এবার ওড়ো
প্রিয় পুরুষ, কতদিন পর যে তোমার সঙ্গে মনে মনে কথা বলছি, কে জানে! হয়তো বেশ কয়েক মাস, বছর নিশ্চয়ই নয়। বিগত ওই দীর্ঘ সময় আমি ভাবাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নিজের সঙ্গেও কথা বলিনি। তবু নাকি আমার ঠোঁট নড়েছে, বলছিল তাপস। ডাক্তারবাবুও তাই বিশ্বাস করেছেন। আমি কিন্তু জানি না। নিজেরই ঠোঁট এখন আমার অবাধ্য হয়ে গেছে।
সে যাক, কী আর করা যাবে! এখন তুমি এ প্রশ্ন আমায় করতেই পারো, ভাবনাচিন্তা না করে এই ক’টা দিন আমি কীভাবে কাটালাম? কোনও জাগ্রত মানুষই চিন্তা না করে থাকতে পারে না। আমিও হয়তো ছিলাম না। কোনও একটা চিন্তা অদৃশ্য ভ্রমর-গুঞ্জনের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। কী চিন্তা সেটা জানি না। আসলে হল কী, কিছু ওষুধ, যার প্রভাবে মনের সামনে আবছায়া নেমে এল। নিজের চিন্তার নাগাল পাচ্ছিলাম না আমি।— এত অবধি শুনে নিশ্চয়ই খুব ঘাবড়ে গেলে। ভাবছ, ফুরফুরে নরম মনের মেয়েটার হল কী! একই সঙ্গে এটাও চিন্তা করছ, এতই যখন বেহাল অবস্থা আমার, তা হলে আজ হঠাৎ তোমার সঙ্গে কথা বলতে বসলাম কী করে! বলছি, বুঝিয়ে বলছি। দাঁড়াও একটু জল খেয়ে নিই।— এ কী ব্যস্ত হচ্ছ কেন! আমি নিজেই বিছানা থেকে নেমে জল খেতে পারব। হয়তো নামতেই হবে না। যেই উসখুস করব, ওমনি, ওই যে আমার কর্তব্যপরায়ণ বর তাপস, জানলার বাইরে মেঘে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার জন্য মুখিয়ে বসে আছে, সব ছেড়ে আমাকে বলবে, কী হল উঠছ কেন? কী দরকার লাগে বলো।
আমি মোটেই পুরোপুরি শয্যাশায়ী নই। দিব্যি ঘুরেফিরে বেড়াতে পারি। তবু তাপস ওর এক্তিয়ারের মধ্যে যা পড়ে, সব কাজই আমার করে। তাপসই তো ডাক্তারের পরামর্শমতো আমাকে এই শৈলাবাসে নিয়ে এসেছে।… দেখলে তো একটু পাশ ফিরতেই তাপস কেমন আমার প্রয়োজন জেনে নিয়ে জল এগিয়ে দিল। তাপসের মুখটা আজ ভোর থেকেই গোমড়া। পরাজিতের কাঠিন্য। ওর দোষ নেই। ভোরবেলা মিনিট পাঁচেকের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিয়েছিল। আমার ঘুম ভাঙতে বেশ কিছুটা সময় খরচ হয়েছে। চোখ খুলেই আমি দেখি, বুকের ওপর আকাশছোঁয়া তুষার শৃঙ্গ। আচমকা এই অভিঘাতে কেঁপে উঠি। তাপস হয়তো জানে না, অপ্রস্তুত অবস্থায় কখনও কোনও বিশালতার সামনে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তা সে যত সুন্দরই হোক! ধবল শাণিত ভয়ংকর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আমার মুহূর্তের জন্য মহাজাগতিক কোনও প্রাণীর দাঁত বলে ভ্রম হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে বালিশে মুখ গুঁজি আমি। তাপস ডেকে ডেকে সারা হয়। এই ফাঁকে মেঘ ঢেকে দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। আমার
আরোগ্যের আকাঙ্ক্ষার মতো আগ্রহ নিয়ে তাপস তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে।
গতকাল সন্ধেবেলা গাড়ি চেপে থোপা থোপা কুয়াশার ভেতর দিয়ে আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি। বৃষ্টিও হচ্ছিল ঝিরঝিরে। পাহাড়, পাকদণ্ডি, গাছ কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। ফগ লাইটের হলুদ সম্পাতে পাহাড়ি রাস্তাটা স্বপ্নে দেখা পথ বলেই মনে হচ্ছিল। পেট্রলের গন্ধকে হার মানিয়ে গাছ, পাহাড় ভেজা গন্ধ আসছিল নাকে। এই অস্পষ্ট আবহাওয়ার কারণে তাপসের মুড ছিল টোটালি অফ। গাড়িতে বসে ঘনঘন বিরক্তির শব্দ করছিল মুখে।
কাঠের বাড়ির অনুকরণে তৈরি হোটেল। ঝিমোনো আলোর করিডর যখন আমরা পার হচ্ছিলাম, মৃত বৃক্ষের মচমচ শব্দ হচ্ছিল। ওই অসহ্য নিস্বন পেরিয়ে আমরা আরও নির্জনতম ঘরে এসে পৌঁছোলাম। ঘরে ঢুকেই তাপস জানলার পরদাগুলো টান মেরে সরিয়ে দিয়েছিল। পুরো রুমটাই কাচে মোড়া। রুম সার্ভিসের ছেলেটা জানাল, এখানকার কোনও হোটেলে এরকম ভিউ সাইট ঘর নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা এখান থেকে সরাসরি দেখা যায়। দৃষ্টিপথের দূরত্ব আঠাশ কিলোমিটার।
বাইরে তখন অপ্রকাশিত বেদনার মতো কুয়াশা। পরম আকুতিতে আমাদের জানলায় গাল ছুঁইয়েছে। সার্ভিস বয়টাকে ডাহা মিথ্যুক মনে হচ্ছিল তখন।
আজ ভোরে মুহূর্তের প্রাকৃতিক উদ্ভাসে বেসামাল হলেও, তোমার সঙ্গে যোগাযোগটা ঘটে গেল। মনের খানিকটা আবছায়া সরে গেল আমার।… তো যা বলছিলাম, কাল এই ঘরটাতে নিজেদের সইয়ে নিতে টিভি চালিয়েছিল তাপস। তারপর মদের বোতল বার করে সবিনয়ে জানতে চেয়েছিল, খাব একটু?
ইদানিং যে-কোনও ছোটখাটো বদমাইশির আগে তাপস আমার পারমিশন নেয়। খুব সম্ভ্রম করে আমার অসুখটাকে। কেননা ওকে তো এখনও চুমুও খেতে দিই না আমি। তার একটা বিশেষ কারণ আছে। পরে বলছি। এমনিতে বেশ কিছুদিন হল যৌন সাড়া আমার মন তো দেয়ই না, শরীরও না। যৌন বাসনা এখন আমার সমুদ্রঝড়ে নিভে যাওয়া বাতিঘরের মতো। তাপস মাঝেমধ্যে হাতে মোমবাতি নিয়ে প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে চুড়োয়। এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিই আলো।
আমি তো এরকম ছিলাম না প্রিয় পুরুষ। যৌবনারম্ভ থেকেই মধুপায়ীর নিবিড় অথচ আলতো আদরের জন্য কেমন উন্মুখ হয়ে থাকতাম। তুমিই তো ছিলে আমার যৌবন শুরুর সাক্ষী প্রথম পুরুষ। মনে আছে সেই বিকেলের কথা! মাকে নিশ্চিন্ত করে সেইদিন আমি সম্পূর্ণ নারী। সবকিছু বুঝিয়ে, গুছিয়ে, সাজিয়ে মা বলল, আজ খেলতে যাসনি। শান্ত হয়ে বাড়িতে বসে থাক।
মায়ের কথামতো আমাদের একতলা কোয়ার্টারের বারান্দায় চুপটি করে বসে ছিলাম। টাউনশিপ-এর পার্ক থেকে ভেসে আসছিল বন্ধুদের হইচই। শীত চলে যাচ্ছে। আমাদের ছোট্ট বাগানে দোপাটি গাঁদা জিনিয়ারা নিস্তেজ। বাগানময় হলুদ আলো। একটা শালিক সেই হলুদ আলোর মধ্যে থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। তখনই তুমি এসে দাঁড়িয়েছিলে। একটু দূরে। কী অপূর্ব তোমার রূপ! হলুদ আলো যেন তরল সোনা হয়ে লেগেছিল তোমার
গায়ে। আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসছিলে, লজ্জায় শিউরে উঠেছিলাম আমি। তুমি কিছু বলার আগে এক ছুট্টে বাড়ির ভেতরে চলে যাই। আসলে চলে যাই নিজের মনোজগতে। সেইদিন থেকেই আমার কল্পনার রাজ্য বোনা শুরু। সেই রাজ্যে তোমার প্রবেশ অবাধ। মন হলেই তোমার সঙ্গে কথা বলি। যখনই কোনও পরিচ্ছন্ন, শ্রীসম্পন্ন পরিবেশে গিয়ে পৌঁছোই, তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াও। রাতে ঘুম না এলে ডেকে নিই তোমাকে। ইচ্ছেমতো স্নানঘরে ঢোকারও পারমিশন দিই। তখন তুমি বাথরুমের জানলা গলে আসা রোদ হয়ে দেওয়ালে সেঁটে থাকো। আমার নগ্নতায় বুঁদ হয়ে যাও। স্নানঘরের আয়নায় তখন মনোরম এক আগুন জ্বলে ওঠে।
এরই মধ্যে সময়মতো বিয়ে হয়ে গেল আমার। দুর্গাপুরের টাউনশিপ ছেড়ে প্রথমে এলাম তাপসদের শোভাবাজারের যৌথ সংসারে। সেখান থেকে কলকাতার উপকণ্ঠে ফ্ল্যাটবাড়িতে। এখানে টাউনশিপের পরিকল্পিত অথচ আন্তরিক পরিবেশ নেই। বাচ্চাদের পার্ক নেই একচিলতে। গাছ নেই বলে পাখিরা হইচই করে বাড়ি ফিরতে পারে না।- তবে এ সবের জন্য কখনও আমি বিরক্তি দেখাইনি। যখনই দম আটকে এসেছে, চলে গেছি দুর্গাপুরের স্কুল মোড়ে। যেখানে অঝোর বৃষ্টিতে আটকে গেছি ছাতিমতলায়। পায়ের নীচে সবজে সাদা গুঁড়ো ফুল। চাপ মিষ্টি গন্ধে পাগল পাগল অবস্থা। ঠিক তখনই তুমি সাইকেল নিয়ে এসে দাঁড়ালে।
তোমার আমার এই অভিসারের কথা আমি কাউকে বলিনি, শুধু একজনকে ছাড়া। সে হচ্ছে পলা। আমার সংসারের কাজের মেয়েও বলা যায় অথবা এখনকার নির্বান্ধব আবাসের একমাত্র সখী। সদ্য বিয়ে হয়েছে মেয়েটার। সুখে ঘর-সংসার করছে। তুমি বলবে, তাকেই বা বলতে গেলাম কেন?— সে বলছি। দাঁড়াও, রুম সার্ভিসের ছেলেটা বোধহয় ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে। টোকা দিচ্ছে দরজায়। তাপস উঠে গেল। যাওয়ার আগে বলল, ব্রেকফাস্ট খেয়ে রেডি হয়ে নাও। এসে থেকে ঘরবন্দি হয়ে আছি। বেরোতে হবে তো!
তাপস বেয়ারার হাত থেকে প্লেটগুলো নিচ্ছে। বেচারা। ঘরবন্দি না, বউবন্দি হয়ে আছে। কতদিন আমাকে এভাবে সহ্য করতে পারবে কে জানে!
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। পলা। কালোর ওপর ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়ে। ওর মা আমাদের ফ্ল্যাটে কাজ করত। হঠাৎই একদিন ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। বলল, বউদিদি, মেয়েটা বড় হয়ে গেল, কাজে তো দিতেই হয়, দিলে তোমাদের মতো ভদ্র শিক্ষিত বাড়িতে দেওয়াই ভাল। অন্য যা সব ফ্যামেলি, সাহস হয় না।
আমি তখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি পলার দিকে। এই তেলচিটে কাঠিসার মায়ের এরকম মেয়ে ! থাকে খালপাড়ের কলোনিতে! মেয়েটার ভ্রমরকৃষ্ণ চোখ। শরীর জুড়ে সতেজ সারল্য। এখনও চোখেমুখে সদ্য ফেলে আসা কিশোরীবেলার জলছাপ রয়ে গেছে।
প্রথম ক’দিন শান্ত হয়ে কাজ শুরু করলেও, ক্রমেই প্রকাশিত হতে লাগল ওর ছটফটানি, উসখুস ভাব। দেখে বুঝতে পারতাম তোমার মতো কাউকে সে পায়নি। কাজের ফাঁক পেলেই দাঁড়িয়ে থাকত বারান্দায়। লুকিয়ে আমার কসমেটিক্স নিয়ে সাজত। ধরা পড়ে গেলে তৎক্ষণাৎ ওঠবোস করত নিজের কান মুলে। দিন যেতে না যেতেই কমনীয় উদ্ধত হয়ে
উঠছিল পলার শরীর। কী আশ্চর্য, ওর গায়ের কালো রংটা থেকেও যেন আলো বেরোত। আমারও গেল ঝোঁক চেপে, ওকে ভাল পুষ্টিকর খাবার দিতাম। তবে নির্বিকার মুখে। ও অবাক হত। দুধের সর, হলুদবাটা মেখে কিছুটা ওর জন্য রেখে উঠে যেতাম। যেভাবে মানুষ তার অগোছালো বাগানের কাছে অলস আগ্রহে জল দেয়, সেই ভঙ্গিতেই পরিচর্যা করছিলাম পলার। অল্প লেখাপড়া, দেশবিদেশের রূপকথা শুনিয়ে ওর নিজস্ব মনোজগৎ তৈরি করার চেষ্টা করছিলাম। এ ব্যাপারে মেয়ের কোনও আগ্রহ নেই। বলে, ধুর বাপু, এসব আমার ভাল্লাগে না। তোমরা একটা সোনামণির ব্যবস্থা করো তো। তার সঙ্গে খেললে বরং কাজ দেবে।
তাপসকে বললাম, পলা তো সারাদিন থাকেই রাতটাও না হয় থাক। যা শেখাই সব তো কলোনিতে গিয়ে ভুলে যায়।
আমার প্রস্তাবটাকে আদিখ্যেতা আখ্যা দিয়ে তাপস বলল, কাজের মেয়েকে অত মাথায় তুলো না। আমাদের পুরনো বাড়িতে দেখেছ তো, কাজের লোকেদের বিছানা, চেয়ারে বসতে দেওয়া হয় না।
একটা দুর্বল অজুহাতে তাপস ওবাড়ি ছেড়ে এলেও, সংস্কারগুলো নিয়ে এসেছে। এতই অন্ধ সেইসব সংস্কার, পলার মনোহর উদ্ভাসটাই দেখতে পাচ্ছে না। এই দেখতে না পাওয়াটায় আমি কি একটু নিশ্চিন্ততা পেয়েছিলাম? কী জানি! এখন মনে করতে পারি না। মেয়েটা কিন্তু খুব চটপটে, কাজের ছিল। যতক্ষণ বাড়িতে থাকত, হাত চলত আর খই ফুটত মুখে। ফাঁকিবাজি বলতে, বারান্দায় দাঁড়ানো আর মাঝেমধ্যে জড়িয়ে ধরত আমায়। মনে হত যেন আমারই ছোটবেলা আমাকে আদর করছে। ওর চুলে শরীরে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া মাঠ, বাগান, শীত ফুরিয়ে যাওয়া দোপাটির স্পর্শ পেতাম।
নাঃ, বড্ড তাড়া দিচ্ছে তাপস। চা, জলখাবার খাওয়া হয়ে গেছে আমাদের। তাপস বলছে, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। পাঁচ-ছ’ কিলোমিটার দূরে একটা ঝরনা আছে। চলো দেখে আসি।
আমার মধ্যে কোনও উৎসাহ না দেখে তাপস বলে, এখানে এসেও ঘরে বসে থাকবে নাকি! তুমিই এককালে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাথা খারাপ করে দিতে।
হাসি পায়। আমার নিজের মাথাটা খারাপ করার পর তাপস আমাকে নিয়ে বেড়াতে এল। ডাক্তারবাবু পরামর্শ দিয়েছেন, আমাকে ডেলি রুটিন আর পরিচিত পরিবেশের বাইরে ক’টা দিন রাখতে। সঙ্গে সঙ্গে তাপস ম্যাজিকের মতো অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করে ফেলল।
যাই, বলছে যখন একটু ঘুরেই আসি। তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে।
তুমি কি খেয়াল করছ প্রিয় পুরুষ, এই যে আমরা প্রাচীন বিশাল বৃক্ষের অরণ্য পাশে রেখে চলেছি, যার ছায়া আমাদের ভাড়া গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে পড়েছে, এই ছায়ারা আমায় যেন কিছু বলছে। ছায়ার ভাষা যদি বুঝে থাকি, ওরা বলছে, এইখানে, এইখানে আছে।
কী আছে? কে আছে? কিছুই বুঝতে পারছি না। এই বৃক্ষচ্ছায়ার কণ্ঠস্বর কেমন যেন
অন্যরকম। ভয় সংক্রমণের গলা। এই স্নিগ্ধ মনোরম প্রকৃতির মাঝে এসেও কীরকম জানি ভয় ভয় করছে আমার। অথচ চিরকালই আমি শ্রীসম্পন্ন নয়নাভিরাম দৃশ্যের কাছাকাছি যেতে চেয়েছি। সেই যাত্রাপথ আজ এত ভয়সংকুল কেন?
গাড়ির জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীচে পাহাড়ের মাথায় মেঘের মুকুট। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীর বাল্মীকিপ্রতিভা। আমাদের হাতে-গলায় গাঁদার মালা। কিন্তু নাচদিদির (এই মুহূর্তে আসল নামটা মনে পড়ছে না) বেণির মালাটা তাজা বেলফুলের। বেশ মোটা। কী অমোঘ তার আকর্ষণ। স্টেজে নাচ সেরে এসেই আমি নাচদিদির সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরতে লাগলাম। অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে যেতে, নাচদিদির চোখ পড়ল আমার ওপর, কী রে, তুই বাড়ি যাবি না!
আপনার মালাটা দেবেন দিদি? ফাংশান তো এখন শেষ
ও, এইজন্যই তুই আমার পিছন ছাড়িসনি। কী অদ্ভুত মিষ্টি মেয়ে রে বাবা! নাচদিদির কমপ্লিমেন্টের থেকেও বেলফুলের মালাটা হাতে নিয়ে আমার ভাল লেগেছিল। ঠিক ওই পাহাড়ের মাথায় মেঘটার মতো। আমি জানি ওই মেঘের গায়ে বেলফুলের গন্ধ আছে।
সে যাক, বলছিলাম পলার কথা। পূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পলার মধ্যে অতিরিক্ত উচ্ছলতা দেখা দিল। হাঁটাচলায় দোলায়িত দেখানেপনা ভাব। টিভির পরদায় নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্ভাবনার দৃশ্য রুদ্ধশ্বাসে গিলত। শাসন করতাম। ধমকাতাম। খিলখিল করে হাসত। আমার আশঙ্কা ঠিক প্রমাণিত করে তাপস একদিন অফিস থেকে ফিরে বলল, মেয়েটাকে আর রাখা যাবে না।
কেন
এই তো একটু আগে দেখলাম, ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে চার-পাঁচটা বখাটে ছেলের সঙ্গে হাহা-হিহি করছে।
খবরটা শুনে আমারও খুব রাগ হল। পরের দিনই ধরলাম ওকে, তোকে খাইয়ে পরিয়ে ওই নোংরা ছেলেদের জন্য তৈরি করছি! কোনও টেস্ট নেই তোর! ওই ছেলেগুলোর মধ্যে কে তোর লাভার। না কি সবাই।
নির্লজ্জ মেয়ের হাসি থামে না। বলে, না গো, দীনেশের সঙ্গেই আমার ভাব। বাকিরা দীনেশের বন্ধু।
দীনেশ ছেলেটা কেমন?
খুব ভাল। আমাকে ভীষণ ভালবাসে। প্রমোটার নিমাই দলুইয়ের ডান হাত দীনেশ।
আমি প্রমোটার নিমাই দলুইকে চিনি না। তার ডানহাতের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে জানি না কিছুই। থম মেরে বসে রইলাম। পলা বলে যাচ্ছিল। তোমার সঙ্গে একদিন দীনেশের আলাপ করিয়ে দেব। দেখলেই বুঝতে পারবে, কী ভাল ছেলে। ও বলেছে, বিয়ের পর আর ক্যাম্পে থাকবে না। নিমাইবাবু ওকে ফ্ল্যাট দেবে।
আমি বলেছিলাম, তুই যা খুশি কর গে যা। ভুলেও ছেলেটাকে আমার সামনে আনবি না।
তাই শুনে বলে কিনা, আচ্ছা বউদি, সত্যি করে বলো তো, তুমি কোনওদিন প্রেম করোনি?
উত্তরে কী বলব আমি। মাথায় তুলেছি নিজেই। তবে শেষ চেষ্টার মতো সেই প্রথম তোমাকে সত্যিকারের মতো করে ওকে বললাম। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বিশ্বাস করছে না। বড় বাস্তব ক্লান্ত মেয়ে। কিছুতেই ওর মনে ছোট্ট একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে পারলাম না।— তারপর ক’দিন পলার সামনে গম্ভীর থাকলাম। মন খারাপ হত এই ভেবে যে, আমার সকল চেষ্টা অবসর বিনোদনের মতো দেখতে হয়ে গেল। এদিকে ওকে যে অন্য কোনও সুস্থ পরিবেশ এবং সভ্য জীবন দেব, সে ক্ষমতাও আমার নেই। এমনই সময় এক সন্ধেতে দীনেশ আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় এল। সমাজের খারাপ দিকের আঁচ লাগা চেহারা। কী আগ্রাসী চাউনি! চেষ্টাকৃত বিনয়ে বলল, পলা আছে বউদি? ক’দিন দেখা করছে না। একটু বলে দেবেন তো।
চলে যাওয়ার আগেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কীরকম যেন বন্য আবেদনময় ঘসঘসে গলা। পরের দিন সকালে পলা কাজে আসতেই ধরলাম, কোন সাহসে ছেলেটা এ বাড়িতে আসে?
একইরকম হেসে পলা বলে, বিশ্বাস করো বউদি, আমি ওকে পইপই করে বারণ করেছি এ বাড়িতে আসতে। দেখা করছি না বলে, থাকতে না পেরে চলে এসেছে। দেখা করছিস না কেন?
কী বলব বউদি, এমন অদ্ভুত আবদার, ওর সব বন্ধুদের সঙ্গে বসে আমায় আড্ডা দিতে হবে। আমার যেন কোনও প্রেস্টিজ নেই। দিয়েছি দেখা বন্ধ করে। এখন একদম টাইট।
কে যে কাকে টাইট দেয়! আমি আর কথা বাড়াইনি। ওদের পরিপার্শ্ব, জীবনধারায় আমি তেমন পরিচিত নই। তবু ভাল লেগেছিল ওর মুখে ‘প্রেস্টিজ’ কথাটা শুনে। অন্তত মর্যাদাবোধটা ওর মধ্যে আমি আনতে পেরেছি।
আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়াল ঝরনার কাছাকাছি। তাপস নেমে গিয়ে আমাকে ডাকছে। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখি, অনেক উঁচু থেকে অবিশ্রান্ত ঝরে পড়ছে জল। ভিজে বাতাস চিরে ডেকে উঠছে অচেনা কোনও পাখি। মন ভাল হতে থাকে। গাড়ি থেকে নেমে আসি। কে জানে কত দূর থেকে পাথর কেটে পাশ কাটিয়ে ঝরনাটা এখানে প্রকাশিত হল। সেইসব অজানা অচেনা পথে যেতে ইচ্ছে হয়। সেখানে কত নাম না জানা অনাঘ্রাত ফুল, গাছ, পাখি !
ঝরনার নীচে জলের গুঁড়োতে রামধনু। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। তাপস সাবধান করে। গ্রাহ্য করি না। আমার শরীরে এখন ঝিরিঝিরি জল। গোপন আদরের মতন আনন্দ দিচ্ছে। কোনও এক অবরুদ্ধ চেতনার আড়াল সরে যাচ্ছে ক্রমশ।
গতকালের থেকেও আজ সকালটা গোমড়া। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাই যায়নি। বেড-টি খেয়ে তাপস এখন বাথরুমে। আজ আর্লি মর্নিং আমরা ফ্লাওয়ার ভ্যালি দেখতে যাব। তাপস নিশ্চয়ই মনে মনে আমার ওপর খুব খেপে আছে। মুখে কিছু বলছে না। ডাক্তার হয়তো আমাকে বকতে বারণ করেছে। কাল একটা যা বিচ্ছিরি সিন করেছি না, তোমাকে কী বলব! ঝরনা দেখে ফেরার সময় বেশ আসছিলাম, মনটাও শান্ত, হালকা। গাছের ছায়ারা উইন্ডস্ক্রিনে ঝাঁপিয়ে পড়লেও, বোবা হয়ে ছিল। খাদের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল ঘণ্টার আওয়াজ। ঠিক যেন কোনও মনাস্ট্রিতে অবিরল কেউ ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে অথবা ছোটবেলার সেই হাওয়াই মিঠাইওলা সেঁদিয়েছে ওইখানে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ওটা একটা পোকার ডাক। তখনই প্রশ্ন করলাম, পোকাটাকে সে কোনওদিন দেখেছে কিনা? ড্রাইভার বলল, জঙ্গলে ঢুকে বহু তল্লাসি করেও, সে কোনওদিন দেখতে পায়নি।
যাই হোক, ওই ঘণ্টার শব্দে আমাদের ফেরার পথ বেশ নির্জন পবিত্র হয়ে উঠেছিল।
হোটেলে ঢুকেই বাধল গন্ডগোল। রিসেপশানের সামনে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই আমি চমকে উঠলাম। তাপসের হাত আঁকড়ে বলি, দীনেশ। ওই লোকটা দীনেশ না?
তাপস আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, দীনেশ এখানে কোথা থেকে আসবে! ওসব তোমার মনের ভুল।
লোকটার শুধু পিঠের দিকটা দেখা যাচ্ছে। আমি কিন্তু শিয়োর, ও দীনেশই। লোকটার পায়ের কাছে লাগেজ নামানো। পলা কোথায়? পলাকে কি গাড়িতে বসিয়ে রেখে এসেছে। বেয়ারার হাতে চাবি দিয়ে ম্যানেজার ঘর দেখাতে বলল দীনেশকে। বেয়ারাকে অনুসরণ করে চলে গেল দীনেশ।
তাপসের হাত ছেড়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজেদের রুমে ফিরে যেতে। তাপসকে বললাম, এক্ষুনি এই হোটেল আমাদের ছেড়ে দিতে হবে।
রুমে ঢুকে আমি বসে গেলাম সাজতে। এ সাজ কিন্তু ট্যুরের জন্য সাবলীল ড্রেসআপ নয়। রীতিমতো ঘটা করে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিয়েবাড়িতে পরে যাওয়া সাজ। শাড়ি, গয়না, অতি উজ্জ্বল প্রসাধন। সব আমি বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। প্রস্তুতির কোনও ফাঁক রাখতে চাইনি। পলার সঙ্গে যে-কোনও সময়ই দেখা হয়ে যেতে পারে। হয়তো সেই সম্ভাবনার কথাই ঝরনা দেখতে যাওয়ার সময় গাছেরা বলছিল, এইখানে, এইখানে আছে।
বুঝতে পারছি তুমি অবাক হচ্ছ এই ভেবে, পলার মুখোমুখি হওয়ার সঙ্গে সাজের কী সম্পর্ক! সে কথা পরে বলছি। আগে গন্ডগোলটা বলে নিই, আমাকে সাজতে দেখে তাপস বলছিল, আবার তুমি এরকম করছ! এখানে এসেও পলাকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছ না! তা হলে বেড়াতে নিয়ে এসেও কোনও লাভ হল না।
আয়না মারফত ভেঙে পড়া তাপসকে দেখে আমি বললাম, ঠিক আছে, তুমি আগে গিয়ে দেখে এসো পলারাই এসেছে কিনা।
দুই
তাপস বেশ উৎসাহ নিয়ে রিসেপশানে গেল এবং ফিরে এল খুব দ্রুত। বলল, যে লোকটাকে আমি দেখেছি, ঘর দেখে তার নাকি পছন্দ হয়নি। চলে গেছে।
তাপসের এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসাটাতেই আমার সন্দেহ হল। বললাম, আমাকে ঘরটা দেখাও।
সে ঘর তো তালা মারা।
তালা খুলে দেখাও। ওরা এইখানে আছে। এইখানেই।
রুম সার্ভিসের ছেলে ডেকে তালা খোলানো হল। ফাঁকা ঘর। বিছানার ওপর লন্ডভন্ড চাদর। বেড সাইড টেবিলের ওপর উচ্ছিষ্টের প্লেট। মেঝেতে মদের বোতল, গ্লাস গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটু আগে যেন মহাভোজ হয়ে গেছে। পলাকেই খেয়ে ফেলেছে বোধহয়। তবু বাথরুম, খাটের তলায় খুঁজলাম পলাকে। অতঃপর আবছা অন্ধকার আয়নায় সালংকারা নিজেকেই খুঁজে পেলাম। এ ঘরেও যেন সেজেগুজে পলার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। তাপস বলল, কী, বিশ্বাস হল তো?
হতাশ হয়ে ফিরলাম নিজেদের রুমে। তাপস আমাকে কী একটা বিশ্বাস করার কথা বলছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বলে চলেছে একই কথা।
তাপস এবং হোটেলের ছেলেগুলোকে উত্ত্যক্ত করার জন্য খুবই অপরাধবোধ হচ্ছিল। তাপস অবশ্য এসব আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, পূর্ণ উদ্যমে নানান মনভোলানো কথা বলছিল। তখনই ও ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারের কথা বলে, যা আমরা আজ দেখতে যাব। ম্যানেজার নাকি তাপসকে বলেছে, জায়গাটা অনবদ্য সুন্দর। ফুল, পাখি, প্রজাপতি… ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে প্রজাপতি হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।
তো যাক, আমার সাজের প্রসঙ্গ বা উদ্দেশ্য বলি, এমনিতে আমি চড়া সাজ মোটেই পছন্দ করি না। বিয়ের সময় যা একবার ডাকসাইটে সেজে ছিলাম। তারপর থেকে গয়নাগাটি, বেনারসি সব তোলা ছিল। সাজের ব্যাপারে প্ররোচিত করল পলা। দীনেশ ওই একবারই আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিল। তারপর থেকে পলা কেমন উড়ুউডু। কাজে মন নেই। মাঝেমধ্যেই কামাই। হাঁটাচলায় কেমন যেন উদ্ধত, বেহায়া ভাব। বোঝাতে যাই। সর্বনাশ মেশানো হাসি হাসে। আক্ষেপ হয় আমার, আমারই পরিচর্চিত গাছ, বেড়ে গিয়ে অন্যের আঙিনায় ফুল দিচ্ছে।
হঠাৎ টানা কামাই। কিছুদিন অপেক্ষা করার পর তাপসকে বলি, যাও ওদের কলোনিতে। গিয়ে খবর নাও একটা। মেয়েটার শরীরটরির খারাপ হল কি না।
তাপস ওদের কলোনিতে যেতে চায় না। খালপাড় জায়গাটার অনেক বদনাম। নোংরা পরিবেশ। আমার উপরোধে নিমরাজি হয়ে গেল। ফিরে এল থমথমে মুখ নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
তাপস বলল, রেপড হয়েছে পলা। গ্যাং রেপড। এখন হাসপাতালে।
কী আশ্চর্য, ধর্ষণ শব্দটা কোনও ধাক্কাই দিতে পারল না আমাকে। এতটাই ক্লিশে হয়ে গেছে! তাপস তখন বলে যাচ্ছে, ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। ক’দিন আগে ইনকমপ্লিট এক হাউজিং-এর ছ’তলায় এক দঙ্গল কাকের চেঁচামেচিতে সন্দেহ হয় এলাকার লোকের।
ওপরে উঠে উদ্ধার করে পলাকে। ভাগ্যিস তখনও প্রাণ ছিল!…
তাপস শুনিয়ে যাচ্ছিল বৃত্তান্ত। আমার মাথায় ঘুরছে, আচ্ছা, ঠিক কতক্ষণ পর ধর্ষিতা নিজেকে সমর্পণ করে? ঠিক কখন শরীর আর মন আলাদা হয়ে যায়? তোমাকে বলতে লজ্জা নেই প্রিয় পুরুষ, তখন একবার প্লেজার কথাটাও মাথাতে এসেছিল। ওই বীভৎস ঘটনার মধ্যে কি কোথাও এক চিলতে আনন্দানুভূতি থাকে? পরক্ষণেই নিজেকে ধমকাই, এসব কী ভাবছি আমি। মেয়েটা কেমন আছে এখন? ব্যস্ত হয়ে উঠি হাসপাতাল যাওয়ার জন্য।
তাপস যেতে দিল না। বলল, এই অবস্থায় আমাদের ওখানে না জড়ানোই ভাল। পুলিশ আমাদের নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবে। দরকার বুঝলে আমাদের ফ্ল্যাটে পুলিশ নিজে থেকেই চলে আসবে। আমাদের আর কষ্ট করে কী লাভ!
বেশ ক’দিন কেটে গেল। পুলিশ কিন্তু এল না। এমনকী নিউজ পেপারেও বেরোল না পলার খবর। ওঁদেরও দোষ নেই। খালি একঘেয়ে ধর্ষণের খবর ছেপে কাগজটাকে বোরিং করার কোনও মানে হয় না।
কেউ না আসুক। পলা কিন্তু ফিরে এল। আমি অবশ্য জানতামই ও ফিরে আসবে। আমার কাছ ছাড়া যাবেই বা কোথায়। শুধু শরীরটুকু ফেরত পাওয়া ছাড়া পলা আর সবই খুইয়ে এসেছে। অনুজ্জ্বল শাড়িটা সেদিন যেন একটু বেশি ঢাকাঢুকি দিয়ে পরা। ওর গা থেকে ভেসে আসছিল হাসপাতালের গন্ধ। মেঘ কালো মুখ করে লেগে গেল কাজে।
আমি সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম, ‘ধর্ষণ’ অক্ষরটা ছেপে ছেপে এবং বারবার উচ্চারিত
হয়ে শক্তি হারালেও, ধর্ষিতার ওপর তার পরাক্রম একইরকম বজায় থাকে। তাপস বাজার থেকে ফিরে পলাকে দেখে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। আমাকে ডেকে
বলল, ওকে চলে যেতে বলো।
আমি বললাম, ওর দোষটা কী?
তাপস আমার কথা কানে না তুলে,
নিজেই পলাকে ডেকে বিদেয় হতে বলল।
পলা কাঁদছিল। হাতেপায়ে ধরছিল আমাদের। যদি ভিজে যাই, এই ভয়ে তাপস আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে নিজেই পলার কান্নার সামনে দাঁড়াল। তাপস ওকে কী কী বলছিল, এখন আর খেয়াল নেই। পলা অন্তিম আকুতিতে বলে যাচ্ছে, দাদা গো, আপনাদের বাড়িতেই আমাকে রেখে দিন। খাওয়া-পরায় থাকব। মাইনেও দিতে হবে না। চৌকাঠও পেরোব না আমি।
পলার কান্নার সুরে আমি বর্ষার রাগিণীর আভাস পাচ্ছিলাম। যেন ধু ধু মরুভূমির মাঝে শূন্য রাজমহলে বসে একটানা গেয়ে যাচ্ছে কোনও নারী। দিকচক্রবালে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই।
পলা চলে গেল। দু’দিন যেতে একজন বুড়ি বহাল হল বাড়ির কাজে। আমিও ভুলতে চেষ্টা করছিলাম পলাকে। হঠাৎই একদিন বিকেলে পলা উপস্থিত। আমি তো ওকে দেখে চিনতেই পারি না! কী অপরূপ লাগছে! জমকালো শাড়ি, গা জুড়ে গয়না, সিঁথি উপচে সিঁদুর। শরীর থেকে ভেসে আসছে সুখী সুখী গন্ধ। বলল, বউদি, দীনেশ বিয়ে করে নিল। ,
কীভাবে রাজি হল?
কীভাবে আবার। পার্টির লোকেদের ধরলাম। এখন তো লজ্জার কিছু নেই, সবটাই বললাম, দীনেশই বন্ধুদের দিয়ে এসব করিয়েছে। নিজেও ছিল। পার্টি চেপে ধরল দীনেশকে। পুলিশও থানায় নিয়ে গিয়ে ভালই কড়কানি দিয়েছে। শেষমেশ দীনেশ রাজি হল। ছেলেটা আসলে ভাল, জানো বউদি। একটু বদসঙ্গে পড়ে গিয়েছিল, এই যা!
আমি বললাম, যাক, তোর তো একটা গতি হল। এখন মন দিয়ে… মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পলা বলল, গতি কী বলছ বউদি! আমাকে পেয়ে ও একদম পালটে গেছে। চোখছাড়া করতে চায় না। গয়না, শাড়ি ওই তো বেছে বেছে নিয়ে এল। আমি বলি, এতসব কিনে দিয়ো না। আমার এসব অভ্যেস নেই। লোকের বাড়ি কাজ করে খেতাম…
একটু দেরি হলেও, বুঝতে পারলাম সেদিন তাড়িয়ে দেওয়ার শোধ নিতে এসেছে পলা। দেখাচ্ছে ওর বৈভব। আমার স্নেহ ভালবাসা ভুলে আমাকেই প্রতিপক্ষ ঠাওরেছে। প্রতিপক্ষের শক্তি হ্রাস করতে চাইলে, তার প্রশংসা করতে হয়। জানে না বোকা মেয়েটা। আমিই উলটে ওর প্রশংসা শুরু করলাম, তোকে কিন্তু এসব পরে দারুণ মানিয়েছে, সুন্দর দেখাচ্ছে।
পলা অন্যরকম হাসছিল। দ্বিধাগ্রস্ত অহংকারে ফিসফিসিয়ে বলল, এসবের জন্য সুন্দর লাগছে না। পেটের ভেতর সে এসে গেছে।
আমি চমকে উঠি, সে কী রে, কার?
কার, কী করে বলব! সেদিন পাঁচটা ছেলে ছিল।
দীনেশকে বলেছিস?
বলব। ভাল মুড দেখে বলতে হবে।
যদি রাজি না হয়। নষ্ট করতে বলে।
বলবে না, বিয়েটায় যখন রাজি হয়েছে, বাচ্চাটাও মেনে নেবে। তা ছাড়া ওই দিন ফ্ল্যাটবাড়িতে দীনেশই তো আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।
পলার কথা শুনে আমি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি৷ কী জানি বাবা, বোকা মেয়েটা এসব পরিস্থিতি কী করে সামলাবে! উদ্বেগ তাড়াতে সহজ হওয়ার ভান করি, হ্যাঁরে বিয়েতে আমার থেকে কী নিবি?
সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল পলা। হেলাফেলা ভঙ্গিতে বলল, কী আর দেবে। সবই তো আছে। দিয়ো কিছু একটা।
দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল পলা। বললাম, আবার আসিস। চিন্তায় থাকব। হ্যাঁ, আসব। খুব তাড়াতাড়িই আসব। সন্ধের দিক করে। আজ তো দাদার সঙ্গে দেখা হল না।
কীরকম একটা গোলমালের মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেল পলা। অপমানিতও লাগছে, আবার ওর জন্য চিন্তাও হচ্ছে। হয়তো আশঙ্কার কিছু নেই। ওকে করুণা করে অপমানটা আড়াল করতে চাইছি। আমার আপন ভুবনকে তুচ্ছ করে পলা আসলে প্রমাণ করে গেল সুখী হওয়া কত সহজ।
তার পরের দিন থেকেই আমি কোনও ঝুঁকি নিইনি। বিকেল হতে না হতেই সেজেগুজে
বসে থাকতাম। কী জানি কখন জাঁকালো সাজে পলা চলে আসে।
প্রথম দিন তাপস ব্যাপারটা মজা করে নিল। হাসতে হাসতে বলল, এখন বুঝেছ তো, সোনাদানা কত অর্থহীন। উপলক্ষর অভাবে ঘরে বসে পরে থাকতে হচ্ছে।
রাত হতে সাজ খুলে ফেললাম। তাপসের সামনে কিছু ভাঙলাম না। সন্ধেবেলা শরীরে দীপ জ্বালিয়ে বসেছিলাম বলেই হয়তো অবশিষ্ট উষ্ণতার আকাঙ্ক্ষায় তাপস এসেছিল কাছে। অভ্যস্ত আবেশে তাপসকে শরীরে গ্রহণ করলেও, একসময় চোখ খুলে দেখি, তাপসের জায়গায় দীনেশের মুখ! তৎক্ষণাৎ ঘৃণ্যটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিই।
সেই শেষবার। আর তাপসকে ঘেঁষতে দিইনি কাছে। পরের দিন আবার সেজেগুজে পলার অপেক্ষায় থেকেছি। পলা আসেনি। তাপসের জোরাজুরিতে সাজের আসল কারণটা বললাম। ওর মুখে চিন্তার মেঘ ঘনাল। সাজ বন্ধ করলাম না আমি।
তাপস একদিন অফিস থেকে ফিরল ফুরফুরে মেজাজে, তোমার পলাকে নিয়ে দীনেশ তো হনিমুনে গেছে। খবর নিলাম।
ওরা কবে ফিরবে?
তা তো জানি না। অত ডিটেলে খোঁজ করিনি।
তাপসকে বললাম, বাচ্চার দুটো সোনার বালা এনে দিয়ো তো। পলা বোধহয় বাচ্চা কোলেই আসবে।
আমার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে রইল তাপস। ক’দিন অপেক্ষা করলাম, তাপস বালা তো নিয়ে এলই না। বদলে কী একটা খবর নিয়ে এল, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
তারপর থেকেই অনেক কিছু বুঝতে পারি না। শুনতে পাই না। কিন্তু সাজতে ভুলি না বিকেলে। তাপস নিয়ে গেল ডাক্তারবাবুর কাছে। উনি এমন সব ওষুধ দিলেন, মনটা ঢুকে গেল দীর্ঘ কোনও গুহাপথে। আলোর উদ্দেশে সেখানে ট্রেন চলছে অনন্তকাল ধরে। আমার মাথায় একটানা গুম গুম শব্দ।
এই শৈলাবাসে এসে একটু একটু করে যেন ফিরে পাচ্ছি নিজেকে। তোমাকেও।
দেখেছ, তোমার সঙ্গে কথায় এতই মশগুল, কখন যে শাড়ি পরেছি, গাড়িতে উঠেছি, কিছুই খেয়াল নেই। এখন আমরা আবার সেই পবিত্র নির্জন পাহাড়ি পথে। ঘণ্টা বাজছে জঙ্গলে। মাঝেমধ্যেই পাহাড় বেয়ে ঝরনা এসে পথ কেটে যাচ্ছে। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে গাছের আকার। ঝোপঝাড়ে আচমকাই হেসে উঠছে অচেনা ফুল। পৃথিবীর এখন অনেক ওপরে আমরা। কী অমলিন রোদ, হাওয়া, গন্ধ। আমরা বোধহয় ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারের কাছাকাছি এসে গেছি। এখানে আকাশ অপরাজিতা ফুলের মতো নীল। দূরে দূরে শান্ত ধবল শৃঙ্গের সারি যেন ধ্যানমগ্ন।
এই উদার সৌন্দর্যের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না বলেই বোধহয় তাপস এবং ড্রাইভার বড্ড চুপচাপ। আমার কিন্তু ভীষণ ভাল লাগছে। হালকা হয়ে যাচ্ছে মাথা। টের পাচ্ছি, আপন-হাসি ফুটে উঠেছে মুখে। অনেক দিন হাসিনি আমি।
গাড়ি আর যাবে না। এটাই হয়তো ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার। এখনও অগণন ফুলের শোভা
চোখে না পড়লেও, আবহাওয়ায় তাদের ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছি।
নেমে এলাম গাড়ি থেকে। ড্রাইভার উঁচু একটা টিলা দেখিয়ে বলল, উয়ো হ্যায় বাটারফ্লাই টপ। পয়দল যানা পড়েগা। বহুত তিতলিয়াঁ মিলেগি উঁহা। যা কে দেখিয়ে কিতনি খুবসুরত কালার। ঈশ্বর কিতনা বড়া আর্টিস্ট হ্যায় তিতলিয়োঁ কো দেখ কর পতা চলতা হ্যায়। ড্রাইভার এল না। সে নাকি বহুবার দেখেছে। আমি আর তাপস প্রবল আগ্রহ উৎকণ্ঠায়
এগিয়ে গেলাম ঐশ্বরিক সৌন্দর্য দেখতে।
সত্যিই কী অপূর্ব এই প্রাকৃতিক শিখর। চারপাশে কত বর্ণময় ফুল, প্রজাপতি, পাখির মিষ্টি ডাক। বনজ গন্ধ। সমস্ত আবছায়া সরে যাচ্ছে মন থেকে। আমি কি স্বাভাবিক হয়ে আসছি? খাদের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াতেই শিউরে উঠলাম। মনে পড়ে গেল সব। খাদের অতল থেকে উঠে আসছে অজস্র প্রজাপতি। মনে পড়িয়ে দিচ্ছে ভুলে যাওয়া সেই দুঃসংবাদ, পলারা হনিমুনে গেছে খবর নিয়ে আসার কিছুদিন পর তাপস আর একটা খবর নিয়ে আসে, দীনেশ ফিরে এলেও, পলা ফেরেনি। অ্যাক্সিডেন্টে খাদের তলায় তলিয়ে গেছে।
সেদিনই কি পলা সন্তান ধারণের খবরটা দীনেশকে দিয়েছিল? দীনেশ আর বোঝা বাড়াতে চায়নি। ঠেলে ফেলে দিয়েছে পলাকে।— কথাটা মাথায় আসতেই পিছন ফিরে দেখি তাপস এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। তাপসের কাছে আমিও তো এখন বোঝা।
ম্যানেজার বলেছিল, এখানে এলে নাকি প্রজাপতি হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সত্যিই ইচ্ছে করছে আমার। নীচের জঙ্গলে ঘণ্টা বাজছে। ওখানেই আছে পলা, পলার বাচ্চা। আমারই কল্পিত সরল সৌন্দর্যে নির্বাসিত হয়েছে ওরা। কোন ঈশ্বরগণ পুজো করছে ওদের? অবিরল ঘণ্টা বাজছে কেন! প্রিয় পুরুষ, আমাকে বিবর্ণ এলেবেলে একজোড়া ডানা দাও। আমার পলাকে একবারটি দেখে আসি।
দেশ, নভেম্বর ২০০৩