আধুনিকের আত্মহত্যা

আধুনিকের আত্মহত্যা

১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দের কথা। ১৯১৪-১৮ বিশ্বযুদ্ধে যত যুবক ইয়োরাপের ভবিষ্যৎ খ্রিস্টধর্মের ব্যর্থতা এবং স্ব স্ব আদর্শবাদ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, কেন জানিনে, তার দশমাংশও করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ যখন ইয়োরোপের ভিন্ন ভিন্ন নগর, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও ভারতের শাশ্বত বাণী প্রচার করে বক্তৃতা দেন তখন বিশেষ করে মুগ্ধ হন তারাই, যারা একদা খ্রিস্টধর্মে গভীর বিশ্বাস ধরতেন কিন্তু যুদ্ধের কল্পনাতীত বর্বরতা দেখে সে ধর্মের কার্যকারিতা অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপের খ্রিস্টানগণকে দ্ৰমানুষে পরিবর্তিত করতে পারবে কি না, সে-বিষয়ে অত্যন্ত সন্দিহান হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকেই নৈরাশ্যবশত সাতিশয় বিরক্তিসহ চার্চে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাদের ঈশ্বরবিশ্বাসের দৃঢ়ভূমি পর্যন্ত যেন তাদের পায়ের তলা থেকে ক্রমেই শিথিল হয়ে সরে যাচ্ছিল। শুধু যুবক সম্প্রদায়ই নয়, অপেক্ষাকৃত বয়স্ক গুণীজ্ঞানী পণ্ডিতরা পর্যন্ত ইয়োরোপের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন ভিক্টোরীয় যুগে তাদের যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মনুষ্যজাতি, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গগণ সভ্য থেকে সভ্যতর পর্যায়ে উঠছে এবং ফলে একদিন আর এ-সংসারে দুঃখদৈন্য অনাচার-উৎপীড়ন থাকবে না, সেটি লোপ পেল। বিশেষ করে যারা ইতিহাসের দর্শন নিয়ে হেগেলের যুগ থেকে প্রশ্ন করছেন যে, ইতিহাসে আমরা শুধু অসংলগ্ন, চৈতন্যহীন মূঢ় কতকগুলি ঘটনা-সমষ্টি পাই, না এর পিছনে কোনও সচেতন সত্তা ঘটনাপরম্পরাগত ক্রমবিকাশের মাধ্যমে শুধু যে মানুষকে উন্নততর এবং সভ্যতর পন্থায় নিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, নিজেকেও সপ্রকাশ করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকেই দ্বিতীয় সমাধানটি অগ্রাহ্য করলেন, এবং অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাস-দর্শনের সুপণ্ডিত অসন্ট স্পেঙলার তাই লিখলেন, য়ুরোপের সূর্যাস্ত (ড্যার উন্টেরগাঙ ডেস্ আবেন্টলাভের)। বইখানার খ্যাতি সে যুগে পঞ্চমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু আমি যুবকদের কথা বলছিলুম। তাদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বাণীর মাধ্যমে অনুত্ব করল যে প্রচলিত খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস না করেও শাশ্বত সত্য ধর্মনিরপেক্ষ ঈশ্বরবিশ্বাসের উচ্চতম পর্যায়ে ওঠা যায়, এঁদের একাধিক জন তখন প্রাচ্যভূমিতে এসে স্থায়ী বসবাস নির্মাণ করতে উস্ত্রী হন।

এঁদেরই একজন মসিয়ো ফের্না বেনওয়া। রবীন্দ্রনাথ যে-কজন ইয়োরোপীয়কে বিশ্বভারতীতে কয়েকজনকে অন্তত সাময়িকভাবে শিক্ষাদানের জন্য আহ্বান করেছিলেন তাদের সকলেই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন : যেমন লেভি, ভিটারনিস, দুচ্চি ইত্যাদি। খাঁটি সাহিত্যিক ছিলেন একমাত্র অধ্যাপক বেনওয়া এবং তিনি ফ্রান্সেও সুপরিচিত ছিলেন। তার প্রকৃত পরিচয় আমরা পাই, যখন মনীষী রমারল তার জীবনের ষষ্টিতম বত্সরে পদার্পণ করার শুভলগ্নে বিশ্ববাসী গুণীজ্ঞানীগণ একখানা পুস্তক তাকে উৎসর্গ করেন। বইখানার নাম তারা দেন লাতিনে লিবার আমিকরু- অর্থাৎ সখাগণপ্রদত্ত (উৎসর্গিত) পুস্তক। এদেশ থেকে লেখেন মহাত্মা গান্ধী, জগদীশচন্দ্র বসু ইত্যাদি। পৃথিবীর প্রায় সর্ব সভ্যদেশ থেকে কেউ-না-কেউ ওই শুভলগ্নে রাকে অভিনন্দন জানিয়ে তার সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন। আমার এখনও মনে আছে এক আরব রলাঁকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন, তুমি লৌহসম্মার্জনী দ্বারা ইয়োরোপের কুসংস্কার জঞ্জাল দূর করেছ। বলা বাহুল্য, এই লেখনী সঞ্চয়নে আপন রচনা দিয়ে শ্লাঘাপ্রাপ্তির জন্য যখন সর্ববিশ্বের সহস্র সহস্র গুণীজ্ঞানী উগ্রীব, তখন প্যারিস থেকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানানো হয় অধ্যাপক বেনওয়াকে, তার রচনার জন্য। তিনি তার স্বাভাবিক বিনয়শত আশ্রমের কাউকে কিছু বলেননি, কিন্তু ওই লিবার আমি যখন আমাদের লাইব্রেরিতে পৌঁছল তখন আমরা সেটিতে আমাদেরই অধ্যাপকের রচনা দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হই। তিনিও আবার তার প্রবন্ধে কোনও গুরুগম্ভীর বিষয়ের অবতারণা করেননি আমরা ঠিক সেই সময়ে তার ক্লাসে রলর এক স্বল্পখ্যাত পুস্তিকা পিয়ের এ লস- পিটার ও লসি পড়ছিলাম। চটি বই। বিরাট জা ক্রিস্তফ লেখার পর রল দুই তরুণ-তরুণীর একটি বিশুদ্ধ প্রেমের কাহিনী লিখে জা ক্রিরে মতো বিরাট পুস্তকের কঠিন কঠিন সমস্যা, ইয়োরোপীয় সভ্যতা নিয়ে আলোড়ন-বিলোড়ন থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিলেন। বেনওয়া তাঁর প্রবন্ধ লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে পিয়ের এ লাস–যতদূর মনে পড়ছে, এই শিরোনামা দিয়ে, এবং পিয়ের এ স পড়ে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীর মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তার সবিস্তার বর্ণনা দেন। রলাকে উৎসর্গিত লিবার আমিকম্পু স্তকের কোনও কোনও অংশ সেসময়ে কালিদাস নাগ অনুবাদ করে এদেশে প্রকাশ করেন।

অধ্যাপক বেনওয়ার গত হওয়ার দিবস বিস্ময়সূচক। যে গুরুর কাছ থেকে তিনি অকৃপণ স্নেহ ও সম্মান পেয়েছিলেন তারই জন্মশতবার্ষিকীর দিনে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

এস্থলে আমি অধ্যাপক বেনওয়ার জীবনী লিখতে যাচ্ছিনে। বস্তুত ১৯২১ থেকে এবং সঠিক বলতে গেলে যবে থেকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন সেই সময় থেকে ১৯৪১ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত যেসব গুণীজ্ঞানীরা এখানে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করেছিলেন তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার ভার আমার স্কন্ধে নয়। কার, সেটা বলা বাহুল্য। বছর দশেক পূর্বে লাইপসিক বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রভবনকে লেখে, তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের জীবনী প্রকাশ করছেন, জনৈক মার্ক কলিন্স সম্বন্ধে শান্তিনিকেতনের কেউ কিছু জানে কি না? (কলিন্স এখানে অধ্যাপনা করেছিলেন। অন্যরা তাদের ছাত্রদের সম্বন্ধে লেখে আর আমরা আমাদের অধ্যাপকদের বৃথা বাক্য থাক! (স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন।)(১)

সেই বেনওয়া সাহেব কয়েকদিন ফরাসি ক্লাস নেওয়ার পর বললেন, তোমরা যে মলিয়ের, ফ্লবের, যুগো (Hugo), জিদ, ফ্রাস পড়তে চাও সে তো খুব ভালো কথা। কারণ আজকালকার ইয়োরোপীয় ছাত্রছাত্রীদের এসব লেখকের বই পড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা লাতিন-গ্রিক তো শিখতেই চায় না, তার অনুবাদেও বিরাগ, এমনকি এই একটু আগে যাদের নাম করলুম, তাদের লেখার প্রতিও কোনও উৎসাহ নেই, তাদের কারণ তারা লেখেন ক্লাসিকাল পদ্ধতিতে। তার অন্যতম মূল সূত্র যে জিনিস স্বচ্ছ (ক্লিয়ার, পরিষ্কার যার অর্থ অতি সহজেই বোঝা যায়) নয়, সে জিনিস ফরাসি নয় (সূ কি নে পা ক্ল্যার নে পা ফ্রাসে!) আর এ-যুগের পাঠকরা চায় আধা-আলো-অন্ধকার। তাদের বক্তব্য, তোমরা জীবনটাকে যতখানি সহজ সরল স্বচ্ছ ধরে নিয়েছ এবং ফলে স্বচ্ছ সরল পদ্ধতিতে প্রকাশ করো জীবনটাকে বাস্তবে সে তা নয়, জীবন ওরকম হয় না। সর্ব মানবজীবনেই আছে আলো-আঁধারের দ্বন্দ্ব তাই তার প্রকাশও পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে না। আমরা আজ যা লিখছি সেটা পুরনো স্টাইলকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছে, এবং তোমরা যারা প্রাচীন পদ্ধতিতে অভ্যও তারা তো এটাকে দুর্বোধ, অবোধ্য এমনকি অর্থহীন প্রলাপ বললেও বলতে পারো, কিন্তু আমরা তার কোনওই পরোয়া করিনে। আমরা আমাদের অপক্ষে এগিয়ে যাব, এবং এই করেই নতুন পথ বানাব।

এতদিন পরে কী আর সবকথা মনে থাকে! এটা হচ্ছে ১৯২১/২২/২৩-এর কাহিনী। তখনও এদেশে মডার্ন কবিতা জন্ম নেয়নি, (পরবর্তী যুগে যখন নিল, তখন হিসাব নিয়ে দেখা গেল, এসব মডার্ন কবিতাতে যে শব্দটি বার বার, এমনকি বলা যায় সর্বাধিকবার আসে সেটি ধূসর। তখন মনে পড়ল, ফ্রান্সের মডার্নদের সম্বন্ধে অধ্যাপক বেনওয়ার প্রাচীন দিনের বিবৃতি সেখানে মূল কথা ছিল অস্পষ্ট দ্বমুখর এবং সর্বোপরি আধা-আলো-অন্ধকার। সেই বস্তুই এদেশে এসে পরেছে ধূসর আলখাল্লা! তা হবেই-না কেন? এদেশটা তো বৈরাগ্যের গেরুয়া বসনধারী, আর গেরুয়া যা ধূসরও তা!) তবে মোটামুটি যা বলেছিলেন, সেটা মনে আছে এবং চোখের জলে নাকের জলে মনে আছে?

কারণ সর্বশেষে সাহেব বললেন, অতএব এই নতুন ফ্রান্সকেও ভোমাদের চেনা উচিত বিশেষ করে তার কাব্যপ্রচেষ্টাকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফ্রান্স থেকে আনালেন–তখনকার দিনে জাহাজ-রেলে প্রায় দু সপ্তাহ লাগত বেশ মোটা মোটা দু-ভলুমে সম্পূর্ণ মডার্ন কবিতার চয়নিকা। শিরোনাম, পোয়েৎ দ জুই, পোয়েটস্ অব টুডে, হালের কবি, আজকের কবি যেটা আপনার প্যারা লাগে বাংলাতে সেইটেই বেছে নিন।

বলছিলুম না, চোখের জলে নাকের জলে পড়েই যাচ্ছি, পড়েই যাচ্ছি, কোনও হদিস আর পাইনে। ক্লাসের পড়া তৈরি করতে আগে আমার লাগত তিন পো ঘন্টাটাক, এখন দু-ঘণ্টা তিন-ঘণ্টা অভিধান ঘেটেও কোনও হদিস পাইনে। একটা তুলনা দিয়ে জিনিসটা পরিষ্কার করি। আপনি কোনও বিষয়বস্তু পড়ছেন যেটা সরল, এবং লেখকের উদ্দেশ্যও সরল। সেখানে মনে করুন হঠাৎ এল একটা শব্দ যার অর্থ আপনি জানেন না, যেমন ধরুন কর। অভিধান খুলে মানে পেলেন করা ধাতুর রূপ বিশেষ, খাজনা হাত কিরণ হাতির গুড় হিন্দুর উপাধি বিশেষ। এতক্ষণ ধরে লেখকের সবকথাই আপনার কাছে পরিষ্কার ছিল বলে, পূর্বাপর প্রসঙ্গ বিবেচনা করে আপনি চট করে বুঝে গেলেন কোন অর্থটা লাগবে, লেগেও গেল ক্লিক করে। তাই বোধহয় অভিধানকে কুঞ্চিকাও বলা হয়। সেখানে আপনি পাবেন চাবি– এটা প্রয়োগ করে আপনি যে অচেনা শব্দরূপ খুলতে চান, সেটি খুলতে পারেন। এর পরে তুলনাটা হয়তো টায়-টায় মিলবে না, আমার বক্তব্য কিঞ্চিৎ খোলসা করবে। আপনার নিজের যে তালা আপনি নিত্যি নিত্যি খোলেন তার চাবি যদি হারিয়ে যায়, আর কেউ এসে একগুচ্ছ জাত-বেজাতের চাবি দেয়, তা হলে কোন চাবিটি দিয়ে আপনার তালাটি খোলা যাবে সেটা চট করে বেছে নেবেন– জোর, নিতান্ত একাকার হলে, দু-তিনটে ট্রায়েল নিয়েই কর্মসিদ্ধি।

আর এখানে, অর্থাৎ এই মডার্ন কবিতা নিয়ে হালটা কী? যেন তালাটিই দেখতে পাচ্ছিনে ভালো করে আদৌ আছে কি না সে ভি কসম খেয়ে বলতে পারব না, অর্থাৎ বিসমিল্লাতেই গয়লৎ (গলৎ)-কেমন যেন আবছা-আবছা গোছ, ওই যে সায়েব অধ্যাপক স্বয়ং বলেছিলেন কেমন যেন আধা-আলো-অন্ধকার, ফরাসিতে বলে ক্রেস্কুল (ইংরেজিতে বিশেষ্যটা চলে না বটে, কিন্তু বিশেষণটা ৫epuscular- মাঝে মাঝে পাওয়া যায়) এদেশের পরবর্তী যুগের ধূসর! এদিকে তালাটাই দেখতে পাচ্ছিনে ভালো করে, ওদিকে অভিধান আমার হাতে তুলে দিলেন চারটে চাবি এখন লাগাই কোনটা? এমনকি রাজাকে হাতির শুঁড় (কর) দিলুম অর্থও যদি রাজাকে খাজনা (কর) দিলুম এর বদলে বেরোয় তাতেও আমি খুশি। কথায় বলে হাতের একটা পাখি কানা মামার চেয়ে ভালো–ঐ যা, দুটো প্রবাদে গোবলেট করে ফেললুম নাকি? তা সঙ্গগুণে সবই হয়। অর্থাৎ সে-যুগের ফরাসি মডার্ন কবিতা শব্দ, অর্থ, অনুপ্রাস, এমনকি বানান নিয়েও, এক্ষুনি আমি যা গোবলেট পাকালুম, তার চেয়ে কোটি গুণে (ইনফিনিটি সিম্বলটি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটি বোধহয় ছাপাখানায় নেই) ওস্তাদ ছিল– গোবলেট পাকাতে।

বেশ কয়েকদিন, গলদঘর্ম পরিশ্রম করার পর আমি স্থিরনিশ্চয় হলুম, আমার মনে সন্দেহের অবকাশ মাত্র রইল না, এ বন্ধু কাব্য নয়, এটা নিশ্চয়ই দর্শন। কারণ দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে দার্শনিকশ্রেষ্ঠ শোপেনহাওয়ার বলেছেন (আমি অনুবাদের খাতিরে একটুখানি কনসুরা লাগাচ্ছি);

দর্শন হল গিয়ে অমানিশার অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্ব অণ্ডের অনুসন্ধান।

কিন্তু এ তত্ত্বে পৌঁছনোর পরও আমি অত সহজে হাল ছাড়িনি– তার জন্য বয়সটাই দায়ী; এটা জেদির বয়স।

কারণ আমার মনে পড়ল, ছেলেবেলায় কাকার কাছে শোনা একটি তত্ত্বোপদেশমূলক কাহিনী। এক রাজার ছিল একটি অতি বিরল মহামূল্যবান, সাদা হাতি। সে দিন দিন কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তার অনুসন্ধান করার ফলে ধরা পড়ল যে, তার মাহত শত সাবধানবাণী সত্ত্বেও অতি সঙ্গোপনে হাতির দানা চুরি করছে। রাজা ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে তার প্রাণদরে হুকুম দিলেন। মাহুত যখন দেখল এ-হুঁকুম কিছুতেই রদ হবে না, রাজার সামনে নিবেদন করল, তাকে যদি এক বছরের সময় দেওয়া হয় তবে, একমাত্র তারই জানা গোপন কৌশল প্রয়োগ করে ওই সাদা হাতিটাকে দিয়ে মানুষের মতো কথা বলাতে পারবে। রাজা সম্মত হলেন। মাহুতের অন্তরঙ্গ বন্ধুরা যখন তাকে ওধাল হাতিকে দিয়ে সে কথা বলাবে কী করে, তখন সে বলল, ভাইরা সব, এক বছরের ভিতর কতকিছুই-না ঘটতে পারে। এক বছরের ভিতর রাজা মারা যেতে পারেন, কিংবা হাতি মারা যেতে পারে, কিংবা আমি মারা যেতে পারি এবং কে জানে, কিংবা হয়তো হাতিটা শেষমেশ কথাই বলে ফেলতে পারে!

আমিও সেই আশাতেই রইলুম, কে জানে এসব কবিতার মানে একদিন হয়তো বেরিয়ে গেলে যেতেও পারে। যদিও অকপট চিত্তে স্বীকার করছি, আমার তখন মনে হয়েছিল, এবং আজও মনে হয়, আচম্বিতে হাতির মানুষের মতো কথা বলতে পারাটার সম্ভাবনা এসব কবিতার অর্থ বোঝার সম্ভাবনার চেয়ে ঢের ঢের বেশি।

সত্যের অপলাপ হবে বলে স্বীকার করছি, সাহেব আমাদের বলেও ছিলেন, প্রাচীন যুগের ল্য কঁৎ দ্য লিল বা গোর কবিতার অর্থ যেরকম বর্ণে বর্ণে বোঝা যায়, এসব পোয়েৎ দ জ্বরদ্যুই- হালের কবিদের কাছ থেকে সেটা যেন প্রত্যাশা না করি- এর নাকি অনেকখানি সরাসরি, সোজাসুজি অনুভূতির যোগে চিত্তে গ্রহণ করতে হয়। কী প্রকারে সে যোগ করতে হয় সেটা অধ্যাপককে গুধিয়ে তাকে বৃথা হয়রান করতে চাইনি। কারণ যেখানে অনুভূতির কারবার সেখানে সে রসে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়া তো আর সিলজি দিয়ে বানোনা যায় না। যেমন মাকে কী করে ভালোবাসতে হয় এটা তো আর কাউকে ইন্সট্রাকশন দিয়ে শেখানো যায় না যেরকম বিস্কুটের টিনের উপরে ছাপা নির্দেশনানুযায়ী-প্রক্রিয়ায় টিনটি পরিপাটিরূপে খোলা যায়।

পাঠক শুধোবেন, তা হলে ক্লাসে কি অধ্যাপক সেগুলো বুঝিয়ে দিতেন না? এবারে ফেললেন মুশকিলে। সাহেব মোটামুটি একটি ইংরেজি অনুবাদ খাড়া করে দিতেন– কারণ ইংরেজি ও ফরাসির শব্দসম্পদ বিশেষ করে চিন্তা ও অনুভূতি সংশ্লিষ্ট বিমূর্ত শব্দ একই ভাণ্ডার থেকে নেওয়া হয় বলে বহু কবিতার শতকরা ষাটটি শব্দ দুই ভাষাতেই এক। অনুবাদ করা কঠিন নয়। কিন্তু তাই বলেই কি জিনিসটা সরল হয়ে যাবে? মডার্ন বাংলা কবিতার শব্দগুলো তো আপনি চেনেন, তাই বলে কি অর্থ বোধগম্য হয় তার ওপর সর্বক্ষণ ভয়, এখনও তো মামুলি ফরাসিটাই ঠিকমতো রপ্ত হয়নি, হয়তো গাড়োলের মতো এমন প্রশ্ন গুধিয়ে বসব যেটা বাঙলায় প্রকাশ করতে হলে বলি, সওকাও রামায়ণ পড়ে- ইত্যাদি।

তবে দুটো জিনিস লক্ষ করলুম। শোলডার শ্রা করা বা কাঁধ উঠিয়ে-নামিয়ে নিজের অসহায়তা প্রকাশ করার অভ্যাস সর্ব ইয়োরোপীয়েরই আছে, কিন্তু এর সবচাইতে বেশি কনজাশ ফ্রান্সে–শ্যাম্পেন বা ব্র্যান্ডির চেয়েও ঢের ঢের বেশি; এসব কবিতা বোঝাবার সময় বেনওয়া সাহেব যা শোভার শ্রাগ করলেন তার থেকে আমার মনে হল যে আগামী দশ বৎসরের রেশন তিনি ওই হালের কবিদের পাল্লায় পড়ে তিন মাসেই খতম করে দিচ্ছেন। এবং ওই শ্রাগ করার সঙ্গে সঙ্গে হাতের তেলোদুটো এমনভাবে চিত করতেন যে আমরা স্পষ্ট বুঝতুম, ইংরেজিতে যাকে বলে, ঘোড়াকে জলের যথেষ্ট কাছে আনা হয়েছে, এখন সে যদি না খায়—

দ্বিতীয়ত, সনাতন লেখকদের বেলা তিনি মাঝে মাঝে আমাদের অনুবাদ করতে বলতেন। কিন্তু এই মডার্ন কবিদের হাতে নিরীহ বঙ্গসন্তানদের বে-পনাহ অর্থাৎ একান্ত অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে তিনি সাহস পেতেন না। নরখাদক না হলেও, যারা তাদের কবিতা বোঝবার চেষ্টা করে, তাদের মগজ যে কীরকম কুরে কুরে খেতে পারেন, সে তত্ত্বটি সায়েবের অজানা ছিল না। এবং ওই সময়ে শান্তিনিকেতনের একটি ছেলে পাগল হয়ে গেলে যে গুজব রটেছিল, তার বিরুদ্ধে তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে আমি আজ বলছি, সর্বৈব মিথ্যা; সে ছোকরা একদা ফরাসি ক্লাসে আসত বটে, কিন্তু ওইসব পোয়েৎ দ জ্বরদইদের প্রথম দর্শন পাওয়ামাত্রই সে বাপ্পো বাপ্পো রব ছেড়ে অধ্যাপক মিশ্রুজির পাণিনি ক্লাসে চলে যায়– যে ক্লাসটাকে আমরা বাঘের চেয়েও বেশি ভরাতাম এবং পরে মুক্তকণ্ঠে বলে, এসব হালের ফরাসিস কবিদের বোঝার চেয়ে পাণিনির সূত্র বোঝা ও কণ্ঠস্থ করা ঢের ঢের সহজ।

একে মডার্ন, তায় ফরাসিস, তদুপরি কোনও কোনও কবি পাস প্যারিসিয়ান উপস্থিত আবার বাংলা দেশে একটা বিশেষ রস বা ওই ধরনের একটা কিছু নিয়ে জোর আন্দোলন চলছে– কাজেই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা অসম্ভব নয়, এসব কবিরা কাব্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার মধ্যে কোনও পার্থক্য স্বীকার করতেন কি না? আমার তো শেষ প্রসা ছিল ওইটেই। এত যে মেহৎ করছি, তার ফলে আখেরে যদি এমন কিছু জুটে যায় যার প্রসাদাৎ সংস্কৃত-পড়নেওলাদের ঢিট দিতে পারি। ধ্যওর তোর চৌরপঞ্চশিকা আর কুট্টনীমত! আসল মাল এ্যাদ্দিনে, বাবা, এদেশে এসে পৌঁছেছে, নাক বরাবর প্যারিস থেকে। আয়, শুনে যা। কারণ এদের কেউ কেউ অল্পবিস্তর পাস পড়েছে, অবশ্য ইংরেজি অনুবাদে,(২) তাই (ওই বয়সে) আমার সরস আহ্বান শুনে যে আমার সামনে করজোড়ে আসন নিত সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু হায়, অধ্যাপক বেনওয়া স্বয়ং বহু বৎসর প্যারিসে কাটিয়েছিলেন বলে এ-বিষয়ে সাবধান হতে জানতেন। ক্লাসে দুটি মেয়ে ছিল বলে তিনি প্রথমদিনই বলে দিয়েছিলেন, কোন কোন কবিতা ক্লাসে পড়ানো হবে।

আমার নিজের কেমন জানি একটা অন্ধবিশ্বাস সেসময় জন্মেছিল যে অধ্যাপক বেনওয়া স্বয়ং এই নতুন একোল স্কুল বা রীতিটা পছন্দ করতেন না, বিশেষ রসও পেতেন না। তিনি আমাদের সঙ্গে মডার্ন ফ্রান্সের নবীন কাব্য-আন্দোলনের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মাত্র অনেকটা যেন কর্তব্য পালনের জন্য।

তবু এই সুবাদে একটি তত্ত্বকথা বলে রাখা ভালো। এসব মডার্ন কবিদের সাধনা ছিল সত্যই বিস্ময়জনক। কারও কারও ছন্দহীন, লয়বিহীন, মিলবর্জিত বস্তৃত সর্ব অলঙ্কারশূন্য– এলোপাতাড়ি আবোল-তাবোল শব্দসমষ্টি দেখে যখন আমরা উদ্ভ্রান্ত তখন বেনওয়া সায়েব অপেক্ষাকৃত প্রাচীন কাব্য থেকে পড়ে শোনাতেন এদেরই আগেকার দিনের, প্রাচীন পদ্ধতিতে রচিত কবিতা– মডার্ন আন্দোলনে যোগ দেবার পূর্বে রচিত।

 এবং সেগুলো শুনে, পরে পড়ে স্তম্ভিত হয়েছি। অনবদ্য এক-একটি কবিতা! কতখানি পরিশ্রম, কতখানি সাধনার প্রয়োজন এরকম অত্যুত্তম কবিতা রচনা করতে! অর্থাৎ, এরা ব্লাফ-মাস্টার নন। প্রাচীন পদ্ধতিতে কবিতা রচনা করার টেকনিক, স্কিল, কৌশল সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করার পর এঁরা যে কোনও কারণেই হোক খুব সম্ভব নিজের সৃষ্টিতে ঈপ্সিত পরিতৃপ্তি না পেয়ে ধরেছেন অন্য টেকনি, বা বলা যেতে পারে, চেষ্টা করছেন নতুন এক টেকনিক আবিষ্কার করার। সেজানের ছবি দেখে অজ্ঞজন মনে করে, এরকম এলোপাতাড়ি তুলির বাড়ি ধাম-ধুপুস মারা তো যে কোনও পাঁচ বছরের বাচ্চাও দেখিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সেজান যখন প্রাচীন অ্যাকাডেমিক টেকনিকে আঁকতেন তখনকার ছবি দেখলে চক্ষুস্থির হয়ে যায়। তখনকার দিনের অ্যাকাডেমিক যে কোনও চিত্রকরের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারতেন, কারণ একে তো ছিল তাঁর বিধিদও অসাধারণ সৌন্দর্যবোধ ও স্পর্শকাতরতা, তদুপরি তার আঙুলগুলো যেন শুধু ছবি আঁকার জন্যই বিধাতা নির্মাণ করেছিলেন, এবং সর্বোপরি তার বহু বৎসরব্যাপী অক্লান্ত সাধনা, ওই প্রাচীন অ্যাকাডেমিক টেকনিক্ সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ আয়ত্ত করার জন্য। এদেশে তাই যখন দেখি, মাত্র দুটি বছর রেওয়াজ- কবিতা, গান, নাচ যাই হোক না কেন–করেছে কি না, তার আগেই সে লেগে যায় কম্পোজ করতে, এবং অন্যকে বিজ্ঞভাবে নবীন পন্থা বাঙ্গাতে, তখন– থাক্ গে।

ইতোমধ্যে আবার জর্মন ভাষার অধ্যাপক ছুটিতে চলে যাওয়ার দরুন বেনওয়া সায়েবের ঘাড়েই পড়ল জর্মন শেখাবার ভার, এবং তিনিও ফরাসি মডার্ন কবিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলেন জর্মন মডার্ন কবিদের মডার্নতম রাইনের মারিয়া রিলুকে! সে আরেক নিদারুণ অভিজ্ঞতা, সুকুমার রায়ের ভাষায় ভুক্তভোগী জানে তাহা, অপরে বুঝিবে কিসে?–সে-কাহিনী আরেক দিনের জন্য মুলতবি রইল। শুধু এইটুকু নিবেদন, চেষ্টা দিয়েছিলুম, স্যর, সেই সতেরো-আঠেরো বছর বয়সেই চেষ্টা দিয়েছিলুম, এই কবিতা নামক জিনিসটির রসাস্বাদন করার। আর যে দোষ দেবেন দিন, শুধু এইটুকু বলবেন না যে, বুড়ো-হাবড়া হয়ে যাবার পর মডার্ন কবিতার প্রেম কামনা করে হতাশ-প্রেমিকরূপে পরিবর্তিত হয়েছি।

তার পর এল সেই শুভলগ্ন যেদিন মডার্ন কবিতার সঙ্গে আমাদের তালাকটি বেনওয়া সাহেব মঞ্জুর করলেন। আমরা সোল্লাসে ফিরে গেলুম দোদে, ফ্লুবেরের কাছে। শুনেছি, স্পেনের লোক নাকি বছরের প্রথম দিন এক গেলাস জল নিয়ে তাতে কড়ে আঙুলের ডগাটি ডুবিয়ে সেই আঙুল জিতে লাগিয়ে অতি সন্তর্পণে সভয়ে চাটার পর আঁতকে উঠে বলে, ওই সেই প্রাচীন দিনের পুরনো বিস্বাদ বস্তু; চ, ভাই, ফিরে যাই আমাদের মদের গেলাসেই। কেন যে পাদ্রি সায়েব মদ কমাতে আর বেশি জল খেতে বলেন বোঝা ভার। আমরাও স্পানিয়ার্ডদের মতো ফিরে গেলুম আমাদের ক্লাসিক্স-মদ্যে।

আমাদের মুখের ভাব দেখে নেওয়া সায়েব হেসে বললেন, তবু তো আমরা আছি ভালো, কারণ আমরা চর্চা করি সাহিত্যের। সেখানে উল্কষ্টে-নিকৃষ্ট পার্থক্য করা তেমন কিছু অসম্ভব কঠিন নয়। সেখানে রুচিবোধের অনেকখানি স্থিরতা আছে। কিন্তু হত যদি আমাদের বিষয়বস্তু চিত্র? তা হলে খানিকটে আভাস পেতে সে-ক্ষেত্রে রুচির কী আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হয় রাতারাতি। আজ যার ছবি ভোলা নিলামে বিক্রি হল লক্ষ ডলারে, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে সেই ছবিই বিক্রি হল হাজার ডলারে। আজ যাকে বলা হচ্ছে গ্রামের গ্র্যান্ড মাস্টার বা মেসরো (ওস্তাদের ওস্তাদ) তিন বছর যেতে-না-যেতে তাঁর ছবি হয়ে গেল বিল, পিফল (রদি, চোতা)!আর এসব ছবিই কিন্তু অ্যাকাডেমিক স্টাইলে আঁকা; কোনও নতুন এক্সপেরিমেন্টের কথা উঠছে না।

তবেই ধারণা করতে পারবে মডার্ন পেন্টিং নিয়ে কী অসম্ভব রুচি পরিবর্তন, রীতিমতো খুনোখুনি মারামারি। আর সে ছবিগুলোতে আছে কী? ধোয়াটে, তামাটে, বিকুটে কী যেন কী, জানেন শুধু আটিই, বা হয়তো তার অন্তরঙ্গ সখামণ্ডলী, এতে আছে কী, আর্টিস্টের উদ্দেশ্য কী নিচে লেখা বসন্ত। আর, আজ ফার অ্যাজ আই অ্যাম্ কনসার্নড় সেখানে বসন্ত না লিখে অভিধানের ভিতরের বা বাইরের যে কোনও শব্দ লিখলেও আমার তাতে সুবিধা-অসুবিধা কিছুই হয় না। অধিকাংশ আর্টিস্টই আবার তাদের ছবির কোনও নামই দেন না। বলেন, তারা নাকি ডিক্সনারি ইলাসট্রেট করার জন্য আঁকেন না।

বেনওয়া সাহেব সেদিন আরও অনেক খাঁটি তত্ত্বকথা বলেছিলেন। কারণ খাস ফরাসিদের মতো তাঁর কৌতূহল ও উত্সাহ ছিল–কাব্য, সঙ্গীত, চিত্র, ভাস্কর্য ইত্যাদি নানা রসের নানা প্রকাশে, নানা বিকাশে। সর্বশেষ তিনি ইমপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, কুবিজম, দাদাইজম ইত্যাদি বহুবিধ ইজম-এর ইতিহাস শোনানোর পর শেষ করলেন বানরালের কীর্তিকাহিনী শুনিয়ে।

কাহিনীটি আমার চোখের সামনে আজও জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় নাটকের যিনি হিরো তার নামটি ভুলে গিয়েছি। বানরালে-বানরালে গোছ কী যেন এক বিজাতীয় নাম– এ নামটা অনায়াসে আমারও হতে পারত, তবে এটুকু মনে আছে যে নামের মধ্যিখানে আন্ কথাটি ছিল। অবশ্য এ নাট্যের আদ্যন্ত আজও অতি সহজেই আবিষ্কার করা সম্ভবে, সামান্য কয়েক মাস কলকাতা-দিল্লি-বোম্বাই (এ ব্যাপারে বোম্বাই কোন পুণ্যবলে তীর্থভূমিতে পরিণত হলেন সে রহস্য পূতভূমির পাণ্ডারাও জানেন না) মাকু মারার পর নিরাশ হয়ে, শেষটায় ভিটেমাটি বেচে, কালোবাজারে ফরেন এক্সচেঞ্জ কিনে যদি প্যারিস চলে যান (ভুলবেন না, ফেরার সময় ম পলিয়ে থেকে একটা ডিলিট নিয়ে আসবেন; এদেশে কাজে লাগবে। প্ল্যাটফর্মেই বোধহয় সনদ বিক্রি হয়, নইলে হয়তো দু-একদিন বিশ্ববিদ্যালয়-পাড়ায় বাস করে, রেডিমেড থিসিস কিনে সেটা পেশ করা মাত্রই সনদটা পেয়ে যাবেন সঙ্গে সঙ্গে…ডট করা লাইনের সঠিক জায়গায় নাম সই করতে কিংবা টিপসই দিতে যেন ক্রটি না হয়…) তবে অদ্যকার বঙ্গসন্তানমাত্রই আনন্দিত হবে যে, কালোবাজার সেখানে নেই (সব খোলাখুলি, সামনাসামনি)।

প্যারিসের লোক সে কাহিনী এখনও ভোলেনি। আপনাকে নতুন করে বলার সুযোগ পেয়ে বড়ই উৎসাহের সঙ্গে সেটি কীর্তন করবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন মডার্ন আর্ট প্যারিসের অন্যসব প্রাচীন অর্বাচীন কলাসৃষ্টিকে ঝেটিয়ে মহানগরী থেকে বের করে দিয়েছে, তখন হঠাৎ একদিন উদয় হলেন গটগট করে, সূর্যোদয়ের গৌরব নিয়ে এই চিত্রকর চিত্রকর বললে অত্যল্পই বলা হয় যেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। এতদিন নাকি নির্জনে চিত্রসাধনায় নিযুক্ত ছিলেন বলে কোনও প্রদর্শনীতে ছবি পাঠাননি। কিন্তু এইবারে তার সময় হয়েছে। কারণ মডার্ন আর্ট তার নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে, তার চরম সিদ্ধিতে পৌঁছে গেছে এরই চিত্রকলায়।

একইসঙ্গে প্যারিসের তিনখানা প্রখ্যাততম পত্রিকা মারফত শুধু কলাবিভাগের নয়, অসাধারণ জ্ঞাতব্য সংবাদরূপে কাগজের উত্তমাঙ্গেও প্রকাশিত প্যারিসবাসী এবং দু-তিন দিনের ভিতর তাবৎ ফরাসিস জাতি এই নব অরুণোদয়ের সংবাদ পেয়ে বিস্মিত, স্তম্ভিত ও মুগ্ধ হল। ক্রমে ক্রমে সর্ব আর্টজর্নলে, বিশেষ করে সেইসব আলট্রা-মডার্ন-আর্টজলে, যেগুলো খবরটা সর্বপ্রথমে পরিবেশন করতে পারেনি বলে ঈষৎ বিব্রত বোধ করছিল, সর্বত্রই এই নবীন আর্টিস্ট সম্বন্ধে কলামের পর কলাম, পাতার পর পাতা জুড়ে নানাপ্রকারের বিশ্লেষণ তথা তাঁর প্রথম চিত্রের জন্ম থেকে শেষ চিত্র অবধি তার ক্রমবিকাশের সুনিপুণ ইতিহাস সবিস্তার বর্ণিত হল। শেষটায় কিন্তু একে লুফে নিলেন আলট্রা-মডার্ন আর্টের ক্রিটিকদের চাইরাই। এরা অ্যাকাডেমিক আর্টের জন্মশত্র, কসমূ-খাওয়া-খুনি-দুশমন। অন্যপক্ষে প্রথমটায় কিঞ্চিৎ গাইগুই না-রাম-না-গঙ্গা ধরনের দু-একটা মন্তব্য করার পর আলট্রা মডার্নদের হাতে ঘোল খেয়ে চুপসে রঙ্গভূমি বা জঙ্গভূমি, যাই বলুন, পরিত্যাগ করলেন। ওদিকে সেই চিত্রকরের ছবি দেখবার জন্য যা ভিড়, সেটা সামলাতে গিয়ে প্যারিস পুলিশের মতো সহিষ্ণু প্রতিষ্ঠানও হিমশিম খেয়ে গেল। ওঁর ছবি না-দেখা থাকলে তো প্যারিসের শিক (chic) সমাজে মুখ দেখানো যায় না, ওঁর সম্বন্ধে বিজ্ঞভাবে কথা বলাটাই তখন দ্যনিয়ে ক্রি– dernier cri- শব্দে শব্দে অনুবাদ করলে শেষ চিৎকার কিন্তু তার থেকে আসল অর্থ ওত্রায় না, বরঞ্চ আখেরি কালাম বললে ওরই গা ঘেঁষে যায়। আর্টের ব্যাপারে ফরাসি হনুকরণ (to ape)-কারী ইংরেজও ওই দর্নিয়ে ক্রি-ই আপন ভাষাতে ব্যবহার করে, অর্থ uterunost refinement- এরকম দুটো শব্দ কিছুতেই অনুবাদ করা যায় না বলে।

এমন সময় সিন্দবাদের সেই সুদর্শন, নিটোল, নিখুঁত সি-মোরগের আণ্ডাটি গেল ফেটে, কিংবা কেউ দিলে ফাটিয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে বেরুল উৎকট পচা দুর্গন্ধ। প্যারিসে তিষ্ঠনো কি সোজা ব্যাপার।

সেই যে বলেছিলুম একইসঙ্গে প্যারিসের তিনখানা প্রখ্যাততম পত্রিকা মারফত এই নবীন রবির প্রথম সংবাদ বেরোয়, এবং পরে সকলের অলক্ষ্যে এঁরা কেটে পড়েন সেই তিন সংবাদদাতা বা জালিয়াৎ আঙটি ফাটালেন– সর্বজনসমক্ষে ফটোগ্রাফসহ।

আসলে বানরালে নামে কোনও আর্টিস্টই নেই। এই তিন মিত্র একটা গাধাকে শক্ত করে বেঁধে নেন একটা খুঁটিতে। লম্বা ন্যাজে মাখিয়ে দেন সযত্নে, আর্টিস্টরা–বরঞ্চ বলা উচিত আলট্রামডার্ন আর্টিস্টরা যে রঙ, অয়েল কালার ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, সেইসব রঙ। তার ন্যাজের কাছে, পিছনে, আটিস্টদের তেপায়া স্ট্যান্ড বা ইজলের উপর ক্যানভাস। তার পর সেই গাধাটাকে দে, বেধড়ক মার! সে বেচারি পিছনের ঠ্যাং দুটো তুলে যত লাফায়, ততই তার নানা-রঙে-রাঙা ন্যাজ থাবড়া মারে ক্যানভাসের উপর। সঙ্গে সঙ্গে আঁকা হয়ে যায় মোস্ট আলট্রামডার্ন ছবি! ভিন্ন ভিন্ন সাইজের ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাস নিয়ে, গাধার ন্যাজ কখনও বিনুনির মতো ভাগ করে, কখনও গোচ্ছ গোচ্ছা করে বেঁধে যার যথা অভিরুচি–রঙের ভিন্ন ভিন্ন সংমিশ্রণ করে আঁকা হল ছবির পর ছবি! এবং পাছে লোকে অবিশ্বাস করে তাই ছবির প্রতি স্টেজে তার ফটো, গাধার লম্পঝম্পের ফটো, গর্দভের পুচ্ছাংশসহ চিত্রাংশের ফটো– এককথায় শব্দার্ধে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফ তোলা হয়েছে অপর্যাপ্ত।

তিন জালিয়াত বলা বাহুল্য, এরা তল্কালীন তথাকথিত মডার্ন আর্টিস্টদের গোঠ বেঁধে, দল পাকিয়ে চিৎকার ও অ্যাকাডেমিক আর্টের উদ্দেশে তাদের অশ্রাব্য কটুবাক্য শুনতে শুনতে হন্যে হয়ে গিয়ে শেষটায় উপযুক্ত সত্ত্বারটি করেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আবার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দিলেন বানরালে নামটার মধ্যখানে ane- ফরাসিতে যার অর্থ গর্দভ শব্দটি গোপনে গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ গাধাটিই এসব ছবির প্রকৃত আর্টিস্ট।

তস্য বিগলিতাৰ্থ, মোস্ট-আলট্রা-মডার্ন-আটিস্ট তথা তাদের মুখপাত্র আর্টক্রিটিকরা আদিন ধরে যাকে তাদের শিরোমণি করে, তাদের হিরো বানিয়ে বিনা বাদ্যে নেচেছেন (কী কল পাতাইছ তুমি! বিনা বাইদ্যে নাচি আমি।- লেখকের মাতৃভূমির প্রবাদ) তিনি একটি গর্দভ!

এ-জাতীয় ঘটনা আরও ঘটেছে। তার ফিরিস্তি দিতে যাবে কে আর উপরের উল্লিখিত ঘটনাটির পিছনে রয়েছে নষ্টামি। কিন্তু যেখানে কোনওপ্রকারের কুমতলব নেই, সেখানেও যে এরকমের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে সেটা বছর পাঁচেক পূর্বে সপ্রমাণ করে সুইডেনের মতো ঠাপ্ত দেশ।

সুইডেনের অন্যতম প্রখ্যাত অতি আধুনিক চিত্রকর কালক্ট্রোম ছবি আঁকার সময় একখানা ম্যাসোনাইটের টুকরোয় মাঝে মাঝে তুলি পুঁছে নিতেন। কাজেই সেটাতে হরেকরকম রঙ লেগে থাকার কথা। ওই সময় সুইডেনের ললিতকলা আকাঁদেমি এক বিরাট মহতী চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন–স্বতঃস্ফূর্ত কলা (Spontaneous art বা স্পন্টানিসাস এর নাম এবং এটাকেই তখন সর্বাধুনিক কলাপদ্ধতি বলা হত) ও তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ এই নাম দিয়ে সেই চিত্রপ্রদর্শনীতে থাকবে সুইডেন তথা অন্যান্য দেশের স্পন্টানিসমু কলার উত্তম উত্তম নিদর্শন। তখন হয়েছে কী, চিত্রকর ফালক্ট্রোম তার অন্য ছবি যাতে ডাকে যাবার সময় জখম না হয় সেই উদ্দেশ্যে পূর্বোল্লিখিত তুলি পৌঁছার রঙবেরঙের ম্যাসোনাইটের টুকরোখানা তার অন্য দু-খানা ছবির উপর রেখে প্যাক করে প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে দেন– এস্থলে বলা উচিত ফালক্ট্রোম ছবি ক্যানভাসের উপর না এঁকে আঁকতেন ম্যাসোনাইটের উপর। আকাঁদেমির বড়কর্তারা ভাবলেন এটাও মহৎ আর্টিস্টের এক নবীন কলানিদর্শন, এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সেই তুলি পোঁছার টুকরোটির নিচে আর্টিস্টের স্বনামধন্য নাম লিখে বুলিয়ে দিলেন তাঁর অন্য ছবির পাশে।

কেলেঙ্কারিটা কী করে বেরিয়ে পড়ে সে অন্য কাহিনী, কিন্তু যখন পড়ল তখন উঠল কাগজে কাগজে হইহই রব। শেষটায় খুদ আকাঁদেমির প্রেসিডেন্ট খুদাল্লার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বলেই ফেললেন, কী করি মশাইরা, বলুন। কে জানত শেষটায় এরকম ধারা হবে? অজিকাল নিত্যি নিত্যি এতসব নয়া নয়া এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে যে, কোনটা যে এক্সপেরিমেন্ট আর কোনটা যে অ্যাক্সিডেন্ট কী করে ঠাওরাই আমরা ভেবেছি গুণী ফালক্ট্রোম আর্টের ক্ষেত্রে একটা অভিনব নবীন পন্থা আবিষ্কার করতে পেরেছেন এবং সেই ভেবে ওই ছবিটাও প্রদর্শনীর অন্যান্য ছবির সঙ্গে টাঙিয়ে দিয়েছি।

রাস্তার লোক সব শুনে বলল, এতদিন যা শুধু সরস্বতীর বরপুত্ররাই বহু সাধনার পর, বহু তপস্যার ফলে সৃষ্টি করতে পারতেন, এখন দেখছি অ্যাক্সিডেন্টও (আকস্মিক যোগাযোগ) সেটা করতে পারে?

এর বহুপূর্বেই সংস্কৃতেও নাকি বলা হয়ে গিয়েছে, কোটি কোটি বৎসর ধরে উইপোকা কাঠ খেয়ে খেয়ে হিজিবিজি যে নকশা কাটছে, তার ভিতর হয়তো একদিন পূর্ণ প্রণব মন্ত্রটিই খোদাই হয়ে বেরিয়ে আসবে। পাঠক আদৌ ভাববেন না, আমি মডার্ন কবিতা বা আর্টের দুশমন। এর চেয়ে সত্যের অপলাপ ও অন্যায় অবিচার আমার প্রতি আর কিছুই হতেই পারে না। বস্তুত আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করি, প্রকৃত শিল্পী প্রতিদিন সেই চেষ্টাতেই থাকবে, কী করে নতুন ভঙ্গিতে নবীন পদ্ধতিতে তার মহত্তম চিন্তা নিবিড়তম অভিজ্ঞতা মধুরতম ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। নইলে তো আমরা প্রলয় পর্যন্ত পাখিসবের সঙ্গে সেই একই রব গেয়েও কূল পাব না।

কিন্তু গেল ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমি বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছি। পাবলো পিকাসোর নাম শুনলে আজকের দিনে শতকরা নিরানব্বই জনকি প্রাচীন কি অর্বাচীন সবাই অজ্ঞান। সেই পিকাসো গেল ফেব্রুয়ারি মাসের কাছাকাছি একটি বিবৃতি দেন। বোম্বায়ের Alvi Book Bulletin-এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় সেটি বেরিয়েছে। উপস্থিত আমি কোনও মন্তব্য করছি না। শুধু সেটি তুলে দিচ্ছি। বাংলায় অনুবাদও করব না, কারণ যারা ইংরেজি জানেন না তারা অযথা সন্তাপ থেকে বেঁচে যাবেন, আর যারা জানেন তাদের জন্য অনুবাদ নিষ্প্রয়োজন। আসল প্রধান কারণ অবশ্য, এটির সুষ্ঠু অনুবাদ আমার শক্তির বাইরে। তবে উভয় পক্ষকে অসন্তুষ্ট করার জন্য মোটামুটি একটি ব্যাখ্যা দেব।

Pablo Picasso, 83 years old Spanish-born father-figure of the modernist cult in art, has now made a sensational confession that he was simply amusing himself at the expense of his intellectual admirers with his bizarre creations. Says he :

The people no longer seek consolation and inspiration in art. But the refined people, the rich, the idle, seek the new, the extraordinary, the original, the extravagant, the scandalous. And myself, since the epoch of Cubism, have contended these people with all the bizarre things that have come into my head. And the less they understood it the more they admired it.

By amusing myself with all these games, all this nonsense, all these picture puzzles and arabesques, I became famous, and very rapidly. And celebrity, for a painter, means sales, profits, a fortune. Today, as you know, I am famous and very rich.

But when I am alone with myself I have not the courage to consider myself as an artist in the great sense of the word, as in the days of Giotto, Titian, Rembrandt, and Goya. I am only a public entertainer who has understood his time.

পিকাসো উক্তির বিগলিতাৰ্থ- আজকের দিনের মানুষ কলাসৃষ্টির দ্বারস্থ হয় না সান্ত্বনা বা অনুপ্রেরণার জন্য; আজকের দিনের নির্মা, তথাকথিত বিদগ্ধ ধনীরা চায়, নতুন, মৌলিক, অসাধারণ, বাড়াবাড়ির চরম, কেলেঙ্কারির কলা আর তিনি সেই ক্যুবিজেম-এর(৩) আমল থেকে তার মাথায় যতসব আবোল-তাবোল হযবরল (bizarre)(৪) এসেছে, সেগুলো দিয়ে ওইসব ধনীদের সন্তুষ্ট করেছেন। এবং তার ওইসব বিজার ছবি তারা যত কম বুঝতে পেরেছে, সেই অনুপাতে মুগ্ধ প্রশংসা করেছে ততই উচ্চমাত্রায়। আর তিনিও ফুর্তি পেলেন ওই ধরনের, ওদেরই প্রার্থিত খেলা খেলতে আঁকলেন অর্থহীন যা-তা (ননসেন্স), ছবির ধাঁধা, জ্যামিতিক ডিজাইন এবং তারই ফলে হয়ে গেলেন বিখ্যাত। আর আর্টিস্টের পক্ষে বিখ্যাত হওয়ার অর্থই, প্রচুর ছবি বিক্রির ফলে প্রচুরতর অর্থলাভ। এবং সবাই এখন জানেন, পিকাসো বলছেন, তিনি এখন বিখ্যাত এবং খুবই সম্পদশালী।

কিন্তু তার পরই বলছেন, কিন্তু তিনি যখন একা বসে আত্মচিন্তা করেন, তখন আর তার সাহস হয় না, নিজেকে সেই মহান অর্থে শিল্পী আখ্যা দিতে, যে অর্থে শিল্পী বোঝাত জিত্তো, তিসয়ান, রেমব্রান্ট, গোইয়া-র যুগে। তিনি শুধু দিয়েছেন সবাইকে ফুর্তি (পাবলিক এন্টারটেনার–তার রূঢ়তম অর্ধ ভাড়, সার্কেসের ক্লাউন, সঙ) কারণ তিনি যেমন কলি, তেমন চলি তত্ত্বটি বুঝতেন।

এই বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর পিকাসোর কর্তাভজা সম্প্রদায়ে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট হয়, সেটা আমার চোখে পড়েনি। তবে আমার কাছে পূর্বের অবোধ্য একটি সমস্যা সরল হয়ে গেল।

পিকাসো বৃদ্ধবয়সে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। কয়েক বছর পর তরুণী তাকে ত্যাগ করে তালাক দেন (কিংবা হয়তো পিকাসোই এমন পরিস্থিতি নির্মাণ করেন যে তালাক ভিন্ন অন্য গতি ছিল না—কারণ তিনি গ্রেট আর্টিস্ট হন আর নাই হন, এ-তত্ত্বটি কিন্তু অনস্বীকার্য, গ্রেট আর্টিস্টদের যে-খামখেয়ালির বাতিক থাকে, মাথায় যে-ছিট থাকে সেটা তিনি পেয়েছেন ন-সিকে।) এবং পিকাসোর সঙ্গে তার দাম্পত্যজীবন সম্বন্ধে একখানি পুস্তক প্রচার করেন। পিকাসো নাকি সেটা ঠেকাবার চেষ্টা করে বিফল হন। সেই জীবনীটি যখন ধারাবাহিকভাবে কন্টিনেন্টের একটি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয় তখন তার প্রায় সবকটা কিস্তিই আমি পড়ি, এবং আমার মনে সবচেয়ে বেশি বিস্ময় সৃষ্টি করল– আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, সে পুস্তিকায় পিকাসো তার তরুণী স্ত্রীকে আর্ট বলতে কী বোঝায় এবং এই বিষয় নিয়ে যেসব আলোচনা তার সঙ্গে করেন সেগুলো সব প্রাচীন যুগের কথা; অর্থাৎ সেই মাইকেল এঞ্জেলোর আমল থেকে প্রায় একশো বসর পূর্বপর্যন্ত আলঙ্কারিক, কলারসিকরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্টের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, আর্ট-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যেসব অভিমত প্রকাশ করেছেন, পিকাসো মোটামুটি তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র!

আমি তখন চিন্তা করে বিহ্বল হয়েছি, এই যদি আর্ট সম্বন্ধে পিকাসোর ধারণা হয় তবে তাঁর আঁকা ছবির সঙ্গে এ ধারণার কোনও সামঞ্জস্যই তো খুঁজে পাচ্ছিনে! একদিকে লোকটি আর্ট সম্বন্ধে ক্ল্যাসিকাল, অ্যাকাডেমিক ধারণা পোষণ করেন, আর অন্যদিকে তিনি একে যাচ্ছেন তার ভাষাতেই বলি– বিজার গ্রোটেক যতসব মাল!

এ যেন, আপনি নামতা শিখেছেন ঠিকই, কিন্তু অঙ্ক কষার বেলা করছেন ৩x৪ = ৮২, ৭+৫ = ২!

পিকাসোর এই বিবৃতিটি পড়ে আমার মনের ধন্দ গেল। তার আদর্শ ছিলেন জিতো, রেমব্রান্টই, কিন্তু তিনি জানতেন প্রথমত, ওদের স্তরে আদৌ পৌঁছতে পারবেন কি না; দ্বিতীয়ত, পৌঁছতে পারলেও বাজারে সেই প্রাচীন ঢঙের ছবির চাহিদা আজ আর আদপেই নেই; তৃতীয়ত, তারও খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন এবং সর্বশেষে, সেই অর্থের জন্য যখন ছবি আঁকব আপন আদর্শ বেহায়া বিসর্জন দিয়ে– তবে সেইটাই কবি পূর্ণমাত্রায় ইংরেজিতে যাকে বলে উইথ এ ভেনজেনস, উর্দুতে বলে, পড়ে তলওয়ার দামকে সম্ভালে কোই– তলওয়ার যখন ধরেইছি তখন রক্তের ছিটে পড়বে বলে কুর্তার দমন (প্রান্ত, অঞ্চল) অন্য হাত দিয়ে সামলানোটা বিলকুল বেকার।

অবশ্য এসব তর্কবিতর্কের অর্থ হয়, যদি আমরা নিঃসন্দেহে ধরে নিই যে পিকাসো এ-বিবৃতিতে প্রাণের কথা খোলাখুলিই বলেছেন, সজ্ঞানে সত্যভাষণই করেছেন। নইলে কাল যদি আরও পয়সা কামানোর জন্য, বা বিনা-কারণেই আরেকটা নয়া ফয়তা ঝেড়ে বলেন, না না, ওটা আমার সত্য বিবৃতি নয়। আমি শুধু রগড় দেখবার জন্য এই মস্করাটা করেছিলাম আমার অন্ধ স্তাবক, এবং ওইসব মূর্ষ ধনীরা যারা নৃত্য করতে করতে আমার ছবি কিনেছে হুজুগে মেতে, ন্যায্যমূল্যের শতগুণ বেশি টাকা ঢেলে, তারা তখন কী বলে?–সোজা ইংরেজিতে আই উয়োজ পুলিং দেয়ার লেগ!– তখন আজ যেসব প্রাচীনপন্থীরা এই হাটের মধ্যিখানে হাঁড়ি ভাঙাটা দেখে উল্লাসে চিৎকার করে উঠেছেন, তাঁরা লুকোবেন কোন ইঁদুরের গর্তে!

অবশ্য শেষপর্যন্ত কর্তাভজাদের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। তারা বলবেন, আজ যদি শেক্সপিয়ারের স্বহস্তে লিখিত একখানা গোপন ডাইরি বেরোয় যাতে তিনি লিখেছেন, আমি হতে চেয়েছিলুম হোমার, ভার্জিলের মতো কবি, কিন্তু যখন দেখলুম এ যুগে সেসব কবিদের চাহিদা নেই তখন হয়ে গেলুম পাবলিক এন্টারটেনার- ভাঁড় তা হলেই কি আমরা সেটা মেনে নেব, আর বলব, শেক্সপিয়ার গ্রেট পোয়েট নন!,

মুসলমানদের ভিতর একাধিক সম্প্রদায়ের লোক বিশ্বাস করেন, তাঁদের সপ্তম ইমাম (পৃথিবীতে আল্লার প্রতিভূ) অদৃশ্য হয়ে যান, তিনি সত্যি সত্যি মারা যাননি– সময় হলেই তিনি অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে মাহূদি (কল্কি) রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। অন্য সম্প্রদায় বলেন, সপ্তম ইমাম না, অদৃশ্য হন দ্বাদশ ইমাম, তিনিই মাহদিরূপে ইত্যাদি। তৃতীয় সম্প্রদায় বলেন, দ্বাদশ না, চতুর্বিংশতি ইত্যাদি।

এদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে স্পেনের আন্দালুশ প্রদেশের মৌলানা ইবন হাজম যেন এদের বাবদে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে মাথা থাবড়াতে থাবড়াতে বলছেন, অলৌকিক এদের অন্ধবিশ্বাসের পঙ্ককুণ্ডে নিমজ্জিত হয়ে থাকবার ক্ষমতা! কারও ইমাম অদৃশ্য হয়েছেন অষ্টম শতাব্দীতে, কারও নবম, কারও-বা দশমে। যে জিনিস হারিয়ে গেছে (অদৃশ্য হয়েছে) দুশো তিনশো চারশো বছর আগে, এরা এখনও সেটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউবা আবার বলে, অদৃশ্য ইমাম আছেন একটা মেঘের আড়ালে। আহা, যদি জানতুম কোন মেঘটা! চিৎকারে চিৎকারে তাকে অতিষ্ঠ করে বলতুম, সশরীরে নেমে এসে কুলে বখেড়ার ফৈসালা করে দাও না, বাবা! তাজ্জব তাজ্জব!

পিকাসসোর আগের বিবৃতি যদি সত্য হয় তবে আমাদের বলতে হবে, ভক্তজনের উপাস্য পিকাসো তিনি আত্মহত্যা করলেন। আর ভক্তজন বলবেন, তিনি মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়েছেন।

.

আর যেসব সরলজন বিশ্বাস করে ওইসব বিজারের বাজার বিলকুল ফুটা, মশকরা করে ছবির ধাঁধা বানিয়ে আর আরাবে একে প্রকৃত কলাসৃষ্টি হয় না, তার জন্য প্রচুর অক্লান্ত তপস্যার প্রয়োজন তাদের জন্য নিম্নের উদ্ধৃতিটি তুলে দিলুম; কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলুম না আমার চোখে পড়েছে এই আজ : কিছুদিন আগে কোনও একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আলাউদ্দিন সাহেব এবং গোলাম আলি সাহেবকে সংবর্ধনা জানানো হয়। অভিনন্দনের উত্তরে আলাউদ্দিন সাহেব বললেন– নাই বছর ধরে সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর দর্শনের আশায় সাধনা করে আসছি। একটিমাত্র আশায় দিনের পর দিন সাধনা করে আসছি। একদিন-না-একদিন তিনি প্রসন্ন হয়ে আমাকে অমরাবতীর সংগীত-মন্দিরে ঢোকবার অনুমতি দেবেন। আজও আমার সাধনার শেষ নেই। এতদিন সাধনার ফলে দূর থেকে শুধু মন্দিরের আবছায়া ছায়াটা যেন একটু একটু নজরে আসছে।

এর পর গোলাম আলি সাহেব অভিনন্দনের উত্তরে বললেন– আলাউদ্দিন খা সাহেব। মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। দেবী সরস্বতী তার সাধনায় তুষ্ট হয়ে তাকে মন্দিরের ছায়া দেখিয়েছেন। কিন্তু আমি হতভাগ্য এতদিন সাধনা করার পরেও সঙ্গীত-মন্দিরের ছায়া দেখতে পাওয়া দূরে থাক–উপরে ওঠবার সিঁড়িটুকুও এখনও শেষ করতে পারিনি। জানি না কত সহস্র বছর আরও কঠিন কঠোর সাধনায় দেবী প্রসন্ন হবেন।

———–

১. এইসব অধ্যাপকদের সম্বন্ধে যেটুকু সামান্য বিবরণ পাঠক পাবেন সেটুকু শ্ৰীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনীতে। কিন্তু তার মূল বক্তব্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ছিল বলে, বাধ্য হয়ে অধ্যাপকদের সম্বন্ধে বিবরণ দিয়েছেন সংক্ষিপ্তরূপে।

২. সব জিনিস মূল ভাষাতে পড়তে হবে এ উন্নাসিকতার কোনও অর্থ হয় না। আমার আপন অভিজ্ঞতা বলে, বহুক্ষেত্রে অনুবাদ মূলের চেয়ে ঢের সরেস হয়েছে। তার একাধিক কারণ আছে, কিন্তু সে-আলোচনা এস্থানে অবান্তর এবং সংক্ষেপে সারবার উপায় নেই।

৩. এদেশে গগনেন্দ্রনাথ সত্যই ছবি এঁকেছিলেন ওই ঢাবিজ পদ্ধতিতে।

 ৪. মডার্ন মাথামুণ্ডুহীন ছবির জন্যই যেন এই মোক্ষম bizarre শব্দটি নির্মিত হয়েছিল। ইংরেজ আভিধানিক এর প্রকৃত অর্থ বোঝাতে গিয়ে যেন দিশা না পেয়ে অনেকগুলো কাছেপিঠের শব্দ ও তাদের সমন্বয় করেছেন : eccentric, fantastic, grotesque, mixed in style, half barbaric. কিন্তু এদেশের সুকুমার রায় বিজার শব্দটির প্রকৃত অর্থ একটি কবিতার মারফতে যা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সেটি বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। আমি কয়েক ছত্র তুলে দিচ্ছি :

কেউ কি জানে সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা
ছবির ফ্রেমে বাধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা?
 পাউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা?
 কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে?
 জোছনা রাতে সবাই কেন আলতা মাখায় চোখে?
 ওস্তাদের লেপমুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে?
 টাকের পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে?
 সভায় কেন চেঁচায় রাজা হুক্কা হুয়া বলে?
মন্ত্রী কেন কলসি বাজায় বসে রাজার কোলে?
 সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
 কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি ইত্যাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *