রাক্ষস
স্টেশনে ঢোকার আগে রোজকার মতো খবরের কাগজ কিনছিল নন্দিতা, হকার বলরামের পাশে বসে থাকা ভবঘুরে জবা বলে উঠল, আমার বিয়ে, দিদিমণি, চাঁদা দিতে হবে কিন্তু।
বিস্ময়ে একটু থমকায় নন্দিতা। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, কবে বিয়ে? পাত্র কোথাকার? বলরামের পাশ থেকে উঠে আসে জবা। নন্দিতার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, সামনের বৈশাখেই ভাবছি বিয়েটা কবে নেব। পাত্র বিহারি।… একটু থেমে জবা বলে, বাঙালি বিহারি বিয়ে হতেই পারে, বলুন?
না হওয়ার কিছু নেই। তোদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে অসুবিধে না হলেই হল। নন্দিতার কথায় লজ্জা পায় জবা। বলে, না না, ও বাংলা বোঝে। বলতেও পারে একটু আধটু।
আপ প্ল্যাটফর্মে এসে পড়েছে দু’জনে। নন্দিতা যাবে ডাউনে। টিকিট কাটার ব্যাপার নেই। মান্থলি করা আছে। নন্দিতা রানিগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়ায়। বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়েছে। সংসারের নানান সমস্যা সামলাতে গিয়ে বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। প্রেমে বিশ্বাসভঙ্গের শিকারও হয়েছে একবার। এদিকে হাটেমাঠে ঘোরা মেয়েটার বিয়ের ঠিক হয়ে গেল!
তাকায় নন্দিতা, আজ লম্বা ঝুলের ফ্রক এবং যথারীতি আধভেজা। বাগানে, পুকুরে ঘুরে বেড়ায়। একটু ডিঙি মেরে হাঁটে, পায়ে খয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের চটি। বয়স আন্দাজ করা কঠিন। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে। কোন মূর্তিমান যে একে বিয়ে করতে রাজি হল, কে জানে। নন্দিতা জিজ্ঞেস করে, বিয়ে ঠিক করল কে?
ওভারব্রিজের সিঁড়িতে পা রেখে জবার দিকে একবার
ফের লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়েছে জবা। নন্দিতা বলে, লাভ ম্যারেজ? নিজেই ঠিক করেছিস?
সরলভাবে হাসে জবা। ওর কাঠখোট্টা চেহারায় অদ্ভুত এক লাবণ্য উঁকি মারতে দেখে নন্দিতা। এতেই স্পষ্ট হয় মেয়েটা সত্যিই উন্মুখ হয়েছে মধুযাপনের কামনায়।
জবা আজ সঙ্গ ছাড়ছে না। ওভারব্রিজের চাতাল ধরে চলেছে পাশাপাশি। সেটা হয়তো শুধুমাত্র চাঁদা আদায়ের জন্য নয়। আনন্দের খবরটা পছন্দের কারওকে জানাতে ভাল লাগছে, তাই। নন্দিতা যতদূর জানে মেয়েটার নিজের বলতে কেউ নেই। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এই কালীপাহাড়িতে। ঋতু অনুযায়ী কখনও নিমপাতা, কুল, আম, জাম, সজনে ফুল, ডাটা শাকপাতা ফেরি করে ঘুরে ঘুরে। নন্দিতাকে দেখলেই গছিয়ে দেয়। আজ ওর হাতে কিছু নেই, শুধু আনন্দের খবর আছে। ডাউন প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে
নন্দিতা বলে, নিজেরা যখন ভালবেসে বিয়ে করছিস, ঘাঘরবুড়ির মন্দিরে গিয়ে করলেই হয়। খরচার তো কিছু নেই। চাঁদা তোলার কী দরকার।
আহ্লাদের সুরে জবা বলে, আমাকে যারা ভালবাসে তাদের খাওয়াব। তোমাকেও আসতে হবে। চাঁদাও নেব।
আচ্ছা, সে হবেখন। বিয়ের দিনটা আগে ঠিক কর। বলে তড়িঘড়ি পায়ে সিঁড়ি ধরে নামতে থাকে নন্দিতা। কানে আসছে, ট্রেন ঢোকার শব্দ। জবা রইল দাঁড়িয়ে।
ট্রেনে উঠে উলটো দিকের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল নন্দিতা। অন্য দিন মাঝখানে থাকে, গল্প করে নিত্যযাত্রী বন্ধুদের সঙ্গে। কালীপাহাড়ি থেকে ওঠে তিনজন, অশোক, মীনাদি, সুনন্দ। ওরা দেখেছে, নন্দিতার সঙ্গে আসছিল জবা। ট্রেনে ওঠার আগে অশোক তাই জানতে চেয়েছিল, পাগলিটা পিছন ধরেছিল কেন? কী বলছে?
ও কিছু না। বলে এড়িয়ে গেছে নন্দিতা। শুভ খবর এত আগে থেকে পাঁচকান করতে নেই। লোকের নজর লেগে যায়। বেশ কয়েক বার সম্ভাবনা তৈরি হয়েও বিয়েটা হয়ে ওঠেনি নন্দিতার। চলন্ত ট্রেনের বাইরে এখন তার দৃষ্টি। দৃশ্য বলতে, কয়লার স্তূপ আর কালোমাঠ। ইতিউতি এক-দুটো ফুলে ভরা পলাশ, শিমূল চরম বিদ্রূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চৈত্রের রোদ এবং ঘোলাটে আকাশের মধ্যেও আজ কেন জানি হাওয়াটা তেমন শুকনো লাগছে না। জবার পোশাকের মতোই একটু ভেজা ভেজা।
জবা ফিরে এল খবরের কাগজের হকার বলরামের কাছে। ডাউন লোকাল থেকে নামা এক প্যাসেঞ্জারকে ম্যাগাজিন বিক্রি করে বলরাম জবাকে জিজ্ঞেস করে, দিদিমণিকে কত দিতে বললি?
আমি কিছু বলিনি। একশো-দুশো দেবে নিশ্চয়। দিদিমণির মন খুব ভাল। বলে বলরামের পাশে উবু হয়ে বসল জবা।
পঁচিশ বছরের হকার জীবনে বলরাম জবাকে দেখছে বারো-তেরো বছর তো হবেই। মেয়েটা যবে থেকে কালীপাহাড়ি স্টেশনে ঘাঁটি গেড়েছে, তখন থেকেই। জবার ব্যাপারে খানিকটা অভিভাবকের দায় অনুভব করে বলরাম। জবা অবশ্য সেটা বোঝে না। চলে নিজের মর্জি মতো। তবে বলরামকে খুব বিশ্বাস করে। জবা এখন আর প্ল্যাটফর্মে শোয় না। ঘর ভাড়া নিয়েছে রেললাইনের ধারে। ওর ইচ্ছে বিয়ে হবে ওই বাড়ির উঠোনে। বর টোপর মাথায় আসবে। বিহারি পাত্র কি টোপর মাথায় দিতে রাজি হবে?
দু’জন প্যাসেঞ্জার কাগজ কিনতে এল। তারা চলে যাওয়ার পর বলরাম জবাকে বলে, ছেলেটাকে একবার দেখালিও না। দেখলে বুঝতে পারতাম লোক কেমন।
দেখাব, ও বহুৎ লজ্জা পায়। একদিন আনছিলাম তোমার কাছে, মাঝরাস্তা থেকে পালাল।
কথাটা শুনে চিন্তা বাড়ে বলরামের, বিয়ের কথা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে কোনও ছেলে ভুলিয়ে ভালিয়ে জবার টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। মেয়েটার থেকে জোর করে টাকা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কালীপাহাড়ির সবচেয়ে বড় গুন্ডারও নেই। বলরাম বলে,
ছেলের বাড়ি থেকে যখন বিয়েটা মানছে না, তোকেই তো ঠাকুরমশাই ঠিক করতে হবে। গিয়েছিলি নাকি রঘু ভট্টাচার্যের কাছে?
গিয়েছিলাম। শালা মারতে এল। বলল, পাগলি ফাগলির বিয়ে আমি দিই না। ওর ভাইপোকে ধরলাম। সন্তুদা এখন বিয়ে ফিয়ে দিচ্ছে। বলেছে, পাঁজি দেখে ডেট জানাবে,
বৈশাখে বেশ ক’টা দিন আছে। চারটে অর্ডারও আছে সন্তুদার। ফাঁকা দিন দেখে জানাবে। এই হল জবা, পুরোহিতকে শালা বলে। বিয়ে দেওয়া হচ্ছে অর্ডার। এর বিয়ে নিয়ে চিন্তা হবে না তো কার নিয়ে হবে? সন্তু হয়তো ওর কথার কোনও গুরুত্বই দেয়নি। যা হোক একটা বলে ভাগিয়েছে। অভিভাবকহীন মেয়েটা বুঝতেই পারছে না, নিজেই নিজের বিয়ে দেওয়া কত কঠিন ব্যাপার। বোঝানোর জন্য বলরাম আলোচনায় যায়। বলে, বিয়েতে কত জনকে খাওয়াবি, লিস্ট করেছিস? কী খাওয়াবি, কত খরচ হবে…
কথার মাঝে জবা বলে, আমি তো শক্ত হিসেব পারি না, জানো। তুমি একটু খাতা পেনসিল নিয়ে কষো না। নেমন্তন্নের লিস্টটা আগে বলছি।
আলগা আগ্রহে নিজের হিসেবের খাতাপেন তুলে নেয় বলরাম। বলে, বলে যা।
জবা হাতের কড় ধরে বলতে থাকে, প্রথমে হচ্ছে, স্টেশনের ঠাকুমা। তারপর মুরগিচোর, চাওয়ালা রামকিশোরদা, পাতাখোর কানাই, লাল টমেটম পঞ্চানন, খ্যাপা গোপালের মা…
থামাতে বাধ্য হয় বলরাম। বলে, তুই শুধু নামগুলো বল বাকিটা আমি বুঝে নেব। হঠাৎ উঠে পড়ল জবা, বলল, দাঁড়াও, ডাক্তারবাবু ফিরছে। চাঁদার কথাটা বলে আসি।
খাতা নামিয়ে রাখে বলরাম। এই অস্থিরমতির ভাগ্যে যে কী আছে, ভগবান জানেন! রোদের তাপ চড়চড় করে বাড়ছে। বলরাম ছাতা খুলে মাথায় দেয়। জবার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়াটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে বলরামের, ভোরবেলা ট্রেন থেকে ডিলার এমনভাবে প্যাকেট ফেলল, দড়ি খুলে ছত্রখান হয়ে গেল কাগজগুলো। ডিলারকে গালাগাল দিতে দিতে কাগজ জড়ো করছে বলরাম, দেখে এক ঢাল চুলের বছর বারো-তেরোর ফ্রক পরা অচেনা মেয়ে তার কাগজগুলো গোছাতে লেগেছে।
কাজ শেষে হাত বাড়িয়েছিল মেয়েটা। বলেছিল, টাকা দাও। তোমার কাজ করে দিলুম।
উচ্চারণ শুনেই বলরাম বুঝেছিল মেয়েটা কলকাতার কাছাকাছি কোনও জেলার। সবিস্তার জানার জন্য বলেছিল, এইটুকু মেয়ে টাকা নিয়ে কী করবি! চ, আমার সঙ্গে চাপাঁউরুটি খাবি চল।
জবা রাজি হয়নি। বলেছিল, না, তুমি টাকা দাও।
মেয়েটি জেদি, হারিয়েও যায়নি। মেজাজ দেখেই মালুম হচ্ছিল। মাথা খারাপও নয়। কাজ বেশ গুছিয়ে করল। বলরাম বলেছিল, ঠিক আছে, টাকা পাবি, চা-ও খাবি আমার সঙ্গে। কত উপকার করলি আমার।
স্টেশনের বাইরে সুরথের চায়ের দোকানে এসে বসেছিল দু’জনে। বলরাম কথায় কথায় জেনে নিল মেয়েটার নাম। অনাথ আশ্রম থেকে পালিয়ে এসেছে। জায়গাটার নাম বলতে
পারল না। রাতে পায়ে হেঁটে ব্যান্ডেলে এসে ট্রেনে চেপেছে। ভোরের দিকে খুব খিদে পেয়েছিল বলে নেমে পড়েছে এই স্টেশনে।
জবাকে প্রথমে থানায় জমা দেওয়ার কথা মনে হয়েছিল বলরামের। মেয়েটার ডাগরডোগর শরীর দেখে ভয় পায়, যদি কোনও ক্ষতি হয়ে যায়। নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। টানাটানির সংসার। বউ মেনে নেবে না।
মঙ্গলামাসির ভাতের হোটেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল জবাকে। ফাইফরমাশ খাটবে, খাওয়া পরা চলে যাবে। ব্যস্ত হোটেল, কোলিয়ারির মজুররা কাস্টমার। মঙ্গলামাসি ডাকাবুকো মেয়েমানুষ, নজরে থাকবে মেয়েটা।
কিন্তু কোথায় কী! জবা ওখানে দু’দিনের বেশি টিকল না। চলে এল প্ল্যাটফর্মে। সেখানে তখন তিন জনের ঠিকানা, পাগল বুধিয়া, অন্ধ বুড়ো, এক পা কাটা বুড়ি। এদের সঙ্গে বেশ ক’টা কুকুর। বলরাম অনেক করে বুঝিয়েছিল জবাকে, রাতে প্ল্যাটফর্মে শুলে, যে-কোনও সময় বিপদ হতে পারে। মেয়েটা কথা শুনল না। স্টেশন এলাকা জুড়ে সমস্ত কাজ কারবারে হাত লাগিয়ে পয়সা কামাত। যেমন মাছ সবজিওলার মোট বয়ে দেওয়া। চুরির কয়লা ট্রেনে তোলা। ইচ্ছেমতো চায়ের দোকানে ঢুকে কাপ-প্লেট ধুতে বসা।
জবার ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বেগে থাকত বলরাম। এক মাসও হয়নি, আশ্রমের লোক এসে ধরে নিয়ে গেল ওকে। ঘটনার সময় ছিল না বলরাম। শুনে নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল। দু’মাস পর ফিরে এল জবা। আগের চেয়ে অনেক বেশি একরোখা দেখাচ্ছিল। জানাল, এবারও পালিয়ে এসেছে। আশ্রম তার একেবারে ভাল লাগে না। খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। পায়ে ছেঁচড়ে যাওয়া দাগ, গাছে উঠে বিশাল উঁচু পাঁচিল টপকেছে।
জবাকে আর কখনওই কেউ নিতে আসেনি। সেবার ফিরে নিজের ঘোরাঘুরির এলাকা বাড়িয়ে ফেলল। লোকের বাগানের কচি নিমপাতা, বেল, আম, জাম, খেতের সবজি চুরি করতে লাগল। জেলেরা পুকুরে জাল ফেললে যেচে পড়ে কাজে হাত লাগায়। দু’-চারটে মাছ পায় খাটনি বাবদ। কিছু মাছ লুকিয়ে গামছায় বেঁধে রাখে। ওর এই স্বভাবের কথা জেনেও লোকে ঘাঁটায় না। একবার মুখ ছোটাতে শুরু করলে চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে ছাড়বে। ইটপাটকেল ছুড়বে ধরতে এলে। মাছ সবজি নিয়ে বাজারে বসে যায় অথবা ঘুরে ঘুরে বেচে। প্যান্টশার্ট পরে রিকশা, ভ্যান রিকশাও চালিয়েছে। এইভাবে বেশ কিছু টাকাও করে নিয়েছে এতদিনে। টাকা কোথায় রাখে, কেউ জানে না। এখানকার বাসিন্দারা বাইরে থেকে আসা আত্মীয়বন্ধুদের দেখায় জবাকে। যেভাবে আঙুল তুলে দেখায় মন্দির, মসজিদ, কোলিয়ারি, ভাঙা নীলকুঠি…
প্ল্যাটফর্মে শোওয়ার কারণে একবারই বিপদে পড়েছিল জবা। ফাঁড়াটা ওর, নাকি যারা ওকে রেপ করতে এসেছিল, নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। ফ্রক পরা স্বাস্থ্যবতীকে প্ল্যাটফর্মে ঘুমোতে দেখে মাতালগুলো লোভ সামলাতে পারেনি। রাতের প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিল। ওরা তো জানত না, মেয়েটাকে ঘিরে যে সব কুকুর ঘুমিয়ে আছে, সেগুলো জবাঅন্তপ্রাণ। জবা ওদের সঙ্গে কথা বলে, খাওয়ায়, আদর করে। বহিরাগত মাতালদের পক্ষে এটাও জানা সম্ভব নয়, জবা লাইনের পাথর গামছায় বেঁধে, মাথার নীচে রেখে শোয়।
ফলে যা হওয়ার তাই হল, দলের কিছু লোক পালালেও দু’জনকে পেড়ে ফেলল জবা। সে একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড।
থানা পুলিশ, হসপিটাল সবই হল। জবার ডাক পড়ল কোর্টে। তার আর যাওয়ার সময় হল না। তারপর লোকগুলোর কী হল, জানা যায়নি। জবার রণচণ্ডী কাণ্ড ছড়িয়ে গেল লোকমুখে। সেই থেকে কেউ আর ওর কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না।
মেয়েটা যে কবে প্রেমে পড়ল, টেরই পেল না বলরাম। ছেলেটা নাকি কোয়ারডির সরকারি খনিতে কাজ করে। পাত্র হিসেবে তা হলে ভালই বলতে হবে। জবাকে কেন পছন্দ করল, বোঝা যাচ্ছে না। চলতি হিন্দিগানের সুর ভেঁজে হেথাসেথা ঘুরে বেড়ায় মেয়েটা। গলায় সুরও আছে। কালীপাহাড়ির কালোমাঠে রোদে পুড়ে কোকিলের মতো হেঁটে যায় জবা। কোকিলের সংসার হওয়া কি আদৌ সম্ভব?
জবা সেই যে পাল ডাক্তারকে ধরতে ছুটল, আর পাত্তা নেই। আবার অন্য কোথাও চলে গেছে। টো টো করা যে ওর স্বভাব। একেবারে রক্তে মিশে আছে।
সন্ধে হল, কৃষ্ণসায়রের ঘাট থেকে উঠে পড়ল বিসলা। পুকুর ধারে জবা বসে রইল একা। বিসলার সঙ্গে কিছুটা পথ সে যেতেই পারত। গেল না। চিন্তায় ভারী হয়ে আছে মাথা, উঠতে ইচ্ছে করছে না। বিসলার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে আছে জবা। আমকাঁঠালের বাগান পেরিয়ে কয়লাগুঁড়োর রাস্তা ধরল বিসলা। খানিক বাদেই ঝাঁকড়া বটগাছটার আড়ালে চলে গেল। ওখানেই বেআইনি খাদ। রাতভর ওই খাদে কয়লা কাটবে বিসলা। ওর কাজটা নিয়েই যত চিন্তা জবার। খনিটা চালায় এলাকার বিশাল গুন্ডা কিশোর সাউ। এরকম আরও অনেক খাদান আছে তার। পুলিশ, নেতাদের টাকা খাইয়ে রাখে। যখন পারে না দিতে, পুলিশ ধরে নিয়ে যায় মজুরদের। তিন-চারমাসের জন্য চালান দেয় জেলে।
জবা বিসলাকে বহু বার বলেছে, কাজটা তুমি ছেড়ে দাও। অন্য কারবার করো। রিকশা চালাও। আমিও তো কিছু রোজগার করি।
বিসলা শোনেনি। কয়লা কাটায় যা লাভ, অন্য কারবারে তা হয় না। হওয়ার কথাও নয় কালীপাহাড়িতে। চাষটাষ খুব কম হয়। মাঠের পর মাঠ কয়লার গুঁড়ো। প্রচুর চোরাই খনির গর্ত এখানে সেখানে। জবা প্রথম যখন এসেছিল এখানে, গাছপালা ছিল অনেক। পুকুরের ধারে মেছোবক, টিয়া পাখির ঝাঁক নামত ফসলের খেতে। লোকের কত ধরনের কারবার ছিল তখন। এখন একটাই, কয়লা। বাবুলোক কমে গেছে। একে একে চলে যাচ্ছে আসানসোলে। বাজারে পয়সাওলা খরিদ্দার হাতে গোনা। কুলিমজুরে ভরে গেছে এলাকা। আর আছে মোটরবাইকওয়ালা সুদখোর।
বিসলা এখানে এসেছিল সরকারি খাদানে কাজ করবে বলে। কাছেই জামতাড়ায় ওর দেশ। দেশের এক চাচা বলেছিল কাজ পাইয়ে দেবে। টাকাও নিয়েছিল বিশ হাজার। জমি বেচে, টাকা দিয়েছিল বিসলার বাবা। লোকটা চাকরি দিতে পারেনি। আশা দিয়ে রেখেছে এখনও। কোয়ারডির কুলি ধাওড়ায় দেশের সেই চাচার সংসারে থাকে বিসলা। চাকরির জন্য দু’মাস অপেক্ষার পর চোরাই খাদানের কাজে ঢুকে পড়েছে সে। রোজগার খারাপ না।
সপ্তাহে একদিন বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসে। বিক্রি করা জমি ওর বাবা হয়তো আবার কিনে নিয়েছে। এদিকে বিসলা দিনের আলোয় আর বেরোতে চায় না। মনে সব সময় ভয়, যদি পুলিশে ধরে। জবার খুব ইচ্ছে ছিল বলরামদার সঙ্গে বিসলার আলাপ করাবে। বিসলাকে খালি মিথ্যে করে বলতে হবে, সরকারি খনিতে কাজ করে সে। জবা তেমনটাই বলে রেখেছে, বলরামদাকে। বিসলা রাজি হল না। তার হেভি প্রেস্টিজ। স্কুলে অনেক দূর অবধি লেখাপড়া করেছে বিসলা।
কালীপাহাড়িতে এসে চাকরি না পেয়ে বিসলা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত। প্রায়ই দেখা হয়ে যেত জবার সঙ্গে। একসময় জবা খেয়াল করল, দেখা হয়ে যাওয়াটা ঘটনা নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে বিসলাই তার পিছনে ঘুরছে। জবা হয়তো পাঁচিল টপকে রেলকোয়ার্টারের গাছ থেকে আম পাড়ছে, এপাশ ওপাশ তাকাতে গিয়ে দেখে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিসলা হাঁ করে তার চুরি করা দেখছে। লুকিয়ে কারও পুকুরে খেপলা জাল মেরেছে জবা, গোটাতে গিয়ে জাল আটকেছে ঝোপকাঁটায়, গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বিসলা। জলে নেমে গিয়ে ছাড়িয়ে দিল জাল। জবা যখন মালসুদ্ধু ভ্যানরিকশা টানে, বাজারে জিনিস বিক্রি করে, তখনও দেখেছে বিসলা তাকে দূর থেকে লক্ষ করে যাচ্ছে। এক রাতে স্টেশনের বেঞ্চে শোওয়ার সময় দেখল, বিসলা ওভারব্রিজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ঠায় তার দিকে চেয়ে রয়েছে। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল জবার। দৌড়ে ওর সামনে গিয়ে বলেছিল, অ্যাই শুয়ার কা বাচ্চা, সারাক্ষণ পিছু পিছু ঘুরিস কেন রে? তোর ধান্দাবাজি বুঝি না ভেবেছিস।… আরও অনেক গালাগাল করেছিল বিসলাকে। এখন ভাবলে লজ্জা করে। বিসলা মাথা নিচু করে ঝাড় শুনল। তারপর মিনমিনে গলায় বলেছিল, তুমকো বহুত আচ্ছা লাগতা হ্যায় মেরা।
কথাটা শুনে মোটেই মন ভেজেনি জবার। এ ধরনের ঢঙের বুলি সে অনেক শুনেছে। ব্যাটাছেলেরা কত খারাপ হতে পারে তত দিনে জানা হয়ে গেছে তার।
মন ভিজল কিছুদিন পর। মুসলিয়া গ্রামে ঘুরপাক খেতে গিয়েছিল জবা। যদি লাউটা মুলোটা পাওয়া যায়, বাজারে বেচবে। দুপুর গড়াতেই আকাশ জুড়ে মেঘ করে এল। জবার একটা ব্যাপারে ভীষণ ভয়, বিদ্যুৎ চমকানো। কেন এই আতঙ্ক জানে না। ভয়টা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই, আকাশ কালো করে আসছে দেখে জবা পা বাড়িয়েছিল ডেরার দিকে। বড় রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ দৌড়োনোর পরই মেঘ চিরে আলোর ঝলকানি শুরু হল। নামল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। জবা বুঝল এভাবে বেশি দূর যেতে পারবে না। একবার করে বিজলি চমকাচ্ছে, খালি হয়ে যাচ্ছে বুক, রাস্তা থেকে খানিক দূরে মাঠের মধ্যে একটা পোড়োবাড়ি দেখে ঢুকে পড়েছিল সে।
লাভ কিছু হল না। বাইরে থেকে বোঝা যায়নি, বাড়ির ছাদ প্রায় পুরোটাই খসে গেছে। দেওয়াল ঘেঁষে কোনওক্রমে মাথা বাঁচাচ্ছিল জবা। আকাশে বিদ্যুৎ চমকেই যাচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে বিজলির ফলা এখনই গিঁথে ফেলবে জবাকে। কাছাকাছি ঘনঘন বাজ পড়ার আওয়াজ। জবা কুঁকড়ে গিয়ে কাঁপছে। সেই সময় বড় করে আলোর চমকানির মধ্যে দেখেছিল, বিসলা লাফিয়ে ঘরটাতে ঢুকল। পেটানো চেহারা, জামাপ্যান্ট ভিজে লেপটে গেছে শরীরে। শিয়রে শমন, বুঝতে অসুবিধে হয়নি জবার। বিসলা তাকে ছেড়ে দেবে না।
অনেক দিন ধরে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। ঘুরে আঘাত করার ক্ষমতা জবার নেই। ঝড়বাদলা সব সাহস শুষে নিয়েছে। মুষল ধারায় আবছা হয়ে থাকা চিতাবাঘের মতো শরীরটা যখন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল জবার চোখে, ছিটকে পোড়ো বাড়িটা থেকে বেরোতে যায়, হোঁচট খেয়েছিল প্রচণ্ড।
তারপর আর কিছু মনে নেই। ঘোর কাটল ওষুধের দোকানের বেঞ্চ-এ। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল আর মাথায় ব্যান্ডেজ। ভারী মাথাটা ঘুরিয়ে দেখেছিল দোকানের চাতালে ভেজা শরীরে উবু হয়ে বসে আছে বিসলা। দোকানি পরেশদা বলল, ওই ছেলেটা ছিল বলে বেঁচে গেলি। রক্ত থামছিল না। মাথায় তিনটে সেলাই হয়েছে।
বাইরে বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। অ্যাসবেস্টাস চুঁইয়ে পড়ছে জল। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে গা থেকে জল ঝাড়ছিল কাক।
রিকশা করে স্টেশনে ফিরতে ফিরতে ভাব হয়ে গেল বিসলার সঙ্গে। জানা গেল বিসলা ওকে সব সময় ফলো করে। পোড়ো বাড়িতে সেই কারণেই উদয় হয়েছিল।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রিকশায় আসতে গিয়ে কী যে হয়ে গেল জবার, তখনই ঠিক করে নেয় বিসলাকেই বিয়ে করবে। সেদিনই অবশ্য বিসলাকে সে কথা জানায়নি। ক’দিন আদাড়ে বাদাড়ে মাঠে তেপান্তরে একসঙ্গে ঘোরার পর বিসলাকে বলেছিল, শুধু ঘুরলেই হবে না। বিয়ে করতে হবে কিন্তু।
বিসলা এক কথায় রাজি। বিয়ে ব্যাপারটা যে বেশ ভাল কিছু, ছোটবেলায় হোমে থাকতে বুঝেছিল জবা। ফি বছর হোমের একটা-দুটো দিদির বিয়ে হত। বাইরের কোনও দয়ালু মানুষ বিয়ে করে নিয়ে যেত তাদের, কনে বিদায়ের সময় দিদিরা খুব কাঁদত। ক’দিন পরেই হোমের দিদিমণিদের সঙ্গে দেখা করতে আসত হাসিমুখে। ওই হাসি দেখেই জবা আন্দাজ করতে পারত, বিয়ে খুব সুখের জিনিস।
বিয়ে করতে হলে হোমে থেকে বড় হতে হবে। সে ধৈর্য জবার ছিল না। আশ্রমের ছাদে উঠলে বাইরের রাস্তা। গাছপালা, বাড়ি, গাড়ি, ফেরিওয়ালা তাকে চুম্বকের মতো টানত। হোমে বড্ড শাসন, পেট ভরে খেতে দেয় না। মারে। বাইরে এত কড়াকড়ি নিয়ম নেই, প্রথম বার পালিয়ে বুঝেছিল জবা। তাই দ্বিতীয় বার পালাতে বেশি সময় নেয়নি। ঘর সংসারের আশা অবশ্য ছেড়ে দিয়েছিল। ছানাপোনাসুদ্ধু কোনও স্বামী-স্ত্রীকে রাস্তায় বা স্টেশনে দেখলে, আকুল হয়ে চেয়ে থাকত। জানত, এরকম দিন তার আসবে না।
বিসলা কথা দিল সরকারি খনিতে চাকরি হলেই বিয়ে করবে। একদিন বাসে করে নিয়ে গেল ওর দেশের বাড়ি জামতাড়ায়। বিয়ের পর জবাকে তো ও বাড়িতেই থাকতে হবে। কিন্তু বিসলার বাড়ির লোক দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল দু’জনকে। বেজাতে বিয়ে দেবে না। বলরামদা একথা শুনে বলেছে, তোদের ভাষা আলাদা, বেজাত হতে যাবে কেন।
জবার এত সব মাথায় ঢোকে না। শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হবে না বুঝে স্টেশন ধারে আলুওয়ালা রাজুদার গুদাম ঘরটা ভাড়া নিয়েছে। ফাঁকাই পড়ে ছিল জায়গাটা। রাজুদার ব্যাবসা অনেক পড়ে গেছে। টালির চাল, ইটের গাঁথনির ঘর, পরিষ্কার করে নিয়ে জবা এখন ওখানেই থাকছে।
সরকারি চাকরিটা হচ্ছে না দেখে বিসলা চোরাই খাদানে মাল তোলা শুরু করল। জবার ভীষণ আপত্তি। বলেছে, অ্যাক্সিডেন্টের ভয় আছে, পুলিশে ধরতে পারে। কী দরকার ওসব কারবার করার। ট্রেনে হকারি করো। বাজারে মাছ বেচো।
বিসলা বলেছে, ইঁহা জমিন কা উপর মে মাল নেহি হ্যায়। নীচে বহুত হ্যায়। হাম ঘরবালো কো দিখা দেঙ্গে বিসলা কিতনা কামা সাকতা হ্যায়।
দেখিয়েছে বিসলা। হপ্তায় একবার করে দেশের বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসে। তাদের এখন আর কোনও আপত্তি নেই জবাকে ঘরের বউ করতে। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, বিসলার কাজটা জবা মেনে নিতে পারছে না। আর বিসলার কাজ না থাকলে জবাকে মানবে কেন শ্বশুরবাড়ির লোকে। এই নিয়ে ক’দিন ধরেই তর্কঝগড়া চলছে বিসলার সঙ্গে। অবশেষে বিসলা রাজি হয়েছে কাজটা ছেড়ে দিতে। আলুওয়ালা রাজুদার সঙ্গে বিসলার কথা বলিয়ে দিয়েছে জবা। আসানসোলের মুনশিবাজারের আড়ত থেকে আলুপেঁয়াজ নিয়ে এসে বাজারে বসবে বিসলা। রাজুদা বলেছে, হাজার পাঁচেক হাতে নিয়ে কারবারে নামতে। সেই টাকা জোগাড়ের জন্যই বিসলা এখনও খনিতে নামছে।
সন্ধে উতরে গেল। মাইকে ভেসে আসছে চৈতার ভজন। চৈত্রমাস জুড়ে বিহারি মজুররা খোল করতাল বাজিয়ে জটলা হয়ে গান গায়। কৃষ্ণসায়রের ঘাট থেকে উঠে পড়ল জবা। ওপারে ঝোপঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে। জবার খুব ইচ্ছে বিয়ের দিন বাড়িটা টুনি লাইট দিয়ে সাজাবে। তার পছন্দের লোকজন দেখতে আসবে তাকে। খাওয়ানো হবে বেঞ্চ, টেবিলে। মাইক বাজবে। খুব ধুম হবে সেদিন। সন্তুদা বিয়ের দিন পাকা করেছে, বৈশাখের ছাব্বিশ তারিখ। জবাকে অনেকেই চাঁদা দিয়েছে। আরও দেবে। বলরামদা বলেছে, দেখিস, লোকের টাকা নিয়ে কারবার। তোর লাভার না ডোবায়। এখনও তো চোখের দেখা দেখলাম না ছেলেটাকে।
কী করে দেখাবে জবা, কয়লাচোরটা যে লোকজনের সামনে আসতে চাইছে না। আজও একবার বলল, বিয়ের দিন পেছোতে। পাঁচ হাজার জমা হতে এখনও অনেকটাই বাকি। জবা সাফ বলে দিয়েছে, বিয়ে ওই দিনেই হবে। তার একহপ্তা আগে তুমি ছেড়ে দেবে কাজ। ঘর খরচা চালাব আমি।
রাস্তায় উঠে এল জবা। বটগাছের পিছনে বাঁশে বাঁধা কপিকল দেখা যাচ্ছে। ওখানেই বিসলাদের খনি। পাতকুয়োর মতো গর্ত। আওয়াজ আসছে কপিকলের। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে লরি। মাটির নীচ থেকে কয়লা তুলে সঙ্গে সঙ্গে বোঝাই হচ্ছে। ব্যাটারির বাতিতে দেখা যাচ্ছে সব কিছু। পুলিশ এলেই নিভে যাবে আলো।
খনির গর্ত কিছুটা নেমে গিয়ে কোন দিকে কত দূর বেঁকে গেছে, কে জানে! ভাবার সঙ্গে সঙ্গে গা শিরশির করে ওঠে জবার, পিছিয়ে আসে চার পা। বিসলা পায়ের তলায় নেই তো? বিশাল পাপ লাগবে জবার। আর ক’দিন পরেই বিসলার সঙ্গে বিয়ে হতে যাচ্ছে তার।
কাল জবার বিয়ে। নিজেই নিজের বিয়ে দেওয়া যে কত ঝকমারির কাজ, হাড়ে হাড়ে
টের পাচ্ছে জবা। এমনিতেই তার ভাড়াবাড়িটা পাড়া থেকে বাইরে। ভ্যানরিকশা করে মালপত্তর নিজেই টেনে আনছে বাড়িতে। এই যেমন খানিক আগে পড়তি বাজার থেকে সবজিপাতি নিয়ে এল। টাকা লাগেনি, বাজারওয়ালারা দিয়েছে। কাল সবাই খেতে আসবে। ভ্যানরিকশাটা ক’দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছে জবা। ভ্যানওয়ালাকে দিয়ে টানাতে গেলে অনেক টাকা বেরিয়ে যাবে। বাজে খরচ জবা একেবারে করবে না। বিয়েটা একটু জাঁকজমক করে করার শখ ছিল বলে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। বিসলা ছেড়ে দিয়েছে খনিতে নামা। টাকা হাতে যা জমেছিল, সেইটুকু নিয়েই আসানসোল থেকে আলু কিনে এনে বাজারে বসছে। বিক্রিবাটা তেমন হচ্ছে না। আপাতত জবাকেই দু’জনের পেট চালাতে হবে।
বাড়ির সামনে মাটির রাস্তায় মেরাপ করা গেট হয়েছে। ঘড়াঞ্চি লাগিয়ে সেখানে লাইট ফিট করছে উত্তমদা। চোখ কুঁচকে এখন সেটাই দেখছে জবা। মাথার ওপর গনগনে রোদ। লাইট আজ না লাগালেও চলত। কাল কালীপাহাড়িতে আরও চারটে বিয়ে, উত্তমদা কাজ এগিয়ে রাখছে। সাউন্ডবক্স এখনও এসে পৌঁছোয়নি। ওটাই বরং আগে দরকার। কাল ভোর থেকে সানাই চালিয়ে দেবে জবা। আলো জ্বলবে তো বিকেলবেলা। ঘড়াঞ্চির ওপরে থাকা উত্তমের উদ্দেশে জবা বলে, কই গো, তোমার মাইক তো এখনও এল না।
উত্তম জবার দিকে ঘাড় ফেরাতে গিয়ে কিছু একটা লক্ষ করে থমকে যায়। জবা অনুসরণ করে উত্তমের দৃষ্টি। দেখে, স্টেশনরাস্তায় কিছু লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে। উত্তম বলে, কী হয়েছে বল তো?
জবা কোনও উত্তর করে না। পায়ে পায়ে এগোতে থাকে পাকারাস্তার দিকে। লোকগুলোর দৌড়োনোর মধ্যে সাইরেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে জবা। কান দিয়ে শুনছে না, মনে বেজে উঠছে বিপদ ঘণ্টি। বে-আইনি খনির দুর্ঘটনার খবর নিঃশব্দেই বেজে ওঠে। এখানে আসার পর থেকে এরকম অভিজ্ঞতা দু’বার হয়েছে জবার। উত্তমদাও বুঝেছে, নিশ্চিত হতে পারছে না।
একপাল লোকের সঙ্গে জবাও এখন দৌড়োচ্ছে। কু-ডাকছে মনে। ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছে কোয়ারডির পাশে চোরাই খনিতে ধস নেমেছে। বিসলা ওখানেই কাজ করত। আজ বাজারে বসেনি বিসলা। মাঝে আরও দু’দিন ডুব মেরেছিল। চেপে ধরেছিল জবা, কোথায় গিয়েছিলে?
স্বীকার করেছিল বিসলা। বলেছিল, ডবল মজুরি দেবে শুনে খনি কাটতে গিয়েছিলাম। প্রচুর গালাগাল দিয়েছিল জবা। বিসলা কি আজও ডবল টাকার লোভে নেমেছিল রাক্ষসের পেটে?… গলা শুকিয়ে যাচ্ছে জবার। বিসলাকে চোখে না দেখা অবধি শান্তি নেই।
অনেকটা এলাকা জুড়ে ধস নেমেছে। এসে গেছে পুলিশ। জমা হয়েছে প্রচুর লোক। জবা ভিড়ের মধ্যে খুঁজে যাচ্ছে বিসলাকে। দুটো বড়ি তোলা হয়েছে। জবা দেখে নিয়েছে, বিসলা নয়। কিন্তু কোথায় গেল মানুষটা! এত বড় একটা ঘটনা শুনে এখানেই চলে আসার কথা।
হঠাৎই জবা দেখতে পেল বিসলার দেশওয়ালি চাচাকে। কীরকম যেন গুম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এর ধাওড়ায় থাকত বিসলা। সরকারি খনিতে চাকরি দেবে বলেছিল এই লোকটাই।
জবার চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে চাচা। সরে পড়ার ধান্দা করছে, দৌড়ে লোকটার সামনে যায় জবা। জানতে চায়, বিসলা কোথায়?
দেশ গ্যায়া। বলে লোকটা।
জবা জিজ্ঞেস করে, কখন গেল? আমাকে তো কিছু বলেনি।
উসকা পিতাজিকা তবিয়ত খারাপ হ্যায়! খবর আতেহি চল গ্যায়া সুবহ।
উত্তরের মধ্যে তেমন জোর নেই। জবার কেন জানি মনে হচ্ছে লোকটা মিথ্যে কথা বলছে। বুকের ফাঁকা ভাবটা বেড়ে চলেছে ক্রমশ। পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে গর্তের মুখে। গর্তটা এখন আর গোল নেই। মাথার সিঁথির মতো লম্বা হয়ে ধসে পড়েছে মাটি। জবা বড় পুলিশের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা মাতব্বর গোছের লোক পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, এই দু’জনেই নেমেছিল স্যার। আমরা খোঁজ নিয়েছি, আর কেউ নামেনি।
বড় পুলিশ মাথা নাড়ছে। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। জবাও জানে, পুরো ঢপ। খনিতে দু’জন শুধু নামে না। একসঙ্গে অনেকে ঢোকে। আশপাশে চোখ ঘোরাতে গিয়ে জবার দৃষ্টি থামে একটা ঝোপের গোড়ায়। কয়েক জোড়া চপ্পল দেখা যাচ্ছে না!
দৌড়ে যায় জবা। তিনজোড়া টায়ার কাটা চটি, একটা বাহারি। দামড়ার হাট থেকে বিসলাকে বাহারি চটিটা কিনে দিয়েছিল জবা। লাফিয়ে গিয়ে চটিটা তুলে নেয় হাতে। পুলিশের দিকে তাকিয়ে জবা চিৎকার করে বলে, স্যার, ভেতরে আরও বড়ি আছে।
কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল জবার ওপর। মজুর টাইপের কেউ। জবার হাত থেকে চটি ছিনিয়ে নেবে সে। বলছে, ইয়ে মেরা হ্যায়। ছোড় শালি। ছোড় না…
জবা কিছুতেই দেবে না। ঝটাপটি লেগে গেল। বিসলার চটি আগলে রাখার মাঝেই জবা লক্ষ করল, বাকি চটিগুলো কখন যেন উধাও হয়ে গেছে।
জ্যৈষ্ঠের পড়ন্ত বিকেল। বাতাসে রোদপোড়া গন্ধ। আপ-লোকাল থেকে স্কুল ফেরত নামল নন্দিতা। রিকশা স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে থমকে গেল পা। রিকশা দুটো, একটার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জবা। মেয়েটাকে প্রায় একমাস পর দেখল নন্দিতা। বেচারির বিয়েটা হয়নি। বিয়ের ঠিক আগের দিন বে-আইনি খনির নীচে মাটিচাপা পড়ে মারা গেছে ওর প্রেমিক।
নন্দিতাকে দেখে নিয়েছে জবা, টেনে আনছে রিকশা। সে নিশ্চিত, তার রিকশাতেই উঠবে নন্দিতা। রিকশা চালানো জবার নানা কাজের মধ্যে একটা। এই সময় প্যান্টশার্ট পরে। আজ পরেনি, হাঁটুঝোলা ফ্রক পরনে।
ভারী অস্বস্তি নিয়ে জবার রিকশায় ওঠে নন্দিতা। কোনও মেয়ের রিকশা চালানোটা মেনে নিতে পারে না সে। তার ওপর মেয়েটা এখনও শোক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ওর চেহারা অন্তত তাই বলছে।
স্টেশন রাস্তা ধরে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে রিকশা। মমতাহীন গ্রীষ্মের বাতাস ছুঁয়ে
যাচ্ছে দু’জনকে। জবা আজ বড়ই চুপচাপ। আগে বকবক করে কান ঝালাপালা করে দিত। এরকমটা হওয়াই অবশ্য স্বাভাবিক। কাগজের হকার বলরাম নন্দিতাকে জানিয়েছে ভাবী বরের দেহ যে ধসের নীচে চাপা পড়ে আছে, ছেলেটার চটি দেখেই জবা সেটা টের পায়। চটিটা কেড়ে নিয়েছে স্থানীয় এক মজুর। বলছে, ওটা তার চটি।
খনির মালিককে বাঁচাতে লেবারটা এরকম বলেছে। মালিক জেলে গেলে, কাজ যাবে তার। জবা প্রেমিকের বাড়ি গিয়ে জানায়, তাদের ছেলে চাপা রয়েছে মাটির নীচে।
তারা মানতে চায় না। ছেলে নাকি গেছে কলকাতায়। নন্দিতা বলরামের কাছে জানতে চেয়েছিল, সত্যিটা কী?
বলরাম বলেছে, সত্যিটা সকলেই জানে। জ্যান্ত কবর হয়েছে ছেলেটার। আসলে ছেলেটার ভাই এবার চোরাই খনিতে কাজে ঢুকেছে। বাড়ির লোক যদি বড় ছেলের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে হইচই করে, ছোটটার কাজ চলে যাবে।
এই তো এখানকার অবস্থা। দেশের জনসংখ্যা একই রইল, সরকার কিছু জানতে পারল না। প্রতারক, প্রতারিত একই দলে চলে গেলে, কীই বা করার আছে! জবা নাকি টানা পুলিশের কাছে দরবার করে চলেছে। বলছে, বডিটা অন্তত একবার বার করে দেখাও।…
পুলিশ বলছে, ছেলেটা যে নিখোঁজ, বাড়ির লোক তো সেটা মানছে না। কমপ্লেন করেনি কোনও। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।
বলরামের ভীষণ চিন্তা জবা বেশি জেদ দেখাতে গিয়ে কয়লা মাফিয়ার হাতে খুন না হয়ে যায়।
দূরে ছাতাপাথর মোড়ের পিছনে সূর্য ডুবছে। চারপাশে হলুদ আলোয় উড়ছে ধুলো। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে বাসায়। রিকশাটা কষ্ট করে টানছে জবা। খাওয়া দাওয়া মনে হয় ঠিকমতো করে না। ওকে বেশ রোগাও লাগছে আজ। নন্দিতা জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে, তোর ওই ছেলেটার ব্যাপারে কোনও বিহিত হল?
প্যাডেল মারতে মারতে শুধু মাথা নাড়ে জবা। নন্দিতা প্রসঙ্গ থেকে একটু সরে এসে বলতে থাকে, আর এখানে থাকা যাবে না, বুঝলি। কয়লা কেটে কেটে পুরো উইয়ের ঢিবি হয়ে গেছে এলাকাটা। কোনওদিন না সবসুদ্ধু বসে যায়। এই তো গত পরশু, তালপুকুরিয়ার সব জল মাটির তলায় নেমে গেল। আমরা তো দু’-এক মাসের মধ্যে এখানকার বাড়ি বিক্রি করে আসানসোলে চলে যাচ্ছি।
জবা কোনও উত্তর করে না। উকিলপাড়া এসে গেছে। ডান দিকের রাস্তায় ঢুকলেই নন্দিতাদের বাড়ি।
রিকশা থেকে নেমে নন্দিতা ভাড়া দিতে যায়, জবা বলে ওঠে, রেখে দিন। আপনি তো আমার থেকে টাকা পান।
কেন রে? কীভাবে! বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চায় নন্দিতা।
জবা বলে, বিয়েটা তো হল না। দুশো টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। ভাড়া খেটে শোধ করে দেব।
নন্দিতা জবার একটা হাত তুলে টাকাটা গুঁজে দেয়। বলে, তুইও আসানসোলে চলে চ।
এখানে থেকে কী করবি! সবাই একে একে চলে যাবে।
টাকাটা ফ্রকের বুকে ঢুকিয়ে নিয়ে রিকশা ঘুরিয়ে নেয় জবা। প্যাডেল মেরে মেন রাস্তায় ওঠে। ঠিক করে একবার তালপুকুরিয়ায় যাবে। পুকুরটা শুকিয়ে গেছে, লোকমুখে শুনেছে। দেখা হয়নি।
ঘাঘরবুড়ির মন্দির পেরিয়ে জবা রিকশা নিয়ে ঢুকে পড়েছে সরু রাস্তায়। কিছু দূর যেতেই পথ আটকাল কয়লা পাথর, ঝোপজঙ্গল। রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে যায় জবা। শিরীষগাছের নীচে এসে পুকুরটা দেখে বুকে জোর ধাক্কা লাগে, যেন কালীপাহাড়ির চোখ। জবার মতোই কেঁদে কেঁদে শুকিয়ে ফেলেছে সমস্ত জল। পুকুরটার মতো জবাও কালীপাহাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। এখানকার মাটির তলায় রয়ে গেছে তার বড় আপনার জন। অনাথিনী জীবনের একমাত্র সম্বল।
শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১১