গো অ্যাজ ইউ লাইক
মাঠ থেকে মাইকের ঘোষণা সাততলা অবধি পৌঁছোতে গিয়ে অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। মনে হয় বুঝি সেই স্কুলবেলার মাঠ থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে। সাততলায় মধুরাদের ফ্ল্যাট। মধুরা এখন একা। অ্যানাউন্সমেন্টে কান রেখে বোঝে এখনও দুটো ইভেন্টের পর তাদের ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার আয়নার সামনে গিয়ে বসে মধুরা। পরনে সাদা থান। শ্যাম্পু করা চুল। ধবধবে সিঁথি। না, চুলের অরণ্যে লুকিয়ে চিলতে সিঁদুরছোঁয়া সে রাখেনি। এ ব্যাপারে নিঃসংশয় হয়েছে অভীকের আচরণে। অভীকের এসব নিয়ে কোনও সংস্কার বা সংশয় নেই। ও লক্ষই করে না মধুরা সিঁদুর পরেছে কি পরেনি। ধ্যাবড়া করে সিঁদুর লাগিয়েও অভীকের নজর থমকাতে পারেনি মধুরা। এই উদাসীনতাকে উপেক্ষা বলে ভুল হতে পারে। তা নিশ্চয়ই নয়। স্ত্রী সন্তানের প্রতি কর্তব্যে কোনও ফাঁক রাখে না অভীক।
গতকালই ইন্দ্র এসেছে আমেরিকা থেকে। এইটুকু সময়ে কতবার যে বলেছে, মধুরা, তুমি তো দেখছি অভীকটাকে গার্হস্থ্য ইডিয়ট বানিয়ে দিয়েছ! কথার পিঠে মধুরার বলতে ইচ্ছে হয়, আমি কিছুই করিনি। শুধু সঠিক মানুষ বেছেছি। সে জানে একটা সংসারকে কীভাবে সুখী রাখতে হয়। ভাগ্যিস সে তোমার মতো হৃদয়হীন কেরিয়ারিস্ট নয়।
কলকাতায় ইন্দ্রর পৈতৃকবাড়ি না হলেও, অনেক নিকট-আত্মীয়র বাড়ি আছে। সেখান থেকেই কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। তবু এতদিন বাদে সে যখন ছুটি নিয়ে দেশে ফিরল, উঠল পুরনো বন্ধুর বাড়িতেই। এখানে ক’দিন থেকে পাণ্ডুয়ায় নিজেদের বাড়ি যাবে। কেন এখানেই এসে উঠল ইন্দ্ৰ! জিজ্ঞেস করলে বলেছে, পিছুটান। কলেজ জীবনের সোনালি অতীত।
সত্যিই কি তাই, না কি দেখতে এসেছে অভীককে বিয়ে করে কতটা সুখী হয়েছে মধুরা?
ইউনিভার্সিটির বারান্দা, থাম, গাছপালা, বন্ধুবান্ধব সবাই জানত মধুরা ইন্দ্রর সম্পর্ক। শুধু জানত না ইন্দ্রর পাগলামিতে সায় দিয়ে মধুরা ইতিমধ্যেই বিয়েটা রেজিস্ট্রি করে রেখেছে। নিরীহ ভালমানুষ অভীক ছিল মধুরা-ইন্দ্রর কমন ফ্রেন্ড। অভীকও জানত না বিয়ের কথা।
এম এ-র ফাইনাল ইয়ার। ক্লাস চলছে পুরোদমে। ইন্দ্র এক সপ্তাহ বেপাত্তা। হঠাৎ একদিন এসে জানাল, ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাচ্ছে। কী একটা কোর্সের জন্য স্কলারশিপ ম্যানেজ করেছে। পরীক্ষাটা দিয়েই অবশ্য যাবে। সারপ্রাইজ দেবে বলে, এতদিন ওর চেষ্টার কথা বলেনি।
তা হলে আমার কী হবে! আমাদের সম্পর্কের! অসহায় বিস্ময়ে জানতে চেয়েছিল মধুরা।
ইন্দ্র বলেছিল, কী আবার হবে! আমি ওখানে সেটেল্ড হয়ে গেলেই তুমি চলে আসবে। আর যদি না পারি, আমিই চলে আসব তোমার কাছে। সম্পর্ক মানে তো কোনও বন্ধন নয়।
তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে কবে যেন চলে এল ইন্দ্রর বিদেশ পাড়ি দেওয়ার দিন। নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই যে প্লেনে উঠল ইন্দ্র, চিঠি এল একবছর পর, পায়ের তলায় মাটি পেতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে। এসেছি যখন ফিরব না। আমাদের হুজুগের বিয়েটা ইচ্ছে করলে ভুলে যেতে পারো। কাগজপত্তর তো তোমার কাছেই আছে, পুড়িয়ে দিয়ো, ভাসিয়ে দিয়ো… অক্ষরগুলো গভীর নিরীক্ষণেও আঁকাবাঁকা ঠেকেনি মধুরার কাছে। এতটুকু হাত কাঁপেনি ইন্দ্রর। মধুরার চোখের জলেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চিঠি।
ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগলেও, এই ট্র্যাজেডি কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেনি মধুরা। কেন বলবে, বিয়ে করার আগে তো কারুর পরামর্শ চায়নি।
দিন যায়। একে একে বন্ধুরা দূরে সরে গেলেও, কীভাবে যেন অভীকের সঙ্গে সম্পর্কটা রয়ে গেল। আর কোনও চিঠি এল না ইন্দ্রর। অভীকের সঙ্গে বিয়ের আগের দিন পুরনো বিয়ের কাগজগুলো পুড়িয়ে দিল মধুরা। সেই বিশ্বাস পোড়ার গন্ধটা আজও নিশ্বাসে বয়ে বেড়াচ্ছে সে, তাই তো এ বাড়িতে পা দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ইন্দ্র সন্দেহের জাল বুনে দিয়েছে তার মনে। মধুরাকে একা পেয়ে বলেছে, দেখে তো মনে হচ্ছে সুখেই আছ। আমাদের বিয়ের কথাটা অভীক জানে?
না। মাথা নামিয়ে বলেছিল মধুরা।
এটা কিন্তু তুমি খুব খারাপ করেছ। আই নো অভীক ইজ ভেরি নাইস গাই। ওকে এভাবে ঠকানো তোমার উচিত হয়নি।— একটু থেমে, ভেবে নিয়ে ইন্দ্র বলে, তোমরা দু’জনেই আমার বন্ধু। আমাকে ব্যাপারটা কনফেস করতে দাও। অভীক জানুক সত্যিটা। তুমিও তখন রিয়ালাইজ করতে পারবে, ও সত্যিই তোমাকে ভালবাসে কিনা। মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জীবন কিছুতে সুখের হতে পারে না।
বিচ্ছিরি একটা চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিল ইন্দ্ৰ। তবে কথাটা আজ না হয় কাল অভীককে ও বলবেই। উচ্চারণে সেরকমই একটা একরোখামি ছিল। ইন্দ্ৰ নিজে এতদিন কীভাবে কাটিয়েছে, কেন বিয়ে থা করেনি। কেনই বা মধুরাকে ভুলে গিয়েছিল… এত ক’টা প্রশ্নের একটাও করতে পারেনি মধুরা। জবাব চাওয়ার স্পর্ধাকেই আঘাত করেছে ইন্দ্ৰ।
আজ দুপুরে ইন্দ্রর সঙ্গে বোঝাপড়ার সুযোগ ছিল। এড়িয়ে গেল ইন্দ্র। অভীক আর বাবানের পেছন ধরল। আজ থেকে বইমেলা শুরু। কথার নানা ছলে ইন্দ্রকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল মধুরা, কালই তো সবে এসেছ। একটু রেস্ট নাও। এতদিন বাদে সাত সমুদ্র পেরিয়ে এলে, ভাল করে কথাই হল না। কথা ছাড়াও চাউনিতে আর্তি মিশিয়ে ছিল মধুরা। গ্রাহ্য করেনি ইন্দ্ৰ। বলেছে, দেখে আসি অভীকের অধঃপতনটা! শালা একসময়
ফিল্ম ডিরেক্টার হবে ভেবেছিল, এখন টিভি জার্নালিস্ট হয়ে ক্যামেরা সঙ্গে করে ঘুরছে। হোপলেস। মধুরা তুমি একটু স্যাকরিফাইস করলেই, মানে ওকে বিয়ে ফিয়েতে না জড়ালে, নিশ্চয়ই কেউকেটা হত।
এ সব কথার কথা। হয়তো আজই একলা পেয়ে অভীককে সব বলবে ইন্দ্র। বদলে যাবে মধুরার পরবর্তী জীবন। হয় সে ভালবাসায় বাঁচবে, নইলে করুণায়। কী অপেক্ষা করছে তার জীবনে, জানে না।… আয়নার সামনে বসে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মধুরা। দু’আঙুলে ক্রেপ আর গাম দিয়ে গোল পাকাচ্ছে। নকল আঁচিল। ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’-এর প্রপোজালটা মধুরাই দিয়েছিল। তাদের আকাশদ্বীপ ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সে প্রত্যেক বছর স্পোর্টস কম্পিটিশান হয়। প্রতিবারই গৃহিণীদের জন্যে মিউজিক্যাল চেয়ার। একঘেয়ে। মধুরার প্রস্তাবে সবাই এককথায় রাজি। এই মুহূর্তে আকাশদ্বীপ অ্যাপার্টমেন্টের বাহাত্তরটা ফ্ল্যাটে গৃহিণীরা কে কী সাজছে কে জানে!
ছোট্ট নকল আঁচিলটা ঠোঁটের ওপর, একটু বাঁদিক ঘেঁসে স্পিরিটগাম দিয়ে সেঁটে দেয় মধুরা। হ্যাঁ, অনেকটা মণিপিসির মতো লাগছে। মণিপিসি সাজছে মধুরা। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে এই সাজটাই বেছে নিয়েছে। ছোটবেলায় অনেকেই বলত তাকে মণিপিসির মতো দেখতে। ঠোঁটের ঠিক এই জায়গায় বাদামি রঙের আঁচিল ছিল মণিপিসির। পানপাতা মুখ, লম্বা নাক, মাখনের মতো গায়ের রং, তার সঙ্গে আঁচিলটা যেন রত্নের মতো উপস্থিতি নিয়ে মধুরাদের সংসার ভরিয়ে রাখত পিসি। খুব অল্পবয়সে বিধবা হলেও, কক্ষনও ভাগ্যকে দোষারোপ করেনি। এমনকী, মধুরা যেদিন শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে, সারাবাড়ি কাঁদলেও, মণিপিসির চোখে জল ছিল না। মধুরা কাঁদতে কাঁদতে জানতে চেয়েছিল, তুমি কেন কাঁদছ না পিসি! তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
হাসতে হাসতে পিসি বলেছিল, কষ্ট কেন হবে! শ্বশুরবাড়ি যাওয়া কত আনন্দের, আমার থেকে আর কে ভাল বুঝবে।
মধুরার বিয়ের এক সপ্তাহ যেতে না যেতে হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেল পিসি। মধুরা তখন লাভায়, হনিমুনে। পিসির মারা যাওয়ার খবরটা পেয়ে প্রথমেই আক্ষেপ হয়েছিল আঁচিলটার কথা ভেবে। ওটাও তো পুড়ে গেল। ছোটবেলায় গল্প শুনতে শুনতে তুলতুলে আঁচিলটায় হাত চলে যেত। মণিপিসি বলত, বেশি নাড়াচাড়া করিস না, খুলে পড়ে যাবে। ওটা আমার শ্বশুরবাড়ির পুঁটলি। যা দেওয়া থোওয়ার সব ওর মধ্যে ভরে দিয়ে তোর বাবার কাছে রেখে গেছে আমাকে।
ফোন বাজছে। চুলে জিঙ্ক অক্সাইড লাগাচ্ছিল মধুরা। ব্রাশ রেখে উঠে যায়। হ্যালো!
মা, আমি।
এই দেখো, আবার বাবার মোবাইল থেকে ফোন করছিস, খরচা হচ্ছে না?
ও কিছু হবে না। তুমি কী করছ এখন? কী মেকআপ নিচ্ছ, বাসনওলি না পোস্টম্যান?
বলব না। দেখি, তোরা এসে চিনতে পারিস কিনা। তোর বাবা কাকারা কোথায়? বাবা একজনের ইন্টারভিউ নিচ্ছে। ইন্দ্রকাকাকে অনেকক্ষণ দেখছি না। বোধহয় হারিয়ে
গেছে। প্রচণ্ড ভিড়। ইন্দ্রকাকা কলকাতার সব চেনে তো মা?
সব চেনে। তুই ফোন অফ কর। তাড়াতাড়ি বাবার কাছে যা। রাখছি।
আবার একা মধুরা। বাবানের মুখে ইন্দ্র হারিয়ে গেছে শুনে ক্ষণিকের জন্য হলেও, বুকটা মেঘশূন্য হয়েছিল। এখন আর মানুষ ইচ্ছে করলেই হারিয়ে যেতে পারে না। খেয়ালবশে ইন্দ্র হয়তো দেশের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেছে। তুমি এরকম আগেও হারিয়ে গেছ ইন্দ্ৰ। আবার হারিয়ে যাও কিছুদিনের জন্য অন্তত। আমি নিজেই সব অভীককে বলি। যদি মেনে না নেয়, সংসারের ডালপালাগুলো গা থেকে খুলে তোমার অপেক্ষায় থাকব— ভাবতে ভাবতে হোঁচট খায় মধুরা, এখনও তার মনে ইন্দ্রর জন্য জায়গা পড়ে আছে! এটাই কি প্রথম প্রেমের ঘোর? নাকি অনিশ্চয়তা থেকেই এসব কথা মাথায় আসছে? অভীক তো তাকে কম ভাল বাসে না। দূর মফস্সলের স্কুলে টিচারি করতে যেত মধুরা। ধকল সহ্য হচ্ছিল না। অভীকই তো বলল, ছেড়ে দাও। আমার রোজগারে চালিয়ে নেব।
আবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় মধুরা। দুটো ছোট্ট প্লাস্টিকের পাউচের মধ্যে তুলো ভরছে। এ দুটো দু’গালে রাখবে। প্লাস্টিকের পাউচগুলো ভীষণ কিউট। ওর মধ্যে আমেরিকার চকোলেট ছিল। ইন্দ্র এনেছে। পাউচ দুটো মুখে পুরে, আয়নায় ঝুঁকে পড়ে। আই ব্রো পেনসিল তুলে নেয়। বলিরেখা তৈরি করতে হবে।
বইমেলার মাঠে ইন্দ্র যখন ব্যাপারটা বলবে, কীরকম এক্সপ্রেশান হবে অভীকের? ও কি সত্যিটা যাচাই করতে তখনই গম্ভীর মুখে বাড়ির দিকে হাঁটা দেবে? পেছনে বাবান আসছে কিনা লক্ষই করবে না! কী করে বাড়ি ফিরবে বাবান! অনেক সম্ভাবনার কথাই মাথায় আসছে মধুরার, কোনওটাই তেমনভাবে কামড়ে ধরছে না। কারণ টোটাল সিচুয়েশনটাই ইন্দ্রর হাতে। তার আর কিচ্ছু করার নেই। কাচবিহীন গাঁধীজি মার্কা গোল চশমাটা ড্রেসিং টেবিল থেকে তুলে চোখে দিতেই চমকে ওঠে, অবিকল মণিপিসি লাগছে।
ডোরবেল বাজে। মণিপিসির মতো শ্লথপায়ে হেঁটে আইহোলে চোখ রাখে মধুরা। বেঢপ কোমরে জিন্স, ওপরে রঙিন টপ। ব্যস এইটুকু দেখেই মধুরা বুঝতে পারে পাশের ফ্ল্যাটের ঋতুপর্ণা। বলেছিল মড মেয়ে সাজবে। বেচারা শ্বশুর শাশুড়ির জন্য সালোয়ার কামিজও পরতে পারে না। বাইরে থেকে ঋতুর গলা পাওয়া যাচ্ছে, খোলো না বাবা, দেখি কী সেজেছ।
দরজা খুলে দেয় মধুরা। বিস্ময়ের চোখে ঋতুর চোখ বড় বড়। বলে, আরিব্বাস, কী মেকআপ! একদম চেনাই যাচ্ছে না! তুমি শিয়োর ফার্স্ট হবে মধুরা। ভেতরে আসবে তো? জিজ্ঞেস করে মধুরা।
একী, তোমার ভয়েসটাও যে পালটে গেছে। কীভাবে করলে এসব? মুখে কী পুরেছ দেখি? এইজন্যেই গলাটা অন্যরকম লাগছে।
ঘরে ঢুকে আসে ঋতু। আয়নার সামনে গিয়ে বলে, এবার আমার চুলটা স্টাইল মতো বেঁধে দাও তো। গোড়াতেই তোমার কাছে আসা উচিত ছিল। স্কুলে নাটক টাটক করাতে, তুমি ভাল সাজবে না তো কে সাজবে।
সাজ সাঙ্গ করে দু’জনে নিজেদের ফ্ল্যাট লক করে। লিফটের দিকে এগিয়ে যায়। ঋতুর বর, ছেলে, শ্বশুর শাশুড়ি সবাই মাঠে। লিফটে করে নীচে নামতে নামতে ঋতু বলল, মধুরা, তোমাকে বগলদাবা করে শাশুড়ির কাছে নিয়ে যাব। বলব, বুঝলেন মা, আজ থেকে এঁকেই আমি মাদার ইন ল করে নিলাম। আপনার থেকে অনেক সুইট।
দু’জনেই হাসতে থাকে। খাঁচাবন্দি হাসি মাটি ছোঁয়। লিফটের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে দু’জনে। পাঁচ ফ্ল্যাটে এঁটো খাওয়া বিড়ালটা সিঁড়ির গোড়ায় বসে ছিল, ওদের দেখে ঘাবড়ে গিয়ে দে দৌড়।
রোদে বিকেলের রং লেগেছে। মাঠে বেশ ভিড়। বাচ্চাদের হইচই, মাইকের আওয়াজ মিলেমিশে একাকার। ভিড় ভেদ করে মাঠের ঘেরা জায়গায় আসতেই ঋতু চেঁচিয়ে ওঠে, ওই দেখো মধুরা, আমার বর জিতছে। সঙ্গে সঙ্গে ধমক দেয় মধুরা, আস্তে, লোকে চিনে ফেলবে।
সত্যিই মাঠের মাঝখানে একটা মাত্র চেয়ার আঁকড়ে বসে আছে ঋতুর নিরীহ বর। পাশে দাঁড়িয়ে বি ব্লকের প্রফেসার সামন্ত। ঋতুর হাজব্যান্ডের সঙ্গে তর্ক করছে, সম্ভবত চেয়ারটার অধিকারের বৈধতা নিয়ে। ঋতু পাশ থেকে দৌড়োল বরকে সমর্থন করতে। তখনই মাইকে ঘোষণা হল, মিসেসদের ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ ইভেন্ট আর একটু পরেই শুরু হবে। পার্টিসিপেন্টরা একে একে ডায়াসে এসে সুপ্রিয়াদির কাছে নাম লিখুন, পাশে কী সেজেছেন উল্লেখ করুন। তারপর মাঠের মাঝখানে চলে যান।
মিনিট পনেরো কেটে গেছে। ডায়াস থেকে নেমেই একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়েছে মধুরা। মাঠের মাঝে ভিন্ন সাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে গৃহিণীরা! এক একজন তো দারুণ মেকআপ করেছে। বোসগিন্নি ট্যাক্সি ড্রাইভার। সুলেখাদি ট্রেনের হকার। সি ব্লকের মিমি পাগলি সেজে মাঠের ধুলোয় আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে, মেকআপ ভাল, তবে ওভার অ্যাকটিং। মোটামুটি যাদের চেনে মধুরা, সবাইকে বেশ ধরা যাচ্ছে। অনেককেই চেনে না। হিজড়ের মেকআপ নিয়েছে একজন, দারুণ অ্যাকটিং করছে। যদিও ওর পেছন পেছন ঘুরছে একটা বছর চারেকের ছেলে। নিশ্চয়ই ওরই ছেলে। মায়ের পিছু ছাড়েনি। হঠাৎ মেয়েটাকে চিনতে পারে মধুরা, অহনা না! নান্দীকারে অভিনয় করে। ওই মনে হয় ফার্স্ট হবে।
মধুরার অবশ্য কিছু হওয়া নিয়ে চিন্তা নেই। মাঠের মাঝখানে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি তার। তবে এটাও ঠিক এখনও পর্যন্ত তাকে দেখে কেউ চোখ থামায়নি। ছদ্মবেশটা আসল বেশদের সঙ্গে মিশে গেছে। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে হাউসিং-এর গেটে। ওরা কখন ফিরবে?
মাঠের মজায় মন বসাতে পারছে না মধুরা। মনটা পালিয়ে যাচ্ছে অতীতে। মনের চোখে ভেসে উঠছে পনেরো বছর আগের ঢাকুরিয়া লেক। টিভির মিউট-এর মতো সামনের দৃশ্য থেকে সমস্ত হইচই উধাও হয়ে গেল। কানে বাজছে একটা পাখির ডাক, টো টো টেউল টো টো টেউল… পাশে বসে ইন্দ্র। মধুরা বলছে, বলো তো কী পাখি?
ঠোঁট উলটে ইন্দ্ৰ বলে, কী জানি। পাখিটা তখন অন্যরকম ডাকে। যেন কথা বলে। বলো তো কী বলল?
অবুঝ মাথা নাড়ে ইন্দ্ৰ। ‘কেষ্ট গোকুল’ বলেই হাসতে থাকে মধুরা। আঙুল তুলে গাছের ডালে বসে থাকা পাখিটা দেখিয়ে বলে, বেনেবউ।
বাঃ, বেশ সুন্দর নাম তো!
তখন বেনেবউ নামের জন্মকথা শোনায় মধুরা। ছোটবেলায় মণিপিসি তাকে বলেছিল এক বেনেবাড়ির সাত ছেলের সাত বউ। সকালবেলাই সাত ছেলে কাজে বেরিয়ে যায়, ফেরে সেই সূর্য ডুবে গেলে। সাত ভাই একসঙ্গে খেতে বসে। সাত বউকে সাত রকম পদ রাঁধতে হয়। বউদের মধ্যে যার রান্না যেদিন খারাপ হয় সাত ভাইয়ের হাতে মার খায় সে। এত মিল ভাইদের মধ্যে।
একদিন ডাল রাঁধার ভার ছিল ছোট বউয়ের। তখনকার দিনে মাটির হাঁড়িতে রান্না হত। ছোটবউ ডালে যত হলুদ দেয়, কিছুতেই আর রং হয় না। কীরকম যেন ফ্যাকাশে দেখতে লাগে। জায়েদের ডেকে দেখায় ছোটবউ, কী যে করি দিদি, কিছুতেই রং আসছে না। তারাও দেখে সত্যিই তো ডাল সাদা হয়ে আছে। এদিকে ছোটছেলের যে চণ্ডালের রাগ। রান্না খারাপ হলে সেই সবথেকে বেশি চেঁচামেচি করে। থালা ছুড়ে দেয়। বউদিদের চ্যালা কাঠ দিয়ে মারে। গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়। সেই ছোটছেলের বউয়ের ডালে রং আসছে না! অন্য বউরা যে যার রান্নায় ফিরে যায়, তাদেরও কম ভয় নয়। আরও বারকতক হলুদ
দিয়ে ছোটবউ হাঁড়ির জলে তাকিয়ে থাকে, এবার ডালটার স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে। শেষে ভয়ে, মনের দুঃখে ডালের হাঁড়ি দু’হাতে তুলে নিজের মাথায় মেরে ভাঙতেই ছোটবউ পাখি হয়ে উড়ে যায়। সেই পাখিই বেনেবউ। শরীরের যে সব জায়গায় হাঁড়ির কালো দাগ লেগেছিল, সেখানে কালো ছোপ, আর বাকি ডালের হলুদ রং।
পাখি থেকে বউ হয়ে যাওয়া আজ বড় আকর্ষণ করে মধুরাকে। মন ফিরে আসে মাঠে। শেষ ইভেন্ট বলে একটু শৃঙ্খলা-ভঙ্গ হচ্ছে। এরিনার মধ্যে ঢুকে পড়ছে দর্শক। বহু পরিচিত মানুষই মধুরার সামনে দিয়ে চলে গেছে, এখন পর্যন্ত কেউ ডেকে কথা বলেনি। এত সহজে আত্মগোপন করা যায়! অকারণেই মনটা একটু হালকা লাগে। তখনই চোখে পড়ে, হাউসিং-এর গেট দিয়ে ঢুকে আসছে তিনজন। বাবান, অভীক, ইন্দ্র। চিলের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অভীকের মুখটা পড়ার চেষ্টা করে মধুরা। এতদূর থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ওরা এগিয়ে আসছে মাঠের দিকে।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়েও, বসে পড়ে মধুরা। বুকের মধ্যে যেন পায়রা ডানা ঝাপটাচ্ছে। ইন্দ্ৰ, অভীক দু’জনে চুপচাপ। বাবানটা মাঠের ভেতর ঢুকে এসে মাকে খোঁজে। একবার মধুরার ওপরও চোখ বুলিয়ে যায়, পায় না। তার মা তো এখন মণিপিসি, না বাবানের মণিদিদা হয়ে গেছে। চিনবে কী করে, তাকে তো কোনওদিন দেখেইনি।
অভীক, ইন্দ্র মাঠের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। খুঁজছে মধুরাকে। অভীকের মুখটা বেশ সিরিয়াস লাগছে, সেটা কি ক্লান্তিতে নাকি ঘৃণায়? তুলনায় ইন্দ্র অনেক রিল্যাক্সড। সব কিছু বলে হালকা হয়ে গেছে, ইন্দ্ৰ কাল চলে যাবে। তারপর? অভীক যদি আর কথা না বলে,
বাবান যদি ‘মা’ বলে আর না ডাকে! কতটা কষ্ট হবে আমার? ভাবতে ভাবতেই মধুরা দেখে, অভীক অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বাবানকে ডেকে নিচ্ছে। আর একবার সারা মাঠে চোখ বোলায় বাবান। চোখে হতাশা। ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে।
ইভেন্ট শেষ। ডায়াসের সামনে ভিড়। পাগলি সেজেছিল মিমি, ওই ফার্স্ট হয়েছে। সেকেন্ড অহনা। মাইক বলছে, এখানে দু’-একজনের নাম দেখছি, মেকআপের উল্লেখও আছে, অথচ তাদের আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না। দয়া করে তাঁরা যদি ডায়াসে এসে নিজেদের পরিচয় দেন ভাল হয়।
তার মানে মধুরার মতো আরও কেউ কেউ আছে যারা বেনেবউ হয়ে গেছে। ফিরতে পারছে না।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন হাউসিং-এর বাইরে চলে এসেছে মধুরা। কোথায় যাবে সে? বাপের বাড়ি বলতে এখন আর কিছুই নেই। দুই দাদা বাইরে চাকরি করে। বছরে একটা চিঠি দেয় কিনা সন্দেহ। মধুরাও দেয় না। সে তো ধরেই নিয়েছিল তার বাসা অটুট। অতীতের একটা ছোট্ট ভুল সব কিছু তছনছ করে দিল। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও প্রাণীর অতীত এত জীবন্ত হয় না। কিন্তু কী আশ্চর্য, বর্তমানে নিজেকে একটু বদলে নিতেই ওরা আমায় চিনতে পারল না।
সন্ধে নেমে গেছে। পাখিরা গাছে ফিরছে। মধুরাও ফেরে অনিশ্চিত বাসার দিকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেকেই, মধুরার সাজটা যে নকল খেয়ালই করছে না কেউ।
ডোরবেল টিপতে দরজা খুলল বাবান, কাকে চাই?
বুকটা ধক করে ওঠে, বাবান তাকে চিনতে পারল না! আলো অন্ধকার করিডর। হয়তো সেই কারণেই চিনতে অসুবিধে হচ্ছে। মধুরা কি ঘরে ঢুকে যাবে? কী হল, কাকে খুঁজছেন? কত নম্বর?
প্রচণ্ড অভিমানে চোখে জল এসে যাচ্ছে মধুরার। বাবানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অভীক, কাকে খুঁজছেন আপনি?
মধুরা কোনও উত্তর না দিয়ে ঘরে পা রাখে। ওরা অবাক হয়ে যায়। বাবান বলে, আরেঃ, মা তুমি! একদম চেনাই যাচ্ছে না। শিয়োর প্রাইজ পেয়েছ… আরও কী সব বলে যাচ্ছে ওরা। হাসাহাসি করছে নিজেদের মধ্যে। মধুরা হেঁটে যায় নিজের ঘরে। বাড়ির পরিবেশ বলছে, ইন্দ্ৰ এখনও কথাটা বলেনি। হয়তো কাল বলবে।
নিজের বিছানায় চুপচাপ বসে আছে মধুরা। ওরা ডাকাডাকি করছে। বাবান আসে ঘরে, ও মা, চলো। কিছু খেতে দাও।
মধুরার কোনও বিকার নেই। ছেলে খেতে চাইলে বুকের মধ্যে আকুলিবিকুলি ভাব হয়, আজ তার কোনও লক্ষণ নেই। কেন? মণিপিসির কোনও সন্তান ছিল না বলে?
বাবান চলে যাওয়ার পর অভীক আসে, কী ব্যাপার, এত চুপচাপ! মাঠে কিছু হয়েছে? একদৃষ্টে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে মধুরা। একটু সময় নিয়ে অভীক বলে, ও বুঝেছি, প্রাইজ পাওনি বলে, মুড অফ।
পুরনো বউয়ের মন ভাল করার জন্য আর বেশি সময় নষ্ট করে না অভীক। ও চলে যাওয়ার পর আসে ইন্দ্র। চাপাস্বরে বলে হোয়াটস রং মধুরা? হঠাৎ এরকম সিন ক্রিয়েট করছ কেন!
উত্তর দেয় না মধুরা। ইন্দ্র সুর পালটে বলে, আমি ভাবছি কথাটা অভীককে না জানানোই ভাল। তোমার জন্য নয়, আমিই সহ্য করতে পারব না, অভীক যদি হেসে উড়িয়ে দেয়। আমাদের বিয়েকে ছেলেমানুষি কাণ্ড বলে।
বুকের মধ্যে কলেজবেলার একটা মেয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। মধুরাকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। ঘরে কিছুটা সময় কাটিয়ে ইন্দ্রও চলে গেল। মধুরা পায়ে পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কাচবিহীন গোল চশমাটা খুলে মণিপিসিকে বলে, পাষাণী। নিজের জন্যেও কাঁদতে পারো না!
কথাসাহিত্য শারদীয় ২০০৩