স্পাই
আশ্চর্য!
মানুষ কত সহজে বিশ্বখ্যাত লোককে ভুলে যায় বিশ্ববিখ্যাত লোককে ভোলাটা মানুষের পক্ষে অবশ্যই স্বাভাবিক।
মাতা হারিকে সচরাচর পৃথিবীর লোকে পয়লা নম্বরি পাই খেতাব দিয়েছে কিন্তু অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সে খ্যাতির চৌদ্দ আনা পরিমাণ গুজব আর কিংবদন্তির ওপর নির্ভর করছে। বাকি দু-আনাও বিশ্বাসযোগ্য কি না বলা কঠিন।
কিন্তু গত বিশ্বযুদ্ধের স্পাইদের রাজার রাজা রিষার্ট জরগে সম্বন্ধে অনেক কিছু পাকা খবর জানা গিয়েছে। অবশ্য এ সত্য প্রতিভাসিত যে, যে কোনও স্পাই সম্বন্ধে সব খবর কোনওদিনই পাওয়া যায় না। স্পাই ধরা পড়ার পর তার সম্বন্ধে সব খবর যদি খুঁড়ে বের করা যায় তবে সে চা পাই।
কিন্তু তার পূর্বে আরেকটি কথা বলে নিই। গুপ্তচরবৃত্তি বা এসপিয়োনাজের প্রথম অলিখিত আইন, গুপ্তচর যদি বিদেশে ধরা পড়ে তবে যেদেশের হয়ে সে কাজ করছিল সেদেশ কিছুতেই স্বীকার করে না যে ওই লোক তাদের গুপ্তচর। তার কারণ, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে এক দেশ অন্য দেশে সরকারিভাবে গুপ্তচর রাখতে পারে না– অথচ আশ্চর্য, প্রায় সব দেশই সেটা করে থাকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে জরগে একমাত্র ব্যত্যয়। রুশের হয়ে ইনি জাপানে সুদীর্ঘ দশ বৎসর কৃতিত্বের সঙ্গে স্পাইগিরি করে ১৯৪১-এ ধরা পড়েন এবং ১৯৪৪-এ তার ফাঁসি হয়। যুদ্ধশেষে যখন তার কর্মকীর্তির অনেকখানি প্রকাশ পেল তখন তাবৎ ইয়োরোপে হইচই পড়ে গেল এবং বহু ভাষায় তার সম্বন্ধে বিস্তর সিরিয়াল রগরগে কেতাব, সিনেমা, নাট্য ইত্যাদি তাবৎ পূর্ব-পশ্চিমকে রোমাঞ্চিত করে তুলল। বিশেষ করে জাপানকে। কারণ এইমাত্র বলেছি তার শেষ কর্মভূমি ছিল জাপান।
এবং এই ডামাডোলের মধ্যিখানে কোথায় না রুশ তার গোরস্তানের নৈস্তব্ধ্য বজায় রেখে নিস্তব্ধতা হিরণয়–সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন নীতি পুনরায় সপ্রমাণ করবে, উল্টো পৃথিবীর সব রাজনৈতিক-ঐতিহ্য ধূলিসাৎ করে সগর্বে সদম্ভে সরকারিভাবে স্পাই জরগের স্মৃতির উদ্দেশে বলশেভিক রুশ দেশের সর্বাধিপতি সর্বোচ্চ সম্মান মেডেল ইত্যাদি অর্পণ করলেন– এ মেডেল রুশ দেশের যুদ্ধকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদেরই দেওয়া হয় মাত্র। যতদূর মনে পড়ছে তার ছবিসহ স্ট্যাম্পও বেরিয়েছিল।(১) কিন্তু হায়, সে মেডেল গ্রহণ করার জন্য জরগের দারাপুত্র পরিবার কেউ ছিল না। তার স্ত্রীকে তিনি বহু পূর্বেই তালাক দিয়েছিলেন– তার গুপ্তচরবৃত্তিতে সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ করার জন্য। অনেকটা হিটলারের মতো। তিনিও ওই কারণে আদৌ বিয়ে করেননি– করলেন, যখন তার রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চের বৃহৎ কৃষ্ণ যবনিকা নটগুরু মহাকাল কামান গর্জনের অট্ট করতালির মাঝখানে নামিয়ে দিলেন, এবং সে বিবাহ সেই কৃষ্ণ যবনিকার অন্তরালে। আত্মহত্যার পিস্তলধ্বনি সে বিবাহের আতশবাজির বোম। স্ত্রীও নাট্যমঞ্চের জুলিয়েতের মতো বিষপান করলেন।… মার্কিন খবরের কাগজের নেকড়েরা এড়ি (পূর্ব বাঙলার মুসলমানি ভাষায়, তালাকপ্রাপ্তা রমণীকে এড়ি–ডিভোর্সে–এবং বিধবাকে বাড়ি বলে) জরগেকে খুঁজে বের করুল। রমণী স্বল্প- তথা সত্য-ভাষিণী। তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, ন-সিকে খাঁটি স্পাইদের মতো জরগে তার স্ত্রীকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে দেননি তিনি কী নিয়ে দিবারাত্র লিপ্ত থাকেন।
জরগের জীবন এমনই বৈচিত্র্যময় এবং ঘটনাবহুল যে, সুদ্ধমাত্র তার সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিতে গেলেই একখানা মিনি সাইজের মহাভারত লিখতে হয়।… আমি গুপ্তচর জরগেকে নিয়ে গুপ্ত পদ্ধতিতে দিব্য একখানা রগরগে সিরিয়াল লিখতে পারি- যত কাঁচা ভাষা ততোধিক বেটপ শৈলীতে লিখলেও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যবশত সেটা উৎরে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু বয়স হয়েছে। আমার জীবনদুর্গে প্রাচীরের বাইরে, গভীর রাত্রে যমদুতের পদধ্বনি প্রায়ই নতে পাই। মাঝে মাঝে ইদানীং ক্রমেই টেম্পো বেড়ে যাচ্ছে-প্রাচীরের উপর সাহেবি কায়দায় নকুও করে। এহেন অবস্থায় সিরিয়াল অসম্পূর্ণ রেখে উল্টোরথহীন রথযাত্রায় বেরুতে চাইনে–মমেকসদয় সম্পাদকমণ্ডলীকে ক্ষিপ্ত পাঠক সম্প্রদায়ের অভিসম্পাতকুণ্ডে নিমজ্জিত করে। কাজেই সম্ভাব্য ক্ষিপ্ত পাঠকমণ্ডলীর জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ দিচ্ছি– সাতিশয় সংক্ষিপ্ত (২)
দুই কারণে সোভিয়েত দেশ জরগের কাছে চিরঋণী। অবশ্য রুশের আরও বহু সেবা তিনি করেছেন।
প্রথম : হিটলার রুশদের আক্রমণ করার বেশ কয়েক মাস অর্থাৎ পর্যাপ্তকাল পূর্বে জরগে জাপান থেকে গোপন বেতারযোগে (বেতারযন্ত্রটি চালাতেন তার এক সহ-স্পাই) স্তালিনকে খবর পাঠান, হিটলার চুক্তিভঙ্গ করে রুশ আক্রমণ করবে। শুধু তাই নয়, কোন মাসে, কোন সপ্তাহে সে খবরও পাকাপাকিভাবে জানান। আশ্চর্য, যখন খুদ জর্মনির মাত্র গুটিকয়েক ডাঙর ডাঙর জাদরেল জানতেন যে হিটলার রুশ আক্রমণ করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেছেন এবং তারাও জানতেন না, কবে কোন মাসে হিটলার সে হামলা শুরু করবেন, তখন জর্মনি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের জাপানে বসে জরগে এই পাকা খবরটি পেলেন কী করে? মনে রাখা উচিত, ১৯৩৯-এ যুদ্ধার পর থেকে জাপান এবং জর্মনির মধ্যে কোনও যাতায়াত পথ ছিল না। (সুভাষচন্দ্র যে কতখানি বিপদের ঝুঁকি মাথায় তুলে জর্মনি থেকে জাপান পাড়ি দিয়েছিলেন সেকথা সবাই জানেন।) সুইজারল্যান্ড থেকে গোপন বেতারেও যেমন মনে করুন খবরটা প্রথম জনি থেকে নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডে গুপ্তচর মারফত গেল– সেটা পাঠানো প্রায় অসম্ভব ছিল। ওরকম বেআইনি জোরদার বেতার ট্রান্সমিটার সুইস সরকার ধরে ফেলতই ফেলত। এস্থলে আরও বলি, হিটলার তার যুদ্ধের প্ল্যান তার দূর-মিত্র জাপানকে তো বলতেনই না, তার অতিশয় নিকট-মিত্র ভৌগোলিক ও হার্দিক উভয়ার্থে মুসসোলিনিকেও আগেভাগে জানাতেন না। এবং জাপানে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসও আর-পঞ্চাশটা দেশে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসের মতোই যে এ ব্যাপারে কিছুই জানত না সে তো বহু ক্ষেত্রে সপ্রমাণ হয়ে গেছে। হিটলার যে তার ফরেন আপিস এবং তাঁর রাজদূতদের অবিশ্বাস করতেন তাই নয়, এদের রীতিমতো ঘৃণা করতেন। এবং এ তত্ত্বটি হিটলার কোনওদিন গোপন রাখার কণামাত্র প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র তার আপন খাস প্যারা ফরেন মিনিস্টার রিবেট্রপকে। ইনি জাতে শুড়ি। কূটনীতিতে তার কোনও শিক্ষাদীক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। তত্সত্ত্বেও হিটলার গদিনশিন হওয়ার সামান্য কয়েক বৎসর পর তার পার্টি, ফরেন আপিস, এমনকি তার দক্ষিণ হস্ত গ্যোরিঙ, বাম হস্ত গ্যোবেলস সক্কলের তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে রিবেট্রপকে দুম করে বসিয়ে দিলেন ফরেন আপিসের মাথার উপর মহামান্য পররাষ্ট্র সচিবরূপে।
জরগের দ্বিতীয় অবদান : যে রাত্রে জাপানি মন্ত্রিসভা এক অতিশয় গোপন বৈঠকে স্থির করলেন হিটলার রুশ আক্রমণ করার পর জাপানকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, তারা যেন রুশের পূর্বসীমান্ত আক্রমণ করে যে তারা কোনও অবস্থাতেই রুশ দেশ আক্রমণ করবেন না, তার পরদিন ভোরবেলা জরগে সেই সাতিশয় গুরুত্বপূর্ণ গোপনতম সিদ্ধান্তটির বর পেয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে স্তালিনকে পূর্ব পদ্ধতিতে সংবাদটি জানান। স্তালিনের বুকের উপর থেকে জগদ্দল জগরনট নেমে গেল। জাপানি আক্রমণের ভয়ে পূর্ব সীমান্তে ভার যে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল সেটাকে তদ্দশ্যেই পশ্চিম সীমান্তে এনে হানলেন হিটলারের উপর মোক্ষম হামলা। দুই সীমান্তে একইসঙ্গে কে লড়তে চায়? ওই করে সর্বনাশ হল কাইজারের। হিটলারেরও আখেরে সেই গতিই হয়েছিল। রুশ বেঁচে গেল।
পত্রান্তরে বেরিয়েছে : গত ৬ নভেম্বর পূর্ব জনির পূর্ব বার্লিনের একটি রাস্তার উপর প্রাক্তন রুশ স্পাইদের একটি সম্মিলিত অনুষ্ঠান হয় প্রকাশ্যে। রয়টার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন : স্পাইদের সম্মেলন– তা-ও প্রকাশ্যে।
এরা সমবেত হয়েছিলেন তাদের গুরুর গুরু জরগের স্মরণে।
পঁচিশ বৎসর পূর্বে বিশ্ব কনিজমের জন্য টোকিয়োতে প্রাণ দেন।
যে রাস্তাতে ভঁরা সমবেত হন সেখানে সেনাবাহিনীর ব্রাসব্যান্ডের সঙ্গীতসহ রাস্তাটির নতুন নামকরণ হয়।
রিষার্ট জরগে স্ট্রাসে।
.
রিষার্ট জরগে খাঁটি জর্মন নাম। রিষার্টের পিতা ছিলেন খাঁটি জর্মন, মা রুশ। জরগের জন্ম রুশদেশে। জাপানে থাকাকালীন জরগে সর্বজনসমক্ষে বলতে কসুর করতেন না যে, রুশের প্রতি তার বিশেষ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি আছে। তৎসত্ত্বেও কেউ কখনও সন্দেহ করেননি যে তিনি রুশের শাই, অতখানি কী করে হয়। এদিকে তার মূল কর্ম ছিল জাপান সম্বন্ধে স্তালিনকে খবর দেওয়া এবং দ্বিতীয় সেই সুদূর জাপান থেকে জর্মনির অভ্যন্তরীণ গুপ্ত খবরও সহ করে তাকে জানানো কী করে তিনি সংগ্রহ করতেন সেটা প্রাশাটে (প্ল্যানচেটে) শার্লক হোমসকে আবাহন জানালে হয়তো জানা যেতে পারে। জরগে ধরা পড়ার পর জাপানে প্রবাসী জর্মন-অজর্মন সবাই একবাক্যে বলেছেন, জরগে কস্মিনকালেও তাদের কাছ থেকে জর্মনি সম্বন্ধে কোনও খবরাখবর পাম্প তো করতেনই না, উল্টো নয়া নয়া খবর দিয়ে তাদের পিলে চমকে দিতেন; পরে সেগুলো কনফারড হত।
জরগের চেহারাটি ছিল সুন্দর এবং পুরুষত্বব্যঞ্জক। দীর্ঘ বলীয়ান দেহ। নাক চোখ ঠোঁট যেন পাথরে খোদাই অতি তীক্ষ্ণ। তাঁকে দেখে মনে হতো যেন চ্যাম্পিয়ন বক্সার বিরাট কোনও মেলাতে চ্যালেঞ্জ করে বেড়াচ্ছেন, কেউ তার সঙ্গে লড়তে রাজি আছে কি না–
বলছেন এরিষ করট, জাপানে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসের দুই নম্বরের কর্মচারী। অবশ্য টোকিয়োতে তিনি সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতেন তর্কযুদ্ধে এবং জিততেন হামেশাই। কারণ তার তূণীর ভর্তি থাকত তথ্যের লেটেস্ট ইনটেলিজেন্সের শরচ্ছে। অর্থাৎ নেকেড় ফ্যাক্টস।
সেই যে গল্প আছে, গ্রামাঞ্চলের দুই ইরাকি জমিদার মোকদ্দমা লড়তে লড়তে আপিল করেছেন বাগদাদের শেষ আদালতে অর্থাৎ স্বয়ং খলিফা হারুন-উর-রশিদ এর শেষ ফাইনাল বিচার করবেন। এক জমিদার বাগদাদে এসে উঠলেন তার সখা বাদশার প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদে। প্রতিবাদী উঠলেন তার বাল্যের বান্ধবী বাদশার খাস প্যারা রক্ষিতার বাড়িতে। বাদী মোকদ্দমা হেরে গ্রামে ফিরলে পর সবাই বিস্ময় মেনে শুধোল, প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে উঠেও আপনি মোকদ্দমার সুরাহা করতে পারলেন না? তিনি বিজ্ঞজনোচিত কণ্ঠে বললেন, তাঁরা যে উঠেছিলেন রাজরক্ষিতার বাড়িতে। আমার কোনও যুক্তি কোনও নজির দাঁড়াতে পারে উলঙ্গ যুক্তির বিরুদ্ধে, এগেনস্ট নেকেড আরগুমেন্ট!
জরগের বেশভূষা ছিল অপরিপাটি; তিনি বাস করতেন টোকিওর সবচেয়ে খাঁটির খাঁটি ঘিঞ্জি জাপানি মহল্লায় এবং বাড়িটা চোখে পড়ার মতো নোংরা। কিন্তু জাপানিদের আকর্ষণ করার মতো কেমন যেন একটু চুম্বকের শক্তি তার সর্বাঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হত। তারা তাকে পুজো করত বললে কমই বলা হয়। এদিকে তার চালচলন ছিল ভ্যাগাবন্ড, বেদে বা বোহেমিয়ান ধরনের। রমণীবাজি করতেন প্রচুর এবং মদ্যপান করতেন বেহ। তিনটে বোতল হুইস্কি ঘণ্টা কয়েকের ভিতর সাবড়ে দিতেন তিনি অক্লেশে- চোখের পাতাটি না কাঁপিয়ে এবং তাঁর চোখের সেই তীক্ষ্ণ জ্যোতিটির উপর সামান্যতম ঘোলাটে পৌঁছ পড়ত না।
অর্থাভাব তার লেগেই থাকত। ধরা পড়ার পর অনুসন্ধান করে জানা যায়, তার আমদানি যে কোনও মাঝারি রাজ-দূতাবাসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের মতো অতি সাধারণ। পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি কখনও তার স্পাইবৃত্তি এক্সপ্লয়েট করেননি। তিনি স্পাই হয়েছিলেন কম্যুনিজমের প্রতি তার আন্তরিক আদর্শবাদে প্রবুদ্ধ হয়ে।
জরগে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন রুশ এবং জনি উভয় দেশে। তার স্বৰ্গত ঠাকুর্দা ছিলেন কার্ল মার্কসের সেক্রেটারি। শিক্ষা সমাপনান্তে, প্রথম যৌবনে, এ শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি পশ্চিম জর্মনিতে একটি কম্যুনিস্ট পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অতঃপর তাঁকে তৃতীয় ইন্টারনেশনালের বৈদেশিক গুপ্তচর বিভাগে কর্ম দিয়ে স্কানডিনেভিয়া ও পরে তুর্কিতে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পাঠানো হয়। তুর্কিরা এসব বাবদে অসাধারণ চালাক। গন্ধ পেয়ে যায়। অচিরায়। জরগে কিয়ৎকাল জেল খাটলেন– তার গুপ্তচরবৃত্তিতে এই একটিমাত্র কলঙ্ক; সর্বসাধারণ অবশ্য যুদ্ধশেষের অনেক পরে এসব জানতে পায়। ১৯৩০ সালে রুশ সরকারের আদেশে তাকে পাঠানো হয় সাংহাইয়ে। এখান থেকে আরম্ভ হয় তার কৃতিত্বময় জীবন। …জরগেকে যে জাপানি কোর্ট মারশালের সামনে দাঁড়াতে হয় সে মোকদ্দমার নথিপত্র মার্কিনরা জাপান অধিকার করার পর হস্তগত করে। তার থেকে জানা যায়, জরগে সাংহাইয়ে যেসব দেশি-বিদেশি কম্যুনিস্টদের সংস্পর্শে আসেন তাদের অন্যতম হজুমি ওসাকি নামের জনৈক জাপানি। এরপর এরা মস্কোর আদেশে টোকিও চলে আসেন।
প্রকাশ্যে তার পেশা ছিল নাৎসি-নির্দেশচালিত (অবশ্য তখন তাবৎ জর্মন প্রেসই গ্যোবেলসের কজাতে) ফ্রাঙ্কফুর্টের আলগে-মাইনে সাইটুঙের সংবাদদাতারূপে। তবে তাঁর অনেক প্রবন্ধই ছাপাবার মতো সাহস সম্পাদকমণ্ডলীর ছিল না। তারা সেগুলো না ছেপে চেপে যেতেন। সহকর্মীরূপে তাঁকে ক্লাউজেন নামক আরেক জর্মন গুপ্তচর দেওয়া হয়েছিল। প্রকাশ্যে তাঁর ব্যবসা ছিল মোটর মেরামতি। ওদিকে ছিলেন সেরার সেরা রেডিয়োর ওস্তাদ। অবশ্য জাপান থেকে কুশের পূর্বতম সীমান্তে রেডিয়োবার্তা পাঠাতে জোরদার ট্রান্সমিটারের দরকার হয় না– ধরা পড়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম। ক্লাউজেনও ধরা পড়েছিল কিন্তু তাকে জাপানিরা ফাঁসি দেয়নি; যুদ্ধশেষে রুশ দেশে ফিরে যাবার অনুমতি দেয়।
জরগে যখন ধরা পড়লেন এবং সামান্যমাত্র অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে তিনি বাঘা স্পাই, তখনই জাপান মন্ত্রিমণ্ডলী বিশ্বয়ে হতবাক। এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য! এইমাত্র যে জাপানি হজুমি ওসাকির নাম বললুম সে লোকটি কী করে হয়ে গিয়েছিলেন প্রিন্স কনোয়ের সাতিশয় বিশ্বাসভাজন সহকর্মী। এই কনোয়েটি যে-সে ব্যক্তি নন। একে তো জাপানের তিন-চারটি খানদানিতম ঘরের একটির প্রিন্স ডিউক, তদুপরি তিনি তিন-তিনবার জাপানের প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন– এঁর আদেশেই জাপান ত্রিশক্তি চুক্তিতে যোগ দেয়, হিটলার ও মুসসোলিনির সঙ্গে এবং এরই রাজত্বকালে পাকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। যদিও ঘোষণা করা হয় তার পদত্যাগের পরে। এবারে পাঠক তারিখগুলো লক্ষ করবেন। ১৯৪০-এর জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ পর্যন্ত (ক্যাবিনেট পুনর্গঠনের জন্য মাত্র দুটি দিন বাদ দিয়ে) কনোয়ে ছিলেন জাপানের সর্বময় কর্তা এবং হজুমি ওসাকি ছিলেন তাঁর পরম বিশ্বাসী অন্তরঙ্গজন। বলা বাহুল্য গোপন মন্ত্রণাসভার আলোচনা–সিদ্ধান্ত ওসাকি কনোয়ের কাছে পেয়ে কমরেড জরগেকে গরম-গরম সরবরাহ করতেন এবং এই চোদ্দ মাসেই জাপানের এ যুগের ইতিহাসে সবচেয়ে মোক্ষম-মোক্ষম মরণ-বাচন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় (হিটলারের সঙ্গে দোস্তি, মার্কিনের সঙ্গে লড়াই)। একেবারে গাঁজাখুরি অবিশ্বাস্য ঠেকে যে, হিটলার-সখা কনোয়ের পরম বিশ্বাসী সহচর ছিলেন হিটলারবৈরী রুশের গুপ্তচর এবং তিনি জাপানের গোপনতম সিদ্ধান্ত স্তালিনকে পাঠাচ্ছেন হিটলারের বিনাশসাধনের জন্য। এবং হিটলার বিনষ্ট হলে যে আপন মাতৃভূমি জাপানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী সে তত্ত্বটি বোঝার মতো এলেম নিশ্চয়ই এই ঝানু গুপ্তচরের পেটে ছিল। তিনি নাকি গুপ্তচরবৃত্তিতে তালিম পেয়েছিলেন জরগের কাছ থেকে। জরগে যে স্পাইদের গুরুর গুরু সেকথা তো পূর্বেই বলেছি।
১৭ অক্টোবর ১৯৪১-এ জরগে গ্রেফতার হন। ঠিক তার ৩২ দিন পূর্বে কনোয়ে মন্ত্রিত্ব পদে ইস্তফা দেন। এ দুটোতে কোনও যোগসূত্র আছে কি না আমার কাগজপত্র কেতাবাদি সে সম্বন্ধে নীরব। আমার মনে হয় পুলিশ কোনও গুপ্তচর সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়ামাত্রই তাকে গ্রেফতার করে না। বেশ কিছুদিন তাকে অবাধে চলাফেরা করতে দেয়। তার সহকর্মী চরদের চিনে নেয়। তার পর এক শুভ প্রভাতে বিরাট পেয়াজাল ফেলে সবকটা মাছ ধরে। ইতোমধ্যে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কনোয়েকে অবশ্যই জানানো হয়েছে যে, তার বিশ্বাসী ওসাকিই অশেষ পাপের পাপী পঞ্চম পাতকী। তার চেয়ে বেশি পাপী বিশ্বাসঘাতকী।
এত বড় কেলেঙ্কারির পর প্রধানমন্ত্রী থাকা যায় না। কনোয়ের রাজনৈতিক জীবন এখানেই চিরতরে খতম। ১৯৪৫-এ তিনি আত্মহত্যা করেন। কনোয়ে ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি খানদানি উচ্চকর্মচারীকে, জরগের নির্দেশে ওসাকি পারদর্শিতার সঙ্গে দিনের পর দিন পাম্প করেছিলেন।
সামসনের মতো জরগে পুরো এমারত ধূলিসাৎ না করতে পারলেও জাপান রাষ্ট্রের ভিতে যে ফাটল ফাটিয়ে যান সেটা কখনও মেরামত হয়নি।
———-
১. কোনও ফিলাটেলিস্ট পাকা খবর জানালে বাধিত হব।
২. শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী-লেখকের উপকারার্থে মসলা নিবেদন। একখানা বৃহৎ ব্যাকরণ রচনা করার কয়েক বৎসর পর তিনি তারই একখানি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেন। আমার সঙ্গে দেখা হলে পর দুষ্টু হাসি হেসে বললেন, এটা হল সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ; আগেরটা ছিল ক্ষিপ্ত ব্যাকরণ।