বৃষ্টি হবেই
প্রথমটায় মনে হয়েছিল ভুল দেখছি। গত পনেরো দিন ধরে যে ছেলেটাকে গোটা গ্রাম খুঁজছে, দুটো পরিবার শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না, আমি খুঁজে হয়রান হয়ে ডিউটি জয়েন করে গেছি— সেই শহীদুল আমার থেকে হাত সাতেক দূরে দাঁড়িয়ে। পরনে খোপ কাটা সবুজ শর্ট জামা। জামাটা নতুন কিনেছিল। ছোড়দিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে এই জামাটাই পরছিল খুব।
দুপুরে হাওড়ার ছ’নম্বর প্ল্যাটফর্ম এখন বেশ ফাঁকা। আমার এক্ষুনি শহীদুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলা উচিত, কেন এরকম কাণ্ড করলি তুই! কী দোষ করেছিলাম আমরা। ভোট মিটে গেলেই তো গ্রামের লোক একঘরে করে দেবে আমাদের… এসব ভাবতে ভাবতে নার্ভাস হয়ে গেলাম। নিজেই আড়াল বেছে নিলাম ছানাওলাদের পেছনে। শহীদুলকে অবশ্য চোখ-ছাড়া করলে চলবে না। ও নিশ্চয়ই দুটো পঁয়ত্রিশ বর্ধমান কর্ড-এর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় নামে সেটাই দেখার।
আজ দোকান মালিকের শালা না মরলে দুটো পঁয়ত্রিশ ধরা হত না, দেখাও হত না শহীদুলের সঙ্গে। এই জন্যেই বোধহয় বলে, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন। আজ ভগবানের নজর আমার দিকে। শহীদুলকে যদি ঠিকঠাক ফলো করে যেতে পারি, মানে ও যদি আমায় না দেখতে পায়, ছোড়দির হদিশ পেয়ে যাব। তারপর শহীদুলের বাবাকে গিয়ে ছোড়দিদের আস্তানাটা বলে দিলেই, উনি সব সামলে নেবেন। সেরকমই কথা হয়ে আছে ফয়জুল চাচার সঙ্গে। তবে এই গট আপটা গ্রামের অন্য কেউ জানে না।
গত পাঁচদিন আগে সাইকেল চেপে স্টেশনে আসছি। পৌনে আটটার লোকালটা ধরতে হবে। হাটতলার বেশ কিছুটা আগে ফয়জুল চাচার সঙ্গে দেখা। একা বটগাছের বেদিতে বসে আছেন। দৃশ্যটা আমাকে খুব অবাক করল। মনে পড়ল না, ভদ্রলোককে আগে কখনও রাস্তাঘাটে একা দেখেছি কিনা। অ্যাক্টিভ পার্টি কর্মী। আমাদের গ্রামে ওঁদেরই পঞ্চায়েত চাচা ইচ্ছে করলেই প্রধান হতে পারেন হয়তো আরও বড় কোনও উচ্চাশা আছে বলে, হল না। ভোট কিন্তু ওঁকে দেখেই পড়ে।
চাচা হাতের ইশারায় আমাকে থামতে বলেন।
সাইকেল থেকে নেমে সামনে যাই। চাচার চেহারাটা কেমন যেন ঝিমোনো লাগে। বলে, তোর জন্যেই বসে ছিলাম। দিদির কোনও খবর পেলি?
উদ্ভট প্রশ্ন। চাচার ছেলে পালিয়েছে ছোড়দিকে নিয়ে, খোঁজ দিতে হবে আমাকে! রাগ করার উপায় নেই। নিরীহ ভেড়ার মতো ঘাড় নাড়ি। চাচা যেন জানত এরকম উত্তরই পাবে।
তাই আবার বলে, আমার ছেলেটা তো অমানুষ। ঘরবাড়ি, বাবার সম্মান নিয়ে ভাবে না। কিন্তু শিউলি খুব ভাল মেয়ে। সেই ছোট্ট থেকে দেখছি। ইদানীং ও-ই তো তোদের সংসারের সব কিছু দেখভাল করত। খুবই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। বাড়ির ওপর মায়া আছে। যোগাযোগ করলে, ও-ই তোদের সঙ্গে করবে।
বুঝতে পারছিলাম অত বড় নেতা হয়েও নিজের ছেলের কাছেই হেরে গেছে চাচা। শেষমেশ আমার মতো নগণ্যের শরণাপন্ন। নানান দুর্ভাবনার মধ্যেও ব্যাপারটায় বেশ মজা পাচ্ছিলাম।
চাচা আবার বলেন, তোর বাবার কাছেই যেতাম। কিন্তু পলিটিক্যাল কারণে যেতে পারছি না। তোর আমার মধ্যেই ব্যাপারটা থাক। দিদির কোনও খবর পেলেই চুপচাপ এসে আমাকে জানাবি। বাকিটা আমি সামলে নেব।
চাচাকে সামনে পেয়েও কয়েকটা জরুরি কথা জানতে চাওয়ার সাহস হল না আমার। ঠিক আছে বলে সাইকেলে উঠে পড়েছিলাম। সবথেকে জরুরি যেটা জানার, ছোড়দির সঙ্গে শহীদুলের কি বিয়ে হয়ে গেছে? গ্রামে দু’রকম গুজব উড়ছে, শহীদুল নাকি কোরান ছুঁয়ে কসম খেয়েছে, সে আর বাড়ি ফিরবে না। দু’নম্বর গুজব, কাজিসাহেব ডেকে ছোড়দিকে কলমা পড়িয়ে নিকা করেছে শহীদুল। তারপর ঘর ছেড়েছে। কোনটা ঠিক এখনও জানা যায়নি। যাই করে থাকুক না কেন, যে ছুরিটা ছোড়দি, শহীদুল আমাদের পরিবারের পিঠে ঢুকিয়েছে, তার দু’দিকেই ধার। ঘরের কাজে এক্সপার্ট হলেও ছোড়দিটা চিরকালই একগুঁয়ে। যা ঠিক করবে, না করে ছাড়বে না। কিন্তু শহীদুল এরকম হুটহাট ডিসিশন নেওয়ার ছেলে নয়। আমার ঠাকুমা সেদিন ওকে কী এমন বলেছিল যে ওরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল! ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করলে এখন কাঁদে। বলে, আমি কিছুই কই নাই। শুধু কইছি, জানোই যহন তোমাগো ভোট দিমু না, তহন দ্যাওয়াল নোংরা করো ক্যান!
এত নিরীহ কথা বলার বান্দা ঠাকুমা নয়, হুল ফোটাতে মাস্টার। নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছে, শহীদূল মাথার ঠিক রাখতে পারেনি। ছোড়দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বলে। মা গিয়েছিল পুকুরঘাটে। বাবা কোনও একটা কাজে বর্ধমানে। ঘাট থেকে উঠে এসে মা দেখে, উঠোন ভরতি পাড়ার লোক। ঠাকুমা দেদার গালাগালি দিচ্ছে। শহীদুলের হাতে দেওয়াল লেখার ব্রাশ। সেটা ছুড়ে ফেলে হনহন করে চলে গেল। মা ব্যাপারটা বোঝার জন্য ছোড়দিকে খোঁজে। সে তখন ঘরে ব্যাগ গুছোচ্ছে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ছাড়ে ছোড়দি। কাপড়জামা ছাড়া আর কিছুই নেয়নি সে। কানের পলকা দুলটাও খুলে রেখে গেছে।
শহীদুল প্রথমে নিজের বাড়িতে তুলেছিল ছোড়দিকে। টাইমিং-এ ভুল হয়েছিল। একমাস পরেই পঞ্চায়েত ইলেকশন। একে হিন্দুর মেয়ে, তাও আবার বিরোধী পার্টি সমর্থকের পরিবারের, লোকেরাও ছেড়ে কথা বলল না শহীদুলকে। আগমার্কা হিন্দুপার্টির সঙ্গে যদি বিয়েই হয়, তা হলে ভোটের লড়াই অনেক ফিকে হয়ে যাবে। নিজেদের ধর্মের লোকেদের ভোট পাবে না ফয়জুল চাচারা। অতএব পাত্রপাত্রী যে যার বাড়ি ফিরে যাও।
ফেরার। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে। পায়ে পায়ে এগোচ্ছে শহীদুল। আমি কড়া নজর রেখেছি। ও যে
কথাটা মানেনি ছোড়দিরা। তারপর থেকেই দু’জনে
কমপার্টমেন্টে উঠবে, সেটাতেই উঠতে হবে আমাকে। তবে একদম শেষে, যেন টের না পায়।
অনেক স্টেশন পার হয়ে গেছে। কমপার্টমেন্ট এখন মোটামুটি ফাঁকা। আমি বসে আছি দরজার প্যাসেজের এপাশে। ওপাশে শহীদুল। আমার সিট থেকে ওকে দেখা না গেলেও জানি, এখনও নেমে যায়নি। কারণ স্টেশন এলেই দরজার দিকে চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে থাকছি।
শহীদুল কেন কলকাতায় এসেছিল? নিশ্চয়ই কোনও কাজের খোঁজে। প্ল্যাটফর্মে যেরকম অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, বোঝা যায় এখনও কিছু ব্যবস্থা করতে পারেনি। কোথায় থাকছে, কী খাওয়াচ্ছে ছোড়দিকে, কে জানে!
শহীদুল কিন্তু এতটা অবিবেচক ছিল না। এই তো কয়েকমাস আগে, ছোড়দি ক’দিন বেশ রাত করে বাড়ি ফিরছিল। অনেকেই দেখেছে হেলথ সেন্টারের মাঠে বসে ওরা দু’জন অনেক রাত অবধি আড্ডা মারে। পাড়ার লোকেরা এবার ফিসফিসানি ছেড়ে বাবাকে মিঠে হুমকি দিল, তাদের ছেলেমেয়েরা কী শিখবে! বাবার দম নেই ছোড়দিকে কিছু বলার। মা, ঠাকুমা ঘ্যানঘ্যান শুরু করতে, ছোড়দি রাতে ফেরা আরও আধঘণ্টা পিছিয়ে দিল। শেষমেশ আমাকে ভার দেওয়া হল, শহীদুলকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে। আমি পাড়ায় খুব একটা মিশি না। ছোড়দি মুসলমান ছেলেকে প্রেম করার পর থেকে আরও এড়িয়ে চলি। আমার কোনও দল নেই। ওদিকে শহীদুল বড় নেতার ছেলে। ওদের পার্টি রাজ্যের সরকার চালাচ্ছে। তবু দুরুদুরু বুকে ওদের খেত জমির দিকে গেলাম। ওখানেই শহীদুলকে পাওয়া যাবে। শহীদুলের তিন দাদা চাকরি, ব্যাবসা করে প্রতিষ্ঠিত। শহীদুলই চাষ দেখাশোনা করে।
পাহারার মাচায় একলাই পাওয়া গেল শহীদুলকে। বাড়ির সমস্যা বললাম। রাগ করল না। তাড়িয়েও দিল না। বরং বেশ চিন্তিত দেখাল। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলে ওঠে, তোর দিদিই কিন্তু জেদ করে এসব করছে। বাড়ি ফিরে যেতে বললে, যায় না। ইদানীং বিয়ের জন্য ভীষণ চাপ দিচ্ছে!
আশেপাশে কোনও সাক্ষী নেই দেখে, বলেছিলাম, বিয়েটা করে নে। আমাদের গ্রামে তো তোদের ধর্মের লোকই বেশি। কে কী বলবে।
ম্লান হেসে শহীদুল বলেছিল, তুই কি ভাবিস অন্য ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করলে আমাদের সমাজ সহজে মেনে নেবে? এ ব্যাপারে তোদের মতোই আমাদের সমাজ গোঁড়া। ষোলো আনার বিচার বসবে। ফাইন হবে। তার ওপর আমাদের ফ্যামিলিতে তোর দিদি আদৌ মানাতে পারবে কিনা— তাই ভাবছিলাম একটা চাকরি বাকরি যদি পাই, শিউলিকে নিয়ে আলাদা থাকব।
হায়ার সেকেন্ডারি ফেল শহীদুল চাকরি পেলে, কত আর মাইনে পাবে। আলাদা সংসার চালাবে কী করে? তবু চাঁদনিতে আমি যে দোকানে চাকরি করি, মালিককে শহীদুলের জন্য বললাম। অবশ্যই শহীদুল আমার কেউ হতে যাচ্ছে, না বলে। লাভ হল না। মালিকের নাকি এমনিতেই ওভারহেড বেশি।
শহীদুল কিন্তু আমাদের সমস্যা বুঝেছিল। ছোড়দি তারপর থেকে আর রাত করে বাড়ি ফিরত না।
ঝাপানডাঙা ছাড়ল ট্রেন। এর পরই আমাদের স্টেশন জৌগ্রাম। শহীদুল কি জৌগ্রামেই নামবে? হার মেনে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। ছোড়দিকে কোথায় রেখে এসেছে?
আমার বিরাশি বছরের ঠাকুমা রাত্তিরে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রোজ এক কথা বলে ও অনুপম, এবার তো কোর্ট পুলিশ করবার লাগে। শিউলিরে বোধহয় বাংলাদ্যাশেই লইয়া গ্যাছে। যে দ্যাশ ছাইড়া পলাইয়া আসলাম আমরা, আবার সেহানেই লইয়া গেল মাইয়াডারে!
এই বুড়িকে কে বোঝাবে, সব মুসলমান ওপারের নয়। শহীদুলরা আমাদের অনেক আগে থেকে এপারের বাসিন্দা। আমরা এসেছি একাত্তরে। আমি তখনও অবশ্য জন্মাইনি। আমাদের অন্যান্য রিলেটিভরা বনগাঁ, বারাসাত, কলকাতায় আস্তানা গাড়লেও বাবা যে কীভাবে বর্ধমান অবধি চলে এল কে জানে। মুশকিল হচ্ছে, এ অঞ্চলে বাঙালের সংখ্যা হাতে গোনা। আমাদের পাড়ায় একমাত্র আমরাই বাঙালবাড়ি। ঘটিরা এখনও সুযোগ পেলেই খোঁচা মারে। এ ক্ষেত্রে বাবার যেটা প্রথমেই করা উচিত ছিল, এপারে এসেই লাল পার্টিতে ঢুকে যাওয়া। যেমন আমাদের অনেক আত্মীয় করেছে। লাল পার্টিতে অনেক মুসলিম দেখে বাবা ভিড়ল না। ওপারে হিন্দু বলে হ্যাটা খেয়েছে, এপারে বাঙাল বলে খোঁটা খাচ্ছে। একটা বিশুদ্ধ হিন্দু পার্টির জন্য অপেক্ষা করছিল বাবা। যেই সেটা পেয়ে গেল, শুরু হয়ে গেল মাখামাখি। এখন সেই পার্টিই আমাদের হুড়কো মারছে, তাড়াতাড়ি মেয়েকে ফেরত নিয়ে এসো। শত্রুর সঙ্গে বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না। একঘরে করে দেওয়ারও হুমকি দিচ্ছে ওরা। একঘরে করে দেওয়া মানে আগেকার মতো নয়। তার থেকেও খারাপ। আমাদের চাষের জমিতে পাম্পের জল দেবে না। বাড়ির ইলেকট্রিক লাইন কেটে দেবে। পাড়ার একটা লোকও কথা বলবে না আমাদের সঙ্গে। তখন কোথায় যাব আমরা?
এই রে, জৌগ্রাম ঢুকে যাচ্ছে ট্রেন। এখনও তো শহীদুল গেটের কাছে এল না। তা হলে কোথায় নামবে? ওকে ধাওয়া করতে গিয়ে আবার সেই আগের মতো হেনস্তা হতে হবে না তো? ছোড়দিরা পালিয়ে যাওয়ার চারদিনের মাথায় শহীদুলের জিগরি দোস্ত আনসার আমায় খবর দিল, ওরা আঁটপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছে। ঠিকানা বুঝে নিয়ে আমি একাই গিয়েছিলাম। তাঁতিবাড়ি। একান্নবর্তী পরিবার। শহীদুলের নাম করতেই ওরা আমায় ঘিরে ধরল। জানতে চাইল, আমি শহীদুলের কে হই? বোকার মতো সত্যি কথা বলে ফেললাম। ওরা আমায় এই মারে তো সেই মারে। ওদের বক্তব্য, আমরা নাকি প্ল্যান করে দিদিকে ওদের পরিবারে গছিয়েছি। শহীদুল যদি ওখানে যায়, ওরা দিদিকে ঘরে তুলবে না। নাম বদলে মুসলমান হলেও না।
কোনওক্রমে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচি। এবং বুঝতে পারি ছোড়দিকে নিয়ে শহীদুল অনেক দূরেই চলে গেছে। সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোড়দির ওপর অভিমান হয়। ও কি জানে না, যত দূরে চলে যাবে, ততই সরে যাবে আমাদের পায়ের তলার মাটি।
ট্রেনের জানলার বাইরে রোেদ পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। হাওয়ায় বিকেল বিকেল গন্ধ।
জৌগ্রাম ছেড়ে নবগ্রাম পেরিয়ে গেল ট্রেন। আমি এখন মান্থলি টিকিটের সীমানার বাইরে। উইদাউট টিকিট। তবু শহীদুলকে ছাড়ব না। ছোড়দির খোঁজ পেতেই হবে।
সংসারের প্রায় সবটাই করত ছোড়দি। বাবা যখন যা রোজগার করত তুলে দিত ছোড়দির হাতে। চাষের টাকারও হিসেব রাখত ছোড়দি। আমি মাইনে পেয়ে ওর হাতেই দিতাম। এমনকী ঠাকুমাও গোয়ালের দুধ বিক্রি করে টাকা জমা রাখত ছোড়দির কাছে। ছোড়দির বিয়ের জন্যেই টাকা জমাচ্ছিল ঠাকুমা। সেসব কিছুই নিয়ে যায়নি ছোড়দি। পরের দিন ডিউটিতে কী পরে যাব, সেটাও খাটের ওপর গুছিয়ে রেখে গিয়েছিল।
আমার জামা প্যান্ট কেচে রাখা, টিফিন দেওয়া, বাড়িতে কী রান্না হবে, সব ছোড়দিই করত। আমরা জানতাম বড়দির মতো ওর-ও একদিন বিয়ে হবে। যদিও বড়দি ওর মতো কাজের ছিল না। শুধু খুব ফরসা ছিল। তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায়। আজ না হয় কাল ছোড়দিরও বিয়ে হবে। যে যার কাজ বুঝে নিতে হবে আমাদের। হয়তো ছোড়দি কালো বলেই ওর ওপর আমরা একটু বেশি নির্ভর করতাম। তা বলে এটা ভাবতে পারিনি, চলে যাওয়ার আগে সংসারটা এভাবে পথে বসিয়ে যাবে। হ্যাঁরে ছোড়দি, তোকে কি আমরা খুব খাটাতাম, তাই কি তড়িঘড়ি করে এরকম একটা ডিসিশন নিয়ে ফেললি!
ওই তো ট্রেনের দরজার কাছে উঠে গেছে শহীদুল। পাল্লারোড ঢুকছে গাড়ি। তার মানে এখানেই নামবে। রেডি হয়ে বসি। ট্রেন থেমে, চালু হওয়ার মুখে রানিং-এ নামতে হবে।
ঘোর বিকেল। দোকান, বাজার লোকালয় ছাড়িয়ে শহীদুল এখন বাঁধের রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। আমি ফিট চল্লিশেক পেছনে। বাঁধের বাঁ পাশে দামোদরের চরা, চিকচিক করছে বালি, ডান পাশে খেতজমি। এবার বৃষ্টি প্রায় হয়নি। লাঙল চষা জমিগুলো খাঁ খাঁ করছে। হেঁটে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই শহীদুল, থামার লক্ষণ নেই। আর থামবেই বা কোথায়! আশপাশে বসতের কোনও চিহ্ন নেই। কোথায় থাকে তা হলে? ফাঁকা রাস্তায় আমি আর শহীদুল ছাড়া কেউ নেই। ও যদি হঠাৎ এখন পেছন ফেরে, আমি লুকোনোর জায়গা পাব না। কিন্তু আশ্চর্য ও হাওড়া স্টেশন থেকে এত অবধি একবারও পেছন ফেরেনি। গভীর দুশ্চিন্তায় হেঁটে যাচ্ছে একা। আজ ওর পাশে কোনও বন্ধু নেই, পার্টি নেই। ক্ষমতাবান বাবা নেই। আজ সত্যিই খুব একা শহীদুল।
হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসে, শহীদুলের পেছন পেছন গিয়ে যেই ছোড়দির হদিশ পেয়ে যাব, শহীদুলকে মেরে, অজ্ঞান করে ছোড়দিকে নিয়ে পালিয়ে আসব। আজ কিছুতেই শহীদুল আমার সঙ্গে পারবে না।- এরকম ছেলেমানুষি ভাবনায় নিজেরই হাসি পেল। ছোড়দি কেন আসতে যাবে আমার সঙ্গে। ওকে তো শহীদুল আটকে রাখেনি। স্বেচ্ছায় শহীদুলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে। বাধা দেওয়ার হলে, ছোড়দি ঘর ছাড়ার সময় দেওয়া যেতে পারত। তখন আমি ডিউটিতে। লাস্ট ট্রেনের আগের ট্রেনে রোজকার মতো জৌগ্রাম ফিরলাম। সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে দিব্যি গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছি। বাড়ির দেয়ালে এসে চোখ আটকে গেল, লাল পার্টির অসমাপ্ত দেওয়াল-লিখন, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে গতবারের বিজয়ী প্রতিনিধি জাকির তালু— ব্যস আর কিছু লেখা নেই।
হাতের লেখাটা ভাল। দেখলেই চেনা যায় শহীদুলের লেখা। ভোটের সময় ফয়জুল চাচা তার ছোট ছেলেকে চাষের কাজ থেকে সরিয়ে দেয়াল লেখায়। আধখানা লেখা দেখে তখনই মনে কু-ডাকল। বাড়ি ঢুকে দেখি, ঠিক তাই। সারাবাড়ি থমথমে, যেন পরিবারের কেউ চাষে দেওয়ার বিষ খেয়েছে। বাড়ির লোকের কাছে পুরোটা জানতে না জানতে বিশুদ্ধ হিন্দু নেতা হাজির। এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি ক্যান্ডিডেট। আমাকে বললেন, যা সঙ্গে ছেলে দিচ্ছি, দিদিকে নিয়ে আয়।
সঙ্গে যে সব ছেলে দিল, কোনও কালে তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল না। ছেলেগুলো ক’দিন আগেও অন্য পার্টি করত। শহীদুলদের বাড়ি গিয়ে দেখি, আমাদের বাড়ির থেকেও নিস্তব্ধ। ফয়জুল চাচা ধরা গলায় জানাল, শহীদুল বাড়ি এসেছিল শিউলিকে নিয়ে, ঝগড়াঝাঁটি করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আবার বেরিয়ে গেছে।
তখনই গুজব ছড়াল বাতাসে, কোরান ছুঁয়ে কসম খেয়ে বাড়ি ছেড়েছে শহীদুল। কেউ বলল কাজি ডেকে কলমা পড়ে…
এ কী! বাঁধ থেকে ডানদিকের ঢালু জমিতে নেমে যাচ্ছে কেন শহীদুল? দাঁড়িয়ে পড়ি। অবাক হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু দূরে একটা সরু খাল। তার ওপর বাঁশের সাঁকো। সেই দিকেই যাচ্ছে শহীদুল। সাঁকোর পরেই কোনও এক সময় প্ল্যান করে লাগানো শাল, সেগুন, শিশু গাছের সারি। বাকি চারপাশের জমি অনাবাদী। গাছের
আড়ালে চলে গেলে শহীদুলকে আর দেখতে পাব না। আমিও নেমে আসি ঢাল বেয়ে। সাঁকোর শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে শহীদুল। আমি সাঁকোতে পা রাখতে যাব। শহীদুল আমার দিকে না তাকিয়েই বলে ওঠে, সাবধানে আসিস। পোলটা নড়বড়ে।
পা থেমে গেছে আমার। বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ। তার মানে শহীদুল টের পেয়েছে আমি ফলো করে আসছি। ওপারে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় শহীদুল, কী হল, আয়। দাঁড়িয়ে রইলি কেন। আমি জানি তুই অনেকক্ষণ ধরে আমার পেছন পেছন আসছিস। ইচ্ছে করলেই তোকে ভড়কি দিতে পারতাম।
আর দ্বিধা করে লাভ নেই। পোল পেরিয়ে ওপারে গেলাম। শহীদুল বলছে, শিউলির কথা ভেবেই তোকে ঘোরপ্যাঁচ খাওয়াইনি। এখানে এসে থেকে শিউলি বাড়ির কথা যত না বলে, তোর কথাই ও বলে বেশি। ঘুরতে ফিরতে, ভাইটা কী খেয়ে ডিউটি গেল, জামাকাপড় কী পরছে, রেগেমেগে কাজ ছেড়ে দিল নাকি, তুমি একবার চাঁদনিতে গিয়ে দেখে এসো, কাজে যাচ্ছে কি না। এরকম নানা কথা। তাই ভাবলাম তোর সঙ্গে একবার দেখা হওয়া ভাল। ওর মনটা ঠান্ডা হবে। এতক্ষণ জানান দিইনি, পাছে তুই পালিয়ে যাস। এবার আমার একটু লজ্জা হচ্ছে। ছোড়দি কি সব বলে দিয়েছে শহীদুলকে? মাঝে মধ্যে
আমার সাইকেলটা ছোড়দি তেল দিয়ে মুছে দিত, সেটাও!
শহীদুলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলি, এখানে তোরা থাকিস কোথায়?
ওই যে। বলে আঙুল তুলেছে শহীদুল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভাঙাচোরা চারচালা। আমাদের জমির মুনিশরাও এরকম ঘরে থাকতে চাইবে না। শহীদুলকে জিজ্ঞেস করি, এটা কাদের জায়গা?
আমার দূর সম্পর্কের এক মামার। বিঘে পাঁচেক মতো জমি। দেখাশোনা করার কেউ নেই। চাষও হয় না। বলল, গিয়ে থাক। পারলে চাষবাস করিস। কিন্তু চাষ করব কী, টাকা কই? তার ওপর এ বছর আবার বৃষ্টির দেখা নেই। তোর দিদি বলছে এখানেই চাষ করবে। এর মধ্যেই বেশ কিছু সবজি লাগিয়েছে। সারাদিন এই নিয়েই থাকে। আমি কলকাতায় কাজ খুঁজতে যাই।
আমরা উঠোনে পৌঁছে গেছি। আমাদের গলা পেয়ে চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে ছোড়দি। একটা পুরনো শাড়ি কীরকম করে যেন পরেছে, চেনাই যাচ্ছে না। আরও চেনা যাচ্ছে না মুখের হাসিটা দেখে। ও বাড়িতে বেশ কয়েক বছর ধরে ছোড়দি হাসত না। আজ হাসছে। ঠিক যেন কালো মেঘের আড়াল থেকে ছিটকে আসা রোদ্দুর।
চা মুড়ি খেতে খেতে অনেক কথা হল। একে একে বাড়ির সবার খবর নিল ছোড়দি। দুগ্গা গাই, ভেলু কুকুরও বাদ গেল না। শহীদুলকে বললাম ফজজুল চাচার কথা। উনি চাইছেন ছেলে যেন বাড়ি ফেরে।
উত্তরে শহীদুল বলল, আব্বা যদি আমাদের রিলেশন মেনে নিত, অনেক আগেই একটা চাকরি করে দিতে পারত আমাকে। আব্বার প্রচুর সোর্স। জানে, চাকরি পেলেই শিউলিকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাব। তাই জমি জায়গার ভার দিয়ে দিল।
ছোড়দিদের উঠোনের আলো ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা। পাখির কিচির মিচির। ছোড়দিকে বললাম, বাবা বলছিল, আমাদের দু’বিঘে দশকাঠা তোর নামে করে দেবে। জমির পাশে বাড়ি করে তোরা থাক না। চাষবাস দেখাশোনা করবি। পরের জমিতে ফসল ফলিয়ে কী লাভ? কবে এসে তুলে দেবে।
উত্তর দিল শহীদুল, না রে অনুপম, গ্রামে গেলে ওরা আমাদের টিকতে দেবে না। টানাহ্যাঁচড়া করবে। হিন্দু মুসলিম এক হয়ে গেলে, ওরা পার্টি করবে কী নিয়ে। দু’ধর্মের যে সব লোক, যখনই এক হতে চাইবে আমাদের গ্রামদেশে জায়গা হবে না তাদের। তার থেকে এখানেই আমরা ভাল আছি। কেউ আমাদের চেনে না। বলে, উঠে গেল শহীদুল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে পইঠের পাশে রাখা বালতির জলে ভাল করে ওজু করল। ওর মুখ থেকে ধুয়ে যাচ্ছিল নিজের গাঁ-ঘরের ওপর জমা ক্ষোভ অভিমান। তারপর শান্ত চেহারায় ঘরে এসে নামাজে বসল।
ছোড়দিকে বললাম, তুইও নামাজ পড়িস নাকি? ছোড়দি মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়ল। তারপর আঙুল তুলে দেখাল, ঘরের কোণে ফ্রেমে বাঁধানো ওর ঠাকুর-দেবতা। আমি অজান্তে কিছুটা আশান্বিত হয়ে বলে ফেললাম, তোরা বিয়ে করিসনি? করেছি। রেজিস্ট্রি করে।
নামাজ সেরে উঠে এল শহীদুল। ছোড়দি বলল, আজ রাতে খেয়ে যা এখানে ভাই। না রে, বাড়িতে কিছু বলা নেই। ইদানীং একটু রাত হলেই বড্ড চিন্তা করে মা ঠাকুমা। বলে, চাটাই থেকে উঠে দাঁড়ালাম। শহীদুল বলল, চল তোকে এগিয়ে দি। থাক, তোকে যেতে হবে না। আমি রাস্তা চিনে নিয়েছি।
চল না, পোলটা অন্তত পার করে দি। যা অবস্থা ওটার, ভেঙে টেঙে গেলে তোকে তো তুলতে হবে।
আমরা হাসতে হাসতে উঠোনে নেমে আসি। দরজায় দাঁড়িয়ে ছোড়দি বলে, ভাই, আবার আসিস। পাড়া বা বাড়িতে কিন্তু বলিস না এখানকার ঠিকানা।
আমি কিছু বলার আগেই শহীদুল বলে ওঠে, ওকে বারণ করে তুমি আটকাতে পারবে না। ও যেটা ভাল বুঝবে করবে।
ছোড়দি আর কিছু বলে না। মুখটা হাসিহাসি করে রাখে। তার মানে গোঁয়ার দিদিটা স্বামীর কথা খুব মানে।
সাঁকোর কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল শহীদুল। সন্ধে নামতে বেশি দেরি নেই। পা চালিয়ে বাঁধের রাস্তায় উঠে আসি। হঠাৎ শাঁখের আওয়াজে পা থেমে যায়। কোথা থেকে আসছে শব্দটা? আশেপাশে তো কোনও বাড়ি নেই। ছোড়দিই বাজাচ্ছে শাঁখ। চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মঙ্গল ধ্বনি। ফয়জুল চাচা ঠিকই বলেছে, বড় লক্ষ্মীমন্ত আমার দিদি। পেছন ফিরে গাছপালার আড়ালে দিদিদের বাড়িটা খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ে, আকাশের দু’প্রান্ত থেকে দুটো কালোমেঘের স্তম্ভ উঠে এসেছে ছোড়দিদের জমিবাড়ির ওপর। বৃষ্টি হবে। আজ রাতেই হয়তো বৃষ্টি নামবে আশীর্বাদের মতো। ওই দুটো মেঘের একটা আল্লা, আর একটা ঈশ্বর। বৃষ্টিতে উর্বর হবে ছোড়দিদের জমি। ওরা ঠিক খেয়েপরে থাকবে। আমি কোনওদিনই ছোড়দিদের ঠিকানা কাউকে বলব না। সে আমাদের একঘরে করেই দিক, আর কেটে পুঁতে ফেলুক।
তথ্যকেন্দ্র শারদ সাহিত্য ২০০৩