ধানের গন্ধ

ধানের গন্ধ

ট্রেনপথটা ভালই ছিল। বাসে প্রচণ্ড ভিড়। আমি তো নয়ই, লাবণিও বসার জায়গা পায়নি। লাবণিকে নিয়ে আসার পক্ষে সময়টা ভুল বাছা হয়েছে। বাস ভরতি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে। আমাদের স্টপেজের আগে সিট পাওয়ার কোনও চান্স আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি যখন একা এই পথে আসি, সেই ভোরের ট্রেন, একই সময়ের বাস, ভিড়ের ব্যাপারটা খেয়াল করাই হয় না। বিয়ের পর প্রথম বউ নিয়ে দেশের বাড়ি যাচ্ছি, ওর স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বাড়তি একটা টেনশন তো হবেই। লাবণি নিবিড়ভাবে গ্রামজীবন দেখেনি। যাদবপুরে বড় হয়েছে। আমরা এখন গড়িয়ায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি। গ্রাম না চেনা লাবণি যে কী করে আদ্যন্ত একটা গ্রামের ছেলেকে পছন্দ করে বসল, কে জানে! দেশের বাড়ি থেকেই আমি গ্র্যাজুয়েশন করি, এম এ পড়তে যাই যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। ওখানেই আলাপ লাবণির সঙ্গে। ওর তখন বি এ ফাইনাল ইয়ার। কলেজ পত্রিকায় ‘বাংলার লিটল ম্যাগাজিন’ নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেই সূত্রে লাবণি এক বন্ধুকে সঙ্গে করে দেখা করতে আসে। প্রবন্ধটা ওর ভাল লেগেছিল। আলাপ পর্বে যখন জানল, কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি গ্রামে থাকতাম, খুব অবাক হয়ে বলেছিল, আপনাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না।

কেন, গ্রামের ছেলের ট্রেড মার্কটা কী, যা দেখে তুমি বুঝতে পারতে? জানতে চেয়েছিলাম।

লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল লাবণি। আমতা আমতা করছিল। আমি তো জানি ‘গ্রামের ছেলে’ বলতে ও কী বোঝে, একটু ক্যাবলা মার্কা হবে। পোশাক পরবে পুরনো ডিজাইনের অথবা উৎকট আধুনিক। আর পাঁচটা শহুরে মানুষের মতো লাবণিরও একই ধারণা ছিল। এরা তো জানে না, ইদানীং গ্রামের ছেলেমেয়েরাও কীরকম ড্রেস কনশাস হয়ে গেছে। সকালে দলে দলে কলকাতায় ঢুকে, সন্ধেবেলা বেরিয়ে যাবে কাজ সেরে, কেউ আলাদা করে চিনতে পারবে না। আমাকে চেনা আরও মুশকিল। বালিকোঠা গ্রামে আমাদের পরিবার সবচেয়ে ফরসা। বিনা মেক-আপে এমন রং কলকাতাতেও বড় একটা দেখা যায় না। গ্রামে আমরাই একঘর ব্রাহ্মণ। বাকি বেশিরভাগ মাহিষ্য। দু’ঘর মাত্র কায়স্থ। আমাদের গ্রামের ঠাকুর শীতলা মা। পূজক আমরাই। নিত্য পুজো ছাড়াও বছরে দু’বার বড় করে উৎসব হয়। বৈশাখ আর অগ্রহায়ণে। গ্রামের লোক বলে ‘দেশপুজো’। দেশের পুজো থেকেই মনে হয় এসেছে কথাটা। বৈশাখের পুজোতে লাবণিকে নিয়ে আসছি। বাড়ির লোক জানে না। হঠাৎ আমাদের দেখে অবাক হয়ে যাবে। কার কেমন এক্সপ্রেশন হবে, ভাবতে ভাবতে হাসছি, হাসিটা স্লিপ খেয়ে ঠোঁটে চলে এসেছিল। বাসের হ্যান্ডেল

আর সিটের পেছন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লাবণি জানতে চাইল, কী হল, হাসছ কেন? সত্যিটি গোপন করে বলি, কেমন লাগছে, জার্নি? খুব তো শ্বশুরবাড়ি যাব বলে হাঁফিয়ে উঠেছিলে।

আমার অভ্যেস আছে। বলে, জানলার বাইরে চোখ রাখল লাবণি। খেত জমি, ফাঁকা মাঠ, জলা-জঙ্গল পিছিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। হু হু করে হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে। হাওয়ায় দেশের বাড়ির গন্ধ। প্রতিবারই ট্রেন থেকে নামার পর এই গন্ধটা পাই। কয়েকবার আসার পর লাবণিও পাবে। বাসে ঠাসাঠাসি হলেও, বাইরে যথেষ্ট রিলিফ। চোখের আরামটা পাওয়া যায়। লাবণি বলছে বটে ‘অভ্যেস আছে’, কলকাতায় মানুষ, যাতায়াত করেছে ভিড় বাসে। কিন্তু দূরপাল্লার লাক্সারি বাসের ভিড়টা অন্যরকম। দাঁড়ানোর কথা ভেবে বাসটা তৈরি হয়নি। তবু এই অঞ্চলের এটাই অন্যতম প্রধান যান।

লাবণি এতক্ষণে ভাব জমিয়েছে সিটে বসে থাকা স্কুলের শাড়ি পরা দুটো মেয়ের সঙ্গে, কোথায় তোমাদের স্কুল?

শ্রীপুর।

কোন ক্লাসে পড়ো?

টেন।

শ্রীপুর কতদূর এখান থেকে?

আরও দেড় ঘণ্টা।

উত্তর শুনে লাবণি আমার দিকে তাকায়। চোখে বিস্ময়। আমি বলি, শ্রীপুরের স্কুলটা নামকরা। এই রাস্তায় আরও একটা স্কুল আছে। মাঝারি মানের। এরা ভাল স্টুডেন্ট, তাই এতদূর যাতায়াত করে।

নীল পাড়, সাদা শাড়ির মেয়ে দুটি নিজেদের মধ্যে লাজুক হাসি বিনিময় করল। নলহাটিতে এসে গেছে বাস। এরপরই আমাদের স্টপেজ, মনোহরপুর। সেখান থেকে ট্রেকার। নামতে হবে নাহার মোড়ে। তারপর ভ্যানরিকশায়, এখানকার লোক ট্রলি বলে, আমাদের গ্রাম ‘বালিকোঠা’ রিকশা সোজা চলে যাবে বাড়ির উঠোনে। বাবা কি তখন নতুন বাড়ির দালানে বসে পেশেন্ট দেখবে? পরনে ধুতি, খালি গা। গায়ের রংকে হার মানিয়ে ধবধব করছে পইতে। আমাদের দেখলে, রুগি দেখা ভুলে উঠে দাঁড়াবে, সে কী রে, তোরা! একেবারে না বলে কয়ে। তারপর হাঁক পাড়বে, আভা, দেখে যা কারা এসেছে…

আভা আমার বোন। বি এ পড়ছে। সংসারের অভিভাবক এবং বাবার কম্পাউন্ডার। ইঞ্জেকশন, অক্সিজেন, স্যালাইন দিতে জানে। সব ব্যবস্থাই আমাদের বাড়িতে আছে। এ ছাড়া উপায়ও নেই। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পঁচিশ কিলোমিটার দূরে, দাঁতনে। বড় হাসপাতাল যেতে গেলে মেদিনীপুর, আশি কিলোমিটার পথ। খুব সিরিয়াস পেশেন্ট ছাড়া বাবা অনেকটাই সামলে দেয়। অথচ বাবা আর এম পি সার্টিফিকেট পাওয়া ডাক্তার। হার্টের চিকিৎসায় বাবার যথেষ্ট নামও আছে। বলতে নেই, বাবার ওষুধ খেয়েই ঠাকুমা নব্বই পার করে ফেলল। রীতিমতো কর্মক্ষম আছে। চোখে একটু কম দেখে, এই যা। আমাকে দেখতে পাবেই। বিয়ের সময় লাবণিকে পরিষ্কার দেখতে না পেয়ে দুঃখ করছিল, লাতিবউ আর একটুকু গুড়িয়ে হুইতে পারলুনি!

ঠাকুমা ভীষণ ফরসা। ছোটবেলায় চাঁদের বুড়ি মনে হত। মায়ের রং বাদামি। পূর্ণিমা আড়াল করা গাছের ছায়া পড়েছে মায়ের শরীরে। হয়তো সেই কারণেই আমাদের বাড়িতে মা একটু চুপচাপ। তবে আমাদের দেখলে মায়ের হাসি উছলে পড়বেই। রিকশা ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়বে গোটা পরিবার। কাকার ছেলে সন্তু বলবে, তুই আসবি, ফোন করে দিলি না কেন আমার মোবাইলে!

কখন কোথায় থাকিস তুই, হয়তো দেখব ওড়িশায় প্রোগ্রাম করতে গেছিস…

সন্তু ফাংশানে কিশোরকুমারের গান করে। বাড়ির সঙ্গে জরুরি যোগাযোগ করতে হলে ওর ফোনই সম্বল। সবসময় ওকে পাওয়াও যায় না। বাবা দিন পনেরো আগে ফোন করেছিল কলকাতার বাড়িতে। তারহীন সরকারি ফোন দেওয়া হচ্ছে গ্রামে। অ্যাপ্লাই করবে কি না জিজ্ঞেস করছিল। ইদানীং বাবা সামান্য সিদ্ধান্ত নিতে আমার মতামত চায়। বয়স হচ্ছে। ফোনে সমস্ত কথা বলাও হয় না বাবার। এবার মুখোমুখি হয়ে অনেককিছু বলতে পারবে। এরকম না জানিয়ে আসার মজাই আলাদা। ছ’মাস হল বিয়ে হয়েছে আমাদের। অনুষ্ঠান হয়েছে গড়িয়ার একটা বাড়ি ভাড়া করে। ঠাকুমাসুদ্ধু বাড়ির সব্বাই গিয়েছিল। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ছিল কিছু। গ্রামের লোক, পাড়া প্রতিবেশীদের খাওয়ানো হয়নি এখনও। ওদের খাওয়ানো মানে হাজার তিনেক পাত। চারটে গ্রামের লোক বাবাকে এক ডাকে চেনে। দেড় বছর আগে ঠাকুরদা মারা গেছে আমার। বাবা ওই পরিমাণ লোক খাইয়েছে। এখন হাত ফাঁকা। গ্রামের ডাক্তারের ফিজ নেওয়ার রেওয়াজ নেই। ওষুধ বিক্রি করে যা লাভ৷ কিছু জমিজমা আছে। গাঁয়ের মন্দিরে পুজো করে কাকার সামান্য রোজগার হয়। আমরা বড়লোক নই, গরিবও বলা যাবে না। বাবা চেনা পরিচিতদের কথা দিয়েছে, নাতি বা নাতনির অন্নপ্রাশনে সকলকে খাওয়াবে।

সবাই হাসিমুখে গ্রহণ করেছে বাবার আশ্বাস। গ্রামের মানুষ চুনিলাল ডাক্তারকে পিতামাতার মতো মান্য করে। আমার চিন্তা লাবণিকে নিয়ে, কতটা সম্মান করতে পারবে গুরুজনদের। বিয়ের সময় দেখেছে পাকাবাড়িতে। বাবাদের সাজপোশাক ছিল পরিচ্ছন্ন। ব্যবহারে বিনয়ের আড়ষ্টতা। তাই লাবণিও ছিল যথেষ্ট শ্রদ্ধাবনত। যেমন আমার ক্ষেত্রে ঘটেছিল, প্রথম আলাপে বিশ্বাসই করেনি, গ্রামে বড় হয়েছি। আমাদের মাটির বাড়িতে আড়ম্বরহীন পোশাকের বাবা-মাকে ওর কতটা গ্রহণযোগ্য মনে হবে, কে জানে! পুরনো বাড়ির মাটির দাওয়ায় পাত পেড়ে খাওয়া হয় আমাদের। উচ্ছিষ্টের অপেক্ষায় নাগালের মধ্যেই থাকে বাড়ির বিড়াল, কুকুর। অদূরে গোয়ালঘর। গন্ধ একটু আসেই। এসব মানিয়ে নিতে পারবে তো লাবণি? এই সংশয় থেকেই বিয়ের পর দেশের বাড়ি আসা হচ্ছিল না। বাবা সম্ভবত আমার দ্বিধাটা ধরতে পেরেছিল। তাই ফোন করে বলত, বউমাকে নিয়ে আয়। আশপাশের সবাই দেখতে চাইছে। এখন তো আমাদের বাড়িতে কোনও অসুবিধে নেই। নতুন বাড়িতে তোদের আলাদা ঘর করা আছে। ফ্যানও লাগিয়েছি। বাথরুম, পায়খানা পাকা…

পুরনো বাড়িতে বর্ষাকালে জল উঠত। আমার ছোটবেলায় দু’বার পড়ে গিয়েছিল বাড়ি। অনেকদিন ধরে অল্প অল্প পয়সা জমিয়ে বাবা-কাকা লাগোয়া নতুন বাড়ি করেছে। সেটাও

মাটির। তবে সিমেন্টের পিলার দেওয়া। দোতলা করা হয়েছে। মাটি থেকে দালান এত উঁচুতে, ভারী বর্ষাতেও জল ঢোকার কোনও সম্ভাবনা নেই। এতকিছু সত্ত্বেও আশঙ্কা যাচ্ছিল না আমার, থাকার সুব্যবস্থাই তো সবকিছু নয়। বাড়ির লোকের গ্রাম জীবনের অভ্যেসগুলো যাবে কোথায়! লাবণি আসার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল। স্কুলে পড়ায়, ছুটির সমস্যা নেই। আমি এখনও চাকরি করি না। রিসার্চ স্কলার। তবু নানা ব্যস্ততার ভান করে এড়িয়ে গেছি। ‘দেশপুজো’ আমাকেও ভীষণ টানে বলে চলে এলাম।

মনোহরপুরে এসে গেল বাস। কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, এগরা, কাঁথি, দিঘা… ছোট দুটো লাগেজ নিয়ে নেমে এলাম আমরা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে লাবণি বলল, উরিব্বাস, এ তো দেখছি বেশ জমজমাট জায়গা। সবকিছুই পাওয়া যায়, কোল্ড ড্রিঙ্কস, চিপস। ক্যাসেট, সিডির দোকান, কসমেটিক্স… তুমি যে বলেছিলে মনোহরপুর একটা গ্রাম।

দাঁড়াও, এটা বাসস্ট্যান্ড বলে একটু বাজার মতো হয়ে আছে। দু’মিনিট ভিতরে গেলেই আসল চিত্রটা দেখতে পাবে। বলতে বলতে মনোহর বেরার স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়াই। পঞ্চায়েত থেকে করা আবক্ষ মূর্তি। লাবণিকে বলি, এঁর কথাই তোমাকে বলছিলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামী। মাতঙ্গিনী হাজরার সঙ্গে আন্দোলনে ছিলেন। এই গ্রামেই জন্ম। এঁর নামেই গ্রামের নাম হয়। আগে এই জায়গাটার নাম ছিল সরাইদা।

হাইওয়ে ছেড়ে বাঁদিকের সরু রাস্তায় চলে এসেছি। একটাই ট্রেকার দাঁড়িয়ে আছে নাহার মোড় যাওয়ার। দুটো মাত্র প্যাসেঞ্জার হয়েছে। বারোজন না হলে ছাড়বে না। এক এক সময় মনে হয় আজ বুঝি আর হবে না। হয়ে কিন্তু যায়ই।

উঠতে যাচ্ছি ট্রেকারে। পেছন থেকে কে যেন ডাকল, হেই দিপু, ঘর যাবু ত?

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিনোদ। আমার স্কুলবেলার বন্ধু। উত্তর দেওয়ার বদলে হাসলাম। ‘বাড়ি যাচ্ছি’ আন্দাজ করা জলের মতো সহজ। ও জানেও, কথা খুঁজে না পেয়ে, ওটাই বলল। এগিয়ে এল সাইকেল গড়িয়ে, আগে খবর দিলিনি কেন? গাড়ির ব্যবস্থা করি রাখতাম। বউকে নিয়ে প্রথম এলি…

কথাগুলো কান এড়িয়ে লাবণিকে বললাম, এ হচ্ছে আমার স্কুলের বন্ধু। বিনোদ দাস। এখন বালি সিমেন্টের ব্যাবসা করে।

লাবণি হাতজোড় করে নমস্কার করল। বিনোদও তাই করে, ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্যাসেঞ্জার জোগাড় করতে। সাইকেল স্ট্যান্ড করে হাত তুলে ডাকতে লাগল, কে যাবে নাহার মোড়, কেতুগ্রাম, বাঁশতলা…

বিনোদ হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করতে পারেনি। স্কুলে থাকতে আমার সঙ্গে ওর ছোটখাটো একটা ঝামেলা হয়েছিল। সেই থেকে দু’জনের কথা ছিল না। প্রায় সাত-আট বছর হয়ে গেল। আজ বউ সমেত আমাকে দেখে ঝালাই করে নিল বন্ধুত্ব। এতদিনে বুঝতে পেরেছে, অন্য জীবনে পা রেখেছি আমরা। স্কুলের অভিমান পুষে রাখা বোকামি। বিনোদও বিয়ে করেছে, একটা ছেলেও আছে সম্ভবত। তাদের কাউকেই আমি দেখিনি।

ড্রাইভারের পিছনের সিটে আমাদের ব্যাগ রেখে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে আছি। একটা-দুটো করে প্যাসেঞ্জার হচ্ছে। সবই গরিবগুরবো মানুষ। মহিলাদের খালি পা, পুরুষদের খালি গা।

বিনোদ আবার এগিয়ে আসে। কপালে চিন্তার ভাঁজ, তোদের যে অনেকটা হাঁটতে হবে রে দিপু।

কেন?

মাইতিদের সারের দোকানের পরেই যাত্রাপাটির বাস উলটি পড়ে আছে। ট্রলিরিকশা যাবে কীরকম?

সত্যিই আশঙ্কার কথা। বিনোদ যে অঞ্চলটার উল্লেখ করল, ট্রেকার থেকে নামার পর আমাদের ভ্যানরিকশায় যাওয়ার কথা। গ্রামের লোক হেঁটেই যায়। প্রায় চার কিলোমিটার মতো কাঁচা রাস্তা। লাবণি কি অতটা হাঁটতে পারবে? মাথার ওপর রোদও উঠেছে চড়বড়ে। বিনোদের কাছে জানতে চাই, বাস ওলটাল কী করে! লোকজন মারা যায়নি তো?

তা যায়নি, হয়েছে কী জানু, ভোররাতে পালা তখন শেষ হব হব, হেল্পারের কী খিয়াল হইলা, ফাঁকা বাসটা নিয়ে নাহারমোড়ে আসতে গেলা। হাত প্র্যাক্টিস হবে। আমাদের ওই পথটা কী জিনিস তো বুঝেনি, খালি ত্যাড়াব্যাকা। পড়িছে শালা মাইতির দোকানের আগের বাঁকে… বলেই একটু যেন সিঁটিয়ে গেল বিনোদ, বন্ধুর বউয়ের সামনে ‘শালা’ বেরিয়ে গেছে।

বাসটা তোলার চেষ্টা হচ্ছে? জানতে চাই আমি।

তা হচ্ছে। আমাদের গ্রামের লোক পারেনি। পচ্ছিম পাড়ার লোকেদের ডাকতে যাইছে। পশ্চিমপাড়ার লোক মানে আদিবাসীদের কথা বলল বিনোদ। ফের জিজ্ঞেস করি, যাত্রাপার্টির লোকগুলো কী করছে?

কী আবার করবে। বুসি আছে গাছতলায়।

হেল্পারের কিছু হয়নি তো? এটা জিজ্ঞেস করল লাবণি।

না বউদি, ওর কিছু হয়নি। বাস লাট খেতেই লাফি নামি পড়েছিল। তবে ওখন যাত্রাপার্টির পাশে খুব গালাগাল খাচ্ছে।

ট্রেকারের হর্ন বেজে উঠল বার কয়েক। ঘুরে দেখি, আমাদের দুটো জায়গা ছাড়া বাকি সব ভরতি। বিনোদের কাছে বিদায় নিয়ে আমি লাবণি উঠে পড়লাম ট্রেকারে। বিনোদ বলে, তনে যা। আমি কাজ সারি যাইঠি।

মিনিট পাঁচেক পাকা রাস্তা হুস করে ফুরিয়ে গেল। ভাঙা ইটের রাস্তায় গাড়ি এখন লাফাচ্ছে। আমায় চুপ করে বসে থাকতে দেখে, লাবণি জিজ্ঞেস করে, কী হল, কী ভাবছ?

মুখে বললাম, কিছু না।—আসলে ভাবছি, নাহার মোড়ের পর চার কিলোমিটার হাঁটতে পারবে তো লাবণি? ভাঙাচোরা মাটির রাস্তা। ভ্যানরিকশাতে গেলেও মাঝে মাঝে নামতে হয়।

গতকাল এলে খুব মজা হত। বলো! বলল লাবণি।

কেন?

যাত্রা দেখতাম। একটু থেমে লাবণি জানতে চায়, কোথাকার দল গো, কলকাতার? না, কাঁথির। কাঁথির যাত্রাসমাজ খুব নামকরা। অন্য জেলাতেও শো করার ডাক পায়।

আমি কোনওদিন যাত্রা দেখিনি, জানো? বলে, চুপ করে গেল লাবণি। মন দিয়ে গ্রাম্য প্রকৃতি দেখছে। বছরখানেক হল চওড়া করা হয়েছে এই রাস্তা। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছ লাগানো হয়েছে সার দিয়ে। বেশ পরিচ্ছন্ন লাগছে চারপাশটা। পঞ্চায়েত ভালই কাজ করেছে এখানে। লাবণি পাশে থাকার কারণে, আমি একটু হলেও ওর চোখ দিয়ে দেখছি, আমার বহুদিনের চেনা জায়গাটাকে। আকাশটাও যেন একটু বেশি পরিষ্কার লাগছে, তিরবেগে উড়ে যাচ্ছে পাখি। শহরে এই গতি বজায় রাখতে পারে না ওরা। হিসেব করে উড়তে হয়… আর একটু হলেই লাবণিকে একটা জিনিস দেখাতে মিস করে যেতাম। আঙুল তুলে বলি, ওই দেখো, আমার স্কুল। ক্লাস ফাইভ থেকে হাজার সেকেন্ডারি অবধি পড়েছি।

মাঠের মাঝে পাঁচিল ঘেরা হলুদরঙের তিনতলা বাড়ি। এখন বোধহয় ক্লাস চলছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে স্কুলবাড়ি। ছাত্ররা ক্লাসঘরে। দোতলার বারান্দায় হেঁটে যাচ্ছেন সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন টিচার। চলন্ত ট্রেকারে বসে থাকার জন্য চিনতে পারলাম না। মন দিয়ে আমার স্কুলটা দেখে লাবণি বলল, এরই মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমরা! মানে?

তোমার স্কুল এসে গেল মানে তো গ্রামে ঢুকে পড়েছি।

মাথা খারাপ নাকি, এখনও আট কিলোমিটার পথ।

ওরে বাবা অতদূর থেকে স্কুলে আসতে। সাইকেলে আসতে নিশ্চয়ই?

হেঁটে আসতাম। দেরি হয়ে গেলে দৌড়ে নিতাম একটু। গ্রামঘরে সাইকেল তখন বাহুল্য। তবে আমাদের একটা ছিল। রুগি দেখতে যেত বাবা… কথাগুলো বলতে বলতে লাবণিকে চার কিলোমিটার হাঁটানোর সংকোচটা কেটে গেল।

পৌঁছে গেলাম নাহারমোড়ে। ধুলো উড়িয়ে চলে গেল ট্রেকার। অন্য দিন জায়গাটা সামান্য হলেও কোলাহলমুখর থাকে। খোলা থাকে তিনটে দোকান। বাঁধানো গাছতলায় জিরোয় ভ্যানওলা, আড্ডা মারে বুড়োরা। আজ সব ফাঁকা। গ্রামের লোক কাল রাতভর যাত্রা দেখেছে, বেলা পর্যন্ত ঘুমোবে আজ। গুমটি দোকানের গায়ে যাত্রার পোস্টার দেখিয়ে লাবণি জানতে চাইল, এই পালাটাই হয়েছে কাল? দলের নামের নীচে কাঁথির অ্যাড্রেস দেখছি।

হ্যাঁ। আমি এই দলের পালা আগে দেখেছি। স্ট্যান্ডার্ড ভালই।

পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থেকে লাবণি বলে, দারুণ কাব্যিক নাম পালাটার, ডানাওলা বউ, মন দিল না কেউ। কলকাতার দলগুলো কীরকম উলটোপালটা নাম দেয়।

মনে মনে হাসি, ‘ডানাওলা বউ’-এর যে কাব্যসুষমা আবিষ্কার করল লাবণি, আমি নিশ্চিত পালাটার বিষয় তা নয়। কোনও বারমুখো গৃহবধূর কেচ্ছা নিয়ে গল্প। এসব চড়া সুরের প্রহসন টানা একঘণ্টা বসে দেখতে পারবে না লাবণি। আমার অবশ্য অভ্যেস আছে।

ডাক্তার, তুমি এঠি দাঁড়ি আছ বা, ঘর যাব ত?

কথাটা বলল হাঁটুর ওপর ধুতি পরা উদোম গায়ের কানুদা। এর সঙ্গে লাবণির আলাপ না

করালেও চলবে। কানুদাকে বলি, বাড়ি তো যাব, কিন্তু রিকশা কই?

ট্রলি তো আজ পাবনি গো। সব লোক মন্দিরকে যাইচে। তবু দেখিঠি দাঁড়াও। বলে, রাস্তা আড়াআড়ি পার হয়ে চাষের জমির দিকে এগিয়ে গেল কানুদা। ওখানে হেলে পড়া একটা ভ্যানরিকশা দেখা যাচ্ছে।

লাবণি জিজ্ঞেস করে, তোমাকে ডাক্তার বলে ডাকল কেন?

হেসে ফেলে বলি, তোমার খেয়াল নেই, তোমাকে বলেছি, গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি গ্রামে কিছুদিন ডাক্তারি করেছিলাম। সেই থেকে ওরা জানে আমি ডাক্তার। এখন কলকাতায় প্র্যাকটিস করি।

চাষের জমি থেকে ভ্যানরিকশা নিয়ে এসেছে কানুদা। বলে, উঠে পড়ো ডাক্তার। গাঁয়ের লক্ষ্মীকে ত হাঁটি লি যাইতে পারবনি।

রিকশায় উঠে পড়লাম দু’জনে। কানুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়িটা কার? বলাই খাঁড়ার।

সে কোথায়?

মাল খাই কাহো পড়ি আছে।

লাবণি বলে, নেশা কাটার পর সে তো তার রিকশার খোঁজ করবে…

করু। আমি ত আর চুরি করিঠিনি। তুমানেকাকে আঘুই দেইঠি।

এরপর আর কোনও প্রশ্ন জোগায় না লাবণির মুখে। ভ্রূ কপালের দিকে তুলে হেসে নুয়ে পড়ে। রিকশা চলছে হেলতে দুলতে। কানুদাকে বলি, শুনলাম, যাত্রাপার্টির বাস উলটে আছে রাস্তায়। যাবে কী করে?

ও ঠিক চালি যাবে। তুমানে একটু নামি দাঁড়িব, গাড়ি কাত করি লি যাবা।

এবার বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করি। রিকশার ঝাঁকুনি তেমন গায়ে লাগে না। মাইতিদের দোকানের সামনে এসে পড়েছি, বন্ধ আছে। ওই তো বাঁকের মুখে খেতের মধ্যে হেলে আছে যাত্রাপার্টির বিশাল বাস। ফলন্ত ধানগাছ চেপটে আছে অসহায়ের মতো। ডানদিকে গাছতলায় বসে আছে কুশীলব। কয়েকজন তাস খেলছে। হাতপাখার হাওয়া খাচ্ছে দুটো মেয়ে। রিকশা থেকে নেমে আর্টিস্টদের দেখতে দেখতে এলাকাটা পার হলাম। ওরাও আমাদের দেখছে। লাবণি বলল, লাল শাড়ি পরা মেয়েটা বোধহয় নায়িকা, ডানাওলা বউ।

কানুদা শুনতে পেয়েছে কথাটা। ভ্যানরিকশাটা তুলেছে রাস্তায়। আমাদের বলে, পড়ো। লাবণিকে বলে, মায়াটা নায়িকা না গো, ননদ সাজহ্লা। নায়িকা ত বাসের এরকম অবস্থা দেখি, মোবাইলে কাকে ফোন করলা। ঘণ্টাখানেক বাদে বাইক চাপি তাগড়া জুয়ান গটে ছ্যানা আইসি লি গেলা তাকে।

কানুদার কথা শুনে লাবণি তো হাসছেই, আমিও না হেসে পারি না। আমরা ধীরে ধীরে গভীর গ্রামে ঢুকে পড়লাম। বড় বড় গাছেরা অভিভাবকের দায়িত্বে আড়াল করেছে রোদ। পানবরজ, বাঁশবন, পাটখেত, ধানখেতের মধ্যে দিয়ে সাপের চলনে চলেছে রাস্তা। লাবণি বলে, কী নিস্তব্ধ চারপাশটা, না!—বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে, কোনও পলিউশন নেই। বাতাস যেন নাড়ি ছুঁয়ে এল।

কথাটার মধ্যে সামান্য নগ্নতার আভাস আছে দেখে, কানুদার দিকে একবার খেয়াল করলাম, শোনেনি তো? লাবণি নতুন বউ, ঘোমটা দেয়নি, সেটাই হয়তো খারাপ লাগছে কানুদার।

খানিক বাদে লাবণি গা ঝাড়া দিয়ে বলে ওঠে, ধুর, আমি এই গ্রাম থেকে যাচ্ছি না। কী আছে, কলকাতায়?

এবার শুনতে পেল কানুদা। কষ্ট করে প্যাডেল মারতে মারতে বলল, থাকি যাও বউদিমণি। আমাদের গাঁ খারাপ লাগবনি।

লাবণির আবেগটা কমন। বহু বন্ধু আমার দেশের বাড়ি এসে একই কথা বলে গেছে। এক-দু’জন আবার জমি কেনার কথাও তুলেছিল। কলকাতায় গিয়ে সব ভুলে গেছে। যেমন যাবে লাবণি।

এখন বিকেল। লাবণিকে পেয়ে বাড়ির লোক যতটা উচ্ছ্বসিত হবে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে বেশিই হয়েছে। সে এখন আমার নাগালের বাইরে। আমি বসে আছি বারান্দার ওপর বাবার চেয়ারে। এখানে বসেই রুগি দেখে বাবা। দুপুরে খেয়েদেয়ে উঠে বাবার সঙ্গে গল্প করতে এসেছিলাম। প্রতিবারই কলকাতা থেকে কিছু সাময়িক পত্রপত্রিকা নিয়ে আসি, সেগুলো দিলাম। পত্রিকা হাতে করে সেই যে উধাও হল বাবা, আর দেখা নেই। তারপর থেকে আমিই দেখে যাচ্ছি রুগি। কোনও আপত্তি করছে না পেশেন্টরা। ভাবছে, কলকাতার চিকিৎসা পাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত তিনজনকে দেখেছি। চিকিৎসা করার এক্তিয়ার আমার আছে। গ্র্যাজুয়েশনের পর ‘কমিউনিটি মেডিকেল সার্ভিস’ কোর্সটা করেছিলাম। প্রত্যন্ত গ্রামে চিকিৎসার প্রাথমিক পরিষেবা দেওয়ার জন্যে ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ মানে ‘হু’ থেকে কোর্সটা করানো হয়েছিল। সদ্য সার্টিফিকেট পেয়েছি, সেই সময় গ্রামের একটা বাজে ঝামেলায় জড়িয়ে গেল বাবা। কোর্ট-কাছারি অবধি গড়ায় ব্যাপারটা। মন ভেঙে গিয়েছিল বাবার। ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে ঘরবন্দি করেছিল নিজেকে। সংসারের কথা ভেবে আমি বসতে শুরু করি বাবার জায়গায়। আমাদের ট্রেনিংটা বাবাদের তুলনায় আধুনিক ছিল, আমি একটু সাহসীও ছিলাম। যেসব কেস সদর হাসপাতালে অথবা নার্সিংহোমে পাঠাত বাবা, আমি বাড়ি বসেই তা ম্যানেজ করে দিতাম। আমার সময় থেকে বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার, স্যালাইন, অজ্ঞান করার ইঞ্জেকশন রাখতে শুরু করি। দ্রুত নাম ছড়িয়ে পড়ল আমার। দূর দূর গ্রাম থেকে ‘কল’ আসত। এ সবের মাঝে কোর্টের কেসে রেহাই পেল বাবা। ফিরে এল পুরনো বৃত্তিতে। আমাকে পাঠিয়ে দিল কলকাতায়। আমাদের বংশে এবং এই গ্রামে আমিই প্রথম এম এ পাশ করলাম, এখন ডক্টরেট হতে যাচ্ছি। বিয়ের আগে প্রেমপর্বে লাবণিকে যখন বলেছিলাম, আমি একসময় চুটিয়ে মেডিকেল প্র্যাকটিস করেছি, বিশ্বাস করেনি। আজ হাতেকলমে রুগি দেখছি দেখে, হেসে খুন। বলে, বাংলা সাবজেক্টের একজন রিসার্চ স্কলার গ্রামে ডাক্তারি করছে জানলে, কলকাতার নিউজ চ্যানেলগুলো ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ে আসবে।

আজ প্রথম পেশেন্টের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, পাশের বেঞ্চে বসে মনোযোগ

সহকারে শুনছিল। তখনই পুকুরের জলে ঝুপুস করে আওয়াজ। পুরনো বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল বোন। পুকুরে মারল ডাইভ। নারকেল পড়েছে। লাবণি উঠে গেল মজা দেখতে। তারপর থেকেই বোনের সঙ্গে ভিড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে ওদের দেখা গিয়েছিল উঠোনের প্রান্তে আমগাছতলায়। ঝেঁপে আম এসেছে এবারে। এখনও অবশ্য কাঁচা। বোন গাছে উঠে লগি দিয়ে পাড়ছিল আম। আঁচল পেতে দাঁড়িয়েছিল লাবণি। তারপর ওদের দেখি নদীর দিকে হেঁটে যেতে। এই গ্রামে শেষ বাড়িটা আমাদের। এক মিনিট হাঁটলে সরু খাল, আমরা নদী বলতে ভালবাসি। এখন জল নেই। বর্ষাকাল ছাড়া থাকে না।

তিনটে রুগির পর আর কেউ আসছে না। বাবাকে দিয়ে যাওয়া পার্টির নিউজপেপারটা পড়ছি। কলকাতায় পড়া হয় না। ইতিমধ্যে বারচারেক ফল্স খেয়েছি, আমাদের পরের গ্রাম থেকে হেঁটে আসছিল মানুষ, ভাবলাম বুঝি পেশেন্ট। তা নয়, ওরা প্রত্যেকেই আমাদের উঠোন দিয়ে হেঁটে গেল মন্দিরতলায়। ‘দেশপুজো’ দেখতে যাচ্ছে। পিছনের গ্রামগুলোর মানুষ শর্টকাট করার জন্যে আমাদের ভিটেটাকে বেছে নেয়।

কাগজটা পড়া হয়ে গেছে। বোর লাগছে টানা বসে থাকতে। উঠতে যাব, দেখি দালানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে কণা। পিঠ বেয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার। কণা কেন গ্রামে? ওঠা হল না। বসে রইলাম চেয়ারে। দেশে আসার মেজাজটা নষ্ট হয়ে গেল। কণা এসে বসল আমার উলটো দিকের চেয়ারে। চেহারাটা একটু ভারী হয়েছে। পরিপূর্ণ নারী লাগছে ওকে। চোখের কালির মতো পুরনো সেই বিষণ্ণতা এখনও ওর শরীর ছেড়ে যায়নি। হয়তো বা আরও গাঢ় হয়েছে। তবু নষ্ট করতে পারেনি কণার রূপ। জল না থাকলেও নদীখাত একই বিভঙ্গে বাতাস বয়ে নিয়ে যায়। কণা বানানো হাসি হেসে বলল, কেমন আছ দিপুদা? সহজ থাকার চেষ্টা করি আমি। বলি, ভাল। কবে এলি তুই?

গতকাল এসেছি।

বর এসেছে তোর?

এসেছে।

বরকে ‘দেশপুজো’ দেখাতে নিয়ে এলি বুঝি? বিয়ের পর থেকে তো আর আসিসনি? মুখ নিচু করে মাথা নাড়ে কণা। অন্য কিছু ভাবছে। জানতে চাই, শরীর খারাপ নাকি? বাবার কাছে দেখাতে এসেছিস? আমাকে বলতে পারিস। বিকেল থেকে আমিই পেশেন্ট দেখছি। বাবা একটু ছুটি নিয়েছে।

আমি তোমার কাছেই এসেছি। শুনলাম, বউ নিয়ে এসেছ।

কপালে বোধহয় ভাঁজ পড়ল আমার, অশুভ কিছুর গন্ধ পাচ্ছি। কপট আন্তরিকতায় বললাম, বউয়ের সঙ্গে আলাপ করবি? একটু বস তা হলে। আভা ওকে নিয়ে বেড়াতে গেছে।

বউদির সঙ্গে আলাপ তুমি না করালেও হয়ে যাবে। আমি এসেছি তোমার কাছে একটা দরকারে।

চোখে প্রশ্ন ঝুলিয়ে তাকিয়ে থাকি। দরকারটা বলতে সময় নিচ্ছে কণা। মুখটা কেমন যেন পালটে যাচ্ছে। বেদনা ঘন হচ্ছে মুখে। ও কি বিয়েতে সুখী হয়নি? কিন্তু আমি যে

শুনেছিলাম… ভাবনার মাঝপথে কণা বলে ওঠে, আমাকে একবার নিয়ে যাবে সেখানে? কোথায়?

যেখানে মাটি চাপা দিয়েছিলে ওকে।

মুহূর্তে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার। হাত দুটো আঙুল জড়াজড়ি করে পড়ে আছে টেবিলে। নিজের মনে হচ্ছে না। এই হাতে কণার অ্যাবরশন করেছিলাম আমি। বাচ্চা প্রায় সাত মাসের হয়ে গিয়েছিল। ফুল গ্রোথ। বাচ্চাটাকে মাটিতে পুঁতেছিলাম এই হাতেই। এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কণার জীবনটা শেষ হয়ে যেত।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার মাঝে বিকেলের রঙে লাগল এক চিলতে সন্ধের ছোপ। পুকুরের জল হল সামান্য কালো। আমি বলি, ওসব কেন এখনও মনে রেখেছিস?

মাথা নিচু রেখে কণা বলে, ভুলতে পারছি না যে। কোথাও কোনও বাচ্চা কাঁদলে, এই চার বছর বাদেও বুক টনটন করে আমার, কেউ যদি জোর জবরদস্তি আমার পেটে বাচ্চাটা এনে দিত, ভুলতে অসুবিধে হত না। ওটা যে নিখিলদার…

যেন এক যুগ পর নিখিলের চেহারাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। সচেতনভাবেই ভুলেছিলাম এতদিন। আমার ক্লাস-মেট। দু’জনেই পড়াশোনায় বেশ ভাল। আমাদের নিয়ে গ্রামের মানুষের খুব গর্ব। একসঙ্গে মাঠ ভেঙে স্কুল, বাসে করে বেলদা কলেজে পড়তে যেতাম। নিখিল টিউশন পড়াত গ্রামের ছেলেমেয়েদের। আমি বাবার কম্পাউন্ডার। নিখিলের কোচিং ক্লাসে কণা পড়ত। বর্ষার পুকুরে প্রথম পদ্মের মতো যৌবন এসেছিল কণার শরীরে। লাজুক, অপ্রস্তুত যৌবন। কণা-নিখিলকে সেইসময় এক-দু’বার আমি পান বরজের কাছে দেখি। গোপন প্রেম আড়াল করার ব্যাপারে পান বরজের সুনাম আছে। আমি কিন্তু নিখিলকে সতর্ক করিনি। চেয়েছিলাম কণার সঙ্গে ফেঁসে যাক। আর কোনওদিন গ্রাম থেকে বেরোতে পারবে না। খুব গরিব শ্বশুরবাড়ি হবে। শিক্ষাদীক্ষার কোনও বালাই নেই কণাদের বাড়িতে। ওর বাবা, কাকা মাঠে কাজ করে। মাথায় ধানের বস্তা বয়। ওইভাবেই নিখিলকে বইতে হবে শ্বশুরবাড়ি। আমি চলে যাব বাইরে, বৃহত্তর জগতে। কিন্তু রাসকেলটা এমন কাণ্ড ঘটাবে, কে জানত!

কী গো, যাবে তো নিয়ে?

কণার ডাকে সংবিৎ ফিরল। বললাম, জায়গাটা কি এখন আর মনে আছে, সেই কবেকার ব্যাপার।

মিথ্যে কথা বোলো না। ওসব কাজ কেউ ভোলে না। অত দূরে বিয়ে হয়ে চলে যাওয়ার পরও কি আমি ভুলতে পেরেছি বাচ্চাটাকে?

কথা ঘোরানোর জন্যে বলি, হ্যাঁরে, এতদিন বিয়ে হল, ছেলেমেয়ে হয়েছে তোর?

চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে আলগা দিয়ে বসে কণা, বলে, না। আমার তাতে কোনও দুঃখ নেই। তোমাদের জামাই ডাক্তারের পেছনে পয়সা ঢেলে যাচ্ছে। একটু থেমে বলে, আমার কী মনে হয় জানো, তুমি বোধহয় একটু বেশিই সাফসুতরা করে দিয়েছিলে পেটটা। গোটা নাড়িটাই কেটে বাদ দিয়েছিলে। তাই আর কেউ আসছে না। একদিক থেকে ভালই হয়েছে, আগের বাচ্চাটাকে ভুলে যেতাম হয়তো। নিখিলদাকেও আর মনে পড়ত না।

অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা থেকে কথা বলছে কণা। ওর বুলির মধ্যে ঢুকে পড়েছে হিন্দি শব্দ। যেমন এখন বলল, সাফসুতরা। কণার বিয়ে হয়েছে উত্তরপ্রদেশের ছেলের সঙ্গে। এরকমভাবেই ও একদিন ভুলে যাবে বাংলা। ‘দেশপুজো’ দেখতে আসার ছলে, মৃত বাচ্চার কবর দেখতে চাইবে না।

কখন যাবে তা হলে? ফের জিজ্ঞেস করে কণা।

ভবি ভোলবার নয়। কিছু একটা উত্তর দিতে মুখ তুলি। দেখি, আভা, লাবণি উঠোন ধরে এগিয়ে আসছে। কণাকে বলি, তোর বউদি আসছে, ভালই হল, আলাপ হয়ে যাবে।

শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল কণা। দালানে উঠে এল লাবণি। আভা যেন একটু শরীর ঝামটে চলে গেল ভিতর বাড়ির দিকে। ভঙ্গিটা কণাকে উপেক্ষার। কণা গ্রামের নাম খারাপ করেছে, দুটো পরিবারের মুখে চুনকালি তো মাখিয়েইছে, আমার বাবাকেও যথেষ্ট সমস্যায় ফেলেছিল। আভার উপেক্ষা তাই কণার প্রাপ্য। ধুলোভরতি চটি পরা লাবণি কণাকে আপাদমস্তক মাপছে। ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে কণা। লাবণিকে বলি, এ কিন্তু পেশেন্ট নয়। আমাদের চারটে বাড়ি পরেই ওদের বাড়ি। নাম কণা। বিয়ে হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। অনেকদিন পর দেশে এল।

কথা শেষ হতেই কণা ‘আমি আসি বউদি’ বলে তড়িঘড়ি নেমে গেল দালান থেকে। লাবণি বেশ অবাক হয়েছে। বলল, মেয়েটা যেন পালিয়ে বাঁচল মনে হল। না না লজ্জা পেয়েছে। সাফাই গাইলাম আমি।

উঁহুঁ। আমার মনে হচ্ছে অন্য কিছু। বলতে বলতে পাশের বেঞ্চিতে বসল লাবণি। একটু ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করল, কী মশাই, পুরনো প্রেম নয় তো?

কী যে বলো না। বলে, হাসতে থাকি আমি। ফের বলি, ওকে আমি সেই ইজের পরা বয়স থেকে দেখছি। অনেকদিন পর বাপের বাড়ি এল, তাই দেখা করতে এসেছে। অনেকদিন পর এল কেন?

এলাহাবাদ থেকে কি ঘনঘন আসা যায়।

অত দূরে বিয়ে করতে গেল কেন মেয়েটা? কাছাকাছি কি ভাল পাত্র ছিল না। নাকি তোমার বিরহ ভুলতে চলে গেছে দূরে?

কথাগুলো ঠাট্টার সুরেই বলছে লাবণি। আমিও সুযোগ পেয়ে গেলাম আমাদের গ্রাম সম্বন্ধে কিছু তথ্য দেওয়ার। বলতে থাকলাম, এ গ্রামের অনেক মেয়েরই উত্তরপ্রদেশে বিয়ে হয়। যেসব মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে, দেখতে ভাল নয় অথবা খুব গরিব ঘরের তাদের উত্তরপ্রদেশের পাত্রর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। কোনও কিশোরী যদি বেচাল করে, উত্তরপ্রদেশে বিয়ে দেবে বলে ভয়ও দেখায় বাবা-মায়েরা।

শুধু উত্তরপ্রদেশ কেন? জানতে চায় লাবণি

যতদূর জানি, উত্তরপ্রদেশের কোনও এক বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে মেয়ের সংখ্যা কম। এবং ওদের মেয়ের বাড়িতে মোটা পণ দিয়ে বিয়ে করতে হয়। যারা গরিব, বাংলার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। এখানেও পণ দেয়, তবে খুব সামান্য। এইসব নেগোশিয়েশন করার জন্যে একটা চক্রও আছে। মেয়েগুলো যে প্রবাসে অত্যাচারিত হয়, তা নয়। ভালই থাকে।

ওখানে মানাতে না পেরে কেউ আবার বরসুদ্ধু ফেরত আসে গ্রামে। আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকজন উত্তরপ্রদেশের ভ্যানরিকশাওলা, চাষের মজুর, ছোট ব্যবসায়ী আছে। এলাকার লোক ওদের ‘জামাই’ বলে ডাকে। বলে, নিজের ঠাট্টায় নিজেই হাসি। লাবণি হাসে না। স্বগতোক্তির ঢঙে বলে, এই মেয়েটার তো অত দূরে বিয়ে হওয়ার কথা নয়। বেশ সুন্দর দেখতে!

কী উত্তর দেব ভেবে পাই না। দুর্বল যুক্তি দিই, কলকাতার মেয়েদের আমেরিকায় বিয়ে হয় না?

আভা থালায় তিন কাপ ‘চা’ নিয়ে আসে। বলে, দাদা, চা খেয়ে রেডি হয়ে নে। যাবি তো মন্দিরতলায়? আজ অর্কেস্ট্রা আছে। সন্তুর টিম। সন্তুও গাইবে।

চায়ের কাপ তুলে নিয়ে বললাম, যাব। ভাইয়ের ফাংশন দেখা হয়নি আগে। আভা সামনের চেয়ারে বসে জানতে চাইল, কী বলতে এসেছিল?

‘কণা’র কথা বলছে আভা। আমি মুখে বললাম, তেমন কিছু না, দেখা করে গেল। চোখ দিয়ে বোঝালাম, প্রসঙ্গটা বউদির সামনে তুলিস না। আভা চট করে বুঝে নিয়ে কথা ঘোরায়। লাবণিকে বলে, জানো বউদি, তোমরা এসেছ দেখে সন্তু খুব নার্ভাস হয়ে গেছে। বলছে, গাইবে না। তুমি শহরের মেয়ে, যদি ভাল না লাগে, ভুলটুল ধরে ফেলো…

আভা-লাবণি সাজগোজ করতে করতে সন্ধে নামিয়ে দিল। মন্দিরতলায় যাওয়ার জন্যে উঠোনে নেমে এলাম আমরা। আমাদের বাড়ির ঘরে-বাইরে সমস্ত আলো জ্বলছে। দোতলার বারান্দা জুড়ে লাগানো হয়েছে স্থায়ী টুনি বাল্ব। বাড়ির কপালে চৌকো প্লেটে ডিস্কো লাইট বিভিন্ন কায়দায় জ্বলছে নিভছে। লাবণি বলল, এত আলো জ্বালিয়ে রেখে কী লাভ! ঠাকুমা ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই, সবাই তো ফাংশানে গেল।

আভা বলে, নেভানো যাবে না বউদি। এ সব সন্তুর খেয়াল। ইলেকট্রিক বিল সন্তুই দেয়। ‘দেশপুজো’ আছে বলে নয়, রোজই এরকম আলো জ্বলে।

লাবণির মুখে অবাক ভাব। তবে কথা বাড়াল না। হাঁটতে লাগল আমাদের সঙ্গে। সন্তুর সাইকোলজিটা আমি বুঝি, গ্রামে বিদ্যুৎ এলেও, বেশিরভাগ বাড়ি কানেকশন নেয়নি। তাদের মত হচ্ছে, কী হবে নিয়ে, বেশ তো চলে যাচ্ছে। খামোকা বিলের টাকা গুনতে যাব কেন!

ওইসব বাড়িতে সন্ধেবেলা রাত হয়ে যায়, ভোরে শুরু হয় দিন। সন্তুরা কয়েকজন মিলে বহু তদ্বিরের পর গ্রামে বিদ্যুৎ আনে, পাত্তা দেয়নি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ।

আভার হাতে চার্জার টর্চ। আলো ধরে এগোচ্ছি তিনজনে। আমাদের পেরিয়ে চলে যাচ্ছে আরও কয়েক জোড়া পা, তাদের কারও হাতে হারিকেন, কেউ বা নিয়েছে টর্চ। কে যেন বলল, কেমন আছিস রে দিপু? এলি কবে?

লোকটাকে চিনতে না পেরেও, উত্তর দিলাম, ভাল আছি। আজই এলাম।

মন্দিরতলার মাঠ থেকে ভেসে আসছে অর্কেস্ট্রার ঝমাঝম আওয়াজ। লাবণি এই নিয়ে দু’বার যাচ্ছে মন্দিরতলায়। দুপুরে স্নান করে মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল শীতলা মাকে প্রণাম

করতে। ফিরে এসে বড়বড় চোখ করে বলেছিল, তোমাদের ঠাকুর কী বড়লোক গো! শুনলাম, ওঁর নামে নাকি অনেক জমিজমাও আছে!

আমি বলেছিলাম, ওই জমিজমার আয় থেকেই তো বছরে দু’বার উৎসব হয়। না হলে গ্রামের লোকের এত টাকা কোথায়! যাত্রা, অর্কেস্ট্রা, ভোগ… কাল আবার সারা গ্রামের লোক দুপুরে মায়ের মন্দিরে মাছ-ভাত খাবে।

সে কী ঠাকুরের প্রসাদ মাছ-ভাত কেন! খিচুড়ি নয়?

না। গাঁ-ঘরের মানুষ ঠাকুর দেবতাকে নিজের ঘরের লোক করে নেয়। শীতলা যেন সত্যিই মা, তাই মাছ-ভাত।

কথাটা শুনে খুব মজা পেয়েছিল লাবণি। বলে, বাঃ, দারুণ ব্যাপার তো!

লাবণির মুখচোখ বলে দিচ্ছে, গ্রামের অ্যাটমসফিয়ার ভালই উপভোগ করছে। একদু’দিন অবশ্য সবারই ভাল লাগে।

আমরা পৌঁছে গেলাম মন্দিরতলায়। প্রত্যেকবারের মতো ছোটখাটো একটা মেলা বসেছে। মাঠে থিকথিক করছে ভিড়। স্টেজে হিন্দি গান গাইছে ঝকঝকে পোশাক পরা মেয়ে। রঙিন আলো রোল করছে তার শরীরে। স্টেজের দু’পাশে মানুষ সমান দুটো সাউন্ড বক্স। এত আওয়াজ আমার বেশিক্ষণ সহ্য হবে না।

আভাকে বলি, তোরা গিয়ে বস। আমি কিছুক্ষণ শুনে চলে যাব। সন্তুর গান বোধহয় শোনা হবে না। বড্ড আওয়াজ। তোরাও রাত করিস না। চেনাজানা কাউকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি চলে আসবি।

আভার মতো লাবণিও দেখলাম আমার কথা মেনে নিল। ঢুকে গেল বসে থাকা মানুষের ভিড়ে। একা হতেই অন্য একটা আশঙ্কার কথা মাথায় এল, কণা নিশ্চয়ই এসেছে মাঠে। এখনও ওর প্রস্তাবে রাজি হইনি আমি। ফাঁকা পেয়ে আবার যদি এসে ধরে। একটা বিষয় বুঝতে পারছি না, জায়গাটা দেখে ওর কী উপকার হবে! কেন চাইছে দেখতে? তবে ওর আকুতিটা জেনুইন। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কেননা, যে ঘটনা ঘটিয়ে ও গ্রাম ছেড়েছে, অন্য মেয়ে হলে দশ বছরের আগে এ মুখো হত না। চার বছরও হয়নি ফিরে এসেছে কণা। বেছেছে ‘দেশপুজো’র সময়টা। সবাই উৎসব নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। নজর স্থির হবে না ওর দিকে। একই সঙ্গে এটাও আন্দাজ করেছে, দেশপুজোয় আমি আসবই। এ পুজোয় পুরোহিত বাড়ির লোকেদের আলাদা সম্মান। খাতির পেতে সবাই ভালবাসে। নিখিল কি খ্যাতির চেয়েও বেশি কণাকে ভালবাসত? আমার মনে হয় না। কণা বাড়িতে যখন ধরা পড়ল, পেটেরটা পাঁচ মাস। শহর হলে এমনটা হত না। সন্তানদের ওপর সদাসতর্ক নজর থাকে বাবা-মায়ের। গ্রামের মায়েদের সংসার অনেক বড়। গোরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, বাগান, পুকুর। মাটির বাড়ি তকতকে রাখা, ধান শুকোনো, মুড়ি ভাজা… ছেলেমেয়েরা অনায়াসে মায়ের চোখ আড়াল হয়ে থাকতে পারে। বাবা-কাকারা পড়ে আছে চাষের জমিতে, তাসের আড্ডায়। …মেয়ের সর্বনাশ হয়েছে জানার পর কণার বাবা দৌড়ে গেল গ্রামের মাথাদের কাছে। চড়-চাপড়ের বৃষ্টি, চুল ছিঁড়ে নেওয়ার প্রয়াসের মধ্যে কণা স্বীকার করে নিয়েছে, পেটের সন্তান নিখিলের। ঘটনাটা চাউর হওয়ার আগেই মাতব্বররা কণাদের

বাড়িতে মিটিং-এ বসল। যাঁদের মধ্যে ছিল আমার বাবা। ডেকে পাঠানো হল নিখিলকে। সে বেচারা তখনও কিছু জানে না। কণা জানায়নি। মিথ্যে অজুহাতে অথবা ঝগড়ার নাটক করে বন্ধ করেছিল টিউশান যাওয়া। স্কুলেও যেত না। কণা তখন পনেরো। গ্রামের মেয়ে। বুদ্ধি পাকেনি। পেটেরটাকে নিয়ে কী করা উচিত, ভাবতে ভাবতে পার করে দিচ্ছিল দিন। নিখিল এক কথায় মেনে নিল, সন্তানটা তার। চিরকালই ভীষণ ভদ্র ছেলে নিখিল। বাবারা ঠিক করল সেদিনই নিখিল-কণার বিয়ে দেওয়া হবে। জাতের হিসেবে এবং আর্থিক সংগতিতে কণারা যেহেতু অনেক নীচের দিকে, নিখিলের বাড়ির লোক বেঁকে বসতে পারে। একটা ঘরে নিখিলকে বন্ধ করে শিকল তুলে দেওয়া হল। বাবারা গেল নিখিলের বাড়ি। কণার প্রতি অভিমান (কেন জানায়নি পেটে সন্তান এসেছে), নাকি সামাজিক হেনস্থা, হয়তো বা শিকল তুলে দেওয়ার আওয়াজটাই ওকে ভয়ংকরভাবে অপমানিত করেছিল। নিখিলের বাড়ির লোককে নিয়ে এসে যখন দরজা খোলা হল, গলায় গামছা পেঁচিয়ে নিখিল কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে।

ফেঁসে গেল বাবারা। বিয়ের সম্মতি নিয়ে নিখিলকে সই করানো হয়েছিল কাগজে। সাক্ষী হিসেবে মাতব্বরদের সইও ছিল। সেই কাগজে ছিল না কণার পেটের সন্তানের কথা। কেচ্ছা চাপা দিতেই বয়ানটা ওইভাবে সাজিয়েছিল গ্রামের পাঁচমাথা। নিখিল স্বীকারোক্তি দেয়, কণার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল।

নিখিলের পরিবার থানায় ডায়রি করল, গ্রামের পাঁচমুখিয়া আর কণার বাড়ির লোক তাদের ছেলেকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছে। অ্যারেস্ট হতে হল বাবাদের। অনেক দৌড়ঝাঁপ করে জামিন পাওয়া গেল। চলল কেস। তখনই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে বাবা। প্র্যাকটিস ছেড়ে দেয়েছিল। কণার পরিবার তখন কোর্টকাছারির চেয়েও বেশি চিন্তিত ছিল কণাকে নিয়ে, পিতৃহীন বাচ্চাটা পেটে বাড়ছে। কণার বাবা আমাকে এসে ধরল, তুমি ওটাকে নিকেশ করো। জন্মালে কী পরিচয় দেব। সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।

বললাম, এত অ্যাডভান্স স্টেজে সম্ভব নয়। জীবনের ঝুঁকি আছে কণার।

গঞ্জনা শুনে মেয়ে এমনিই বিষ খাবে। শেষ চেষ্টা করে দেখো একবার। সব যদি ঠিকঠাক হয়ে যায়, ওকে উত্তরপ্রদেশে বিয়ে দিয়ে দেব।

গ্রামের সামাজিক পরিস্থিতি বুঝে ঝুঁকিটা নিলাম। বাড়িতে ডাইলেটেশন অ্যান্ড কিউরেশন তখন হামেশাই করি। অ্যাডভানাস স্টেজ অ্যাবরশনে সাহায্য করেছি কোর্সের স্যার নিলয় বসুকে। বাড়িতে অক্সিজেন, স্যালাইন, অজ্ঞান করার ইঞ্জেকশন সবই আছে। স্যারকে স্মরণ করে পুরো প্রক্রিয়াটা সারলাম। বাবা মাথা নিচু রেখে আমাকে অ্যাসিস্ট করে গেল। প্রাণহীন পরিপূর্ণ শিশুটিকে আমিই পুঁতে দিয়ে এসেছিলাম মাঠে। নিখিলের পরিবারকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিয়ে কেস উইথড্র করানো গেল। ‘বালিকোঠা’ গ্রামে ফিরে এল স্বাভাবিক ছন্দ। প্র্যাকটিস শুরু করল বাবা। আমাকে মাস্টার ডিগ্রি করতে পাঠিয়ে দিল কলকাতায়। তখনই কোনও এক সময় বিয়ে হয়ে যায় কণার। কলকাতায় বসে খবরটা পেয়েছিলাম। সামান্য আত্মগর্ব হয়েছিল, অপারেশনটা তার মানে নিখুঁত করেছি। এখন দেখা যাচ্ছে তা নয়, বাচ্চাটার অস্তিত্ব রয়ে গেছে কণার মনের গভীরে… এইসব ভাবতে ভাবতে কখন

যে মন্দিরতলা ছেড়ে বাড়ির উঠোনে চলে এসেছি, খেয়াল নেই। আমাদের আলোজ্বলা বাড়িটাকে অন্ধকার সমুদ্রের মাঝে আলোকিত জাহাজ মনে হচ্ছে। কিন্তু এ কী, বারান্দায় বসে আছে কে?

এগিয়ে যেতেই কণা উঠে দাঁড়াল। বলল, মাঠে তোমাকে খুঁজলাম। না পেয়ে ভাবলাম বাড়িতে আছ। তাই এলাম।

কেন, কী ব্যাপারে?

তখন কথা পুরো হল না যে। আবার শুনছি, তুমি নাকি কালই চলে যাচ্ছ। আমাকে জায়গাটা দেখাতে নিয়ে যাবে কখন?

বললাম, তুই যাবিই?

যাব বলেই তো অত দূর থেকে ছুটে এসেছি। নইলে এখানে আমার নিজের কে আছে বলো, বাবা-মা তো বিদায় করে নিশ্চিন্ত হয়েছে।

বুঝতেই পারছি মত পরিবর্তন করা যাবে না কণার। এড়িয়ে যাওয়াও মুশকিল, লাবণির সামনেই হয়তো এসে ধরবে। তখন আর এক সিন ক্রিয়েট। অগত্যা কণাকে বলি, সকাল ছ’টার সময় নদীর ঘাটে থাকিস।

মুহূর্তে সমস্ত বিষাদ সরে যায় কণার মুখ থেকে। মেঘের আড়াল সরিয়ে যেন ভেসে উঠল চাঁদ। চলে যায় কণা।

ভোর। শুকনো নদী আড়াআড়ি পার করে কণাকে নিয়ে চাষের জমিতে উঠে পড়েছি। ধান ছাড়াও ডাল, সবজি, ফুলের চাষ দিয়েছে অনেকে। চাষের ধরন ধারণ আগের চেয়ে পালটে গেছে। এ দিককার সমস্ত জমিই শীতলা মায়ের। আমাদের গ্রামে পঞ্চায়েত ছাড়াও একটা সমান্তরাল গ্রাম পরিচালন কমিটি আছে, তাদের মুখিয়া বা বাড়ুয়া বলা হয়। কোনও ব্যক্তি অন্যায় করলে, জরিমানা হিসেবে জমি অথবা টাকা নেওয়া হয়। সেগুলো চলে যায় মন্দির ট্রাস্টের হাতে। চাষিরা জমি ভাড়া নেয় বছর চুক্তিতে। সেই কারণেই মা শীতলা এত বড়লোক। কণার কাণ্ডের জন্যে ওদের অনেকটা জমিই চলে গেছে মায়ের নামে। ওর বাবা পরের জমিতে ভাগচাষ করে।

মিষ্টি একটা হাওয়া দিচ্ছে। নীল আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। মাথার ওপর ডাক দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে দোয়েল, টিয়াপাখি ঝাঁক বেঁধে নেমে আসছে ধানের খেতে। ভোর কেটে ভারী নির্মল একটা সকাল ফুটে উঠছে চারপাশে। এইসময় একটা বিচ্ছিরি কাজে চলেছি আমি। পথের সঙ্গী কণা কোনও কথা বলছে না। পুকুরঘাটে সোনার দুল হারিয়ে ফেলার মতো মুখভঙ্গি করে হেঁটে যাচ্ছে।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম সেই মাঠে। খেত ভরতি পাকা ধান নুয়ে পড়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণে আঙুল তুলে কণাকে বললাম, ওইখানে। তখন সবে ধান কাটা হয়েছে।

আমার আঙুল-নির্দেশ ভালমতো বুঝে নিয়ে এগিয়ে যায় কণা। নির্দিষ্ট কোণে পৌঁছে আলের ওপরই বসে পড়ে। হাত বোলায় ধানগাছের ওপর। যেন আদর করছে। ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে কান্নায়।

কাকা যেহেতু পুরোহিত, ভোগপ্রসাদ বাড়ি নিয়ে এসেছিল। খেয়েদেয়ে আমি, লাবণি দুপুর দুপুর বেরিয়ে পড়লাম। ভ্যানরিকশা এসেছিল উঠোনে। চাকা গড়াতেই মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ঠাকুমা বলেছিল, যাবার সময় শীতলা মাড়োয় গড় করি যাবু।

মন্দিরতলায় এসে রিকশাকে দাঁড়াতে বললাম। মাঠে এখন প্রসাদ খেতে বসেছে গ্রামের লোক। ওদের মাঝখান দিয়ে আমি, লাবণি মূল মন্দিরের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, চোখে পড়ল কণা, খাওয়ার সারির মধ্যে বসে আছে। হাসছে আমাকে দেখে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। লাবণি খেয়াল না করে এগিয়ে গেল। ভোরের শোকাচ্ছন্ন ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে কণা। ওই মাঠ থেকে ওকে প্রায় তোলাই যাচ্ছিল না। অনেক বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনি গ্রামে। এখন ওর হাসিটা কি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ?

সামনে যাই কণার। ভোরের বিষাদ দৃশ্য ভুলে গেছি বোঝাতে, ঠাট্টার গলায় বলি, কী রে, কেমন লাগছে বাঙালি খানা? তোর জিভ এখন উত্তরপ্রদেশের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। দারুণ লাগছে গো। কতদিন পর মায়ের প্রসাদ খাচ্ছি। বলার পর কণা আমাকে হাতের ইশারায় নিচু হতে বলে। হেঁট হই আমি। চাপাস্বরে বলে, এই ভাতের মধ্যে আমার ছেলের মাঠেরও চাল মিশে আছে। ধান হয়ে ফুটেছে সে। ওর গায়ের গন্ধ পাচ্ছি, নিখিলদারও…

চকিতে সোজা হয়ে দাঁড়াই। বাইরে থেকে কণাকে স্বাভাবিক লাগলেও, মনের ভিতরে বিরাট গন্ডগোল রয়ে গেছে। নকল হেসে বলি, চললাম রে। এসো।

তুই ক’দিন থাকবি?

দেখি। বলে, আমার পিছনে কাকে যেন হাত নাড়তে থাকে কণা। ঘুরে গিয়ে দেখি লাবণিকে টা-টা করছে। প্রত্যুত্তর দিচ্ছে লাবণিও। এগিয়ে যাই ভ্যানরিকশার দিকে।

আবার দু’পাশে ফসল ভরা মাঠ। আমরা চলেছি নাহারমোড়। লাবণি জিজ্ঞেস করে, এত চুপচাপ, বাড়ি ছেড়ে যেতে মন খারাপ করছে?

কথা জোগাচ্ছে না মুখে। মাথা নেড়ে ‘না’ বলি। লাবণি বলে যায়, আমরা কিন্তু অনায়াসে এখানে এসে থাকতে পারি, বাবা বলছিলেন, পার্টির লোকের সঙ্গে চেনাজানা আছে ওঁর, আমাকে এখানেও একটা স্কুলের চাকরি জুটিয়ে দিতে পারবেন। তুমি যদি এদিকে প্রফেসারি না পাও, বাবার মতো ডাক্তারি করবে। দিব্যি চলে যাবে আমাদের। শহরের সব ব্যবস্থাই এখানে আছে, টেলিফোন, টিভি, ফ্যান, আলো…

আরও কী সব বলে যাচ্ছে লাবণি। আমি দেখতে পাচ্ছি দূরে কণাদের জরিমানা দেওয়া জমি। একটু খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে অবাক হই, ওই মাঠে দু’জন কাজ করছে। একজন যুবক আর একটা বাচ্চা ছেলে। বাচ্চাটার মাথায় গামছার পাগড়ি। বাচ্চার মা তথা যুবকটির স্ত্রী মন্দিরতলায় বসে পরমানন্দে মাছ-ভাত খাচ্ছে এখন। আমার চোখের সামনে আমাদের গ্রামের মধ্যে জেগে উঠছে আর একটা গ্রাম। লাবণিকে বলতে ইচ্ছে হয়, আমাদের গ্রামে আলো এলেও, ওই যুবকটির গ্রামে তা কোনওদিনই পৌঁছোবে না। অন্ধকার থেকে যাবে চিরটা কাল।

সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি, ২০০৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *