দ্বন্দ্ব-পুরাণ
মহাপুরুষদের জীবনধারণ প্রণালি, তাদের কর্মকীর্তি এমনকি দৈবেসৈবে তাদের খামখেয়ালির আচরণ দেখে তাদের শিষ্য-সহচর তথা সমকালীন সাধারণ জন আপন আপন গতানুগতিক ক্ষুদ্র বুদ্ধি দ্বারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, কী করে একটা মানুষের পক্ষে এরকম কীর্তিকলাপ আদৌ সম্ভবে। এ-প্রহেলিকার সমাধান না করতে পেরে শেষটায় বলে, ওহ! বুঝেছি। এরা অলৌকিক ঐশী শক্তি ধারণ করেন। তখন আরম্ভ হয় এদের সম্বন্ধে কিংবদন্তি বা লেজেন্ড নির্মাণ। কোন পির ধূলিমুষ্টি স্বর্ণমুষ্টিতে পরিবর্তিত করতে পারতেন, কোন গুরু চেলাদের আবদার-খাইয়ে অতিষ্ঠ হয়ে রাগের বশে এক কুষ্ঠরোগীকে পদাঘাত করা মাত্রই তনুহূর্তেই, সে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যায়–হরি হে তুমিই সত্য।
ফারসি ভাষাতে তাই প্রবাদ আছে, পিরেরা ওড়েন না, তাদের চেলারা ওঁদের ওড়ান পিরহা নমিপরন্দ, শাগির্দান উন্হারি মি পরানন্দ–অর্থাৎ আমাদের পির উড়তে পারেন। তবে কি না সে অলৌকিক দৃশ্য সবাই দেখতে পায় না।
অর্থাৎ,
অদ্যাপিও সেই লীলা খেলে গোরা রায়।
মধ্যে মধ্যে ভাগবানে দেখিবারে পায়
এস্থলে লক্ষণীয় আপনার-আমার মতো পাঁচু-ভূতোকে নিয়ে কেউ ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র লেজেন্ডও নির্মাণ করে না। করবার কোনও প্রয়োজন বোধ করে না।
তাই আশ্চর্য হলুম একটা ব্যাপার দেখে। কিছুদিন পূর্বে এই গৌড়ভুমির এক মহাপুরুষকে নিয়ে জনৈক সুপণ্ডিত গভীর গবেষণামূলক একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তাঁর বক্তব্য থিসিস–ওই মহাপুরুষকে নিয়ে যেসব অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে সেগুলো নিছক রূপকথা, সোজা বাংলায় গাঁজা-গুল; আসলে উনি ছিলেন অত্যন্ত সাদামাটা সাধারণ জনের একজন।
এ থিসিস ধোপে কতখানি টেকে কি না-টেঁকে সেটা আমি বলতে পারব না– আমার পশ্চাদ্দেশে লোহার শিকলি দিয়ে টাইম বম বেঁধে দিলেও প্রাণ বাঁচাবার জন্যও (যদ্যপি পয়গম্বর সাহেব বলেছেন, জান্ বাঁচানো ফর্জ। নামাজ রোজার মতোই ফর্জ অর্থাৎ অবশ্য-কৰ্তব্য কর্ম, না করলে সখৎ শুনাহ বা কঠিন পাপ হয়!
তাই আমি ওই লেখককে (তিনি যে সত্যই সুপণ্ডিত সে-বিষয়ে আমার মনে কোনও দ্বিধা নেই, কারণ আমি তার একাধিক গভীর গবেষণাময় সুচিন্তিত পুস্তক পড়েছি) মাত্র একটি প্রশ্ন শুধোতে চাই। সেই আলোচ্য মহাপুরুষ যদি আসলে অতই সাদামাটা সাধারণজন হন তবে তার সম্বন্ধে অত লেজেন্ড, অত অলৌকিক কাহিনী নির্মাণ করবার দায় পড়েছিল কোন গণ্ডমূর্খ-মণ্ডলীর ওপর। লেজেন্ডগুলো সত্য না মিথ্যা সে বিচারের গুরুভার বিধাতা এ হীনপ্রাণের স্কন্ধে রাখেননি। আমি শুধু জানি, সাধারণজনকে দিয়ে মানুষ অলৌকিক কর্ম করায় না; যদি বা অতি, অতিশয় দৈবেসৈবে, দু-একজনকে নিয়ে লেজেন্ড তৈরি করে, তবে প্রথম পরশুরামের বিরিঞ্চি স্মরণে এনে তার পর কাশীরামদাসের শরণ নিতে হয় :
কতক্ষণ জলের তিলক থাকে ভালে।
কতক্ষণ থাকে শিলা শূন্যেতে মারিলে—
তাবৎ লেজেন্ডই যে নৈসর্গিক নিয়মভঙ্গকারী অলৌকিক কর্ম, মিরাকল হবে, এমন কোনও পুদার কসম বা কালীর কিরে নেই। সাদামাটা, হার্মলেস লেজেন্ড আজকের দিনেও নির্মিত হয়। পাঠক হয়তো প্রত্যয় যাবেন না, কিন্তু হয়, হয় এই বিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ সপ্তম দশকে। অন্তত নব লেজেন্ডের ফাউন্ডেশন স্টোন পোঁতা হয়।
ওই তো সেদিন পত্রান্তরে পড়লুম, জনৈক লেখক লিখেছেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ চা পান করতেন না। আমি তো বিস্ময়ে স্তম্ভিত। আমি তাকে বহু-বহুবার চা খেতে দেখেছি, এ-দেশি চা, যাকে সচরাচর ব্ল্যাক টি বলা হয়, উত্তম গোত্রবর্ণের অর্থাৎ, উজ্জ্বল সোনালি রঙের চা হলে তারিফ করতে শুনেছি। একবার চীন দেশ থেকে গ্রিন টি (যদিও গরম জলে ঢালার পর রঙ এর হয়ে যায় ফিকে লেমন ইয়োলো) আসে গুরুদেবের কাছে। সে চায়ের শেষ পাতাটুকু পর্যন্ত তাঁকে সদ্ব্যবহার করতে দেখেছি।
তা হলে এ লেজেন্ডের মূল উৎস কোথায়? এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চা-বাগানের কুলিদের উপর বর্বর ইংরেজ ম্যানেজার (আই.সি.এস.-দের তাচ্ছিল্যব্যঞ্জক ভাষায় বক্স-ওয়ালা–কারণ তারা চায়ের বাক্স নিয়ে কারবার করে) কী পৈশাচিক অত্যাচার করত সে-সংবাদ বাঙালি জনসাধারণের কানে এসে পৌঁছয়। তখন চায়ের নামকরণ হয় কুলির রক্ত এবং অনেকেই এই কুলির রক্ত চায়ের পাতা বাড়ি থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠান, কাউকে চা পান করতে দেখলে ঘৃণামিশ্রিত উচ্চকণ্ঠে সর্বজনসমক্ষে বলতেন, লজ্জা করে না মশাই, কুলির রক্ত পান করতে। রবীন্দ্রনাথ এ আন্দোলনের খবর রাখতেন; বিশেষ করে যখন স্মরণে আনি, যে-স্বর্গত শশীন্দ্র সিংহ তাঁর সাপ্তাহিক ইংরেজি খবরের কাগজে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে অকুতোভয়ে চা-বাগানের টমকাকার কুটির লিখে লিখে বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সুপরিচিত ছিলেন। অতএব আজ যিনি এক লেজেন্ডের প্রথম চিড়িয়া ওড়ালেন যে রবীন্দ্রনাথ চা খেতেন না, তিনি হয়তো ধরে নিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় তখন আর পাঁচজন সহানুভূতিশীল বাঙালির মতো চা বয়কট করেছিলেন এবং জীবনে আর কখনও চা খাননি। বয়কট হয়তো তিনি করেছিলেন–কিন্তু নিশ্চয়ই সেটা কিয়ৎকাল (এবং স্মরণে রাখা উচিত সে-যুগে চায়ের এত ছড়াছড়ি ছিল না বোধহয় মোটামুটি গত শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ স্টিমার প্যাসেনজারদের মুফতে চা পান করানো হত), কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত আমি তাকে বহুবার চা পান করতে দেখেছি।(১) তবে চায়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কোনও আসক্তি ছিল না।
প্রায়ই চা ছেড়ে দিয়ে কিছুকালের জন্য অন্য কোনও পানীয়তে চলে যেতেন। গরমের দিন বিকালে চা বড় খেতেন না– বদলে খেতেন বেলের, তরমুজের শরবত (নিমপাতার শরবতের কথা সকলেই জানেন)। সকাল-বিকেল ছাড়া অবেলায় টিপিকাল বাঙালির মতো তাকে আমি কখনও বেমক্কা চা খেতে দেখিনি। এবং
বর্ণনাটা ক্ষান্ত করি, অনেকগুলো কাজ বাকি,
আছে চায়ের নেমন্তন্ন, এখনও তার সাজ বাকি।(২)
স্মরণে আনুন। অবশ্য চায়ের নেমন্তনে চা খেতেই হবে এমন আইন হিটলারও করেননি যদ্যপি তিনি দিনে-রাতে এভলেস (অসংখ্য, অন্তহীন) কাপস্ অব টি পান করতেন অতিশয় হালকা, মিন-দুধ।
বস্তুত কি চা, কি মাছ-মাংস কোনও জিনিসেই রবীন্দ্রনাথের আসক্তি ছিল না–যা সামান্য ছিল সেটা মিষ্ট-মিষ্টান্নের প্রতি। টোস্টের উপর প্রায় কোয়ার্টার ইঞ্চি মধুর পলেস্তরা পেতে জীবনের প্রায় শেষ বৎসর অবধি তিনি পরম পরিতৃপ্তি সহকারে ওই বস্তু খেয়েছেন।(৩) মিষ্টান্ন তো বটেই বিশেষ করে নলেন গুড়ের সন্দেশ। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মতো ভোজনবিলাসী আমি কমই দেখেছি। এবং প্রকৃত ভোজনবিলাসীর মতো পদের আধিক্য ও বৈচিত্র্য থাকলেও পরিমাণে খেতেন কম– তার সেই পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি দৈৰ্ঘ্য ও তার সঙ্গে মানানসই দোহারা দেহ নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে ঢের কম। ফরাসিতে বলতে গেলে তিনি ছিলেন গুরূমে (ভোজনবিলাসী, খুশখানেওলা); সুরমা (পেটুক) বদনাম তাঁকে পওহারী বাবা (এই সাধুজি নাকি শুধুমাত্র পও = বাতাস খেয়ে প্রাণধারণ করতেন) পর্যন্ত দেবেন না।
লেজেন্ড সম্বন্ধে এইবারে শেষকথাটি বলে মূল বক্তব্যে যাব।
লেজেন্ডের একটা বিশেষ সুস্পষ্ট লক্ষণ এই; দার্শনিক বৈজ্ঞানিক গুণীজ্ঞানীরা যতই কট্টর কট্টর অকাট্য যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করুন না কেন যে, বিশেষ কোনও একটা লেজেন্ড সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক, তবুও তারা সে লেজেন্ড আঁকড়ে ধরে থাকে। এখনও বিস্তর লোক বিশ্বাস করে পৃথিবীটা চেপ্টা, শোনে ভূতপ্রেত, গোরস্তানে মামদো আছে; ইংরেজ বিশ্বাস করে সে পৃথিবীর– সরি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বোৎকৃষ্ট নেশন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এস্থলে আরও বলে নিই; মহাপুরুষদের যারা বিরুদ্ধাচরণ করে তারাও তাদের সম্বন্ধে বিপরীত লেজেন্ড তৈরি করে। যেমন খ্রিস্টবৈরী ইহুদিরা বলেছে প্রভু খ্রিস্ট ছিলেন মাতাল, তিনি শুঁড়িদের (পাবৃলিকাস ইতরজনের সাহচর্যে উল্লাস বোধ করতেন, এবং নর্তকী বেশ্যাদের সেবা গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না (মেরি ম্যাগডলিন)।
বাঙলা দেশে একটা দল আছে। সেটা কতু-বা বর্ষার প্লাবনে দুর্বার গতিতে বন্যা জাগিয়ে জনপদভূমির সর্বনাশ করে যায় আর কভু বা বৎসরের পর বৎসর ফধারা পারা অন্তঃসলিলা থাকে। এ দল পরপর রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র এবং সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধাচরণ করে উপস্থিত ফরু-পন্থানুযায়ী অন্তঃসলিলা। মোকা পেলে বুজবু করে বেরুতে চায়। এদের জন্ম নেবার কারণ সম্বন্ধে এস্থলে আলোচনা করব না।
রবীন্দ্রনাথ চা খেতেন না– এটা নিরীহ, হামলেস লেজেন্ড। কিন্তু এই দল প্রচার করে যে, রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক অক্ষরও জানতেন না, তিনি ছিলেন সুরকানা, মামুলি রাগরাগিণী তিনি ঘুলিয়ে ফেলতেন এবং বিলিতি গান-বাজনার প্রতি তার ছিল অন্ধ ভক্তি। তাই গোড়ার দিকে তার গানের কথাতে সুর দিতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীকালে তাবৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর দিয়েছেন দিনেন্দ্রনাথ!! এস্থলে পুনরায় বলতে হয় : হরি হে তুমিই সত্য।
দ্বিতীয় লেজেন্ড : আমাদের জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন রবিঠাকুর রচনা করেন রাজা পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে। এদের যুক্তি এই প্রকার :
(১) জনগণমন-অধিনায়ক তারতভাগ্যবিধাতা একজন রাজা (কারণ রাজাই তো জনগণের ভাগ্যনির্ণয় করেন)।
(২) পঞ্চম জর্জ রাজা।
অতএব জনগণমন-অধিনায়ক ভারতভাগ্যবিধাতা স্বয়ং পঞ্চম জর্জ।
কুয়োট এরাট ডেমনস্ট্রাভুম (g. E. D.)। আমেন আমেন। সুশীল পাঠক, অবধারিত হোন, যে দল এ-লেজেডের বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল তারা সেটা সত্য জানা সত্ত্বেও সজ্ঞানেই করেছিল। এরা জ্ঞানপাপী। এবং এরা বিলক্ষণ অবগত ছিল, সমসাময়িক বিশ্বাসভাজন শ্রদ্ধেয় গুণীজ্ঞানীরা এই কিম্ভূতকিমাকার থিয়োরিকে দলিলদস্তাবেজ, প্রমাণপত্র, সাক্ষীসাবুদ, যুক্তিতর্ক দ্বারা নস্যাৎ ধূলিসাৎ তো করবেনই, তদুপরি করলারি বা ফাউ হিসেবে আরও প্রমাণ করে দেবেন, এই বিষবৃক্ষরোপণকারীরা হস্তীমূর্খ রামপন্টক (কন্টক থেকে কাটা, পন্টক থেকে পাঠা– জ্ঞানবৃদ্ধ রসসিদ্ধ সুনীতি উবাচ)। কিন্তু এ-দলের চর্ম কাজিরাঙার গণ্ডারবিনিন্দিত বৰ্মসম স্কুল। তাই আমার যখন একদা চর্মরোগ হয় তখন আমার সখা ও শিষ্য চর্মরোগ-বিশেষজ্ঞ ড. লি আমাকে সলা দেন, আপনি পরনিন্দা আরম্ভ করুন। চামড়াটি গারের মতো হয়ে যাবে। গণ্ডারের চর্মরোগ হয় না।
তাই যখন অধুনা খবরের কাগজে দেখতে পাই শ্রীযুক্তা ইন্দিরাকে জনগণমন অধিনায়িকারূপে উল্লেখ করা হয়েছে তখন আমি রীতিমতো শঙ্কিত হই। আজ ইন্দিরা, কাল জ্যোতিবাবু, পরও আপনার মতো নিরীহ পাঠককে হয়তো জনগণমন-অধিনায়ক বলে বসবে, অর্থাৎ পরমেশ্বরের পর্যায়ে তুলে দেবে। কিন্তু এ পয়েন্টটি থাক।
কিন্তু প্রশ্ন এই, জাতীয় সঙ্গীতটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পঞ্চম জর্জকে শোনালে কি হিজ ম্যাজেস্টি আপ্যায়িত হতেন মোটেই না।
আইস পাঠক! গানটি বিশ্লেষণ করহ।
ভারতভাগ্যবিধাতা যে তিনি, সেকথা শুনে রাজা নিশ্চয়ই মনে মনে শুকনো হাসি হাসতেন। তিনি বিলক্ষণ জানেন, তিনি তার মাতৃভূমি ইংলন্ডেরও ভাগ্যবিধাতা নন। তাঁর আপন ভাগ্যই নির্ণয় করেন তাঁর (হ্যাঁ তারই- মশকরা আর কারে কয়?) প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের চুড়োয় বসে। তিনি অবশ্য তখন জানতেন না যে তার যুবরাজ রাজা হবার পর যখন এক এড়িকে (লগ্নচ্ছি = ডিভোর্সড় = তালাকপ্রাপ্তা) বিয়ে করতে চাইবেন তখন তার (!) প্রধানমন্ত্রী তাকে কানটি ধরে দেশ থেকে বের করে দেবেন। এবং তার নাতনি যখন রানি হবেন তখন তার স্বামী রানা (রাজার স্ত্রীলিঙ্গ রানি কিন্তু রানির স্বামী যদি রাজা না হন তবে রানি শব্দ থেকে পুংলিঙ্গ নির্মাণ করে রানা শব্দ ব্যবহার করা হয়। তাই রানি এলিজাবেথের স্বামী রাজা নন, তিনি রানা) ডুক অ এড়া ভিখিরির টোল-খাওয়া মাখনের টিন হাতে করে পার্লামেন্ট বাড়ির সামনে এসে হাঁকবেন দুটো চাল পাই না, আর গেরস্তু-গিন্নি প্রধানমন্ত্রী বাড়ির দরজা এক বুড়ো আঙুল ফাঁক করে (অবশ্য অষ্টরম্ভা দেখিয়ে বিরক্তকণ্ঠে বলবেন ঘরে চাল বাড়ন্ত। প্রধানমন্ত্রী মুসলমান হলে বলবেন, ফিরি মাঙো–অর্থাৎ অন্য বাড়ি যাও।
এর পর যখন অনুবাদক চারণ বলবে, হুজুরকে জনগণ ঐক্যবিধায়ক বলা হয়েছে তখন তিনি বহুযুগসঞ্চিত রাজগৌরব প্রসাদাৎ তার ঠা ঠা করে অট্টহাস্য করার অদমনীয় উচ্ছলাচরণ দমন করে মনে মনে মৃদু হাস্য করে বলবেন, বটে! আমাদের নীতি আমাদের ধর্ম ডিভাইড অ্যান্ড রুল দ্বিধা করে সিধা রাখো। আর এ প্রাইজ ইডিয়ট বলে কী? আমি নাকি ঐক্যবিধায়ক। হোলি জিজস!
এর পর চারণ কাচুমাচু হয়ে বলবে, হুজুর মধ্যিখানের প্যারা খুঁজে পাচ্ছিনে। দুসরা কপি এখুনি এল বলে। ইতোমধ্যে শেষ প্যারাটি অনুবাদ করি। রাজা আমনে শুনতে শুনতে হঠাৎ খাড়া হয়ে বসবেন। কী বললে? পূর্ব গিরিতে রবি উদিল? রবি তো রবীনডর ন্যাট ট্যাগোর– দ্যাট নেটিভ?
চারণ সভয়ে বলবে, এজ্ঞে হ্যাঁ। কারণ একথা তো বিলকুল খাঁটি যে রবি কবি পূর্বদেশে, প্রাচ্যে জন্মেছেন, পূর্ব উদয়গিরিভালে তিনি রাজটীকা।
রাজা জর্জ তো রেগে টঙ। কী, কী-আস্পদ্দা। কাউকে যদি পূর্বদেশে, ভারতে উদয় হইতেই হয় তবে সে হব আমি। তার পর গরগর করে বলবেন, ভাইসরয়টাকে বলে গে, পুবের মণিপুর পাহাড়ের উপর সিংহাসন যেন পাতা হয়। আমি যেখানে উদিত হব। আশ্চর্য, এত বড় একটা ফশন ডংকিগুলো বেবাক ভুলে গেছে। চিফ অব্ প্রটোকল মাস্টার অব সেরিমনিজকে এক্ষুনি ডিসমিস কর।
ইতোমধ্যে মিসিং দুই প্যারা এসে গেছে। অনুবাদক তো ভয়ে কাঁপছে। অনুবাদ করে কী প্রকারে শেষটায় ভয়ে না নির্ভয়ে ইত্যাদি ফরমুলা কেতাদুরস্ত করে বলল, হুজুর, কবি বলছে, আপনি চিরসারথি, আপনি শখ বাজাচ্ছেন (হে চিরসারথি তব…শঙ্খধ্বনি বাজে)।
রাজা তো রেগে টঙ। ক্রোধে জিঘাংসায় বেপথুমান হয়ে হুঙ্কারিলেন, কী! এত বড় বেআদবি, বেইজ্জতি বেত্তমিজি! এ তো লায়েসা মাজেস্টাস (laesa majestas)। হিজ ম্যাজেস্টিকে অপমান। অবশ্য নেটিভটা লাতিন লায়েসা মাজেষ্টাস জানে না। কিন্তু এটাও কি জানে না, এর চেয়ে শতাংশের একাংশ অপরাধ করেও, কোনও কোনও স্থলে না করেও ব্রিটিশ রাজে লক্ষ লক্ষ লোক ফাঁসি গেছে।
অসহ্য অসহায়। আমাকে বলছে সারথি। মোটর ড্রাইভার। আমার বাবা এডওয়ার্ড যখন ইহজগতের স্বপ্নাতীত অকল্পনীয় সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বপ্রথম ডেমলার গাড়ি নিয়ে তাঁর কাজিন কাইজারকে বার্লিনে দেখতে যান তখন কাইজার বিস্ময়ে অভিভূত ছোট বাচ্চাটার মতো নাগাড়ে সাড়ে-তেরো ঘণ্টা গাড়িটার পালিশের উপর হাত বুলিয়েছিলেন। বাবা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা গাড়ির জন্য বারোটা ড্রাইভার। আর আজ আমাকে রাজাকে বলছে আমি মোটরড্রাইভার, ফোর। আমার আস্তাবলে ক-শো ড্রাইভার আছে তার খবর আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি পর্যন্ত জানে না। আর আমি নাকি ওহ্।
তার পর বিড়বিড় করে যেন আপন মনে বললেন, আর বলছে কী, আমি নাকি চিরসারথি। আমি চিরকাল ড্রাইভার থাকব। পার্মেনেন্ট পোস্ট। আমার প্রমোশন তক হবে না। আমি এমনই নিষ্কমা চোতা রদী ড্রাইভার! হোলি মৈরি– হ্যাঁ, নেটিভরা মাইরি বলে বটে–আমি যদি এ লোকটাকে আমার রোলসের চাকায় বেঁধে না, আগে তো বলডুইনের এজাজৎ চাই। ড্যাম বলডুইন! আর আমি শাঁখ বাজাই। পল্টনের বিউগলে ফুঁ দি। ছি ছি।
চারণ আবার সভয় নির্ভয় করে নিয়ে বলল, হুজুরকে বলেছে স্নেহময়ী মাতা।
এবারে রাজা লক্ষ দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করলেন। অবশ্য অন্য কারণও ছিল।
সিংহাসনে কোচের মতো স্প্রিং থাকে না। থাকে পাতলা একখানি কুশন। কংগ্রেসের সম্মানিত সিডিশাস মেম্বার ভারতীয় ছারপোকার পাল সেখানে বাসা বেঁধে হুজুরের কোমলাঙ্গে তখন ব্যাংকুয়েট পরবের মাঝখানে।
কম্পিত কণ্ঠে রাজা বললেন, আমি এখুনি ফিরে যাচ্ছি দেশে। সব সইতে পারি। কিন্তু আমি মা, আমি স্ত্রীলোক! বুঝেছি লোকটার ইনসলেন্স। বলতে চায়, কূটনৈতিক কারণে, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য–rasion d tat– আমি মাগী হওয়া সত্ত্বেও মেকডনান্ড বলডুইন আমাকে মন্দার বেশে সাজিয়েছে। আমি আসলে মেনি, ওরা আমাকে পরিয়েছে হুলোর ছদ্মবেশ।
কাঁপতে কাঁপতে রাজা কার্পেটে বসে পড়লেন। প্রায় কান্নার সুরে বললেন, সেদিন শিকারের সময় এক নেটিভ শিকারি বলেছিল, এক আসামি নাকি দারোগাকে বলেছিল, হুজুর, আমার মা বাপ। দারোগা নাকি বলেছিল, বাপ হতে পারি, কিন্তু আমাকে মা বলছিস কেন? আমি কী স্যারি (শাড়ি পরি। শিকারি আমাকে বলেছিল, হুজুর, আসামি যদি শুধু বাপ বলত তবে দারোগা ছেড়ে দিত। মা বলেছিল বলে সেশনে সোপর্দ করল। ফাঁসি হল। … দারোগাকে মেনি বলাতে সামান্য দারোগা ফাঁসিকাষ্ঠে চড়াল। আর আমি ইংলন্ডেশ্বর, অ্যান্ড অব্ দি ডমিনিয়নস বিওন্ড দি সিজ, ডিফেন্ডার অব ফেথ, এপারার অব্ ইন্ডিয়া। আর এই শেষেরটা কী কারসিকতা! আমি কি বকিংহম পেলেসে নিভৃতে পেটিকোট পরি, ঠোঁটে নখে আলতা মাখি! ওহ! অসহ্য অসহ্য!
তার পর রাজা কোর্ট-গেজেট প্রকাশ করলেন, ওই নেটিভ টেগোরের গান আমার উদ্দেশে লেখা নয়।
তথাপি এ-লেজে মরে না।
কিন্তু এ কাহিনী এখানে বন্ধ করি। হালে বঙ্কিমচন্দ্রের রামায়ণ-সম্বন্ধে একটি রচনা হিন্দিতে অনুবাদিত হলে তার বিরুদ্ধে দিল্লির আদালতে ডবল ফৌজদারি মোকদমা রুজু হয়েছে। বঙ্কিমবাবু নাকি বিস্তর ছুটোছুটি করেও একটা বটতলার চারআনি মোক্তারও পাচ্ছেন না– অথচ একদা তিনি স্বয়ং দুদে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তাবৎ ছাতুখোর খোটা চুরনবেচনে-ওলাকে বংশধর লালাজি ব্যারিস্টার দারুণ চটিতং … পাঠক, তিষ্ঠ ক্ষণকাল টেলিফোন বাজছে।
হ্যাঁ, যা ভেবেছিলুম তাই। এক হিন্দিপ্রেমী সোল্লাসে জানালেন, আজ সকালে বঙ্কিমবাবুর ফাঁসি হয়ে গিয়েছে।
আমার এ লেখন হিন্দিতে অনুদিত হলে আমার নির্ঘাত ছ মাসের ফাঁসি।
.
মে মাসের ২৯ তারিখ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গাঁধী শান্তিনিকেতন আশ্রমে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বলা বাহুল্য এই তাদের প্রথম পরিচয় নয়। গাঁধীজি যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগ করে ভারতে আসেন তখন তিনি প্রায় চার মাস শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয় পরিচালনা করেন। ওই সময়ে ৬ মার্চ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।(৪) এর পর ১৯২১-এর পূর্বে উভয়ের আর কোনও মালাকাত হয়েছিল কি না জানি নে। তবে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১-এ গাঁধীজি জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা ভবনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আলাপ-আলোচনা করেন। গাঁধীজির উদ্দেশ্য ছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ যে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করেছিলেন সেটা বন্ধ করা এবং কবি যেন সত্যাগ্রহকে অন্তত তাঁর আশীর্বাদটুকু জানান।(৫) বলাবাহুল্য গাঁধীজি অকৃতকার্য হন। এই আলোচনা হয়েছিল রুদ্ধদ্বারে। কবি ও গাঁধীজি ছাড়া এ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মাত্র আর একজন দীনবন্ধু এনড্রজ। বস্তুত তিনিই এ-দুজনকে একত্র করেছিলেন; তার আশা ছিল, সামনাসামনি আলাপচারি হলে হয়তো দুজনের মতের মিল হয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষের মঙ্গলের জন্য তিনি এই দুই প্রখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ্য সংঘর্ষ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।(৬)
এ মোলাকাত সম্বন্ধে একটি হাফ-লেজেন্ড আছে। তবে সেটা অবনীন্দ্রনাথকে দিয়ে। তিনি বললেন, এত বড় জব্বর একটা পেল্লাই ব্যাপার এলাহি কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে আর আমরা দেখতে পাব না, শুনতে পাব না? আচ্ছা দেখি। অর্থাৎ শব্দার্থেই তিনি দেখে নিলেন কি-হোল দিয়ে, কীভাবে দুই জাদরেল ও তাঁদের মধ্যিখানের সেতুবন্ধ এনড্রজ আসন গ্রহণ করেছেন। বিচিত্রা বাড়িতে বিলিতি কেতায় কি-হোল আছে কি না জানিনে; তবে হয়তো তিনজনের আসন নেওয়ার পর বাইরের থেকে দরজায় খিল দেওয়ার পূর্বে তিনি একঝলক দেখে নিয়েছিলেন। আপন বাড়িতে ফিরেই তিনি একে ফেললেন একখানা বেশ বড় সাইজের গ্রুপ ছবি। মুখোমুখি হয়ে বসেছেন দুজনা দু প্রান্তে। তাদের বসার ধরন টিপিকাল- ঠিক এই ধরনেই তারা আকছারই বসতেন। আর গাঁধীর পিছনে একপাশে বসেছেন এনড্রজ। এর তিন মাস পরে বাৎসরিক কলাপ্রদর্শনীতে অবনবাবু ছবিখানি এক্সিবিট করলেন। দাম দেখে তো বিশ্বজনের চক্ষুস্থির। সেই আমলে– আবার বলছি সেই আমলে– পনেরো হাজার টাকা! কে একজন বলল, দামটা বড্ড বেশি হয়ে গেল না? অবনবাবু শেয়ানা বেনের মতো হেসে বললেন, বা রে! আমি তো সস্তায় ছাড়ছি। এদের প্রত্যেকের দাম পাঁচ-পাঁচ হাজারের চেয়ে ঢের ঢের বেশি নয় কি? এ ছবি যখন কেউ কিনল না, তখন অবনবাবু বললেন, এটা কাকে দেওয়া যায়? রবিকাকা হেথায়, গাঁধী হোথায়। তবে কি না এনড্রজের নিবাস বলতে যদি কিছু থাকে তবে সেটা তো রবিকাকার ছায়াতেই। দুজন যখন শান্তিনিকেতনে তখন এটা যাক ওখানকার কলাবনে। এ ছবি অনেকেই নিশ্চয় কলাভবনে দেখেছেন। তবে দীর্ঘ ৪৮ বৎসর পর রঙ বড় ফিকে হয়ে গিয়েছে।
১৯২৫-এর ২৯ মে গাঁধীজি আবার রবীন্দ্রনাথকে স্বপক্ষে টানবার জন্য শান্তিনিকেতন আসেন এবং দুদিন সেখানে থাকেন। ইতোমধ্যে শান্তিনিকেতনেই ৯০ খানা চরকা ও তকলি চলিতেছে– বিধুশেখর, নন্দলাল প্রভৃতি সকলেই চরকা কাটিতেছেন। আবহাওয়া তা হলে অনুকূল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন : তিনি (গাধী) শান্তিনিকেতনে আসিতেছেন, রবীন্দ্রনাথের সহিত চরকা সম্বন্ধে আলোচনাই প্রধান উদ্দেশ্য। গাঁধীজি জানিতেন কবি তাহার সহিত চরকা সম্বন্ধে একমত নহেন, তবুও বোধহয় বিশ্বাস ছিল যে, নিজের ঐকান্তিকতার বলে তিনি কবিকে তাহার পথে আনিতে পারিবেন। দুই দিন তাহাদের দীর্ঘ আলোচনা চলে, বলা বাহুল্য কেহ কাহাকেও নিজ মতে আনিতে পারেন নাই। তৎসত্ত্বেও এখানে বলিয়া রাখি, উভয়ের প্রতি পূর্ববই অক্ষুণ্ণ রহিল।*[* * প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, ৩য় খণ্ড : পৃ. ১৬৪।]
২৯-এ গ্রীষ্মবকাশের মাঝখানে পড়ে। আমি তখন দেশে, সিলেটে।
ফিরে এসে কী আলোচনা হয়েছিল সে সম্বন্ধে নানা মুনির নানা কীর্তন শুনলুম। কিন্তু সেসব রসকষহীন আলোচনা নিয়ে লেজেন্ডের গোড়াপত্তন হয় না। আমি বলতে চাই অন্য জিনিস।
ফিরে এসেই গেলাম আমার মুরুব্বি গাঙ্গুলীমশাইকে আদাব-তসলিমাত জানাতে। শুনেছি, ইনি রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় বউদির (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী আত্মীয় ছিলেন। গাঙ্গুলীমশাই ছিলেন শান্তিনিকেতন গেস্ট হাউসের ম্যানেজার। সে আমলে শান্তিনিকেতন মন্দিরের কাছে যে পাকা দোতলা বাড়ি (এইটেই আশ্রমে মহর্ষি-নির্মিত প্রথম বাড়ি এবং বর্তমান বোধহয় বিশ্বভারতীর দর্শন বিভাগের আস্তানা) সেইটেই ছিল গেস্ট হাউস। তারই নিচের তলায় একটি ছোট্ট কামরায় মিলিটারি বুট তথা হাফ মিলিটারি ইউনিফর্ম পরিহিত, হীতলাল প্রভৃতি দাসবংশ কর্তৃক সমাদৃত হয়ে সাতিশয় ফিটফাট রূপে বিরাজ করতেন মহাপ্রতাপান্বিত মহারাজ প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায় বা গাঙ্গুলীমশাই। বিরাজ করতেন বললে বড়ই অগ্লোক্তি করা হয়– রামায়ণী ভাষায় বলতে গেলে শ্রীরামচন্দ্রের ন্যায় গাঙ্গুলিমশাই ম্যানেজার পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া অপ্রতিহতভাবে রাজ্যশাসন ও অপত্যনির্বিশেষে অতিথিশালায় পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ তথা অষ্টকূলাচল সপ্তসমুদ্র থেকে রবিমন্দ্রিত দেশ দেশ নন্দিত করি ভেরীর আহ্বানে সমাগত হিন্দু বৌদ্ধ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রিস্টানি অতিথি সজ্জনকে যেন প্রজাপালন করিতেন। তার দাপট তাঁর রওয়াবের সামনে দাঁড়াতে পারেন এমন লোক আশ্রমে সে আমলে ছিলেন কমই। লোকে বলে, তিনি যখন গেস্ট হাউসে বসে হীতলাল! বলে হুঙ্কার ছাড়তেন তখন এক ফার্লং দূরে রতন কুটিতে প্রফেসর মার্ক কলিগের ছোকরা চাকর পঞ্চা আঁতকে উঠত তার পিলে চমকে উঠে এপেনডিসের সঙ্গে স্ট্যাম্বুলেটেড হয়ে যেত।
গাঙ্গুলীমশাই ম্যাট্রিক অবধি উঠতে পেরেছিলেন কি না সেকথা বলতে পারি না। তাই পাঠক পেত্যয় যাবেন না যে এঁর আবাল্য অতিশয় অন্তরঙ্গ সখা ছিলেন বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতা দেবীর পুত্র ব্যঙ্গসুনিপুণ অভূতপূর্ব সাহিত্য-সমালোচক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, সম্পাদকমণ্ডলীর মুকুটমণি পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেক ইনটেলেকচুয়েল বা বুদ্ধিজীবী।
গাঙ্গুলীমশাইয়ের মতো সর্বাঙ্গসুন্দর, নিটোল পারফেক্ট রাকোঁতর স্টোরিটেলার মজলিসতোড় কেচ্ছাবলনেওলা এ পৃথিবীতে আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। রাকোতর হিসেবে ওসকার ওয়াইল্ড ছিলেন এ কলার ম্রাট। সে বাবদে যা কিছু লেখা হয়েছে, বিশেষ করে গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদক, ১৯৪৮-এ নোবেল প্রাইজ বিভূষিত আঁদ্রে জিদ (এই হালে, ২২ নভেম্বর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী মহাড়ম্বরে ইয়োরোপে উদ্যাপিত হল, কিন্তু হায়, কৌলিক রচনার যে প্রখ্যাত লেখক আপন সৃজনকর্ম স্থগিত রেখে গীতাঞ্জলির অনুবাদ করলেন তিনি অন্য কোনও মহান লেখকের রচনা অনুবাদ করে তাকে এভাবে সম্মানিত করেছেন বলে শুনিনি যে আঁদ্রে জিদ ইয়োরোপে অজ্ঞাত বাঙালি নামক জাতের শ্রেষ্ঠ ধন ইয়োরোপের বিদগ্ধতম জাতের প্যারিস সমাজে প্রচার করলেন, তাঁকে এই উপলক্ষে কোনও বাঙালি স্মরণ করেছে বলে কানে আসেনি। তাঁর অন্তরঙ্গ সখা ওয়াইল্ড সম্বন্ধে যা লিখেছেন সেসব পড়ার পর রাকোতর হিসেবে গাঙ্গুলীমশাইয়ের প্রতি আমার ভক্তি বেড়েছে বই কমেনি। বস্তুত আ লা রিডারস্ ডাইজেন্ট বলতে হলে ইনিই আমার মোট অনফরগেটবল ক্যারেকটার। এঁর কাছ থেকে আমি সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষায় চালু ইডিয়ম, প্রবাদ এবং কলকাতার কনি শব্দ শিখেছি। আমার মতো তার অন্য এক সমঝদার–সাপুড়ে সম্মোহিত সর্পের মতো মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন আনন্দবাজার গ্রুপের শ্রীযুক্ত কানাইলাল সরকার। আমার কথা পেত্যয় না পেলে ওয়াকে শুধোবেন।
বলা বাহুল্য, বিলকুল বেফায়দা বেকার, আমি গাঙ্গুলীমশাইয়ের সে বয়ানের বন্যা, টৈটম্বুর রসের ছিটেফোঁটাও এই হিম-শীতল, রসকষহীন সিসের ছাপা হরফে প্রকাশ করতে পারব না। একমাত্র লোক যিনি পারতেন তিনি আমার রসের দুনিয়া-আখেরের পিরমুরশিদ পরশুরাম রাজশেখর বসু।
আমি তাকে মায়ের দেওয়া এক বোতল অত্যুকৃষ্ট সিলেটি আনারসের মোরব্বা দিলে পর তিনি আমার ললাটে চুম্বন দিলেন, মস্তকাঘ্রাণ করলেন। বেলা তখন একটা। তিনি আহারাদি সমাপন করে খাটে শুয়ে আলবোলায় ফুরুৎ ফুরুৎ মন্দমধুর টান দিচ্ছিলেন। আমাকে আদর করার পর ফের লম্বা হয়ে শুয়ে নলটি তুলে নিলেন। চোখ দুটি বন্ধ করে, কবির ভাষায় আকাশ পানে হানি যুগল ভুরু বললেন, গেরো হে গেরো। এমন গেরো আমার পঞ্চাশ বছরের আয়ুতে কখনও আসেনি। পুলিশের সঙ্গে মারপিট করে অসহ্য মশার কামড়ের মধ্যিখানে তেরারি হাজতে কাটিয়েছি, চন্নগর মাহেশের ফেস্তাতে যাবার পথে মাঝগঙ্গায় নৌকোডুবিতে হাবুডুবু খেয়েছি জলে পড়লে আমি আবার নিরেট পাথরবাটি-থিয়েডারের এক হাফ-গেরস্ত মাগী আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল ইত্যাকার বহুবিধ যাবতীয় ফাড়া-মুশকিল গেবো-গর্দিশ বয়ান করার পর বললেন, ওসব লস্যি হে লস্যি। ওহ্! এ গেরো যা গেল।
আমি বললুম, এ আশ্রম তো শান্তির নিকেতন। এখানে আবার গেরো?
গাঙ্গুলীমশাই নল ফেলে দিয়ে যুক্তকরে, মহর্ষির উদ্দেশে প্রণাম করে বললেন, তিনি পিরিলি বংশের প্রদীপ, আর সেই পিরিলি বংশের এ অধম পিলসুজ দেলকোর ছায়া। পাপ মুখে কী করে বলি, এখানেও মাঝে মাঝে অশান্তির উপদ্রব দেখা দেয়। কিন্তু বাবা, আমা হেন সামান্য প্রাণীকে বলির পাঁঠার মতো বেছে নেওয়া কেন?
আমি হুঁকোর নলটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললুম, কোটা ল্যান, খুলে কন।
গাঙ্গুলীমশাই বললেন, গাঁধী হে, গাধী! তোমরা যাকে মহাত্মা ঠহাত্মা বল। তার পর ফের যুক্তকরে বললেন, তারা ব্রহ্মময়ী মা, বজ্রযোগিনী মা, রক্ষে দাও মা এসব মহাত্মাদের লেক লজর থাকে।
আমি তাজ্জব মেনে বললুম, গান্ধীজি তো অতিশয় নিরীহ, নিরুপদ্রবী, ভালো মানুষ। তিনি আপনার গেরো হতে যাবেন কেন?
গাঙ্গুলীমশাই বললেন, এই বুঝলেই তো পাগল সারে। তোমাকে তা হলে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
জানো তো বাপু, দেশ-বিদেশের হোমরা-চোমরা এখানে এলে আকছারই ওঠেন উত্তরায়ণে; বাস করেন হয় গুদেবের (প্রাচীন-পন্থীরা গুরুদেব না বলে বলতেন গুর্দের্ব) পাশে, নয় রথীবাবুর ওখানে। আমি তো নিশ্চিন্দি মনে দিব্য গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর উত্তরায়ণের নায়েব গোমস্তা চাকরবাকরদের দেখলেই মনে মনে ফিকফিক করে হেসে ভাবি, সব ব্যাটা বলির পাঠা। গাঁধী মাছ মাংস খান না বটে, কিন্তু মা কালীকেই কী তার উদ্দেশে বলি দেওয়া পাঠা কেউ কখনও খেতে দেখেছ; গাঁধী খাবেন না, সত্যি কথা, কিন্তু তাই বলে চাকর নফরের বলি নির্ঘাত। তখন কেমন জানি, কিংবা জানিনে, একটা অহেতুক অজানা শঙ্কা আমার ব্রেন-বক্সের-ব্ৰহ্মতালুতে ঢুকে সর্বাঙ্গ শিরশিরিয়ে পায়ের চেটো দিয়ে বেরিয়ে গেল তোমারই মুখে শোনা,
পাঁঠার বলি দেখে পাঠী নাচে।
(পাঁঠা বলে) ও পাঠী তোমার লাগি বিবির শিরনি আছে।
আমি তখন পাঠীর মতো আপন মনে ফিকফি হাসছি, বিলকুল খেয়াল নেই যে পির বিবির দর্শাতে পাঠা বলি হয় না, বলি হয় পাঠী, শিরনি চড়াবার জন্যে। সাদামাটা রাঢ়ীতে বলে, ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে, সবার একদিন আছে শেষে। (৮) উত্তমরূপে প্রবাদটি হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বেই দ্যাখ-তো-না-দ্যাখ সঙ্গে সঙ্গে এওলাফরমান উপস্থিত! আমি কি তখন আর জানতুম যে এই ফরমান-পুষ্পগুচ্ছের ভিতর লুকিয়ে আছে গোখরোর বাচ্চা। আমি তো নাপাতে নাপাতে উত্তরায়ণ পৌঁছলুম। পকেট থেকে ডাস্টার বের করে বুটজোড়া পরিষ্কার করে খোলা দরজায় হাফ মিলিটারি মোলায়েম টোকা দিয়ে গুর্দেবের ঘরে ঢুকলুম।
গুর্দেব লেখা বন্ধ করে আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, বসো গাঙ্গুলী। আমি সিভিলিয়ান কায়দায় তার পায়ের ধুলো নিয়ে মিলিটারি কেতায় দাঁড়িয়েই রইলুম।
গুর্দেব অত্যন্ত প্রসন্ন বদনে আমাকে বললেন, যবে থেকে তুমি এখানে এসেছ, বুঝলে গাঙ্গুলী, আমার ঘাড় থেকে অন্তত একটা বোঝা নেমে গেছে, ভিজিটারদের আরাম-আয়েসের জন্যে আমাকে আর মাথা ঘামাতে হয় না। তুমি একাই একশো; সব সামলাতে পার। আমি তো মনস্থির করে বসেছিলুম গান্ধীজিকে এই উত্তরায়ণেই গেস্টরুমে তুলব। কিন্তু আজ এইমাত্র তার কাছ থেকে চিঠি পেলুম, তিনি দুটি দিন এখানে নির্জনে শান্তিতে বাস করতে চান। তুমি তো জানো, আমার এখানে উদয়াস্ত ভিজিটারের ভিড় লেগেই আছে। তাদের আনাগোনা, বারান্দায় চলাফেরা, আঙিনায় হাঁকডাক গাঁধীর শান্তিভঙ্গ করবে। তাই স্থির করেছি, তোমার গেস্ট হাউসের দোতলাই তার জন্য সবচেয়ে ভালো আবাস হবে; আর তুমি যা-তা ভিজিটারকে ঠেকাতে যে কতখানি ওস্তাদ সে আমি ভালো করেই জানি। তোমার হাতে গাধীকে সঁপে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলুম।
গাঙ্গুলীমশাই সেই ফাঁসির হুকুমের স্মরণে একটুখানি কেঁপে উঠে কাঁপা গলায় বললেন, বাব্বা! আমি আমার ওই গেস্ট হাউস আস্তাবলে গাঁধীকে রাখব কী করে? একটা শোবার ঘরে আছে দুখানা স্পিঙের খাট। সে এমনই স্প্রিং যে তার উপর রামমূর্তি সার্কাসের ফেদার-ওয়েট বামনাবতার গুলৈও সে-স্প্রিং ক্যাচর-ম্যাচর করে মেঝের সঙ্গে মিশে যায়। আমাদের পাড়াতে এক পাদ্রি সাহেব লেকচার দিতে গিয়ে বলেন, প্রফেট নোআর আমলে সর্ববিশ্বব্যাপী এক বিরাট বন্যা হয়। ঈশ্বরসৃষ্ট তাবৎ প্রাণী, বৃক্ষ, তৈজসপত্রাদি যাতে সেই বন্যায় লোপ না পায় তাই তিনি নোকাকে আদেশ দেন, তিনি যেন একটা বিরাট নৌকা গড়ে তার উপর প্রত্যেক প্রাণী, প্রত্যেক জীব, এমনকি প্রত্যেক আসবাবপত্র জোড়ায় জোড়ায় হেপাজতির সঙ্গে তুলে রাখেন। গুরুগম্ভীর হয়ে এতখানি শাস্ত্রালোচনা করার পর গাঙ্গুলীমশাই ঈষৎ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জিরিয়ে নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমার মনে রত্তিভর সন্দ নেই যে আমার গেষ্ট হাউসের উপরের তলায় যে দুটি খাট আছে সেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বময় ঘোরাঘুরি করে শেষটায় আশ্রয় পেল দেবেন্দ্রনাথের চরণপ্রান্তে। আফটার অল্ তিনি তো প্রফেট–নোআরই মতন গত শতাব্দীর প্রফেট।
এস্থলে বলে রাখা প্রয়োজন, গাঙ্গুলীমশাই ছেলেবেলা থেকেই সে যুগের বিলিতি এদেশে একদম বেখাপ্পা– ডবল খাট, ড্রেসিং টেবিল, এসৃক্রিতোয়ার, বিদে, চায়না ইত্যাদিতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনিই আমাকে একদিন বলেছিলেন যে তার ধনী ঠাকুন্দা তার ভিলাটি সাজিয়েছিলেন নসিকে বিলিতি কায়দায় একমাত্র ডাবল সি টা ছিল ব্যত্যয়, নেটিভ স্টাইলে গোড়ালির উপর বসে কর্মটি সমাধান করতে হত। তা সে যাই হোক, গাঁধীজির অভ্যর্থনার জন্য যেটুকু মিনিমামেস্ট দরকার সে তিনি পাবেন কোথায়, গাঙ্গুলীমশায়ের ভাষায় আফটার অল লোকটা তো বিলেতে ব্যারিস্টারি পাস করেছে।
গাঙ্গুলীমশাই বলে যেতে লাগলেন, গুদে বোধহয় আমার হতভম্ব ভাব দেখে তরসা দেবার জন্য বললেন, তোমার যা যা দরকার আমার এখান থেকে, রথী আর বউমার বাড়ি থেকে নিয়ে যেও। আহ্! কথাটি শুনে পেরানটি জুড়িয়ে গেল। ওঁয়ার আছেটা কী? এরকম কম আসবাবপত্র নিয়ে তার ক্রিচারস কম্ফর্ট পোয় কী করে জানেন ব্রহ্মময়ী।(৯) অবশ্য রথীবাবুর বাড়িতে এটা-সেটা আছে, কিন্তু একটা ভদ্রলোকের বাড়ি তো আর লাজারসের গুদাম নয় যে প্রত্যেক আইটেম দু-তিন দফে করে থাকবে। ও বাড়ি থেকে আমার যা দরকার– খাট সোফা কোচ, নতুন পর্দা, লেখা-পড়ার জন্য উত্তম টেবিল-চেয়ার, একটা পেনট্রির আসবাবপত্র যেখানে খাবার জড় করা হবে, ডাইনিংরুমের জন্য একটা সাইডবর্ড যেখানে পেনট্রি থেকে আসা খাবারের ডিস ডিনার টেবিলে সার্ভ করার পূর্বে রাখা হয়, হল-মার্কওলা উত্তম রুপোর ছুরি-কাঁটা–।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, অবাক করলেন, গাঙ্গুলীমশাই! আপনি আমাকে সেই বু সব ইংরেজের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। ফরাসি ভাষা জানে না; প্যারিসের রেস্তোরাঁয় তাই আঙুল দিয়ে মেনুতে দেখিয়ে দিল প্রথম পদ। এল সুপ। এবার অব আঙুল দিল মেনুর মধ্যিখানে। ভাবল, মাছ-মাংস ওই ধরনের কিছু একটা সলিড় সাবসৃটেনশাল আসবে– ফরাসিতে যাকে বলে পিয়েস দ্য রেজিসাস অর্থাৎ যে বস্তু (পিস) আপনার ক্ষুধাকে মোক্ষম রেজিসটেন্স দেবে। ও হরি! ফের এল সুপ। খানাপিনা বাবদে হটেনটট গোত্রের ইংরেজ জানবে কী করে বিদগ্ধ ফরাসি জাত মেনুতে নিদেন ত্রিশ রকমের সুপ রাখে (হটেনটট গোরা বলে, উই ইট টু লিভ, আর বিদগ্ধ ফরাসি বলে, উই লিভ টু ইট)। এদিকে ইংরেজের রেস্ত ফুরিয়ে এসেছে। পুডিং মুডিং-এর আশায় দেখাল সর্বশেষ আইটেম। এল টুথ পেক–খড়কে। বুঝুন ঠ্যালা। তরলতম দু-কিস্তি সুপ খেয়ে, পান করে বললে সঠিকতর হয়, খড়কে দিয়ে দাড়ি খোটা! আপনি যে ইংরেজটাকেও হার মানাতে চললেন। করমচান্দের সুযোগ্য সন্তান মোহনদাস গাঁধী তো শুনি খান বা পান করেন– পাজের শুরুয়া বা সুপ, সে-ও অতি হালকা আর বকরির দুধ। ওই দুই তরল দ্রব্য মুখে পৌঁছে দেবার জন্য আপনি ওঁকে হাতে তুলে দেবেন হামিলটন কোম্পানির হল মার্কওলা রুপোর ছুরি আর কাঁটা! ভাগ্যিস আপনি চীনের ইম্পিরিয়াল পেলেস থেকে হীরে পান্না বসানো চপ ঠিক রেকুইজেশন করেননি।
গাঙ্গুলীমশাই ঠোঁটের এককোণ দিয়ে কিস্তিতে কিস্তিতে ধুয়ো ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তোমার যেমন আঙ্কেল। যে ভিখিরি কুকুরের সঙ্গে মারামারি করতে করতে ডাস্টবিন থেকে খুঁজে খুঁজে খুঁটে খুঁটে অখাদ্য খায়, তাকে খেতে ডাকলে কী রাস্তা থেকে বাড়িতে একটা ডাস্টবিন তুলে এনে সেই ময়লার ভিতর সেই অখাদ্যই রাখ নাকি, যেটা সে নিত্যি নিত্যি খায়? আর দু-তিনটে যেয়ো কুকুর লড়াই করার জন্য।
আরে বাপু, যার যা বেষ্ট, মেহমানকে সেইটে দিতে হয়। আমি তাই দিন তিনেক উদয়াস্ত খেটে উপরের তলার তিনখানা ঘর সাজালুম। খুব যে মন্দ হল তা বলব না। অবশ্য দুর্গা নাম জপ এক সেকেন্ডের তরেও কামাই দিইনি।
মহারাজ আসবার আগের দিন বেলা প্রায় দশটার সময় গর্মি তখন নিদেন ১১২ ডিগ্রি দেখি, কে যেন মিন-ছাতায় রোদ্দুর ভেঙে ভেঙে আসছে। কে চোখ কচলে দেখি– সর্বনাশ– জাব্বাজোব্বা পরা গুর্দেব। প্রথমটায় ভেবেছিলুম মহর্ষিদেবের ছায়া-শরীর। জানো, বোধহয়, অনেকেই জ্যোৎস্নারাতে দেখেছে, সাদা আলখাল্লা পরা তার ছায়াকায়া মন্দির থেকে বেরিয়ে তার মর্তের বাসভবনে এই গেস্ট হাউসের দিকে আসছেন। এবার বুঝি ঠা ঠা রোদূরে। তবে ভরসা এই, কাছে গেলেই উপে যাবেন।
আমি বললুম, যত সব গাঁজা। মহর্ষিদে এ মন্দির কখনও দেখেননি। শুনেছি, মহর্ষির আদেশে হাভেল সাহেব না কে যেন আর অবন ঠাকুরে মিলে এটার প্ল্যান করেন। এটার প্রতি পরলোকে গিয়েও তার মোহ থাকবে কেন?
গাঙ্গুলীমশাই বললেন, আমি তো পড়িমরি হয়ে ছুটলাম গুদেবের দিকে, রঙচটা বাঁশের ছাতাখানা নিয়ে। তিনি ছাতাখানা উপেক্ষা করে মৃদু হেসে বললেন, দেখি গাঙ্গুলী, অতিথি সল্কারের কী ব্যবস্থা করেছ।
গাঙ্গুলী মহাশয়ের সর্বাঙ্গে সভয় কম্পনের শিহরণ খেলে গেল– গুরুদেবের ওই অত্যন্ত হামলেস ইচ্ছা প্রকাশের স্মরণে। বললেন, সবাই আমাকে ভরসা দিয়েছিল, গাধী কিছুতেই গুর্দেবকে এ বাড়িতে তকলিফ বরদাস্ত করে আসতে দেবেন না। তিনি যাবেন স্বয়ং–যতবার প্রয়োজন হয় উত্তরায়ণে, যাত্রী যেরকম ভক্তিভরে তীর্থস্থলে যায়। কাজেই গুর্দেব আমার জোড়াতালির ঘর-সাজানো দেখতে পাবেন না। এখন উপায়? এক ঝটকায় মা কালীর ঘুষ ডবল করে দিলুম– দুটোর বদলে চারটে মোষ।
হায়, হায়, হায়। গেরো, গেরো, গেরো। গুদে ঘরে ঢুকেই বললেন, এসব করেছ কী হে! সব যে বিলিতি মাল। ব্রাস রড়ওলা শ্রিং খাট! সর্বনাশ। বের কর, বের কর টেনে। এখনি। আর লোক পাঠাও, দেরি কর না– অমুকের বাড়িতে বিয়ের সময়ে সে পেয়েছিল চীনে মিস্ত্রির হাতে খোদাই করা করা একখানা জবরদত্ত কাঠের পালঙ্ক। আনাও সেটা। আর এসব যে একেবারে বিলিতি বেড় শিট, বালিশের ওয়াড়। তুমিই যাও, গাঙ্গুলী, হা তুমিই যাও, বউমার কাছে। তার গুদামঘরে আমার একটা মস্ত বড় সিন্দুক আছে। তার ভিতর খদ্দরের সব জিনিস পাবে। আমি যখন গেলবার আহমদাবাদ গিয়েছিলুম তখন সবাই আমাকে চেপে ধরল খন্দর পরার জন্য। আমি বললুম অত মোটা কাপড় আমার সয় না। তারা যেন চ্যালেন্জটা তুলে নিল। ধুতি, পাঞ্জাবির অতি মিহিন কাপড় থেকে আরম্ভ করে বিছানার চাদর, ওয়াড়–এমনকি খদ্দরের মশারি। না হে না, তুমি ভাবছ ওর ভিতর মানুষ দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। মোটেই না। এমনই মিহিন যেন মলিন। ভিতরে যে ওয়ে আছে। তার দিকে বাইরের থেকে তাকালে মনে হয় মাঝখানে কোনও মশারি নেই।
হঠাৎ কার্পেটের দিকে নজর যেতে ফের ইকম, ফেলে দাও এটাও। তার পর কী যেন ভাবতে গিয়ে উপরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বিজলিবাতির বাব। চিন্তিতভাবে যেন আপন মনে বললেন, এটাকে নিয়ে কী করা যায়? আমাকে বললেন, যা, বউমার ওখানে যাবার সময় নন্দলাল আর ক্ষিতিমোহনবাবুর স্ত্রীকে এখানে পাঠিয়ে দিও। আমি সব আদেশ তামিল করার সময় ভাবলুম, হনুমানজিকে কে বলে সরল? তিনি তার মুনিটিকে হাড়ে হাড়ে চিনতেন। এখন বলছেন, লে আও বিশল্যকরণী। আনা মাত্রই হয়তো ফের হুকুম-ওই যু-যা। বিবতারিণীর কথা বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম। যাও তো বস পবননন্দন হনুমান পবনগতিতে। নিয়ে এস ওই বস্তুটি। তখন ঘষ্টাতে ঘটাতে যাও ফের ওই মোকামে। ক-বার যেতে আসতে হবে সে কি স্বয়ং প্রভু রামচন্দ্রই জানেন? অতএব নিয়ে চল সমুচা গন্ধমাদনটাকে। আর এস্থলে স্মরণ কর, আমাদের ওর্দেবের বাবামশাই কী করতেন? ঘড়ি ঘড়ি মত বদলাতেন বলে তার খাস সহচর দুদিন অন্তর অন্তর বিদেশ থেকে টেলি পাঠাতেন, বাবু চেনজেস হিজ মাইন্ড। পুত্রের যে সেটা অর্সায়নি কী করে জানব? আমি নিয়ে চললুম গন্ধমাদন প্রমাণ সেই বিরাট সিন্দুকটাকে। আমার অবশ্য সুবিধে, আমাকে তো ওটা বইতে হবে না। বইবে ব্যাটা হীতলাল, কালো, ভোলা, বঙ্কা গয়রহ।
গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেখি, চীনা পালঙ্ক তখনও আসেনি। খবর পেলুম সক্কলের পয়লা এসে পৌঁছেছেন ঠানদি (ক্ষিতিমোহনবাবুর স্ত্রী)। সেটা অতিশয় স্বাভাবিক। তার নাম কিরণ। তার টাটু ঘোড়ার মতো চলন দেখে ক্ষিতিবাবুই একদিন বলেছিলেন, সার্থক নাম কিরণ! কী run দেখেছ?
উপরে গিয়ে দেখি তুলকালাম কাও। ঠানদি এবং জনা তিন-চার এক্সপার্ট মহিলা লেগে গেছেন ঠিক সেন্ট্রাল বাতিটার নিচে দুনিয়ার যত কঠিন কারুকার্য ভরা বিরাট গোল একটা আল্পনা আঁকতে। শুর্দেব এককোণে চুপ করে বসে বসে সব দেখছেন। এমন সময় নন্দলাল এলেন। গুর্দেব তাঁকে বললেন, এক কাজ কর তো নন্দলাল। ওই বালবটাকে আড়াল করতে হবে। তুমি এটার নিচে একটা পেতলের চেপ্টা ফ্লাওয়ার ভাজ ছাত থেকে সরু সরু চেন দিয়ে বুলিয়ে দাও তো। ঠিক মানানসই সাইজ ও শেপের ও-রকম একটা ভা বউমার আছে। আর ভাজ ভর্তি করে দাও পদ্মফুল দিয়ে, কুঁড়িগুলো যেন গোল হয়ে বাইরের দিকে মাথা ঝুলিয়ে দেয়। বিজলির আলো আসবে পদ্ম পাপড়ির ফাঁকে ফাঁকে। কী বললে? পদ্ম না-ও পাওয়া যেতে পারে! নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। একটু দূরে লোক পাঠালেই হবে। নইলে মানানসই অন্য ফুল? নন্দলাল মাথা নেড়ে জানালেন হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে সেই মানওয়ারি জাহাজ সাইজের পালঙ্ক এল।
আমি এ কাপড়, ও শিট দেখাই। তিনি নামঞ্জুর করেন। শেষটায় না পেরে বললুম, সিন্দুকটা নিচে রয়েছে। উপরে নিয়ে আসব কি? এক ঝলক হেসে বললেন, না, আমি নিচে যাচ্ছি। সেখানে চেয়ারে বসে শেষ রুমাল অবধি নেড়ে-চেড়ে পরখ করলেন, বাছাই করলেন। তার পর ফের উপরে এসে চেয়ারে বসে বিছানা তৈরি করা বাবদে পই পই করে বালালেন, কোন শিটটা উপরে যাবে, কোনটা নিচে ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও মেলা মেলা বায়নাক্কা ঝামেলা। জলের কুঁজোটা কোথায় থাকবে, নাইট-টেবিলের পাশে ছোট্ট শেলফে কী কী বই থাকবে– সেসব কথা বলতে গেলে বাকি দিনটা, চাই কি রাতটাও কাবার হয়ে যেতে পারে। সংক্ষেপে সারি। হঠাৎ বললেন, চল গাঙ্গুলী, স্নানের ঘর দেখে আসি। ঢুকেই বললেন, একী কাণ্ড! সরাও এখুনি ওই জিন টাটা। নিয়ে এস আমার স্নানের ঘর থেকে পেতলের বড় গামলাটা। আর এখানেই একটা বোয়ামে আছে বেসন। নিয়ে এস একটা রুপোর কৌটোতে করে। সাবানটা সরাও। আমি বললুম, ওটা গডরেজের ভেজিটেবল সোপ। তা হোক। ফেলে দাও ওটা। আর ওই টার্কিশ টাওয়েলটাও সরাও। সিন্দুক থেকে নিয়ে এস খদ্দরের ভোয়ালে, আর একখানা সবচেয়ে সরেস গামছা। নিমের দাঁতন কই? আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ওঁর তো দাঁত নেই, আর্টিফিসিয়াল আছে কি না জানিনে। তা হোক, নিয়ে এস দাঁতন। আর ক্ষিতিমোহনবাবুর স্ত্রীকে বল, আজই যেন সুপরি পুড়িয়ে বাকি সব তিনি জানেন টুথ পাউডার বানিয়ে পাঠিয়ে দিতে। বুঝলুম, কোনও নবীন দশনসংস্কারচুর্ণ ক্ষিতিমোহনের স্ত্রী বদ্যি-গিন্নি তো।
করে করে সবকটা তৈরি হল। সেই ১১৪ গরমে আর ক্লান্তিতে আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। বৃদ্ধ প্রভু কিন্তু খুট খুট করে দিব্য এ-ঘর ও-ঘর করছেন।
দম নিয়ে গাঙ্গুলীমশাই বিরাট এক তাওয়া সাজাতে সাজাতে বললেন, তোমার প্রাণ যা চায় সেই দিব্যি, কসম, কিরে আমাকে কাটতে বললে আমি এখুনি সেইটে কেটে বলব আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস কোনও বধূ তার বরের জন্য, কোনও প্রেমিক তার প্রিয়ার জন্য কস্মিনকালেও এরকম বাসরঘর মিলনশয্যা তৈরি করেনি। আর গুর্দেবও এ কর্ম পূর্বে কখনও করেননি সে বিষয়ে আমি আদালতে তিন সত্যির দোহাই দিয়ে কসম খেতে রাজি আছি।
আরেকটা কথা শোন, সৈয়দ। গুদেবের মতো স্পর্শকাতর, সুন্দরের পূজারি যখন সব হৃদয় ঢেলে দিয়ে কোনও কিছু সুন্দর করে গড়ে তুলতে চান–এই যেমন এ বাড়িটাকে তার চরম সুন্দর রূপ দেওয়া তখন তার হাজার মাইল কাছেও আসতে পারে কোন প্রফেশনাল ডেকোরেটরের গোঁসাই।
আর সমস্ত জিনিসটা ছিল অত্যন্ত সিমপল অথচ প্রত্যেকটি জিনিস থেকে উথলে উঠছিল সৌন্দর্য।
আমি শুধালুম, তার পর?
গাঙ্গুলীমশাই শান্তকণ্ঠে বললেন, এবানেই কাহিনীটি শেষ করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু তুমি যখন আদ্যন্ত শুনতে চাও তবে কী আর করি বলি।
গাঁধীজিকে উপরের তলায় নিয়ে গেলেন স্বয়ং গুর্দেব। আমি তার ধরা-ছোঁওয়ার ভিতরে– যদি-বা কোনও কিছুর দরকার হয়। তাই সব দেখেছিলুম, সব শুনেছিলুম। দুই হিমালয়ের সাক্ষাৎ উভয়ের মধ্যে গভীরতম প্রীতি– এমনকি সংঘাত। সেই মোকা ছাড়ব আমি! হে!
বেশ পরিষ্কার স্পষ্ট লক্ষ করলুম, গাধী যেন দু-চারটে জিনিস দেখলেন, কিন্তু কোনও কিছুই লক্ষ করলেন না। আল্পনা, মাথার উপরে ফুলের ডালি, তাজমহলের মতো খাটবিছানা, বেডকভারের ঠিক মাঝখানে বাটিকে কাজ করা নিটোল গোল মেডালিয়নের ভিতর সেই অজন্তার ছবি, যেখানে একটি তরুণী দু-ভাজ হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রভু বুদ্ধের পদতলে পদ্মফুলের অঞ্জলি দিচ্ছে।
কোনও কিছুই যেন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না।
তার পর তিনি আস্তে আস্তে উত্তরের খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার দৃষ্টি যেন মন্দির পেরিয়ে টাটা বিলডিং ছাড়িয়ে কোন সুদূরে চলে গেছে। হঠাৎ গুদেবের দিকে ফিরে বললেন, এরই কাছে ছাতে যাবার সিঁড়ি আছে না? চলুন।ছাতে গিয়ে দুজনাতে অল্প একটু পাইচারি করার পর গাধী একগাল হেসে বললেন, আমি এই ছাতেই বাসা বাঁধব। ভারি চমৎকার!
আমি অবাক হয়ে বললুম, তার মানে?
মানে আর কী? পড়ে রইল সব নিচে। আমি তাকে কখনও ওই বেডরুমের একটিমাত্র জিনিস ব্যবহার করতে দেখিনি। অবশ্য একথা ঠিক, যে দুটি দিন এখানে ছিলেন তার অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন উত্তরায়ণে, ঋর্দেবের সঙ্গে আর বড়বাবুর (দ্বিজেন্দ্রনাথের) সান্নিধ্যে। বড়বাবুর কাছ থেকে বুড়ো ফিরছিলেন হাসিখুশি ভরা ডগমগ মুখে, আর গুদেবের কাছ থেকে চিন্তাকুল বদনে। রাত্রি কাটাতেন ছাতে। গাঙ্গুলীমশাই থামলেন।
অনেকক্ষণ গভীর চিন্তা করার পর বললেন, আমি পলিটিক্স একবর্ণও বুঝিনে। গাধীর লেখা এক ছত্রও পড়িনি আর গুদেবের সামান্য যেটুকু পড়েছি সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমার মতামতের কোনও মূল্য নেই। তবু বলি, এবারও গাঁধী-গুর্দেবে মনের মিল হল না। কিন্তু আমার মনে হয় এবারেই ছিল বেস্ট চান্স। আমার মনে হয়, গাধী যদি ওই আল্পনা, পদ্মফুলের আলো এবং সুদেবের আরও পাঁচটা সযত্নে সাজানো নেড়েচেড়ে দেখতেন, একটুখানি কদর দেখাতেন তা হলে গুদেবের দিলটা একটু মোলায়েম হত। লোকে বলে গাধী সত্যের পূজারি আর শুর্দেব নাকি সুন্দরের পূজারি! কিন্তু গুর্দেব যে সত্যেরও পূজারী সে-ও তো জানা কথা। গাধীও নিশ্চয়ই সুন্দর জিনিস ভালোবাসেনকে বাসে না, কও! কিন্তু তার কোনও লক্ষণ আমার পাপ চোখে পড়েনি। তাই আমার মনে হয় গাঁধী যদি তার জন্য সাজানো ঘরটাকে একটু পুজো করতেন। মানে একটু আদর করতেন তা হলে গুর্দেব ভাবতেন, এ লোকটা ভিতরে ভিতরে সুন্দরেরও পূজা করে। আমার বংশের না হোক, আমার গোত্রেরই লোক। তাই হয়তো একটা সমৰাও হয়ে যেত।
আবার দেখ, গাধীজি তাঁর সত্য-উপলব্ধির প্রতীক চরকা সবাইকে বিলোচ্ছেন। আমরা হাত পেতে নিচ্ছি কিন্তু আমরা কোনও প্রতিদান দিচ্ছিনে কারণ আমাদের মতো সাধারণ লোকের কীই-বা আছে যে তাঁকে দেব? কিন্তু গুদেবের বেলা তো সেকথা নয়। তিনি সুন্দরের পূজা করে অনেককিছু পেয়েছেন। কই, গাঁধী তো তার কাছ থেকে নিলেন না! এমনকি এই যে সামান্য সাজানো কামরা কটি– তার ফুল, কিছু আল্পনা কোনওকিছুই লক্ষ করলেন না– গ্রহণ করলেন না।
তাই বলি, সৈয়দ, সংসারটা চলে গিভ অ্যান্ড্র টেকের ওপর।
.
উপসংহারে নিবেদন, বলা বাহুল্য, গুরুদেবকে নিয়ে যে আমি উত্তম পুরুষে কথা বলিয়েছি তার অধিকাংশই আমার কল্পনাপ্রসূত। কারণ যদিও গাঙ্গুলীমশাই গুরুদেবের কথাবার্তার চো আনা আমাকে সে সময়ে ঠিক ঠিকই বলেছিলেন তবু ভুললে চলবে না, পূর্বেই নিবেদন করেছি, গাঙ্গুলীমশাই ছিলেন পয়লা নম্বরি কীর্তনিয়া–রাকোতর। নিশ্চয়ই তার বর্ণনায় বেশ খানিকটে রঙচঙ চড়িয়ে ছিলেন– ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
তদুপরি তিনি আমাকে কাহিনীটি বলেন, ১৯২৫-এ। আর আমি এ কাহিনী লিখছি ১৯৬৯-এ!! কিন্তু মূল ঘটনাগুলো যে সত্য তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি (কারণ এ ঘটনা পরে আরেকবার ঘটে- তবে সেখানে পাত্র গাঁধী ও মুসসোলিনির প্রতিভূ এক জাহাজ-কাপ্তান)।
অবশ্য আমি দুই লাইনেই এ কাহিনী শেষ করতে পারতুম। যথা : গুরুদেব অতিশয় সযত্নে ঘর সাজালেন। তার সৌন্দর্য গাঁধীজির চোখে পড়ল না। কিন্তু তা হলে তো লেজেন্ডের গোড়াপত্তন হয় না–রবিপুরাণ কাহিনী নির্মিত হয় না।
আরেকটি কথা বলার খুব যে একটা প্রয়োজন আছে তা নয়। তবু বলি। সুচতুর পাঠক অতি অবশ্যই বুঝে গিয়েছেন, গুরুদেবের মুখে আমি যে ভাষা বসিয়েছি, অতি অবশ্যই গুরুদেব ওরকম কাঁচা বাংলা বলতেন না। এবং সহৃদয় পাঠক বুঝে গিয়েছেন বলেই আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। প্রবাদ আছে- টু আন্ডারস্টেন্ড ইজ টু ফরগি।
এবং গাঙ্গুলীমশাইয়ের ভাষারও জেল্লাই জৌলুস জ্যান্ত জিন্দা করতে পারিনি আমি–দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর পর।
সর্বশেষে বক্তব্য এটা লেজেন্ড, রূপকথা, পুরাণ। ইতিহাস নয়।
.
দ্বন্দপুরাণ উপরেই শেষ হল। কিন্তু গাঁধী-পুরাণের অন্য এক কাহিনীর ইঙ্গিত আমি এইমাত্র দিয়েছি। সেটি বলিনি। সে-ও মজাদার।
দ্বন্দপুরাণের ছ বছর পরের ঘটনা। ১৯৩১ রাউন্ড-টেবিল সেরে গাধীজি দেশে ফেরার জন্য বেছে নিলেন একখানা ইতালির জাহাজ। ইল দুচে বেনিতো মুসসোলিনি তো ড্যাম গাড়ি। (ওদিকে জর্মন জাত বড় নিরাশ হয়েছিল। গাধী বলেছিলেন, রাউন্ড-টেবিলে তিনি যদি সফলতা লাভ করেন তবে ইয়োরোপে যে একটিমাত্র জায়গা দেখার তার ঐকান্তিক কামনা আছে সেটিকে তিনি তীর্থযাত্রীরূপে শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশে ফিরবেন– ভাইমার, কবি গ্যোটের লীলাভূমি ও সমাধিস্থল। কিন্তু গোলটেবিলে নিষ্ফল হলেন বলে সোজা দেশে ফেরেন।) মুসসোলিনি খবর পাওয়া মাত্র বললেন, যে জাহাজে গাঁধী যাবেন সেটা অত্যুত্তম, কিন্তু তার সেরার সেরা কাবিনা লুসোরিয়োজা (সাধু সাবধান! ইতালীয় ভাষার সঙ্গে আমার অতি সামান্য নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পরিচয়– ভুল হতে পারে। অর্থ হচ্ছে কাবিন দ্য ল্যুকস, লাকসারি কেবিন, সবচেয়ে আক্রা ভাড়ার বিলাস কেবিন) নিশ্চয়ই রাজা মহারাজা ফিল্টারের পক্ষে যথেষ্টরও বেশি, কিন্তু গাঁধী এখানে এসে তিনি যে অলঙ্কার ব্যবহার করলেন তার ইংরেজি আছে- গাঁধী? হি ইস নট এভরিবডিজ কাপ অব্ টি– বাংলাতে মেরেকেটে বলা যেতে পারে, ভিন্ন গোয়ালের একক গোমাতা, মা ভগবতী কিংবা আমরা যেরকম বলি কানু ছাড়া গীত নেই, তার সঙ্গে মিলিয়ে গাধী ছাড়া নর নেই। আরবরা বলে, গাঁধী মহারাজের কাহিনী সব কাহিনীর মহারাজা। তার পর হুকুম দিলেন, গাঁধীকে সবসে বঢ়িয়া কেবিন দাও একটা না, সুইট অব কেবিন। বেডরুম, ড্রয়িংরুম, এন্টিরুম (ভিজিটরদের জন্য প্রতীক্ষাগৃহ), আপন খাস ডাইনিংরুম ইত্যাদি ইত্যাদি। লক্ষপতিদের বুকিং কেনসেল করে। আর তোমাদের দ্য লুকস্ কেবিনের সোফা কোচ বিছানা বাথরুম লক্ষপতিদের জন্য গুড ইনাফ, মলটো বুয়োনো (ভেরি গুড়) কিন্তু গাধীর জন্য নয়। পালাদসো ভেনেসিয়া (ভেনিস পেলেস–ইটালির প্রায় সর্বোত্তম প্রাসাদ) থেকে তাবৎ ফার্নিচার পাঠাও। সর্বশেষে বললেন, ওই অচ্ছি অচ্ছি তাগড়ি বকরি, দুধকে লিয়ে। এই ফার্নিচার পাঠানোর পিছনে হয়তোবা কিঞ্চিৎ ইতিহাস আছে। এখানে আবার গুরুদেব প্রধান পাত্র।
যারা কবিগুরুর মৃত্যুর পর তার বধূমাতা স্বর্গীয় প্রতিমা দেবীর নির্বাণ পুস্তিকা পড়েছেন, তারাই জানেন, অসুস্থাবস্থায় তিনি কিছুদিন কাটান তার এক প্রিয়া শিষ্যার বাড়িতে, দক্ষিণ আমেরিকার আরজেনটিনায়। এর নাম ভিকরিয়া (অর্থাৎ বিজয়া এবং কবি দেশে ফিরে একেই তার পরের গ্রন্থ উৎসর্গ করেন। কবির সঙ্গে তোলা এঁর ছবি পাঠক পাবেন পূরবী কাব্যে, বিশ্বভারতী সংস্করণ রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, ১০৫ পৃষ্ঠার মুখোমুখি। একে উদ্দেশ করে কবি একগুচ্ছ কবিতা লিখেছেন পূরবীতে বিদেশি ফুল অতিথি ও অন্যান্য কবিতা দ্রষ্টব্য) ও কাম্পো। কবি দেশে ফেরেন ইটালিয়ান জুলিয়ো চেজারে (জুলিয়াস সিজারের ইতালির উচ্চারণ) জাহাজে করে। জাহাজে বিদায় দিতে এসে ভিকরিয়া দেখেন (পূরবীর বদল ও গীতবিতানের তার হাতে ছিল গান দ্রষ্টব্য শ্ৰেতব্য) যে, যদিও কবিকে সর্বোত্তম দ্য লুকস্ কেবিন দেওয়া হয়েছে তবু সদ্য রোগমুক্ত জনের জন্য হেলান দিয়ে বসার আরামকেদারা সেখানে নেই। তিনি তদণ্ডেই লোক পাঠালেন বাড়িতে; যে আরাম কেদারায় অসুস্থ কবি বসতে ভালোবাসতেন সেইটে নিয়ে আসতে। বিরাট সে কেদারা, তাই কেবিনের ছোট দরজা দিয়ে ঢোকে না। ভিকরিয়া ডেকে পাঠালেন জাহাজের কাপ্তানকে। বিরাট জাহাজের কাঁপতেন হেজিপেজি লোক নয়– তাকে ডেকে পাঠানো যে সে লোকের কর্ম নয়। তাই এস্থলে বলে রাখা ভালো, তার অর্থসম্পত্তি ছিল প্রচুরতম এবং তাৰং আর্জেন্টাইনের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারিত। তিনি সুসাহিত্যিক, প্রভাবশালী মাসিকের সম্পাদিকা এবং পরবর্তীকালে তিনি ইউনাইটেড নেশনসের একাধিক বিভাগে তার দেশের প্রতিভূ হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। টাইম সাপ্তাহিকে আমি সে বিবরণী পড়েছি ও তার ছবি সেখানে দেখতে পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিক উত্সবে আরজেনটাইন ডাকবিভাগ কবির ছবিসহ বিশেষ স্ট্যাম্প প্রকাশ করে ভিকরিয়ারই জোরদার প্রস্তাবে। এবং তিনি নির্দেশ দেন, ডাকবিভাগ যেন কবির কোন ছবি ছাপা হবে তাই নিয়ে মাথা না ঘামায়। ভারত যে ছবি ছাপাবে সেটা তিনি কবিপুলের কাছ থেকে আনিয়ে ডাকবিভাগকে দেবেন। ডাকবিভাগ মাতার সুপুত্রের মতো তাবৎ নির্দেশ মেনে নেয়। এই স্ট্যাম্প খামে সেঁটে ভিকরিয়া কবিপুত্রকে একখানা চিঠি লেখেন; আমি সেটি দেখেছি। যা বলছিলুম : কাপতানকে ভিকরিয়া হুকুম দিল কেবিনের দরজা কেটে কেদারা ঢোকাও।* [** এ কেদারার শেষ ইতিহাস পাঠক পাবেন, কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ শেষলেখাতে। এ ঘটনার দীর্ঘ ষোল বৎসর পরে, কবি তার মৃত্যুর পাঁচ মাস পূর্বে রোগশয্যায় সেই কেদারাখানা খুঁজে নিয়ে (ছাপাতে আছে খুঁজে দেব– হবে খুঁজে নেব) তার উদ্দেশে একটি মধুর কবিতা লেখেন। শেষলে কাব্যের ৫ নং কবিতা পণ্য।] বলে কী? দ্য লস কেবিনের দেয়াল করাত দিয়ে কেটে তার অঙ্গহানি করা। কাপতান গাইগুই করছে দেখে জাতে দজ্জাল সেই স্পেনিশ রমণী আরম্ভ করলেন ভর্ৎসনা, অভিসম্পাত, কাপতানের আসন্ন পতনের ভবিষ্যদ্বাণী-মুষলধারার বাক্যবাণে তাকে জর্জরিত করতে। এ ঘটনা স্বয়ং কবি কনফার্ম করেছেন। তিনি পুরো ঘটনাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে এস্থলে, বলেন, আমি স্পেনিশ ভাষা জানিনে। কিন্তু তিকরিয়ার সেই জ্বালাময়ী ভাষার কটুবাক্যের রসগ্রহণে আমার কণামাত্র অসুবিধা হয়নি।
কাপতান পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। বংশরক্ষার জন্য সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের মিস্ত্রিকে পাঠিয়ে দেয়।
হয়তো এ ঘটনা মুসসোলিনির কানে পৌঁছয়। হয়তো তাই এ ঘটনার ছ বছর পর গাঁধীজি যখন তার জাহাজে চড়লেন তখন তিনি পালাসো ভেনেসিয়া থেকে সেরা সেরা আসবাবপত্র পাঠান।
যে জাহাজে করে গাঁধী দেশে ফেরেন তার এক ইতালীয় স্টুয়ার্ড আমাকে এ কাহিনীটি বলে। আমি তার সবিস্তর বর্ণনা আমার বড়বাবু গ্রন্থে গান্ধীজির দেশে ফেরা নাম দিয়ে লিখেছি। এস্থলে সংক্ষেপে সারি।
গাঁধীজি জাহাজে উঠলেন। ভয়ে আধমরা (কারণ নির্মম ডিকটেটর মুসসোলিনির কানে যদি খবর পৌঁছয়– গুজব হোক আর না-হোক, লেজেন্ড হোক আর সত্য ইতিহাসই হোক যে– গাঁধীর পরিচর্যায় ক্রটি-জখম ছিল তা হলে বারোটা রাইফেলের গুলি খেয়ে তাকে যে ওপারে যেতে হবে সে বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চয়) তথাপি সগর্বে সদম্ভে গাঁধীজিকে দেখালেন তার জন্য স্পেশালি রিজার্ভড় প্রাসাদসজ্জায় গৌরবদীপ্ত আরাম-আয়েসের ইন্দ্রপুরী সদৃশ্য কেবিনগুলো। গাঁধীজির অনুরোধে তার পর তিনি তাকে দেখালেন বাদবাকি তাবৎ জাহাজ।
সর্বশেষে গাঁধী শুধোলেন, সবচেয়ে উপরে খোলা ডেক-এ (ছাতে যাওয়া যায় কি না?
কাপ্তান সানন্দে তাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। উন্মুক্ত আকাশের নিচে বিরাট বিস্তীর্ণ ডেক।
গাঁধী বললেন, আমি এখানে তাবু খাঁটিয়ে বাস করব।
কাপ্তান বদ্ধ পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে গোঙরাতে গোঙরাতে বলল, অসম্ভব, অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব। এই ভূমধ্যসাগরে রাত্রে তাপমাত্রা নামবে শূন্যে। সুয়েজ খাল আর লোহিত সাগরে দুপুরের গরমি উঠবে ১১৪ তক। এমন কর্ম থেকে আপনাকে ঈশ্বর রক্ষতু।
গাঁধী ঝাড়া তেরোটি দিনরাত্রি কাটিয়েছিলেন উপরে। প্রতি সকালে মাত্র একবার নেমে আসতেন নিচে। প্রার্থনা করতে। সর্বশ্রেণির প্যাসেনজার নিমন্ত্রিত হতেন। শুনেছি খালাসিরাও বাদ যায়নি।
কিন্তু গাঁধীজির এই দুই প্রত্যাখ্যানের ভিতর অতলস্পর্শী পাতাল এবং গগনচুম্বী আকাশের পার্থক্য রয়েছে।
মুসসোলিনির ভেট ছিল আরাম-আয়েস বিশাল-ঐশ্বর্য। গাঁধী যে সেগুলো সবিনয় প্রত্যাখ্যান করবেন সেটা কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু রবি কবি গাঁধীর সামনে ধরেছিলেন সরল, অনাড়ম্বর সৌন্দর্য। কবিরই ভাষায় বলি,
দুয়ারে এঁকেছি
রক্তরেখায়
পদ্ম-আসন,
সে তোমারে কিছু বলে?
হায়, বলেনি।
———
১. ১৯২১-২২ রবীন্দ্রনাথ বাস করতেন দেহলী বাড়ির উপরের তলায়, নিচের তলায় সস্ত্রীক দিনেন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে একেবারে লাগোয়া নতুন বাড়ি হসটেল ঘর। সেখানে শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ, বিনোদবিহারী ইত্যাদিরা বাস করতেন। শেষ কামরায় স্বর্গত অনাথনাথ বসু এবং আপনাদের স্নেহধন্য এ অধম। সর্বশেষ কামরা রবীন্দ্রনাথের পেরিরূপে ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ প্রতিমা দেবী, মীরা দেবী, কমলাদি (দিনুবাবুর স্ত্রী) রবীন্দ্রনাথের যে দৈনন্দিন আহার্য পানীয় পাঠাতেন সেগুলো প্রথম এ পেরিতে জড়ো করে (চাকরের নাম ছিল সাধু; বনমালী পরে আসে) রবীন্দ্রনাথকে সার্ভ করা হত। ওই ঘর পেরুবার সময় সবসময়ই চোখে পড়ত আহারাদি কী কী। আমার জানার কথা।
২. এই কবিতাটি নিয়ে আমার মনে ধন্দ আছে। এ দু লাইন থেকে বোঝা যায় কবি ব্যস্ত, চাষের নেমন্তন্নের জন্য এখনও সাজ করা হয়নি; অথচ তার ঠিক ষোল লাইন পরেই বলেছেন, বিশেষ কারণে তিনি যে বৃদ্ধ নন সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। (তখন তার বয়েস ৬২) এবং বলেছেন,
এই ভাবনায় সেই হতে মন এমনিতরো খুশ আছে,
ডাকছে ভোলা খাবার এল আমার কী তার হুঁশ আছে?
এখন প্রশ্ন, কবি এই বললেন তিনি চায়ের নিমন্ত্রণে যাচ্ছেন এবং তার পরই নাকি ভোলা খাবার নিয়ে এসেছে। তবে কি লখনৌওলাদের মতো বাড়ি থেকে উত্তমরূপে খেয়ে নিয়ে দাওয়াতে যেতেন যাতে করে সেখানে খানদানি কায়দায় কম-সে-কম খাবেন। কিংবা ফরেসডাঙার এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মতো যেখানে নিমন্ত্রিত মাত্র ভোজ্যবস্তুর প্রতি নজর বুলিয়ে জলস্পর্শ না করে বাড়ি ফিরে যান। বিশ্বাস না হয়, অবধূত রচিত নীলকণ্ঠ হিমালয়ে মল্লিখিত মুখবন্ধে এ বাবদে সবিস্তর বর্ণনা পড়ন।
৩, সিলেট ও খাসিয়া সীমান্তে একরকম অতুলনীয় মধু পাওয়া যায়। এ মধু মৌমাছিরা সুদ্ধমাত্র কমলালেবুর ফুল থেকে সংগ্রহ করে (সিলেটি কমলালেবুও পৃথিবীতে সবচেয়ে মিষ্ট এবং সবচেয়ে সুগন্ধি, যদিও জাফার নেবুর চেয়ে সাইজে ছোট)। ছুটিতে দেশে যাবার সময় গুরুদেব আমাকে বললেন, পারিস যদি আমার জন্য কিছু কমলামধু নিয়ে আসিস। আমি খুশি হয়ে বললুম, নিশ্চয়ই আনব কিন্তু কাশ্মিরের পদ্মমধু কি এর চেয়ে আরও ভালো নয়। শুরুদেব স্মিত হাস্য করলেন। ভাবখানা কিসে আর কিসে।
৪. শ্ৰীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তার রবীন্দ্রজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে (পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৩৫৫) লিখছেন : দুই মহাপুরুষের প্রথম সাক্ষাক্তার হইল (৬ মার্চ ১৯১৮)। পৃ. ৩৭৭। এটা বোধহয় ছাপার তুল। হবে ১৯১৫।
৫. রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ (একুশ বছরের বড়। কিন্তু গোড়ার থেকেই সত্যাগ্রহ আন্দোলন সমর্থন করে গাঁধীকে পত্র লেখেন। গান্ধীজির ভক্তেরা, আশা করি অপরাধ নেবেন না, যদি বলি, হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থরাজির সঙ্গে গান্ধীজির খুব নিবিড় পরিচয় ছিল না। ওদিকে দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বশাস্ত্ৰ তথা সর্বদর্শন বিশারদ। তাই গান্ধীজি খুব একটা বল পেয়েছিলেন যে তার আন্দোলন শাস্ত্রসম্মত এবং হিন্দু-ঐতিহ্যপন্থী। দ্বিজেন্দ্রনাথকে গাধী ডাকতেন বড়দাদা বলে। ১৬ জুলাই (অর্থাৎ গাঁধী ভেটের প্রায় মাস দেড়েক পূর্বে ১৯২১-এ) রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোমেরিকা ভ্রমণের পর আশ্রমে ঢুকেই দ্বিজেন্দ্রনাথকে প্রণাম করতে যান। কুশলাদি জিগ্যেস করার পর তিনি একাধিকবার রবীন্দ্ৰনাথের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করবার চেষ্টা দেন– কারণ তিনি জানতেন, রবীন্দ্রনাথ এ আন্দোলনের বিরোধী কিন্তু অতিশয় তার সঙ্গে এবং দৃঢ়ভাবে রবীন্দ্রনাথ সে আলোচনার গোড়াপত্তন করতে দিলেন না। অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলুম।
৬. এ আলোচনার বিবরণী কখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে এনডুজ সাহেব আশ্রমে ফিরে ঘরোয়া বৈঠকে আমাদের একটা প্রতিবেদন দেন কিন্তু আমাদের নোট নিতে মানা করেন। আমি ঘরে ফিরে যতখানি মনে ছিল গরমাগরম লিখে ফেলি। সে পাণ্ডুলিপি কাবুলে বিদ্রোহের সময় বরিয়ে যায়। তাতে করে বিশেষ ক্ষতি হয়নি। এ আলোচনার সারাংশ না হোক, বিষয়বস্তু পাঠক প্রাগুক্ত পুস্তকের ৮২-৮৩ পৃষ্ঠায় পাবেন।
৭. পিরিলি খেতাবটি নাকি মুসলমান বাদশা ঠাকুর গোষ্ঠী এবং তাঁদের আত্মীয়দের দেন। কথাটা পির এবং আলী শব্দের অশুদ্ধ সন্ধি। আমি যখন শান্তিনিকেতনে ছিলুম তখন গুরুদেবের এক পিরিলি আত্মীয় ছোকরা আমাকে বলে, ভাই তোর নাম মুজতবা আলী, আর আমার বংশের নাম পির আলী। দুজনারই পদবি আলী। আর ওই সিলেটি রাকেশ বলছিল তুই নাকি পির বংশের ছেলেও বটিস। তবেই দ্যাখ, তুই আমার কাছের কুটুম।
৮, শ্রদ্ধেয় সুশীলকুমার দের অত্যুত্তম বাংলা প্রবাদ গ্রন্থে আছে (নং ৪৯৯৯) পাঠায় কাটে, পাঠী নাচে, পাঠা বলে মগধেশ্বরী আছে। সুশীলবাবু এর টীকা লিখতে গিয়ে জে, ডি, এনডারসেন-এর ওপর বরাত দিয়ে বলেছেন, মগধেশ্বরী পুজোতে চট্টগ্রামে পাঠী বলি দেওয়া হয়।
৯. কথাটা খুবই সত্য। প্রাগুক্ত দেহলী বাড়িতে যখন কবি থাকতেন তখন দেখেছি তার ছিল (১) দু-খানা তক্তপোশ জুড়ে একটি ফরাস- তার গদি কোয়ার্টার ইঞ্চি পুরু হয় কি না হয় (২) মেসে পড়াশোনার জন্য যেরকম মিনিয়েচার টেবিল দেয় তারই এক প্রস্থ ও একখানা চেয়ার (৩) সামনে ন্যাড়া ছাতের উপর দু-একখানা বেতের কুশনহীন চেয়ার এবং (৪) বোধহয় উপাসনা করার জন্য একখানা হেলানো-হাতাহীন জলচৌকির মতো কাষ্ঠাসন। গোসলখানায় কী কী মহামূল্যবান জিনিস ছিল দেখিনি, তবে এমনই একটা সঙ্কীর্ণ করিডরের মতো ফালি জায়গায় সেটা ছিল যে সেখানে নূরজাহানের হাম্মাম থাকার কথা নয়।