স্বজন
ঘুষ আর দালালির মধ্যে মূল পার্থক্যটা কোথায়? এক ঝটকায় ভাবলে দালালির টাকা নেওয়াটা কম অপরাধের মনে হয়। তা কি সত্যি? দুটোর মধ্যেই ফাঁকি, অন্যায় কাজকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে। তা হলে কি দালালি নেওয়াটা অন্যায় হয়ে গেল? বঞ্চিত করা হল সরকারকে।- এসব জটিল ভাবনায় নাকি অঙ্কে অফিসের দু’ঘণ্টা কাবার হতে চলল শ্যামলের। অফিসে ঢুকে, নিজের চেয়ারে বসে আধ ঘণ্টার মধ্যেই সে একটা খাম পেয়েছে। এম সি ডি ডিপার্টমেন্টের বড়বাবু নিজে এসে থাবায় লুকানো খামটা টেবিলে রাখলেন, হাতটা ধীরে ধীরে এগিয়ে দিয়ে বললেন, বড় উপকার করলে ঘোষাল। এটা রাখো। এটা কী, কেন, আমি ঠিক… বলতে বলতেই বড়বাবু হাওয়া। তখনও শ্যামলদের পে সেকশানে সে আর অনন্তদা ছাড়া বাকি কেউ আসেনি। খামটা নিয়ে বাথরুমে গিয়েছিল শ্যামল। কড়কড়ে আটটা পাঁচশো টাকার নোট। হিসেব বহির্ভূত পাঁচ টাকাও জীবনে কখনও পায়নি শ্যামল। ছোটবেলায় রাস্তায় পড়ে থাকা কোনও কয়েন কুড়িয়েছে কি না মনে পড়ে না। হঠাৎ চার হাজার টাকা পেয়ে সে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যায়।
কম্পিটেটিভ পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিটা পেয়েছে বছর আড়াই হল। প্রথম যে সেকশানে পোস্টিং হয়েছিল, ঘুষ না নিয়ে কাজ করাই অসম্ভব। সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে গেছে। ডিপার্টমেন্টের সবাই নেয়। ওই সেকশানের ফাইলরা ভীষণ জীবন্ত, ছটফটে। স্টাফেরা ঘুষের ধরন বুঝে একটা পোশাকি নাম দিয়েছে ‘স্পিড মানি’। ওদের যুক্তি হচ্ছে, আমরা তো সরকারের কোনও ক্ষতি করছি না। জনগণকে কুইক সার্ভিস দিচ্ছি। এর জন্য অবশ্যই আমাদের কিছু প্রাপ্য। এই অঙ্কটায় গোড়ায় গলদ আছে। সরকার যে মাইনেটা দেয়, সেটা ধীরে কাজ করার জন্য নয়। দ্বিতীয়ত, মাইনেটা হয় জনগণের টাকাতেই। আবার তাদের থেকে টাকা নিয়ে কাজ দ্রুত করে দেওয়া মানে সরাসরি প্রতারণা।
বড়কর্তাদের ধরেকরে তিন মাসের মধ্যে পে-সেকশানে চলে এসেছিল শ্যামল। এত তাড়াতাড়ি ডিপার্টমেন্ট বদলানো সহজ কথা নয়। হয়েছিল একটা কারণেই, পে-সেকশানে ঘুষটুষ নেই। একদম ড্রাই টেবল। শুধুমাত্র তারাই এই ডিপার্টমেন্ট বেছে নেয়, অফিস ছাড়াও যাদের বাইরের একটা জগৎ আছে। নানান কর্মকাণ্ডে সেখানে যুক্ত তারা। সাধারণত সংস্কৃতিকর্মীরাই এই সেকশানটায় থাকতে চায়। মাসে দশদিন মোটামুটি কাজ থাকে। বাকি দিনগুলোয় ইচ্ছেমতো অফিসে ঢোকা, বেরোনো করা যায়।
শ্যামল সেভাবে কোনও কর্মকাণ্ডে যুক্ত নয়। সে শুধু চোখ ভরে কলকাতাটাকে দেখে। ভাল থিয়েটার সিনেমার খবর পেলেই বউ নিয়ে দেখতে যায়। তা ছাড়া কলকাতায় হরেক
রকমের মেলা তো লেগেই আছে। ইদানীং শ্যামল আর মীনা অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের এগজিবিশনগুলোর নিয়মিত দর্শক। দু’জনেই মানুষ হয়েছে গ্রামে। কলকাতা চিরকাল সম্ভ্রম আদায় করেছে দু’জনের কাছে। আজ সেখানে বসবাস করে কলকাতাটাকে দেখাই তাদের একটা বিরাট কাজ। তবে শ্যামল সর্বদাই প্রস্তুত থাকে মহৎ কোনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে শ্যামল সোজা গিয়েছিল এম সি ডি-র বড়বাবু পার্থ ঘোষের টেবিলে। মুঠোয় রাখা টাকাটা এগিয়ে দিয়ে বলে, না স্যার, এটা আমি কিছুতেই নিতে পারব না। ছোট ভাইয়ের মতো সামান্য একটা কাজ করে দিয়েছি বলে, এতগুলো টাকা…
মুঠোটা হাত দিয়ে সরিয়ে বড়বাবু বললেন, দাদা এত লাভ করল, ইচ্ছে করে না ছোট ভাইকে কিছু দিতে? এটা তো ঘুষ নয় রে বাবা। তুমি এরকম ইতস্তত করছ কেন! তোমার বউদির সঙ্গে কথা বলেই ওটা আমি দিয়েছি। কোনও জিনিসই হয়তো কিনে দিতাম। ভাবলাম, সেটা যদি তোমার দরকারে না লাগে। তার থেকে যেমন ইচ্ছে যায় ওই দিয়ে কিনে নিয়ো। বউমাকে ছোটখাটো গয়না গড়িয়ে দিতে পারো। গিন্নিরা এর থেকে খুশি আর কিছুতে হয় না। আর হ্যাঁ, আমার বউ তোমাদের দু’জনকে একদিন খাওয়াতে চেয়েছে। সামনের কোনও একটা সানডে ফ্রি রেখো।
একপ্রকার বাধ্য হয়ে শ্যামল টাকাসুদ্ধু নিজের সিটে ফিরেছিল। বড়বাবুর জন্য সে যা করেছে, উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। সামান্য বুদ্ধি আর একটু যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াতে ব্যাপারটা উতরে গেছে। মার্চ মাসের একদিন কপালে হাত দিয়ে শ্যামলের টেবিলে এসে বসেছিলেন বড়বাবু। ভীষণ আক্ষেপের সুরে বললেন, বছর বছর যদি এত ট্যাক্স দিতে হয়, তা হলে এই অসম্ভব পরিশ্রম, টেনশান, উঁচু পদের গুরুদায়িত্ব বয়ে কী লাভ বলো শ্যামল! একটা পয়সা জমাতে পারছি না। অথচ বাজারের মাছওলা নিতাই বিকেলবেলা মারুতি ভ্যানে চেপে হাওয়া খেতে বেরোয়।
রসিকতায় সংগত করে হেসেছিল শ্যামল। তারপরই একটা ফিকির বাতলে ছিল, আচ্ছা স্যার, আপনি তো অফিস থেকে ‘হাউস বিল্ডিং’ লোন নেননি, না? ওটা নিলে কিন্তু আপনার অনেক ট্যাক্স সেভ হত।
ধুর, বাড়ি করে কী করব। আমাদের যে বিশাল শরিকি বাড়ি। নিজের পজেশন ছেড়ে দিলেই সম্পত্তি গোল হয়ে যাবে।
উত্তরে শ্যামল বলেছিল, তা হলে এক কাজ করুন, যে-কোনও একটা ফ্ল্যাট কিনে তালা মেরে রেখে দিন। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
কী লাভ হবে তাতে, সেই তো মাসে মাসে একগাদা টাকা কাটা যাবে স্যালারি থেকে। বড়বাবুর হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে শ্যামলের মনে পড়েছিল ওদের হাউসিং-এর অনুপম মাস্টারমশাইয়ের কথা। ক’দিন আগেই বলছিলেন, স্টুডেন্ট বেড়ে যাচ্ছে, এইটুকু ফ্ল্যাটে জায়গা দিতে পারি না। প্রোমোটারকে বললাম, এখনও তো চারটে ফ্ল্যাট বিক্রি হল না, দিন না একটা ভাড়া সিস্টেমে। ওখানে টিউশান পড়াই। রাজি হল না। বলল, ফ্ল্যাটটা সেকেন্ডহ্যান্ড হয়ে যাবে। দাম পাব না। অনুপম স্যারের প্রস্তাবটাই একটু অন্য অ্যাঙ্গেলে
ফেলে বড়বাবুর সামনে রেখেছিল শ্যামল। সবিস্তার জানিয়ে বলল, ফ্ল্যাটটা আপনি কিনে মাস্টারমশাইকে ভাড়া দিন। ভাড়ার বিলও দিতে হবে না। প্রয়োজনমতো তাঁকে উঠে যেতে বলতে পারবেন। সকাল, বিকেল মিলিয়ে ঘণ্টা ছয়েক ইউজ হবে ফ্ল্যাট। ডেপ্রিসিয়েশন কম হবে।
উপায় শুনে বড়বাবুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। শ্যামলের দু’হাত ধরে বলেছিলেন, তুমি ভাই লোন বার করা থেকে টোটাল কাজটা যদি করে দাও বড় উপকার হয়। বাপঠাকুরদার ছায়ায় মানুষ হয়েছি, বিষয়বুদ্ধি আমার চিরকালই কম।
কাজটা এমন কিছু কষ্টসাধ্য নয়। এরজন্য আলাদা কোনও পরিশ্রম করতে হয়নি শ্যামলকে। অনুপম স্যারের চাওয়া, বড়বাবুর পাওয়াটা ঘটিয়ে দিয়েছে। পরিচিত দু’জনকে সাহায্য করাই ছিল তার একমাত্র অভিপ্রায়। বদলে চার হাজার টাকা।
এ টাকা আকাশ থেকে পড়েনি। সরকার হিসেব কষে, গুনে-গেঁথে বাজারে ছেড়েছে। তার মানে কোথাও কেউ বঞ্চিত হচ্ছে অবশ্যই। কার বা কাদের টাকা এটা?
অথচ গোটা ঘটনার মধ্যে বেআইনি কিছু নেই। শ্যামল যদি টাকাটা ইচ্ছেমতো খরচ করে কারও কিছু বলার থাকবে না। শুধু হিসেবে একটা গোঁজামিল থেকে যাবে। ম্যাথের ভাল স্টুডেন্ট হওয়ার সুবাদে ব্যাপারটা কিছুতেই মনপসন্দ হচ্ছে না শ্যামলের। তার চাকরিতে এত কঠিন অঙ্কের মুখোমুখি কখনও হতে হয় না। যেমন, কম্পিটেটিভ পরীক্ষায় বসার আগে পড়া, ব্যাসাল্ট শিলার প্রধান উপাদান কোনও দরকার লাগে না তার কাজে। বিশ্ব দারিদ্র্য দিবস অথবা মিউটেশন তত্ত্বের প্রবক্তার নামটা ভুলে যাওয়াতে চাকরি টিকিয়ে রাখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আজ এক বিচিত্র, জটিল অঙ্ক তার সামনে।
ছাত্রাবস্থায় যখনই পড়াশোনা সংক্রান্ত কোনও কঠিন বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে ক্ষণিকের জন্য মন সরিয়ে নেওয়া শিখেছিল শ্যামল। এই মুহূর্তে সেই পদ্ধতি নিল। ফাইল খুলে কাজে ডুবে যেতে যেতে ভাবে, আচ্ছা, টাকাটা হজম করে নিতে আমার অসুবিধেটা ঠিক কোথায়? ভাবনা একটু এগোতেই একাধিক সমস্যা মাথায় আসতে থাকে। যেমন, মীনাকে যদি সত্যিই আজ একটা গয়না কিনে দেয়, ও জানতে চাইবে, টাকা কোথায় পেলে? কী উত্তর দেবে শ্যামল? ‘দালালি করে পেয়েছি’ বললে, ভীষণ ছোট হয়ে যাবে মীনার কাছে। সেক্ষেত্রে যদি মিথ্যে করে বলে, অমুক এরিয়ারের টাকা অথবা অন্য কোনও অফিশিয়াল সোর্স… বিশ্বাস করানো যাবে না মীনাকে। সে বোকা বা লোভী কোনওটাই নয়। হঠাৎ প্রাপ্তিতে কপালে তার ভাঁজ পড়বেই। সামান্য সরকারি কর্মচারীর আচমকা এত ক’টা টাকা পাওয়া যে বেশ অবাস্তব এবং সন্দেহজনক সাধারণ বুদ্ধির মানুষও সেটা আন্দাজ করতে পারে।
অন্য একটা রাস্তা আছে, শ্যামল যদি একা একাই পুরো টাকাটা নিজের জন্য খরচ করে, ধরা যাক, এবার থেকে টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরবে রোজ। দামি ভাল ভাল খাবার খাবে হোটেলে বসে… দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠতেই কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। অভ্যেস খারাপ হয়ে যাওয়ারও একটা সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। আসল ব্যাপার
কী, বিনা পরিশ্রমের টাকা সবাই ঠিক হজম করতে পারে না। এই যেমন, ট্যাক্সির কথা মাথায় আসতেই শ্যামলের মনে পড়ে গেছে চাকরি পেয়ে প্রথম বাড়ি যাওয়ার দিনটার স্মৃতি, কলকাতার বাস লোহার পোল অবধি এসে বাঁদিকের বড় রাস্তা ধরে কোতুলপুরের দিকে চলে যায়। বাড়ি ফেরার ওটাই লাস্ট স্টপ। লোহার পোল থেকে শ্যামলদের পাড়া পায়ে হেঁটে আধঘণ্টা মতো৷ স্টপেজে গোটা চার-পাঁচেক ভ্যানরিকশা থাকলেও পাড়ার সবাই পথটুকু হেঁটেই মেরে দেয়। আরও দূরের যাত্রীরা শেয়ারে রিকশা চাপে।
সেদিন কী মনে হতে, বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠেছিল শ্যামল। রিকশাওলা চেনা লোক। আর কোনও প্যাসেঞ্জার পায়নি। বলল, চলো তোমায় একাই পৌঁছে দি। টাকা পাঁচেক দিয়ো’খন।
না করেনি শ্যামল। রিকশা চলেছে হু হু করে। পাড়ার অনেকের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, কেউ বা হাত নাড়ছে, রিকশা থামিয়ে কুশল নিচ্ছে দু’-একজন। শ্যামল তাদের পাড়ার গর্ব। একমাত্র সে-ই সরকারি চাকরি পেয়ে কলকাতায় থাকতে শুরু করেছে। রিকশা যখন বটতলা পার করেছে, হঠাৎ চোখে পড়ে রাস্তার পাশে হেঁটে যাচ্ছেন বাবা। খালি গা, পরনে ধুতি, কাঁধে বিশাল একটা থলে। রিকশাকে থামতে বলার আগেই বাবাকে ক্রস করে গেল শ্যামল। থলের ভারে ঘাড় বেঁকে গেছে বাবার। আড়চোখে দেখলেন শ্যামলকে। তড়িঘড়ি রিকশা থামায় শ্যামল। রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে আসে। বাবাকে প্রণাম করে বলে, চলুন রিকশায় যাই।
নাঃ, তুমি যেমন যাচ্ছ যাও। বাসে এতটা পথ জার্নি করে এয়চ, টায়ার্ড লাগতেই পারে।
ক্যাবলা হেসে শ্যামল বলেছিল, না না টায়ার্ড নয়। এমনিই আসছিলাম, রিকশাওলা ধরল। একটু থেমে শ্যামল বলে, থলেটা রিকশায় রাখুন। ও পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমরা বরং হেঁটেই যাই।
উত্তরে বাবা বলেছিলেন, না থাক। আমার অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে।
বাবার সেই প্রত্যাখ্যান আজও ভোলেনি শ্যামল। বাবার থলেতে ছিল শ্যামলদের জমির পাকা কলা। সেদিন বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো দিয়েছিলেন। আট বিঘে জমির পিছনে উদয়াস্ত পড়ে থেকে বড় ছেলেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, এটা তাঁর কাছে বিরাট সার্থকতা। রিকশায় চাপা নিয়ে সারাদিনে একবারও মৃদু ভর্ৎসনা করেননি। রাতে খেতে বসে প্রসঙ্গটা ঘুরে এল অন্যভাবে। বাবা জানালেন, পুজো চলাকালীন অভয়স্যার নাকি তাঁকে আলাদা ডেকে নিয়ে মেয়ে মীনাকে পুত্রবধূ করার অনুরোধ জানান। এ ব্যাপারে শ্যামলের মতামত জানতে চাইলেন বাবা। শ্যামল কোনও কথা না বলে খেয়ে যাচ্ছিল। মা-ও দু’-একবার খোঁচাল, বল না, তোর কী মত?
না করার প্রশ্নই ওঠে না। পাশের পাড়ার অভয়স্যারের বাড়িটাকে গোটা গ্রামের লোক সমীহ করে চলে। ওঁর বড় মেয়ে মীনা বেশ সুন্দরী, কিন্তু বড্ড বেশি পার্সোনালিটি। মীনাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া শ্যামলের কষ্ট-কল্পনাতেও ছিল না। শ্যামলের নীরবতার ভাষা বুঝে নিয়ে বাবা বলে যাচ্ছিলেন, মেয়েটাকে আমার বরাবর খুব পছন্দ। একটুও অহংকার নেই।
বাপের যথেষ্ট পয়সা থাকতেও চার মাইল রাস্তা সাইকেল ঠেঙিয়ে রোজ কলেজ যায়। কখনও বাসে বা রিকশায় যেতে দেখিনি।
রিকশার প্রসঙ্গটা আবার এসে পড়াতে লজ্জায় অধোবদন হয়েছিল শ্যামল। তারপর দিন দেখে যথাসময়ে গুরুজনদের উদ্যোগে, ব্যবস্থাপনায় বিয়েটা হয়ে যায়। শ্যামল যেদিন মীনাকে নিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসছে, বাবা এক ফাঁকে শ্যামলকে ডেকে বললেন, দেখিস বাবা, শহরে গিয়ে মেয়েটার যেন গ্রামের স্বভাবগুণগুলো নষ্ট না হয়ে যায়।
বাবার আশঙ্কা অমূলক ছিল। শ্যামলকে কিছুই লক্ষ রাখতে হয়নি। মীনা আদ্যন্ত গ্রামের স্বভাবই বজায় রেখেছে। বাড়তি কোনও চাহিদা নেই। খরচ আর অপচয়ের তফাত সহজেই করতে পারে। তাই তো এই চার হাজার টাকাকে বৈধতা দিতে কোনও মিথ্যেই ওর কাছে খাড়া করা যাবে না।
তা হলে কী গতি হবে টাকাগুলোর? কেন জানি টাকাগুলোকে এখন যেন বেওয়ারিশ লাশ বলেই মনে হচ্ছে, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শ্যামলের কাঁধে।
ডিপার্টমেন্ট গমগম করছে এখন। একমাত্র শ্যামলই ফাইল খুলে থম মেরে বসে আছে। ইতিমধ্যে দু’-একজন সহকর্মী এসে জিজ্ঞেস করে গেছে, কী হল ঘোষাল, এত চুপচাপ! রায়দা এসে বললেন, নিশ্চয়ই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। ভীষণ কমন মধ্যবিত্তের আন্দাজ। যেন ঝগড়া করার একমাত্র উপযুক্ত পাত্রী হচ্ছে বউ। শ্যামল ভাবে, আচ্ছা, আমার প্রবলেমে পড়লে সহকর্মীরা কী করত? জিজ্ঞেস করবে একবার? দরকার নেই বাবা, এক্ষুনি নানান ঠাট্টা-তামাশা শুরু করবে। এদের কাছে এই টাকাটা খরচ করা কোনও ব্যাপারই না, ভোগের ব্যাপারে সবাই সিদ্ধপুরুষ। এরা অফিসে এসে প্রতিদিন নিয়ম করে স্ত্রীদের খাঁকতির বর্ণনা করে।
ওদের কথা শুনে আন্দাজ করা যায়, এই টাকা ওরা বাড়ি নিয়ে গেলে স্ত্রী আহ্লাদিতই হবে। একই সঙ্গে শ্যামলের মনে হয়, এতটা জেনারেলাইজ করা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এমন হতে পারে, আমোদপ্রিয়তা মানুষগুলোর বাহ্যিক রূপ। টাকাটা হঠাৎ পেয়ে গেলে, এরাও একটু থমকাবে। দু’-একজন দান-ধ্যানের কথাও ভাবতে পারে। এরকম না হলে জগৎটাই অচল হয়ে যেত।
‘দান’-এর ব্যাপারটা মাথায় আসতেই খেয়াল হয় বিল সেকশানের সরকারদার কথা। গোটা অফিসে মানুষটা একমাত্র ব্যতিক্রম। বিল সেকশানে প্রচুর টাকা পড়ে। কন্ট্রাক্টারদের বিল পাশ হয়। সরকারদা শ্যামলের মতো সেকশান না বদলে টেবিলে এক সেবাসংস্থার কৌটো বসিয়ে দিয়েছেন। পার্টিরা ‘স্পিডমানি’ ওটাতেই ফেলে। সেবাপ্রতিষ্ঠানের সদস্যরা মাসে একবার এসে কৌটো বদল করে দিয়ে যায়।—ভাবনার মাঝে বিদ্যুচ্চমকের মতো শ্যামলের মনে হয়, তাই তো, সরকারদার কৌটোতে টাকাটা ফেলে দিয়ে আসাটাই ন্যায্য কাজ হবে। পরক্ষণেই মত বদলায় শ্যামল, ওখানে গিয়ে টাকা ফেললেই সরকারদার পাশের টেবিলের স্টাফেরা ফুট কাটতে পারে, কী হে ব্রাদার, তোমাদের সেকশানেও আজকাল গুঁড়ো পড়ছে। অযথা একটা কৌতূহল তৈরি হবে ওদের মনে। তার থেকে বরং ‘দান’
ব্যাপারটা অফিসের বাইরে গিয়ে সেরে নেবে শ্যামল। কলকাতায় দান করার জায়গার অভাব হবে না।
মোটামুটি একটা সমাধান পেয়ে এবার আর কাজে মন দিতে অসুবিধে হয় না শ্যামলের। অফিসের ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়। ডিপার্টমেন্টে কত লোকজন আসে, কিছুক্ষণ অন্তর ফোন বেজে ওঠে। একটা এস টি ডি রিং-এর পর সুনীলদা চেঁচায়, ঘোষাল তোমার ফোন। ফোনসেট সুনীলদার টেবিলে থাকে, চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় শ্যামল। এস টি ডি রিং যখন, নিশ্চয়ই দেশের বাড়ি থেকে এসেছে।
রিসিভার কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ও প্রান্তে মায়ের গলা ভেসে ওঠে, হ্যাঁরে, তোরা আছিস কেমন? কোনও খবর নেই দু’হপ্তা হল।
ভাল। তুমি আবার ফোন করতে এলে কেন? বলে শ্যামল। দেশের বাড়িতে ফোন নেই। বুথে ফোন করতে লোহার পোলে আসতে হয়। ও প্রান্তে মা এবার আসল উদ্দেশ্য বলে, ছোটমামাকে দেখে এসেছিস?
ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে শ্যামল, এই রে, মামাকে তো দেখে আসা হয়নি। দিন কুড়ি আগে মা ফোন করে বলেছিল, খবর পেয়েছি, জন্ডিস বাধিয়ে তোর ছোটমামা পি জি হাসপাতালে ভরতি হয়েছে। একবার গিয়ে দেখে আসিস। জানিসই তো ওদের দেখার মতো কেউ নেই… ওয়ার্ড আর বেডনাম্বার দুটোই দিয়েছিল মা। চিরকুটে লিখে সেই যে পকেটে পুরেছে শ্যামল, পরে আর একদম খেয়াল হয়নি। আসলে মামাদের সঙ্গে রিলেশান অনেক আগেই ঢিলেঢালা হয়ে গেছে, কিন্তু মা কী করে ভোলে আপন ভাইদের।
শ্যামলকে চুপ থাকতে শুনে অপর প্রান্তে মা আবার বলে, কী রে, কিছু বলছিস না যে, কোনও খারাপ খবর নেই তো?
কথার শেষে মায়ের গলাটা একটু কেঁপে যায়। সামাল দিতে শ্যামল বলে ওঠে, না না, খারাপ কিছু নয়। হাসপাতাল থেকে কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছে, আজ সব রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
কথার পিঠে মা বলে ওঠে, যা না বাবা আজকে একবার।
হ্যাঁ, ঠিকই করেছিলাম যাব। তোমরা সব ভাল আছ তো?
আছি একপ্রকার। দুলিগাইটা আবার একটা এঁড়ে বিইয়েছে। তোর বাবা এখন ওসব নিয়েই মত্ত, বয়স হচ্ছে, গেরাহ্যিই করে না। তোরা আসছিস কবে? যাব। সামনে একটা ছুটি দেখে।
আমি আবার পরশু ফোন করব। মামার সব খবর নিয়ে আমাকে জানাস। আচ্ছা।
রিসিভার নামিয়ে রাখার পর শ্যামল ঠিক করে, ছুটির এক ঘণ্টা আগে অফিস থেকে বেরিয়ে অবশ্যই একবার ছোটমামাকে দেখে আসবে। অফিসে এসে থেকে দালালির টাকা নিয়ে কত দার্শনিক ভাবনা ভেবেছে, অথচ নিজের রক্তের সম্পর্কের মামা কুড়ি দিন ধরে হাসপাতালে শুয়ে আছে, একবারও দেখতে যেতে পারেনি।
অফিস থেকে বেরিয়ে বাসে চাপে শ্যামল। এসপ্ল্যানেডে আসতেই বুকপকেটে রাখা চার হাজার টাকা যেন প্রাণ ফিরে পায়। নিভে আসা বিকেলে চোখে পড়ে হলুদ আলোর ঝকঝকে দোকান। কত সব শাড়ি, গয়না, প্রসাধন… জিনিসগুলো যেন লাস্যময়ী যুবতীর মতো টানে শ্যামলকে। বাঁধা বাজেটের বাইরে গিয়ে এর মধ্যে কোনও একটা অনায়াসে কিনতে পারে আজ। কাউকে ঠকানো হবে না। শুধুমাত্র হিসেবে একটু গোলমাল থেকে যাবে, এই যা।
প্রায় জোর করেই চোখ সরিয়ে নেয় শ্যামল। টাকাটা দান না করা অবধি তার শান্তি নেই। ছোটমামার পরিস্থিতি বুঝে সেখানেও কিছু দেওয়া যেতে পারে। যদিও সেটা ঠিক হবে না। নিজের উপার্জনের টাকাই মামাকে দেওয়া উচিত। অন্য একটা সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে, ছোটমামা হয়তো টাকা নিতে রাজি না-ও হতে পারে। কারণ, মামার বাড়ির সঙ্গে বহুদিন হল কোনও সম্পর্ক নেই শ্যামলদের। বাবার সঙ্গে বৈষয়িক একটা ব্যাপারে ঝামেলা হয়েছিল দাদুর। তারপর থেকে যাতায়াত, মুখ দেখাদেখি সব বন্ধ। মা অবশ্য লুকিয়ে সব খবরাখবর রাখে। মামার বাড়ির স্মৃতি খুবই কম শ্যামলের। ওর যখন ক্লাস সিক্স তখনই ঝগড়াটা হয়। তারপরও ছোটমামা খিড়কির দরজা দিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসত। রান্নাঘরে বসে চাপা স্বরে কথা বলত ভাই আর দিদি। মা একের পর এক লুচি ভেজে মামাকে খাওয়াত। অবশ্যই বাবা তখন চাষের জমিতে।
মামার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মা কিছুক্ষণ অন্তর শ্যামলকে সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে বলত, দেখতে হবে বাবা আসছেন কি না। বাবা ফেরার আগেই নিঃশব্দে কেটে পড়ত ছোটমামা।
সেই নিরীহ, ত্রস্ত ছোটমামা আজ হাসপাতালে। মাঝে অনেক বছর কেটে গেছে। দাদু, দিদা বেঁচে নেই শ্যামলের। জয়রামবাটিতে মামার বাড়ির কী দশা জানে না শ্যামল। মায়ের মুখে শুনেছে এখন আর বাড়িতে কেউ থাকে না। বড় দুই মামা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। দু’জনেই থাকে বর্ধমানে। ছোটমামার আর্থিক অবস্থা বেশ নড়বড়ে। কোনও এক বিল্ডিং প্রোমোটারের কাজ দেখাশোনা করে কলকাতায়। মামার দুই মেয়ে, এক ছেলে। কাউকেই দেখেনি শ্যামল। ছোটমামার বিয়েতে যায়নি, মামিকেও চেনেনি। মামা কি তাকে চিনতে পারবে?
দাদা, আপনার পি জি আসছে।
কন্ডাক্টারের ডাকে বাসের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় শ্যামল। ‘আপনার পিজি’ কথাটা কানে কেমন যেন বিঁধে থাকে। পি জি হাসপাতালটা আমার? এত রোগ ভোগ, মৃত্যু, জন্ম অবিরত ঘটে চলেছে এখানে, কই, কোনওদিন তো আসিনি দেখতে। এটাও তো কলকাতার মধ্যেই পড়ে।
হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ঢুকে এনকোয়ারিতে যায় শ্যামল। কাউন্টারে এক মধ্যবয়স্কা বসে আছেন। শ্যামল জানতে চায় ম্যাকেঞ্জি ওয়ার্ডটা কোথায়?
ভদ্রমহিলা আঙুল তুলে উলটোদিকে লাল বাড়িটা দেখিয়ে দেন। বাড়িটার দিকে যেতে যেতে শ্যামল দেখে, মাঠে কাগজ পেতে বসে আছে রোগীর আত্মীয় পরিজন। কেউ
আবার চাদর পেতে শুয়েও পড়েছে। উৎকণ্ঠা সয়ে গিয়ে এদের মুখে এখন অদ্ভুত নিরাসক্ত অভিব্যক্তি। বেশ কিছু লোকের চেহারা, পোটলাপুটুলি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুর-দূরান্ত থেকে এসেছে। হাসপাতালের চত্বরটা যেন ভিন্ন একটা জগৎ। বাইরের চলমান জীবনের সঙ্গে কোনও মিল নেই।
লালবাড়ির গেটে দু’জন গার্ড। ভিজিটাররা গেট পাস দেখিয়ে ঢুকছে। ভিজিটিং আওয়ার্স নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না শ্যামলের। সব হাসপাতাল, নার্সিংহোমে বিকেলের দিকে লম্বা ভিজিটিং টাইম থাকে। কিন্তু পাস পাবে কোথায়? এই টেকনিকাল সমস্যাটা তো মাথাতেই ছিল না। মামাকে দেখতে আসতে পারে এমন কাউকে চেনে না শ্যামল। গেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ কঠোর মালুম হচ্ছে। একটা বছর পঁচিশেকের ছেলের সঙ্গে তর্কাতর্কি হচ্ছে টাফ চেহারার গার্ডের। পাস ছাড়া ঢুকতে চাইছে ছেলেটা। ভিজিটিং আওয়ার্স ছ’টায় শেষ। হাতে মিনিট চল্লিশেক বাকি।
আশা ছেড়েই দেয় শ্যামল। এ যাত্রায় আর ছোটমামাকে দেখা হবে না। আবার কাল আসতে হবে।
বলুন দাদা, আপনার কী দরকার?
ইয়াং ছেলেটাকে উপেক্ষা করে টাফ চেহারার গার্ড প্রশ্নটা করে শ্যামলকে। সচকিত হয়ে শ্যামল বলে, আমার এক রিলেটিভ ভরতি আছেন এখানে। গ্রাম থেকে এসে সোজা অ্যাডমিট হয়েছেন। খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছি। এদিকে পাস নেই। ওদের কারও সঙ্গে…
শ্যামলকে কথা শেষ করতে না দিয়ে গার্ড উদার কণ্ঠে বলে, যান, ভেতরে যান। বেশি টাইম নেই, তাড়াতাড়ি করবেন।
শ্যামল চট করে গেট পার হয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শোনে ইয়াং ছেলেটা গার্ডকে বলছে, ওঁকে কেন ছাড়লেন। ওঁরও তো পাস নেই।
বেশ করেছি, ছেড়েছি। তোমাকে ছাড়ব না। বহুত টেন্ডাই-মেন্ডাই করছ। এবার পুলিশ ডাকব। শ্যামল বোঝে, এখানেও ইগো ক্ল্যাশ। একতলায় উঠে শ্যামল একজন নির্ভরযোগ্য চেহারার ভিজিটারকে জিজ্ঞেস করে, ম্যাকেঞ্জি ওয়ার্ডটা কোথায়? সে ওপরতলা দেখিয়ে দেয়। আবার সিঁড়ি ভাঙা। সেখানে গিয়ে দেখে লোকটা ভুল বলেছে, এটা এলেক্স। এখানকার একজন বলে, আর একতলা উঠতে হবে শ্যামলকে। সেই তথ্যও ভুল। ভিক্টোরিয়া ওয়ার্ডে পৌঁছে গেছে শ্যামল। এবার হসপিটালের এক ব্যস্তসমস্ত স্টাফকে ধরে। সে বলে, আপনি খামোকা ওপরে উঠে এসেছেন। ম্যাকেঞ্জি একদম নীচের তলায়। এইভাবে ওপর নীচ করে, পরাধীন ভারতের অনেক সাহেব-মেম-এর স্মৃতি ছুঁয়ে ঘর্মাক্ত শ্যামল যখন সত্যিই ম্যাকেঞ্জিতে পৌঁছোয়, ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হতে পনেরো মিনিট বাকি।
বিশাল হলঘর। প্রচুর বেড। মাত্র দু’জন রোগীকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। মা বলেছিল, বেড নাম্বার তিন। এক কোথা থেকে শুরু হয়েছে কে জানে! হাতে সময় বেশি নেই। সামনে দিয়ে এক সিস্টারকে যেতে দেখে শ্যামল বেড নাম্বার থ্রি-র হদিশ চায়। হাত তুলে দেখিয়ে দেয় সিস্টার।
বেডের সামনে গিয়ে শ্যামল দেখে, ছোটমামা আধশোয়া হয়ে পাশের বেডের পেশেন্টের সঙ্গে গল্প করছে। দেওয়াল থেকে ধরলে পাশের বেডের নম্বর চার। মামার হাতে স্যালাইন চলছে। চার নম্বর বেডের পেশেন্ট মোটামুটি সুস্থ। মামার দিকে ফিরে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছে।
শ্যামলের উপস্থিতি লক্ষ করে ওই লোকটাই। মামাকে কিছুটা ইশারায়, বাকিটা অস্ফুটে বলে, আপনার কেউ এসেছেন।
ছোটমামা ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফেরায়। চোখ দুটো সরষেখেতের মতো হলুদ। ভীষণ অচেনা লাগে মামাকে। মামাও চিনতে পারছে না। দু’জনের মাঝে ঢুকে আছে দীর্ঘ কুড়ি বছরের অদর্শন। শ্যামলের মুহূর্তের জন্য মনে হয়, কোনও ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? কিন্তু তা কী করে হবে, বেড নাম্বার তিন, জন্ডিস রোগী, সবই তো মিলছে। দ্রুত স্মৃতির রাস্তা ধরে কুড়ি বছর পিছিয়ে যায় শ্যামল, আড়ালে আবডালে চুপিচুপি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসা যুবক মামাকে এখন আর ততটা স্পষ্ট করে মনে করতে পারে না। আবছা যতটুকু খেয়াল আছে, ছোটমামা ছিল বেশ লম্বা, ঝাঁকড়া একমাথা চুল, খাড়া নাক। বেডে শুয়ে থাকা পেশেন্টের সঙ্গে চুলটা ছাড়া বাকি সব মিলছে। যদিও রোগভোগে অনেকটাই বিধ্বস্ত। মায়ের মুখের আদল যেন পাওয়া যাচ্ছে মানুষটার মুখে। তবে সাংঘাতিক মিল ওই ত্রস্ত, ভীরু চাউনিতে। তবু যদি কোনও ভুল হয় কথা বলতে গিয়ে নিশ্চয়ই কেটে যাবে।
বেডের পাশে রাখা টুলটায় গিয়ে বসে শ্যামল। মামা এখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শ্যামল বলে, চিনতে পারছ না ছোটমামা? আমি শ্যামল।
অল্প মাথা নেড়ে ম্লান হাসে মামা। বলে, কীভাবে ঢুকলে ভেতরে? পাস নেই তো। ও যে দুটো পাস-ই নিয়ে গেল।
দিয়ে দিল ঢুকতে। আমি এদিকে কিছুতেই খুঁজে পাই না। তোমার ওয়ার্ড। ইস, একটু আগে এলে মামির সঙ্গে দেখা হত।
পাশের বেডের পেশেন্ট শ্যামলদের কথোপকথন শুনছিল। শ্যামল ঘুরে তাকাতেই লোকটা টানটান হল বিছানায়। শ্যামল এবার মামার দিকে ফিরে জানতে চায়, ডাক্তাররা কী বলছে, কবে ছাড়বে?
ভাঙা গলায় কষ্ট করে মামা বলে, দাঁড়াও, এত সহজে ছাড়বে! দু’মাস ভুগে ভরতি হয়েছি। একগাদা কীসব পরীক্ষা করতে দিয়েছে। দিল্লিতে রক্ত পাঠাতে হবে। অনেক খরচ। এতসব আমি কোথায় পাব বলো?
মামাকে সত্যিই ভীষণ রিক্ত, নিঃস্ব লাগছে। সারা শরীরে দারিদ্র্যের সঙ্গে সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ছাপ।
হঠাৎ হলঘর কাঁপিয়ে ঘণ্টা বেজে ওঠে। শ্যামলকে চমকে উঠতে দেখে মামা বলে, দেখা করার টাইম শেষ হতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি। এটা জানান দিল। শ্যামলের বুকপকেটের টাকাটা অনেকক্ষণ বাদে একটু যেন নড়ে ওঠে। মন বলে, সেবা সংস্থায় টাকাটা না দিয়ে পুরোটা মামাকে দিয়ে দেবে নাকি? ওইসব প্রতিষ্ঠানে ডোনেশানের টাকা নিয়ে নানান কেচ্ছা-কাহিনি শোনা যায়।
নোটগুলো বুকপকেট থেকে বার করে, একটু লুকিয়ে ছোটমামাকে দেয় শ্যামল। বলে, এটা রাখো। টেস্টফেস্ট করাতে লাগবে।
টাকার দিকে না তাকিয়ে শ্যামলের দিকেই বড় বড় চোখ করে তাকায় মামা। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। শ্যামল ব্যাপারটাকে আরও স্বাভাবিক করতে বলে, মা পাঠিয়েছে। আত্মীয়স্বজনকে বলার দরকার নেই। আমি আবার খোঁজ নিতে আসব।
মামার হাত ছুঁয়ে আশ্বস্ত করে উঠে আসে শ্যামল। ওয়ার্ডের সমস্ত রোগীদের ফেলে চলে যাচ্ছে আপনজনরা। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হওয়ার ফাইনাল ঘণ্টা বাজে।
লালবাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসার পর বেশ নির্ভার লাগে শ্যামলের। টাকাটার একটা গতি হল। মাকে মামার খবরটা দিতে পারবে, কন্ডিশান খুব একটা সিরিয়াস নয়। টাকার ব্যাপারে যদিও একটু পক্ষপাতিত্ব হয়ে গেল। অঙ্কটা মেলানো হল জোর করেই।
শ্যামলের আক্ষেপের কোনও কারণ নেই। সে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যেতেই তিন নম্বরের পেশেন্ট দ্রুত নোট ক’টা গুনে বালিশের তলায় রাখে। তারপর বালিশে মাথাটা একটু বেশিই চেপে শুয়ে পড়ে। তার বুক উত্তেজনায় ওঠানামা করছে। বারবার দরজার দিকে তাকায়।
চার নম্বর বেডের পেশেন্ট এবার উঠে বসে। তিন নম্বরকে জিজ্ঞেস করে, ছেলেটা কে হয় আপনার?
ভাগনে। ছোট করে উত্তর দেয় তিন নম্বর।
বেশ পয়সাওলা মনে হল। কিছু দিল নাকি?
ইতস্তত করে তিন নম্বর বলে, হ্যাঁ, ওই আর কী, দিল সামান্য।
চার নম্বরের বোধহয় কোথায় একটা খটকা লেগেছে। তাই জানতে চায়, আপন ভাগনে?
না ঠিক আপন না, তবে নিজেরই মতো। আমাদের গ্রামদেশে আত্মীয়স্বজন তো একটু ছড়ানো ছেটানো। যার সঙ্গে বেশি মেলামেশা সেই হয় আপন। ছেলেটা কলকাতায় বড় চাকরি করে…
ফের শুয়ে পড়ে চার নম্বর। তার কোনও আপন দেশের ভাগনে নেই। তিন নম্বর নিষ্পলক চেয়ে থাকে হাসপাতালের সিলিং-এর দিকে। আশঙ্কা আর আনন্দ একসঙ্গে তোলপাড় করছে তার মন। একটু আগে যে ছেলেটা তাকে টাকা দিয়ে গেল, কস্মিনকালেও তাকে দেখেনি তিন নম্বর। ছেলেটা নিশ্চয়ই এই বেডের আগের পেশেন্টের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলেছে। আগের পেশেন্টও ছিল জন্ডিস রোগী। আজ সকালেই ছাড়া পেয়েছে। তিন নম্বর তখন ছিল মেঝেতে।
কাল সকালেই ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হলেই ছেলেটা ভুল শোধরাতে আসবে। ফেরত চাইবে টাকা। তা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। তার আগেই পালাতে হবে হাসপাতাল থেকে। টাকাগুলো নিজের অভাবের সংসারে দিয়ে, ফের অন্য হাসপাতালে ভরতি হয়ে
যাবে। বউ ছেলেমেয়েকে বলবে, আমার এক দেশের দিকে আপন ভাগনে টাকাটা দিয়েছে। তোমরা খরচ করো। আমায় সরকার দেখবে।
তিন নম্বরের কল্পদৃষ্টিতে ভরাট হয়ে যায় তার সংসারের সমস্ত ফুটোফাটা। ঝিমিয়ে যাওয়া সন্তানরা দুরন্ত হয়ে ওঠে। স্ত্রীর মুখে ফিরে আসে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া হাসি। চোখ বুজে নেয় তিন নম্বর। হাসপাতালের হাহাকার করা জানলা দিয়ে ভেসে আসে স্বপ্নরা।
শ্যামল টেরই পেল না। সম্পূর্ণ অজান্তে সে একটা কঠিন অঙ্ক মিলিয়ে দিয়েছে।
শারদীয়া আনন্দবাজার ২০০৪