ঠুটো
রবিবার রুগির ভিড় এমনিতে কমই হয়। সুমিতকে জব্দ করার জন্য বুঝি ডিসপেনসারি থিকথিক করছে আজ। কুড়ি বাই পঁচিশ ফুটের ঘর। স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের মতো চেয়ার টেবিলে সুমিত, দেওয়াল ঘেঁষে বেঞ্চ আর মেঝেতে জবুথবু হয়ে বসে আছে রুগি। এরা সব গ্রাম-গঞ্জের মানুষ। এদের জন্য পরদা ঘেরা প্রাইভেসির দরকার হয় না। পাঁচজনের সামনে নিজের রোগের কথা বলতে কুণ্ঠিত হয় না একটুও। শুয়ে পরীক্ষা করার জন্য সুমিতের পেছনে একটা দেড় হাত চওড়া বেঞ্চ আছে। এই শহরটা মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্তে। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে আছে কিছু বাংলাদেশের পেশেন্টও। দালালকে টাকা দিয়ে বর্ডার টপকেছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট শিবুকে সুমিত বলে রেখেছিল, দশটার পর আর রুগি দেখবে না। নাম লেখার খাতা যেন সাড়ে ন’টার মধ্যে তুলে নেয়।
শিবু নির্দেশমতো কাজ করেছে, লাভ হয়নি কিছু। একটা পেশেন্ট ছাড়ছে তো দুটো ঢুকে যাচ্ছে ঘরে। এরা শহরে এসে তুলনামূলক নির্বাক থাকে। শিবু ওদের বারবার বলছে, নাম লেখা বন্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তারবাবু আর দেখবেন না। যে যার বাড়ি চলে যাও।
চোখের পলক তুলে শিবুকে একবার দেখে আরও বোকা সেজে যাচ্ছে লোকগুলো। ভাবটা এমন, গাঁ-ঘরের গরিব মানুষ তো, শহুরে বাংলা ভাষাটাও ভালভাবে বুঝি না।
ফিজ় কুড়ি টাকা। এক বুড়িকে দেখা শেষ করল সুমিত। বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়েছে। সুমিত টেবিলে হাত পাতে। এরা টাকা বার করতে বড্ড সময় নেয়। হাত বাড়িয়ে না রাখলে পনেরো অথবা আঠেরো দিয়ে বাকিটা জোড়হাত করে ম্যানেজ করে দেবে। হাত পাতার জেসচারটা কুৎসিত হলেও, যস্মিন দেশে যদাচার…
দুটো কোঁচকানো দশ টাকার নোট হাতে এল সুমিতের। খুলে দেখে নেয় ছেঁড়াটেড়া আছে কিনা। মাঝে মাঝে তিরিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো নোটও চলে আসে, বাজারে সেসব কেউ নিতে চায় না। একবার তো খুচরোর মধ্যে নবাবি আমলের কয়েন চলে এসেছিল।
টাকাটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে সুমিত বৃদ্ধাকে বলে বাইরে কেউ যদি বসে থাকে, বলে দেবেন, আজ আর দেখব না। চলে যেতে বলবেন।
বৃদ্ধা ঘাড় হেলিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সুমিতের সামনের চেয়ারে এসে বসে কোলে বাচ্চা এক মা। ভিড়টাকে আজ ক্রমশ অসহ্য ঠেকছে সুমিতের। কোয়ার্টারে গেস্ট এসেছে। গেস্ট বললে সবটা বলা হয় না, বুজুম ফ্রেন্ড বাবলা। সঙ্গে ওর বউ তুলিকা। বাবলা, সুমিত একসঙ্গে বড় হয়েছে দক্ষিণপাড়ায়। উচ্চমাধ্যমিক অবধি একই স্কুল। কলকাতায় খেলা, সিনেমা দেখতে গেছে স্কুল পালিয়ে। জয়েন্টে র্যাঙ্ক পেয়ে সুমিত গেল ডাক্তারি
পড়তে, বাবলা পিয়োর সাইন্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি। প্রায়ই চলে আসত সুমিতের হস্টেলে। বেশ কয়েকবার রাতে থেকে গেছে। বাবলা ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। বিয়ে করল একটু দেরি করে, গত বছর। বউ নিয়ে সুমিত গিয়েছিল বিয়েতে। তখন বলেছিল, এবার এক শনিরবি দেখে চলে আর আমার ওখানে। দু’বছর হল বদলি হয়ে গেছি, একবারও তো এলি না। মুর্শিদাবাদে কত লোক বেড়াতে যায়, সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব তোদের। আমার ওখান থেকে তো বেশি দূর নয়।
একটু দেরি হলেও বাবলা কথা রেখেছে। আর বাবলা আসা মানে, স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠা। কত গল্প যে করার আছে ওর সঙ্গে… বাচ্চাটার পেটে হাত দিতে, তারস্বরে কেঁদে উঠল। এদের রোগ মোটামুটি এক। একই ধরনের জীবাণুতে সংক্রামিত হয় এরা। অপরিশোধিত জল, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অশিক্ষা। প্রতিরোধের জন্য সুমিতকে বলতে হয় একই কথা, লিখতে হয় একই ওষুধ। সেই ওষুধের ডিলার স্যান্ট্রোগাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সাতসকালে। ওই গাড়িতে চেপে বাবলাদের স্টেশন থেকে নিয়ে এল সুমিত। স্যান্ট্রোটা আজ সারাদিন থাকবে। গাড়ি দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল বাবলার, সে কী রে শালা, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে এসি গাড়ি কিনে ফেললি!
সুমিত বলেছিল, ধুর, আমার নয়। এখানকার এক বন্ধুর।
বাবলার বউয়ের সামনে সঠিক তথ্যটা দিতে অস্বস্তি হচ্ছিল সুমিতের। বাবলাকে বলাই যায়। সুমিতের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড যারা জানে, গাড়ি দেখে অবাক হবেই। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। শরিকি বাড়ির এক কোনায় বাস। বাবা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। তিন ভাই, দু’বোন। সুমিত বড় ছেলে। পড়াশোনায় মাথা ভাল। বাবা সকাল সন্ধে গন্ডাখানেক টিউশন করে সুমিতকে ডাক্তার করেছেন। ছোটবেলা থেকে সুমিতের ওপর বিশেষ নজর ছিল বাবার। পুষ্টিকর দামি খাবারের ব্যবস্থা থাকত বড় ছেলের জন্য। প্রতি বছর ফার্স্ট হয়ে ক্লাসে ওঠে। ভাইবোনগুলো তাকিয়ে থাকত দাদার খাওয়া দাওয়ার দিকে। লুকিয়ে চুরিয়ে ভাগ দিত সুমিত। পরের দু’ভাইয়ের লেখাপড়া বেশি দূর হয়নি। তবে এখন ব্যাবসা করে দাঁড়িয়ে গেছে। বোনেদের বিয়ে হয়েছে যথা সময়ে। কারও জন্য এক পয়সা খরচ করতে হয়নি সুমিতকে। সামর্থ্যও ছিল না। পুরোদস্তুর ডাক্তার হতে যথেষ্ট সময় লাগে। বাবার জমানো টাকাতেই বিয়ে হয়েছে বোনদুটোর। কিছু ধারবাকি মেজভাই করে থাকতে পারে, সুমিতকে জানায়নি। সংসারের কোনও ব্যাপারে বড়দাকে ওরা জড়ায় না। মেজভাই অমিতের বিয়েতে বউ নিয়ে নিমন্ত্রিতের মতো গিয়েছিল সুমিত। ঘটা দেখে মালুম হয়েছে, ব্যাবসা চলছে রমরমিয়ে। ছোটভাই, বোন-জামাই বেশ তোয়াজ করছিল মেজকে। বিষয়টা সীমার কাছেও অপমানজনক ঠেকে। সুমিত যদিও ভাইবোনেদের খুব একটা দোষ দেখে না, হায়ার সেকেন্ডারির পর সেই যে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা শুরু করেছে, সেভাবে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। তবু ছোটবেলার বাড়ি, এক ছাদের তলায় অতকটা পরিবার, পাড়া… এসব কি কখনও ভোলা যায়? ভোলা যায় না কিশোরবেলার বন্ধুদের। স্টেশন থেকে বাবলাদের নিয়ে আসার সময় ক’টা কথাই বা হয়েছে…
বাচ্চাটার নাম জেনে নিয়ে ঘষঘষ করে প্রেসক্রিপশান লিখল সুমিত। বাচ্চার মাকে
বলল, জল ফুটিয়ে খাওয়াবেন ক’দিন। যাওয়ার সময় শিবুর থেকে কয়েকটা ওআরএস-এর প্যাকেট নিয়ে নেবেন। ফের যদি পাতলা পায়খানা করে, গুলে খাওয়াবেন।
ঘাড় নেড়ে বউটা আঁচলের খুঁট খুলতে থাকে। হাসপাতাল থেকে গাদা খানেক ওআরএসএর প্যাকেট আনিয়ে রেখেছে সুমিত, স্যাম্পেল ওষুধপত্তর বিলিয়ে দেয় রোগীদের। যতটা পারে, করে। ,
একগাদা খুচরো পয়সা, আট আনা, এক টাকার কয়েন টেবিলে রাখল বউটা। বিচ্ছিরি শব্দ হল। অভিজ্ঞতাটা নতুন নয়। আজ যেন সবেতেই বিরক্ত লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ঘর ভরতি রুগি দেখে। কয়েনগুলো হাত দিয়ে কাচিয়ে ড্রয়ারে ফেলল সুমিত। তারপরই উঠে দাঁড়াল। গলা তুলে বলতে যাবে, শিবু আর নয়… চেয়ারে এসে বসল চাদর জড়ানো এক বুড়ো। পাশে দাঁড়াল বছর তিরিশেকের একটা লোক। সম্ভবত বুড়োর ছেলে। আদলটা মিলছে। ছেলের মুখে স্থায়ী একটা হাসির ভাব, আসলে কিন্তু হাসছে না। এই এক্সপ্রেশানের লোকেরা বিরূপভাব তৈরি করে সুমিতের মনে। দাঁড়ানো অবস্থাতেই সুমিত বলল, কাল সকালে দেখাবেন। জরুরি কাজ আছে আমার।
বুড়োর ছেলে বলে, ডাক্তারবাবু আমাদের কেসটা খুব সিরিয়াস। একটু দেখে দিন দয়া করে। সেই দত্ত বুরুটিয়া থেকে আসছি।
আর্তিটা ধরা পড়ল গলার স্বরে। মুখটা সেই হাসিহাসি। সুমিত বলে, সিরিয়াস যখন, হাসপাতালে অ্যাডমিট করে দিন। আমি লিখে দিচ্ছি।
না, ঠিক সে ধরনের নয়। আসলে…
কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না। সুমিত বলে দেখুন, সিরিয়াস যদি হবে, উনি এখানে বসে থাকতে পারতেন না, শোওয়ার ব্যবস্থা করতে হত। আজ যান, কাল আবার আসবেন। আমাদেরও তো পার্সোনাল কিছু কাজ থাকতে পারে নাকি? ,
ড্রয়ারে চাবি মেরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সুমিত। চেম্বারের বাইরে পা দিতে গিয়ে চমকে উঠল, বারান্দায়, সিঁড়িতে, রাস্তায় পর্যন্ত পেশেন্ট পার্টি। শিবু কি পারবে এতগুলো লোক তাড়াতে। এদিকে বাবলাকে বলা আছে, জলখাবারটা খেয়ে নে, ততক্ষণ ক’টা রুগি দেখে নিই। তারপর বেরোব মুর্শিদাবাদ দেখতে। লাঞ্চ বহরমপুরের কোনও হোটেলে।
পেশেন্টদের পাশ দিয়ে বারান্দার ধার ঘেঁষে ডাইনিং-এর দরজায় পৌঁছোল সুমিত। ঘরে ঢুকে দেখে, দুই বউ শাড়ি পরছে। ওকে দেখে দু’জনেই দৌড়ে কিচেনে ঢুকে গেল। শাড়ি পরছে মানে প্রায় রেডি। সুমিত জানে মুখের মেকআপ করার পরই শাড়ি পরে মেয়েরা। লিভিংরুমে এসে দেখে, পাজামা পরা খালিগায়ের বাবলা ম্যাগাজিন দেখছে। বিছানা ঘেঁটে ঘুঁটে একসা। ওদের আসার খবর পেয়ে চাদরটা কিনেছিল সীমা। ঘরটাও গুছিয়েছিল যত্ন করে। সব লন্ডভন্ড করেছে বাবলা। ছোট থেকেই ওর এমন স্বভাব। সেটা এখনও আছে দেখে মনে মনে খুশি হয়। বিছানায় বসে বাবলাকে বলে, কী রে রেডি হ
ম্যাগাজিন পাশে রেখে বাবলা বলে, আমার আবার রেডি, পাঞ্জাবি গলাব চলে যাব। তোর রুগি দেখা হল? বাইরে তো হেভি ভিড় দেখলাম।
ও সব হাটিয়ে দিচ্ছি দাঁড়া। এত পেশেন্ট দেখা সম্ভব নাকি আজকে! আমি শালা দু’দিন আগে থেকে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছিলাম, আজ ন’টা অবধি দেখব… কথার মাঝেই নিজেকে শুধরে নিয়ে সুমিত বলে, ওদের অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। দূর দূর গ্রাম থেকে আসে, নোটিশের খবর পাবে কী করে।
বেডসাইড টেবিলের ইন্টারকম তুলে নিয়েছে সুমিত। রিসিভারে বলে, শিবু, একবার শুনে যাও তো।
ফোন রাখার পর বাবলার থেকে প্রশ্ন আসে, কত করে ভিজিট নিস? কুড়ি টাকা। ওনলি টোয়েন্টি। কল-এ গেলে পঞ্চাশ।
ছ্যাঃ ছ্যাঃ। কুড়ি! আমার বন্ধু কুড়ি টাকা ভিজিটের ডাক্তার! লোকজনকে তো বলার মুখ রইল না।
বাবলার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে সুমিত। বলে, ওই সামান্য টাকাই দিতে পারে না অনেকে। গ্রামের গরিবগুরবো লোক সব।
শিবু এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়। সুমিত বলে, যে করে হোক সব পেশেন্টকে ফেরত পাঠাও। আজ আর একটাও দেখব না কিন্তু।
শিবু বলে, লাস্ট একটা দেখে দিন। বাকি আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি। মিনিট পাঁচেক পরে চেম্বারে আসুন।
চলে গেল শিবু। বাবলা উঠে বসেছে বিছানায়। বলে, পেশেন্টগুলো হাসপাতালের আউটডোরে যায় না কেন? তোর কোয়ার্টারের পেছনেই তো আউটডোরটা।
ওদের হয়তো ধারণা,পয়সা দিয়ে দেখালে ডাক্তারবাবু যত্ন করে দেখবেন।
এই হাসপাতালের সব ডাক্তারই তার মানে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে? জিজ্ঞেস করে বাবলা নিজেই উত্তর খুঁজে নেয়। বলে, এখন অবশ্য সরকারি ডাক্তারদের প্র্যাকটিস বেআইনি নয়।
কথার পিঠে চুপ করে থাকে সুমিত। বাবলার জ্ঞাত তথ্যটা ওপর ওপর, খবরের কাগজ ভিত্তিক। আসলে নন-প্র্যাকটিশিং অ্যালাউন্স হিসেবে বেতনের সঙ্গে হাজার চারেক টাকা পায় সুমিত। তাও টাকা নিয়ে পেশেন্ট দেখে। না দেখে উপায় নেই। এটাই এখানকার সিস্টেম। অগুনতি রুগি। এলাকায় প্রাইভেট ডাক্তার ভাল নেই। জীর্ণ, অবহেলিত সীমান্ত শহরে কেন আসবে তারা। এখানে রোগ বেশি, টাকা কম। আউটডোরে এত ভিড় হয়, সামাল দেওয়া যায় না। আলাদা সময় বার করতেই হয়। জলজ্যান্ত ডাক্তার হয়ে এই এলাকায় প্র্যাকটিস না করাটাই বরং অপরাধের
জলখাবারের প্লেট নিয়ে ঢুকল সীমা, তাড়াতাড়ি হাতটা ধুয়ে এসো। আমাদের ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। তুমি খেয়ে নাও। ডিসপেনসারিতে আর কতক্ষণ?
একটা পেশেন্ট। তারপরই বেরিয়ে পড়ব। বলে, বেসিনে হাত ধুতে যায় সুমিত। বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাবলার বউ চুলে আলতো ব্রাশ করছিল, সরে দাঁড়াল সুমিতকে দেখে। ওরা এসে যাওয়াতে কোয়ার্টারটা বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। এরকম মনে হত না, যদি সরকারের দেওয়া ড্রয়িংরুমে চেম্বার না খুলত সুমিত।
ব্রেকফাস্ট সেরে ডাইনিং থেকে বেরোল সুমিত। বারান্দা, সিড়ি সব ভোঁ ভাঁ। একটাও পেশেন্ট নেই। চেম্বারে শুধু একটা পার্টিই বসে আছে, সেই চাদর মোড়া বুড়ো আর তার ছেলে। শিবু এদের কেন তাড়াতে পারল না, কে জানে। শিবু যথেষ্ট চৌকশ। এই হাসপাতালেরই স্টাফ। চাকরির জায়গার থেকে বেশি কর্মতৎপর চেম্বারে। সুমিত দেড় হাজার দেয়।
বুড়োটা কেমন যেন ঝিমোচ্ছে। চেয়ারে বসে সুমিত জানতে চায়, কী হয়েছে আপনার, এই গরমে চাদর কেন গায়ে?
তিন-চারদিন না কামানো দাড়ি, অযত্নের গোঁফ, বয়স আন্দাজ পঁয়ষট্টি। গোবেচারা চোখ তুলে নিজের ছেলের দিকে তাকায়। অর্থাৎ উত্তর দিতে হবে ছেলেকে। ছেলে উত্তর দিতে ইতস্তত করছে। সুমিত ফের বলে, কী হয়েছে না বললে আমি…
কথার মাঝেই সচল হয় বুড়োর ছেলে। মুখের হাসিভাবটা রয়েই গেছে। বুড়োর গা থেকে ধীরে ধীরে খুলে নেয় চাদর। সামনের দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সুমিত। বুড়োর দু’পাশের হাত সুদ্ধ শরীরটা দড়ি দিয়ে বাঁধা!
এ কী, এভাবে বেঁধে রেখেছেন কেন? শরীরে অসুবিধেটা কী?
এবারও কোনও উত্তর না দিয়ে বুড়োর বাঁধন খুলতে থাকে তার ছেলে। একই রকম নিস্তেজ ভাবে বসে আছে বুড়ো। দড়ি খোলা হতেই, বুড়ো নিজের বাঁ গালে চটাং করে চড় মারল। থতমত খায় সুমিত। বিস্ময় কাটার আগেই, ডান হাতে ডান গালে চড়। সুমিত বুড়োর ছেলের দিকে ভ্রূ জড়ো করে তাকায়। বলে, এর মানে কী?
ছেলেটি নির্বিকার ভাবে বলে, এটাই রোগ। তাই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছে।
খানিক ব্যবধানে বুড়ো আবার নিজের বাঁ গালে চড় মারে। খুব জোরে নয়, আবার আস্তেও নয়, সুমিত বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে এই ঘটনায়। বিষয়টাকে ঠাট্টা বলেও মনে হচ্ছে না। বাপ বিষণ্ন, হাসির মুদ্রাদোষ বাদ দিলে, ছেলে গম্ভীর। সুমিত কৌতূহল দেখায়, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো, ব্যাপারখানা কী?
বুড়ো এবার নিজের ডান গালে চড় কষাল। টেবিলের কাছে চলে এসেছে শিবু। অবাক হয়েছে ভীষণ। বুড়োর ছেলে শিবুর দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। ওর উপস্থিতিতে স্বচ্ছন্দ হতে পারছে না। সুমিত শিবুকে বলে, তুমি বাইরে থাকো। না ডাকলে আসবে না।
শিবু চলে যেতে বুড়োই বলে ওঠে, হাত দুইটা আমার বশে নাই ডাক্তারবাবু। আমাকে বাঁচান আপনে। আমারই দুইটা হাত আমারেই মাইরা যাচ্ছে দিবারাত। ঘুমুলে শুধু রেহাই দেয়।
বুড়োর গলা কাঁদোকাঁদো। ঘটনাটা অত্যন্ত অবিশ্বাস্য হলেও, ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনে। নিজের গালে কিছুক্ষণ অন্তর চড় মেরে যাচ্ছে বুড়োটা। সুমিত এটাও লক্ষ করছে, চড় মারার আগে সামান্য কোনও প্রস্তুতি বুড়োটার এক্সপ্রেশানে ধরা পড়ছে না। অ্যাজ ইফ, চড়টা মারছে অন্য কেউ।
এরকম উদ্ভট রোগের কথা আগে কখনও শোনেনি সুমিত। তবু মন একবার ফিরে যায় মেডিকেল কলেজের ক্লাসে, শব ব্যবচ্ছেদের ঘর। বডি ডিসেকশান করে স্যার দেখাচ্ছেন, নার্ভ, মাসল, আর্টারি, ভেইন… কার কী কী কাজ। কোথাও এ রোগের ন্যূনতম ইঙ্গিত ছিল
না। প্রশ্ন করতে হয় বলে করা, সুমিত জিজ্ঞেস করে, কবে থেকে শুরু হল এই রোগ? অন্তত বিশ সেকেন্ডের তফাতে চড় মারা বজায় রেখে বুড়ো বলে, তা ধরুন লয় মাস ছয়েক।
কোনও বিশেষ ঘটনায় কি রোগটা ধরা দিল?
না না, আপনা আপনি। একদিন সাঁঝবেলা নিজের জমির পানে চেয়ে আছি। আগে চাইরদিন খুব ডাউর হইছে। জল থেমেছে সেদিন দু’পহরে। বিকালে সূর্যি দেখা দিয়েই আঁধার নামতে লাগল, আকাশের এপার ওপার থাক থাক মেঘ। মেঘের ধাপে ধাপে আলো, আল টপকানো জলে জমি-পুকুর সব একাকার। মনে হইছিল আকাশের ঢালু অবধি সব জমিই আমার বুঝি। তখনই চড় পড়ল গালে। চমকাইয়া উঠছি। আশপাশে কুনো লোক নাই। কে মারলে? অশরীরী কেউ? এট্টু খেয়াল করতে দেখি, এই কাণ্ড! আমি আমারেই মারছি। হাত দুটো আমার বশে নাই।
এখন আর অতটা বয়স্ক মনে হচ্ছে না বুড়োকে। গাঁট্টা গোট্টা চেহারা। আজব রোগের কারণেই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। ডাক্তারবাবুকে সবটা বলতে পেরে এখন একটু ধাতস্থ। চড় কিন্তু থামেনি। চিন্তায় হোঁচট খাচ্ছে সুমিত। বুড়োর ছেলেকে বলে, হাত দুটো আলতো করে বেঁধে দিন তো।
নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে লোকটা। সে-ও যেন রিলিফ ফিল করছে এখন। হাসিমুখে লেগেছে কৌতুকের ছোঁয়া।
আপনার বয়স এখন কত? বুড়োর কাছে জানতে চায় সুমিত।
সত্তর হয় নাই এখনও।
কাজটাজ কী করেন?
চাষবাস, ব্যাবসা-বাণিজ্য সবই করি। তবে এই ব্যারামটার পর থেকে…
আমার কাছে আসার আগে কাকে দেখিয়েছেন?
আমাদের গেরামে হাকিম আছে একজন। তার দাবাইয়ে কাম হয় নাই। কোয়াক দেখিয়েছি, তাতেও কিছু হলনি। তেনারাই আমারে বললেন, সদরে গিয়ে আপনারে একবার দেখাতে।
একটু চুপ করে থেকে সুমিত বলে, আমিও কিছু করতে পারব না। কলকাতার ডাক্তার দেখাতে হবে আপনাকে। টাকাপয়সা ভালই খরচা হবে। নাম ঠিকানা লিখে দেব ডাক্তারের?
আপনি যা ভাল বুঝবেন, করুন। আপনার ওপর ছেড়ে দিলাম সব। এটা বলল বুড়োর ছেলে, বুড়ো বলে, টাকাপয়সা নিয়ে ভাবতে হবেনি। অনেক আছে আমার। রোগটা কী করে তাড়ানো যায় সেটা দেখুন। লাখ, দু’লাখ যা লাগে দুবো।
চেহারা দেখে কে বলবে লোকটার এত টাকা! সুমিত প্যাড টেনে নিয়ে চেনাজানা এক সাইকিয়াট্রিস্টের নাম ঠিকানা লিখতে থাকে। বুড়োকে জিজ্ঞেস করে, এত টাকা কী করে হল?
বুড়ো বলে, যেরম ভাবে গেরামের বড়লোকদের হয়। বড়সড় অন্যায় কিছু করি নাই।
খেটেছি, বেদম খেটেছি, বুদ্ধি লাগিয়েছি খুব। আজ তাই আমার বিঘের পর বিঘে জমি, বর্গা হতে দিই নাই। ধানকল আছে একটা, হিমঘর দুইটা, ডিপ পাম্প, মিনি পাম্প… অল্প স্বল্প অন্যায় যেগুলো করেছেন, একটু বলুন শুনি।
ওরকম সকলেই করে থাকে। যেমন ধরুন গিয়ে, মিনি বা ডিপ পাম্পের জন্য সরকারের দেওয়া কম দামি কারেন্টে হিমঘর চালাই। আমার গেরামের রাস্তা তৈরির বরাত নিই সরকারি অফিসারকে টাকা খাইয়ে। তিন ফুটের অর্ডারের বদলে দুই ফুট রাস্তা খুঁড়ি। মালের টাকা আমার পকেটে। ইটের কোয়ালিটি দিই চার নম্বরি। জমি বাঁধা রেখে গরিব মানুষকে ধার দিই টাকা। জানি, তারা শুধতে পারবে না। তবুও… কালে কালে চোখের সীমানা ছাড়িয়েছে আমার জমি। আপনে কন, এই সব কি খুব অন্যায্য কাম? গেরাম ঘরে পয়সা করতি গেলে, এটুকু তো করতেই হয়।
প্যাডের ওপর হাত থেমে গেছে সুমিতের। বুড়োর দিকে তাকিয়ে মাথা ওপর নীচ করছে, যেন বুঝতে পারছে সবটা এবং কিছুটা সমর্থনও করছে। শিবুকে নিশ্চয়ই টাকা খাইয়েছে এরা। তাই এখনও রয়ে গেছে চেম্বারে। ডাক্তারের নামের সঙ্গে একটা নার্ভ রিল্যাক্সের ওষুধ দিতে হবে। সুমিত জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম?
কালু মণ্ডল। গেরাম দত্ত বরুটিয়া।
গ্রামের দরকার নেই। সুমিত জানতে চায়, বয়েস ঠিক কত লিখব?
সত্তরের একটু কম করে যা খুশি লেখেন।
প্রেসক্রিপশানে সুমিত লেখে আটষট্টি। ট্যাবলেটের নামটা লিখে দিয়ে বলে, একটা ওষুধ লিখে দিলাম। রাতে শোওয়ার আগে খাবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতার ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে নিন। পরে কী হল না হল আমাকে জানাবেন।
কাগজটা বুড়োর দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে সুমিতের খেয়াল হয়, ওর হাত বাঁধা। বুড়োর ছেলে প্রেসক্রিপশনটা নিল। চোখ বোলাচ্ছে। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, কিছু বুঝছে না। পরে কাউকে পড়িয়ে নেবে। ডাক্তারের ফোন নাম্বারটা লিখে দিয়েছে সুমিত। কাগজটা পকেটে পুরল ছেলে, টাকা বার করছে এখন। এর মাঝে বুড়ো কাতর স্বরে বলে ওঠে, আপনার কী মনে হইছে, ভাল হব তো? নাকি আশা নাই বুঝে ঠেলে দিলেন অন্য ডাক্তারের জিম্মায়।
না, না, এরকম ভাবছেন কেন! যাঁর কাছে পাঠালাম, খুব বড় ডাক্তার। নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবেন।
আশ্বাসে কাজ হয় না, বুড়ো ভেঙে পড়া গলায় বলে, ওপরওলা এ কী শাস্তি দিলেন আমায়! গেরামের লোকজন আমায় কত মানে গোনে, আমার মুখের ওপর কুনো জবাব করতে পারে না পঞ্চায়েত। আজ তাদের সম্মুখে আমি নিজের গালেই চড় থাপ্পড় মারছি! সব মান-সম্মান ধুলোয় মিশে গেল। ঘর থেকে আজকাল বাইর হই না, জানেন। বাড়িতে কেউ দেখা করতি এলে, গরমে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে থাকি। বলি জ্বর হইছে। কাজ কারবার সব লাটে উঠেছে আমার। ছেলেরা সামলাতে পারে না। কাঁচা বয়েস, অভিজ্ঞতা কম।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সুমিত। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষা করছে বাবলারা।
সীমা তাড়া দিতে ডিসপেনসারিতে চলে আসতে পারে। বুড়োর ছেলে একশো টাকার নোট এগিয়ে দেয়। সুমিত বলে, খুচরো কুড়ি নেই?
আপনি পুরোটাই রাখুন। বলে লোকটা। পজ নিয়ে বলে, এত যত্ন করে দেখলেন। লোকে এমনি এমনি আপনার নাম করে না।
সুমিত ব্যক্যব্যয় না করে টাকা নেয়। ভাঙানি দেয় ড্রয়ার খুলে। বুড়োর এ সবে মন নেই। বন্যার্ত মানুষের মতো তাকিয়ে আছে সুমিতের দিকে। বলে ওঠে, লোকে তো কত ধরনের অন্যায়, অপরাধ করে, খুন-জখম, বলাৎকার। দিব্যি হাটে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। আমি এসব কিছুই করি নাই, আমার কেন এইরকম হবে?
যেন জবাব চাইছে সুমিতের কাছে। রোগটা বুঝি সুমিতেরই দেওয়া। বলতে ইচ্ছে করে, ডাক্তার রোগ সারায়, দেয় না। চৌকাঠের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সুমিত। বুড়ো পিছু ডাকে, ডাক্তারবাবু একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সুমিত বলে, কী?
এই যে আমি নিজেকে অজান্তে মারি, বেদনা তেমন লাগে না কিন্তু। বরং শরীরটা হালকা, চনমনে হইয়ে যায়। যেমন ধরুন কিছু আদিব্যাধি ছিল, সামান্য হাঁফওঠা, অল্পতে ঠান্ডা লেগে যাওয়া, ওগুলো গেছে।
তথ্যটাকে গুরুত্ব না দিয়ে সুমিত হাসে। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
বুড়োটা মাথায় রয়ে গেল অনেকক্ষণ। অদ্ভুত রোগ! ডিলারের দেওয়া গাড়ি চেপে মুর্শিদাবাদের নবাবি দ্রষ্টব্য দেখছে সুমিতরা, ইমামবারা, জাহানাকোষা কামান, ফুটো মসজিদ, হাজার দুয়ারি, জাফরাগঞ্জ মোকবারা, কলিজা খাকির জীবন্ত সমাধি। নবাবি আমলের হিংসা, প্রেম, সাফল্য। হতাশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বিদঘুটে রোগগ্রস্ত কালু মণ্ডল। ওর প্রসঙ্গ বাবলাদের কাছে তোলেনি সুমিত, কেন জানি মনে হয়েছে, না তোলাই ঠিক। একাই মাথার মধ্যে নিয়ে ঘুরেছে। বুড়োর ছেলেটাকে নিয়ে ধন্ধ কাটছে না, মুখে আগাগোড়া বিদ্রূপ মেশানো হাসির প্রলেপ ছিল। ছেলে বোধহয় পছন্দ করে না বাবাকে। বাবার ভোগান্তিতে হয়তো মজা পাচ্ছিল। বুড়োটা নিশ্চয়ই ঘাঘু অপরাধী, জীবনে অনেক পাপতাপ করেছে, সবটা খুলে বলেনি সুমিতকে। সন্তানদেরও হয়তো বঞ্চিত করেছে… গঙ্গার হাওয়া, দুই বউয়ের হাসির মূর্ছনায় ভাবনাগুলো মিলিয়ে এসেছিল প্রায়। আচমকা ফিরে এল কাটরা মসজিদ বেড়াতে এসে। ইতিমধ্যে বহরমপুরে দামি রেস্টোরেন্টে লাঞ্চ করেছে সুমিতরা। দুই বন্ধু অল্প ড্রিঙ্ক করেছে। এখন পড়ন্ত বিকেল। গাইডের সঙ্গে মসজিদের সিঁড়ি ভাঙছে সুমিতরা। এখানে আগেও একবার এসেছে সুমিত, চোখ বুলিয়ে চলে গেছে। আজ মন দিয়ে শুনছে গাইডের কথা, মুর্শিদকুলী খাঁ-র অত্যাচারের বর্ণনা দিচ্ছে গাইড। ভিন্ন ধর্মীর ওপর কতটা বিদ্বেষ ছিল তাঁর। লুঠতরাজ, ধর্মস্থান ভেঙে দেওয়া, অনেক কিছু করেছেন। অনুতপ্ত হয়েছিলেন শেষ বয়সে এসে… সিঁড়ির ওপরের চাতালটা লোহার জালের। উঠে এসেছে সুমিতরা। পায়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে গাইড বলে, ওই যে নীচে মুর্শিদকুলী খাঁ-র সমাধি। ওঁর ইচ্ছানুসারে ওখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছে। শোনা যায় বৃদ্ধ মুর্শিদকুলী
খাঁ সিঁড়ির নীচের ঘরে এসে বসে থাকতেন। দর্শনার্থীর পায়ের ধুলো পড়ত তাঁর মাথায়। এটাই ছিল প্রায়শ্চিত্তের পদ্ধতি। বেহেশতে যাওয়ার পথ সুগম হচ্ছে বলে বিশ্বাস করতেন। অনেকে আবার বলে, ওটা মুর্শিদকুলীর সমাধি নয়। ওঁরই বিশ্বস্ত অনুচর মোরাদফরাসের। এই মসজিদটি তারই তত্ত্বাবধানে…
গাইডের কথা আর কানে ঢুকছে না সুমিতের। পায়ের নীচে প্রকোষ্ঠের অন্ধকার এখন অনেকটাই চোখ সওয়া। দেখতে পাচ্ছে, বসে আছে সেই বুড়ো, কালু মণ্ডল।
বাবলারা এগিয়ে যাচ্ছে গাইডের সঙ্গে, সুমিত বিড়াল পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। সিঁড়ির তলায় আলো আঁধার ঘরটায় ঢুকে পড়ে। স্যাঁতস্যাঁতে, গুমসানি গন্ধ। না কালু মণ্ডল নেই। বদলে চিরশায়িত নবাবি আমলের কোনও পুরুষ। বেহেশতে হয়তো পৌঁছে গেছেন, স্মৃতি রয়ে গেছে গুমসানি অন্ধকারে, আগামী মানুষের পদধূলির প্রতীক্ষায়।
খাগড়া বাজারে এসে পেতল কাঁসারের টুকটাক শো পিস কেনা হচ্ছে, সীমা বলল, মনিরুদ্দিনের শাড়ির দোকানে যাব।
সুমিত বলে, আবার শাড়ি! তার থেকে বরং একটা আলমারি কেনো।
আমার জন্য মোটেই যাব না। এখানে বেড়াতে এসে তুলিকা মুর্শিদাবাদি সিল্ক কিনবে না! এরপর আর কিছু বলা যায় না। বাবলার বউয়ের মুখ জ্বলজ্বল করছে। হাজার দুয়ারি দেখার সময় এতটা করেনি। এই ছুতোয় সীমাও একটা কিনবে, কিনুক। মনিরুদ্দিন তার পেশেন্ট, গলা কাটবে না।
শাড়ির দোকানে এসে ঢুকতে যাবে দুই বউ, কী মনে হতে সুমিত সীমাকে বলে, বাড়ির জন্য ক’টা শাড়ি নিয়ো তো। বাবলাদের হাতে পাঠিয়ে দেব।
অত টাকা নিয়ে বেরিয়েছ? জিজ্ঞেস করে সীমা।
সুমিত বলে, তুমি নাও না, বাকি থাকলে মনি পরে নিয়ে নেবে।
সীমারা ঢুকে যায়, কাউন্টারে বসে আছে মনিরুদ্দিন, হাত তুলে উইশ করে সুমিতকে।
শাড়ি বাছার ধৈর্য বা আগ্রহ সুমিত, বাবলার নেই। এই সময়টা তারা দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করবে। বাবলা সিগারেট ধরিয়েছে। বলে ওঠে, শাড়িগুলো আমাদের হাত দিয়ে পাঠাস না। পারলে নিজে গিয়ে দিস।
কেন বল তো? অবাক হয়ে জানতে চায় সুমিত।
ইতস্তত ভঙ্গিতে বাবলা বলে, এখানে আসার দু’দিন আগে অমিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বললাম, তোর বড়দার ওখানে যাচ্ছি। কেমন একটা হেসে উত্তর দিল, যাও, ভালই লাগবে। নবাব-বাদশার জায়গা বলে কথা।
নবাব অর্থে নিজের বড়দাকে উদ্দেশ করা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না সুমিতের। বাবলার বিয়ে উপলক্ষে দক্ষিণপাড়ার বাড়িতে গিয়ে সুমিত টের পেয়েছিল, সম্পর্কের শীতলতা কোথায় পৌঁছেছে। মেজবউ বলেছিল, এইটুকু বাড়ি, ড্যাম্পলাগা, পারবেন থাকতে? মিউনিসিপ্যালিটি এখানে ভাল একটা গেস্ট হাউস করেছে, পাথরের মেঝে, অ্যাটাচড বাথ। বড়দির সুবিধে হবে ওখানে থাকতে।
এটা তো আমারই বাড়ি সোনালী। কেন থাকতে পারব না। সীমাকেও এখানে মানিয়ে নিতে হবে।
তা ঠিক। তবে আপনি তো বেশির ভাগ সময় হস্টেলে, কোয়ার্টারে কাটিয়েছেন।
মেজর বউ অধিকারের সীমানাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। অপমানটা হজম করে গিয়েছিল সুমিত। বাড়ির কাউকে কিছু বলেনি। সীমাকেও না। বলার মুখও তার নেই। সে যে কতটা আত্মপরায়ণ, মেজভাই তার সবথেকে বড় সাক্ষী। অমিতও হয়তো লজ্জায় ঘটনাটা কাউকে বলতে পারেনি। মেডিকেলের সুমিতের তখন ফাইনাল ইয়ার। হস্টেলে খবর এল, সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে বাবার। ভরতি করা হয়েছে দক্ষিণপাড়ার সরকারি হসপিটালে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল সুমিতের, ফাইনাল ইয়ারে এত বড় অঘটন। পড়াশোনায় বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।
মফস্সলের জীর্ণ হাসপাতালে বাবা শয্যাশায়ী। অমিত ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে ব্রেনস্ক্যান করিয়ে এনেছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে ক্লট করেছে রক্ত। ভাগ্য ভাল, বড়ির কোনও সাইড প্যারালিসিস হয়নি। জ্ঞানও আছে বাবার।
কেবিনের ভেতর বাবার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সুমিত। বাবা যেন তার অপেক্ষাতেই ছিলেন। বড় ছেলেকে দেখে বললেন, আমাকে নার্সিংহোমে নিয়ে চল। দেখছি, কী করা যায়।
দেখছি নয়। এখনই নিয়ে চল। এখানে থাকলে মরে যাব আমি। জানি, খরচ হবে। তুই তো এক বছর পরেই ডাক্তার হয়ে যাবি। পারবি না সংসার সামলাতে?
সুমিত উত্তর দিচ্ছিল না। বাবা বলতেন, ডাক্তার হলে গরিব মানুষদের একটু দেখিস। সুমিত ডাক্তার হওয়ার আগেই তস্য গরিব পেশেন্ট হয়ে গেলেন বাবা। মা আগেই মারা গেছেন। বাবা মরে গেলে পেনশন বন্ধ। বোনেদের বিয়ের জন্য যতটুকু সঞ্চয় করেছেন বাবা, পনেরো দিনে নার্সিংহোমে সব টেনে নেবে। সংসার চলবে কী করে? বাবা বেডে শুয়ে একই কথা বলে যাচ্ছেন বারবার। অবুঝ বাচ্চার মতো। জীবনে এই প্রথম হাসপাতালে ভরতি হয়েছেন। জ্বর বা পেটখারাপে বাবাকে কোনওদিন বিছানায় শুতে দেখেনি সুমিত। ওই হাসপাতালের একটা বদনামও ছিল, এলাকার লোক বলত ‘ওয়ান ওয়ে।’ একবার যে ঢোকে বেরোয় না। এরকম বদনাম বহু মফস্সল হাসপাতালের থাকে। সিরিয়াস পেশেন্টকে সাময়িক ভাবে ভরতি করা হয়, তারপর নিয়ে যাওয়া হয় নার্সিংহোমে অথবা কলকাতার বড় হসপিটালে। সেখানে তো বেড পাওয়াই দায়।
বিছানায় উঠে বসেছিলেন বাবা। সুমিতের হাত ধরে নিয়ে বলেছিলেন, তুই আমাকে বাঁচা। তোর জন্যে জীবনে কত কষ্ট করেছি বল!
আর দুটো বছর করতে পারলে না। হতাশাক্রোশে চেঁচিয়ে উঠেছিল সুমিত। তারপর আর একটি ঘটনা ঘটায় এখনও বিশ্বাস হয় না কাজটা সত্যিই সে করেছিল কি না। বাবার কাঁধদুটো ধরে সজোরে শুইয়ে দিয়েছিল বেডে। ঢং করে একটা আওয়াজও হয়। বোধহয় বাবার মাথাটা লোহার বিছানার ওপর দিকটায় ঠুকে গিয়েছিল। কাঁদছিলেন বাবা। অসহায় অপমানের কান্না। ডুকরে ডুকরে বলছিলেন, বাপি তুই আমাকে মারলি!
তখনই কেবিনে ঢোকে মেজভাই, কী হয়েছে রে?
কিছু না। এই সময় একটু হাইপার অ্যাকটিভিটি দেখা দেয়। উঠে বসতে চাইছিলেন।
বাবার কান্না তখনও থামেনি, কথাও না। মেজ সরাসরি তাকিয়েছিল সুমিতের দিকে। চোখে ঘোর অবিশ্বাস। বাবা মারা গেলেন ওই হসপিটালেই। দু’দিন পরে। শেষ ক’দিন কোনও কথা বলেননি। শুধু চেয়ে থাকতেন।
কী রে, ওরকম করছিস কেন?
বাবলার ডাকে সংবিৎ ফেরে সুমিতের। একই সঙ্গে আবিষ্কার করে, নিজের দু’গালে বেশ কয়েকবার চড় মেরেছে সে। জ্বালা জ্বালা করছে গাল। ‘ও কিছু না’ বলে, আপাতত ম্যানেজ দেয় সুমিত।
সীমা বেরিয়ে এসেছে দোকান থেকে। বলে, তোমরা একবার শাড়িগুলো দেখবে না? তোমার দু’বোনের জন্যই কিনেছি। আর মেজ বউয়ের জন্য একটা।
আর তোমরা? জানতে চায় বাবলা।
আমরাও কিনেছি। তবে মাত্র একটা করে। বিল কত হল না হল বুঝতে দোকানে ঢোকে সুমিত। মনটা হঠাৎই কেমন যেন বেশ ঝরঝরে লাগছে।
আরামটা পেয়ে বসল সুমিতকে। ইদানীং একলা হলেই কালু মণ্ডলের রোগ চেপে ধরে তাকে। তবে পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে আছে। ইচ্ছে মতো চড়টা বন্ধও করতে পারে। খেলাটা বাথরুমেই খেলতে হয়। বুড়ো ঠিকই বলেছিল, আঘাত লাগে না তেমন। বরং শরীরটা চাঙ্গা হয়ে যায়। একদিন ধরা পড়েছিল সীমার কাছে। ভেবেছে আশেপাশে নেই। বেডরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মজাসে নিজের গালে চড় মারছে সুমিত, সীমা ঢুকে পড়ে অবাক, অ্যাই, এ কী করছ তুমি?
বুদ্ধি করে সামলে নেয় সুমিত, দেখছি কতটা চর্বি হয়েছে।
ফ্যাট তুমি বডিতেও গ্যাদার করেছ। মর্নিং ওয়াকে বেরোও এবার থেকে।
প্রায় ছ’মাস কেটে গেছে। রাত আটটা নাগাদ চেম্বার সেরে ড্রয়িং-এ বসে সুমিত মেডিকেল জার্নাল ওলটাচ্ছিল, টেবিলে ঠান্ডা হচ্ছিল সীমার দেওয়া চা। শিবু এসে বলল, ‘কল’ আছে।— কোথাকার?
দত্ত বুরুটিয়া, গাড়ি নিয়ে এসেছে। নিয়ে যাবে দিয়ে যাবে।
পার্টিকে একবার ডাকো।
শিবু চলে যাওয়ার একটু পরে ঘরে যে ঢুকল, একপলক দেখেই চিনতে পারে সুমিত, বুড়োর ছেলে। ওর মুখের সেই অকারণ হাসিটাই চিনতে সাহায্য করল। লোকটা বলে, ডাক্তারবাবু, চারদিন ধরে বেহুঁশ জ্বর আমার ছেলের। ওর মা আনতে দিল না। যদি হাসপাতালে ভরতি করে দিই।
শিবু চৌকাঠে দাঁড়িয়ে শুনে নিল রোগের বৃত্তান্ত, সেই অনুযায়ী অ্যাটাচি সাজিয়ে দেবে। সুমিত জানতে চায়, আপনার বাবা কেমন আছেন?
বাবা তো নেই। মারা গেল দু’মাস হল।
পিতার মৃত্যুর খবর এত নির্বিকার ভাবে দিতে, এই প্রথম কাউকে দেখল সুমিত, ফের জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল?
ওই সেই একই রোগ।
মানে। বিস্মিত হয় সুমিত। ওই রোগে কারুর মরার কথা নয়। লোকটা কি হেঁয়ালি করছে?
কালু মণ্ডলের ছেলে বলে যায়, কলকাতার ডাক্তার দেখানোর পর রোগটা আরও বেড়ে গেল। সব সময় অস্থিরভাব, ছটফট করছে আর চড় মারছে নিজের গালে। বুড়ো পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিল ডাক্তারবাবু। একদিন কোন ফাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে রেলের লাইনে বডি দিয়ে দেয়।
চমকে ওঠে সুমিত। লোকটার কোনও বিকার নেই। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে যাচ্ছে, আমাদের কী মনে হয় জানেন ডাক্তারবাবু, বাবা আসলে মরতে যায়নি।
বুঝলাম না। অবাক দৃষ্টিসহ বলে সুমিত। লোকটা একটু দম নেয়। শিবু অ্যাটাচিটা এনে রাখে টেবিলে। বুড়োর ছেলে বলে, হাত দুটো আলাদা কাটা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। মনে হয় লাইনে হাত দুটোই দিতে গিয়েছিল বাবা, হিসেবে গন্ডগোল হয়ে যায়।
শরীরটা ভীষণ আনচান করতে শুরু করেছে। সুমিত টের পায় কপালে ঘাম ফুটে উঠছে তার। উঠে দাঁড়ায় সোফা ছেড়ে। চিড়বিড় করছে দু’পাশের গাল। হাতটা ঠেকাতে পারলে ভাল লাগত। সেটা করা যাবে না। বুড়োর ছেলে ধরে ফেলবে, ডাক্তারবাবু সংক্রামিত হয়েছে বাবার রোগে। লোকটা হাসবে। যেমন সব সময় হাসে।
অ্যাটাচিটা তুলতে যায় সুমিত, ফাঁকা হয়ে যায় বুক। কনুইয়ের পর থেকে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ডান হাতের দিকে তাকায়, একই অবস্থা! নুলোর মতো দাঁড়িয়ে থাকে সুমিত। বুড়োর ছেলে কী যেন বলে যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে না সুমিত। তার কানে বাজছে নিয়তির মতো অদৃশ্য, অমোঘ ট্রেনের চাকার দূরন্ত শব্দ। কী অসম্ভব গতি!
শারদীয় দেশ ২০০৬