সহচরী

সহচরী

দুপুর পুড়ে বিকেল হয়েছে আলিপুরে। ফোন বাজছে। জানলাবদ্ধ ঘরে সোফায় মাথা হেলা দিয়ে আছে সায়নী। ফোনটা তুলছে না। ও জানে এটা ঘোস্টকল। কী করে বুঝল! ভুতুড়ে ফোনের রিং-টোন তো আলাদা হয় না। তা হলে কি নির্দিষ্ট একটা সময়ে ফোনটা আসে? তাও নয়। তবু সায়নী নিশ্চিত এটা সেই ঘোস্ট কল। বেশ কিছুদন হল বাড়িতে এই উপদ্রবটা শুরু হয়েছে। সায়নী ফোনটা ধরে ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে-সঙ্গে ও প্রান্ত নামিয়ে রাখে। মায়ের ক্ষেত্রেও ঘটে তাই। সায়নী মাকে বলে, কে বলো তো?

কেউ একটা হবে। মানুষের যে কতরকম খেয়াল! নির্লিপ্ত মুখে উত্তর দেন মা। সায়নী বুদ্ধি দিয়েছিল, ফোনে সি এল আই কানেকশন করলে হয় না, নম্বরটা ধরা যাবে। লাভ হবে না। এই ধরনের ফোন যারা করে, আটঘাট বেঁধেই করে।

একটু থেমে মা বলেন, ছেড়ে দে, অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। একটা সময় আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে।

মা ভীষণ কুল। যে কোনও সিচুয়েশনই ঠান্ডা মাথায় ট্যাল করেন। একেই বোধহয় বলে ম্যাচিওরিটি। সায়নী এতটা পারে না। একটা সময় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। আজ যেমন কলেজে বাঁধটা চুরমার হয়ে গেল।

ফোনের আওয়াজ থেমে যায়। সায়নী একবার ভাবে রিসিভারটা নামিয়ে রাখবে। কারণ, ফোন না ধরলে খানিক বাদেই আসে কল। এরকম বারকয়েক এসে একসময় থেমে যায়। আবার হয়তো দু’চারদিন পরে এল। সায়নী বাইরে থাকলে মাকে নির্ঘাত অনেকবার ফোনটা রিসিভ করতে হয়। পরে সে নিয়ে কোনও বিরক্তি প্রকাশ বা আলোচনা করেন না মা। রিসিভার নামিয়ে রাখতে গিয়েও পিছিয়ে আসে সায়নী, পরখ করবে তার ধারণা ঠিক কি না। কী করে জানি বুঝতে পারে এটাই সেই কল। আজ যদি আবার আসে ফোনটা, খুব করে লোকটাকে দু’-চার কথা শুনিয়ে দেবে সায়নী। অভদ্র লোকটা নিশ্চয়ই জানে এ-বাড়িতে শুধু দু’জন মহিলাই থাকে। তাই এত সাহস। এমনিতেই সায়নী আজ জীবনের চরম বাঁকের সামনে দাঁড়িয়ে। তার মাঝে এসব ছ্যাবলামি, অসহ্য! নিজের ভাবনায় সামান্য হোঁচট খায় সায়নী, আমি কেন ধরেই নিচ্ছি, যে ফোন করে সে একজন পুরুষ। মহিলাও তো হতে পারে। অর্ণবের আচরণ কি আমায় শেষমেশ পুরুষ বিদ্বষী করে দিল! আড়ষ্ট করে দিল চেতনার অর্ধাংশ।

দু’হাতে চুলে আঙুল চালিয়ে সোজা হয়ে বসে সায়নী। না, এত সহজে দুর্বল হয়ে পড়লে চলবে না। অর্ণবের সাধ্য নেই সায়নীর ক্যারেকটার-প্যাটার্ন চেঞ্জ করে দেয়। সত্যি বলতে কী,

মা-ও তো বলতে গেলে বাবার ভালবাসা, সাহচর্য থেকে বঞ্চিত। কই, মায়ের এক্সপ্রেশনে সে সবের তো কোনও ছাপ নেই। পুরুষমাত্রই খারাপ, এরকম কোনও অভিযোগ করেন না মা। বরং সায়নী যেদিন প্রথম অর্ণবকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল, ভয়ে ভয়ে ছিল খুব। কী জানি, মা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করেন! হয়তো বাবার প্রাপ্য শ্লেষ, রাগ সব অর্ণবের উপর এসে পড়বে। অবচেতনে এমনই একটা আশঙ্কায় অল্প বয়স থেকেই ভুগত সায়নী। তাই হয়তো সিরিয়াস অ্যাফেয়ারে জড়াতে সময় নিয়েছিল। দু’-চারটে ক্যাজুয়াল ছেলে বন্ধু ছিল তার। অত্যন্ত মাপ করে তাদের সঙ্গে মিশেছে, বাড়িতে কখনওই আনেনি। অর্ণবকে আনতেই হবে। ওকেই লাইফ পার্টনার করবে ভেবে রেখেছে সায়নী। মাকে সেই ইঙ্গিত দিতেই অর্ণবকে নিয়ে আসা। মা কিন্তু আনএক্সপেক্টেড ভাল ব্যবহার করলেন অর্ণবের সঙ্গে। জানতে চাইলেন, বাড়িতে কে কে আছেন? কেরিয়ার নিয়ে কী ভাবছে অর্ণব? উত্তরে অর্ণব বলেছিল, আর বলবেন না কাকিমা, বাড়ির অমতে ঝোঁকের মাথায় প্রায় জেদ করে ফাইন আটর্স নিয়ে পড়ছি। ফাইনাল ইয়ারে এসে মনে হচ্ছে, চিরবেকার জীবনই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেদিক থেকে সায়নী ভালই করেছে কমার্শিয়াল নিয়ে।

না, না এভাবে ভাবা ঠিক নয়। যে-কোনও স্ট্রিম মন দিয়ে চর্চা করলে আর্নিং-এর একটা ব্যবস্থা হয়ে যায় ঠিক। তা ছাড়া ফাইন আর্টস নিয়ে পড়লে কমার্শিয়াল কাজ করতে পারবে না, এমন কোনও বিধিনিষেধ নেই। বরং একটু অ্যাডভান্সড থাকবে।!

কথাটা বলে কিচেনে চলে গিয়েছিলেন মা। ক্ষণিকের জন্য উদ্দীপ্ত হয়েছিল অর্ণবের মুখ। বলে ওঠে, সত্যি বস, একখানা মা বানিয়েছ মাইরি। আনপ্যারালাল।

মায়ের প্রশংসাই করছিল অর্ণব। ভঙ্গিটা পছন্দ হয়নি সায়নীর। বলেছিল, মাইন্ড ইয়োর

ল্যাঙ্গোয়েজ অর্ণব। তা ছাড়া মাকে আমি বানাইনি, মা-ই আমাকে বানিয়েছে। সরি, সিলি মিসটেক। তুমি তো জানোই সায়নী, আমার এক্সপ্রেশন একটু লাউড। নর্থ ক্যালকাটার ছেলে তো।

সেই খোশমেজাজের অর্ণব কিছুদিন হল কেমন যেন প্রাজ্ঞ, গম্ভীর হয়ে গেছে। বদলটা এসেছে সায়নীদের গ্রুপে পিয়া আসার পর থেকে। প্রথমদিকে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি সায়নী। মিঠু আর বিদিশা একদিন সতর্ক করে দিল, সায়নী, কেসটা কিন্তু আমাদের ঠিক সুবিধের ঠেকছে না। পিয়া তোর অর্ণবের দিকে একটু বেশি হেলছে।

পাত্তা দেয়নি সায়নী। বলেছিল, পিয়ার ফিগারটাই একটু বেন্ড। তাই ওরকম মনে হয়। সায়নীর পার্সোনালিটিকে ওদের গ্রুপের সবাই সমীহ করে চলে। মিঠু, বিদিশা আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু ব্যক্তিত্ব দিয়ে কি সন্দেহের বিষ প্রতিরোধ করা যায়? সায়নী আড়েঠারে লক্ষ রাখতে শুরু করে অর্ণব, পিয়ার উপর। মিঠু, বিদিশা ভুল কিছু বলেনি। অর্ণবকে কিছু বলার আগে আর-একটু সময় নেয় সায়নী। ওই সময় নেওয়াটা বোধ হয় কাল হল।

আবার ফোনটা বেজে ওঠে। চিন্তা ছিঁড়ে যায়। তার মানে সায়নীর আন্দাজই ঠিক, ঘোস্ট কল। ফোনটা তুলতে যাবে সায়নী, কেটে গেল। বড্ড তাড়াতাড়ি কেটে দিল এবার। কে যে ফোন করে, কী মজা পায় কে জানে! আচ্ছা, বাবা ফোন করেন না তো? বউ অথবা মেয়ের গলা শুনে নিশ্চিন্ত হন। কথাটা মাথায় আসতেই হাসি পায় সায়নীর। বাবার চরিত্রে

ইমোশনের ছিটেফোঁটাও নেই। কেরিয়ারসর্বস্ব, কাজপাগল, রাশভারী মানুষ। সায়নী শৈশব অবধি স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পায় না, বাবা কোনওদিন তার এবং মায়ের সঙ্গে বসে আড্ডা মেরেছেন। বেড়াতে গেলেও বাবা একটু দূরত্ব রেখে আগে আগে হাঁটতেন। সেই দূরত্ব বেড়ে এখন মুম্বই পর্যন্ত হয়েছে। বাবা ওখানেই সেটেলড। সায়নীদের নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বাবা। সায়নীর পড়াশোনা, বাড়ি দেখবে কে? এইসব নানা অজুহাত দেখিয়ে মা যেতে রাজি হননি। ঠাকুরদার তৈরি বিশাল বাড়িতে এখন মাত্র দুটি প্রাণী, মা আর সায়নী। ঠাকুরদা, ঠাকুরমা কেউ বেঁচে নেই। বাবা একমাত্র সন্তান। মাসে দু’বার ফোন করেন বাবা। মায়ের সঙ্গে সাংসারিক দু’-একটা কথা, সায়নীকে পড়াশোনা নিয়ে কিছু কাঠকাঠ প্রশ্ন, ব্যস, খোঁজ নেওয়া হয়ে গেল। কলকাতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা পাঠান বাবা। প্রয়োজনমতো মা তুলে নিয়ে আসেন।

বাবা-মায়ের রিলেশনটা কী করে টিকে আছে কে জানে! কোনও এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। সেই সুতোটা কি সায়নী? নিজেকে অদৃশ্য ভাবতে খারাপ লাগে।

নিজের মা-বাবার এরকম নিরুত্তাপ সম্পর্ক দেখে কনজুগাল লাইফ সম্বন্ধে রীতিমতো অনাগ্রহ জেগেছিল সায়নীর। অর্ণবের সঙ্গে মিশে সেটা ক্রমশ কেটে যায়। অ্যাপ্রোচটা এসেছিল অর্ণবের কাছ থেকেই। বিনা ভূমিকায়, একদম আচমকা। সে এক মজার ঘটনা। সায়নীদের আর্ট কলেজে একটা নাটকের গ্রুপ আছে। বিভিন্ন ইয়ারের নাটকে উৎসাহী স্টুডেন্টরা গ্রুপে জয়েন করে। নাটক অনিয়মিত মঞ্চস্থ হলেও ওরা নিয়ম করে গুলতানি মারে। সিনেমা, নাটক দেখতে যায়। বইমেলায় ঘোরে। সেরকমই একদিন দলবেঁধে বইমেলায় ঘুরছে সায়নীরা। তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার সায়নীর। শরীরে স্কুল-স্কুল গন্ধ। অর্ণব দু’বছরের সিনিয়র। দুরন্ত দেখতে। সায়নী ওকে দাদা বলে। সেদিন বোধ হয় একটু বেশিই দাদা দাদা করছিল সায়নী। আসলে অর্ণবকে সেদিন হলুদ পাঞ্জাবি, নীল জিন্‌সে দারুণ লাগছিল। পাশে হাঁটতে হাঁটতে অর্ণব নিরাসক্ত গলায় বলে, আচ্ছা সায়নী, তুমি যদি আমার নামের পাশে দা শব্দটা যোগ না করো, অসুবিধে হবে খুব? আনকমফর্ট ফিল করবে?

অভিসন্ধিটা না বুঝেই স্মার্ট থাকার জন্য সায়নী বলে ফেলে, একটুও না। থ্যাঙ্ক য়ু। আমি আশাই করিনি এত তাড়াতাড়ি তুমি আমাকে অ্যাকসেপ্ট করবে। তার মানে? বড় বড় চোখ করে জানতে চেয়েছিল সায়নী। ফিচেল হাসি হেসে অর্ণব বলেছিল, দাদা হচ্ছে গিয়ে প্রেমের পথে কাদা। পৌঁছোতে অনেক টাইম লেগে যায়।

তেড়েফুঁড়ে উঠে সায়নী বলেছিল, অ্যাই, এসব কী বলছ? আমি কিন্তু সেরকম মিন করে… কে শোনে কার কথা! অর্ণব এগিয়ে যাওয়া বন্ধুদের ডেকে বলেছিল, লিস্ন ফ্রেন্ডস, আজকের দিনটা তোমরা নোট করে নাও। কোনও একদিন মেমোরেবল ডে হবে এটা। আমি অথবা সায়নী যদি কোনওদিন বিখ্যাত হই, তোমরা নাতি-নাতনিদের কাছে বলতে পারবে, আমাদের প্রথম প্রেমের দিনের সাক্ষী ছিলে তোমরা।

বন্ধুরা এর-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সায়নী দাঁড়িয়ে আছে বইমেলার শেষ বিকেলের সূর্যটার রঙে রাঙা হয়ে।

অর্ণব আবার বলে, কী হল বন্ধুরা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? দেখছ না, বালিকা প্রেমে পড়ে কেমন ব্রীড়াবনত হয়ে আছে। প্লিজ, আমাদের উৎসাহ দিতে, সায়নীর জড়তা কাটাতে তোমরা ক্ল্যাপ দাও, প্লিজ ক্ল্যাপ। ব্যস, তারপর আর কী, হাততালির চোটে কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। ওরকম প্রাণখোলা ছেলের মনে এখন পিয়ার গ্রহণ। মেয়েটা মাসছয়েক হল গ্রুপে ঢুকেছে। কলেজে সায়নীর চেয়ে এক ইয়ারের জুনিয়র। দেখতে আহামরি কিছু নয়। ইটচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে, আদুরে ন্যাকা টাইপের। গাড়ি চেপে কলেজে আসে। প্রথমদিকে সায়নীর সঙ্গে খুব ভাব জমিয়েছিল। সায়নীদের প্রেমের ব্যাপারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইত, তোমাদের কবে থেকে প্রেম? কোথায় কোথায় ঘুরতে যাও তোমরা? তোমাকে অর্ণবদা কোনওদিন কিস করেছে…? যতসব আলতুফালতু প্রশ্ন। সায়নী ওকে এড়াতে শুরু করেছিল। তখন তো বুঝতে পারেনি কেন এত খোঁজ নিচ্ছে পিয়া। মিঠু, বিদিশা সতর্ক করার পর চোখ খোলে সায়নীর। কিছুদিন নজর রাখার পর অর্ণবকে বলে, কী ব্যাপার, পিয়ার সঙ্গে তোমার এত কী কথা? তুমি যে বলো নেকু টাইপের মেয়েদের সঙ্গে তোমার একদম পটে না।

উদাসীন হাসি হেসে অর্ণব বলেছিল, মেয়েটা অদ্ভুত ধরনের। কল্পনার জগতে বাস করে। বড়লোকের ওয়েল প্রোটেক্টেড একমাত্র সন্তান তো…

দেখো বাবা, তুমি আবার ওই প্রোটেকশনে শেল্টার নিয়ো না। ছদ্ম আশঙ্কার গলায় বলেছিল সায়নী।

তক্ষুনি নকল গম্ভীর হয়ে অর্ণব বলে, সত্যি তো, এদিকটা ভেবে দেখিনি। হিল্লে হয়ে যাওয়ার একটা চান্স আছে।

বিনিময়ে রামচিমটি খেতে হয়েছিল অর্ণবকে। প্রসঙ্গটা সেখানেই চাপা পড়ে যায়। ওদের একটু আধটু মেলামেশাটা মেনেও নিয়েছিল সায়নী। কেননা, সে মোটেই সংকীর্ণ মনের নয়। কিন্তু আজ কলেজে ঢুকতেই অমিতেশ যে খবরটা দিল, মাথা ঠিক রাখা গেল না। কলেজ গেটে সম্ভবত সায়নীর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল অমিতেশ। চোখাচোখি হতেই অমিতেশ বলে, সায়নী, তোর সঙ্গে কথা আছে। ক্যান্টিনে চ’।

কী কথা রে? পরে বললে হয় না? এক্ষুনি ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।

না, তোর এখনই শোনা উচিত, বলে অমিতেশ গটগট করে হাঁটা দিয়েছিল ক্যান্টিনের দিকে। খুবই সিরিয়াস স্টুডেন্ট অমিতেশ। ক্লাস বাঙ্ক করে আড্ডা মারার বান্দা সে নয়। ভয়ভয় করছিল সায়নীর

ক্যান্টিনে বসে সামান্য ভূমিকা করে নিল অমিতেশ, দ্যাখ সায়নী, বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে, আসলে এসব লাগাই-ভাঙাইয়ের মধ্যে আমার থাকতে ভাল লাগে না। কিন্তু তুই যেহেতু আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড…

অনেক হয়েছে, আসল কথাটা বল, বলে গাড়ি ট্রাকে ফেলেছিল সায়নী। তারপর অমিতেশ যা বলল মোটামুটি এরকম—গতকাল ও নাকি অর্ণব-পিয়াকে নাটক শেষে গিরিশ মঞ্চ থেকে বেরোতে দেখেছে। ওরা দু’জনে খুব হাসাহাসি করছিল।

খবরটা শুনে মাথায় আগুন ধরে যায় সায়নীর। ওই আগুন গিরিশ হলের অন্ধকার

কাটাতে পারে না। অর্ণব এখন অবধি কিছু জানায়নি তাকে। কেন শুধু দু’জনে গিয়েছিল? সায়নীকে বলতে পারত যেতে।

ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সোজা অর্ণবকে গিয়ে ধরে সায়নী। খবরের উৎসটা চেপে যায়। শান্ত হয়ে অভিযোগ শোনে অর্ণব। তারপর বলে, হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কোনও উপায় ছিল না। মেয়েটা বড় নাছোড়।

কিছুই বুঝতে পারছি না, হতাশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে সায়নী।

অর্ণব বলে যায়, প্রথমদিকে মেয়েটার চাইল্ডিশ কথাবার্তা আমার ভালই লাগত। তখন বুঝিনি পিয়া এরকম ব্যাডলি আমার প্রেমে পড়ে যাবে। কথাটা তোমাকে বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠেনি। ইদানীং পিয়া বলতে শুরু করেছে, ওকে যদি আমি কম্পানি না দিই, শি উইল কমিট সুইসাইড। তবে আর-একটা অঙ্গীকারও করেছে, সুইসাইডাল নোটে আমার নাম লিখবে না। শুধু আমিই জানব আমার জন্যেই ও মরেছে।

আর আমি? বলতে না চাইলেও কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সায়নীর। একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। ওর নিঃস্ব, অপমানিত মুখ দেখে অর্ণব বেশ নার্ভাস হয়ে যায়। বলে, তুমি ব্যাপারটা এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন? যেন আমাদের সম্পর্ক আজ থেকেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। পিয়াকে আমি সঙ্গ দিচ্ছি টু শেভ হার লাইফ। আর কম্পানি দেওয়া মানেই তো প্রেম নয়। আমার অ্যাটিটিউডে ও নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পেরেছে। এই ইনফ্যাচুয়েশনটা খুব তাড়াতাড়িই কেটে যাবে।

যদি না কাটে? জানতে চেয়েছিল সায়নী। কথা হারিয়ে অর্ণব তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সায়নী ফের বলে, বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া মেয়ের বায়না তুমি মেটাবে, আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করে যাব! তুমি ভাবলে কী করে?

প্লিজ সায়নী, তুমি সিচুয়েশনটা বোঝার চেষ্টা করো। তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে?

অর্ণবের কথা পিছনে ফেলে হাঁটা দিয়েছিল সায়নী। একটাও ক্লাস করেনি। সোজা বাড়ি। বাসে আসতে-আসতে ভেবেছে, সে-ও তো অর্ণবকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। তা বলে সুইসাইডের হুমকি দিয়ে ওকে আটকে রাখা! এত নীচে নামতে পারে মানুষ…!

কলেজ থেকে ফিরে সেই যে ড্রয়িং-এ এসে বসেছে সায়নী, একা-একাই ভেবে যাচ্ছে পরবর্তী পদক্ষেপ। মা একবার এসেছিলেন চা দিতে। নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন মেয়ের মুড খারাপ। কিছু জিজ্ঞেস করেননি, এটাই মায়ের স্বভাব। অযাতিত সাহায্য করে মেয়েকে পরনির্ভর করতে চান না। কিন্তু যে প্রবলেমে পড়েছে সায়নী, কারও একটু হেলপ তো চাই-ই। মায়ের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা করবে ভাবলেই নিজেকে কেমন ছোট লাগছে। অর্ণবও অনেক নীচে নেমে যাবে মায়ের চোখে। তা হলে কী করা যায়?

এমন সময় আবার ফোনটা বেজে ওঠে। সোফা থেকে ছিটকে ফোন তোলে সায়নী। রিসিভার কানে চেপে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, আপনি কে বলুন তো? কেন এভাবে বিরক্ত করেন আমাদের? কী চান আপনি? এত কাপুরুষ, গলাটা পর্যন্ত শোনাতে ভয় পাচ্ছেন। ইতর কোথাকার… বলতে-বলতেই সায়নী খেয়াল করে, সে আবার ধরে নিচ্ছে কোনও পুরুষই

ফোনটা করেছে। হতে পারে পিয়া ঠিক করেছে সায়নীকে বাড়িতেও শান্তিতে থাকতে দেবে না। ওর কী ক্ষতি করেছি আমি!

চেঁচামেচির চোটে মা ঘরে চলে এসেছেন। অবাক চোখে জানতে চান, কাকে গালাগালি দিচ্ছিস? কী হয়েছে?

রিসিভার হাতে ঝুলিয়ে সায়নী হতাশ গলায় বলে, সেই ফোনটা। আমাদের কাছে কী চায় মা?

ওর কথাটায় একটু যেন কান্না ছুঁয়ে আছে। মেয়ের হাত থেকে রিসিভার নিয়ে ক্রেডেলে রাখেন সোমা। তারপর সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বলেন, কী হয়েছে তোর? একদম মুড অফ। এত খারাপ ব্যবহার তুই করিস না কারও সঙ্গে!

মায়ের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সায়নী। মেয়ের দু’গালে হাত রেখে সোমা বলেন, আমাকেও বলবি না কী হয়েছে? সায়নী নিজেকে লুকোতে পারে না। মায়ের গলায় ছোট্টবেলার আদর। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সায়নী।

পরের দিন কলেজে ডুব মারল সায়নী। আজ এসেছে। পরিস্থিতি এখন অনেকটাই তার অনুকূলে। ভাবাই যাচ্ছে না গত পরশু কী সাংঘাতিক সমস্যার সামনে ছিল। কোনও পথ ছিল না সমাধানের। একদিনের মধ্যেই ম্যাজিকের মতো প্রবলেম হাওয়া। কলেজে ঢুকে আজ পিয়াকে খুঁজেছিল সায়নী। নেকু সম্রাজ্ঞী এসেছেন। একটু এড়িয়ে দূরে দূরে থাকছে।

ওষুধ যা পড়েছে মনে হয় সহজে আর ভিড়বে না। সমাধানের পথ বের করেছিলেন মা। পরশু কান্নাকাটির পর মাকে সব ঘটনাই খুলে বলেছিল সায়নী। মা একটুও বিচলিত হলেন না। বললেন, এটা এমন একটা কিছু ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন নয়। আমি মেয়েটার বাড়ি যাব। ওর গার্জেনকে বলব, আপনার মেয়ের মাথায় আত্মহত্যার ভূত ঘুরছে। ওকে ইমিডিয়েট সাইকিয়াটিস্ট দেখানো উচিত।

শুনে তো সায়নীর চোখ বড় বড়। বলে উঠেছিল, তুমি পারবে গিয়ে বলতে? ওঁরা যদি তোমাকে অপমান করেন।

সহ্য করব। মেয়েটার কিন্তু উপকারই হবে। আমি নোটিশ করার দরুণ গার্জেনরা ওর উপর নজর রাখবেন ঠিক। তা ছাড়া আমার মেয়ের দিকটাও দেখতে হবে। আমি জানি তোর আর অর্ণবের ভালবাসা পিয়োর। সত্যিকারের ভালবাসার মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান মস্ত অন্তরায়। সারাজীবন কষ্ট পাবি, অভিমানের পাহাড় ডিঙোতে পারবি না।

কথাগুলো বলে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পাশের ঘরে চলে যাচ্ছিলেন মা। সায়নী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, সত্যি কী ইন্টেলেক্ট মায়ের। নিজের স্বামীর কাছে কোনও গুরুত্ব পেলেন না। এখন হিস্ট্রি অফ আর্টের ক্লাসে বসে বাবার উপর রাগ হচ্ছে। এস ডি-র লেকচার কানেই ঢুকছে না। অন্যমনস্কভাবে বাবার মুখের একটা স্কেচ খাতায় আঁকছে সায়নী, ঠিক যেন হচ্ছে

দুই

না। কোথাও একটা গন্ডগোল থেকে যাচ্ছে। ক্লাস শেষ হতেই সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে রুমে ঢুকল অর্ণব। আমরা আইনক্স-এ সিনেমা দেখতে যাচ্ছি, যাবে তো?

সায়নী ভেবেছিল গ্রুপের সঙ্গে আইনক্সে বুঝি পিয়াও আসবে। আসেনি। তার মানে ঘোর ভেঙেছে। মাকে ওদের বাড়ি যেতে হয়নি। পরশু বিকেলে মায়ের প্ল্যান শোনার পর ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল, সত্যিই যদি পিয়ার বাড়ির লোক মাকে অপমান করেন। আমার জন্য মা কেন অপমানিত হবেন। কথাটা রাতে ফোন করে অর্ণবকে বলে সায়নী। ফোনের ও-প্রান্তে অর্ণব এক্সসাইটেড। বলেছিল, দারুণ প্ল্যান বের করেছেন তো কাকিমা! এইজন্যই বলি, তোমার মা একজন মহীয়সী। শোনো সায়নী, আপাতত কাকিমাকে ওদের বাড়ি যেতে হবে না। আমি প্রথমে পিয়াকে বলি, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি ভালবাসার উপসর্গ নয়, মেন্টাল ডিসঅর্ডার। চলো, তোমাদের বাড়ি যাই, মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করি…আশা করা যায় এতেই দমে যাবে পিয়া। আর শোনো, আজ তুমি কলেজ অফ করো। মেয়েটা হয়তো সিন ক্রিয়েট করতে পারে।

গতকাল অর্ণবের কথামতো ডুব মেরেছে সায়নী। একদিনে অনেকটাই কাজ হয়েছে। লাইঞ্জে ঢোকার আগে দেবাশিসের সেলফোন চায় সায়নী। মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আজ দেরি হবে ফিরতে, সেটাও বলে নেওয়া দরকার। সায়নীর গলার আওয়াজ শুনেই মা টের পাবেন, মেঘ কেটে গেছে। বাড়ির নম্বর টিপে মোবাইল সেট কানে রেখেছে সায়নী, অনেকক্ষণ হয়ে গেল, মা তুলছেন না। কোথাও বেরোলেন নাকি? এপারের রিং বন্ধ হয়ে যায়। রি-ডায়াল করে সায়নী। খানিক রিং হওয়ার পর মা তোলেন ফোন। রিসিভার কানে নিয়ে মা শুধু ‘বলছি’ বলেন। এখনও বললেন। একটু মজা করতে ইচ্ছে করে সায়নীর, চুপ করে থাকে। ঘোস্টকলের মতো। কিন্তু একী, মা কীসব বলতে শুরু করেছেন, অপ্রত্যাশিত, আশ্চর্য সব কথা!

শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে আজ কলেজ যায়নি সায়নী। গত দু’দিন সে ভীষণ অন্যমনষ্ক থেকেছে। এমন একটা সমস্যায় পড়েছে এবার, অর্ণবকে তো নয়ই, মাকেও বলা যাবে না। মনের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে খুব। বেলা করে ঘুম ভেঙেছে আজ। ড্রয়িং-এ বসে ব্রেকফাস্ট করছে এখন। মা বসে আছেন উলটো দিকের চেয়ারে। এক হাতে নিউজপেপার অন্য হাতে চায়ের মগ। ফোন এল। আন্দাজমতো সেই কল৷ দু’জনের কেউই ধরছে না। কেটে গেল। আবার এল খানিক বাদে। সায়নী গিয়ে তুলল রিসিভার। কানে না নিয়ে মায়ের দিকে বাড়িয়ে বলল, তোমার ফোন।

ধরা পড়ে যাওয়া ত্রস্ত চাউনি নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন সোমা। কেমন স্নেহের গলায় সায়নী বলে, কী হল, ধরো!

মায়ের হাতে ফোন দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে সায়নী। রাস্তা শুনশান।

তিন

আসবার সময় মাকে বলে এসেছে, একটু শ্যামাদার দোকান থেকে আসছি।

ফোনটা যে মায়ের জন্যই আসে, এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে আইনক্স থেকে মাকে ফোন করার দিন। চুপ করে থাকা ফোনের উদ্দেশে মা বলতে শুরু করেছিল, কেন এভাবে বারবার ফোন করো তাপস! আমি তো বলেছি সেই স্কুল, কলেজবেলার কথা আমি সব ভুলে গেছি। দোষ আমারই ছিল, আমার অভিমান মানায় না। তা ছাড়া আমি এখন মেয়ের মা। আমার মেয়ে তার মাকে একটা খারাপ, জালি মা বলে ভাবুক আমি চাই না। আমাদের ভালবাসা… তারপর আর শুনতে ইচ্ছে করেনি সায়নীর, ভীষণ নাভার্স লাগছিল।

একটু আগে মায়ের কিশোরীবেলাটা হাতে তুলে দিয়ে আসতে পেরে বুকটা হালকা লাগছে। কষ্ট কি হচ্ছে না সামান্য? না, হচ্ছে না। আজ কলকাতার আকাশটা অনেক বেশি নীল। হাওয়ায় প্রাণখোলা ভাব।

উনিশ কুড়ি, ডিসেম্বর ২০০৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *