বনমালা
গ্রামের নাম ছিল চন্দনপুর৷ ‘ছিল’ বলার কারণ, চন্দনপুর থেকে এক ক্রোশ দূরে চড়ুইপোতায় পৌঁছে কেউ যদি জানতে চায়, চন্দনপুর গ্রামটা কোথায়? নিশ্চয়ই জবাব পাবে, সে নামে এক গ্রাম ছিল বটে, অজয়ের এলোপাথাড়ি বন্যায় সেসব ধুয়েমুছে সাফ। উত্তরদাতার একবারও খেয়াল পড়বে না, আজও রায়চৌধুরী, মানে জমিদারদের ভাঙা বাড়িটা চন্দনপুরের শেষ স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তদুপরি সে বাড়িতে দু’জন বাসিন্দা আজও যে বর্তমান, এ কথাও কারও স্মরণে থাকে না। না থাকারই কথা। বছর বিশেক হল নদীর খামখেয়ালিপনায় বিরক্ত হয়ে জনপদবাসীরা সরে গেছে দূরে। কতবার লুটিয়ে পড়া বাড়ি গড়া যায়! পলিমাটিতে শেষ হয় চাষের সম্ভাবনা। জমির সীমানাও মুছে যায়। অতএব চন্দনপুর এখন বিস্মৃতির গহ্বরে।
তবে এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ বা অনুযোগই নেই রায়বাড়ির দুই বাসিন্দার। একজন চন্দ্রভানু রায়চৌধুরী, সম্ভবত চৌধুরী বংশের শেষ পুরুষ। আর তার চাকর কুঞ্জ।
চন্দ্ৰভানু শেষ কবে লোকালয়ে গেছেন, নিজেরই খেয়াল নেই। কালেভদ্রে কুঞ্জই বাজার দোকান করতে বাইরে যায়। তাও তার প্রয়োজন মিটে যায় চড়ুইপোতা ঢোকার মুখেই। সেখানে ঘোষালবাড়ির দালানে হরেক মালের ছোট দোকান। গ্রামের গরিব মানুষরা সেখান থেকে আট আনার চাল, চার আনার তেল, চারটে দেশলাই কাঠি কেনে। কুঞ্জর বাবুর অবস্থা অত খারাপ নয়। হাটবাজার যাওয়ার ব্যাপারে কুঞ্জরই প্রবল অনীহা। দোকানি শ্রীদাম ঘোষাল মাঝমধ্যেই জানতে চায়, হ্যাঁরে কুঞ্জ, তুই আর তোর বাবু ওই ভুতুড়ে বাড়িতে কী করিস বটে সারাদিন? সাপ-শামুকে ভরা ওই চরায় মানুষ থাকে!
কুঞ্জ হাসে। বলে, বাবু আমার বিরাট পণ্ডিত লোক। দিনরাত মোটা মোটা কেতাব পড়েন, কী সব লেখেন! দেশ-বিদেশ থেকে কত চিঠি আসে বাবুর… এ সবই কুঞ্জর বানানো কথা। রায়বাড়িতে প্রচুর বই আছে ঠিকই, কিন্তু বাবু কোনওদিনই সেসব উলটেপালটে দেখেন না। লেখালিখির বালাই নেই। লণ্ঠনের পলতে উসকে দিলে বলেন, কী দরকার মিছিমিছি তেল অপচয় করার!
সারাদিন শুয়েবসেই কেটে যায়। মাঝে মধ্যে সারাবাড়ি পায়চারি করেন। যান বাগানে। কখনও সখনও বারবাড়ির দালানে আরামকেদারা পেতে দিতে হয়। বিকেল হলে নিয়মিত ছাদে যান। পাঁচিলের সামনে দাঁড়িয়ে বেভুল তাকিয়ে থাকেন সামনে। সেখানে হেলে পড়া সূর্যের আলোয় চকচক করে অজয়ের ক্ষীণ জলধারা। কথাবার্তা বলেন খুব কম। সন্ধে উতরে গেলে নীচের তলায় নেমে আসেন। গান শোনেন হাতল ঘোরানো গ্রামোফোনটা চালিয়ে। সে যে কী গান, মাথামুন্ডু কিছুই বোঝে না কুঞ্জ। মনে হয় যেন চোঙা থেকে বেরিয়ে আসছে তিন কুড়ি পার করা কোনও বুড়ির কান্না। ভীষণ একঘেয়ে। যন্তরটার বোধহয় অবস্থা শেষ।
সেই গান শুনে বাবুর মন ভাল হয়। তখনই কিছু কথা বলেন, সবই ওঁদের বংশের প্রতাপের কথা। ওঁর ঠাকুরদার বাবা কেমন ছিলেন, কেমন সম্পর্ক ছিল সুলতানদের সঙ্গে, ক’টা ঘোড়া ছিল, হাতি ছিল… অবিশ্বাস করার উপায় নেই। ঘোড়া না থাকলেও, আস্তাবল এখনও আছে। পোর্টমানে যত্ন করে রাখা গদি, লাল জাজিম, ঘণ্টা দেখে বোঝা যায় হাতিও ছিল। প্রকাণ্ড হলঘরের মাথায় ভাঙা ঝাড়বাতি প্রমাণ করে এ-বাড়িতে নটীর নূপুর হেসে উঠত একদিন।
বড় বড় চোখ-মুখ করে জমিদারবাবু সেইসব গল্প করে যান। নাকের পাটা, গাল লাল হয়ে ওঠে। ঘনঘন শ্বাস নেন। গল্পের প্রতি তবু কোনও আগ্রহ জন্মায় না কুঞ্জর। পুরু ধুলো ভরতি নাচঘর, অজস্র ফাটল আর আগাছায় ভরা এই প্রাসাদের প্রাণ যেন ফেরে না। কুঞ্জ ঢুলে ঢুলে পড়ে। বাবুর সন্দেহ হয়। জিজ্ঞাসা করেন, কী রে, ঘুমুলি নাকি?
ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া নাল মুছে, কুঞ্জ ঢুলুঢুলু চোখে মাথা নাড়ে। বাবু বলে যান, আমার ঠাকুরদার এক দিদি ছিল জানিস। রেবতীদেবী। কী সাংঘাতিক মহিলা ! ঠাকুরদার বকলমে উনিই তো জমিদারি দেখতেন। একবার হয়েছিল কী, এক ইংরেজ সাহেব এলেন আমাদের মহালের ওপর ট্যাক্স বাড়ানোর অর্ডার নিয়ে। চিকের পরদার এপারে রেবতীদেবী, ওপারে সাহেব। কথা চলছে দোভাষীর মাধ্যমে। সাহেব ব্যাটা ইংরেজিতে দোভাষীকে নিজের দলে টানার চেষ্টা করছিল। সাহেবকে পুরো ঘাবড়ে দিয়ে রেবতীদেবী ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করেন। তখন সাহেবের একদম ল্যাজেগোবরে অবস্থা… হাসতে থাকেন জমিদারবাবু। হাসতে হাসতে উঠে পড়েন আরামকেদারা ছেড়ে। বাতিদানের আলোয় তাঁর ছায়া বিশাল হয়ে আছড়ে পড়ে দেওয়ালে। হাসির চোটে আলো কেঁপে উঠলেও, কুঞ্জর কোনও বিচলন হয় না। এসবে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বাড়ির পিছনে শিয়াল ডেকে ওঠে। আস্তাবল থেকে বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাওয়া যায়। ঘুমে চোখ জুড়ে আসে কুঞ্জর। মনিব নিশ্চয়ই রাগ করেন। মুখে কিছু বলেন না। তবে ইদানীং ঘুম তাড়ানোর একটা ব্যবস্থা হয়েছে। খুবই কুৎসিত, অপমানজনক সে ব্যবস্থা। সভ্য সমাজে কহতব্য নয়।
সে যাই হোক, সকালে উঠেই কুঞ্জর কাজ শুরু হয়ে যায়। এই বিশাল বাড়ির যতটুকু অংশ পদচারণ ও বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করেন জমিদারবাবু, সেটুকু সে ঝাড়পোঁছ করে রাখে। তারপর ইঁদারা থেকে জল তোলা, রান্নাবান্না, কাচাকাচি… তার কি কাজের শেষ আছে! এই যেমন এখন ছাদে উবু হয়ে বসে বাবুর গড়গড়াটা ভাল করে মুছছে। যেন ধুলো-ময়লা সরিয়ে জমিদারবাবুর গল্পকথাগুলো সত্যিকারের করার চেষ্টা। পশ্চিম আকাশে এখনও লাল ছোপ ধরেনি। বাবু গিয়ে দাঁড়িয়েছেন পাঁচিলের ধারে। এই সময়টা চেয়ারে বসে তামাক খেতে খেতে বাবু সন্ধে নামা দেখেন।
গড়গড়ার মুখ থেকে কলকে তুলে তামাক, টিকে সাজাতে যাচ্ছিল কুঞ্জ, হঠাৎ চন্দ্ৰভানু বলে ওঠেন, হ্যাঁরে, মুক্তাপুরে কি মেলা লেগেছে?
অবাক হয়ে মাথা নাড়ে কুঞ্জ। মুক্তাপুর হচ্ছে বাগদিদের বাস। গরিব গাঁ। মেলাফেলা ওদিকে হয় না। শনিবার করে টিমটিমে হাট বসে।
এদিকে আয়। বলে, বাবু অজয়ের দূর জলের দিকে হাত তোলেন। পাশে দাঁড়িয়ে কুঞ্জও জলের দিকে তাকায়। মনে হয় যেন মৃদু স্রোত বইছে দক্ষিণ পানে। ভাঁটার টান। কিন্তু মেলার সঙ্গে অজয়ের জলের কী সম্পর্ক, ধরতে পারে না কুঞ্জ। বাবু বলেন, দেখতে পাচ্ছিস?
চোখ কচলে আবারও মাথা নাড়ে কুঞ্জ। অথচ তার বয়স বাবুর অদ্দেক। ভাল খাওয়াপরা করেছেন ছোটবেলায়। বাবু বলেন, যা, নীচের আলমারি থেকে আমার দূরবিনটা নিয়ে আয়।
আদেশটা খুবই মনোমতো হয় কুঞ্জর। দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। বাবুর দূরবিনটার ওপর তার ভীষণ দুর্বলতা। বাবুর অলক্ষ্যে যন্ত্রটা নিয়ে সে দূরের পথিক কাছে টেনে আনে। পূর্ণিমার চাঁদকে নাগালে রেখে অনেক গল্প করে। এটা তার গোপন বিনোদন।
দূরবিনটা নিয়ে ছাদে ফিরে এসেছে কুঞ্জ। চোখে লাগাতেই দেখে, অজয়ের জলে ভেসে যাচ্ছে মেলার শালপাতা, রঙিন কাগজ, এমনকী একটা হাওয়া ভরা আস্ত বেলুন। উত্তেজিত স্বরে কুঞ্জ বলে ওঠে, তাই তো, ঠিক বলেছেন!
যাবি একবার? বাবুর গলায় আবদারের সুর।
কুঞ্জ অবাক হয়ে বলে, আপনি যাবেন আজ্ঞা! চলুন না। আপনি তো কোথাও যেতেই চান না।
আরে ধুর, আমি না। তুইই যা। চার আনার গুড়কাঠি বিরক্ত হয়ে কুঞ্জ বলে ওঠে, কোন কালে পড়ে আছেন আপনি! গুড়কাঠি মোড়ার কাগজটিও হবেনি চার আনায়।
আনিস। অনেকদিন খাইনি।
ঠিক আছে বাবা, এক টাকার নিস। তাড়াতাড়ি তামাক সেজে বেরিয়ে পড়। ফিরতে ফিরতে নইলে রাত হয়ে যাবে।
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কুঞ্জর মুখ। তড়িঘড়ি নীচের তলায় যেতে যেতে সে বলে, আমার মেলাখরচ দু’টাকা লাগবে, বলে দিলাম।
মেলা ছুঁয়ে ভেসে আসা বাতাসের গন্ধ শুঁকে আপন হাসি হাসেন চন্দ্ৰভানু। কত শত স্মৃতি লুকিয়ে আছে এই বাতাসে! কুঞ্জর বাবার কাঁধে চেপে কত মেলায় যে গেছেন!
পা চালিয়ে কুঞ্জ চলেছে মুক্তাপুরে। ভেসে আসা সিনেমার গান যেন তার হাত ধরে টানছে। হাঁটায় ঢুকে যাচ্ছে নাচের ছন্দ। অনেক দিন বাদ কাছেপিঠের গাঁয়ে মেলা বসল। নয়তো সেই কেঁদুলি বোলপুরে যেতে হয়। গিয়েছে কুঞ্জ। কিন্তু সেখানে শহুরে মানুষের এত ভিড়, পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়। টাল রাখা দায় হয়ে পড়ে। যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে।
গাঁয়ের মেলা সেদিক থেকে অনেক আপনার। কাঠের নাগরদোলার কোঁকানি, হাতে ঠেলা ঘূর্ণি, চাকতির জুয়ো, পাঁপড়ভাজা… বাবু দিলেন সাকুল্যে তিন টাকা। কী করে এত সব হবে!
এবড়োখেবড়ো জমি পার হতে হতে একই সঙ্গে উৎসাহিত পরক্ষণেই নিরুৎসাহ হচ্ছিল
কুঞ্জ। অনাবাদী জমি। নানান সরীসৃপ, ভাম, বেজির অবাধ বিচরণ এখানে। কুঞ্জর এসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। দূরে বাঁশবন। ওখান থেকেই বসতির ছিরিছাঁদ লক্ষ করা যায়। পাঁচ-ছ’ঘর সাঁওতাল থাকে। এরাই একমাত্র রায়বাড়ির আধ মাইল দূরে পায়ে হাঁটা পথটাকে মুছে যেতে দেয়নি। ওই পথ ধরেই অজয়ে মাছ মারতে যায়। ভুলেও রায়বাড়ির সদরমুখো হয় না। কিন্তু একসময় যেত। তখন জমিদারবাবুরা কেউ থাকত না। কুঞ্জর বাবা নিরাপদর ওপর ছিল রায়বাড়ির দেখভাল করার দায়িত্ব। যৎসামান্য টাকা মানিঅর্ডার আসত কলকাতা থেকে, তা দিয়েই খুব যত্ন করে বাগান করত বাবা, অল্প জমি জুড়ে চাষও দিত। মুনিষ খাটতে আসত এরা। চাষ, বাগানের ফসল কুঞ্জরাই খেত। বেশ কিছুটা নষ্ট হত খরা, বন্যায়। কুঞ্জর মা মারা গেল পাঁচ-ছ’দিনের জ্বরে। প্রায় বিনা চিকিৎসায়। ডাক্তার, হাসপাতাল চন্দনপুর থেকে অনেক দূর। তবুও বাবা রায়বাড়ি ছেড়ে নড়ল না। কুঞ্জ ততদিনে সেয়ানা হয়েছে। বাবাকে বলেছিল, কী হবে এসব দেখে, যাদের জমিবাড়ি তাদের তো হুঁশ নেই। চলো সব ছেড়েছুড়ে বাকিদের মতো ডাঙায় চলে যাই।
নিরাপদ ছেলের পরামর্শ কানে নেয়নি। বলেছিল, বাবুরা একদিন আসবে দেখিস, নইলে মাসে মাসে টাকা পাঠাতে যাবে কেন? আমরা চার পুরুষ এ বাড়ির খানসামা। আমি মারা যাওয়ার পর তোকে এ বাড়িটা আগলে থাকতে হবে। এটাই বাপের আদেশ বুঝবি। মাথার ওপর ছাদ, পেট-ভাত দুটোই জুটে যাবে। তোর আর চিন্তা কীসের?
বাবু সত্যিই একদিন এলেন। বাবা তখন মৃত্যুশয্যায়। কোট প্যান্ট পরা বিলেতি কায়দার চন্দ্রভানুকে দেখে, কুঞ্জর ঠিক ভরসা জাগল না। ঠগ নয় তো? দেখা গেল তা নয়। এই বাবুকেই বাবা নাকি কোলেপিঠে নিয়ে ঘুরেছে। কুঞ্জর বাবার সঙ্গে জমিদারবাবুর অনেক কথাবার্তা হল। মরে যাওয়া গুরুজনদের কথা ঘুরেফিরে আসছিল মুখে। কষ্ট ছিল না। রাতের তারারা নিবতে না নিবতে দেহ ছেড়ে চলে গেল বাবা। শেষকৃত্যের সমস্ত ব্যবস্থা করলেন বাবু। শ্রাদ্ধ-শান্তি হল। ইতিমধ্যে শহুরে পোশাক ছেড়ে চন্দ্রভানু ধুতি পিরানে পাক্কা জমিদার। বললেন, আর কোনওদিন শহরে ফিরব না।
জমিদারবাবু আদৌ বিয়ে করেছেন কি না, ছেলেমেয়ে আছে কি নেই, কিছুই জানে না কুঞ্জ। ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে কোনও উত্তর পায়নি। মাসে একবার বাবুর নামে মানিঅর্ডার আসে, ব্যস। আর কোনও মানুষ না, চিঠি না, কেউ খোঁজই নেয় না মানুষটার।
সাঁওতালপাড়া পার হতেই মেলার গান, বাজনা, ভেঁপু, তেলেভাজার গন্ধ জাপটে ধরল কুঞ্জকে। হাসিহাসি মুখে মেলাতলার দিকে এগিয়ে যায় কুঞ্জ। পাশ দিয়ে দৌড়োচ্ছে বোতাম ছেঁড়া জামার ছেলেপুলে, আধ ন্যাংটা বাচ্চারা। গাঁয়ের মেয়ে-বউয়ের মুখে লাজুক কৌতূহল।
মেলার এদিক সেদিক ঘুরে কুঞ্জ অবশেষে ম্যাজিকের তাঁবুতে। চটের ওপর সামনের সারিতে বসে সে এখন মন্ত্রমুগ্ধ। মনের মধ্যে জোর টানামানি চলছে। ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গিনী ডানাকাটা পরিটিকে নিয়েই হয়েছে মুশকিল। এত সুন্দর দেখতে মেয়ে কুঞ্জ কোনওদিন দেখেনি। আজ পর্যন্ত ভিডিয়ো হলে দেখা দুটো হিন্দি সিনেমার নায়িকাকে ও কল্পনায় নিয়ে আসে। এ মেয়েটা তাদেরও ছাড়িয়ে গিয়ে চড়ুইপোতার লক্ষ্মী ঠাকুরের মতন হয়ে যাচ্ছে। তা কিছুতেই হতে দেবে না কুঞ্জ। এই নিয়েই মনের মধ্যে তুমুল আলোড়ন। একবার যখন ম্যাজিশিয়ান করাত দিয়ে মেয়েটাকে তিন টুকরো করতে গেল, নিজের জায়গা থেকে ছিটকে উঠতে যাচ্ছিল কুঞ্জ, পরক্ষণেই নিজেকে সামলায়। মাচায় যা হচ্ছে সবই তো নিছক খেলা।
তিন টুকরো হয়ে মেয়েটা যথারীতি জোড়াও লেগে গেল। মুক্ত ঝরানো হাসি ছড়িয়ে চলে গেল মঞ্চের আড়ালে। আবার ফিরে এল জরির অন্য পোশাকে। ঝলমলে কাপড়ের ভেতরে শরীরের ঢেউ যেন ফুঁসে ওঠা অজয়ের জল। কুঞ্জর হঠাৎ খেয়াল পড়ে সে অনেকক্ষণ দম বন্ধ করে বসে আছে।
কখন যে শো ভেঙে গেছে খেয়াল নেই। বন্ধ পরদার দিকে ঠায় তাকিয়ে কুঞ্জ। কে যেন এসে ডাকে, কী হল ভায়া, এখনও টিকিট উসুল হয়নি বুঝি, বাড়ি যাবে না? ঘোর ভেঙে কুঞ্জ দেখে, ম্যাজিশিয়ান। এখন অবশ্য পরনে লুঙি, কোঁচকানো পাঞ্জাবি। হাতে মদের গ্লাস।
আবেগ সামলাতে না পেরে ম্যাজিশিয়ানের পা ধরে নেয় কুঞ্জ, আমাকে আপনার দলে নিন। কী দারুণ আপনার ভেলকি! আপনার খেলা দুটো টিকিট কেটে দেখা উচিত।
অভিনয়টা এত ভাল হবে কুঞ্জ নিজেও ভাবেনি। আসলে কোন ভেলকিতে মজেছে, ম্যাজিশিয়ান তা টেরই পেল না। বলল, আয়, গ্রিনরুমে আয়। আমার সঙ্গে দুটি খেয়ে বাড়ি যাবি।
খাওয়ার সময় আবার দেখা হল পরির সঙ্গে। নাম বনমালা। আলাপ করিয়ে দিল ম্যাজিশিয়ান। সাধারণ ছাপা শাড়িতে রূপ যেন আরও খুলে গেছে। হাতে রঙিন তরল। হাসি মাদকতাময়। চোরা চাউনিতে কী বিষম বিষ! আবেগ মেশানো লজ্জাটা ঢাকতে গিয়ে কুঞ্জও দু’পাত্তর মেরে দিল। তারপর বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে। ম্যাজিশিয়ানের হাত ধরে বলতেই থাকে, শিষ্য করবেন তো? চরণে এট্টু ঠাই দিবেন গো।
ম্যাজিশিয়ান বাড়ির কথা খেয়াল করিয়ে দেয়। কুঞ্জ বলে, আমার বাড়ি নেই, মা বাবা ভাই বোন কেউ নেই। শুধু এক শালা মনিব আছে। শালা ফাঁকা জমির জমিদার।… তারপর মনিবের উদ্দেশে আরও কিছু অকথ্য গালিগালাজ করে।
ম্যাজিশিয়ান বোঝে কুঞ্জর নেশা হয়ে গেছে। মেলাতলা পার করে কুঞ্জকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে যায় ম্যাজিশিয়ান।
ধু ধু মাঠ পার হচ্ছে কুঞ্জ। কানে বাজছে বনমালার খিলখিলে হাসি। চরাচর জুড়ে জ্যোৎস্নার আলো। দূরে রুপোলি ফিতের মতো অজয়ের জল। চিকচিক করছে বালি। এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে কুঞ্জর মনে হয়, এটাও কি কম ভেলকিবাজি! যাচ্ছিলাম কী মন নিয়ে, চারপাশে রুখোশুখো জমি, ফেরার সময় জোছনায় সব মোলাম। এই ভেলকির জাদুকরকে দেখা যায় না।… এত আনন্দের মধ্যেও মনের ভেতর একটা কাঁটা খচখচ করছে। কী যেন একটা হয়নি, বাকি আছে কিছু একটা ! বুকপকেটে কাগজে মোড়া গুড়কাঠি। হাত ছুঁয়ে একবার দেখে নেয় কুঞ্জ। ম্যাজিকের তাঁবুতে ঢোকার আগে বাবুর জন্য মনে করে কিনে রেখেছে। তা হলে?
মাথার ওপর কর্কশ ডাক দিয়ে উড়ে যায় রাতচরা পাখি। বিদ্যুচ্চমকের মতো কুঞ্জর মনে পড়ে, আজ মার খাওয়া হয়নি। হ্যাঁ মার খাওয়া। রোজ খায়। বাবু প্রতি রাতে তাকে লাঠিপেটা করে। এটা তাদের খেলা। ঘুম তাড়ানোর কুৎসিত বিনোদন। নিছক আনন্দ ছাড়াও কুঞ্জর এই খেলায় আর একটা পাওনা হয়। বাবু ওকে ভাল ভাল খেতে দেন। তুলে দেন নিজের পাত থেকেও। ওই সময়টা মনিব চাকর কোনও ভেদাভেদ থাকে না। এই খেলার সাক্ষী অবলা বিড়াল, ইঁদুর, আরশোলা, টিকটিকি। আকাশের চাঁদ-তারাও জানে। খেলা হলেও প্রতিটি বেত্রাঘাতে নদী থেকে ভেসে আসা নির্মল বাতাস শিউরে ওঠে। দেওয়াল থেকে মেঝেতে খসে পড়ে টিকটিকি। কুঞ্জ থাকে নিষ্কম্প। যে-কোনও মারই গা-সওয়া হয়ে গেছে তার।
খেলাটা শুরু হয়েছিল এমনিই একদিন। বংশের নানান বীরত্বের কাহিনি অন্যান্য দিনের মতোই বলে যাচ্ছেন বাবু। ঘুমে ঢুলে পড়ছে কুঞ্জ। অভিমানী কণ্ঠে বাবু বলে উঠেছিলেন, বুঝলি কুঞ্জ, এই যে আমি কথা বলছি আর তুই ঘুমোচ্ছিস, আমার ঠাকুরদা হলে কী করতেন বল তো?
কী করতেন? আধবোজা চোখে জানতে চেয়েছিল কুঞ্জ।
বেত মারতেন, বেত।
আপনিও মারুন। তাতে যদি চটকাটা ভাঙে। সাঁঝবেলায় কাজই-বা কী বলুন? মানুষজন নাই। ঝগড়াঝাঁটি নাই। বিজলিবাতিও নাই।
ধ্যাত, তা আবার হয় নাকি! লাজুক গলায় বলেছিলেন বাবু। তারপর বলেন, ওসব আজকাল অচল। লোকে জানলে আমার জেল হয়ে যাবে।
কিচ্ছু হবেনি। এই মরা চরায় কে আসছে দেখতে! আপনার ঠাকুদ্দা যেমন করে শাসন করতেন, যা যা বলতেন, যেরকম করে মারতেন, যাত্রাপালার মতো করুন, বেশ জমবে। বলে, বেত নিয়ে এসে বাবুর হাতে দেয় কুঞ্জ। বাবু যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। পিঠ পেতে উবু হয়ে বসে কুঞ্জ। বলে, কী হল মারুন, মারুন না। আমি কিছু মনে লিব নাই। বলুন, আপনার ঠাকুদ্দা কীরকমভাবে ধমকাতেন।
বাবু বলে ওঠেন, বল শুয়োর শরবতটা এত তেতো হল কেন, বল? তোকে না কতদিন বলেছি, লেবুটা…
আলতো করে পিঠে বেত পড়ে৷ কুঞ্জ বলে, হলনি। আর এট্টু জোরে। আমার যে অ্যাক্টিংটো আসছেনি।
বাবু আর একটু জোরে মারেন। কুঞ্জর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, এবারের মতো মাফ করে দেন কত্তা। আর হবেনি। কুনোদিন হবেনি।
বাবুর হম্বিতম্বি বাড়ে। আরও মারেন। কুঞ্জ বারবার মাফ চেয়ে খেলাটা জমিয়ে দেয়। বাবু খুব আমোদ পান। কুঞ্জও পুলকিত হয়। বেশি উৎসাহে বাবু দু’-একবার বেশ জোরেই মেরে ফেলেছেন বলে, দুঃখিত, লজ্জিত দুটোই হন। ব্যস, ব্যস আর না। যথেষ্ট হয়েছে, বলে, বেত ছুড়ে ফেলে, বাবু কুঞ্জর পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। তারপর বলেন, অনেক রাত হল। চল, খেয়ে নিই।
সেদিন নিজের পাত থেকে কুঞ্জর থালায় খাবার তুলে দিয়েছিলেন। পরের দিন দশটা টাকা দিয়ে বলেন, চড়ুইপোতায় গিয়ে রসগোল্লা নিয়ে আয়। সন্ধেবেলা নাটকের পর দু’জনে খাব।
তারপর থেকে সে যাত্রাপালা রোজই চলে। না চললে বাবুর ঘুম আসে না। কুঞ্জরও না। আজ পালার সময় চলে গেছে। রাত ক’টা এখন কে জানে! বাবু নিশ্চয়ই জেগে বসে আছেন। আজ আর সেই খেলার উৎসাহ নেই কুঞ্জর। বরং খেলাটার কথা ভেবে এখন তার ঘেন্নাই হচ্ছে। পেটে খিদে নেই বলেই কি?
একবার টোকা মারতেই সদর খুলে গেল। চাঁদের আবছা আলোয় বাবুর দুশ্চিন্তামাখা মুখ, কী রে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ! আমি তো ভাবলাম চোর ডাকাতের পাল্লায় পড়লি হয়তো।
কী আছে আমার সঙ্গে, চোর ডাকাত ধরবে! বিরক্তির সুরে বলে কুঞ্জ। সদর ডিঙিয়ে দরজা দেয়।
বাবু বলেন, সে না থাক। জমিদারবাবুর চাকর তো, ওরা ভাববে নিশ্চয়ই কিছু আছে। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে কুঞ্জ। বুকপকেট থেকে কাগজে মোড়া গুড়কাঠি বার করে বাবুর
হাতে দেয়। বাবু বলেন, এখন এসব খেয়ে কী হবে! রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। সে কী, আপনি এখনও খান নাই! আশ্চর্য হয়ে বলে কুঞ্জ।
তুই না এলে একা একা খাই কী করে বল।
আমি মেলা থেকে খেয়ে এসেছি। আপনাকে বেড়ে দিই, আপনি খেয়ে শুয়ে পড়েন। তা কী করে হয়। আজ আমাদের যাত্রাপালা হয়নি। ঘুমই আসবে না।
কথাটা শুনেই মাথা গরম হয়ে যায় কুঞ্জর। ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে, ওসব খেলাফেলা আজ থেকে বন্ধ। আমিও আর ই বাড়িতে থাকব নাই। আমার হিসেবটো মিটিয়ে দেন। কালই চলে যাব।
বড় বড় পা ফেলে কুঞ্জ ভেতর বাড়িতে চলে যায়। রায়চৌধুরী বংশের শেষ পুরুষ বিষণ্ন চিত্তে একটা গুড়কাঠি তুলে কামড় দেন, এ হেঃ, একদম নেতিয়ে গেছে।
পরের দিন সন্ধেবেলা। এক দিনের পুরনো পূর্ণিমার চাঁদ কুটিল হাসি নিয়ে উঠেছে আকাশে। রায়বাড়িতে একজনের দীর্ঘশ্বাস। কুঞ্জ দুপুরে চলে গেছে। চন্দ্রভানু এখন একা। একদিন যে এরকম হবে, সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবেন, চন্দ্রভানু জানতেন। কিন্তু দিনটা যে এত নিকটে, সেটা আশা করেননি। আধুনিক সভ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে চন্দ্রভানু এই নির্বাসন নিজেই বেছে নিয়েছিলেন। এমনই সৌভাগ্য, কুঞ্জ তাঁকে এনে দিয়েছিল হারিয়ে যাওয়া সময়ের নির্যাস। অভ্যেসটা খারাপ করে দিয়ে গেল কুঞ্জ। এখন শুধু দিন গোনার পালা।… এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন চন্দ্রভানু। আমলকী গাছের মাথায় শুকতারাটা প্যাট প্যাট করে চেয়ে আছে চন্দ্রভানুর দিকে। এমন সময় সদরে ভীরু শব্দে ঠক ঠক।
হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে চন্দ্রভানুর। তা হলে কি ফিরে এল কুঞ্জ! দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলেন। এ কী সর্বনাশ কাণ্ড! কুঞ্জর সঙ্গে এই অপরূপা তন্বীটি কে? চাঁদের আলো পিছলে যাচ্ছে মেয়েটার গায়ে। চাঁপাফুলের মতো রং, একটু লম্বার ওপর সরু কোমরের মেয়েটা মনে করিয়ে দিচ্ছে, ছোটবেলায় পরদার আড়াল থেকে দেখা নন্দা বাইয়ের কথা।
আয়, ভেতরে আয়। কোথায় যে চলে যাস! কুঞ্জদের সাদর অভ্যর্থনা জানান চন্দ্রভানু।
শিরশিরে একটা ভয় কুঞ্জর পিঠ বেয়ে নেমে যায়। বাবুর চোখ লালসায় ভরা। এটা কোনও অভিনয় নয়, আজই বাবুকে আসল জমিদার মনে হচ্ছে।
রায়বাড়ির বিগবেন ঘড়িতে দশটার ঘণ্টা বাজল। অন্য দিন হলে কুঞ্জদের এই সময়টাই গভীর রাত। বনমালার জন্য রাত পিছিয়ে গেছে। কুঞ্জ অবশ্য রসুইঘরে। তরিবত করে রান্না করতে হচ্ছে। বনমালা বাবুর ঘরে। বাড়ি ঢুকতেই বাবু এমনভাবে বনমালাকে টেনে নিলেন, যেন ওঁর জন্যেই বনমালাকে নিয়ে এসেছে কুঞ্জ। মুরগি আনতে দরাজ হাতে টাকা বার করে দিলেন বাবু। সিরাজগঞ্জে আজ হাটবার। দু’মাইল ঠেঙিয়ে যেতে হল সেখানে। মাংস রান্না হয়ে এসেছে। ভাঙা জমিদারবাড়ির দালানময় ভেসে বেড়াচ্ছে সুখী সুখী গন্ধ। কুঞ্জর মুখে হাসি নেই। কী ভেবেছিল, কী হল!
কথামতো আজ দুপুরেই পোঁটলা বেঁধে বাগদিপাড়ার মেলায় হাঁটা দিয়েছিল কুঞ্জ। ম্যাজিশিয়ানের দলে নাম লেখাবে। আর ফিরবে না। বাবু অনেক করে বুঝিয়েছেন। হাতে-পায়ে ধরাই যা বাকি ছিল। কুঞ্জর মনে তখন অন্য টান। বাবুর কথা গ্রাহ্যই করেনি। মেলায় পৌঁছে দেখে অবাক কাণ্ড, সব কিছুই ঠিকঠাক আছে, শুধু ম্যাজিকের তাঁবুটাই কীরকম খোলামেলা। শূন্য খাঁচার মতন। বুকটা হায় হায় করে উঠেছিল। ক্রমে খবর নিয়ে জানে, ম্যাজিশিয়ানটা নাকি দাগী ডাকাত। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তবে সঙ্গিনীটি আগেই বেপাত্তা।
মনখারাপ নিয়ে মেলাতলা ছেড়ে ফিরে আসছিল কুঞ্জ। একটু ফাঁকায় আসতেই দেখে, পাশে পাশে হাঁটছে ঘোমটা দেওয়া একটা বউ। কুঞ্জ যত জিজ্ঞেস করে, কে গা তুমি, কোন গাঁয়ের, কাদের ঘরের মেয়ে?
উত্তর নেই। সাঁওতাল পাড়া পার হয়ে দক্ষিণদাড়ির মাঠে পা রাখতেই ঘোমটা খুলে ফেলে বউটা। কুঞ্জ তো হতভম্ব। বনমালা বলে, পুলিশ আমাকেও খুঁজছে। দু’-চারটে রাত লুকিয়ে রাখতে পারবে না?
আবেগে বিহ্বল কুঞ্জ অতি কষ্টে নিজেকে সামলায়। বলে, আরও মাইল খানেক ঘোমটা দিয়ে হাঁটা লাগবে।
ওই পথটুকু জুড়ে তাদের সুখী দাম্পত্যের কল্পনায় কেঁপে কেঁপে উঠেছে কুঞ্জ। কিন্তু বাবুর বাড়িতে ঢুকে ব্যাপারটা ঘুরে গেল, বনমালা যেন আর চিনতেই পারছে না। একবারও এল না রসুইঘরে।
কুঞ্জ, খানা লাগাও। অন্দরমহল থেকে ভেসে আসে বাবুর গলা। বাবাঃ, ভাষাই পালটে গেছে!
ঢিমেতালে গড়িয়ে যাচ্ছে রাত। নাচঘরের জানলার কোনও একটা বোধহয় খোলা রয়ে গেছে। হাওয়া এসে দোলাচ্ছে ভাঙা ঝাড়লণ্ঠন। ঠুং ঠাং আওয়াজ। বাবুর ঘরে গুজুর ফুসুর
খিলখিলে হাসি৷ কুঞ্জ থাকে ভাঁড়ারঘরে। দু’কানে আঙুল ঢুকিয়ে, হাঁটু বুকে চেপে সবে ঘুমটা বাগিয়ে এনেছে, কে যেন ঠেলা দেয় গায়ে। বারবার। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখে, বনমালা ! অবাক হয়ে কুঞ্জ বলে, কী ব্যাপার, তুমি!
হিসহিসিয়ে বনমালা বলে, বুড়োটা শুধু বকতেই জানে, কোনও কম্মের নয়। সরে শোও। সরে গিয়ে বনমালাকে জায়গা দেয় কুঞ্জ। বনমালা শোয় না। চোখটা যেন জ্বলে। এ আগুন নেভানোর বয়স বাবু পার করে গেছেন, কুঞ্জ সবে দরদ লাগিয়ে দুটো কথা বলতে যাবে, বনমালা বলে ওঠে, ওসব ঢঙ করার সময় পরে অনেক পাবে। দরকারি কথাটা আগে শোনো, বুড়োটাকে খুন করতে হবে। লোকটার নিশ্চয়ই অনেক টাকা। লাশ বাগানে পুঁতে দিলে কেউ টের পাবে না। আমরা এ বাড়িতেই থেকে যাব।
কুঞ্জর চোখ বড় বড়, মুখ হাঁ হয়ে গেছে। বনমালার শরীর থেকে ভেসে আসছে বাবুর ঢেলে দেওয়া আতরের সুগন্ধ, সেই মেয়ে কিনা বাবুকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করতে বলছে! বনমালা তাড়া দেয়, কী হল, ভ্যাবলা মেরে গেলে যে, আমাকে পেতে গেলে এটুকু তোমায় করতেই হবে।
কুঞ্জ বলে, বাবুর যে খুব টাকা আছে, মনে হয় না। তাঁর ঠাকুদ্দার ছবির পিছনে হিডন চেস্ট থেকে দু’-দশ টাকার বেশি বার করতে দেখিনি।
আছে, ওখানেই সব আছে। হিরে, সোনা, টাকা। ব্যাটা মহা কিপটে। একটা বুড়ো শকুন। বলে, গরম শ্বাস ফেলে বনমালা।
গম্ভীর মুখে কী যেন ভাবে কুঞ্জ। একটু পরে বলে, কিন্তু খুনটা করব কী দিয়ে?
কেন, এত বড় জমিদারবাড়ি, বর্শা, ছুরি, কিচ্ছু নেই!
হাল ছাড়া গলায় কুঞ্জ বলে, ধুর ধুর, সেসব ধুলো, জং পড়ে একদম ভোঁতা হয়ে গেছে। লাউডগাও কাটা যাবেনি।… বলতে বলতে কুঞ্জর মনে পড়ে একটা অস্ত্র আছে, কাঠকুটো কাটতে, নারকেল ছাড়াতে লাগে। কুঞ্জ বলে ওঠে, রামদা আছে, চলবে?
খুব চলবে। একটু ধার দিয়ে নিয়ো। তবে শানওলার কাছে নয়। পুলিশ চট করে খোঁজ পেয়ে যাবে।
চন্দ্রভানুর ঘর থেকে জলদগম্ভীর নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসে। কুঞ্জ, বনমালা ফিসফিসিয়ে খুনের পরিকল্পনা করতে থাকে। লাশটাকে বাগানের কোথায় পুঁতবে? এদিকে আবার শিয়ালের বড় উৎপাত, যদি মাটি সরিয়ে বার করে ফেলে… পাখির কিচিরমিচিরে কুঞ্জর খেয়াল হয় কখন যেন ভোর হয়ে গেছে। সচকিত কুঞ্জ বলে ওঠে, এই রে, আলো ফুটে গেল যে, এক্ষুনি চা চাইবে বাবু।
খাট থেকে নেমে দাঁড়াতেই কুঞ্জর কনুই টেনে ধরে বনমালা। বলে, তুমি রামদাটা শান দেওয়ার ব্যবস্থা করো। চা, রান্নাবান্না আমি সামলাচ্ছি।
দুপুর। নদীর ধারে গা শিরশিরে শব্দ। পাথরের ওপর দা শান দিচ্ছে কুঞ্জ। অজয়ের জলের মতোই চকচক করছে অস্ত্রটা। সন্তুষ্ট হয়ে চরে উঠে আসে কুঞ্জ। কোমরে ধুতির খুঁটে ভাল করে বেঁধে নেয় রামদা। তারপর হাঁটতে থাকে রায়বাড়ির উদ্দেশে।
সদর পার হতেই দেখে, বাবু বারান্দার আরামকেদারায় বসে, একা একা দাবা খেলছেন। পায়ের কাছে পোষা বিড়ালের মতো রোদ। বাবুর ওই রাজকীয় ভঙ্গির সামনে কুঞ্জ কেমন যেন বেশি অনুগত হয়ে যায়। মাথা নিচু করে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। বাবু ডাকেন, কুঞ্জ শোন।
বুকটা ধক করে ওঠে কুঞ্জর। সামনে দাঁড়িয়ে বলে, বলুন।
বোস এখানে।
একরাশ কুণ্ঠা আর অস্বস্তি নিয়ে বাবুর পায়ের থেকে একটু দূরে বসে কুঞ্জ। বাবু বলেন, খুনটা কখন করবি ঠিক করলি? বেলাবেলি সেরে ফেলবি, নাকি রাত অবধি অপেক্ষা করতে হবে?
ঠকঠক করে কাঁপছে কুঞ্জ। তা হলে কি বনমালা সব বলে দিল? তাতে ওর কী লাভ! এমনও হতে পারে বাবু দূরবিন লাগিয়ে দেখে নিয়েছেন, নদীর ধারে কুঞ্জর শান দেওয়া। ঠিক কী যে ঘটেছে কুঞ্জ আন্দাজ করতে পারে না। রসুইঘর থেকে ফোড়ন দেওয়ার ‘ছ্যাঁক’ শব্দ ভেসে আসে। বাবু গড়গড়ার পাইপে টান দিতে দিতে, ঘুঁটি তুলে নিজেই নিজেকে চাল দেন। মুখ না ঘুরিয়ে বলেন, কোথায় পুঁতবি? কবরটা খুঁড়ে কাজ এগিয়ে রাখ।
কুঞ্জর ফোঁপানোর শব্দ শুনে বাবু ফিরে তাকান। বলেন, খামোকা কাঁদছিস কেন? আমার থেকে খাওয়া নুন চোখের জল দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যে।
বিশ্বাস করেন বাবু, ওর ওসকানিতে…
হাত তুলে আশ্বস্ত করে বাবু বলেন, জানি। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছিস, আমি মরে গেলে তুই পেট চালাবি কী করে! তখন আবার দুটো পেট হয়ে যাবে। তারপর হয়তো আরও। পিয়ন তোর হাতে মানি অর্ডার দেবে না। আর আমার চেস্টে যে কিছুই নেই, তুই ভাল করেই জানিস।
মনের কুয়াশা কেটে যেতে থাকে কুঞ্জর। সত্যি বড্ড ভুল করে ফেলতে যাচ্ছিল। ভাতকাপড়ে রাখতে না পারলে, বনমালাও একদিন চলে যাবে। ছিঃ ছিঃ, এভাবে নিজের পায়ে কেউ কুড়ুল মারে! বাবু আবার ফিরে গেছেন দাবা খেলায়। কুঞ্জ বলে, তা হলে মেয়েটাকে নিয়ে কী করা যায়?
চলে যেতে বল।
যদি না যেতে চায়।
চল, পুলিশে ধরিয়ে দিই। পুলিশ তো ওকে খুঁজছে।
পুলিশ যদি বলে, দু’দিন লুকিয়ে রেখেছিলেন কেনে?
বাবুর কপালে এবার চিন্তার ভাঁজ। যেন কঠিন কোনও চালের সামনে পড়েছেন। একটু সময় নিয়ে বলেন, ভাল কথায় না গেলে, ওকেই খুন করে বাগানে পুঁতে দিবি। কেউ টের পাবে না।
অসহায়ভাবে বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে কুঞ্জ। নিজেকে কোমরে গোঁজা রামদাটার সঙ্গে আলাদা করতে পারে না। সেও তো এখন অন্ধ অস্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। নিজের কোনও পছন্দই নেই।
পরের দিন সন্ধেবেলা শিয়ালটা রায়বাড়ির বাগানে ঢুকতে গিয়েও, পিছিয়ে আসে। আজ যেন সপাৎ সপাৎ আওয়াজটা বড্ড বেশি। রায়বাড়ির গুমসানো বাতাস ভীষণ হাঁফাচ্ছে। অস্থির হয়ে সারা বাড়ি জুড়ে উড়ছে বাদুড়। বিড়ালটা ভয়ে দৌড়োচ্ছে জ্যোৎস্না মাখা বালুচরা ধরে।
রায়বাড়ির দালানে প্রতিটি বেত্রাঘাতের শব্দের পর ভেসে আসছে কুঞ্জর গলা, মারুন বাবু, আরও জোরে মারুন। ভুলিয়ে দিন মেয়াটোকে।
বাবুও যথাসম্ভব জোরেই মারছেন। উনিও ভুলতে চেষ্টা করছেন মেয়েটাকে। মেয়েটা যে এ বাড়িতে নেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তার কী গতি হল, এই দু’জন ছাড়া বাড়ির অবলা পশুপাখিরাও জানে না। রোজকার মতোই যুগ-অভিজ্ঞ প্রাচীন চাঁদ আলোর খ্যাপলা জাল ফেলে বসে আছে চন্দনপুরের মাথায়। এই রোমহর্ষক ঘটনায় তার কোনও বিচলন নেই। হালের পৃথিবীর কোনও নাটকীয়তাই আর তাকে টানে না।
দেশ জুন ২০০৪