দর্পণ

দর্পণ

বছর পনেরো পূর্বে সেই সোনার বাংলা মেতে উঠেছিল রম্যরচনা মারফত রম্যসাহিত্য সৃষ্টি করতে। তার পর সে হুজুগ কেটে যায় তার কারণ বর্ণন উপস্থিত মুলতুবি রাখলুম। বছর পাঁচ-সাত পূর্বে দেখলুম, কেষ্টবিষ্টু তো বটেই, পাঁচু-পেঁচি তক্ ছেড়ে কথা কইছেন না– সবাই লেগে গেছেন, আত্মজীবনী প্রকাশ করতে। সে মোকায় আমারও মনে বাসনা যায় একখানি সরেস আত্মজীবনী ছেড়ে আর পাঁচজনকে ঘায়েল করে দিই, কিন্তু বিধি বাম। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে ম্যান প্রোপোজেস, গড় ডিসপোজেস- মানুষ প্রস্তাব পাড়ে (কোনকিছুর কামনা করে) আর ভগবান সমাধান করেন, তার ইচ্ছেমতো। এটা ইংরেজ আমাদের শিখিয়েছেন আর পাঁচটা ভুল জিনিস শেখাবার সঙ্গে সঙ্গে। আপনারা সরলচিত্ত ধরেন, আর ভাবেন, ইংরেজ আমাদের ইংরেজি শিখিয়েছে। বিলকুল ভুল। ইংরেজ নিজে শেখে কিংস ইংলিশ, তার অর্থ, তাদের রাজা- উপস্থিত, রানি যে ইংরেজি ব্যবহার করে। আর আমাদের শিখিয়েছে ব্যাবু ইংলিশ বা বাবু ইংলিশ! আসলে প্রবাদটা ম্যান প্রোপোজেস, উম্যান ডিসপোজেস অর্থাৎ পুরুষ প্রস্তাব করে, স্ত্রীলোকে ফৈসালা করে। প্রবাদে ভেজাল কর্ম কিছু নতুন নয়; স্মরণ করুন বেদনিষ্ঠ সদাচারী ব্রাহ্মণসন্তান দ্রোণাচার্য তার শিশুতনয়কে দুধের পরিবর্তে কী দিয়েছিলেন। কিংবা সদাশয় সরকার– থাক গে আবার শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইনে।

শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইনে! হেন বাঙাল আছে কি যে শ্বশুরবাড়ি যেতে চায় না? অসার খলু সংসারে সারং মন্দির দেবভাষায় আপ্তবাক্য। ওই তো করলেন ব্যাকরণে ভুল!

আত্মজীবনী লিখি-লিখছি লিখি-লিখছি করছি এমন সময় এক রমণীর পাল্লায় পড়ে আমাকে কয়েক বছর জেলে কাটাতে হয়।

শুনেছি, জরাসন্ধ নাকি চৌদ্দ বছর আলীপুর জেলে কাটান। তার কয়েক বছর পর একদা বাসে করে এই জেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় তার বালকপুত্র চিৎকার করে সোল্লাসে তাকে শুধোয়, বাবা, ওইবেনে তুমি চোদ্দ বছর ছিলো না?

বাস-সুদ্ধ লোক তার পানে কটমটিয়ে তাকায়। যদ্যপি গাঁটকাটার চোদ্দ বছর জেল হয় না, তবু সবাই অচেতন মনে আপন আপন পকেটে হাত দিয়ে মনিব্যাগ পাকড়ে ধরে। তা ধরুক। কিন্তু বেচারি জরাসন্ধ বাস-সুদ্ধ লোককে বোঝান কী প্রকারে যে, তিনি জেলে চোদ্দ বছর সুপারিনটেনডেনটের কর্ম করেছেন। বুঝুন ঠ্যালাটা! তাই তো ঋষি বলেছেন, দারা পুত্র পরিবার কে তোমার তুমি কার? পুত্র না হয়ে আর কেউ হলে শান্তস্বভাব তিতিষ্ণু জরাসন্ধ বসিয়ে দিতেন নাকে মোক্ষম এক ঘুষি!

না। আমি জেলে যাই, আইনত, খাস জজসাহেবের হুকুমে। সেকথা যথাসময়ে হবে।

জেলে একজন আরবের সঙ্গে আলাপ হয়–আমি পোরট সইদের একটা গোপন নাইটক্লাবে চাকরি করার সময় কিছুটা আরবি শিখে যাই, ওই ভাষায় কটুকাটব্য করতে ততোধিক।

আরবটি বেশ লেখাপড়ি করেছে। তবু যে কেন জেলে এল তার কারণ একটি সরে ফারসি কবিতাতে আছে।

এক বৃদ্ধ বাজিকর তার ছেলেকে বলছে, দ্যাখ ব্যাটা, এই বয়সেই তুই আমার মতো হুনুরির কাছে সব এলেম রপ্ত করে নে। কী করে পাঁচটা বল নিয়ে লুফোলুফি করতে হয়; টুপির ভিতর থেকে জ্যান্ত খরগোশ বের করতে হয়, হাত-পা বেঁধে বাক্সে ভরে সমুদ্রে ফেলে দিলে বেরিয়ে আসতে হয়।

শুনবি না বুড়ো বাপের কথা তা হলে আল্লার কসম, খুদার কিরে কেটে বলছি, তোকে পাঠাব পাঠশালে, তার পর ইস্কুলে, তার পর কলেজে। এম-এ, পি-এইচ-ডি করে বেরোনোর পর যখন দোরে দোরে ভিক্ষে মাগবি, লাথি-ঝাটা খাবি তখন বুঝবি রে, ব্যাটা, তখন বুঝবি, বুড়ো বাপ হক কথা বলেছিল কি না।

আরবের বেলাও বোধহয় তাই হয়েছিল। কলেজের বিদ্যেতে যখন পেট ভরল না তখন শিখতে গেল বড় বিদ্যে-ল্যাটে গেল, ল্যাটে গেল! বুড়ো বয়সে বিয়ে করা আর বড় বিদ্যে শিখতে যাওয়া একই আহাম্মুকী!

পিরসাহেব সেজে আরবিস্থান থেকে সোনা পাচার করতে গিয়ে শ্রীঘর।

সেকথা থাক। তার কাছে কিন্তু একখানা বই ছিল। সেটি পবিত্র কুরান শরিফ বলাতে জেল-কর্তৃপক্ষ সেটিকে তার কাছে হামেহাল রাখবার অনুমতি দিয়েছিলেন।

অতখানি আরবি বিদ্যে আমার নেই যে, স্বচ্ছন্দে কেতাবখানা পড়ি। তাই আরব বাবাজিই আমাকে পড়ে শোনাত। লেখকের নামটা আমার এখনও মনে আছে। এরকম দেড়-গজি নাম ইহসংসারে বিরল বলে সেইটে বহু তকলিফ বরদাস্ত করে মুখস্থ করে নিয়েছিলুম : আবু উসমান আমর ইবন বহুর উল জাহিজ ধানাই-পানাই বাদ দিলে তার বিগলিতাৰ্থ দাঁড়ায় প্রলম্বিত চক্ষুপল্লব বিশিষ্ট এই জাহিজ লিখেছিলেন তার আত্মজীবনী।

এদেশে যে আরব্যরজনী খুবই প্রচলিত সে তথ্য আরব জানত না। আমি সে আরব্যরজনীর কথা বলছিনে যেটি আপনারা কলেজ স্ট্রিটে পান কেটেছেটে সেটিকে করা হয়েছে গঙ্গাজলে ধোওয়া তুলসী পাতাটির মতো পূতপবিত্র। আমি বটতলা সংস্করণের কথা বলছি। অশ্লীলতায় মূল আরব্যরজনী-ওই যে কী বলে, লেডি চ্যাটারলি না কী- তেনাকে ঢিড-দুয়ো দিতে পারে, হেসে-খেলে। পারলে সত্য গোপন করতুম, কিন্তু সুচতুর পাঠক বহু পূর্বেই ধরে ফেলেছেন ওই কারণেই বইখানা আমাকে ছেলেবেলায়ই আকৃষ্ট করেছিল। আহা, ওই যে নিগ্রো ছোকরা গোলাম আর সুন্দরী প্রভুকন্যার কেচ্ছা–না, থাক আবার আলীপুর যেতে চাইনে।

আরব বলছিল, জাহিজ নাকি আরব্যরজনীর খলিফা হারুন-অরু-রশিদের নাতি না কে যেন, সেই খলিফার উজিরের নেক্‌-নজরের আশকারা পেয়ে আপন বউকে পর্যন্ত ডরাতেন না। ব্যস, ওই এক কথাই কাফি। কথায় বলে, বাঘের এক বাচ্চাই ব্যস্।

আত্মজীবনী আরম্ভ করার গোড়াতেই মনে পড়ল, জাহিজ যে অবতরণিকা দিয়ে তার জীবনী আরম্ভ করেছেন সেইটে দিয়ে আমিও আরম্ভ করলে আমারও যাত্রা হবে নিরাপদ

যেমতি মূষিক ভ্রমে সাগরে বন্দরে
নৃপতরী আরোহিয়া—

 এমন সময় খটকা লাগল। জাহিজের কিঞ্চিৎ পরিচয় তো দিতে হয়। নিদেন তার জন্মকাল লীলাভূমি তো বালাতে হয়।

অধমের বাসভবনে যারাই পায়ের ধূলি দিয়েছেন, তারাই জানেন সেখানে আর যা থাক, না-থাক, বই সেখানে একখানাও নেই। শুনেছি এক বিদ্যাসাগর নেটিভ মহারাজা ভাইয়ের সামনে আপন কিম্মৎ বাড়াবার জন্য একটি কলেজ খোলেন। প্রিন্সিপল নিযুক্ত হয়ে দেখেন, কলেজ লাইব্রেরি নামক কোনওকিছু সেখানে নেই। তিনি টাকা চাইতেই মহারাজা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, নিকালো হারামিকো অভি স্টেটসে। লেখাপড়া শিখে আসেনি, এখন বুঝি বই পড়ে কলেজে পড়াবে! আমাকে কি উলু পেয়েছে নাকি?

এর থেকে আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।

অবশ্য নতমস্তকে বার বার স্বীকার করব, একখানা বইয়ের সন্ধানে আমি সংবরণের মতো পত্নীর কামনা করে

–তপতীর আশে
 প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত—

করেছি। কী সে বই ধর্মগ্রন্থ, আয়ুর্বেদ, কামশাস্ত্র –?

এসব কিছু না। একখানা চেক্ বই। সে দুঃখের কথা আর তুলব না।

কিন্তু পুলিশের হুলিয়ার হুড়ো খেয়ে উপস্থিত যেখানে গা-ঢাকা দিয়ে আছি সেই এলাকায় এক অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তি বাস করেন। তদুপরি তিনি অতিশয় অমায়িক। আমি তার কাছে নিবেদন করলুম, স্যার, জাহি নামক আরবি লেখক কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

চট করে একখানা বই টেনে নিলেন। ঠিক ওই ঢপের আরও খান পঁচিশেক ভলুম শেলফে বিরাজ করছিল। বই থেকে পড়ে বললেন, মৃত্যু হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে

আমার কেমন যেন ধোকা লাগল। বললুম, ১৮৬৯; হারুন-রশিদের নাতির অমিলের লোক তিনি এই কথাই ভো শুনেছি।

ঠিকই তো! দেখি, হারুনের নাতি- বলে আরেক ভলুম পাড়লেন যা, অল ওয়াসিক-৮৪২ থেকে ৮৪৭। একটু চিন্তা করে বললেন, অহ্ হে, বুঝেছি। ১৮৬৯-এর প্রথম ১-টা বাদ দিতে হবে! ওয়াসিকের মৃত্যুর পর আরও বাইশ বছর বেঁচেছিলেন আর কি। তা থাকুন আর নাই থাকুন। মোদ্দা কথা, কিন্তু ইনি নবম শতাব্দীর লোক, আর এই পণ্ডিতদের বেদ বলো, কুরান বলল, পরম পূজনীয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বেচারিকে টেনে নিয়ে এলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে! তোবা! তোবা!! নির্জলা পূর্ণ এক হাজার বছরের ডিফরেন্স্।

যেরকম সরলভাবে তিনি আমাকে স্ক্যান্ডালটা বুঝিয়ে বললেন যে মনে হয়, কলকাতার ডিটেকটিভ পর্যন্ত সেখানে থাকলে বুঝে যেত।

জাহিজ অবতরণিকায় বলেছেন, চতুর্দিকে আমার দুশমন আর দুশমন–দুশমনে দুশমনে আবজাব করছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমার মুরুব্বি; কেউ ডরের মারে আমার রাজহাঁসটাকে পর্যন্ত করতে সাহস পায় না। কিন্তু আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, আমার দেহাস্থি গোরস্তানে প্রোথিত আমার পুণ্যশ্লোক পিতৃপুরুষগণের জীর্ণাস্থির সঙ্গে শুভযোগে সম্মিলিত হওয়ার পূর্বেই (মেহেরবান খুদা সে ভমিলন আসন্ন করুন!) আমার দুশমন-গুষ্টি অশেষ তৎপরতার সঙ্গে লিপ্ত হয়ে যাবে আমি এবং আমার ঊর্ধ্বতন তথা অধস্তন চতুর্দশ পুরুষের পুতিগন্ধময় নিন্দাবাদ করতে এবং তার শতকরা ন-সিকে কপোলকল্পিত, আকাশপুরীষ-চয়িত বেহ গুলগঞ্জিকার ঝুটমুট।

যেমন, আমি জানি, আর পাঁচটা নিন্দাবাদের মাঝখানে, অতি কুচতুরতাসহ তারা কীর্তন করবে– আমি নাকি অতিশয় প্রিয়দর্শন সুপুরুষ ছিলুম, সাক্ষাৎ ইউসুফ-পারা হেন দেবদুর্লভ চেহারা নাকি কামনা করেন স্বয়ং বেহস্তের ফেরেস্তারা।

ক্রোধান্ধ হয়ে জাহিজ এস্থলে হুঙ্কার ছাড়ছেন, মিথ্যা, মিথ্যা, সর্বৈব মিথ্যা। আমার প্রতি অন্যায় অবিচার! আমি অভিসম্পাত দিচ্ছি, যে এ অপবাদ রটাবে তার পিতা নির্বংশ হবে। আমি আদৌ সুশ্রী নই। বস্তৃত টেকো মর্কটটার চেহারা পেলে আমি বর্তে যাই। আমার মুখমণ্ডল নামক বদনাদন চেহারার বিভীষিকা দেখে অসংখ্য শিশু ভিরমি গেছে। আমার–

সরল পাঠক! অধম অবগত আছে তুমি জাহিজের এই আত্মকথন শুনে ধন্ধে পড়ে গ্রীবা কয়নে লিপ্ত হয়েছ। তোমার মনে হচ্ছে, এ তো বিচিত্র ব্যাপার! কেউ যদি জাহিকে প্রিয়দর্শন বলে মন্তব্য করে তবে সেটা নিন্দা হতে যাবে কেন, আর যে মন্তব্যটা করেছে সেই-বা দুশমন হতে যাবে কেন? আর জাহিজ্ব যদি কুৎসিতই হন তাতেই-বা কী? তার গোর হয়ে যাওয়ার পর কে আর মিলিয়ে দেখতে পারবে তিনি সুরূপ না কদ্রুপ ছিলেন। কথায় বলে, মড়ার উপর এক মণও মাটি শ মণও মাটি। তবে কি জাহিজ নিরতিশয় সত্যনিষ্ঠ ছিলেন? তার সম্বন্ধে কেউ মিথ্যে বলুক, এটা তিনি সইতে পারতেন না?– তাও সে মিথ্যে প্রিয়ই হোক, আর অপ্রিয়ই হোক।

এসবের উত্তর আমি দেব কী প্রকারে বেলা গড়িয়ে গেল, আর তুমি এখনও বুঝতে পারনি, আমার পেটে সে-এলেম নেই। বিশেষত আমার সেই মুরুব্বি পণ্ডিত যিনি দশটি ভাষায় ত্রিশ-ভলুমি সাইক্লোপিডিয়া নিয়ে কারবার করেন এবং যার বাড়তিপড়তি মাল ভাঙিয়ে আমি হাঁড়ি চড়াই, তিনি গায়েব। তবে শেষ দেখার সময় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে বলেন, রেনেসাঁসের পূর্বেই এই লোকটা লিখল আত্মজীবনী! আশ্চর্য আশ্চর্য! রেনেসাঁসের পুর্বে তো শুধু রাজরাজড়া আর ডাঙর ডাঙর সাধুসন্ত। সাধারণ মানুষেরও যে একটা ব্যক্তিগত অস্তিত্ব আছে সেটা আবিষ্কৃত হল রেনেসাঁসের সময়। সাধারণ লোকের আত্মজীবনী তো প্রথম লেখেন আবেলরাড় দ্বাদশ শতাব্দীতে, তার পর দাতে নবজীবন (ভিটা নুওভা) লেখেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে। আর তোমার ওই জাহিজ না কে লিখে ফেললে নবম শতাব্দীতে? বড়ই বিস্ময়জনক, প্রায় অবিশ্বাস্য।

সরল পাঠক, তোমার কুটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলাম না। তবে একটা ভরসা তোমাকে দিতে পারি। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে- এক্সট্রিম মিট– দুই অন্তিম প্রান্ত একত্র হয়ে যায়। যেমন দেখতে পাবে গ্রাম্য গাড়ল (ভিলেজ ইডিয়ট) দাওয়ায় বসে সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দেয় একটা শুকনো খুঁটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে, আর যোগীশ্রেষ্ঠও তাবৎ দিবসটা কাটিয়ে দেন একাসনে বসে বসে। উভয়েই কর্মস্পৃহা জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। বিদ্যাবুদ্ধিতে আমি এক প্রান্তে, জাহিজ অন্য প্রান্তে উভয়ের সম্মিলন অবশ্যম্ভাবী।

এতএব আমার আত্মজীবনী যদি অবহিতচিত্তে পাঠ কর তবে হয়তো তোমার প্রশ্নগুলোর কিছুটা সদুত্তর পেয়ে যাবে।

জাহিজ তার কেতাব আরম্ভ করেছেন এই বলে যে, তার দুশমনের অভাব নেই। এইখানে তার সঙ্গে আমার হুবহু মিল। বাকিটা সবিস্তার নিবেদন করি। আত্মজীবনী-লেখক মাত্রই আপন বাল্যকাল নিয়ে রচনা আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথও এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। এবং সেই সুবাদে সকলেই আপন আপন বংশ-পরিচয় দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যতটা পারেন, পরিবারের মান-ইজ্জত বাড়িয়েই বলেন। এ নিয়ে বাক্যব্যয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। স্বদেশ, স্বজাতি, মাতৃভাষা নিয়ে অযথা অহেতুক বড়াই করে না, এমন মানুষ বিরল।

আমাকে কিন্তু ক্ষমা করতে হবে। তার কারণ এ নয় যে, আমি হীন পরিবারের লোক। সত্য কারণটা পাঠক একটু ধৈর্য ধরলেই বুঝতে পারবেন।

বস্তুত, পরিবার আমাদের খানদানি। আমাদের পূর্বপুরুষ শাহ আহমদের (শাহ এস্থলে বাদশা নয়- সৈয়দকে মধ্যযুগে শাহ বলা হতো) দরগা এখনও তরপ পরগনাতে আমাদের দ্রাসনে বিরাজিত সেখানে প্রতি বৎসর উস্ হয়। তারই অল্প দূরে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের মাতুলালয়- মাতা শচী দেবীর জন্ম সেখানেই। আমাদের বংশ পিরের বংশ- এরা কিন্তু যজমানগৃহে অন্ন পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। আমার পিতামহ, মাতামহ, আমার অগ্রজদ্বয় সুপণ্ডিত। আমার অগ্রজ প্রায় কুড়ি বৎসর পরিশ্রম করে সম্প্রতি চর্যাপদের একখানি নতুন টীকা রচনা করছেন। আমার কনিষ্ঠা ভগ্নীর ফকিরি, মারিফতি গীত ঢাকা বেতারে শুনতে পাবেন।

কিন্তু থাক, আর না। এ বিষয়টাই আমার কাছে মর্মান্তিক পীড়াদায়ক। কুলমর্যাদার প্রস্তাব উঠলেই আমার পিতা বলতেন, বাপ-ঠাকুর্দার শুকনো হাড় চিবিয়ে কি আর পেট ভরবে? আমিও চিবোইনি। চিবোনো দূরে থাক, আমাদের পিতৃপুরুষ যে গোরস্তানে শুয়ে আছেন তার পাশ দিয়ে যেতে হলে আমি মাথা হেঁট করি।

আমি এই গোষ্ঠীর একমাত্র ব্ল্যাকশিপ- কালা ম্যাড়া!

শব্দার্থে আমার বর্ণ ঘোরতর কৃষ্ণ তো বটেই–বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বর্ণনা আর দেব না। তবে এইটুকুন বলতে পারি পরবর্তীকালে উচ্চ-শিক্ষার অজুহাত দেখিয়ে জন্মদাতা ও শিক্ষাদাতা দুই উরুর কিল-কানমলা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যখন শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নিই তখন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর শ্ৰীযুত রামকিঙ্কর বায়েজ আমাকে দেখামাত্রই সোল্লাসে চিৎকার করে ওঠেন, হুরে হুরুরে। কেল্লা মার দিয়া। কিষ্কিন্ধ্যার মহারাজ সুগ্রীবের বংশধর শ্ৰীযুক্ত আহাদী কুঞ্চিতপদ আমাকে বায়না দিয়েছেন শয়তানের একটি মূর্তি গড়ে দেবার জন্য। মানসসরোবর থেকে কন্যাকুমারী, হিংলাজ থেকে পরাম কুণ্ডু অবধি খুঁজে খুঁজে হয়রান–মডেল আর পাইনে। গুরুদেবের কৃপায় আজ তুই হেথায় এসে গেছিস। আয় ভাই আয়। চ কলাবনে।

ইহুদিদের সদাপ্রভু য়াহভের বেহেশতে শয়তানের প্রবেশ নিষেধ। সেখান থেকে যদি শয়তানের মূর্তি গড়ার ফরমায়েশ আসত সেটাও না হয় বুঝতুম কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যা থেকে। সেখানকার মেয়েমা দুই-ই বুঝি দারুণ খুবসুরত হয়!

পরবর্তীকালে কিষ্কিন্ধ্যা গিয়েছিলাম। দ্রাবিড় অঞ্চলে প্রবাদ আছে, রমণীরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে কামের প্রলোভন থেকে আমাদের রক্ষা কর। তাদের প্রার্থনা পরিপূর্ণ করে ভগবান কিষ্কিন্ধ্যার পুরুষ সৃষ্টি করেন।

কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়ে দেখি, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার। অসিছে রবিবারে যমের পূজা উপলক্ষে অলিম্পিকের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় টাউন হলে একটি টুর্নামেন্ট হবে। যে সবচেয়ে বেশি বিকট মুখ-ভেংচি কাটতে পারবে সে পাবে হাজার টাকার পুরস্কার।

আমি কম্পিট করিনি। নিরীহ দর্শক হিসেবে ছিলম মাত্র। অবশ্য বিকট বিকট গরিল্লাপারা নরদানবরাই এই ভেংচি প্রদর্শনীতে হিস্যে নিয়েছিলেন কার্তিক যতই ভেংচি কাটুন না কেন, তাকে তো আর মর্কটের মতো দেখাবে না!

সে কী ভেংচির বহর। এক-একটা দেখি আর আমার পেটের ভাত চাল হয়ে যায়। আর সে কী দুর্দান্ত নে-টু-নে রে! কোথায় লাগে তার কাছে নিন-হামফ্রের ঘোড়দৌড়!

পালা সাঙ্গ হল। হঠাৎ দেখি তিনজন অজই মল্লদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দর্শকদের গ্যালারি পানে এগিয়ে আসছেন। তার পর ওমা, দেখি, ঠিক আমারই সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার গলায় জবাফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, যদ্যপি আপনি এই কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করেননি তবু আপনাকে প্রথম স্থান না দিলে অবিচার হবে। ভেংচি না কেটেও আপনার মুখে বিধিদত্ত যে ভেংচি সদাই বিরাজ করছে সেটা অনবদ্য, দেব-না, না– যমদুর্লভ। তবে আপনি এই কম্পিটিশনে পার্ট নেননি বলে আইনত টাকাটা দেওয়া যায় না। সেটা যমপূজায় ব্যয় হবে। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ পত্ৰপুষ্পদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণে পৌঁছায়, বিকটের পুজো মাত্রই আপনাকে পৌঁছবে। এ বাবদে শেষ কথা। আমি আজও কেন আইবুড়ো আছি, সেটা বুঝতে কারওরই অসুবিধা হবে না।

পাঠক! এ লেখন প্রধানত তোমার অখণ্ড-সৌভাগ্যবান বংশধরদের জন্য। তারা যদি প্রত্যয় না যায় তবে যেন একবার কলাভবনে সন্ধান নেয়। ওই মূর্তির একটা ফটো তুলে রেখেছিলেন– আশ্চর্য, লেন্সটা কেন চৌচির হল না- ভবিষ্যভ্রষ্টা রামকিঙ্কর। ছবিটা তিনি দেখালেও দেখাতে পারেন। তবে তারা যেন গ্যাসমাস্ক তথা ধুয়ে মাখানো কাঁচ সঙ্গে নিয়ে যায়। মূর্তিটা গায়েব হয়েছে। পুজোরব শিল্পী রদার প্রেতাত্মা সেটি সরিয়েছে।

পাড়ার ভটচার্য মহাশয়ের কাছে শুনেছি, বিয়ের সময় কনে নাকি বরের রূপ কামনা করে (আমার রূপের বর্ণনা দিলুম), বন্ধুবান্ধব বরের উত্তম কুল কামনা করে সেটাও ইল), পিতা সুশিক্ষিত বর চায়– এইবারে আমরা এলুম ইংরেজিতে যাকে বলে ধিক্ অব দ্য ব্যাট বা রণাঙ্গনের কেন্দ্রভূমিতে।

ডাক্তার অবশ্য পরিবারবর্গকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, স্লো বাট স্টেডি উইন্স দ্য রেস- বিলম্বিত চালেই চলুক না, সেই চাল যদি সদা বজায় রাখে তবে সে জিতবে। অর্থাৎ হোক না গদত, সে যদি গর্দভি চাল বজায় রেখে চলে তবে আখেরে ডাবি ঘোড়ার রেস জিতবে।

জীবনের অষ্টম বর্ষাবধি আমি শুধু একটানা ভাত খাব, ভাত খাব বলেছি। একদম স্টেডি সুরে। ডাক্তারের স্তোকবাক্যে আত্মজন পরিতৃপ্ত না হয়ে মেনে নিলেন যে আমি স্লোউইটেড জড়ভরত। অষ্টম বর্ষে (চাণক্যকে ঢিঢ় দিয়ে পঞ্চমে নয়) আমাকে পাঠানো হল পাঠশালে।

হাতেখড়ির প্রথম দিবসান্তে গুরুমশাই যে-শ্লোকটি আবৃত্তি করেন সেটি মমাগ্রজ লিখে নেন :

কাকঃ কৃষ্ণঃ পিকঃ কৃষ্ণঃ কো ভেদঃ পিককাকয়েঃ।
 বসন্তসময়ে প্রাপ্তে কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ ॥

 কাক কোকিল দুই-ই কালো, কিন্তু মাইকেল মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলেন পিকঘর রব নব পল্লব মাঝারে, আর আমার কণ্ঠস্বর শুনেই গুরু বুঝে গেলেন এটা এক্কেবারে জাত দাঁড়কাকের। সবিস্ময়ে দাদাকে শুধোলেন, এটা তোর ভাই।

তার পর তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, কস্মিনকালেও শুনিনি, কাক কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ল! এইবারে একটা ব্যত্যয় দেখলুম– হরি হে, তুমিই সত্য।

এস্থলে তড়িঘড়ি আমি একটি সম্ভাব্য ভ্রম সংশোধন করে রাখি। আমার দাদারা ফর্সা। আর আমি বিটকেল কৃষ্ণবর্ণ। অথচ আমরা একই বর্ণের, অর্থাৎ একই কুলের, অন্তত এই আমার বিশ্বাস ছিল বহুদিন ধরে।

কালের সঙ্গে আমার আরও একটা জবরদস্ত দোস্তি দেখা গেল অচিরাত। আমি নিরবচ্ছিন্ন সেল্ফ পট্রেট আঁকলুম ঝাড়া তিনটি বছর ধরে। অর্থাৎ পাততাড়িতে বছরের পর বছর কাগের ছা বগের ছা লিখে গেলুম।

আমার বিস্ময় লাগে, শিক্ষামন্ত্রী ত্রিগুণা সেনের জন্মনগরী করিমগঞ্জ, আমারও দ্বৎ। তাঁর আমার জন্ম একই বৎসর। আজ তিনি তাবৎ দেশের শিক্ষাদীক্ষা তরণীর কর্ণধার, আর আমি সুর করে একটানা গেয়ে যাচ্ছি–এক বাও মেলে না, দুবাও মেলে না।

আমি যে শিক্ষা-দীক্ষার নিরঙ্কুশ ডডনং হয়ে রইলুম তার জন্য কবিগুরু দেবও খানিকটা দায়ী। অবশ্য তার প্রতি আমার ভক্তি আমৃত্যু অচলা থাকবে। কারণ–

যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়।
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

কবিগুরু বাঙালি তথা ভারতবাসীর সমুখে উত্তম উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন, কিন্তু যে-আদর্শ এলেন আমার দ্বারে/ডাক দিলেন অন্ধকারে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুল্পেখার মতো আমার চিত্তাকাশ উদ্ভাসিত করে দিল সেটি এই :

নেই বা হলেম যেমন তোমার
অম্বিকে গোসাঁই।
আমি তো, মা, চাইনে হতে
পণ্ডিতমশাই।
নাই যদি হই ভালো ছেলে,
কেবল যদি বেড়াই খেলে,
 তুতের ডালে খুঁজে বেড়াই
গুটিপোকার গুটি,
 মুর্খ হয়ে রইব তবে?
 আমার তাতে কীই বা হবে,
 মুর্খু যারা তাদেরি তো
সমস্তখন ছুটি।

 পুনরায় :

যখন গিয়ে পাঠশালাতে
 দাগা বুলোই খাতার পাতে,
গুরুমশাই দুপুরবেলায়
বসে বসে ঢোলে,
 হাঁকিয়ে গাড়ি কোন গাড়োয়ান
মাঠের পথে যায় গেয়ে গান
শুনে আমি পণ করি যে
মুর্খ হব বলে।

আমাকে অবশ্য কোনও উচাটন মন্ত্রোচ্চারণ করে কোনওপ্রকারেই পণ করতে হয়নি। সর্বেশ্বর প্রসাদাৎ ভূমিষ্ঠ হওয়ার লগ্ন থেকেই আমি কর্মমুক্ত। গোড়ায় ভেবেছিলাম, এটা বুঝি জডুত্রে লক্ষণ। পরে শুনি দক্ষিণ ভারতের মহর্ষি ছন্দে গেঁথে বলেছেন, কর্ম কিং পরং। কর্ম তড়ম্ ॥ কর্ম তো স্বতন্ত্র নয়, কর্ম সে তো জড়! তবে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কর্মাতে কমাতে অম্বিকে গোসাঁই হয়ে গিয়ে কোন তুর্কিস্থানের বাখারার আজব মেওয়া আলু-বুখারা লাভ হবে?

অবশ্য নতমস্তকে স্বীকার করব, আমি পাঠশালা পাস করেছিলাম।

শুনেছি, নাৎসি যুগে এমনও চৌকশ স্পাই ছিল যে বিশ গজ দূরের থেকে শুধুমাত্র ঠোঁট নাড়া দেখে দুজনের ফিসফিসিনিতে কী কথাবার্তা হচ্ছে আদ্যন্ত বুঝে যেত এবং পকেটে হাত খুঁজে প্যাডের উপর সেটা আগাপাশতলা শর্টহ্যান্ডে তুলে নিতে পারত। আমি কিন্তু সে লাইনে কাজ করিনি। শ্যেনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকলে আমরা সে ব্যক্তিকে বলি সেয়ানা। আমি সেই দৃষ্টিশক্তির আনুকূল্যে দশ হাত দূরের ব্রিলিয়ান্ট বয়ের পাতা থেকে টুকলি করে তর তর করে পেরিয়ে গেলুম পাঠশালার ভব-নদী।

বুদ্ধিমান জন আপন বুদ্ধির জোরে তরে যায় বলে ভাগ্যবিধাতা মূর্খকে সাহায্য করেন, নইলে তিনিও বিলকুল বেকার হয়ে পড়বেন যে! মৌলা আলীকে শিনি চড়াবে কে, কালীঘাটে মানত মানবে কোন মূর্খ আর বুদ্ধিমান যে করে না, সে তো জানা কথা।

পাঠশালা পাস করার পর করলুম জীবনের চরম মূর্ধমো! কলকাতার বেম্বো-সমাজের বাবু-বিবিরা সে-যুগে পাড়াগাঁয়ে আসতেন আমাদের পেট্রানাইজ করার জন্যে। তাদের চোখে কত না ঢঙ-বেঢঙের রঙ-বেরঙের চশমা। আমারও শখ গেল অপ-টু-ডেট হওয়ার। ভান করতে লাগলুম আমি ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে পাইনে। ডাক্তারকে পর্যন্ত ঘায়েল করলুম– কিংবা সে ছিল ঝটপট দু পয়সা কামাবার তালে।

সেই বেকার চশমা ব্যবহার করে গেল আমার শ্যেনদৃষ্টি। ফল ওত্রালো বিষময়। একই ইস্টিশানে যেমন আগ্রা সিটি, আগ্রা ফোর্ট, আগ্রা জংশন– গাড়ি দাঁড়াতে লাগল তিন তিন বার করে। শ্যেন দৃষ্টি গেছে, টুকলি করতে পারিনি– একই ক্লাসে কাটাই তিন-তিনটি বছর করে।

ইতোমধ্যে কিন্তু আমি দিব্য অকালপকু জ্যেষ্ঠতাতত্ত্ব লাভ করেছি– তারই একটি উদাহরণ দিই। ফেল মেরে দু কান কাটার মতো শহরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি এমন সময় এক গুরুজন, মরালিটি প্রচারে নিরেট পাদরি সাহেব, আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ফেল মেরেছিস? লজ্জাশরম নেই? তোর দাদারা, তোদের বংশ

একগাল হেসে বললুম, কী যে বলেন, স্যার! অ্যামন ফার্স্ট ক্লাস অ্যানসার লিখেছিলুম যে এগজামিনার মুগ্ধ হয়ে খাতায় লিখলে এনকোর এনকোর! তাইতেই তো ফের পরীক্ষা দিচ্ছি!

সম্পর্কে তিনি আমার জ্যাঠা। কিন্তু আমার পকু-নিতম্ব জ্যাঠামো শুনে তিনি থ মেরে গেলেন– আমাদের স্টেট বাস যেরকম আকছারই যত্রতত্র থ মারে বুঝে গেলেন এ পেল্লাদকে ঘায়েল করার মতো পাষাণে, সমুদ্রে নিক্ষেপ পদ্ধতি তাঁর শস্ত্রাগারে নেই। গত যুদ্ধের ফ্লেম থ্রোয়ারের মতো একবার আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, এ ছেলে বাঁচলে হয়!

গুরুজনের আশীর্বাদ কখনও নিষ্ফল হয়! দিব্যপুরুষ্টু পাঁঠাটার মতো ঘোঁত ঘোত করে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি।

মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গেল। হঠাৎ উপলব্ধি করলুম বয়স ষোল। ওদিকে ক্লাস ফাইভের যোগাসন আর পরিবর্তিত হচ্ছে না। দুনিয়ায় যত ডানপিটেমি নষ্টামির মামদো উপযুক্ত পীঠস্থান পেয়ে আমার স্কন্ধে কায়েমি আসন গেড়েছে। আমার তথাকথিত অপকর্মের বয়ান আমি দফে দফে দেব না। তবে এইটুকু বলতে পারি, পরীক্ষার হলে বেঞ্চি-ডেসকো ভাঙা, ট্রামবাস পোড়ানোর কথা শুনলে আমার ঠা ঠা করে উচ্চহাস্য হাসতে ইচ্ছে যায়। আরেকটি কথা বলতে পারি, আজ যে শ্রীহট্ট বার-এর আসামি পক্ষের উকিলরূপে সর্ববিখ্যাত মৌলতি সইফুল আলম খান– তিনি বাল্য বয়সেই কোথায় পেলেন তার প্রথম তালিম? আমার অপকর্ম পদ্ধতি (মডুস অপারেনডি) অপকর্ম গোপন করার কায়দা যে নব-নব রূপে দেখা দিত সেগুলো কি তিনি আমার সহপাঠী কনফিডেন্ট রূপে আগাপাশতলা নিরীক্ষণ করে তারই ফলস্বরূপ আজ উকিল সভায় স্বর্ণাসনে বসেননি!

তবু যদি পেত্যয় না যান তবে তঙ্কালীন আসামের আই.জি, অবসরপ্রাপ্ত শ্ৰীযুত–দত্তকে শুধোবেন। শুটনিক আর কতখানি উঁচুতে গিয়েছিল। তাঁর দফতরে মৎ-বাবৎ যে ফাইল উঁচু হয়েছিল তার সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারে এবং সানন্দে আপনাদের জানাচ্ছি প্রত্যেকটি ফাইলের উপর মোটা লাল উড পেন্সিলে লেখা প্রমাণাভাব প্রমাণাভাব। বেনিফিট অব ডিউটি নামক প্রতিষ্ঠানটি যে মহাজন আবিষ্কার করেছিলেন তাকে বার বার নমস্কার।

কিন্তু দুস্তর সন্তাপের বিষয়, ইহসংসারের হেডমাস্টারকুল এই প্রতিষ্ঠানটিকে যথোচিত সম্মান শ্রদ্ধা করেন না। সে সৎসাহস তাদের নেই। থাকলে আমার সোনার মাতৃভূমি শিক্ষাদীক্ষায় আজ এতখানি পশ্চাৎপদ কেন। আমার নাম দু-দুবার ব্ল্যাক বুক-এ উঠল পর্যাপ্ত প্রমাণাভাব সত্ত্বেও। হেডমাস্টার নাকি মরালি সারটন হয়ে যে কোনও চার-আনি বটতলার মোকতারও বলবে, এটা ঘোর ইলিগালি অনসারটন- আমার নাম কালো কেতাবে তুলেছেন। আরেকটা ঘটনা নাকি তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। এটা যে কীরকম সংবিধান বিরোধী উল্টা ভিরেস (গাড়ল ইংরেজের উচ্চারণে আলট্রা ভাইয়ারিজ বেআইনি স্বেচ্ছাচারিতা, সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে না : হেডমাস্টার তো সেখানে সাক্ষী, তিনি সেখানে বিচারক হন কোন আইনে? এ স্বতঃসিদ্ধটা তো স্কুল-বয় জানে। জানেন না শুধু হেডমাস্টার। তাই বিবেচনা করি, যে স্কুল-বয় এ তত্ত্বটা জানে না সে-ই আখেরে হেডমাস্টার হয়।

তৃতীয়বার কোনও অপকর্ম করলে কালো কেতাবে নাম ওঠে না। তাকে গলাধাক্কা দিয়ে সুর্মা নদীর কালো চোখের সুর্মা কালো) জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সোজা বাংলায় তাকে রাস্টিকেট করে দেওয়া হয়। তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। যদি সেটা শব্দার্থে নেওয়া হয়। রাস্টিকেট শব্দের প্রকৃত অর্থ, গ্রামের ছেলে শহরের স্কুলে এসে গ্রাম্য অভদ্র আচরণ করেছিল বলে তাকে ফের গ্রামে পাঠানো হল, তাকে রাস্টিকিট করে দেওয়া হল, তাকে কাট্রিফাই করে দেওয়া হল। আমি চাঁদপানা মুখ করে সুর্মার ওপারে গ্রামে বাস করে ইস্কুলে আসতে রাজি আছি। বিস্তর ছেলে ওপর থেকে খেয়া পেরিয়ে সরকারি ইস্কুলে পড়তে আসে। আমাদের পাদ্রি সাহেবের কাছে শোনা, লাতিন রুত্তিকারে (গ্রামে বাস করা) শব্দ থেকে রাস্টিকেট কথাটা এসেছে। কিন্তু এসব গুণগর্ভ সুভাষিত শুনে হেডমাস্টার যে আসন ছেড়ে আমি-সত্যকামকে গৌতম ঋষির মতো আলিঙ্গন করবেন এমত আশা তিন লিটার ভাঙ পেটে নামিয়েও করা যায় না। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। এস্থলে ধার্মিকও শুনতে চায় না ধর্মের কাহিনী- নইলে পৃথিবীতে এত গণ্ডায় গণ্ডায় ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম কেন ভট্টচাষ যান মসজিদে ধৰ্মকাহিনী শুনতে এবং বিপরীতটা? হু?

সেসব দিনে না, রাতের আকাশে উত্তমকুমারাদি তারকা আকাশে দীপ্যমান হয়নি। আমার পরবর্তী যুগের সখা দেবকী-পাহাড়ীও তখন অসংখ্য বিমল উজল রতনরাজির মতো খনির তিমির গর্তে। নইলে গাগারিন বেগে চলে যেতুম মোহময়ী মুম্বই বা টলিউডে হেসেখেলে পেয়ে যেতুম যম বা শয়তানের মেন্ রোল।

ভাঙের কথা এইমাত্র বলেছি : তখন স্থির করলুম স্কুলের দরওয়ানজি হনুমান পুজন তেওয়ারি– যিনি কি না পালপরবে ওই বস্তু সেবন করেন এবং সেই সুবাদে আমাকে তথা ফ্রেন্ড স্বদেশ চক্রবর্তীকে ওই বিদ্যায় হাতেখড়ি দেন– তেনাকে ভাঙ খাইয়ে বেহুস করে হেডমাস্টারের ঘরে লাগাব আগুন। গায়ে আগুন লেগে গেঞ্জিটা পুড়ে গেল আর পাঞ্জাবিটা পুড়ল না– এ কখনও হয়! ব্ল্যাক বুক তার মিথ্যা সাক্ষ্যসহ পুড়ে ছাই হবে। সেই ছাই দিয়ে পরব বিজয়-টিকা? ওয়াহু, ওয়াহ্!

ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে–

কিচ্ছুটি করতে হল না। অতি ভৈরব হরষে ওই সময়ে এল অসহযোগ আন্দোলন।

আমারে আর পায় কেডা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *