানেন। যখন তাদের উচিত আমাদের মৃত্যুর চরম দণ্ডাদেশ না দিয়ে লঘুতর দণ্ড দেওয়া অন্যসব কারণ বাদ দিয়ে হোক না সে শুধু আমাদের শিশুসন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তখন তারা বলেন, শাসনদণ্ডের আইন সে অনুমতি দেয় না। এ কী মূর্খতা। কিন্তু বোধহয় এঁরা আপন শিশুসন্তানের প্রতি আমাদের মতো এ গভীর ভালোবাসা পোষণ করেননি। কারণ তাই যদি হত তবে তাদের আচরণ অন্য রকমের হত। আমার এখনও স্মরণে আসছে জেনারেল কচো স্টয়ানফের কথা আমাকে কী বলেছিলেন : বিচারকেরা সন্তানদের কথা স্মরণ রাখেন। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছিনে, হয়তো কখনওই বুঝতে পারব না, তাই যদি হবে, সন্তানদের কথা যদি তারা স্মরণে রাখেন তবে এরকম দণ্ডাদেশ দেন কী প্রকারে?
রাষ্ট্র শক্তিমান এবং রাষ্ট্র কাউকে পরোয়া করে না (ডিফাই)। কিন্তু তাই যদি হবে তবে এরা আমাকে গুলি করে মারছে কেন?
২১ নভেম্বর ১৯৪৩
পুত্রকে–
আমি জানি পিতৃহীন হয়ে তোমার জীবনধারণ কঠিন হবে এবং তোমাকে অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা সইতে হবে। কিন্তু যে সমাজতন্ত্রের জন্যে আমি এ জীবন আহুতি দিচ্ছি সে ব্যবস্থা আসবে(১) এবং তোমাদের জীবনযাপনের জন্য মহত্তর পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
তুমিও সংগ্রামী হও এবং ন্যায়ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও। তোমার মাকে ভালোবাসবে, হে প্রিয়পুত্র। জীবনের বিপদ-আপদে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন।
বুলগারিয়ার রাজনৈতিক পটভূমি বড়ই জটিল। পাঁচশো বৎসর তুর্কদের কবলে পরাধীনতার পর বুলগারিয়া ১৮৭২-এ রুশদের সাহায্যে স্বাধীনতা পায়, কিন্তু গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভে বুলগারিয়ার জনসাধারণ ছিল রুশ-মিত্র, পক্ষান্তরে রাজা বরিস ও তার ফৌজি অফিসাররা ছিলেন হিটলার-প্রেমী। কারণ এই রাজ্যবিস্তার লোভী দলকে হিটলার অনেক লোভ দেখিয়ে হাত করেন এবং প্রকৃতপক্ষে সেখানে তাঁরই চেলাচামুণ্ডারা বুলগার অফিসারদের সাহায্যে নৃশংসভাবে রাজত্ব চালাত। পত্রলেখক স্পষ্টত নাৎসিবৈরী জনসাধারণের অন্যতম ও নাৎসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য মৃত্যুবরণ করেন।
জনৈক জর্মন সৈন্যদ্বারা লিখিত :
হেরবেরট ডুকস্টাইন : জর্মনি।
জন্ম ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ মাগডেবুরগ।
মৃত্যু ২ জুন, ১৯৪৪, যো আনিনা, গ্রিস-এ যুদ্ধে নিহত।
গ্রীষ্ম ১৯৪৪
ডিটমার বা মণিকা– আমার অজাত সন্তান!
যাত্রা এখনও আরম্ভ হয়নি তোমার যাত্রা আমার যাত্রা কারওরই না। সেই বিরাট ঘটনার প্রাক্কালে আমরা উভয়েই প্রতীক্ষমাণ, তুমি তোমার তোমার জন্মগ্রহণ করার, আর আমি আমার যুদ্ধ এবং কাল-ঘূর্ণাবর্ত আমাকে যেখানে টেনে নিয়ে যাবে। সেইহেতু এ পত্র প্রধানত তোমার মায়ের উদ্দেশে লেখা- যে মাতা তার আপন দেহ দিয়ে তোমার আমার মধ্যে সংযোগ স্থাপনা করেছেন। আমি তোমাকে ভালোবাসি যতদিন তোমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দন তোমাকে নিয়তি-নির্দিষ্ট যে পথে যেতে হবে সে পথ দেখিয়ে দিয়ে যায়।
আমার হৃদয় সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে, যতখানি শক্তি সে ধরে– কিন্তু হায়, সে শক্তি বুঝিবা তার নেই যে তোমার বিরাট অভিযানের প্রথম পদক্ষেপগুলো দেখা যাবে শুভেচ্ছা জানায় তোমার মাতাকে ইহসংসারে তোমার সর্বশ্রেয়া যিনি এবং তোমাকে–
— এখনও যার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়নি, তোমার পিতা।
হস্য হসিআও-হসিঅ্যান, চীন।
১৯৪৩-এ যুদ্ধে নিহত।
(একটি ক্ষুদ্র কবিতা)
সংঘ-প্রাচীরের পিছনে
আমাদের বন্ধুত্ব হল নিবিড়তর।
আমরা বিরাট বিরাট যত সব প্ল্যান করলুম
আমাদের আদর্শ আকাঙ্ক্ষা ছিল সুদূরব্যাপী…
কিন্তু বিদায়ের সময় শুধু নাড়লাম মাথা–
একটি মাত্র কথা না বলে একে অন্যের দিকে।
কেননা সেনাবাহিনী তখন এসে দাঁড়িয়েছে
প্রাচীর দুর্গতোরণের সম্মুখে ॥
———–
১. কিন্তু পত্ৰলেখকের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। এর ঠিক এক বত্সর পর বিজয়ী রুশ সেনা নাৎসিদের বিতাড়িত করে বুলগারিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে। ওই সময় বিস্তর নাসিমিত্র নবীন রাষ্ট্র কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। আশা করি, পত্রলেখক যে কামনা করেছিলেন এবারে সেটা পূর্ণ হয়েছিল অর্থাৎ নবীন রাষ্ট্র পত্রলেখক বৈরী-নাসিমিত্রদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার পূর্বে তাদের শিশুসন্তানদের কথা ভেবেছিল।
.
০৫.
যুদ্ধের সময় মাতারাই যে তাদের সন্তান হারিয়েছে তাই নয়, শিশুও মাকে হারিয়েছে– বিশেষ করে গত যুদ্ধের সময়। তাই এ যুদ্ধে মাকে লেখা মেয়ের চিঠিও আছে।
হিটলার গদিতে বসার আগে থেকেই তাঁর শক্র কম্যুনিস্ট ও সোশ্যালিস্টরা তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এবং গোপনে সগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যারা ধরা পড়েন তাদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে বিচারের নামে পরিহাস করা হত বটে, কিন্তু অধিকাংশকেই বিনা-বিচারে কনট্রেশন ক্যামূপে বন্ধ করে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হত।
যুদ্ধ না লাগলে হয়তো হিমলার হিটলার এদের অনেককে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতেন না। কিন্তু হিটলার রুশ-রণাঙ্গনে যতই হারতে লাগলেন ততই তার নিষ্ঠুরতা জিঘাংসা উত্তেজিত হতে লাগল– এই বিদ্রোহী পক্ষের প্রতি। হিটলার তখন স্ত্রী-পুরুষে আর কোনও পার্থক্য রাখলেন না। এমনকি নবজাত শিশুর মাতাও তার বর্বরতা থেকে নিষ্কৃতি পেল না।
১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বামী হানস কপপিসহ স্ত্রী হিলডে কপি গ্রেপ্তার হন। এঁরা দুজনেই হিটলারের বিরুদ্ধে সক্রিয় সোশ্যালিস্ট ছিলেন। কারাগারে হিডে একটি শিশুপুত্রের জন্ম দেন। পিতা নামেই এই শিক্ম নামকরণ করা হয় হাস–এ রেওয়াজ পৃথিবীর বহু দেশে আছে। ছোট হাসের ভূমিষ্ঠ হওয়ার এক মাস পর পিতা বড় হানকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, এবং মাতা হিডেকে আট মাস পরে ১৯৪৩ সালের ৫ আগস্ট। তখন তার বয়স ৩৪।
মাতাকে লেখা কন্যার পত্র
আমার মা, গভীরতম ভালোবাসার মা-মণি,
সময় প্রায় এসে গিয়েছে যখন আমাদের একে অন্যের কাছ থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে। এর ভিতর কঠিনতম ছিল আমার ছোট হানমের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়া– সেটা হয়ে গিয়েছে। সে আমাকে কী আনন্দই না দিয়েছে! আমি জানি, সে তোমার মেহনিষ্ঠ মাতৃহস্তে অতি উত্তম রক্ষণাবেক্ষণ পাবে এবং আমার তরে মা-মণি- প্রতিজ্ঞা কর তুমি সাহসে বুক বাঁধবে। আমি জানি, তোমার বুকে বাজছে, এই বুঝি তোমার হৃদয় ভেঙে পড়বে, কিন্তু তুমি নিজেকে শক্ত করে নিজের হাতে চেপে ধর–খুব শক্ত করে। তুমি ঠিক পারবে–তুমি তো কঠিনতম বাধাবিঘ্নের সামনে সর্বদাই জয়ী হয়েছ– এবারেও পারবে না মা? তোমার কথা যতই ভাবি, তোমাকে যে নির্মম বেদনা আমি দিতে যাচ্ছি সেই কথা– এটাই আমার কাছে সবকিছুর চাইতে অসহনীয়– এই ভাবনা যে, জীবনের যে বয়সে আমাকে দিয়ে তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখনই আমায় ছেড়ে যেতে হচ্ছে তোমাকে। তুমি কি কখনও কোনওদিন আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? তুমি তো জান মা, আমার যখন বয়স কম ছিল– অনেকরাত্রে ঘুম আসত না– তখন যে-চিন্তা আমার মনকে সজীব করে তুলত সেটা–আমি যেন তোমার আগে ও-পারে যেতে পাই। এবং তার পরবর্তীকালে আমার মাত্র একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল; সে আকাক্ষা দিবারাত্র, জানা-অজানায় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত– এ সংসারে একটি সন্তান না এনে কিছুতেই আমি মরব না। তা হলে দেখ মা, আমার এই দুই মহান কামনা এবং তাই দিয়ে আমার জীবন পরিপূর্ণ সফলতা পেয়েছে। এখন আমি যাচ্ছি আমার বড় হানসের মিলনে। ছোট হান– আমি আশা ধরি আমাদের দুজনার ভিতর যা ছিল ভালো, সেইটে পেয়েছে। এবং যখনই তুমি তাকে তোমার বুকে চেপে ধরবে, তোমার এই শিশুটি সর্বদাই তোমাকে সঙ্গ দেবে আমার চেয়ে বেশি, আমি তো আর কখনও তোমার অত কাছে আসতে পারব না। ছোট হাস্- আমার আশা যেন সুদৃঢ় শক্তিশালী হয়, সে যেন মুক্তহৃদয় হয়, দরদী সেবাশীল হৃদয় ধরে এবং তার বাপের অকলঙ্ক চরিত্র পায়। আমরা একে অন্যকে নিবিড়, বড় নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছিলুম। প্রেমই আমাদের সর্বকৰ্ম নিয়ন্ত্রিত করেছিল।
শক্তি দিয়ে যুঝে যেবা দেহ করে দান,
প্রভু রাখে তার তরে মহান নির্বাণ—
মা আমার, আমার অদ্বিতীয় কল্যাণী মা, আর আমার ছোট হান, আমার সর্ব ভালোবাসা সর্বকাল তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে; সাহস ধর–আমি যেরকম সাহস রাখব বলে দৃঢ়প্রত্যয়। —-নিত্যকালের
তোমার মেয়ে হিলডে
মাতাকে নিহত করে যারা শিওকে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত করে তাদের কী নাম দিয়ে ডাকি? হিটলার সর্বদাই ইহুদি বেদের পরিচয় দিতেন তাদের Untemensch= Undermen নাম দিয়ে অর্থাৎ মানুষ যে স্তরে আছে ইহুদি বেদে তাদের নিচের স্তরে। তাই তাদের গ্যাসচেম্বারে পুরে মারা হয়। অথচ আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তার থেকে বলতে পারি, এই দুই জাতই মাতা মাত্রকেই অবর্ণনীয় অসাধারণ প্রীতিম্নেহের চোখে দেখে। এইবারে পাঠক চিন্তা করুন Untermensch পদবি ধরার হক সবচেয়ে বেশি কার?
মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে হিলডের যে দুটি চরম কামনা ছিল সে-দুটি পূর্ণ।
আর সান্ত্বনা দিই যে তাকে দীর্ঘকাল বৈধব্যশোক সইতে হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন ওই-কটি মাসই তার কী করে কেটেছে? আর ওই-কটি মাসেই তার পিতা বড় হানস কী গর্ব, কী বেদনাই না অনুভব করেছিল।
আর সান্ত্বনা দিই এই ভেবে যে মাত্র ন মাসের শিশু মাতৃবিচ্ছেদের শোক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। কিন্তু প্রশ্ন, সে যে মাতৃদুগ্ধ না খেয়ে অন্য দুগ্ধ খাচ্ছে সেটা কি সে ইন্সটিক্ট দিয়ে (অনুভূতি-জাত সরাসরি জ্ঞান) বুঝতে পেরেছিল।
মনকে যতই চোখের ঠার মারি না কেন, যতই সান্ত্বনা খুঁজি না কেন, এ চিঠি গিলতে গিয়ে আমাদের সর্ব বুদ্ধি বিবেচনা সর্ব অনুভূতি চেতনা অসাড় হয়ে যায়।
এই পুণ্যশ্লোকা প্রাতঃস্মরণীয় কন্যা মৈত্রেয়ীর অনুজা। তিনি অমৃতের সন্ধানে ইহবৈভব ত্যাগ করেছিলেন (যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহমং তেন কুর্যাম)। ইনি মাতা ত্যাগ পুত্র ত্যাগ করলেন সত্যশিবের সন্ধানে।
এই অতিশয় অসাধারণ পত্রের পর অন্যের পত্র কি পাঠকের মনে সাড়া জাগাবে? কি আমি তো কোনও ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টি করার জন্য চিঠিগুলো বাছাই করে করে ফুলের তোড়া সাজাচ্ছি না। যেমন যেমন পড়ে যাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আমার হৃদয় স্পর্শ করছে সেগুলো অনুবাদ করে দিচ্ছি এবং আমি বাঙালি বলে আশা করছি বাঙালি হৃদয়ও এগুলো গ্রহণ করবে।
তাই চীন দেশের একটি কবিতা।
বাচ্চাটির বয়স যখন পাঁচ তখন তার বাপ যুদ্ধে মারা যায়। এবং তাকেও কৈশোরে পৌঁছতে না পৌঁছতেই যুদ্ধে যেতে হল। কবিতাটি ঈষৎ মডার্ন স্টাইলে ফ্লাশ-ব্যাক করে রচিত। মডার্নদের বুঝতে কোনও অসুবিধা হবে না, ভূমিকা হিসেবে উপরের দুটি ছত্র লিখতে বাধ্য হলুম প্রাচীনপন্থী পাঠকদের জন্য।
য়েন যুই : চীন।
যুদ্ধের সময় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আহত, তারই ফলে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু।
(সমরাঙ্গনের পুরোভূমিতে তরুণ)
এ তো একফোঁটা ছেলেমাত্র আর এরি মধ্যে যুদ্ধ।
হিম্মতে সে ভরপুর তবু হৃদয় থেকে যেন রক্ত ঝরছে।
তার বয়স তখন মাত্র পাঁচটি হেমন্ত– যখন বাপ যুদ্ধে মারা গেল।
বাড়ি দৈন্যে ঢাকা পড়ল, খাদ্য বস্ত্র খেলনা নেই।
ছেলেটির বয়স ক্ৰমে চোদ্দ হল, তাকেও যুদ্ধে নিয়ে গেল।
দুঃখ-বেদনায় মাতৃহৃদয় খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল।
সমস্ত গ্রীষ্মকাল জুড়ে চলল রক্তপাত আর বহ্নি-দাহনের তাণ্ডব,
ছেলের সংবাদ– সে কোন সুদূরে মরে গেছে না জয়ী হবে।
তখন বিদায় নেবার সময় হায় রে নিষ্ঠুর নিয়তি
ছেলেটি জামাকাপড় পরেছিল বাচ্চাদের মতন তখনও।
তার পর সে বাড়ি ফিরল– বাপেরই মতো হয়েছে লম্বা
মায়ের চোখের দিকে তাকাল, মায়ের কোলে লুটিয়ে পড়ল।
চোখের জল ঝরে পড়ে মায়ের কাপড় দিলে ভিজিয়ে
অতীত কি কেউ কখনও ভুলতে পারে?
বাপ যা চেয়েছিল ছেলেকে সেটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হল
আবার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে হল একটি কথাও বলেনি সে—
.
০৬.
জাঁদরেল থেকে জোয়ান –তা তিনি জর্মন হন বা ফিনই– বস্তৃত যারাই রুশদের বিরুদ্ধে লড়েছে তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছে কষ্টসহিষ্ণুতা আর দার্টে রুশ সৈন্যের জুড়ি নেই। যে অবস্থায় অন্য যে কোনও দেশের সৈন্য ভেঙে পড়বে– বোধহয় একমাত্র জাপানি ছাড়া সেখানে রুশ জোয়ান খানিকক্ষণ ঘাড় চুলকোবে কোনও কিছু ঠিক ঠিক ঠাহর করতে তার বেশ একটু সময় লাগে তার পর এক হাতের তেলোতে আর এক হাত দিয়ে যেন অদৃশ্য ধুলো ঝাড়ছে ওই মুদ্রাটি এঁকে বলবে নিচ্ছিভো। ইট ইজ নাথিং, ডাজুনট ম্যাটার-এর দূরের অনুবাদ। কুছ পরোয়া নহি কই বাত নহি তবু অনেক কাছের অনুবাদ।
কিন্তু দার্ঢ্য– ওইটেই আসল কথা। কিন্তু ওইটেই কি শেষ কথা?
(কবিতা)
সেমেন গোদসেন্কো : সোভিয়েত ইউনিয়ন।
জন্ম ১৯২২। মে ১৯৪২-এর যুদ্ধে আহত হওয়ার ফলে ১৯৫৩ সালে মৃত্যু।
কুড়িটি বচ্ছর আমাদের বয়স বল,
তার পর এই যুদ্ধের বৎসরে,
সর্বপ্রথম আমরা দেখলুম রক্ত, দেখলুম মৃত্যু
সরল, সোজাসুজি, মানুষ যেরকম স্বপ্ন দেখে অক্লেশে।
আমার স্মৃতিপট থেকে কিছুই মুছে যাবে না,
যুদ্ধে প্রথম মৃত জনের সঙ্গে দেখা,
বরফের উপর প্রথম রাত্রিযাপন, শীতে জমে গিয়ে
একে অন্যকে পিঠ দিয়ে ঘুমুলুম।
আমি আমার পুত্রকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব মৈত্রীর দিকে
তাকে যেন কখনো যুদ্ধ করতে না হয়–
সে যেন আমাদের মতো কাঁধে কাঁধ ছুঁইয়ে
মিত্রগণের সঙ্গে ধরণীর বুকে পা ফেলে চলে।
সে যেন শেখে : ন্যায্যভাবে
রুটির শেষ টুকরো ভাগাভাগি করতে।
…মসকোর হেমন্ত, স্মলেনসকের শীত ঋতু,
আমাদের অনেকেই মারা গিয়েছে।
কিন্তু সৈন্যবাহিনীর ঝঞ্ঝা, বসন্তের ঝঞ্ঝা
পরিপূর্ণ করে দিয়েছে এই নব ফাল্গুন।
বিরাট যুদ্ধ এই করে
মানুষের বুকের পাটা ভরে দেয় সাহস দিয়ে।
মুষ্টি হয় দৃঢ়তর, বাক্য হয় গুরু-ভার।
এবং বহু কিছু তখন হয়ে যায় পরিষ্কার।
…কিন্তু এখনও তুমি বুঝতে পারনি–
এইসব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমি হয়েছি আগের চেয়ে কোমলতর।
অর্থাৎ বাইরের কার্যকলাপে, সগ্রামে শান্তিতে রুশজন যতই দার্চ ধরুক না কেন, অন্তরে সে পুষে রাখে কোমলতা, করুণা, মৈত্রী। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই বিশ্বাস ধরি।
আধুনিক রুশ সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অতি অল্প। কাজেই বলতে পারব না, কবি গোদমেনুকো রুশ দেশে কতখানি খ্যাতিপ্রতিপত্তি ধরেন। তবে তার আর একটি কবিতা আমার বড় ভালো লেগেছে।
বাইরে যতই বড়ফট্টাই করুক না কেন, হিটলারের অনেক চেলাই যে ভিতরে ভিতরে গড়ড্যাম্ কাপুরুষ ছিল সেইটে কবি প্রকাশ করেছেন অতি অল্পতেই। ভলগা-অঞ্চলের স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ তখন (ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩) শেষ হয়ে গিয়েছে। বিশ্বজন, এমনকি জর্মন জাঁদরেলরাও তখন জেনে গিয়েছেন যে জর্মনির জয়াশা আর নেই। জয়াশা ত্যাগ করে মুণ্ডহীন দেহে যত্রতত্র বিচরণ করাটা তখন স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো ছিল না। কবিতাটি স্তালিত্যাদে লেখা।
স্তালিদগ্রাদ, মে–নভেম্বর, ১৯৪৩
ফেব্রুয়ারি শেষ হল।
নীলাকাশ
দেওয়ালের ফুটোগুলোর ভিতর দিয়ে
যেন চিৎকার করছে।
প্রতি চৌরাস্তায় তীরের চিহ্ন
জর্মন সৈন্যদের পথনির্দেশ করছে
কোথায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
এ তো ইতিহাস।
এ তো স্মরণের কাহিনী।
সংগ্রামের চিৎকার ভলগা-অঞ্চল থেকে সরে গিয়েছে।
এখন, কীভাবে ইস্কুলগুলো ফের বানাতে হবে
তাই নিয়ে দিবারাত্তির মহকুমা-শহরে গভীর আলোচনা হচ্ছে
বাচ্চারা নিয়ে এল অতিশয় সযত্নে
একখানা বেঞ্চি– কোনও জখম-চোট লাগেনি
যেন কাচের তৈরি পলকা মাল মাটির নিচের ঘর থেকে।
…সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
–হঠাৎ আলোতে-অন্ধপ্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল।
এক জর্মন সৈন্য।
ওহ্! কী কাঁপতে কাঁপতে সে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল।
তার ওভারকোট ছেঁড়া, টেনা টেনা– পা দুটো নড়বড়ে।
ওই শেষ জর্মন সৈন্য স্তালিনগ্রাদে।
একদা বার্লিনে সে যে হামাগুড়ি দিত হুবহু সেইভাবে।
(নাৎসি-প্রধানদের সম্মুখে অনুবাদক)
এভাল্ট ফন ক্লাইস্ট-শ্লেনৎসিন।
জন্ম ২২ মার্চ ১৮৮৯।
ফাঁসিতে মৃত্যু ১৫ এপ্রিল ১৯৪৫।
জনৈক ধর্মভীরু নিষ্ঠাবান ক্যাথলিক ক্রিশ্চানের পূত্রাংশ। ইনি হিটলারের আদেশে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন :
ভগবানের দিকে যে জাতি যতখানি নিয়োজিত করেছে, সেই দিয়ে তার মূল্য বিচার করতে হয়। একটা অ-ক্রিস্টান জাতও ক্রিস্টানদের তুলনায় (যেমন আমরা অনুবাদক) ভগবানের অনেক নিকটতর হতে পারে। আজকের দিনের ক্রিস্টানরা ভগবানের কাছ থেকে অনেক দূরে।
.
০৭.
কনসানট্রেশন ক্যাপের (ক. ক) কেলেঙ্কারি কেচ্ছা এতদিনে হটেনটটরাও শুনে গিয়ে থাকবে কিন্তু তার গৌরবময় যুগে সে তার কীর্তিকলাপ এতই ঢেকে চেপে সারতে পেরেছিল যে সাধারণ নিরীহ জর্মন ক-কর ভিতরে কী হয় না-হয় সে সম্বন্ধে নানারকম গুজব শুনতে পেত বটে, পাকা খবর পাবার কোনও উপায় ছিল না। তদুপরি সুবুদ্ধিমান জর্মনমাত্রই জানত, এ বাবদে অত্যধিক কৌতূহল প্রকাশ করা আপন স্বাস্থ্যের জন্য প্রকৃষ্টতম পন্থা নয়। যেমন ১৯৪৫-এ যখন যুদ্ধ জয়ের কোনও আশাই ছিল না তখন হিটলার-হিমলার আইন জারি করেন যে, কেউ যদি বলে যে এ যুদ্ধে জর্মনির জয়াশা নেই তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হবে; ওই সময় এক জর্মন তার বউকে গোপনে বলে, যুদ্ধে জয়লাভ করার ভরসাটা বরঞ্চ ভালো। মুণ্ডুহীন ধড় নিয়ে হেথাহোথা ছুটোছুটি কাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে আদপেই ভালো নয়।
গল্পটি সেই সময়কার।
ট্যুনিস আর শ্যেল দুই নিরীহ, সদাশান্ত জর্মন। দুজনাতে দোস্তি। পথিমধ্যে দেখা। ট্যুনিস শুধোল, যা রে শ্যেল, অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি বল তো!
হুঁহহ!
সে কী রে? কথা কইছিস না কেন? আমি তো শুনলুম, তোকে কনসানট্রেশন ক্যামপে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওই জায়গাটা সম্বন্ধে তো নানান কথা শুনি! কীরকম ছিলি সেখানে
শ্যেল বলল, ফার্স্ট ক্লাস। উত্তম আহারাদি। পরিপাটি ব্যবস্থা। সকালে বেড়-টি। জামবাটি ভর্তি চা। একটি আপেল, দুখানা খাস্তা বিস্কুট। তার পর আটটা-ন্টায় ব্রেকফাস্ট। ডাবরভ সর-দুধ, কবৃফ্লেক, চাকতি চাকতি কলা, উত্তম মধু। সঙ্গে তো টোস্ট, মাখন, চিজ আছেই। তার পর দুখানা অ্যাবড়া আন্ত মাছভাজা ফ্রেশ মাখমে। তার পর দুটো ফুল-সাইজ পোচ, ডিম ভাজা বা মমলেট– যা তোর প্রাণ চায়– বেকনসহ, কিংবা হ্যামও নিতে পারিস। তার পর
ট্যুনিস সন্দিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলল, সে কী করে?
হা হা হা। ন-সিকে খাঁটি কথা কইছি। ক-ক’র বাইরে বসে তোরা তো নিত্যি নিত্যি খাচ্ছিস lunch-এর নামে লাঞ্ছনা, supper-এর নামে suffer। আমরা খাচ্ছিলুম… পুনরায় সসিজ, কটলেট, এসপেরেগাস, চিকেন রোসটের সবিস্তর বর্ণনা।
ট্যুনিস বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনে। হালে মুলারের সঙ্গে দেখা। সে-ও মাস ছয় ক-কতে কাটিয়ে এসেছে। সে তো বলল সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনী। সে বলল
বাধা দিয়ে বাঁকা হাসি হেসে শ্যেল বলল, বলতে হবে না, সে আমি জানি। তাই তো বাবুকে ফের ওখানে ধরে নিয়ে গিয়েছে।
শ্যেল আর ওখানে ফিরে যেতে চায় না। তাই ইংরেজিতে যাকে বলে সে তার বর্ণনা-টোস্টে প্রেমসে লাগাচ্ছে প্রয়োজনাতিরিক্ত গাদা গাদা মাখন।
কিন্তু শেল-বর্ণিত ঘটনা সত্য সত্যই ঘটেছিল ক-কতে তবে ভিন্নভাবে। যাকে বলে–
উল্টো বুঝলি রাম, ওরে উল্টো বুঝলি রাম।
কালে করলি ঘোড়া, আর কার মুখে লাগাম ॥
১৯৪৫-এর মে মাসে যুদ্ধশেষে বিজয়ী রুশ সেনা যেমন যেমন জর্মনির অন্তর্দেশে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে ক-ক’র বন্দিদের খালাস করে ভ্রাতভাবে আলিঙ্গন করল– কারণ এই বন্দি ছিল হিটলারবৈরী, জমনের দুশমন।
ওই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে চিঠি লিখছে এক চেকোস্লোভাক বন্দি। চিঠিখানি দীর্ঘ। আমি কাটছাঁট করে অনুবাদ দিচ্ছি :
য়ারোস্লাভ য়ান পাউলিক; চেকোস্লোভাকিয়া।
জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫।
মৃত্যু ১৩ মে ১৯৪৫।
উত্তর জর্মনি, মে ১৯৪৫
ওলাফ ঝড়ের বেগে, যেন হোঁচট খেয়ে ঢুকল আমার গারদে। রুপোলি চুলে মাথাভরা ওলাফ। খোঁড়া-পা ওলাফ, তার ক্রাচ দুটিয়ে নিয়ে। তার সেই মধুর হাসি হেসে সে আমায় আলিঙ্গন করল।
মুক্তি মুক্তি মুক্তি।
স্বাধীনতা স্বাধীনতা।
আমরা সবাই এখন মুক্ত, স্বাধীন। এমনকি ডাকাত, খুনিরাও মুক্তি পেয়েছে। সবাই মিলে লেগে গেল আশপাশে ডাকাতি লুটতরাজ করতে। আমি কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারলুম না। ওই যে পেটুক মুলার বলে, আমি ওসব ব্যাপারে একটা আস্ত বুদ্ধ। তদুপরি আমি ভুগে ভুগে অত্যন্ত দুর্বল; রোগে কাতর, সর্ব নড়নচড়নে অথর্ব। আর এই হট্টগোলের মাঝখানে এই প্রথম অনুভব করছি সেটা কতখানি। এদিকে আসছে বাসন বাসন ভর্তি আলু, রুটি, চিনি। অমুক (পত্ৰলেখক ইচ্ছে করেই নামটা ফাঁস করেননি–অনুবাদক) একটা খাসা, বেড়ে সুটকেস লুট করেছে– ভেতরে আছে, শার্ট-কলার-গেঞ্জি-রুমাল এবং চিনি, কোকো, সিগার, মাখন, এক বোতল হৃদয়ভেদী ব্র্যান্ডি, হেনেসি ব্র্যান্ডির চেয়েও উৎকৃষ্ট। তার সোওয়াদটা আমার জিভে এখনও লেগে আছে।
ওদিকে আঙিনার উপর ডাই ভঁই আলু। তন্দুরের ভিতর গাদা গাদা পাউরুটি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তৈরি হয়ে উড়ে উড়ে বাইরে চলে আসছে। পেপে আমাকে একটা ছেঁড়া সুয়েটার, একটা ছোরা আর একজোড়া জুতো দিয়েছে (ক-কর বন্দিরা দুরন্ত শীতে খড়, ন্যাকড়া দিয়ে পা বাধত অনুবাদক)। সত্যিকার জুতো! যতই চেয়ে দেখি প্রাণটা কী যে আনন্দে ভরে আসে।
রুশ সৈন্যবাহিনীর ট্যাঙ্ক, মোটরগাড়ি, বাইসিকল আমাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নমস্কার নমস্কার! কীরকম আছেন? (জুদ্রাসভুইয়েতে, কাহ্ন পজিভাইয়িতে?) বলছে তারা। তারা তাদের গাড়ির থেকে আমাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলছে সিগারেট, রুপোলি-মোড়কে প্যাচানো ৫০ গ্রামের তামাক, মিষ্টি, মাখন-চর্বি, টিনের যাবতীয় বাদ্য, পাজ, টুথপেস্ট, দুধের গুঁড়ো, সিরাপ।
সকালবেলা খেলুম; আন্ডাবেকন, জামবাটি ভর্তি পরিজ, সঙ্গে বিস্তর মার্মালেড, রুটি মাখন প্যাজ, সত্যিকার কফি, চিনিসহ।
(দ্বিতীয় চিঠি)
হয়েছে। আমার একটি অনবদ্য, পুরো পাক্কা আমাশা হয়েছে। ফরাসি পাঁচকরা কালকের দিনে যা বেঁধেছিল (এই সময়ে একাধিক ফরাসি পাঁচকও ক-কতে বন্দি ছিল ও দ্রব্যাদি তথা মালমসলা পেয়ে বহুদিন পর মুখরোচক জিনিস তৈরি করছিল–অনুবাদক) কলিজা-ভাজা তার সঙ্গে সরে-দুধে মাখানো আলুভাতে, তাবত বস্তু পাজ-ফোড়নে, ওহ, সে কী সুন্দর, কী মধুর!
এখন আমাকে কী করতে হচ্ছে, ওইসবের সামনে দাঁড়িয়ে?
দুধ আর আঙুর রস! এই আমার পথ্যি।
দুপুরের খাবার সময় হয়ে এসেছে।
হায় আমার খিদে নেই, রুচি নেই। আমার প্রিয়া, আমার ছোট্ট বউটি এখন কী করছে, কী ভাবছে।
কাল তাকে পাবার জন্য আমার বুক যা আকুলি-বিকুলি করছিল।
মনে হচ্ছে, এইবারেই নাক-বরাবর ওরই দিকে ছুটে যাব।
.
হায়, যুদ্ধশেষের পাঁচ দিন পরই হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
.
০৮.
ভিন্ন ভিন্ন জাতের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বহু চুটকিলা প্রচলিত আছে।
জর্মনির দুই নম্বরের মোড়ল হারমান গ্যোরিঙ যখন বন্দি অবস্থায় রবেরগ মোকদ্দমায় আসামি তখন জেলের গারদে যেসব মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক তাকে পর্যবেক্ষণ করতে আসতেন তাদের সঙ্গে দু-দণ্ড রসালাপ করে নিতেন। এক মোকায় তিনি বলেন,
তোমরা মার্কিন। ইয়োরোপীয় জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য বুঝবে কী প্রকারে শোন :
একজন ইংরেজ শিকারি (ম্পোর্টসম্যান)
দুজন ইংরেজ একটা ক্লাব স্থাপন,
তিনজন ইংরেজ হার ম্যাজেটি কুইনের জন্য একটা কলোনি জয়।
তার পর হেসে বলতেন,
একজন ইতালীয় গাইয়ে,
দুজন ইতালীয়– ডুয়েট গাইয়ে
তিনজন ইতালীয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন! হাঃ হাঃ হাঃ।
এবারে শুনুন,
একজন জর্মন–পণ্ডিত,
দুজন জর্মন একটি নতুন পলিটিকাল পার্টি স্থাপনা (এ বাবদে অবশ্য আমরা, বাঙালিরা এখন হেসে-খেলে জর্মনদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারি।
তিনজন জর্মন? হাঃ হাঃ- বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা! তার পর ফিসফিস করে বলতেন, আর জাপানিরা।
একজন জাপানি–রহস্যময়!
দুজন জাপানি সে-ও রহস্যময়!
তিনজন জাপানি? এবারে এসে গ্যোরিঙ রহস্যপূর্ণ দৃষ্টিতে শ্রোতাদের দিকে তাকাতেন, তার পর বলতেন,
তিনজন জাপনি–সে-ও রহস্যময়। বলেই ঠা ঠা করে উচ্চহাস্য করতেন– সঙ্গে সঙ্গে তার ভালুকি থাবা দুটো দিয়ে তার বিশাল উরুতে থাবড়াতেন– যে উরুর একটা দিয়ে অক্লেশে যে কোনও বঙ্গসন্তানের দুটো কোমর হোতে পারে।
আমার এবং আমার বন্ধুজনেরও ওই ধারণা। যেন অনুভূতির কোনও বালাই-ই জাপানিদের আদৌ নেই। কিন্তু পরের পৃষ্ঠার চিঠিটি পড়ুন :
গরু কিকিয়ু।
জন্ম : ১৯১০
মৃত্যু : ফিলিপিনের যুদ্ধে, ২০ আগস্ট ১৯৫৪
স্ত্রী য়াকোকে লেখা :
মানচুরিয়া
বেশিদিন তো হয়নি তোমার সঙ্গে ছিলুম অথচ ইতোমধ্যেই তোমার সঙ্গ পাবার জন্য আবার আমার কী দুরন্তু আকুলি-বিকুলি। আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি অল্পকালই, তবু তোমার সে-সময়কার চলাফেরা-ওঠাবসার কত না ছবি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে। আর সবচেয়ে জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠ তুমি, যেখানে তুমি কোমল, মৃদু। আমাদের উভয়ের শিশুসন্তানটি জন্ম দেবার পর থেকে তুমি আরও সুন্দর হয়ে উঠেছ। তোমার সৌন্দর্যে যেটুকু শুষ্কতা ছিল সেটা রসঘন হয়ে গিয়েছে, তুমি পেয়ে গেলে এক নবীন পবিত্র সৌন্দর্য মাতৃত্বের সৌন্দর্য। আমার স্মরণে আছে সেদিনকার ছবি, যেদিন আমি টোকিও ছেড়ে চলে এলুম– সামান্য একটু প্রসাধন করে তুমি তখন বসে আছ খাটের উপর।
তখন কী সরল হাসিটি তোমার! অথচ যখন তুমি আমার কল্যাণ কামনা করে বিদায় নিতে এলে আমাদের আঙিনায়, তখন, এই বুঝি, এই বুঝি তুমি কান্নায় ভেঙে পড়বে। নিতান্ত সেই নীরবতা ভাঙবার জন্য আমি তোমাকে বললুম, সাবধান থেক। তার পর আমি ইজুমি আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়লুম। আমি তখন মনে মনে আমাদের বাড়ির দিকে পিঠ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমার ভাবনাচিন্তা তখন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। আমি হৃদয়ে হৃদয়ে অনুভব করছিলাম, আমার মাতৃভূমির সবকিছু যেন সেই সময়েই অন্তর্হিত হল। আমার এই অনুভূতিটি তোমার পক্ষে বোঝাটা হয়তো কঠিন হবে কিন্তু তুমি আমার হয়ে একবার আমার এই অবস্থাটি কল্পনায় বুঝতে চেষ্টা কর। আমার মনে হয়েছিল, ওই বিদায়মুহূর্তে যেন আমার দেহ উর্ধপানে ধেয়ে গিয়ে অনন্তে চলে গেল।
কিন্তু এখন? আজ রবিবারের এই সকালে আমার সর্ব দেহমন ধেয়ে চলেছে তোমা পানে।
বুঝিয়ে বলি; আমার হৃদয় কামনা করছে, তোমার অক্ষিপল্লব মৃদু মৃদু স্পর্শ করতে, তোমাকে শান্ত আলিঙ্গনে ভরে নিতে। তুমি যখন স্মিতহাস্য কর তখন তুমি বড় সুন্দর এবং সবচেয়ে সুন্দর তোমার দন্তপক্তি। হ্যাঁ, তোমার বর্ণ উজ্জ্বল শুদ্র নয়, কিন্তু মানতেই হবে, সে বর্ণ পরিপক্ক গোধূম বর্ণ–তোমার চর্ম সম্পূর্ণ অকুঞ্চিত কোমল। তোমার বক্ষ পূর্ণস্তন–মাতৃত্বের স্ফীতবক্ষ। এবং বর্ণ সেখানে প্রায় স্বচ্ছ ও। আমি তোমার বুকের উপর শিশুটির মতো ঘুমিয়ে পড়তে চাই। বহুবার কামনা করেছি, তোমার সুডৌল গোল বাহুতে মাথা রেখে আরাম লাভ করতে। তোমার সুন্দর সুবিন্যস্ত ওষ্ঠাধরে চুম্বন দিতে দিতে আমি মৃদু হাস্য করি আর তুমি প্রত্যুত্তরে মোহনীয়া মৃদু হাস্য দিয়ে আমাকে জাদু করছ। এরমধারা যত আমার কামনা এগিয়ে যায় ততই ভোমাকে কাছে পাবার বাসনা দুর্বার হয়ে ওঠে। না– এরকম ধরনে আমি আর লিখতে পারব না। এ লাইনটি পড়ে তুমি হয়তো হেসে উঠবে, কারণ এটা আমার স্বভাবের বিপরীত। কিংবা হয়তো তুমি আশ্চর্য হচ্ছ, তোমার কাছে আমার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে নয় কি? কিংবা হয়তো ভাবছ, আমি শিও বুড়ো খোকা এবং তাই আমাকে সোহাগ করতে চাইছনা?
এসব নির্মল স্মৃতি আমার চোখের সামনে বার বার ভেসে ওঠে আর সে-সময়কার কথা বার বার মনে পড়ে।
তোমার পূর্ণ বক্ষ আমার চোখের সামনে মায়াময় কায়া ধরে ফুটে ওঠে। আমার ইচ্ছে যায় যে নিটোল বক্ষে হাত বুলোই ধীরে অতি ধীরে–তোমার মধুর নাসিকা, তোমার মুখ চুম্বনে চুম্বনে ভরে দিই। তুমি তখন মধুর হাসি হেসে উঠবে, আমাকে আদর-সোহাগ করবে। বল দেখি, অন্য কোথা; কোথায় আছে এই বিশ্বভুবনে, এরকম হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য
সুস্থ শরীর-মনে থেক। তোমার চিত্তটিকে সৌন্দর্যময়, প্রেমময় করে রেখ। এরকম যে-মা তার কাছে আমি ফিরে আসছি শিগগিরই।
আমাকে আলিঙ্গন কর, তোমার পূর্ণ বক্ষ, উষ্ণ স্তন দিয়ে।
একটুখানি ধৈর্য ধরে থাক–ব্যস, ওইটুকু শুধু।
.
হায়! বহু যুগ পূর্বে শ্রীরাধার সখী তাকে বলেছিলেন, ধৈর্যং কুরু, ধৈর্যং কুরু গচ্ছং মম মথুরাবে কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ফিরে আসেননি।
পূর্বে নিবেদন করেছি জাপানিরা রহস্যময়। কিন্তু এ চিঠি তো আদৌ রহস্যময় নয়। এ তো সেই রামগিরির বিরহী যক্ষ, মালয়ের কবি আমির হামজার মতো উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলছে!
আর এ পত্রে প্রেম ও কামের কী অনবদ্য সমন্বয়।
.
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে ফ্রান্সে সৈন্য অবতরণ করে জর্মনি জয়ের জন্য, ইংলভ তার তাবৎ কমনওয়েলথের এবং অন্যান্য সৈন্য সেখানে জমায়েত করেছিল। তারা এসেছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আরও মেলা দেশ এবং প্রধানত, সবচেয়ে বেশি আমেরিকা থেকে।
ওই সময়ে জনৈক ক্যানাডাবাসীর পত্র- তার বউকে।
ডনালড আলবেরট ডানকান, কানাডা।
১৯৪৪ সালে, জুলাই মাসের শেষের দিকে, ফ্রান্সে সৈন্যবিতরণের সময় নিহত।
ইংল্যান্ড, ১৪ মে ১৯৪৪
…ইংল্যান্ড এখন আর ইংরেজের (জমিদারি) নয়। এ দেশটা এখন সম্পূর্ণ দখল করেছে মার্কিনরা। একই সঙ্গে চার-চারটে বেস্ বল খেলার মাঠ তৈরি হয়েছে হাইড পার্কে। ইংরেজরা অবশ্যই অনেকখানি সহিষ্ণু, কিন্তু একথা নিশ্চিত মনে বলা যেতে পারে, তারা মার্কিনদের সঙ্গে গভীর পীরিতি-সায়রে নিমজ্জমান হয়নি! মার্কিনদের কাঁড়ি কাঁড়ি কড়ি! তদুপরি কেড়ে নিয়েছে হুঁড়িদের, বাসা বেঁধেছে সেরা সেরা হোটেলে। (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ইংরেজও কড়ির পদে প্যারিসে তাই করেছিল। এই কলকাতাতেই আমরা মার্কিনদের সে রোওয়াব দেখেছি!) কিন্তু ইংরেজ করবে কী? ফ্রান্সে নেমে জর্মনিকে রাজিত করতে হলে যে ইয়াংকিদের প্রয়োজন।
ইংল্যান্ড, ২৪ জুন ১৯৪৪
…এসব তো হল, ওলো, প্রাচীন প্রিয়া (ওন্ড গারল)! বাচ্চাদের আমার হয়ে আদর দিয়ে বল, আমি ইউরোপ থেকে ওদের জন্য সুন্দর টুকিটাকি নিয়ে ফিরে আসব– যখন নিষ্প্রদীপ বিশ্ব আবার আলোকোজ্জ্বল হবে।
ফেরেনি। এক মাস পরে রণাঙ্গনে তার মৃত্যু।
.
০৯.
আডাম ফন ট্রটৎসু (Zu) জলৎসু, জর্মন।
জন্ম : ১৯০৯
মৃত্যু : ২৬ আগস্ট ১৯৪৪
হিটলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য বার্লিনের প্ল্যোসেজে কারাগারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।
ইহলোক থেকে মাতার কাছে বিদায় জানিয়ে মৃত্যুর ক্ষণকাল পূর্বে লেখা শেষ পত্র।
বার্লিন-প্ল্যোসেনজে, ২৬ আগস্ট ১৯৪৪
সবচেয়ে আদরের মা!
তবু ভালো, তোমাকে সামান্য কয়টি ক্ষুদ্র ছত্র লেখার সুযোগ শেষটায় আমি পেয়েছি– তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ; তুমি সবসময়ই আমার কাছে ছিলে, এবং এখনও আছ–আরও নিবিড় হয়ে কাছে আছ। তুমি-আমি যে অনন্ত অনন্তকালীন যোগসূত্রে বাধা, আমি সেটি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জোর আঁকড়ে ধরে আছি। এ কয়েক সপ্তাহ ধরে ঈশ্বর আমাকে তার দাক্ষিণ্য দিয়ে ভরে রেখেছেন এবং সব প্রায় সবকিছুর জন্য আমাকে আনন্দময় সরল-স্বচ্ছ শক্তি দিয়েছেন। এবং তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন এ জীবনে আমি কীভাবে, কোন কোন বিষয়ে কৃতকার্য হতে সক্ষম হইনি। কিন্তু এসবের চেয়েও সবচেয়ে বড় কথা : এই যে তোমাকে কঠিন শোক পেতে হবে, তার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি, এবং বৃদ্ধ বয়সে তুমি যে আমার ওপর নির্ভর করতে, সেই নির্ভর থেকে তোমাকে বঞ্চিত করার জন্য আমি ক্ষমা ভিক্ষা করছি।
তোমায়-আমায় আবার মিলন হওয়ার পূর্বে একটি শেষ চুম্বন–কৃতজ্ঞতা আর স্নেহ ভরা।
তোমার পুত্র তোমাকে যে বড় ভালোবাসে।
— আডাম
তোমার পূত আত্মায়, হে প্রভু আমি নিজেকে সমর্পণ করি…
ইহলোক থেকে পত্নীর কাছে বিদায় জানিয়ে মৃত্যুর ক্ষণকাল পূর্বে লেখা শেষ পত্র।
বার্লিন-গ্লোৎসেনজে, ২৬ আগস্ট ১৯৪৪
প্রিয়া কণিকা ক্লারিটা,
দুঃখের বিষয়, সম্ভবত এই আমার শেষ চিঠি। আশা করি ইতোপূর্বে লেখা আমার দীর্ঘতর পত্রগুলো তোমার কাছে পৌঁছেছে।
আর কিছু বলার পূর্বে এবং সর্বোপরি আমি যা বলতে চাই : নিতান্ত অবাঞ্ছিতভাবে তোমাকে যে গভীর শোক দিতে হল, তার জন্য আমি মাফ চাইছি।
আমি প্রত্যয় দিচ্ছি, আমি চিন্ময়রূপে পূর্বের মতো তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব, এবং দৃঢ়তম প্রত্যয় ও বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করছি।
আকাশ আজ নির্মল, ঘন নীল (পিকক ব্লু) এবং গাছে গাছে মর্মরধ্বনি। আমাদের আদর-সোহাগের মিষ্টি মিষ্টি কথা বাচ্চা দুটোকে শিখিয়ে, তারা যেন পরমেশ্বরের এ প্রতীকগুলো বুঝতে পারে এবং তাদেরও গভীরে যে-প্রতীকগুলো আছে, সেগুলোও চিনতে শেখে। –কৃতজ্ঞতাসহ, কিন্তু গ্রহণ করার সময় যেন থাকে সক্রিয় বীর্যবান সাহস।
আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি।
তার পর অনেক অনেক কিছু বলার রইল। কিন্তু তার জন্য আর সময় নেই।
ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন (আমাদের ঈশ্বর রতু-অনুবাদক) আমি জানি, তুমি কক্ষনও পরাজয় স্বীকার করবে না। আমি জানি, তুমি জীবনসগ্রামে ক্রমাগত এগিয়ে যাবে, এবং যদিও সে সংগ্রামে তোমার মনে হয় তুমি একা, তবু জেনো, আমার অদেহী স্বরূপ অহরহ তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আমি প্রার্থনা করছি, তুমি যেন শক্তিলাভ কর, তুমিও আমার জন্য সেই সেই প্রার্থনা করো। এই শেষের ক-দিনে পুরগাতোরিয়ো এবং মেরি স্টুয়ার্ট পড়বার সুযোগ আমার হয়েছিল।… এছাড়া পড়বার মতো এ ধরনের বিশেষ কিছু আমার ছিল না কিন্তু মনের ভিতর অনেককিছু উল্টে-পাল্টে দেখেছি এবং শান্তচিত্তে সেগুলো পরিষ্কার করে বুঝে নিয়েছি। তাই বলছি, আমার জন্য অত্যধিক শোক করো না–কারণ তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবে, সবকিছুই অত্যন্ত সরল, পরিষ্কার, যদিও সেগুলো গভীর বেদনাদায়ক।
আমার জানতে বড় ইচ্ছে করে, এই যা সব ঘটল, তার ফলে তোমাদের জীবনযাত্রায় কোনও পরিবর্তন হল কি না? তুমি কি রাইনবে যাবে, না যেখানে আছ, সেখানেই থাকবে? অবশ্যই তারা সকলে তোমাকে অত্যন্ত আদরের সঙ্গে গ্রহণ করবেন আমার প্রিয়া, ছোট্ট বউটি আমার! আমার পূর্বের পত্রগুলোতে তোমাকে বলেছিলুম আমার যে বহু বন্ধুবান্ধব আছেন তাদের শুভেচ্ছা জানাতে– এটা আমার অন্তরতম কামনা। তুমি ওদের সকলের সঙ্গে সুপরিচিত; তাই আমার সাহায্য ছাড়াও তুমি আমার শুভেচ্ছা ঠিকমতো তাদের জানাতে পারবে।
আমি সর্ব হৃদয় দিয়ে তোমাকে আলিঙ্গন করছি, অনুজ করছি তুমি আমার সঙ্গে আছ। ভগবান তোমাকে ও বাচ্চাদের আশীর্বাদ করুন।
তোমার প্রতি অবিচল প্রেমনিষ্ঠ,
–আডাম
এ চিঠি দুটি অন্যান্য চিঠির তুলনায় অসাধারণ বলে না-ও মনে হতে পারে। কিন্তু আম। ছিলেন অতিশয় অসাধারণ পুরুষ। অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন তিনি ছেলেবেলা থেকেই এবং হিটলার তার অভিযান আরম্ভ করার সময় থেকেই তিনি বুঝে যান, এইসব নীতি-বিবর্জিত অখ্রিস্টান আন্দোলন জর্মনি তথা তাবৎ ইয়োরোপকে মহতী বিনষ্টির পথে নিয়ে যাবে। আপন দেশে লেখাপড়া করার পর তিনি অক্সফোর্ডে রোর্ডস্ স্কলাররূপে বেলিয়েল কলেজে খ্যাতিলাভ করেন। খোলা-দিল সাদা মনের মানুষ ছিলেন বলে সেসময় তিনি একাধিক ভারতীয়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করেন। যুদ্ধের পর যখন তার পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা হচ্ছিল তখন তাঁর অক্সফোর্ডের বন্ধু শ্ৰীযুত হুমায়ুন কবীরকেও মাল-মসলা দিয়ে সাহায্য করতে অনুরোধ করা হয়।
হিটলারকে সরাবার জন্য গ্রাফ ফ স্টাউনফেনবের্গ তার পায়ের কাছে, টেবিলের তলায়, পোর্টফোলিও ভিতর একটি মারাত্মক টাইম বম্ রেখে বাইরে চলে যান। কিন্তু কিম্মৎ হিটলারকে বাঁচিয়ে দিল। যদ্যপি সেই কনফারেন্সৰুমের একাধিক লোক সঙ্গে সঙ্গে নিহত হন, হিটলারের বিশেষ কিছুই হল না।
ক্রোধোন্মত্ত হিটলার এই চক্রান্তকারীদের ওপর দাদ নেবার জন্য দোষী-নির্দোষী প্রায় পাঁচ হাজার জনকে ফাঁসি দেন। আডাম ছিলেন স্টাউনফেনবের্গের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং তাকে এই কর্মে সর্বপ্রকারের সাহায্য করেছিলেন। তারও ফাঁসি হয়।
অসাধারণ দৃঢ়-চরিত্র ধরতেন বলেই আডাম তার মা-বউকে শেষ চিঠি লেখার সময় সজ্ঞানে যতখানি পারেন অনুভূতি চেপে রেখেছিলেন- পাছে ওদের মনে আরও না লাগে। অথচ তিনি লিখতে পারতেন বড় সুন্দর মরমিয়া জর্মন।
.
ওই সময়ের অল্প পূর্বে একদল ছাত্র মুনিকে প্রথমত গোপনে, পরে অর্ধপ্রকাশ্যে হিটলারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালায়। তারই একজন ধরা পড়ে ফাঁসি যাওয়ার পূর্বে তার মাকে লেখে
মামণি,
তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছিলে, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি যখন আদ্যন্ত চিন্তা করে দেখি তখন মনে হয় আমার সমস্ত জীবন একই রাস্তা ধরে চলেছিল যার অন্তে আছেন– স্বয়ং ভগবান। এখন কিন্তু শোক করো না, যে, রাস্তার শেষাংশটুকু আমাকে এক লক্ষে পেরুতে হল। শিগগিরই আমি এ জীবনে তোমার যত না কাছে ছিলুম, তারচেয়ে অনেক বেশি কাছে চলে আসব।
ইতোমধ্যে তোমাদের সকলের জন্য একটি রাজকীয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করছি।
.
মৃত্যুর প্রাক্কালেও এরকম চিঠি! এতখানি রসবোধ! ফাঁসিতে লক্ষ দিতে হয় বই কি, আর স্বর্গপুরীতে মায়ের জন্য রাজসিক অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করবে সে।
শিশুকন্যাকে লেখা মায়ের চিঠি।
রোজে (গোলাপ) শ্যোএজিগারের জন্ম ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। নাসবিরোধী আন্দোলন চালানোর সময় ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ তিনি বন্দি হন এবং ৫ আগস্ট ১৯৪৩-এ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তার স্বামী বোডো শ্লোএজিগার ছিলেন জর্মন মিলিটারি পুলিশে দোভাষী। তার স্ত্রীর প্রাণদণ্ড হয়েছে, এ খবর পেয়ে তিনি পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।
.
আমার সোহাগের ক্ষুদে, দড়(১) মারিয়াননে।
অনুমান করতে পারছিনে তুমি কবে এ চিঠি পড়তে পারবে। তাই এটি তোমার ঠাকুরমা বা বাবার কাছে রেখে যাচ্ছি, যাতে করে তুমি বড় হয়ে এটি পড়তে পার। এখন তোমার কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতে হবে, কারণ খুব সম্ভব আমরা একে অন্যকে আর দেখতে পাব না।
তা সে যাই হোক না কেন, তুমি যেন স্বাস্থ্যবতী, সুখী এবং সবলা হয়ে বড় হয়ে ওঠো। আমি আশা করছি, পৃথিবী তার যেসব সুন্দরতম জিনিস দিতে পারে সেগুলো তুমি উপভোগ করবে–আমি যেরকম উপভোগ করেছি এবং তোমাকে যেন সেসব দুঃখ-বেদনার ভিতর দিয়ে না যেতে হয়– যেগুলোর ভিতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা : তোমাকে কর্মদক্ষ ও অধ্যবসায়ী হতে হবে। এ দুটি থাকলে বাকি সব আনন্দ-সুখ আপনার থেকেই আসে।
তোমার স্নেহ-ভালোবাসা মুক্ত হস্তে বিলিয়ে দিও না। এ সংসারে তোমার বাবার মতো কম লোকই আছে যারা তার মতো সৎ এবং প্রেমে নির্মল। তাই সমস্ত প্রেম উজাড় করে দেবার আগে একটু ধৈর্য ধরতে শেখো। তা হলে প্রেমে ধোকা খাওয়ার যন্ত্রণা থেকে তুমি বেঁচে যাবে। কিন্তু এমন একজন যেদিন আসবে, যে তোমাকে এতই গভীর ভালোবাসে যে, তোমার সব যন্ত্রণা সে-ও সঙ্গে সঙ্গে সইবে এবং যার জন্য তুমিও সইতে প্রস্তুত–এরকম পুরুষকে তুমি তোমার প্রেম নিবেদন করতে পারো। আমি প্রত্যয় দিচ্ছি, তাকে পেয়ে তার সঙ্গে যে আনন্দ তৃপ্তি তুমি উপভোগ করবে তার থেকে তুমি বুঝতে পারবে, তার প্রতীক্ষায় তুমি যে ধৈর্য ধরে ছিলে, সেটা নিফল হয়নি।
তোমার জন্যে আমি বহু বৎসরের আনন্দ প্রার্থনা করছি; আমার কপাল মন্দ, আমি পেয়েছি অল্প কয়েক বৎসরই। এবং তোমাকে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হতে হবে : যখন তোমার নবজাত শিটিকে তোমার বুকের উপর রাখবে তখন হয়তো আমার কথা তোমার স্মরণে আসবে। তোমাকে যখন আমি প্রথমবারের মতো দুবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলুম সেটি আমার জীবনের চরম মুহূর্ত তুমি তখন মাত্র একটি গোলাপি পুঁটুলি।
তার পরে স্বরণে আন, আমরা রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে জীবনের কত না গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি আমি চেষ্টা করেছিলুম তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। আবার স্মরণে আন, আমরা যে সমুদ্রপারে তিন হপ্তা কাটিয়েছিলুম–তিন মধুর সপ্তাহ। সেখানকার সূর্যোদয় এবং তোমাতে-আমাতে খালি পায়ে বেলাভুমি বেয়ে বেয়ে বাসিন থেকে উকেরিস গিয়েছিলুম; তার পর জলে রবারের দোলনাতে তোমাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলুম; তার পর আমরা দুজনাতে একসঙ্গে বই পড়তুম। বাছা, তোমাতে-আমাতে কতই না সৌন্দর্য উপভোগ করেছি এবং এগুলো তোমাকে নতুন করে উপভোগ করতে হবে, এবং তারও বাড়া অনেককিছু বেশি।
হ্যাঁ, তোমাকে আরও একটি কথা বলতে চাই, মৃত্যুবরণ করার সময় আমাদের মনে বড় বেদনা লাগে যে আমাদের প্রিয়জনকে অনেক অপ্রিয় কথা বলেছি। আমরা যদি দীর্ঘতর দিন বেঁচে থাকতে পারতুম তা হলে আমরা সেটা স্মরণে এনে নিজেদের অনেক বেশি সংযত করতে পারতুম। হয়তো আমার এ কথাটি তুমি স্মরণে রাখবে তাতে করে তোমার জীবন এবং সর্বশেষে তোমার মৃত্যু– তুমি নিজের জন্যে এবং অন্যদের জন্যেও সহজতর করে তুলতে পারবে।
এবং যতবার পার সুখী হও, আনন্দে থাক–প্রত্যেকটি দিন মহামূল্যবান!
যে প্রতিটি মুহূর্ত আমরা দুঃখে কাটাই তার জন্য হাহাকার!
আমার স্নেহ তোমার সমস্ত জীবনভর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে– আমি তোমাকে চুমু খাচ্ছি এবং যারা সবাই তোমাকে ভালোবাসে। বিদায়! বিদায়!! ও আমার সোহাগের ধন– জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমারই কথা আমার গভীরতম মেহের সঙ্গে হৃদয়ে রেখে,
—তোমার মা
———-
১. মূলে আছে ক্লাইন গ্রোস (ইংরেজিতে হবে লিটল বিগ) স্পষ্টত পরস্পরবিরোধী। তবে জর্মনরা আদর করার সময় অনেক ক্ষেত্রে এরকমধারা বলে! কিংবা হয়তো মেয়েটি বয়সে শিশু হলেও গঠনে দার্চ ধরত, যার থেকে মা অনুমান করে যে, কালে সে তন্বঙ্গী না হয়ে পূর্ণাঙ্গী হবে।
.
১১.
য়োরমা হাইসকানেন, ফিনল্যান্ড
জন্ম : ৩১ জুলাই ১৯১৪
মৃত্যু : জুন ১৯৪১
সোভিয়েত-ফিন সগ্রামে সীমান্তে নিহত সৈনিকের রোজনামচা থেকে উদ্ধৃত।
ডিসেম্বর ১৯৩৯ (ফিনিশ সীমান্তে) যুদ্ধের প্রথমদিনই আমি সুভিলাহতির গির্জা-চুড়োয় উঠলুম; সেখান থেকে আবার পর্যবেক্ষণ করব সীমান্তে যেখানে সগ্রাম চলছে… এখান থেকে স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ; অকস্মাৎ একটা চিন্তা আমাকে যেন ঝাঁকুনি দিল : ওই যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে সেখানে যে কোনও মুহূর্তে আমাদেরই একজন নিহত হতে পারে। তখন লক্ষ করলুম গির্জা-চুড়োতে আমি একা নই।
প্রতিরক্ষার জন্য রাখা একটা বালুর বস্তায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি নাবালক বাচ্চা–বয়স এই এগারো-বারো। পরনে চামড়ার কোট, হাতে একটা দুরবিন। ওইটে দিয়ে সে দক্ষিণ পানে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল– সেখান থেকে যুদ্ধের ক্ষীণ কোলাহল-ধ্বনি আসছিল। আমি তো অবাক এরকম অকুস্থলে তো ওর মতো ছোট্ট একটা বাচ্চার থাকার কথা নয়। বনের গাছগুলো ছাড়িয়ে উর্ধ্বে উঠেছে এই গির্জা-চুড়ো; যে কোনও মুহূর্তে শত্রুপক্ষের কামানের গোলা এটাকে হানতে পারে।
এখানে তুমি কী করছ?
বড় সুন্দর তাজা গলায় উত্তর এল : কেন? আমাকে তো জঙ্গি হাওয়াই জাহাজের গতিবিধি পাহারা দেবার জন্য এখানে পাঠানো হয়েছে।
তোমার বাড়ি কোথায়?
শান্তু কঠে উত্তর দিল, হাউটাভারা-য়।
আমি তাড়াতাড়ি শুধোলুম, তোমার বাপ-মা…?
অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল, যেন এ নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না– বাড়িতে বইকি!
বাচ্চাটি আমার দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাল–দুরবিন দিয়ে তদারকি-কর্ম সে তখনকার মতো ক্ষান্ত দিয়েছে।
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আমি আর কোনও প্রশ্ন শুধোতে পারছিনে। বাচ্চাটি কি জানে তার বসগ্রাম হাউটাভারা শব্দার্থে সম্পূর্ণ চিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ওই তো সীমান্তের শেষ গ্রাম। এটাতে কোনও সেনা-সেনানী নেই। কিন্তু ওরই উপর সকাল থেকে শত্রুপক্ষ সব কামান একজোট করে গোলা হেনেছে। এগ্রাম তো সম্পূর্ণ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সেখানেই তো তার বাড়ি– সে বাড়ি কি আর আছে। তার বাপ-মা পরিবারের আর পাঁচজন? তাদের সঙ্গে এর কি আর কখনও দেখা হবে?
কিন্তু সে কি জানে এ সব? না, না, আমি এ প্রশ্ন ওকে শুধোতে পারব না।
ইতোমধ্যে যুদ্ধের আগুন আরও জোরে জ্বলে উঠেছে।
তুই কি এখানেই থাকবি না অন্য কোথাও যেতে চাস?
কেন? এখানেই তো আমার থাকবার কথা নয় কি? তবে আমাকে দিয়ে আর কোনও দরকার নেই? (অর্থাৎ সে চলে যেতে চায়নি অনুবাদক)।
বহুকাল ধরে তার এই শেষ কথাগুলো আমার কানে বেজে যেতে লাগল–বহুকাল ধরে, তার কাছ থেকে, সেখান থেকে বিদায় নেবার পরও।
.
জানেন শুধু ভগবান, এই পিতৃমাতৃহীন গৃহহীন শিশু যুদ্ধের তাড়নায় কোথায় ঘুরে মরেছিল– ফিনল্যান্ডের ডিসেম্বরের দারুণ শীতে–প্রভুই জানেন, সে অন্তত আশ্রয়টুকু পেয়েছিল কি না।
জেলে থেকে বোনেদের প্রতি লেখা বোনের শেষ পত্র– কবিতায়।
… আটদিন ধরে আমি শৃঙ্খলাবদ্ধ
আমার এ অবস্থা কি কখনও ভুলতে পারব?
শেকলগুলো আমাকে নিদারুণ যন্ত্রণা দিচ্ছে।
আমাকে নির্জন কারাগারে দণ্ডিত করা হয়েছে। হে প্রভু, তুমি আমাকে ত্যাগ করছ কেন?… (খ্রিষ্ট নাকি ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় এই হাহাকারই করেছিলেন অনুবাদক)
আমার বোনেরা মিমি, মিনা– তোমরা কি এখনও তোমাদের বোন লোরেনকে স্বরণে আন,
সে তোমাদের ভালোবাসে।
দুঃখবেদনা আমাদের সম্মিলিত করে একই পথে চালাবে,
এই তো ছিল আমাদের শপথ এবং একই অনুভূতি আমরা ভাগাভাগি করে নেব।
আমাকে তারা শিকল দিয়ে বেঁধেছে, কিন্তু আমার হৃদয়টাকে নয়।
আমি আশা রাখি, আমি বিশ্বাস রাখি, আলোকে আলোকে আলোকিত সূর্যরশ্মিময় ভবিষ্যৎ।
কাল যদি আমার মৃত্যু হয়।
তবে কীই-বা হবে?
শুধু আমি মুক্তি পাব আমার পায়ের শৃথল থেকে!
এই মেয়েটির নাম লোরেনস– বোনেদের নাম মিমি, মিনা। কিন্তু পারিবারিক নাম চিঠিতে নেই বলে এদের কাউকেই শনাক্ত করা যায়নি। যেটুকু জানা গিয়েছে তা এই :
ফ্রান্স জয় করার পর জর্মনি তার বৃহদংশে আপন রাজত্ব চালায়। তখন সে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে আন্ডারগ্রাউন্ড সংগ্রাম চলে মাদমোয়াজেল লোরেন তারই একজন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অবশ্য মৃত্যু আসন্ন জেনে এই তার শেষ পত্র।
.
১২.
রণদামামা বাজিয়ে সগর্বে যখন ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বরে হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করলেন তখন তিনি বার্লিনের প্রধানতম রাজপথের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ ও নিরাশ হলেন। তার মনে পড়ল ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-সূচনার কথা। তখন কী উৎসাহ-উত্তেজনার সঙ্গে কাইজারের সেই যুদ্ধং দেহি আবানে জর্মনির জনগণ সাড়া দিয়েছিল।(১) তারা যে এবারে তার এবং গ্যোবেলস্-এর কর্ণপটহবিদারক শত প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও এরকম জড়ভরতের মতো চোখেমুখে নির্বিকার ঔদাসীন্য মেখে পোলাভগামী যুযুধানদের দিকে শুধুমাত্র তাকিয়েই থাকবে– ঘন ঘন সাধুবাদ, করতালি, স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম-সঙ্গীত, প্রজ্বলিত মশালসহ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে কদম কদম বাড়িয়ে তাদের সকলকে শুভেচ্ছা জানানো, সৈন্যদের ধরে ধরে পথমধ্যে তরুণী যুবতীদের যদৃচ্ছা চুম্বনালিঙ্গন কিছু না, কিছু না, সব ঝুট সব ঝুট; হিটলার ও ইয়ার গ্যোবেস তো রীতিমতো মুষড়ে পড়েছিলেন।
আসলে জনগণ সংগ্রাম চায়নি; তারা চেয়েছিল শান্তি। বিশেষ করে হিটলার তার বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা, দূরদৃষ্টি-প্রসাদাৎ, বছর তিনেক পূর্বে দেশকে যে আর্থিক সাচ্ছল্য এনে দিয়েছিলেন তারা চেয়েছিল নির্বিঘ্নে শান্তিতে সেটি দীর্ঘকালব্যাপী উপভোগ করতে। আর ভবিষ্যতে সুখভোগের জন্য হিটলার যেসব গণ্ডায় গণ্ডায় অঙ্গীকার করে বসে আছেন, সেগুলোর তো কথাই নেই। তার অন্যতম, বছর তিনেকের মধ্যে তিনি জনির চাষি-মজুর প্রত্যেক পরিবারকে এক-একখানি সরেস ফল্কভাগেন (volkswagen-folk-car জনগণরথ) দেবেন– বস্তুত তখন থেকেই অনেকে আগাম কিস্তি-আমানত দিতে শুরু করেছে। মোটরগাড়ি তা হলে শিকেয় উঠল।
বললে প্রত্যয় যাবে না, সুশীল পাঠক, এই যে জনির প্রাশান অফিসারগোষ্ঠীকে বহু বহু যুগ ধরে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রণবিশারদ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, তাদেরও অধিকাংশই এ সংগ্রাম চাননি। এদের একাধিক জন সগ্রাম আসন্ন জেনে, এরই এক বৎসর পূর্বে, হিটলারের সমুখে তীব্র প্রতিবাদ তুলে নিরাশ হয়ে আপন আপন পদে ইস্তফা দেন। আর অর্থনৈতিকদের তো কথাই নেই। শাখট-এর মতো অর্থনৈতিক জাদুকরও যখন দেখলেন হিটলার তার সাবধানবাণী শুনলেন না তখন তিনিও অবসর গ্রহণ করলেন। তার বক্তব্য ছিল হিটলার ক্ষুদ্র রাজ্য পোলাভকে আক্রমণ করে যদি আশা করেন যুদ্ধ সেই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে তবে সেটা মারাত্মক ভ্রমাত্মক দুরাশা। সেই খণ্ড-যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হবেই হবে। এবং সেই সুদূরপ্রসারী দীর্ঘকালব্যাপী বিশ্বসংগ্রাম চালাবার মতো কাঁচামাল-মেটিরিয়েল জর্মনির নেই। (এবং শেষটায় প্রধানত এই কারণেই হিটলারের পতন হয়, এবং তিনি ক্রোধোন্মত্ত স্যামসনের ন্যায় সমস্ত গাঁজা– এস্থলে তাবৎ ইয়োরোপ– তাঁর বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে রসাতলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
শুনেছি, যেখানে হোক, যে কোনও প্রকারেই হোক একটা লড়াই বাধিয়ে দেবার জন্য হামেহাল ভেরিয়া হয়ে থাকে একটি গোদা দল অস্ত্রশস্ত্র-নির্মাণকারী বিরাট বিরাট কারখানার মালিকগণ। শুনেছি এরা নাকি গ্যাটের কড়ি খরচা করে অনুন্নত দেশে সিভিল উয়োর লাগিয়ে দিয়ে পরে হরষিত হৃদয়ে উভয় পক্ষকেই বন্দুক কামান বোমা বিক্রি করে খরচার হাজারগুণ মুনাফা তুলে নেয়। (শকুনির যদি এ প্রকারের সুবুদ্ধি থাকত তবে সে নিশ্চয়ই গো-কুলে মড়ক লাগাত।)
এস্থলে কিন্তু শুনেছি, সমরাস্ত্র নির্মাণকারী জর্মনরাও হিটলারের যুদ্ধ কামনা করেননি। এদের অধিকাংশই জানতেন, এ যুদ্ধে জয়াশা নেই। ফলে মুনাফা তো যাবেই যাবে, তদুপরি শত্রুপক্ষ দেশ দখল করে এস্তেক কারখানাগুলোর সমুচা যন্ত্রপাতি স স্ট ব্যারেল আপন আপন দেশে চালান দেবে।
তারা অবশ্য তখন জানতেন না, ধন তো যাবেই, প্রাণ নিয়ে টানাটানি লাগবে।
এবং তা-ও হয়েছিল– ইতোপূর্বে যা কখনও হয়নি যুদ্ধ শেষে মিত্রপক্ষ এইসব ডাঙর ডাঙর অস্ত্রপতিদের বিরুদ্ধে জোর মকদ্দমা চালায়; রিবেট্রপ, কাইটেল ইত্যাদিকে ফাঁসি দেবার পর। জেল তো এঁদের অনেকেরই হয়েছিল– ফাঁসি হয়েছিল কি না, আমার মনে নেই। (অবশ্য শুনেছি, এখন ফের তারা, অথবা তাদের বংশধররা—-বন্দুক কামান তৈরি করে ক্ষণে বেচেন মিশরকে ক্ষণে ইজরাএলকে!)
এবং পাঠক আরও প্রত্যয় যাবেন, হিটলারের আপন খাস চেলা-চামুণ্ডাদের অনেকেই এ যুদ্ধ চাননি!–মায় তার দুনম্বরি ইয়ার বিমান-বহরাধিপতি গ্যোরিং। এঁরা মোকা পেয়ে কলাকৌশলে তখন এতই ধনদৌলত জমিয়েছেন যে, বার্লিনের কুটি সম্প্রদায় এদের ঢপ-বেটপের ঢাউস মেরসেডেজ মোটর দেখতে পেলে কখনও চেঁচিয়ে, কখনও আপিসে মৃদুস্বরে বলত মহারাইশা!–মহারাজা শব্দের জর্মন উচ্চারণ। গ্যেবেস তো একবার উচ্চ কণ্ঠেই বললেন, এদের যদি এখন জুস্ প্রিমে নটি দেওয়া হয় তবেই এরা সর্বার্থে মধ্যযুগের ব্যারন হয়ে যাবে। জুস প্রিমে নটি আইনের অর্থ : প্রথম রাত্রির অধিকার। মধ্যযুগের বহু ব্যারনের অধিকার ছিল তার জমিদারিতে যত কুমারী কন্যা বিয়ে করবে, বিয়ের প্রথম রাত্রি তাদের কাটাতে হবে ব্যারনের শয্যায়।(২)
এরা অবশ্যই অন্তরে অন্তরে যুদ্ধ কামনা করেনি বাইরে যতই লম্বা কোঁচা চড়াক।
তবে একথা ঠিক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ হিটলারমন্ত্রে আবাল্য দীক্ষিত উষ্ণমস্তক (মস্তিষ্ক এদের ধোলাই করে ফেলা হয়েছে, যাকে বলে ব্রেনওয়াশ, তাই বললুম মস্তক, খুলি আরও ভালো) নিম্ন সরকারি সেনাদলের এস-এস-এর অনেকেই যুদ্ধ কামনা করেছিল।
কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের ওই তো একটা মস্ত সুবিধা অসুবিধা যা খুশি বলুন। ক্যাবিনেট ডাকতে হয় না, পার্লিমেন্ট নেই, আর প্লেবিসিটের তো কথাই ওঠে না। হিটলার, নেপোলিওন, স্তালিনকে রোকে কে?
.
মুসসোলিনির যুদ্ধ ঘোষণাটা হয়েছিল আরও মারাত্মক জনমতের বিরুদ্ধে। এমনকি তার আপন জামাই, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাননা পর্যন্ত জর্মনদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নামতে রাজি হননি। মুসসালিনি শেষটায় তাকে জাতিকান-এ রাজদূত বানিয়ে দেন। আর ইতালির রাজা এবং রাজপরিবার যে কট্টর হিটলারবিরোধী ছিলেন সেকথা ইতালির মাক্কারনি-খেকো চাষাটা পর্যন্ত জানত, স্বয়ং হিটলারের তো কথাই নেই। বার্লিনে যখন ইতালির রাষ্ট্রদূত হয়ে এলেন জর্মনির প্রতি মোটামুটি সহানুভূতিশীল–দুষ্টুবুদ্ধিতে অবশ্য রামপন্টক–দিনো আলফিয়েরি, তাকে পর্যন্ত কি হিটলার কি রিবেট্রপ তাদের পক্ষে কনভারট করতে পারেননি।
মুসসসোলিনির চলল একটানা পরাজয়ের পর পরাজয়। শেষটায় তার আপন ফাশি-মণ্ডলী দলীয় সভায় তার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব পাস করল (এটা অবশ্য নাৎসি জর্মনিতে ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়) এবং তার প্যারা মেয়ের স্বামী শ্রীমান চাননা ছিলেন দুই নম্বরের ষড়যন্ত্রকারী। মোকা পেয়ে ইতালির রাজা মুসসোলিনিকে বন্দি করলেন। ফাশি রাজ্য লোপ পেল। কিছুদিনের মধ্যেই রাজা যুদ্ধবিরতির আদেশ দিলেন (৮ সেপ্টেম্বর ইতালির ভ্রাতুযুদ্ধের উল্লেখ করতে গিয়ে আমি পূর্ববর্তী অনুবাদে এ তারিখের গুরুত্বের কথা বলেছি)।
ইতোমধ্যে মিত্রশক্তি সম্পূর্ণ উত্তর আফ্রিকা জয় করে নেমেছে খাস ইতালিতে।
কিন্তু হিটলারও কিছু কম যান না। তার ছলাকৌশল ও দুঃসাহস পরিপূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করে যে প্ল্যান বানালেন সেইটে প্রয়োগ করে, গত বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে দুঃসাহসী জন বিমানচালক করুদজেনি এক পাহাড়ের চুড়োয় অ্যারোপ্লেন নামিয়ে মুসসোলিনিকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে এলেন হিটলার সমীপে।
মুসসোলিনির তুবড়িতে কিন্তু এখন আর বৃত্তির বারুদ নেই। তিনি নির্বিবাদে জীবনের শেষ কটা দিন তার প্রিয়া কারা পেচ্চির সঙ্গে কাটাতে চান। কিন্তু হিটলার বাণ্ডার হয়ে আছেন; বাধ্য হয়ে মুসসোলিনিকে নতুন ফাশি পার্টি নির্মাণ করে উত্তর ইতালিতে রাজ্যস্থাপনা করতে হল। সেটা চলল পরিপূর্ণ জর্মন তাঁবেতে।
ইতালি তখন মার খাচ্ছে চতুর্দিক থেকে। মিত্রশক্তি জর্মনদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এগিয়ে চলেছে ইতালির ভিতরে। ইতালীয়রা লড়তে চায় না। দুই কুত্তা যখন একটা হাড়ি নিয়ে লড়ে তখন হাড্ডিটা (অর্থাৎইতালি) তো কোনও পক্ষ নিয়ে লড়ে না। কিন্তু জর্মন সৈন্য ইতালীয়দের জোর করে ধরে নিয়ে পিছনে সঙিন বসিয়ে তাদের লড়াল।
আর যারা বাধ্য হয়ে পড়ল তাদের মা-বউকে গায়ে গায়ে বিনা বিচারে গুলি করে মারল প্রধানত ফাশিবিরোধী কমুনিস্টরা। এরই একটি নিদারুণ কাহিনী আমি প্রকাশ করি ১৯৬১-৬২ সালে।
তখন অবতরণিকায় লিখি :
মিত্রপক্ষে ও জৰ্মনিতে তখন– জুলাই ১৯৪৪–জোর লড়াই চলছে। এবং জর্মনদের পিছনে ইতালীয় গেরিলারা (এদের কিছুটা কম্যুনিস্ট, বাকিটা ফ্যাসিস্ট ও নাৎসি-বিরোধী) যেমন জর্মনদের বিরুদ্ধে তীব্র গোপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তেমনি আপন দেশবাসী ফ্যাশিস্ট ও জর্মন মিত্রদের (অধিকাংশ ক্ষেত্রে তোর চোটে) বিরুদ্ধেও। এবং দেশবাসীর বিরুদ্ধে লড়াইটাই হয়ে উঠেছিল তীব্রতর, তিক্ততর। রাজনৈতিক আদর্শবাদের জিগির তুলে সবাই আপন আপন শনিধনে লেগে আছে। ইতালি প্রতিশোধের দেশ এমনিতেই আইন আদালত থাকাকালীনও– আর এই অরাজকতার সময় তো কথাই নেই।
.
এমনিতে কিন্তু ইতালীয়রা শান্তিকামী।
তাই তারা খেল গত যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মার।
———–
১. হিটলার স্বয়ং সেই জনতায় ছিলেন। অধুনা এই মহানগরীতে প্রদর্শিত একটি হিটলার-ছবিতে সেটি দেখানো হয়েছে। আসলে যে ফটো থেকে এ অংশ তোলা হয়েছে সেটি পাঠক পাবেন, ফটোগ্রাফার হফমান রচিত হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড পুস্তকে।
২. অনুসন্ধিৎসু পাঠক এ সঙ্গে হুতোম প্যাচার নক্শা কেতাবের গুরুপ্রসাদী অংশটুকু পড়ে দেখবেন।
.
১৩.
ব্যক্তিগত কথা বলতে বাধে। কিন্তু প্রাগুক্ত মহিলা তার শোক সংবরণ করে তার সম-দুঃখে-দুঃখী হৃদয়ের প্রকাশ দেওয়াতে আমিও কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয় করে আপন অভিজ্ঞতা নিবেদন করি।
আমি বার্লিন যাই ১৯২৯-এ। হিটলার তখন মুনিকের স্থানীয় উষ্ণমস্তিষ্ক রাজনৈতিক পাণ্ড মাত্র। ১৯৩০-এ আমি রাইনল্যান্ডের বন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। সেখানে হিটলারের কোনও প্রতিপত্তি ছিল না বললেই চলে।
বন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার গভীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হয় আমার এক সতীর্থ পাউল (Paul) হরস্টারের সঙ্গে। সে পড়ত আইনশাস্ত্র এবং সঙ্গে সঙ্গে তুর্কি ও আরবি-ইচ্ছা ছিল ডক্টরেট নেবার পর ফরেন আপিসে ঢুকবে। আমারও অপশনাল ছিল আরবি। সেই সূত্রে উভয়ের পরিচয় ও অত্যল্পকালের মধ্যেই গভীর সখ্য…। পাউলের বাপ-মা বাস করতেন নিকটবর্তী ডফ শহরে। এক উইক-এন্ডে সে আমায় নিয়ে গেল তাদের বাড়িতে। মা কখনও ইন্ডিয়ান দেখেননি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মন স্থির করতে পারছেন না, আমার জন্য কোন কোন কন্তু রান্না করবেন। আমরা সবাই রান্নাঘরে বসে– কোন একটা কথাচ্ছলে পাউল বলল যে, আমার মা সুদূর ভারতে প্রতিদিন আমার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করছে। শোনামাত্র পাউলের মা তার দু হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে দ্রুতপদে চলে গেলেন পাশের ঘরে।
অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে ফের রান্নায় মন দিলেন।
সন্ধেবেলা ড্রয়িংরুমে কফি আর গৃহনির্মিত অতুলনীয় ক্রিমবান (পাটিসাপটার অতি দূর-সম্পর্কের ভাই) খাচ্ছি এমন সময় একটি অতিশয় সুপুরুষ যুবক এসে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে একটি সুন্দরী। কিন্তু এ যুবক যত্রতত্র সর্বত্র যেরকম পুরুষ-নারী উভয়ের বিমোহিত দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সঙ্গের যুবতীটি ততখানি না। পরস্পরের পরিচয়দির লৌকিকতা অবহেলে, সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সোজাসুজি আমার কাছে এসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, আমি আপনাকে চিনি; পাউলের বন্ধু। আর আমি ওই রাসকেলটার দাদা কার্ল। এবং এই রমণীটি আমার শিরঃপীড়া, অর্থাৎ আমার ভামিনী।
আমি ঘন ঘন হাত ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললুম, আমার কাছে শিরঃপীড়ার অত্যুত্তম ভারতীয় হেকিমি দাওয়াই আছে। দেব আপনাকে। কিন্তু ডাক্তারের ফি দিতে হবে। শিরঃপীড়াটি দূরীভূত হলে সেটি অপরাধ নেবেন না, স্যর সেটি কি আমি পেতে পারি?
কার্ল তো তার পাঁজরের দু পাশ দু হাত দিয়ে চেপে ধরে, কোমরে দু ভাজ হয়ে দুলে দুলে গমগম করে হাসে আর বার বার বলল, আমার তো ধারণা ছিল, পুরবীয়ারা (প্রাচ্যদেশীরা) রসিকতা করতে জানে না– সর্বক্ষণ মোক্ষ, নির্বাণ, স্যালভেশনের চিন্তায় মশগুল! তা, ব্রাদার, কিছু মনে কর না। আমার শিরঃপীড়ার একটি কনিষ্ঠা ভগিনী আছে- একেবারে কামানের গোলা। গেল বছরে মিস্ রাইনল্যান্ড হয়েছেন। নেবে সেটি?
ইতোমধ্যে লক্ষ করলুম কার্লের বউ লজ্জায় একেবারে পাকা টমাটো!
ঝপ করে একটা সোফাতে বসে বলল, কিন্তু তোমাতে-আমাতে আর আপনি চলবে না। বুঝলে? তার পর, হা, কী যেন বলতে এসেছিলুম। আজ সন্ধ্যায় আমার ফ্ল্যাটে পার্টি। পাউল তোমাকে নিয়ে আসবে। ঠিক আছে তো!
আমি বললুম, অতি অবশ্যই। প্লেজার অনার। কিন্তু সেই যে আরেকটি শিরঃপীড়ার কথা বলছিলেন, তিনিও আসবেন কি?
তার পর আর কাকে পায় কে? তার হাসি আর কিছুতেই থামতে চায় না।
শেষটায় কার্ল তার বউকে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল, মায়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিই। তার পর বউকে ফিসফিস করে শুধোল, ওকে তো ডাকা হয়নি। লাস্ট মোমেন্টে আসতে পারবে কি? তুমি দেখ তো।
উত্তরের প্রতীক্ষা না করে সোজা গিয়ে মায়ের কোলে দুম্ করে বসে পড়ল– ট্যারচা হয়ে। বাঁ হাত দিয়ে মায়ের বা বাহু চেপে ধরে, ডান হাত দিয়ে মায়ের ঘাড় পেঁচিয়ে নিয়ে মায়ের গালে ঘন ঘন চুম্বন।
স্পষ্ট শুনতে পেলুম, মা বলছেন, ওরে গরিল্লা, ওঠ, ওঠ, আমার লাগছে!
আমি জানতুম, তখন সে ঘরে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় জন আমি- যদ্যপি আমি কোনও পির প্যাকম্ব নই– নিতান্ত বিদেশি এবং তারও বাড়া ভারতীয় বলে। তাই আমি অক্লেশে বুঝতে পারলাম, কার্ল আমাকে ছেড়ে তার মায়ের কাছে চলে গেল কেন। সামান্য ড্রইংরুমে কে কার পাশে বসে, তাতে কি-বা যায়-আসে! কিন্তু সে তার মাকে বোঝাতে চেয়েছিল, যে-ই আসুক যে-ই থাক, তার কাছে তার মা-ই সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
কার্লের বউ ক্লারা আমাকে বলল, আমার বোন নিশ্চয়ই আসবে। তার অন্য এনগেজমেন্ট থাক আর না-ই থাক।
আমি বললুম, তার অন্য এনগেজমেন্ট হয়তো তার লাভার, তার ইয়ংমানের সঙ্গে। তাকে নিরাশ কাটা কি উচিত হবে, এই আনন্দের দিনে? তাকেও ডাকুন না অবশ্য যদি আপনাদের অন্য কোনও সুবিধা না থাকে।
ক্লারা আমার দিকে বিস্মিত নয়নে তাকাল।
আমি বুঝতে পেরেছি।
আমি শান্ত কণ্ঠে বললুম, আপনি ঘাবড়াচ্ছেন যে আমাতে আর আপনার বোনের লাভারেতে খুনোখুনি হবেনা? নিশ্চিন্ত থাকুন, কিচ্ছুটি হবে না। সে কি আপনার বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব পেড়েছিল?
এ যাবৎ করেনি। কেমন যেন গড়িমসি করছে।
দৃঢ় কণ্ঠে আমি বললুম, আজ রাত্রেই সে প্রস্তাব পাড়বে।
???
আমি আপনার বোনের সঙ্গে একটুখানি ভাবসাব করতেই সে রেগে, চটে, হিংসায় জর্জর হয়ে, আমাকে ঢিড় দেবার জন্য আজ রাতদুপুরেই সে প্রস্তাব পাড়বে। হল?
সে সন্ধ্যায় কার্লের বাড়িতে জব্বর পার্টি হল। আমার তিনটি জিনিস মনে আছে।
কার্ল যখন আমাদের নাচের জন্য পিয়ানো বাজাচ্ছিল তখন আমার নজর গেল তার হাত দু পানির দিকে। সেই হাতের আঙুলগুলো তঙ্গী দীর্ঘ, অথচ সেগুলোর তুলনায় বাকি হাত আরও ছোট। এতে যেন কোনও পোপরশন নেই। কিন্তু কী সুন্দর! এরকম হাতের বর্ণনা দেবার শক্তি আমার নেই। বারবার আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল আমার মায়ের হাত দুটি।
.
গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছি।
এমন সময় কে যেন আমার খাটের বাজুতে এসে বসল। আধো ঘুমে শুধালুম, কে?
আমি পাউলের মা। আমি শুধু বলতে এসেছিলুম, এই যে আমার পাউল, সে সপ্তাহের ছ দিন থাকে বন শহরে, প্রতি শনিবার ছুটে আসে আমার কাছে। আর বন তো এখান থেকে দূরে নয়। ডাকগাড়িতে আধঘন্টার পথ মাত্র। তবু আমি এই ছ দিন কী ছটফটই না করি।
আর তোমার মা? তিনি থাকেন কত সমুদ্রের ওপার।
তার দিন কাটে কী করে?
তুমি খুব তাড়াতাড়ি পাস দিয়ে বাড়ি চলে যাও।
তার পর আমার কপালে চুমো দিলেন। আমার মনে হল, এ তো আমারই মায়ের চুমো।
.
১৪.
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে অকস্মাৎ অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে হিটলারের দল জর্মন পার্লিমেনটে এত অধিক সংখ্যক আসন পেয়ে গেল যে তার গুরুত্ব জর্মনির বাইরে তো বটেই, ভিতরে অল্প লোকই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল। কম্যুনিস্টরা ঠিক-ঠিকই বুঝেছিলেন কিন্তু স্তালিন তখন আপন ঘর সামলাতে ব্যস্ত এবং বিশ্বস্বনজোড়া প্রলেতারিয়া রাজ্য স্থাপনের সদিচ্ছা তিনি তখন প্রায় ত্যাগ করেছেন। জর্মন কম্যুনিস্টরা বাতুশকা স্তালিনের কাছ থেকে সাহায্য পেল অত্যল্পই।
পাঠক হয়তো আশ্চর্য হবে যে, আমার সতীর্থ পাউল হস্টারের অগ্রজ কাল কিন্তু ঠিক-ঠিক বুঝে গিয়েছিল, দেয়ালে কী লিখন লেখা হয়ে গেল
আকাশে বিদ্যুত্বহ্নি কোন অভিশাপ গেল লিখি।
১৯৩২-এর বড়দিনের পরবে গেলুম ড্যুসলডর্ফ।
রান্নাঘরে বসে কার্ল-পাউলের মার সঙ্গে রসালাপ করছি।
এমন সময় কার্ল এসে ঘরে ঢুকল। প্রথম মাকে গণ্ডা দুই চুমো খেয়ে আমাকে দিল গণ্ডাখানেক। কুশলাদির লৌকিকতা বর্জন করে সরাসরি শুধাল–
হেই, ভাইয়া, জর্মন পলিটিক্স কিছু রপ্ত করতে পেরেছিস?– এক বছর তো হয়ে গেল এই লক্ষ্মীছাড়া দেশে এসেছিস?
আমি উন্মা প্রকাশ করে বললুম, পফুই (অর্থাৎ ছিঃ!), এমন কথা বলতে নেই। মুখে ঘা (কুণ্ঠ ঘা-টা আর বললুম না) হবে। জর্মনি কান্ট-গ্যোটে, বেটোফেন ডুরারের দেশ। কিন্তু, বাওয়া, তোমাদের পলিটিক্সের জট ছাড়ানো আমাদের গান্ধীরও কম্ম নয়। হালে একখানা চটিবই কিনেছি। জর্মনের ছাব্বিশ না আঠাশখানা পার্টির (বাপস!) ঠিকুজি-কুলজি দপে দপে তাতে বয়ান আছে। পড়েছিলুম কবে! এখানও মাথাটা তাজ্জিম-মাজ্জিম করছে।
পরম অবহেলা ভরে বলল, ছেঃ! তোদের না থ্রি হানড্রেড মিলিয়ান গডেসেস আছে! হিসাব রাখিস কী করে? তোদের আবার লাকি দেশ– কার্ড ইনডেকসিঙের গব্বযন্তনা সেখানে এখনও পৌঁছয়নি। তা সেসব কথা যাক। ইতোমধ্যে তোকে একটি মহামূল্যবান সদুপদেশ দিচ্ছি– তোর সেই রাম আহাম্মুখীর সাক্ষাৎ ডক্টরেট-সার্টিফিকেট ওই পার্টি পঞ্জিটি সিকি দরে বিক্রি করে দে– তোর চেয়েও প্রাইজ-ইম্বোইল এ দেশে রাইন নদের সামোন মাছের মতো আবজাব করছে। নইলে শিকের হাঁড়িতে (ওদের ভাষায় মাটির নিচের সেলারের কয়লা গুদোমে) তুলে রেখে দে। দরকার মাফিক ওরই পাতা ছিঁড়ে ঘরের স্টোভে আগুন ধরাবি। কিন্তু সেকথাও থাক। আসল তত্ত্বকথাটা শোন।
তার পর সত্যি অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে বলল– কার্লকে এই প্রথম আমি গম্ভীর হতে দেখলুম– বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। জানিস, হিটলার রাইখস্টাগে অনেকগুলো সিট পেয়ে গিয়েছে।
আমি হেসে উঠলুম। এ যেন পর্বতের মূষিকপ্রসব!
ইতোমধ্যে পাউল রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল। লক্ষ করলুম, আমার হাসির সঙ্গে হামদরদী দেখিয়ে দোহারের মতো স্মিত হাস্য সে করল না– যা সে আকছারই করে থাকে। মায়ের মুখে কোনও ভাবের খেলা নেই।
কার্ল কোনওদিকে খেয়াল না করে আমাকে সরাসরি শুধোল, তুই হিটলারের মাইন কামপফ (বাঙলাতে মোটামুটি আমার সংগ্রাম) পড়েছিস?
আমি হাত জোড় করে বললুম, রক্ষে দাও বাবা! ও বই আদ্যন্ত পড়া আমার কর্ম নয়। একে তো তোমাদের এই জর্মন ভাষাটি এমনই প্যাচানো-জড়ানো, ইংরেজিতে যাকে বলে ইনভলভড, এবং নিদেন বিশ-ত্রিশটি লাইনের ন্যাজ না খেলিয়ে তোমাদের একটা সেনটেন্স সম্পূর্ণ হয় না, তদুপরি তোমাদের ওই হিটলারবাবু যেন মাথায় গামছা বেঁধে বেল্ট টাইট করে, মোজা উপর বাগে টেনে নিয়ে, গণ্ডারের চর্বির টনিক বেয়ে উঠেপড়ে লেগে গেছেন, সরল জিনিস কী কৌশলে দুরহ করা যায় অবশ্য আমার জর্মন জ্ঞান যা, সেটা তো নাথিং টু রাইট হোম এবাউট! তবে, হ্যাঁ, বিস্তর হোঁচট খেয়ে চোট-জখম হজম করে খাবলা মেরে মেরে মোদ্দা কথা কটি ধরে নিয়েছি।
কার্ল মাইন কামপফ-এর ভাষা বাবদ সায় দিয়ে বলল, তোর জর্মন ভাষা-জ্ঞানের কথা উঠছে না। ওই আকাট ব্যাটা হিটলার তো আসলে কথা কয় পশ্চিম অস্ট্রিয়ার অতিশয় চোতা জর্মন ডাইলেক্টে। তদুপরি তার গায়ে রয়েছে চেক রক্ত, কেউবা বলে দু-চার ফোঁটা ভ্যাগাবন্ড জিপসি নাপাক খুনও তাতে মেশানো রয়েছে। এরকম দু-আশলা, সাড়ে তিন আশলা লোক, তদুপরি উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে সে আবার লিখবে জর্মন? তা তার লেখার ধরন যত না মারাত্মক, তার চেয়ে তার প্রোগ্রামটা ঢের ঢের বেশি মারাত্মক। ইহুদি জাতটাকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে, ফ্রান্স দেশটাকে উড়িয়ে দিতে হবে এবং সর্বশেষে রাশার বৃহদংশ দখল করে সেখানকার চাষাভুষোদের রীতিমতো গোলাম বানিয়ে, যাকে বলে স্লেভ লেবার, জর্মনদের জন্য ফোকটে দেদার দেদার রুটি মাখন আণ্ডা বেকন লুট করতে হবে। সে-ও না হয় বুঝি, এই বিরাট দুনিয়ায় কত না তরো-বেতরো গুণ্ডা-গ্যাংগস্টার হয়– অতি অবশ্য আমার ধর্ম-বুদ্ধি এতে একদম সায় দেয়, কিন্তু যে করাল বিভীষিকা আমি চোখের সামনে দেখছি সেটা এই যে, হিটলারের এই শয়তানি স্বপ্ন সফল তো হবেই না, মাঝখান থেকে লক্ষ লক্ষ জর্মন যুদ্ধে মারা যাবে, তাবৎ জর্মন দেশটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে এই যে–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ব্রাদার কার্ল, এসবের অধিকাংশ ভোট পাবার জন্য পোলিটিক্যাল প্রোপাগান্ডা। আমাদের রাজা ইংরেজ বলে, তাদের খেদমত করলে খুব শিগগিরই আমরা সবাই রাজা হয়ে যাব, কংগ্রেস বলে, ইংরেজকে তাড়িয়ে দিলে আমরা রাজা না, মহারাজা হয়ে যাব। আমি অবশ্য জিনিসটা বড্ড ক্রুড ভাষায় বলছি। কম্যুনিস্টরা বলে—
হঠাৎ লক্ষ করলুম, কার্লের মুখের উপর দিয়ে যেন একটা উড়ো মেঘের ছায়া পড়ে মিলিয়ে গেল। আমি শুধালুম, কার্ল, তুমি কি কমুনিস্ট
এককালে ছিলুম। বছর দুই হল পার্টি মেম্বারশিপ রিজাইন দিয়েছি। ওই সময় থেকে চাদাও আর দিইনি।
কেন?
সেকথা আরেকদিন হবে।
.
গোটা ১৯৩১টা আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে আমি এমনই ব্যস্ত ছিলুম যে, ডুসলডর্ফ যেতে পারিনি। এমনকি ১৯৩১-এর বড়দিনটাতেও ফুরসত করে উঠতে পারলুম না।
১৯৩২ পরীক্ষা পাস করে জর্মনি ত্যাগ করার পূর্বে একদিনের তরে ডুসলডর্ফ গেম হরস্টার পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য। আমার কপাল মন্দ, কার্ল শহরে ছিল না। বড় বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, বন হয়ে ইতালিতে এসে জাহাজ ধরলুম।
১৯৩২ কেটে গেল। পাউলের চিঠিপত্র পাই।
১৯৩৩-এর জানুয়ারি মাসে হিটলার জর্মনির চ্যান্সেলর বা কর্ণধার হলেন।
তার দু মাস পরে পাউলের একখানা অতি ক্ষুদ্র চিঠি পড়ে আমি স্তম্ভিত। কালকে জর্মনির গোপন পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়ে নির্জন কারাবাসে রেখেছে। বেল পাওয়ার কোনওই আশা নেই। তার বিরুদ্ধে গোপন বা প্রকাশ্য কোনও আদালতে যে মকদ্দমা উঠবে তার সম্ভাবনাও অতিশয় ক্ষীণ।
.
১৫.
১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফেরার পর ৩৩-এর সম্পূর্ণ বছরটি কাটাই দেশের ছোট শহরে মায়ের সঙ্গে। সুদীর্ঘ, প্রায় তিন বছর পর ফের মায়ের কাছে ফিরে এসেছি। এর পূর্বেও, অর্থাৎ ১৯২১ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত আমি মায়ের কাছে এসেছি পুজো আর গরমের ছুটিতে, মাত্র কয়েকদিনের, কয়েক সপ্তাহের জন্য। আমি পেয়েছি মায়ের সঙ্গ-সুখ, মা-ও পেয়েছে আমার সঙ্গ-সুখ– ফের আমাকে দেশ ছাড়তে হবে, এই আসন্ন বিচ্ছেদের তীক্ষ্ণ তলওয়ার সূক্ষ্ম একটি চুলে ঝুলছে অবশ্য অহরহ মায়ের মাথার উপর। কে বেশি আনন্দ পেয়েছিল সেটির মীমাংসা আমি নিজে করবার হক ধরিনে। আমার পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যেসব মাতা ও সন্তান আছেন তাদের হাতেই শেষরায়ের জিন্মেদারি ছেড়ে দিলুম। আর যেসব সন্তানের মা তাদের অল্প বয়সে স্বর্গলোকে চলে গেছেন সেসব দুঃখীদের কথা আমি মোটেই ভাবতে চাইনে।
আমি জানি, আমার যেসব পাঠিকা মা, তাঁরা আমাকে একটা মূর্খ ধরে নিয়ে (এবং আমি সে ধরে-নেওয়াটার বিরুদ্ধে সূচ্যগ্র পরিমাণ আপত্তি মুহূর্তে তরে তুলব না, কারণ আমার পিঠপিঠ দাদা এখনও আমাকে নিত্যনিয়ত অকাট্য যুক্তিপ্রমাণসহ পদ্মভূষণের পরিবর্তে গণ্ডমূর্খ অলিম্পিক ইডিয়েট খেতাব দেয়) বলবেন, অতি অবশ্যই মাতা পুত্রের সঙ্গসুখ পুত্রের তুলনায় বহুগুণে, বহু উৎকর্ষে, বহুতর আনন্দ-ঘন চরম তৃপ্তি পরমারাম পায়। শুধু তাই নয়, পুত্রের জন্যও সে সঙ্গে সঙ্গে এক মহামিলনের মহানন্দময় মহোৎসবের সৃষ্টি করে– কারণ মা তার স্বভাবজনিত নিঃস্বার্থপরায়ণতায় চায়, সন্তানও যেন তারই মতো এমনকি তারও বেশি পরিপূৰ্ণানন্দ লাভ করে। কিন্তু সন্তান কি সেটা পারে পুত্র যুবা। সে চায়, মায়ের ভালোবাসার বাইরেও অনেক কিছু খ্যাতি, প্রতিপত্তি, অর্থবৈভব; তদুপরি সে কামনা করে অন্য রমণীর যৌবন-মদিরারা প্রণয় এ-ও কি তখন সম্ভবে, যে, সে তখন শিকালে যেরকম একাগ্রচিত্তে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে মাতৃস্তন শোষণ করেছিল আজও সেইরকম : তার মাতৃস্নেহসিক্ত সঙ্গসুজাত আনন্দযজ্ঞ থেকে সেই প্রকারেই একাগ্রচিত্তে বাহ্যজ্ঞানশূন্য প্রতিটি মধুকণার সৌরভম্বন আনন্দরস নিঃশেষে শোষণ করবে। সেই শিশু জন্মলাভের পরই মায়ের বামস্তন ওষ্ঠাধর দ্বারা অবিরত নিষ্পিষ্ট করে যেন মাতৃদেহের শেষ রক্তবিন্দু লুণ্ঠন করে নিয়েছে, তার বামহস্ত মাতার দক্ষিণ স্তনের উপর রেখে সেই ক্ষুদ্র হস্তাঙ্গুলির কোমল পরশ দুইয়ে আরও দুগ্ধ আরও অমৃতের আহ্বান জানাচ্ছে।
ইতোমধ্যে মধ্যে মধ্যে তার অতি হ্রস্ব, অতিশয় ফীত বাম পদ দিয়ে মাতার দেহে মধুর মধুর পদাঘাত করছে।
সুশীল পাঠক! তুমি হয়তো ভাবছ, আমি যশোদানন্দন শ্রীশ্রীবালকৃষ্ণের কাব্যচ্ছদে বাধা মাতৃদুগ্ধ পান এতশত যুগ পরে কেন গদ্যময় নীরস ভাষায় পুনরায় পরিবেশন করছি। কিন্তু আমি জানি, প্রকৃত বৈষ্ণবজন বিশেষ করে আমার মুরুব্বি শ্ৰীযুত হরেকৃষ্ণ, আমার এ অনধিকার চর্চা অবহেলে এবং সস্নেহে ক্ষমা করবেন। নিবেদন, আমার বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
এই যে আমি আমার মাকে অনেকখানি হতাশ-নিরাশ করলুম (অবশ্য সব মা-ই সেটা মাফ করে দেয়), তার তুলনায় আমার মা কী করল?
আমার বয়স যখন চৌত্রিশ তখন আমার মা ১৯৩৮ সালে আমাকে ছেড়ে ওপারে চলে গেল। সেই বিচ্ছেদের পর আমি আরও চৌত্রিশ বৎসর ধরে এ সংসারে সেই মায়ের বিরহযন্ত্রণা কতখানি নিতে পারি, তারই চেষ্টা করছি।
এইবারে আমি পূর্বোল্লিখিত উদ্দেশ্য খুলে বলছি
যে-মা আমার দু মাস এক বৎসর এবং সর্বাধিক, পৌনে তিন বৎসরের বিচ্ছেদ সইতে পারত না বলে দিনে দিনে ফরিয়াদ করত, সেই মা-ই আমার জন্য রেখে গেল চৌত্রিশ বৎসরের বিচ্ছেদ-বেদনা।
করজোড়ে স্বীকার করছি আমার মা আমাকে যতখানি ভালোবেসেছিল তার তুলনায় আমার ভালোবাসা নগণ্য। কিন্তু মাকে দিয়েছিলুম মাত্র পৌনে তিন বৎসরের বেদনা। তার বদলে মা আমাকে দিল চৌত্রিশ বৎসরের বিরহ। আমি কোনও ফরিয়াদ, কোনও নালিশ করছিনে। আল্লা আমার মায়ের পূতাত্মা তার পদপ্রান্তে নিয়ে মাকে তার বহু দুঃখ বহু বিরহযন্ত্রণা থেকে শাশ্বত নিষ্কৃতি দিয়ে তাকে সর্বানন্দাতীত চরমানন্দ দিয়েছেন।
স্পর্শকাতরতাহীন পাঠক শুধোবেন, কার্লের কথা কও। তোমার মায়ের কথা এ স্থলে টেনে আনছ কেন?
কালকে জেলে নিয়ে যায় ১৯৩৩-এর বসন্তে। তার পর এল ইস্টারের পরব। ওই সময় আমি পাউলের সঙ্গে প্রতি বছর সডর্ফ গিয়ে সপরিবারে কার্ল এবং পাউল পরিবারের সঙ্গে পরব পালন করতুম। ওই সময়ে প্রভু যিশু ক্রুশবিদ্ধ হন এবং সপ্তাহান্তে তিনি পুনরুত্থান করেন।
১৯৩২-এর পরবের সময় আমি দেশে। কার্ল-পাউল আমাকে রঙিন কার্ড পাঠায়; সঙ্গে দীর্ঘ আবোল-তাবোল-ত্র নানাপ্রকারের কেচ্ছা-কাহিনী।
১৯৩৩, কার্ল জেলে। কিন্তু মানুষ অসম্ভবের আশা ত্যাগ করতে পারে? আমার ছিল দুরাশা, হয়তো হিটলার-রাজ এই সময়ে একটা মহানুভব ব্যত্যয় করে কার্লকে চিঠি লিখতে দেবে।
না। এমনকি পাউলও চিঠি লেখেনি। শুধু কার্ল-পাউলের পিতা আমাকে একটি পিকচার কার্ড পাঠিয়েছে। তার উপরে বৃদ্ধ পিতার কম্পিত হস্তে, কোনওগতিকে লেখা আমার প্রতি আশীর্বচন।
ইতোমধ্যে প্রতি সপ্তাহে প্রতি চিঠিতে বার বার পাউলকে শুধোই (তখন অ্যারমেল হয়নি), কালের খবর কী? কার্লের খবর জানাও।
পাউল উত্তরে আমার মূল প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। তার বাপ-মা, কার্লের বউ-বাচ্চা সম্বন্ধে অনেককিছু লেখে।
তার পর একটা চিঠিতে লিখল, সডর্ফের জেলে সুপারিনটেনডেন্ট আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে নিতে বলেছে, আমি যেন আমার দাদার অতখানি তত্ত্বতাবাশ না করি। নইলে আমাকেও তারা জেলে পুরতে বাধ্য হবে। আমি তাকে দেখতে যাচ্ছি।
তখনও নাৎসি পার্টি পরবর্তী যুগের চরমতম পৈশাচিক বর্বরতায় পৌঁছয়নি। তাই জেলের কর্তা পাউলকে এই সহানুভূতির উপদেশ দিয়েছিল।
এ চিঠি পেয়ে আমি দুর্ভাবনা দুর্ভাবনায় কাতর হয়ে পড়লুম।
তার পর দু মাস ধরে, পুর্ণ দু মাস ধরে পাউল সম্পূর্ণ নীরব। আমার তখন কী অবস্থা সেটা বোঝাই কী প্রকারে?
আমার মা আমার মনমরা ভাব বেশ লক্ষ করেছে। একদিন শুধোল, হ্যাঁ রে, তোর কী হয়েছে। বিদেশি চিঠি পেলেই তুই শুয়ে পড়িস কেন?
আমি সবকথা খুলে বললুম।
কার্লের মা-ও মা, আমার মা-ও মা।
আমার মা বলল, সে কার্লের জন্যে দোওয়া মেঙে তার জন্য নফল নামাজ পড়বে।
ততদিনে বড়দিন এসে গেছে। বড়দিন শেষ হল।
কিন্তু পাউল কিংবা তার বাপ-মা কারও কোনও চিঠি নেই।
ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে পাউলের চিঠি এল।
সংক্ষেপে লিখেছেঃ
ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় দাদা আত্মহত্যা করেছে। কোনও এক সদাশয় জেলগার্ড দাদাকে এক প্যাকেট সিগারেট দেয়- গোপনে। দেশলাই পুড়িয়ে পুড়িয়ে সিগারেটের খোলে সে লিখে গিয়েছে, মাকে সান্ত্বনা দিও। গার্ডটিই আমাকে সেটা পৌঁছিয়ে দেয়।
চিঠি যখন পড়ছি আমার মা তখন সম্মুখে ছিল। শুধোল, হ্যাঁ রে, কী খবর পেলি? তোর বন্ধু ভালো আছে তো?
আমি সত্য গোপন করিনি।
মা দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নামাজের ঘরের দিকে চলে গেল।
.
১৬.
কার্ল-এর কথা শেষ হয়েছে। তথাপি বিবেচনা করি কোনও কোনও সহানুভূতিশীল তথা কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকা জানতে চাইবেন যে, কীসব দুর্দৈব কোন সব নিপীড়নের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে একদিন কারাগারের পাষাণপ্রাচীর ভেদ করে কার্লের কাছে দিব্যজ্যোতি উদ্ভাসিত হল যে এ জীবন নিরর্থক; কিংবা হয়তো কোনও কোনও মনস্তত্ত্ববিদ বিজ্ঞানসম্মত মীমাংসা প্রকাশ করে বললেন, কার্ল অংশত মতিচ্ছন্ন অবস্থায় স্বেচ্ছায় এ সংসার থেকে বিদায় নেয়–কার্ল সম্পূর্ণ সুস্থাবস্থায় কি কখনও তার সে মায়ের কাছ থেকে চিরবিদায় নিতে পারত, যে-মাকে সে এতখানি প্রাণঢালা সোহাগ করত, তার জায়া তার শিশুকন্যাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসত। কবি বলেছেন–
কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?
এরই কাছাকাছি একটি অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, কার্লেরই সমগোত্রীয় হিটলারবিরোধী এক শহিদ। ইনি জর্মনিতে কার্লের মতো অজানা-অচেনা জন নন। উলরিব ফন্ হাসেল ছিলেন ইতালিতে জর্মন রাজ্যের মহামান্য রাষ্ট্রদূত। বিদগ্ধ পণ্ডিতরূপে তিনি ইংল্যান্ড থেকে বুলগেরিয়া, রুমানিয়া পর্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন এবং বহু দেশে বহু পণ্ডিতমণ্ডলীর আমন্ত্রণে বহু জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। হিটলারের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে স্থিরচিয় হওয়ামাত্রই তিনি সেই সম্মানিত রাষ্ট্রদূতের পদ ত্যাগ করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে হিটলারকে নিধন করার যে ষড়যন্ত্র নিল হয় তারই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার দরুন সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। অর্থাৎ কার্লের আত্মহত্যার এগারো বৎসর পর।
ফন হাসেল কিন্তু এক হিসেবে কার্লের চেয়ে সৌভাগ্যবান ছিলেন। নির্জন কারাগারে তিনি কাগজ-কলম পেয়েছিলেন বলে তিনি তার আত্মচিন্তার কিছুটা লিখে যাবার সুযোগ পান।
সেই আত্মচিন্তা পাণ্ডুলিপির মার্জিনে আসন্ন মৃত্যু অনিবার্য জেনে তিনি মাত্র তিনটি ছন্দে গাধা ছত্রে মৃত্যু সম্বন্ধে তার আশাভরা অনুভূতি প্রকাশ করেন।
তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারো মৃত্যুদ্বার দিয়ে
আমরা তখন যেন স্বপ্ন-সম্মোহিত
এবং অকস্মাৎ আমাদের করে দিলে মুক্ত।(১)
সেই রবীন্দ্রনাথের এই দুয়ারটুকু। এটি পার হতে কার্ল, ফন্ হাসেল কারও কোনও সংশয় ছিল না।
১৯৩৩-এর বড়দিনে কার্ল ওপারে চলে যায়।
১৯৬৪-এর গ্রীষ্মে আমি অপ্রত্যাশিতভাবে ফের জমনি যাই।
বন শহরের আমার এক প্রাক্তন অধ্যাপকের সঙ্গে বাস করছি। পাউলকে চিঠি লিখলুম। সে জানাল, ইতোমধ্যে তার মা কার্লের সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন। তার বাপ পেনশন পেয়েছেন। পাউল লিখেছে, না পেলেই ভালো হতো, বুড়ো একটা কিছু নিয়ে থাকতে পারত। এখন সে তার জাগ্রতাবস্থার অধিকাংশ সময় কাটায় রান্নাঘরের সেই ভাঙা কৌচটার উপর যেখানে বসে বসে মাকে সঙ্গ দিত; পূর্বেরই মতো– কিন্তু এখন একা একা, এবং প্রায় সমস্ত দিনরাত্রি আগে অন্তত ন ঘন্টাটাক আপিসে কাজকর্ম করত। আর সমস্তুক্ষণ আগেরই মতো সিগার ফোকে। তবে আগে ফুকত তামাম দিনে গোটা ছয় মোলায়েম সিগার; এখন গোটা আঠারো এবং এ দেশের সবচেয়ে কড়া সিগার। আমি অনুরোধ করাতে মাসি এসেছে। মাসি মায়েরই মতো ভালো রাঁধতে পারে। আগে বাবাই সেকথা বার বার স্বীকার করেছে। এখন শুধু খুঁতখুঁত করে। লক্ষ করলুম, পূর্বের প্রথামতো পাউল যথারীতি আমাকে ডুসলডর্ফ যাবার নিমন্ত্রণ জানায়নি।
বেদনা পাওয়ার কথা ছিল; আমি পেলুম শান্তি-স্বস্তি।
পাউল বন শহরে এসে আমাদের ছাত্রাবস্থার পাব-এ রাঁদেভু স্থির করল।
কুশল আলিঙ্গনাদির পর পূর্বের প্রথামতো সে আধলিটার বিয়ার অর্ডার দিয়ে গেলাসটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শেষটায় একচুমুকে আধগেলাস শেষ করে বলল, কীই-বা তোকে বলি, যা তুই শুনতে চাস। কার্ল ধরা পড়ার একমাস পর এল ইন্টার পরব। কর্মে তার বিশেষ মতিগতি ছিল না কিন্তু ধর্মের পরব, লৌকিকতা নিয়ে সে হই-হুঁল্লোড় করতে বড় ভালোবাসত। নানা রঙের কাগজের ডিম মুড়ে সেগুলোকে চিত্র-বিচিত্র করা থেকে শুরু করে, নিতান্ত বাচ্চাদের মতো সেগুলোকে কল্পনাতীত অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় লুকনো, তার পর আমাদের সব্বাইকে নিয়ে বিকট চিৎকার লাফালাফি দাপাদাপি করে সেগুলো খেজা, তার বউ যেগুলো লুকিয়েছিল সেগুলো খুঁজে পাওয়াতে রেড-ইন্ডিয়ান স্টাইলে তার তা নৃত্য, তার উকট উদ্দাম জয়োল্লাস– এসব কথা সে নিশ্চয়ই জেলে বসে বসে ভেবেছিল।
আমার চোখে জল এল। বললুম, পাউল, তোর মনে আছে ৩২-এর পরবে কার্ল তোর মারফত আমাকে এক ডজন রঙিন ডিম পাঠিয়েছিল?
পাউল মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল, তুই তো সর্ব ধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করিস তোর অজানা নয়, অনেক ক্যাথলিক ইস্টারকে বড়দিনের চেয়ে বেশি সম্মান দেয়। ওই সময় প্রভু যিশু মৃত্যুবরণ করার সময়েও তার নিপীড়নকারীদের ক্ষমা করে যান। এই ইন্টার সপ্তাহটি ক্ষমতা, দয়া, মৈত্রীর সপ্তাহ। আমার সব নৈরাশ্য তখন দুরাশা দিয়ে চেপে ধরে ইস্টার ফ্রাইডে থেকে ইস্টার মানডে অবধি চারদিন রোজ গিয়েছি জেলখানায়, যদি এই ক্ষমাদয়ার সপ্তাহে ওরা একটু নরম হয়। মাকে না জানিয়ে। পাউল থামল।
আমি বললুম, বুঝেছি, তুই বলে যা। আমি দেশে থাকতে সব শুনতে চেয়েছিলুম। এখন আর না। তুই সংক্ষেপে সার।
পাউল বলল, তার দু মাস পরে এল তার মেয়ের নামকরণ দিবস।(২)
কার্ল ওইদিনই করত তার বাড়ির সবচেয়ে জব্বর পরব। মেয়েকে সাজাত শুভ্রাতি সাদা রেশমি জামা-কাপড়ে আর হল্যান্ড থেকে কেনা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম লেস ঝালরে।
কার্ল জেলে। হয়তো ভাবছে মা কী করে বাচ্চাটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে যে আজ সেরকম পরব হচ্ছে না কেন?
তার পর এল কার্লের বাৎসরিক বিবাহোৎসব।
এসব কটা পরব পড়ে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাসে। শুধু তার বউ আর আমাদের মার নামকরণ দিবস পড়ে জানুয়ারি থেকে মার্চে।
এ সব কটা দিনে কাল কারাগারে কী বেদনা অনুভ করেছিল তার খানিকটা কল্পনা আমি করতে পারি। আর সেই দরদী গার্ড আমাকে তার শেষ মেসেজ দিয়েছিল সে আমাকে কিছুটা বলেছিল। কার্ল নাকি তাকে তার পরিবারের প্রতি পর্বদিন ওকে ওই সম্বন্ধে একটু-আধটু বলত।
তার পর বড়দিন এল। সে আর যে সইতে পারল না। সেকথা তোক তো চিঠিতে লিখেছিলুম। তার দু-একদিন পর আমি একটু সুযোগ পেয়ে পাউলকে শুধালুম, আচ্ছা পাউল, কার্ল তো হিটলার জর্মনির সর্বেশ্বর হওয়ার দু বৎসর পূর্বে পার্টি ছেড়ে দেয়, চাদা বন্ধ করে! তবে ওকে ধরল কেন?
পাউল ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বলল, কিন্তু পার্টি কি ছাড়ে (আমাদের ভাষায় কমলি নহি ছোড়তি) কার্ল ছিল পার্টির সবচেয়ে সেরা যুক্তিতর্কসিদ্ধ মেম্বার এবং উত্তম বক্তা। হিটলার ফুর্যার হওয়ার পর যেসব মাতব্বর কমুনিস্টদের গ্রেফতার করা হয় তাদের প্রায় সক্কলেরই নোটবুকে কার্লের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেল। আমি ওদের দোষ দিইনে; কিন্তু নাসিরা স্বভাবতই ধরে নিল এরকম একজন সর্ব-কম্যুনিস্ট-মান্য লোককে বন্ধ করে রাখাই সেফার।
.
পাঠক হয় তো শুধোবেন ‘কত না অশ্রুজল’-এ আমি কার্লের শেষ চিঠিকে যথাযথ মূল্য দিয়ে গোড়ার দিকেই ছাপালুম না কেন? কিন্তু যেখানে আমি অত্যুকৃষ্ট শেষ বিদায়ের চিঠিগুলো অনুবাদ করছি, সেখানে মাকে সান্ত্বনা জানিয়ে তিনটিমাত্র শব্দ, সেগুলোর কী অধিকার ওদের সঙ্গে সমাসনে বসার
———–
১. অধুনা অনেকেই জৰ্মন শিখছেন, তাই মূল পাঠ তুলে দিলুম;
Du kannst uns durch des Todes Nueren
Trtaunend fuehren
Und machest uns Uns auf einmal frel.
২. ক্যাথলিকরা জন্মদিন পালন করে না। ঠাট্টা করে বলে, শ্যাল-কুকুরেরও তো জন্মদিন আছে। তারা পালন করে যে সন্তের নামে বাচ্চার নাম দেওয়া হয়েছে (যেমন পাউল, মারিয়া মেরি, ইত্যাদি) তার সেন্ট পদবি প্রাপ্তির দিন। এটাকে বলে, নামেন্সটাগ্।
বেদনাদায়ক