দখল
ছানার জলের রঙের ভোর। দাওয়ায় বসে আছেন শৈলজা। খানিক আগেই রোজকার মতো ঘুম-অলস পায়ে ছেলে বিনয়েন্দ্র উঠোন ধরে গেল খড়গাদার পিছনে। পস্রাব করে ফিরবে। শৈলজার ঘুম কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। অন্ধকার থাকতেই এসে বসেন বাইরে, পঁচাশি বছরের সঙ্গে যোগ হয় আর একটা দিন। নাতনির বিয়েটা মনে হচ্ছে দেখে যেতে পারবেন, শরীরটা বশে আছে। গত পনেরো-ষোলো বছর ধরে পার্বণ, অনুষ্ঠানের আগে মৃত্যুভয় বড্ড কাবু করে ফেলে তাঁকে। আর ঠিক চল্লিশ দিন পর বিয়ে। জীবনের কোনও শখ আহ্লাদ অপূর্ণ রইল না।
বিনয়েন্দ্র ফিরে আসছে। একটু উঁচু করে ধরেছে ধুতি। খালি গা, আবছা আলোতেও ধবধব করছে গায়ের রং। অবিকল ওর ঠাকুরদা। কানে জড়ানো পইতেটা এখনও নামায়নি। শৈলজা জানতে চান, দেখলু?
বিনয়েন্দ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে বোঝাপড়ার হাসি হাসে। বলে, হুঁ, দেখলি। মন মিজাজ কীরকম?
বিনয়েন্দ্র নিজের শোওয়ার ঘরের দাওয়ার দিকে যেতে যেতে বলে, বেশ ফুরফুরে লাগল্লা*।
আশ্বস্ত হন শৈলজা। বাড়িতে বিয়ের মতো একটা শুভ কাজ এগিয়ে আসছে। শ্বশুরমশাইয়ের মেজাজটা এই সময় ভাল থাকা খুব দরকার। নয়তো কখন কী অনিষ্ট করে বসেন। যদিও অনাসৃষ্টি তিনি সরাসরি করেন না। জমি-জিরেত ছেড়ে ক’দিনের জন্য উধাও হয়ে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে বৃষ্টি-বাদলা বেশি বেশি হয়, উপচে যায় পুকুর। মাছ ভেসে যায়। পচে যায় ফসল। মাটির বাড়ির দুর্বল অংশটা হয়তো বসে গেল। উলটোটাও হয়, এল খরা। বীজতলায় বেড়ে নষ্ট হয়ে গেল ধানচারা। মাঠ ফুটিফাটা, রোয়া গেল না ফসল। পুকুরের জল শুকিয়ে পাতাল দেখা যাচ্ছে। উনি টহলদারিতে না থাকলে কখন যে কী হবে বলা যায় না। এ ছাড়াও বাড়িতে অসুখ-বিসুখ তো আছেই। শৈলজার তাই সবসময় চিন্তা, শ্বশুরমশাই আছেন তো আশেপাশে? উনি যখন বেঁচে ছিলেন, শৈলজা এক প্রকার ঘৃণাই করতেন তাঁকে। কোনওদিন এক গ্লাস জল গড়িয়ে দেননি। সুযোগও পাননি দেওয়ার। শ্বশুরমশাইয়ের ভিটে আলাদা। মাঝে আশশ্যাওড়ার বেড়া। তার উচ্চতা এতই কম যে শ্বশুরমশাইয়ের অমিতাচার জীবনযাপনের পুরোটাই পরিলক্ষিত হত। উনি দ্বিতীয় বিবাহ করতেই শৈলজার শাশুড়ি ছেলেকে নিয়ে পৃথক হয়ে যান। ছেলে অর্থাৎ শৈলজার কর্তা ছিলেন তেমনই নির্লোভ, পৈতৃক সম্পত্তির দিকে ফিরেও তাকাতেন না। যা পেয়েছেন সেটাকেই যথেষ্ট মনে করতেন। তারপর তো কেলেঘাইয়ের খাল অনেকবার ভেসে গেল, শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেল আরও যে কতবার, কোনও গোনাগুনতি নেই। শৈলজার বড় ছেলে বিনয়েন্দ্রর বুদ্ধি, কর্তব্যনিষ্ঠা, পরিশ্রমে আজ রাখালচন্দ্র মিশ্রর ভিটে এক হয়ে গেছে, উঠে গেছে আশশ্যাওড়ার বেড়া। এখন সিমেন্টের পিলার দেওয়া মাটির দোতলা বাড়ি। সারারাত টুনিবাল্ব জ্বলে। ছোট ছেলের ছেলে বিল্টুর শখ।
বিনয়েন্দ্র শুধু ভিটে এক করেনি, জমিজিরেত বাড়িয়েছে অনেক। শৈলজার কর্তা সমাজের বিবেচনায় অপদার্থ মানুষ, বাপের থেকে পাওয়া জমিজমা যতটুকু যা পেয়েছিলেন, ধরে রাখতে পারেননি। নানান খেয়ালে খুইয়েছিলেন। বহুদিন পর্যন্ত হাঁড়ির হাল গেছে শৈলজার সংসারে। রোজগারের উৎস একটাই, গ্রাম-মন্দিরে কর্তার সেবাইতের কাজ। শ্বশুরমশাই বরাদ্দ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র ছেলের স্বভাব-ধরন বুঝতেন ভালমতোই। বলতেন, তোর দ্বারা তো কুনো কাজ হবার নাই। পুরোহিতগিরি কর।
ওই কাজটা এখন শৈলজার ছোট ছেলে রথীন্দ্র করে। সে বাপের ধারা পেয়েছে। সপরিবারে বড়দার ছায়ার তলায় কাটিয়ে দেবে জীবন। বিনয়েন্দ্র পেয়েছে ঠাকুরদার তেজ, বুদ্ধি, চেহারা। স্বভাব কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। মাথা অত্যন্ত ঠান্ডা, লক্ষ্য স্থির এবং অটল। একই সঙ্গে পরের জন্য ভাবে। গ্রামের লোক তাকে অন্যতম মুরুব্বি বলে মানে এখনও। বছর পাঁচেক আগে পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ছিল। নতুন ছেলে-ছোকরার হাতে দায়িত্ব দিয়ে স্বেচ্ছায় সরে এসেছে। স্কুলের চাকরি, টিউশান পড়ানো আর সংসার-ধর্ম নিয়ে আছে আপাতত। দু’বছর পরই চাকরি থেকে রিটায়ার করবে। বলেছে, তারপরই চাষের ব্যাপারে মন দেবে। জমি বাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। আলোআঁধারে হামেশাই দেখা দিচ্ছেন রাখালচন্দ্র মিশ্র। একসময় এই গোবিন্দপুরের গোটাটাই ছিল তাঁর নামে। নাতির ভূসম্পত্তি বৃদ্ধিতে তিনি নিশ্চয়ই খুব খুশি। কোঁচা লুটিয়ে হেঁটে যান খেতজমির আল ধরে। কখনও বা পায়চারি করেন কারও বাস্তুভিটেতে। বিনয়েন্দ্র হয়তো জমিটার বায়না দিয়ে রেখেছে। এই যেমন ক’দিন ধরেই বিনয়েন্দ্র ওকে দেখতে পাচ্ছে চণ্ডীদের উঠোনে। আজও দেখল। জমিটা একসময় শৈলজাদের অংশে ছিল। নিকুঞ্জ চণ্ডী কর্তাকে ঠকিয়ে আত্মস্থ করে। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কর্তা আপশোস করে গেছেন জমিটার জন্য। নিকুঞ্জ মারা গেল একমাস হল। তার ছোট ছেলে এসে বিনয়েন্দ্রকে সাধাসাধি, দাদা, জমিটা কিনে নাও। বড়দার মতো আমিও কলকাতায় গিয়ে ব্যাবসা করব।
বিনয়েন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে রাজি। নিকুঞ্জর ছেলে দাম ধার্য করল এক লাখ কুড়ি। চলতি দামের চেয়ে অনেক বেশি। কোনও পরোয়া নেই। বায়নার টাকা দিয়ে দিল বিনয়েন্দ্র। বাড়ির লোক অবাক। সামনে মিলির বিয়ে। পাত্র ইঞ্জিনিয়ার, ছেলেবাড়ির চাহিদা ভালই। নানান দিক থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে টাকা জড়ো করা হয়েছে। এখন এত খরচ করলে, বিয়েটা হবে কীভাবে? বিনয়েন্দ্রকে ব্যাপারটা খেয়াল করানো হল। সে বলল, লাল্টু এখন সরকারি চাকরি করে। আমার চিন্তা কী! ধার করব। লাল্টু তো পাশে আছে।
নাতি লাল্টু, নাতবউ শিখা আজ আসছে ভদ্রেশ্বর থেকে। বড়বউমা খবর দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। জমি কেনার ব্যাপারে তারা কী বলে দেখা যাক।
শৈলজা বোঝেন তাঁর বড়ছেলের রক্তে মিশে আছে ঠাকুরদার জমি কেনার নেশা। রাখালচন্দ্র বড় ভালবাসতেন জমিজমা। তাই এখনও মায়া কাটাতে পারেননি। ঘুরে বেড়ান গোবিন্দপুর জুড়ে। আশ্চর্যের কাণ্ডটা হল, তাঁকে কিন্তু বিনয়েন্দ্রই শুধু দেখতে পায়। বাড়ির আর কেউ পায় না। ব্যাপারটা নিয়ে তাই মাথা ঘামায় না বাড়ির লোক। বড়বউমা আড়ালে বলে, সব বুজরুকি। শৈলজা অতটা অবিশ্বাস করতে পারেন না ছেলেকে। নিয়মিত শ্বশুরমশাইয়ের খবর নেন বিনয়েন্দ্রর থেকে। এই দেখতে পাওয়ার ঘটনাটা গ্রামের লোক জানে না। এটা একান্ত মিশ্রবাড়ির গুহ্যব্যাপার।
পিছনের গ্রাম কাঁকরডাঙায় সূর্যদেব উঠে পড়েছেন। খালপাড়ের জঙ্গলটার কারণে দেখা যায় না। আকাশ এখন অনেক পরিষ্কার। বড় মাছরাঙা পাখি ডাক দিতে দিতে পাড়ি দিচ্ছে অন্য গ্রামে। জঙ্গলে পড়া দিনের প্রথম আলোর উদ্দেশে শৈলজা কপালে জোড়হাত ঠেকান। প্রার্থনা করেন, আজকের দিনটা যেন এবাড়ির পক্ষে শুভ, কল্যাণকর হয়।
বিকট হর্ন দিতে দিতে বাসটা দহিজুড়ি মোড়ে এসে থামল। কন্ডাক্টার প্যাসেঞ্জার ডাকছে, এগরা, কাঁথি, দিঘা…
সুরঞ্জন বাস থেকে নেমেই ছুটল ট্রেকারের দিকে। শিখার জন্য জায়গা রাখতে হবে। দুটি মেয়ে সমেত ছ’জন যাত্রী অবলীলায় সুরঞ্জনকে দৌড়ে হারিয়ে পৌঁছে গেল ট্রেকারের কাছে। জায়গা অবশ্য পেল সুরঞ্জন, সামনের দিকে হল না। ট্রেকারের পিছনের সিট। গাড়ি লাফাবে, কষ্ট হবে শিখার।
সিটে ব্যাগ, রুমাল দিয়ে দুটো জায়গা নির্দিষ্ট করে সুরঞ্জন বাসের দিকে তাকায়, নেমে এসেছে শিখা। হাসছে। আঁচল গুঁজছে কোমরে।
শিখার হাসির উত্তরে সুরঞ্জনও হাসে। শিখা আসলে মজা পেয়েছে সুরঞ্জনের এভাবে সিট দখলের হুটোপাটিতে। দেশের বাড়ির এরকম অনেক ব্যাপারেই শিখা নির্মল আমোদ উপভোগ করে। ও যে আদ্যন্ত শহরের মেয়ে।
অত দৌড়ে এই! ট্রেকারের কাছে এসে হাসিমুখে কটাক্ষ করে শিখা
। সবই প্র্যাকটিসের ব্যাপার, বুঝলে! নাও, উঠে পড়ো। বলল সুরঞ্জন।
মৌমাছির মতো ট্রেকারটাকে ঘিরে ফেলেছে প্যাসেঞ্জার। শিখা পাদানিতে উঠতে যাবে, কে যেন ডেকে উঠল, বউদিদি উঠোনি। ও লাল্টু, আমি আইসসি। মাস্টারবাবু পাঠিয়ে দিছন।
ট্রেকার ছেড়ে সরে এল শিখা। ভ্যানরিকশা এসে থেমেছে পাশে। হাঁপ ধরা গলায় এই রিকশাওলাই উঠতে বারণ করছিল। কালোঝুলো মানুষটাকে চেনা চেনা লাগল শিখার,
দুই
মনে করে উঠতে পারল না। ওঠা সম্ভবও নয়। তার শ্বশুরবাড়িতে ঘরের লোক বাদ দিয়ে সবসময় পনেরো-কুড়িজনের যাওয়া-আসা-থাকা-খাওয়া চলে, কেউই নিকট আত্মীয় নয়, চেহারাও বৈশিষ্ট্যহীন। কী করে রাখবে মনে!
সুরঞ্জন এখন থেকে লাল্টু হয়ে গেল। ভদ্রেশ্বরের পাড়ায় ওকে এই নামে কেউ চেনে না। বিষম উৎসাহ, উজ্জ্বল মুখ নিয়ে সুরঞ্জন ব্যাগ তুলে নিল সিট থেকে। বলল, চলে এসো শিখা। বাবা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
শ্বশুরমশাই এই নিয়ে দু’বার ভ্যানরিকশা পাঠালেন। বিয়ের পর প্রথম যখন শিখা এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে, তখন আর এবার। রিকশা সহজে পাওয়া যায় না, এতে মালপত্তর বওয়ার কাজই বেশি হয়। প্রথমবার রিকশায় ওঠার পর সুরঞ্জন বলেছিল, আধ-ঘোমটা মতো দিয়ে নাও। নয়তো গ্রামের লোকের চোখে লাগবে। নতুন বউ বলে কথা! বাড়িতে গিয়ে খুলে ফেলো। ওখানে এসব নিয়ে কেউ মাইন্ড করে না।
শিখা মেনেছিল রীতি, ভালই লেগেছিল ব্যাপারটা। ওদের গ্রামে ঢোকার মুখে গৃহস্থের উঠোন থেকে ভেসে এসেছিল উলুধ্বনি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল শিখার।
দহিজুড়ি থেকে ধুলাইয়ার মোড় চার কিলোমিটার রাস্তা। ট্রেকারে যেতে হয়। প্যাসেঞ্জারের চাপে দমবন্ধ হয়ে আসে শিখার। ধুলাইয়ার মোড়ে নেমে পায়ে হেঁটে আরও দেড় কিলোমিটার দূরত্বে শ্বশুরবাড়ি। গ্রামের শেষ বাড়ি সেটা। তারপর কেলেঘাই নদীর খাল। জায়গাটা ভারী মনোরম হলেও যাওয়ার পথটা বড় দুর্গম। প্রথমে তো ট্রেনেই লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা, তারপর বাস, ট্রেকার, হাঁটা…। এখানে আসার কথা উঠলেই গায়ে জ্বর এসে যায় শিখার। বাস থেকে নামার পর আজকের জার্নিটা যথেষ্ট আরামদায়ক হবে। এই যে বসল, নামবে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে। ধুলাইয়ার মোড় পর্যন্ত রাস্তা পাকা। দু’ধারে আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দিগন্তলীন খেত, গ্রামরেখা।
সুরঞ্জন মাসে, দু’মাসে একবার আসে। বিয়ের পর দু’বছরে শিখা এই নিয়ে চারবার আসছে। শিখার কম আসাতে শ্বশুরবাড়ির কারু কোনও অনুযোগ নেই। এরাই বরং মাঝেমধ্যে শিখাদের ভদ্রেশ্বরের ভাড়াবাড়িতে গিয়ে থাকে। সুরঞ্জনের মা, বোন, কাকিমা, কাকা, খুড়তুতো ভাই, ভাই-বউ, এমনকী ঠাকুমাও একবার গিয়ে পনেরোদিন থেকে এসেছেন। সুরঞ্জনের বাবা কখনও যাননি। বিয়ের সময়ও ছিলেন না। সেটা কোনও বিরাগ থেকে নয়, দেশের বাড়ি অন্যের দায়িত্বে রেখে যেতে চান না। সুরঞ্জনের বাবার কোনও গোঁড়ামি নেই। শিখা অব্রাহ্মণ, আপত্তি জানাননি এতটুকু। বাড়ির কারু ব্যবহারেই কোনও তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায় না। প্রেম এবং রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছে শিখারা, শ্বশুরমশাই মেনে নিয়েছেন সব, আক্ষেপ একটাই, ছেলের বিয়েতে গ্রামের লোককে খাওয়াতে পারলাম না। সেটাই এবার পুষিয়ে নেবেন মেয়ের বিয়েতে। দুপুরে খাবে পনেরোশো, রাতে দেড়শো বরযাত্রী এবং প্রতিবেশী, বাড়ির লোক মিলিয়ে তিনশো। এ ছাড়াও আছে দানসামগ্রী, বিয়ের আনুষঙ্গিক ব্যয়। যার অর্ধেকের বেশি জোগাতে হচ্ছে ছেলেকে। আসলে শিখাকে। সুরঞ্জন স্কুলের চাকরিটা পেয়েছে মাত্র ছ’মাস হল। তার আগের রোজগার বলতে টিউশনি। তাও হাজার দুয়েক টাকার। শিখার চাকরির ওপর নির্ভর করে ওদের বিয়ে। বয়স হয়ে যাচ্ছিল
শিখার। সুরঞ্জনের চাকরি হওয়াতে শিখা সবে সুখের দিনের গন্ধ পেতে শুরু করেছিল। ছোট থেকে অভাব ঘুরঘুর করেছে চারপাশে। নিজের চাকরি পাওয়ার পর অনেকদিন বাপের বাড়ির সংসার টেনেছে। এখন আর ও-বাড়ি নিয়ে ভাবতে হয় না। দাঁড়িয়ে গেছে ভাই। ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবছিল শিখা, দু’-চারটে দেখেও রেখেছে। সন্তান এবার না নিলেই নয়, বয়সটাই হয়তো অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এমন সময় ননদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। দেখাশোনা চলছিল অনেকদিন ধরেই। মিলিটা বড্ড রোগা বলে পাত্রপক্ষর পছন্দ হচ্ছিল না। মুখ-চোখ কিন্তু বেশ ভাল। রোগাটা মেকআপ দিতে গিয়ে উপযুক্ত পাত্রর জন্য খরচ প্রচুর বেড়ে গেল। পাত্র বিদেশি ফোন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। মেদিনীপুর টাউনে পৈতৃক দোতলা বাড়ি। ওরা মিলিকে পছন্দ করে যাওয়ায় বেশ অবাক হয়েছিল শিখা। ক্যাশ ডিমান্ড কিছু করেনি। সুরঞ্জন, শিখা গেল দেওয়া-থোওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে। দেশের বাড়ি থেকে সুরঞ্জনের বাবা, কাকা এসেছিলেন পাত্রর বাড়িতে। দানসামগ্রীর চাহিদা শুনে শিখার চোখ কপালে উঠেছিল, বক্সখাট, সোফাসেট, ড্রেসিং টেবিল, আলনা সব সেগুন কাঠের দিতে হবে। আলমারি, প্রণামীর তিরিশটা শাড়ি একেবারে এ-ক্লাস চাই। আর পনেরো ভরি সোনা। শুনতে শুনতে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল শিখার। সুরঞ্জনের বাবা সমস্ত ডিমান্ড অবলীলায় মেনে নিলেন। পাত্রর বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিখা সুরঞ্জনকে বলেছিল, বাবাকে আটকাও। এক ভরি সোনার দাম এখন কত জানো?,
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন শ্বশুরমশাইকে বলেছিল, বাবা, এর আগে যে-স্কুলমাস্টার পাত্রকে আমরা ক্যানসেল করলাম, তারা তো বাইক আর কুড়ি হাজার ক্যাশ চেয়েছিল। হিসেবমতো এই ছেলেটির থেকে বেশ কম। তখন তুমি ক্যানসেল করে দিলে, এর বেলায় রাজি হচ্ছ কেন? পনেরো ভরি সোনা মানে তো টুমাচ।
শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার পাত্রর তুলনায় কম। মাস্টার পাত্র থাকে গণ্ডগ্রামে, মাটির বাড়ি।
দিঘার বাস এসে গিয়েছিল। উঠে গেলেন বাবা, কাকা। শিখারা রিকশা ধরেছিল স্টেশন যাওয়ার জন্য। ফিরবে হাওড়া হয়ে ভদ্রেশ্বরে।
সোনার ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্য পরে লড়ে গিয়েছিল সুরঞ্জন। পাত্রর বাড়িতে ফোন করে ছ’ভরি কমিয়েছে। ওরা আরও পঞ্চাশ জন বরযাত্রী বাড়িয়েছে এবং বলেছে, খাওয়াটা যেন স্ট্যান্ডার্ড হয়। কতটা কী সাশ্রয় হল, এখনও বোঝা যাচ্ছে না। এরপর আবার গোদের ওপর বিষফোড়া, সুরঞ্জনের মা খবর পাঠিয়েছেন, এই সময় শ্বশুরমশাই কোনও একটা জমি কিনতে যাচ্ছেন। তার মানে ঘাটতি পোষাতে হবে শিখাদের। যা একেবারেই সম্ভব নয়। এইসব নিয়েই আজ শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে শিখা। বলা উচিত সুরঞ্জনের। সে বলেছে, বাবাকে বোঝানো আমার পক্ষে কঠিন। বিয়ের আড়ম্বর, তিনটে গ্রামের লোক খাওয়ানোর ইচ্ছে এমন আগ্রহভরে ব্যক্ত করবে, আমিও আবেগতাড়িত হয়ে পড়ব। কেননা, আমাদের পারিবারিক ইতিহাস, নিজেদের দেশগ্রামের সঙ্গে আমার অস্তিত্ব ভয়ংকরভাবে জড়িয়ে আছে। তুমি যেহেতু বাইরের, বাবার সঙ্গে লজিকাল আরগুমেন্টে যেতে পারবে।
অগত্যা সেটাই মেনে নিয়েছে শিখা। খরচ কমাতে না পারলে আবার লোন করতে হবে
ওদের। অলরেডি গয়নার জন্য দেড়লাখ হয়ে গেছে। এরপর যদি বাড়ে, সুরঞ্জনের গোটা স্যালারিটা চলে যাবে ধার শোধ করতে। ফ্ল্যাটের স্বপ্ন আগামী দশ বছরের জন্য ভুলতে হবে শিখাদের।
ওই দেখো শিখা, দারোগা পুকুর। সুরঞ্জন আঙুল তুলেছে।
তাকায় শিখা, রাস্তা থেকে খুব দূরে নয়, কাছেই। পুকুর না বলে দিঘি বলাই ভাল। দারোগা পুকুরের কথা বাসে আসার সময় শুনেছে শিখা। গল্পের ছলে শ্বশুরমশাইয়ের বিষয়সম্পত্তির খোঁজ নিচ্ছিল। আগে জানার প্রয়োজন পড়েনি। মিলির বিয়ের বেশির ভাগ দায় ঘাড়ে এসে পড়ার কারণেই এসব জানতে চাওয়া। নকশাল আমলে এক পুলিশ অফিসারকে খুন করে ওই পুকুরে ফেলা হয়েছিল। সেই থেকে নাম, দারোগা পুকুর। অঘটনের পরেই মালিক পুকুর এবং সংলগ্ন বিঘে পাঁচেক জমি বিক্রি করে দেশান্তরিত হতে চায়। জমি কিনতে আসে ভিন গাঁয়ের অর্থবান লোক। গ্রামের মানুষ চিন্তায় পড়ে যায় খুব। ধান চাষ, মাছ চাষের জন্য এই পুকুরের জলই তখন সম্বল। বাইরের লোক কিনে নিলে ব্যবহার করতে দেবে না। তখনকার দিনে এত পাম্পের চল হয়নি। শ্বশুরমশাই ধারধোর করে কিনে নিলেন দারোগা পুকুর সমেত জমি। ব্যবহার করতে দিলেন গ্রামের মানুষকে। সেই ধার শোধ হতে কুড়ি বছর লেগেছিল। এখন অবশ্য চাষিরা পুকুরের ওপর আগের মতো ডিপেন্ড করে না। জলের জোগান মেটায় শ্যালো পাম্প দিয়ে। সুরঞ্জন বাবার পরোপকারী স্বভাবটা বোঝাতে ঘটনাটা বলেছিল। দিঘিটা ক্রমশ পিছিয়ে যেতে যেতে একেবারে চোখের বাইরে চলে যাওয়ার পর শিখা এখন বলে, তোমাদের বাড়ি তো এখান থেকে অনেক দূর। বাবা এদিককার জমিগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন না কেন? এত দূর এসে চাষের কাজ দেখা তো সম্ভব নয়।
সুরঞ্জন হাসছে। দেশের বাড়ির হাওয়ায় আহ্লাদে লুটোপুটি খাচ্ছে ওর মাথার চুল। বলে, তা হলে তো হয়েই যেত। রাস্তার ধারে এই জমির দাম এখন তুঙ্গে। চাষের কারণে নয়, দোকানপাটের জন্য কিনবে লোকে। একটু থেমে রিকশাচালকের কাছে জানতে চায় সুরঞ্জন, দশরথ কাকা, রাস্তার ধারে এখানকার জমির দাম এখন কেমন?
তা ধরো গিয়ে ডেসিমেল প্রতি দেড়, দুই।
ভ্রূ জোড়া ঘনিষ্ঠ হয় শিখার। সুরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করে, ডেসিমেল বস্তুটি কী? একরের ভগ্নাংশ। এক ডেসিমেল দেড় কাঠার একটু কম বেশি। এসব গ্রামের হিসেব।
বিস্ফারিত চোখে শিখা জানতে চায়, দেড় দুই কি লাখের কথা বলল? সুরঞ্জন ফের হাসে। হাসিতে প্রচ্ছন্ন গর্ব। বলে, এত দামি জমি, অথচ আয় সামান্যই। ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্টের অর্ধেকও ওঠে না। আবার আঙুল তোলে সুরঞ্জন। বলে, ওই যে দেখছ দূরে সোনাঝুরি গাছে ঘেরা জায়গা, ওটাও আমাদের। এরকম বহু জমি এদিক ওদিক কিনে বসে আছে বাবা। চাষ দেখে না কোনওটারই। বাড়ির লাগোয়া জমিরও না। চাষিদের লিজে দেওয়া আছে। বর্গা হয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রতি বছর চাষের লোক বদলে দেয়।
বর্গাটর্গা ভাল বোঝে না শিখা। মূল কথায় আসতে চায়। বলে, এত জমি রেখে লাভটা কী হচ্ছে, যদি ব্যাঙ্কের সুদই না ওঠে!
সুরঞ্জন বলে, জমি কেনাটা বাবার একটা অদ্ভুত ঝোঁক। সব সময় খোঁজ নিয়ে বেড়াচ্ছে, কে কোথায় কী বেচছে। লাভের আশায় বাবা জমি কেনে না। এ ব্যাপারে নিজের ঠাকুরদার সঙ্গে বাবার খুব মিল।
সে তো তোমার ঠাকুরদার বাবার তিনটে বিয়ে, দুটো কেপ্ট ছিল। বাবা তো.…..
কী হচ্ছে কী! শিখার কথার মাঝে বাধা দেয় সুরঞ্জন। চোখের ইশারায় রিকশাচালক দশরথ কাকাকে দেখায়। অর্থাৎ একজন শুনছে। শিখা চাপা গলায় চোখ মটকে বলে, সবচেয়ে খারাপটা ইংরেজিতে বলেছি।
তাতে আরও বুঝবে। খারাপ ইংরেজিটা গ্রামে আগে ঢোকে।
চুপ করে যায় শিখা। আশপাশের মাঠ, জঙ্গল, জলায় চোখ রাখে। রোদ উঠে গেছে ভালই। মিষ্টি হাওয়াটার কারণে কষ্ট তেমন হচ্ছে না। নিজেদের জমি থেকে উঠে আসা হাওয়া আলাদা কোনও আরাম দেয়? তা হলে কেন কোনও লাভ ছাড়াই জমিগুলো কিনে রাখছেন সুরঞ্জনের বাবা! শিখা টের পায় তার মনের ভিতর পরিচিত সেই জেদ ধীরে ধীরে সংকল্পে পরিণত হচ্ছে। যে জেদের জোরে শত আর্থিক কষ্টের মধ্যেও সে কমার্সে মাস্টার্স করেছে। চাকরি পেয়েছে বিদেশি ব্যাঙ্কে। বিয়ে দিয়েছে বোনের। ভালবেসে বিয়ে করেছে প্রায় বেকার সুরঞ্জনকে। সেই প্রত্যয় সম্বল করে আজ বসবে শ্বশুরমশাইয়ের সামনে। খেয়ালের বশে কেনা অপ্রয়োজনীয় জমিগুলো বিক্রি করিয়ে ছাড়বে। কাল এই পথে ফেরার সময় যেন সুরঞ্জন বলতে না পারে, ওই দেখো শিখা, আমাদের দারোগা পুকুর।
ছেলে-বউমা আসবে বলে নাম ডেকে, আগেভাগে মিড ডে মিল খাইয়ে স্কুল ছুটি দিয়েছেন বিনয়েন্দ্র। প্রাইমারি স্কুলটা বাড়ি থেকে হাঁটা পথে তিন মিনিট। স্টাফ সাকুল্যে তিনজন। দু’জন শিক্ষক, একজন বেয়ারা। বিনয়েন্দ্র হেডস্যার।
বাড়ির সকলেরই দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে। দাওয়ার টেবিল চেয়ারে বিনয়েন্দ্র। বাকিরা ইতস্তত দাঁড়িয়ে এবং বেঞ্চ, তক্তপোশে বসেছে। সকাল বিকেল এখানেই টিউশান পড়ান বিনয়েন্দ্র। বেঞ্চ, তক্তপোশে বসে ছাত্র-ছাত্রীরা। ক্লাস টেন অবধি পড়ান। ছাত্র-ছাত্রীদের মাটিতে বসা পছন্দ করেন না। বিকেলে পড়ানো শেষ হলে, গ্রামের চাষিবাসিরা আসে। গল্প আড্ডা চা-বিস্কুট চলে। গ্রামঘরের সমস্ত খবরাখবর পান। নানা পরামর্শ দেন প্রয়োজনে। রাত ন’টা-দশটা অবধি দাওয়া গমগম করে। আজ দুপুরের পরিবেশটা কিন্তু থমথমে। মিলির বিয়ে নিয়ে কথা হবে। এটা একটা পারিবারিক মিটিং। অন্যসময় এই ধরনের জমায়েতে বিনয়েন্দ্ৰ একাই বলেন, বাকিরা সায় দেয় অথবা নীরব থাকে। আজ তা হবে না। বউমা আছে। সে এ বাড়িতে লালিত পালিত হয়নি। বিনয়েন্দ্রর ওপর শ্রদ্ধা থাকতে পারে, আনুগত্যের দাবি করা যায় না। সাম্প্রতিক বিনয়েন্দ্রর নেওয়া একটা সিদ্ধান্তে পরিবারের সদস্যরা খুশি নয়, তিনি টের পেয়েছেন। ছেলে বউমার হঠাৎ আগমনের হেতুও সেটাই। উঠোনে এক জোড়া চড়ুই
তিন
ধুলো ওড়াচ্ছে, সেই দিকে ঠায় চেয়ে থেকে মনটাকে বশে রেখেছেন বিনয়েন্দ্র। ছোটভাই রথীন্দ্র যথারীতি এটা সেটা বলে পরিস্থিতিটাকে নির্ভার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। দাদার মাথার ওপর আলাদা কোনও চাপ পড়ুক সে চায় না। সপরিবারে দাদার গলগ্রহ হয়ে আছে। দাদার ছায়াটাকেই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করে। বিয়ে সংক্রান্তই কথা বলছে সে এখন।
বুঝলি লাল্টু, একটা বৃষ্টি হয়ে গেলে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। মোরাম ফেলতে হবে আমাদের গলিটায়। বাকি রাস্তায় গ্রাম কমিটিকে বলব ফেলতে। বিনয়েন্দ্র মিশ্রর বাড়িতে বিয়া, কথা অমান্য করতে পারবে না ওরা। আর শোন, দুপুরে কিন্তু ফ্রায়েড রাইস থাকছে। গ্রামের বেশির ভাগ লোক কোনওদিন খায়নি। ওরা বলছে, আমরা না করলে, হয়তো ওদের আর ফ্রায়েড রাইস খাওয়াই হবে না।
বাবা! বউমার গলা। থেমে গেল রথীন্দ্র।
নড়েচড়ে বসে গাছপালায় চোখ রেখে বিনয়েন্দ্র বলেন, হ্যাঁ। অর্থাৎ শুনছি। চণ্ডীদের জমিটা কি এখন না কিনলেই নয়? সামনে এতবড় খরচ। হিসেব যা দাঁড়াচ্ছে চারলাখ ছাড়িয়ে যাবে।
প্রসঙ্গটা যে উঠবে বিনয়েন্দ্র জানতেন। উত্তর তাঁর সাজানোই আছে। বলতে থাকেন, এখন যদি না কেনা হয়, ও জমি পড়ে থাকবে না। কেউ না কেউ কিনে নেবে। ওটা তো একসময় আমার বাবার ছিল। দয়াল বর্মন একটা লরিকে ভাড়ায় খাটিয়ে বছর ঘুরতে আর একটা কিনে ফেলল। বাবা ঠিক করল লরির ব্যবসায় নামবে। সামান্য যা জমি ছিল, সব বিক্রি করে দেওয়া হল। তাতেও গাড়ির দাম উঠল না। নিকুঞ্জ চণ্ডী আমাদের প্রতিবেশী, বাবাকে বাকি টাকা ধার দিতে এগিয়ে এল। ধারের বদলে এখানে জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার চল। পুরোটাই বিশ্বাসের ওপর। দেনা শোধ হলেই ফেরত দেওয়া হয় জমি। নিকুঞ্জ চণ্ডী দিল না। মাটির বাড়িটুকু বাদে বাস্তুর সমস্ত জমিই বাবা নিকুঞ্জ চণ্ডীর নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছিল। লরির ব্যবসায় ফেল মেরেছিল বাবা। তৃতীয়বার সেই যে ভাড়া খাটতে গেল, আজও ফেরেনি লরি। তখনকার দিনে ইনশিয়োরেন্সের এত প্রচলন ছিল না। পুলিশও ঢিলেঢালা। পরে আমি কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রথমেই ধারের টাকা শোধ করে জমিটা নিতে যাই। টাকা তো নিলই না নিকুঞ্জকাকা, আমার মুখের ওপর বিচ্ছিরি ভাবে হেসেছিল। সেই অপমান আজও ভুলতে পারিনি আমি।
পরিবারের সদস্যরা চুপ করে বিনয়েন্দ্রর কথা শুনছে। যদিও শিখা বাদে এই কাহিনি তাদের সকলেরই শোনা। পাশের পুকুর থেকে উঠে আসছে হাঁসের ডাক। শিখা বলে, তা হলে আপনি অন্য কোনও প্লট বিক্রি করে এটা কিনে নিন। শুনলাম, ওই সব জমি থেকেও তেমন আয় হয় না।
বিনয়েন্দ্র বললেন, না, বউমা। জমি আমি এক ছটাকও বিক্রি করতে পারব না। একটা সময় আমরা কী খারাপ অবস্থার মধ্যে কাটিয়েছিলাম, ভাবতে পারবে না। গ্রামের লোক প্রায় ভুলতে বসেছিল, রাখাল মিশ্রর উত্তরপুরুষ আমরা। বাবা গ্রাম-মন্দিরের পুরোহিত হয়েও রান্নার ঠাকুরের কাজ করতে গেছে দূর-দূরান্তে। এ ছাড়াও করেছে অনেক ছোট
ছোট কাজ। ডাকাতদের মোট পর্যন্ত বয়েছে। কিন্তু আমার লেখাপড়া কখনও ছাড়ায়নি। গ্রামের লোক বলত, ছেলেকে রান্নার কাজে লাগিয়ে দাও। বাবা শোনেনি। সাধ ছিল ছেলে গ্র্যাজুয়েট হবে। গোবিন্দপুরের প্রথম স্নাতক। সে তো হল। দেশের মানুষ আমায় মাথায় নিয়ে ঘুরল গোটা গ্রাম। সাতাত্তরে গরিবের পার্টির প্রতিনিধি হয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতলাম। গরিব মানুষের দিন ফিরতে লাগল। স্কুলের চাকরিটা পেলাম। তারপর থেকে নিরন্তর বুদ্ধি খাটিয়ে, অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিল তিল করে জমি বাড়িয়েছি। আর্থিক লাভ তেমন না হলেও, আমার গ্রামের মানুষরাই তো খেটে যায় সেখানে। এটাও কম তৃপ্তির ব্যাপার নয়।
একটু নীরব থেকে শ্বশুরমশাইয়ের কথার আবেগটাকে থিতোতে দিল শিখা। তারপর বলল, দেখুন বাবা, আপনি ফ্রি ভাবে মতামত দেওয়ার সুযোগ দেন বলেই বলছি। অন্য কারু বেলায় হয়তো পারতাম না। আপনি সত্যিই গ্রামের মানুষের কথা ভেবে জমি কেনেন, নাকি ঠাকুরদার সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চান? শুনেছি, তাঁকে নাকি আপনি দেখতেও পান!
হেসে ফেললেন বিনয়েন্দ্র। বললেন, না, বউমা, ওটা যে আমার মনের ভুল, আমি নিজেও জানি। ঠাকুরদার সাম্রাজ্য বিস্তারের পদ্ধতিকেও সমর্থন করি না। উনি এসেছিলেন মেদিনীপুরের পূর্ব দিক থেকে, লোকে বলত, পুবের দেশ। তারা নাকি ভীষণ বুদ্ধিমান হয়। পশ্চিম অর্থাৎ এখানে তখন আদিবাসীদের বাস। ঠাকুরদা ছিলেন কবিরাজ, চিকিৎসায় সুনাম ছিল। আদিবাসীরা তাঁকে খুবই মান্য করত। বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নানা ছুতোনাতায় তিনি সহজ সরল নিরক্ষর মানুষগুলোর থেকে একে একে এলাকার সব জমিই নিয়ে নেন।
হয়তো অজান্তে, আপনি কিন্তু তাঁর পদাঙ্কই অনুসরণ করছেন। অধীশ্বর হয়ে উঠতে চাইছেন গোবিন্দপুরের। ঠাকুরদার মতো অসদুপায় নেননি বলে আপনার ইমেজ তাঁর থেকেও উজ্জ্বল।
এই প্রথম শিখার দিকে মুখ ফেরালেন বিনয়েন্দ্র, আন্দাজ করতে পারছেন, কোন বৈদগ্ধ্যের কাছে সমর্পিত হয়েছে তাঁর ছেলে। বউমার জন্য তাঁর গর্বিত হওয়া উচিত কি না বুঝে উঠতে পারছেন না। আপাতত বংশের মুখরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঠাকুরদার সঙ্গে আমার তুলনা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। তাঁর ভালমন্দ বিচার করা উচিত সেই সময়কালের নিরিখে। যেমন ধরো, আদিবাসীদের ঠকিয়ে জমি নিয়ে নিলেও, তাদের পুরোপুরি উৎখাত করেননি। বেহাত হওয়া জমিতে ওরাই চাষ করত। বিদেশ থেকে কৃষি-সংক্রান্ত বই আনিয়ে পড়তেন ঠাকুরদা। আদিবাসীদের উৎসাহিত করতেন নতুন নতুন চাষের জন্য। জনমজুর খাটলেও তাদের অবস্থা আগের তুলনায় ভাল হয়ে গিয়েছিল। জমি হারানোর আক্ষেপ ছিল না। এ বাড়িতে তখন প্রত্যেক পূর্ণিমায় গোপালপুজো হত (আঙুল দেখালেন উঠোনে)। গোটা গ্রামের লোক আসত খেতে। লক্ষ্মীপুজো হত ঘটা করে। বাবার মুখে সব শুনেছি। আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শেষদিকে ঠাকুরদার অবস্থা একেবারেই পড়ে গিয়েছিল। এলাকার পুরনো লোকজন এখনও বলে, ব্রাহ্মণ কবিরাজ বাড়ির ডাল গামছায় বেঁধে নিয়ে যাওয়া যেত। মানে ঘন হত এত। এমন কথাও লোককে বলতে শুনেছি, আমাদের বাড়ির পাকশালার ভিতর অবধি ঢুকে যেত পালকি। আমি অবশ্য অত বড় রন্ধনশালা ছোটবেলায়
দেখিনি, বন্যায় ভেঙে গিয়ে থাকবে। এখানকার জমিদারও রীতিমতো সমীহ করে চলতেন দাদুকে।
আচ্ছা বাবা, আপনি খেয়াল করে দেখেছেন, যে সময়ের কথা বলছেন, কলকাতায় তখন কত বড় বড় মনীষী, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, নীলরতন সরকার, এরকম অনেকে মিলে বাঙালি সমাজটাকে কী হারে সংস্কার করে চলেছেন। আর এখানে আপনার ঠাকুরদা মানুষকে ঠকিয়ে গ্রাস করছেন জমি। একের পর এক বিয়ে, এ ছাড়াও দু’জন….. বলেই হুঁশ ফেরে শিখার। শ্বশুরমশাইয়ের সামনে এতটা বলা উচিত হচ্ছে না।
বিনয়েন্দ্র কিন্তু নির্বিকার। বললেন, কলকাতার ঢেউ গ্রামের দিকে আসতে অনেক বছর লেগেছে। তখনকার দিনে গ্রামসমাজে এগুলোকে দোষ হিসেবে ধরা হত না। গৌরব মনে করা হত। তবে আমি ওঁর শঠতা এবং অমিতাচার জীবনযাপনকে অবশ্যই নিন্দের চোখে দেখি। ওসব গুণপনার শাস্তি উনি জীবদ্দশাতেই ভোগ করে গেছেন। শেষ দিকে জমি বিক্রি করে খেতেন। আমি ভালয়-মন্দয় কোনও দিনই ওঁর সমকক্ষ হতে চাই না, পারবও না। শুধু এই গ্রামে মিশ্র পরিবারের যে লোকমান্যতা ছিল, সেটা কিছুটা হলেও ফেরাতে আগ্রহী।
সামান্য অধৈর্যের গলায় শিখা বলে ওঠে, সেটা শুধু জমির মাধ্যমে কেন, আর কোনওভাবে ফেরানো যায় না? যেমন ধরুন, মায়ের তো গয়না বলতে কিছুই নেই। মিলির জন্য দেড় লাখ টাকার গয়নাই কিনতে হচ্ছে। জমির বদলে মা বা মিলির জন্য গয়না হল না কেন?
একটু থামে শিখা। দূর মাঠ থেকে ভেসে আসছে গোরুর অসহায় হাম্বা ডাক। গলা নামিয়ে শিখা বিনয়ের সঙ্গে বলে, কিছু মনে করবেন না বাবা। একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলতে বাধ্য হচ্ছি। শুনেছিলাম, মা যেহেতু শ্যামলা, ফরসাবাড়ির সুপুরুষের যোগ্য স্ত্রী হতে গা ভরতি গয়না নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো যে গেল, আর তো ফেরত এল না।
কঠিন সত্যটা বলতে পেরে নিজেই কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল শিখা। ভয়ে ভয়ে তাকাল সুরঞ্জনের দিকে। চোখ নামিয়ে নিল সুরঞ্জন। মাথা হেঁট করে আছে সবাই। একমাত্র শাশুড়ি মা পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখছেন স্বামীকে। শ্বশুরমশাইয়ের মুখ চোখের অবস্থা খুবই সঙ্গিন। ফরসা কান, গাল লাল হয়ে গেছে। পলকহীন তাকিয়ে রয়েছেন শূন্যে। প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন হয়তো।
মিলল না শিখার আন্দাজ। শ্বশুরমশাই ধাতস্থ হতে সময় নিলেন। বললেন, ঠিক আছে, বিয়ের জন্য যে টাকা জোগাড় হয়েছে, ওতে হাত দেব না। জমিটা কিনব ধার করে।
শিখা ছাড়বে না। কোণঠাসা যখন হয়েই পড়েছেন সুরঞ্জনের বাবা, জমি কেনার নেশাটা আজই কাটাতে হবে। শিখা বলে, আপনাদের এখানে ধার মানে তো মাসে ফাইভ পারসেন্ট সুদ। আপনার ছেলের কাছে একথাও শুনেছি। গ্রামের পুরুষরা তো বটেই, বউ মেয়েদেরও আপনার ওপর এতটাই বিশ্বাস, তাদের জমানো সামান্য টাকা সুদে বাড়বে বলে আপনাকে ধার নিতে সাধাসাধি করে। অনেক জমি আপনি এভাবেই কিনেছেন। তখন জিনিসপত্তরের দাম কম ছিল। এখন একলাখ কুড়ির মূল্য এবং সুদ গুনতে গেলে সংসার চলবে কী করে? আপনারা কষ্টে থাকলে, আমরাও কি ওখানে শান্তিতে থাকতে পারব? টাকা পাঠাতেই
হবে। চাপটা আলটিমেটলি থেকেই যাবে সবার ওপরে।
এতক্ষণে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল শ্বশুরমশাইয়ের। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিল ঠেলে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, এই সম্বন্ধটা তা হলে ক্যানসেল করে দাও। সস্তার পাত্র দেখো, যাদের এত চাহিদা নেই। অনেকেই এসেছে, আসবে।
দাওয়া থেকে নেমে উঠোন ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন সুরঞ্জনের বাবা। থামছেন না। বাড়ির সীমানা পেরিয়ে ঢুকে গেলেন বাঁশঝাড় মোড়া মাটির রাস্তায়।
চাপা কান্নার শব্দ ওঠে দাওয়াতে। সচকিত হয়ে ঘাড় ফেরায় শিখা। দেখে, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে শাশুড়ি-মা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কান্না আটকাতে। অপ্রতিভ হয়ে পড়ে শিখা, কেন কাঁদছেন উনি? স্বামীর অপমানে, নাকি মেয়ের বিয়ের অনিশ্চয়তায়? শিখা উঠে শাশুড়ির কাছে যায়। অপরাধী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, মা, কেন কাঁদছেন?
কান্না সামলাতে নাজেহাল শাশুড়ি-মা কাটা কাটা ভাবে যা বললেন, জড়ো করলে দাঁড়ায়, আনন্দে কাঁদছি। এতদিন পর একমাত্র তুমিই আমার বুকের কথা বলতে পেরেছ। শাশুড়ির মাথা কাঁধে নেয় শিখা। হাত বুলিয়ে দেয় পিঠে। গন্ধ পায় ন্যাপথলিন মাখা দুঃখের।
রাত নামল ভীরু পায়ে, ভীষণ নিশ্চুপে। দুপুরের মিটিং-এর পর থেকেই এ বাড়ির লোক কথা বলছেই না প্রায়। ভারী আবহাওয়াটা কীভাবে যেন টের পেয়ে সন্ধেবেলা গ্রামের লোকেরা গল্পগাছা করতে এল না। ইদানীং নাকি আড্ডার একটাই বিষয়, কীভাবে সুসম্পন্ন করা যায় মিলির বিয়ে। শিখার শ্বশুরমশাই ফিরলেন রাত করে। নিঃশব্দে খাওয়া দাওয়া সেরে নিজের ঘরে ঢুকে গেছেন। শিখার কিন্তু প্রত্যাশা ছিল শ্বশুরমশাই তার অকাট্য যুক্তিগুলো মেনে নেবেন। বাড়ি ফিরে বলবেন, থাক তা হলে। নিকুঞ্জ চণ্ডীর জমি কিনছি না। বিয়েটাই আগে।
এ সবের কোনও লক্ষণই দেখা গেল না। স্বাভাবিক কারণেই শিখা এখন খুব হতাশ। রাতের খাওয়া সেরে ওদের নির্দিষ্ট ঘরে শুয়েছে। চোখে ভাসছে মিলির মুখ, বেচারি আকুল আর্ত চাউনিতে বিকেল থেকে রাত লক্ষ করে গেছে দাদা-বউদিকে। আন্দাজ করার চেষ্টা করেছে বিয়ে নিয়ে শিখাদের সিদ্ধান্ত।
মিটিং-এর পর ও বিষয়ে শিখা আর সুরঞ্জনের মধ্যে আর কোনও কথা হয়নি। বউয়ের ঘুম আসছে না দেখে সুরঞ্জন এখন গভীর মনোযোগ সহকারে উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছে। আসলে ভান। বোনের বিয়ের ব্যাপারে মতামত দেওয়ার সাহস হচ্ছে না।
বিকেলে গ্রামের এদিক ওদিক শিখাকে নিয়ে গেছে সুরঞ্জন। বেছে বেছে সেই সব জায়গাতেই, যেখানে শ্বশুরমশাইয়ের কিছু না কিছু অবদান আছে। দেখাল, কেলেঘাই খালের ওপর বাঁশের সাঁকো। পিছনের গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের সংক্ষিপ্ত পথ। সাঁকোটা নিজের টাকায় করিয়েছেন শ্বশুরমশাই। মেনটেন্যান্সের খরচও তাঁর। নিয়ে গেল গ্রামের শ্মশানে, চত্বর ঘিরে প্রচুর সোনাঝুরি গাছ। প্রথম লাগিয়েছিলেন সুরঞ্জনের বাবা। পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণের কালচার তিনিই তৈরি করেছিলেন গ্রামে। বহু গাছ একসময় পোঁতা
হয়েছিল। এখন নিজের থেকেই হয়। ছোটগুলো রেখে কাটা হয় পরিণত গাছেদের। কাঠ বিক্রির টাকা গ্রামের উন্নতিকল্পে লাগে। এরকম অনেক কিছু দেখাল সুরঞ্জন— দাতব্য চিকিৎসালয়, বোল্ডার ফেলা রাস্তা, স্কুল বাড়ির সংস্কার। এসব কিছুর পিছনে শ্বশুরমশাইয়ের বিশেষ উদ্যোগ আছে। আসলে সারা বিকেল জুড়ে সুরঞ্জন প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল, তার বাবা ততটা খারাপ নয়, যতটা শিখা ভাবছে।
কিন্তু শিখা ভালমতোই বুঝে গেছে, গ্রামের প্রতি শ্বশুরমশাইয়ের এইসব অবদানের মূল উদ্দেশ্য মিশ্র পরিবারের প্রভাব বিস্তার।
সুরঞ্জনকে বেকায়দায় ফেলার জন্য শিখা ইচ্ছে করেই মিশ্রবংশের কালিমার দিকগুলো তুলে ধরছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, তোমার দাদুর বাবার আর সব বউ-সন্তানরা হারিয়ে গেল কোথায়? রক্ষিতাদেরই বা কী হল?
বিষম অনাগ্রহে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছিল সুরঞ্জন, দাদুর দুই সৎমায়ের একটি করে মেয়ে। তখনকার দিনে কন্যাসন্তানের পিতার সম্পত্তির ওপর আইনি অধিকার ছিল না। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই পর। শেষ বয়সে সেই মেয়েদের একজনের কাছে আশ্রয় নিতে হয়েছিল রাখালচন্দ্র মিশ্রকে। দাদু এবং তাঁর মা অনেক আগেই পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন রাখালচন্দ্রের অনাচারের সংসার থেকে। একজন রক্ষিতা রাখালচন্দ্রের অবস্থা পড়তেই পালিয়ে যায়। অন্যজন থেকে গিয়েছিল এখান থেকে দাদুর বাবা চলে যাওয়ার পরও। অনিচ্ছে সত্ত্বেও দাদু তার ভরণপোষণ করতেন। মহিলার তিনকুলে কেউ ছিল না। ঠাকুমার মুখে শুনেছি তার নাম ছিল জাহ্নবী।
শিখা বাড়ি ফিরেই সুরঞ্জনের ঠাকুমাকে ধরেছিল, দিদা, জাহ্নবীর সঙ্গে ভাব ছিল আপনার? কেচ্ছাকাহিনি বলেই গোড়ার দিকে মিচকি হেসে ফেলেন ঠাকুমা। তারপর বললেন সে মেয়েছেলেকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারতাম না। তোমাদের দাদুর ছিল দয়ার শরীর, জাহ্নবীকে থাকতে দিয়েছিলেন গোয়ালের পাশে একটেরে ঘরে। কী করত সারাদিন? জানতে চেয়েছিল শিখা।
ঠাকুমা বললেন, কী আবার করবে, বাড়ির নানারকম কাজ, ধান শুকানো, মুড়িভাজা, গোরু চরানো, উঠোন ঝাঁট দেওয়া। আমি পাকশালার বাইরে থালায় খাবার রেখে দিতাম, নিয়ে চলে যেত। কোনও কথাবার্তা নয়। শেষ দিকে মাথাটা একটু গোলমাল মতো হয়ে গিয়েছিল। শূন্যের দিকে তাকিয়ে গাল পাড়ত কাকে যেন! আমার মনে হয় তোমার শ্বশুরমশাইয়ের মতো জাহ্নবীও দেখতে পেত তাঁকে, মানে তোমাদের দাদুর বাবাকে।
আচ্ছা দিদা, উনি যখন একাধিক বিয়ে করলেনই, দু’জন রক্ষিতাকে বঞ্চিত করলেন কেন? জানতে চেয়েছিল শিখা। উত্তরে ঠাকুমা এই প্রথম নিজের শ্বশুরের পক্ষ নিলেন। বলেছিলেন, কী করে করবেন! দু’জনেই যে অব্রাহ্মণ। চোখে ধরেছিল বলেই নিয়ে এসেছিলেন।
আরও অনেক কিছুই বলে গেলেন সুরঞ্জনের ঠাকুমা। অন্যমনস্ক হয়ে দাওয়ায় বসে শেষ বিকেলের আলোয় নির্মল গ্রামচিত্র দেখছিল শিখা। কোথাও কোনও মালিন্য নেই। খাতার সাদা পাতার মতো। কে বলবে, এখানেই কত টানাপড়েনের ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে।
এখন রচনা হচ্ছে নতুন আখ্যান, যার একটি চরিত্র শিখা নিজে। কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই চরিত্র, তা অবশ্য জানে না।
কী হল, আজ কি সারারাত জেগে কাটিয়ে দেবে? আলতো করে বুকের ওপর উঠে এসে জিজ্ঞেস করল সুরঞ্জন।
খানিকটা ঘোর লাগা গলায় শিখা জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁগো, জাহ্নবীর যখন যৌবন ছিল, সে তো এই ভিটের ওপরই কোনও একটা ঘরে রাখাল মিশ্রর সঙ্গে শুত।
তাই তো হওয়ার কথা। এখানেই ছিল আমাদের পুরনো বাড়ি। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? না, আমি ভাবছিলাম, এই ঘরটাই সেই জায়গা নয় তো?
শিখা ঠিক কী মিন করতে চাইছে বুঝতে না পেরে সুরঞ্জন তাকিয়ে থাকে ওর মুখের
দিকে। তবে ভাবনাটা যে শুভ নয়, সেটা আন্দাজ করতে অসুবিধে হচ্ছে না। শিখা ফের বলে ওঠে, তখনকার দিনটাই ভাল ছিল, কী বলো? প্রচুর মৌজ মস্তি করে গেছে রাখালচন্দ্র মিশ্র, পাঁচটা মহিলার…
বউকে আদর করার ইচ্ছে হয়েছিল সুরঞ্জনের, সেই আশায় এখন ছাই। বলে ওঠে, তুমি ঘুমোবে? কাল সকাল বেলায় বেরোতে হবে কিন্তু।
বিছানা থেকেই হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচ অফ করে দেয় সুরঞ্জন।
ভোররাতে বৃষ্টি হয়ে গেল। ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে শিখার। এখন দ্রুত হাতে ব্যাগ গোছাচ্ছে। চৌকাঠে এসে দাঁড়াল মিলি। লতানে গাছের মতো ঠেসান দিল পাল্লায়। এমনিতেই রোগা শরীর, আরও যেন শীর্ণ লাগছে। সারারাত হয়তো ভাল করে ঘুমোয়নি। দুশ্চিন্তা করে গেছে নিজের বিয়ে নিয়ে।
কিছু বলবি? মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে শিখা।
আমি কিন্তু আর পাত্রপক্ষের সামনে বসতে পারব না বউদি। অনেক বসেছি। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
এরকম জেদের সুরে কথা বলে না মিলি। একটা মরিয়া ভাব আর তাড়াহুড়ো দেখা যাচ্ছে ওর মধ্যে। বারবার পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়ানোর অপমান থেকে কি পালাতে চাইছে মিলি? শিখা না নিয়ে গেলেও, ও পালাবেই। তেমন বুঝলে হয়তো জীবন ফেলে রেখে। নিজের প্রতি এই গ্লানি থেকে ওকে বার করে আনতেই হবে। মিলির কাছে যায় শিখা। কাঁধে হাত রেখে বলে, আমি নিয়ে যেতেই পারি তোকে। সাধ্যমতো জীবনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করব। মাঝপথে কিন্তু ফিরে আসতে পারবি না। মনে রাখিস, এখানে আসা মানেই, আবার দাঁড়িপাল্লায় উঠে পড়া। কী করবি ভেবে দেখ।
বৃষ্টি ভেজা উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে গোটা মিশ্র পরিবার। দশরথও এসে গেছে ভ্যানরিকশা
চার
নিয়ে। কিছুক্ষণ অন্তর হর্ন বাজিয়ে তাড়া দিচ্ছে। প্রণাম পর্ব চলছে এখন। মিলি তার দাদাবউদির সঙ্গে চলে যাচ্ছে। বাড়ির বউরা ঘোমটার আড়ালে লুকিয়েছে কষ্ট। পুরুষদের চেহারায় নিরুপায় ভাব।
মেয়ে চলে যাচ্ছে, ভেস্তে দিচ্ছে পাকা হয়ে থাকা সম্বন্ধ। বিনয়েন্দ্র স্ত্রীর থেকে শুনেছেন। মিলিকে ব্যাগ গোছাতে দেখে ওর মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কোথায় চললি? মেয়ে বলেছে, দাদা-বউদির ওখানে। আমার থেকে বাবার কাছে যখন জমি বড়, বাবা ওই নিয়ে থাক। ভাবতে বারণ কোরো আমার বিয়ে নিয়ে।
স্ত্রীর মারফত সব শুনে নিরুত্তাপ ছিলেন বিনয়েন্দ্র। যা দেখে মিলির মা বারবার বলছিল, কী হল, কিছু করো, তুমি এত চুপচাপ কেন?
মিলির মা লক্ষ করেনি, তখন চেয়ারে বসে থাকা বিনয়েন্দ্রর পা জোড়া টেবিলের তলার কাঠের ওপর ঘনঘন নড়ছিল।
সেই অস্থিরতা এখনও রয়ে গেছে, ভিজে উঠোনে ঠিকমতন যেন দাঁড়াতে পারছেন না বিনয়েন্দ্র। যথা সম্ভব নিজেকে দৃঢ়বদ্ধ রেখেছেন। ছেলে, বউমা প্রণাম সেরে গেছে। মেয়ে আসছে। লালটু শিখার মতো চটি পরে নয়, গ্রামের রীতি মেনে খালি পায়ে গুরুজনদের প্রণাম করছে মিলি। বিনয়েন্দ্রকে প্রণাম করে সামনে আর দাঁড়াল না, চলে যাচ্ছে। ভিজে মাটিতে ওর পায়ের ছাপ। বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে বিনয়েন্দ্রর, এই প্রথম তাঁদের ভিটেতে লক্ষ্মীর পা বাইরের দিকে আঁকা হল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না বিনয়েন্দ্র, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মেয়ের পায়ের ছাপ।
বউমা এসে দাঁড়াল সামনে। বলল, আপনার মতোই ভূমিহারা চাষিরা নিভৃতে তাদের জমির ওপর এসে চোখের জল ফেলে গেছে। আপনি, আপনার ঠাকুরদা কেউই দেখতে পাননি।
হেঁট করা মাথা ঘনঘন নাড়াচ্ছেন বিনয়েন্দ্র। বলছেন, মিলিকে নিয়ে যেয়ো না। বিয়ে এ বাড়িতেই হোক। জমির দরকার নেই আমার।
বিনয়েন্দ্রর কথা শুনে সকলে স্তম্ভিত। একটু পরেই বিস্ময় ও স্তব্ধতা ভেঙে আনন্দের হাসি ছড়িয়ে পড়ে সবার মুখে। শিখা বলে, মিলি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেছে। ক’টা দিন আমাদের ওখানে গিয়ে থাকুক। বিয়ের দু’-চারদিন আগে নিয়ে আসব।
বিনয়েন্দ্র মুখ তুলে দেখেন পুত্রবধূকে। দেখতে পান মেয়েটার হৃদয়, যেন বিঘের পর বিঘে ফসল ভরা জমি! অত জমি দখল করার সাধ্যি কার? বড়জোর আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে।
শারদীয় দেশ, ২০০৯