এবার দেখি
মঙ্গলবার আমার অফ ডে। অফিস নেই। বন্ধুবান্ধব, বাড়ির লোক সকলেই জানে সকাল ন’টা অবধি ঘুমোব। কেউ ফোন করে না, ডেকে তোলে না খুব দরকার ছাড়া। এখন ফোন বাজছে। আমি শিয়োর ফোনটা আমার নয়। ন’টা এখনও বাজেনি। সাড়ে আটটার পর থেকে আমাদের বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে। তখন দাদার অফিস বেরোনোর তাড়া। ভাইপোর স্কুল।
রাজা, তোমার ফোন।
আমার আন্দাজ ভুল প্রমাণ করে, বলে গেল বউদি। চোখ খুলে উঠে বসি বিছানায়। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাই, সাড়ে সাতটাও বাজেনি। কে ফোন করল এ সময়? সুবিধের ফোন নয় বলেই মনে হচ্ছে।
বাইরের ঘরে গিয়ে ফোন তুলি, হ্যালো!
রাজা, একটা বিপদ হয়েছে। মহুয়াদির গলা। বিপদ কথাটা মহুয়াদির মুদ্রাদোষ। সামান্য সমস্যাকেও ‘বিপদ’ বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। উদ্বেগশূন্য গলায় জানতে চাই, কী হয়েছে?
আবার অফিস যাওয়া বন্ধ করেছে মৈনাক।
ঘটনা নতুন নয়। তবে অনেকদিন পর শোনা গেল। লাস্ট পাঁচ বছর আগে চাকরি প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল মৈনাকদা। কারণটা অবান্তর। এবারেরটা তেমনই কিছু হবে। সে প্রশ্নে না গিয়ে জিজ্ঞেস করি, অফিস না গিয়ে কোথায় যাচ্ছে?
বঁড়শিপোতা।
বাংলা নাম শুনে বোঝা যাচ্ছে ওয়েস্ট বেঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু কত দূরে জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, সেটা আবার কোথায়?
কলকাতাতেই। বাইপাস ধরে রুবি হসপিটাল পেরিয়ে খানিকটা যেতে হবে। তারপর বাঁ-হাতি রাস্তা।
কী আছে সেখানে? কেন যাচ্ছে?
সব বলব। তুমি একবার আসতে পারবে বাড়িতে? তোমার তো ছুটি আজ।
অন্য যে কেউ হলে এড়িয়ে যেতাম। মহুয়াদির সমস্যা এড়ানো যাবে না। মৈনাকদা ও মহুয়াদির বিয়ে আমার মধ্যস্থতায় হয়। ওদের দাম্পত্যের নানা গোলমাল মেরামত করার দায়িত্ব আমারই। ঘটনাচক্রে বিয়েটা সুখের হয়নি। কোনও যুক্তি নেই, তবু আমার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। ঠিক সেই কারণেই যে মহুয়াদি আমাকে ডেকে পাঠাল, তা
কিন্তু নয়। ওদের সবচেয়ে কাছের মানুষ আমি। দু’জনেই আমায় ভীষণ স্নেহ করে। ‘ঠিক আছে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যাচ্ছি’ বলে ফোন নামিয়ে রেখেছি। চা দিতে বলেছি বউদিকে। বঁড়শিপোতা নামটা গেঁথে রইল মাথায়। অদ্ভুত নাম! কলকাতার গায়েই এই নামে জায়গা আছে, অথচ শুনিনি! খবরের কাগজেও আসেনি নামটা। বঁড়শির সঙ্গে জলের একটা যোগাযোগ আছে। জায়গাটা কি জলাভূমি? কী করতে যায় সেখানে মৈনাকদা। পারেও বটে লোকটা, জীবনে কত কী যে করল!
বাসে যথেষ্ট ভিড়। আমার ছুটির দিন হলে কী হবে, অন্যদের তো অফিস টাইম। মিনিট কুড়ির জার্নি। বাগবাজার টু মানিকতলা। তবু অসহ্য লাগছে। এত রাগ হচ্ছে মৈনাকদাটার ওপর… আবার এটাও মানতে হবে, আমার এই ছুটি, বড় অর্থে চাকরিটা মৈনাকদার জন্যই হয়েছে। একটা টিভি চ্যানেলের চিফ ক্যামেরাম্যান আমি। পাস কোর্সে বিএ করার পরই মৈনাকদা ঢুকিয়ে দিয়েছিল সিনেমা, টিভির ইনস্টিটিউটে। বলেছিল, ক্রিয়েটিভ কাজের সঙ্গে থাকবি। চার্ম পাবি জীবনের। নয়তো আমার মতো দশটা-পাঁচটা ডিউটি করে ভোঁতা হয়ে যাবি দিনকে দিন।
মৈনাকদা চাকরি করে ব্যাঙ্কে। ভাল স্টুডেন্ট ছিল। একবার পরীক্ষা দিয়েই চাকরি পেয়ে গেছে। আমি অত ভাল ছাত্র নই। কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেতাম না। ভাগ্যিস মৈনাকদার কথামতো ইনস্টিটিউটে ঢুকেছিলাম। অনেক টিভি চ্যানেল লঞ্চ করল বাংলায়, টুক করে চাকরিটা হয়ে গেল। তবে ক্রিয়েটিভ ব্যাপার স্যাপার আমার চাকরিতেও নেই। সবই ধরাবাঁধা গত৷ এই বাঁধা গতের জীবন মৈনাকদার পছন্দ নয়। ব্যাঙ্কের মতো মহার্ঘ চাকরি হেলায় ছেড়ে ফিল্ম করবে বলে দু’মাস বাড়িতে বসে ছিল। মহুয়াদি, বাড়ির লোক, অফিস কলিগ অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সেবার জয়েন করায়। কাজে মন বসাতে পারত না। সবসময় ব্যাজার মুখ। হঠাৎ অফিস ইউনিয়নে ভিড়ে পড়ল। চিরটাকালই অস্থিরমতি মৈনাকদা। যখন ছোট ছিলাম ওর অস্থিরতা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। আমার থেকে বছর পনেরোর বড়। সম্পর্ক সূত্রে আমার পিসির ছেলে। নিজের পিসি নয়। বাবার দূর সম্পর্কের বোন। আমাদের বাড়িতে একটু বেশিই যাতায়াত ছিল মৈনাকদার। দামাল ভাগনেটিকে বাবা বেশ পছন্দই করতেন। দশ-এগারো বছর বয়সে মৈনাকদা প্রথম চমকে দেয় আত্মীয়-পরিজনকে। দিল্লিতে মুজিবর রহমান হেলিকপ্টার থেকে নামছেন, ছবিটা আগফা ক্লিক ক্যামেরায় তুলেছিল। দিল্লিতে এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল মৈনাকদারা। অভিভাবকদের ঘেরাটোপ ছেড়ে কখন এক ফাঁকে ছবিটা তুলে আনে। খেয়াল করেনি কেউ। টপ অ্যাঙ্গল থেকে তোলা ফটো, বেশ স্পষ্ট। মনে হবে দামি ক্যামেরায় তোলা। আমি বড় হয়ে ছবিটা দেখেছি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরকম টপ অ্যাঙ্গল মাঠের মধ্যে কোথায় পেলে?
মৈনাকদা বলেছিল, একজন মিলিটারিম্যানকে পটিয়ে তার কাঁধে উঠে পড়েছিলাম। তো এই হল আমার মৈনাকদা। অল্প বয়সে আমার বন্ধুদেরও গুরু হয়ে গেল। ওর হাত ধরে রঁদ্যার একজিবিশন দেখেছি। পিকাসোর লিথোগ্রাফ। সিনে ক্লাবে গিয়ে বিদেশি ভাল সিনেমা, গ্রুপ থিয়েটারের নাটক, মনোজগতের ব্যাপ্তি তৈরি করে দিয়েছিল আমার হিরো।
আমি তখন উনিশ। পাশের বাড়ির মহুয়াদির জীবনে বিপর্যয় নেমে এল। বিয়ের সময় দেখা গেল, পিঁড়িতে বসা বর বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। দুলাল জ্যাঠা, মানে মহুয়াদির বাবা বেঁকে বসলেন, এ বিয়ে হতে পারে না। পাত্র পাগল। বিদায় জানানো হল বরপক্ষকে। সারা বাড়িতে নেমে এল শোকের আবহাওয়া। জেঠিমা বারে বারে ফিট হয়ে যাচ্ছেন। মহুয়াদি
লজ্জায়, অপমানে বোবা। ক্যাটারার রান্না করা খাবার রেখে, টাকা নিয়ে চলে গেল।
পরদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিল মৈনাকদা। বললাম, সব ঘটনা। সে তখন সবে চাকরি পেয়েছে। আবদার করলাম, প্লিজ, মহুয়াদিকে বিয়ে করো।
বলল, কোনও অসুবিধে নেই। তবে এক্ষুনি করব না। ব্যাপারটা বড্ড সিনেমার মতো হয়ে যাবে। দুটো মাস কাটুক।
ভেবেছিলাম, এড়িয়ে গেল। সেটা যে নয়, প্রমাণ দিল ঠিক দু’মাস পরে। বাড়ি এসে বলল, কী রে, তোর মহুয়াদির বিয়ে হয়ে গেছে তো?
না, কী করে হবে। সেরকম সহৃদয় পাত্র কি সহজে পাওয়া যায়।
তা হলে নিয়ে আয় মেয়েটাকে দেখি।
তুমি তো দেখেছ।
দেখেছি হয়তো মনে পড়ছে না। তা ছাড়া আমাকে পছন্দ কি না সেটাও তো জানতে হবে।
মৈনাকদা যে মিথ্যে বলছে না, আমি নিশ্চিত ছিলাম। মেয়েদের ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ কখনওই দেখিনি। আর মহুয়াদিকে এমন দেখতে নয় যে, অন্যমনস্ক পুরুষের চোখ টেনে নেবে।
মহুয়াদিকে এনে বসিয়ে দিয়েছিলাম মৈনাকদার সামনে। বন্ধ ঘরে ওরা কী আলোচনা করেছিল, আজও জানি না। বিয়েতে রাজি হল দু’জনেই। গর্বিত হয়েছিলাম আমি। বছর তিন-চারের বেশি গর্ব টিকল না। সংসারী হল না মৈনাকদা। নমো নমো করে অফিসটা চালায় আর বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ায়। গোদের ওপর বিষফোড়া, ওদের কোনও বাচ্চা হল না। মহুয়াদি ডাক্তারের কাছে যেতে চেয়েছে, দু’জনেই পরীক্ষা করাবে। চিকিৎসা হবে প্রয়োজন অনুযায়ী। মৈনাকদা রাজি নয়। বলেছে, যার শারীরিক অক্ষমতায় সন্তান আসছে না, আজীবন সে নিজেকে অপরাধী ভাববে।
অগত্যা মহুয়াদি নিজের পরীক্ষা করায় দেখা গেল, সন্তানধারণের ক্ষমতা মহুয়াদির প্রায় নেই। আমাকে, মৈনাকদাকে খবরটা জানায় মহুয়াদি। বলে, দত্তক নেবে।
একচোট রাগারাগি করে মৈনাকদা রাজি হয়। বলে, নিতে পারি। নিলে যমজ মেয়ে নেব। অবশ্যই তাদের গায়ের রং কালো হতে হবে।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরকম অদ্ভুত চাহিদা কেন?
কারণ, সো-কলড এই নেগেটিভ পয়েন্ট নিয়ে আমাদের সন্তান আসতে পারত, তখন ফেলে দিতে পারতাম না। তো, অ্যাডাল্ট যদি করতেই হয় বেছে বেছে ভাল সন্তান নেব না।
দত্তক নেওয়া হল না। মহুয়াদিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। তার মত, মৈনাকদা ইচ্ছে করেই
এই শর্ত রেখেছে। আসলে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কোনও সন্তানকেই সে নিজের করে নিতে পারবে না।
বিষয়টার জটিলতায় আমি আর ঢুকিনি। মৈনাকদা নিজের মতো বাউন্ডুলেপনা চালিয়ে গেছে। কখনও বাউল, বিচিত্র মানুষ, বিদেশি ভবঘুরে ধরে এনে বাড়িতে রেখেছে দিনের পর দিন। নিজে উধাও হয়ে গেছে ইচ্ছেমতো। উলোঝুলো চুল, দাড়ি এবং গায়ে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ঝগড়া হয়েছে মহুয়াদির সঙ্গে। আমি গিয়ে সামলেছি। এই করতে করতে আমারও বিয়ে করার ইচ্ছেটা চলে যাচ্ছে। পর্ণা এদিকে তাড়া দিচ্ছে রোজ।
পৌঁছে গেছি মৈনাকদার বাড়ি। ডোরবেল টেপার আগেই দরজা খুলে গেল। জানলা দিয়ে বোধহয় পথ চেয়ে বসে ছিল মহুয়াদি।
পুরো নাম বঁড়শিপোতার বিল। মহুয়াদির কথামতো রুবি হসপিটাল পেরিয়ে যেতে, চলে এসেছিলাম বাসের গেটে। বাইপাসের ধারে জোড়া তালগাছ, নীচে সিগারেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের গুমটি দেখে, বাস থামিয়ে নেমে পড়লাম। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম বঁড়শিপোতার রাস্তা। মহুয়াদির দেওয়া পথনির্দেশের সঙ্গে মিলে গেল। দোকানের পেছনেই মোরাম বেছানো রাস্তা। চলে গেছে দিগন্ত অবধি। দু’পাশে সরকারি উদ্যোগে লাগানো নানা জাতের গাছ। ছায়ারা ঘন হচ্ছে গাছের গোড়ায়। বেলা বাড়ছে। রোদে তেমন তেজ নেই। শীত এল বলে।
‘বিপদ’ কথাটা আজ আর মহুয়াদির মুদ্রাদোষ বলা যাবে না। সত্যিই বিশাল সমস্যায় পড়েছে। মৈনাকদা কেন যে এই হিড়িকটা তুলল, বোঝা যাচ্ছে না। ওর চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই মানায় না এই কিম্ভূত প্রস্তাব।
দরজা খুলে থমথমে মুখে দাঁড়িয়েছিল মহুয়াদি। রোগা লাগছিল খুব। এত সিরিয়াস মুড আগে কখনও দেখিনি। গভীর উদ্বেগে বলে উঠেছিলাম, এ কী চেহারা হয়েছে তোমার! ঠিক কী ঘটেছে বলো তো?
মহুয়াদি বলল, ঘরে এসে বসো। জলখাবার রেডি করে রেখেছি। খাওয়ার সময় বলব।
যা শোনাল মহুয়াদি, জলখাবার কী খেয়েছি, এখন আর মনে পড়ছে না। মৈনাকদা অন্য একজনকে বিয়ে করার অনুমতি চেয়েছে মহুয়াদির কাছে। পাত্রী কে, সে ব্যাপারে কিছু বলছে না। যুক্তি হচ্ছে, পাত্রী ভাল-মন্দ বুঝে তো পারমিশন দেবে না মহুয়াদি, খামোকা তার নাম তুলে কী লাভ! মহুয়াদি আন্দাজ করছে, মেয়েটি বঁড়শিপোতার বিলে আছে। সেখানে তিন ঘরের বাস। বেশিটাই জলাজমি। কিছু চাষের জমিও আছে। ওখানকার একটি বাড়িতে গত এক মাস ধরে যাতায়াত শুরু করেছে মৈনাকদা। পাত্রীটি এক খেতমজুরের বউ।
আমার মাথা বোঁ বোঁ করছিল। শেষমেশ গোষ্পদে গিয়ে পা আটকাল আমার গুরুর! এই মৈনাকদাকেই দেখেছি কত সুন্দরীকে অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করতে। তাদের মধ্যে একজন এখন টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। আমি মহুয়াদিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করে শিয়োর
হচ্ছ, চাষিবউয়ের প্রেমে পড়েছে মৈনাকদা? কয়েকটা সিম্পটম দেখে বুঝতে পারছি।
যেমন, যেমন!
এক হচ্ছে, বউটার রান্নার খুব প্রশংসা করে। দোকান-বাজার তোমার দাদাই করে নিয়ে যায়। অবাক হয়ে বলেছিলাম, সে কী, ওখানে খাওয়াদাওয়াও শুরু করেছে নাকি? দুপুরটা প্রায়শই খায়। রাত্তিরে বাড়িতে।
পরের প্রশ্ন করেছিলাম, রূপের প্রশংসা করে না মহিলার?
না, করেনি। অন্য আর একটা লক্ষণ হচ্ছে, মোবাইল ফোন বাড়িতেই রেখে যায়। বেশ কিছু মিস্ড কল হয়। নামগুলোর মধ্যে মহিলারাও আছেন। তাঁদেরকে ওর প্রয়োজন নেই। যাকে দরকার তার কাছে তো চলেই যাচ্ছে।
পাকা গোয়েন্দার মতো অবজারভেশন মহুয়াদির। শুধু মোটিভটাই খুঁজে পাচ্ছে না। তাই মেয়েটিকে দেখতে পাঠাল আমাকে। সে কি খুবই রূপবতী অথবা অন্য কী বিশেষ গুণ আছে তার? গরিব ঘরে সুন্দরী হওয়ার চান্স নেই, ওসব সিনেমায় হয়। পড়ে রইল ‘গুণ’, কী সেটা, যার জন্য অফিস, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে এখানে বসে আছে মৈনাকদা?… আর একটু হলে বাঁশের সাঁকোটা চোখের আড়ালে চলে যেত। রাস্তায় লোক চলাচল নেই। বঁড়শিপোতাটা কোথায়, জিজ্ঞেস করা যেত। মহুয়াদি বলেছিল, খবর নিয়েছি, রাস্তার ধারে খালের ওপর বাঁশের প্রথম সাঁকোটা পেরোলে রতন হেলার বাড়ি। ওদের ওখানেই যায় মৈনাক।
আর বউটার নাম? ফাঁকতালে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। মহুয়াদি বলল, জানে না।
বাঁশের সাঁকোটা বেশ পুরনো। মচমচ শব্দটা চাপা আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে। সাবধানে পার হলাম। সামনে ঘরবাড়ি কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু লম্বা লম্বা গাছ। মাঝে পায়ে চলা রাস্তা। একটু এগোতে চোখে পড়ল ইতস্তত তিনটে টালির চালের বাড়ি। বড়ই নিঃস্ব মলিন চেহারা। অনাদরের ফুলগাছ অথবা তারে ঝোলানো রঙিন কাপড় কিছুই চোখে পড়ছে না। মানুষেরও সাড়াশব্দ নেই। পাখির কিচকিচ ডাক ভাসছে বাতাসে। বাড়িগুলোর পেছনে পুকুর, ও পারে বিস্তৃত চাষের জমি। খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে খুঁজে পেলাম মৈনাকদাকে। গাছঘেরা ফাঁকা মতো জায়গা, এক ছিটে ঘাস নেই। মাদুরের ওপর উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে। আরও খানিকটা হেঁটে গিয়ে দেখি, ওর পাশে বড় স্টিলের বাটি, গ্লাস। বাটি থেকে তুলে মুড়ি খাচ্ছে, কিছুটা ছড়িয়ে দিচ্ছে সামনে। ধুলোর ওপর নেমে এসেছে চড়াই, শালিক, আরও সব অচেনা পাখি।
পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখ তুলে তাকাল। চাহনিটা কীরকম যেন পালটে গেছে। আগের মতো জ্বলজ্বল করছে না। বলল, দূত হয়ে এলি?
গলার স্বরটাও অন্যরকম শোনাল মৈনাকদার। উত্তর না দিয়ে বসে পড়লাম মাদুরে। দুপুরে খেয়ে যাস। সজনী দারুণ রান্না করে।
মহিলার নাম শুনে গা জ্বলে গেল। মৈনাকদা এমনভাবে কথাগুলো বলছে যেন পাকাপাকিভাবে সংসারটা এখানে পেতেই ফেলেছে। কী ইচ্ছে হল, শুয়ে পড়লাম মাদুরে। উঁচু উঁচু গাছের ডগায় নীল রুমালের মতো আটকে আছে আকাশটা। মৈনাকদাকে বলি, অফিস যাচ্ছ না শুনলাম। এখানে বসে থেকে কী করো?
ধরা গলায় নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলে, সময়ের আয়তন বাড়াই।
কথাটা ভাল করে বোঝার জন্য উঠে বসি। মৈনাকদা ভেঙে বলতে যাবে, বাটি হাতে এক মহিলা এসে দাঁড়ায়। আমাকে বলে, মুড়ি ক’টা খেয়ে নিন। আমি চা করছি।
এ কিছুতেই ‘সজনী’ হতে পারে না। দারিদ্র্যের ছোবল বয়স গুলিয়ে দিয়েছে। ওর শরীরের ডিকশনারিতে কোনও দিনই ‘রূপ’ কথাটি ছিল না। কোনও গুণ দিয়েই মৈনাকদার সমকক্ষ ভাবা যায় না একে। আমাকে চমকে দিয়ে মৈনাকদা বলে উঠল, সজনী, এ আমার ভাই। আজ দুপুরে খাবে এখানে। ,
না, না। আমি অতক্ষণ থাকব না। বিরক্তির স্বরে বললাম কথাটা। সজনী কোনও অনুরোধ না করে মুড়ির বাটি রেখে চলে গেল। আমি পুরনো প্রসঙ্গটা ফিরিয়ে আনি, সময়ের আয়তনটা কী ব্যাপার?
মৈনাকদা বলতে থাকে, সময়ের গভীরে যে কতটা সময় লুকিয়ে থাকে, এখানে এসে জানলাম। এখানে অনন্ত দুপুর। অলস বিকেল, সন্ধে ফুরিয়ে রাত আসতেই চায় না।
কীসের এত ভ্যানতাড়া বুঝতে পারছি না। তবে বলতে দিতে হবে। বিয়ের প্রসঙ্গটা আসবেই। তখনই চেপে ধরব। বলে যাচ্ছে মৈনাকদা, এই যে মুড়ি খেতে পাখি নেমে এসেছে উঠোনে, এতদিন ওদের নেমে আসা, মুড়ি খাওয়া দেখতাম। এখন ওরা উড়ে যাওয়ার পর ধুলোয় ওদের পায়ের নকশা দেখি। কী অপূর্ব শিল্প। অথচ শিল্পীর হদিস নেই।
কথা কোনদিকে যাচ্ছে ধরতে পারছি না। মুড়ি মাখাটা ভালই লাগছে খেতে। কিছুটা ছড়িয়ে দিলাম উঠোনে। আরও বেশ ক’টা পাখি উড়ে এল কোথা থেকে।
মৈনাকদা আঙুল তুলেছে দূরে। বলছে, ওই দেখ কপিখেত। ওখান সাদা বক উড়ে উড়ে পোকা খায়। হেমন্তর কুয়াশা নেমে আসে খেতের বুকে। স্পর্শটা এখানে বসে টের পাই। তারপর ওই বিলের জলে বিকেলে প্রতি মিনিটে রং বদলায়। পুকুরের দিকে দেখ, দুটো হাঁস কেমন পুকুর জুড়ে ঢেউ তুলেছে। ওই দেখ, গাছ থেকে খসে পড়া শুকনো পাতা কত সময় ধরে নানানভাবে ভল্ট খেতে খেতে নেমে আসছে মাটিতে।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মৈনাকদা। থামিয়ে বলি, তুমি নাকি আর একটা বিয়ে করতে চাও? পাত্রীটি কে?
ম্লান হাসে মৈনাকদা। বলে, সে আর হওয়ার নয় রে। তোর দিদি হতে দেবে না। আমার সমস্ত প্ল্যান প্রোগ্রাম ভেস্তে দিচ্ছে। যেমন আজ তোকে পাঠাল। এবার থেকে মাঝে মাঝেই ডিসটার্ব করতে আসবি।
পাত্রী কি এই সজনী? সরাসরি জিজ্ঞেস করেই বসলাম।
ছেলেমানুষি হাসি ফুটে উঠল মৈনাকদার মুখে। ঘাড় নেড়ে স্বীকার করল। মুখে বলল, সজনীরা কত গরিব দেখে বুঝতে পারছিস তো? ভাবলাম, হাতে বেশি সময় নেই, ওদের জীবনটা যাপন করে দেখি। ওর বরকে বললাম। আশ্বস্ত করলাম এই বলে, শারীরিক চাহিদা আমার নেই। তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথাও নেই রতনের। কিছু টাকা দিলেই হবে। সজনীও রাজি ছিল। এখন বেঁকে বসেছে। আসলে তোর দিদি এসে টাকা খাইয়ে গেছে ওদের।
সমস্তটাই গুলিয়ে গেল। আমার দিক থেকে পরের প্রশ্ন কী হওয়া উচিত ঠিক করে উঠতে
পারছি না। মহুয়াদি এখানে এসেছে? আমাকে তো বলল না! …ভাবনার মাঝে গলা তোলে মৈনাকদা। সজনী, ও সজনী, বউদি এসেছিল না তোমার কাছে?
কুঁড়েঘরের পইঠায় বসে বাসন ধুচ্ছে সজনী। উত্তর দেয়, না, আসেননি।
মৈনাকদা এবার আমার দিকে তাকাল। বলল, এই নিয়ে কুড়ি-বাইশবার জিজ্ঞেস করা হয়ে গেল। একই উত্তর দিচ্ছে। অথচ ওর নতুন শাড়ি হয়েছে, চটি। রতন হেলার বাহারি পাঞ্জাবি। সব গট-আপ বুঝলি।
আচমকাই প্রশ্নটা মাথায় চলে আসে, হাতে সময় কম বলছ কেন?
সে কী, তোকে বলেনি মহুয়া! অবশ্য ব্যাপারটা জেনেও ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। গলায় ক্যান্সার হয়েছে আমার। বায়োপসি রিপোর্ট পাওয়ার পর বড্ড দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একদিন এসে পড়লাম এখানে। সেই থেকে জমে গেছি, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। উপায় নেই। মহুয়া এসে দাঁড়িয়ে থাকে বাইপাসের গুমটিতে। আমি না ফিরলে সারা রাত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। শেষ ক’টা দিনও শান্তিতে থাকতে দেবে না। এতদিন তো আঁকড়ে রইল। এখন আরও প্রবলভাবে চায়। তুই তো বন্ধুর মতো, বলতে অসুবিধে নেই, সারা রাত জড়িয়ে থাকে আমাকে। গলায় ক্যান্সার। তবু চুমু খাবে ঠোঁটে। কপালে খায় না। পাছে মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা লাগে।
মাটিটা দুলতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ ধরে। কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছে গলায়। কান্না, অভিমান মেশানো বরফ-কঠিন কষ্ট। কোনওক্রমে বলি, এত শরীর খারাপ নিয়ে তুমি এখানে বসে থাকবে! চলো বাড়ি যাই।
এখন যাব না রে। সন্ধের মুখে কোথা থেকে তিনটে প্যাঁচা উঠে আসে আকাশে। বিশাল কালো ডানা মেলে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বসে সামনের জলায়। যেন দিনের যবনিকা টেনে দিল। মৃত্যু হয়তো এরকমই। প্যাঁচাগুলোর উড়ান আমাকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে। অভ্যস্ত হই আমি।
এবার আর কষ্ট নয়। কেমন যেন ভয় ভয় করছে আমার। মাদুর ছেড়ে উঠে পড়ি। মৈনাকদা চললি? বলে,
হ্যাঁ।
মহুয়াকে বলিস দোকানে এসে বসে না থাকতে। সময়মতো আমি ঠিক ফিরে যাব।
বাঁশের সাঁকোর কাছে চলে এসেছি। পেছনে মৈনাকদার গলা পাচ্ছি, আয় আয়, চই চই।— ও কি মৃত্যুকে ডাকছে? তা নয়। হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক ডাকও ভেসে আসছে। ওদের বোধহয় খেতে দেবে। আমি মোটেই মহুয়াদির কাছে যাব না। গিয়ে কোনও লাভ নেই। আবার বাইপাসের ধারে এসে দাঁড়াবে মহুয়াদি। ওদের দু’জনের মধ্যে যে ঝগড়াটা অথবা যুদ্ধ এখন লেগেছে, তা বড়ই অসম। প্রেমের সঙ্গে মৃত্যু। কে জিতবে সকলেই জানে। অথচ যুদ্ধটা নিদারুণভাবে রোমহর্ষক। তাড়াতাড়ি পা চালাই। অসময়ে প্যাঁচা তিনটে উঠে না আসে আকাশে।
রবিবাসরীয় (আনন্দবাজার পত্রিকা), নভেম্বর ২০০৬