রক্ষক
সকাল আটটার রোদ, বরাদ্দ অনুযায়ী ‘মাতৃভূমি’ হাউসিং-এর প্রত্যেক ফ্ল্যাটে ঢুকে গেছে। এসেছে দুধের প্যাকেট, খবরের কাগজ। কাগজের হেড লাইন আর ছবি দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। উইক ডেজ-এ সকালের দিকে এতই কম সময় রাতুল সেনের হাতে। চাকরি করেন বহুজাতিক কোম্পানির উঁচু পদে। নিউজ পেপারের সঙ্গে সম্পর্ক এইটুকুই। বাড়িতে বাংলা, ইংরেজি দুটো কাগজ আসে। চা খেতে খেতে চোখ বুলিয়ে দৌড়ান বাথরুমে।
আজ চোখ আটকে গেছে বাংলা কাগজের খেলার পাতায়। খেলা নিয়ে আলাদা কোনও আগ্রহ নেই সেন সাহেবের। গুরুত্ব দেন আর পাঁচটা খবরের মতোই— কিন্তু আজ চোখ টেনে নিয়েছে একটা হাফ বাস্ট ছবি। খবরের হেডিং হচ্ছে ‘মোহনবাগানের বিজয় রথ থমকে দাঁড়াল’। নিউজটা সাম অফ করলে দাঁড়ায়, লিগের সবক’টা ম্যাচ, যার মধ্যে দু’বার ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে মোহনবাগান লিগ জয়ের দোরগোড়ায়, এমন সময় ড্র করে বসল সুপার ডিভিশনের নীচের সারির এক দলের সঙ্গে। সেই দলের গোলকিপার অসামান্য দক্ষতায় গোলে নেওয়া মোহনবাগানের প্রতিটি শট বাঁচিয়েছে। ছেলেটির নাম অরূপ বাগচী। খবরের মাঝে বেরিয়েছে তারই ছবি।
এরকম ঘটনা আগেও বহুবার ঘটেছে, সে অর্থে ঘটনাটার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। রাতুল সেন পড়েছেন অন্য সমস্যায়। এই ছবির ছেলেটিকে তাঁর ভীষণ চেনা লাগছে। এমনই চেনা যেন তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। অথচ ছেলেটিকে কিছুতেই প্লেস করতে পারছেন না। এমন নয় যে ছবির ছেলেটা অমুকের মতো, পার্টিকুলারলি এই ছেলেটাকেই তিনি চেনেন, সম্ভবত কথাবার্তাও হয়েছে। কিন্তু মনে করতে পারছেন না কেন? একই সঙ্গে এটাও ভাবা দরকার, যুবক বয়সের পর থেকে রাতুল সেনের সঙ্গে ফুটবলের কোনও যোগ নেই। তা প্রায় তিরিশ-বত্রিশ বছর হয়ে গেল। ফাস্ট ডিভিশনের অখ্যাত কম দামি দলের গোলকিপারকে চিনবেন কী করে?
প্লেয়ারটার নাম আরও দু’-চারবার পড়েন সেনসাহেব। একদম অচেনা। কিন্তু ছবিটা যেন তাঁর সঙ্গে কথা বলছে। ছেলেটাকে কি ডাকনামে চেনেন?
কী ব্যাপার, কী পড়ছ এত মন দিয়ে। পেপারটাকে একেবারে নাকে ঠেকিয়ে নিয়েছ? স্ত্রী রুমার গলায় চিন্তায় ছেদ পড়ে। রুমা আবার বলে, তাড়াতাড়ি ওঠো তোমার তো দেরি হয়ে যাবে।
রাতুল সেন মোটেই ব্যস্ত হলেন না। কাগজটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে রুমাকে বলেন এদিকে একবার এসো।
সকালের এই সময়টা রুমার নিশ্বাস ফেলার ফুরসত হয় না। কর্তা অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর ছেলে বেরোয় কলেজে। তবু রুমা আসেন কর্তার ডাকে। বলেন, কী হয়েছে বলো?
কাগজের ছবিটা দেখিয়ে রাতুল সেন বলেন, এই ছেলেটাকে ভীষণ চেনাচেনা লাগছে। তুমি কি মনে করতে পারছ?
ভ্রূ কুঁচকে রুমা ছবি আর খবরে চোখ বোলান। তারপর সবিস্ময়ে তাকান কর্তার দিকে, বলেন, একে আমরা চিনব কী করে। তুমি হয়তো অন্য কারু সঙ্গে গুলোেচ্ছ। কার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছি সেটা অন্তত বলো।
সে আমি কী করে বলব। বাইরে কত লোকের সঙ্গে ওঠাবসা করছ, আমি কি সবাইকে চিনি। বলে কিচেনের দিকে চলে যান রুমা। রাতুল সেন ফের কাগজটা মুখের কাছ নিয়ে আসেন। ছেলে অর্ক নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, বাবা এখনও পেপার নিয়ে বসে আছে। বাবার পড়া হয়ে গেলে তার পালা। সে লক্ষ করে বাবা আজ ইংরেজি কাগজটা ওলটাননি, যেমনকার তেমন ভাঁজ হয়ে পড়ে আছে সেন্টার টেবিলে। সোফায় এসে বসে
অর্ক। ইংলিশ পেপারটা তুলে নিয়ে বাবাকে বলে, কী হল তুমি আজ অফিসে যাবে না? ছবিটা থেকে এখনও চোখ সরাননি রাতুল সেন। কাগজ ঢাকা অবস্থায় ছেলেকে উত্তর দেন, যাব।
কী মনে হতে রাতুল সেন ছেলেকে ফের বলেন, তোর পেপারটার স্পোর্টস পেজ খোল তো।
কেন? অবাক হয়ে জানতে চায় অর্ক। ছেলেকেও গোলকিপারের ছবিটা দেখান রাতুল সেন। বলেন, দেখ তো ইংরেজি কাগজে বেরিয়েছে কি না?
অর্ক নিজের কাগজ খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে, প্লেয়ারটা কি তোমার চেনা?
চেনা চেনা লাগছে, ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না কোথায় দেখেছি।
অর্ক স্পোর্টস পেজ খুলে ওপর নীচ দেখে নিয়ে বলল নাঃ এ কাগজে বেরোয়নি। তবে নিউজটা দিয়েছে।
অন্যমনস্ক ভাবে বাংলা কাগজটা মুড়ে ছেলের দিকে এগিয়ে দেন রাতুল। ভাবেন বড় দলকে আটকে দেওয়া ব্যাপারটা বাঙালি সেন্টিমেন্টে বেশ নাড়া দেয়, সেইজন্যই বাংলা পেপারে ছেলেটার ছবি ঠাঁই পেয়েছে। ইংরেজি পড়ুয়ারা এসব আঞ্চলিক আবেগ পাত্তা দেয় না।
কিচেন থেকে ভেসে আসে রুমার গলা, খাবার কিন্তু রেডি। তুমিই লেট করছ। বেরোনোর সময় বাড়ি মাথায় তুলবে।
রাতুল মনে মনে হাসেন, খাবার বলতে দুটো স্যান্ডউইচ আর ফলের রস। রেডি করতে কতটুকুই বা সময় লাগে। লাঞ্চ করেন অফিসে। সেখানেও বড় সাহেবের খাবার মাপা। বেশি খেলে কাজের অযোগ্য হয়ে পড়বেন। এত রোজগারের মানে কী হল! রাতুল সেনের মনে পড়ে যুবক বয়সের কথা, খেলাধুলো করতেন, খেতেন রাক্ষসের মতো।
অর্ক কাগজের ওপর দিয়ে বাবার চিন্তান্বিত মুখ দেখে বলল, এত স্ট্রেস নিচ্ছ কেন? পরে
ঠিক মনে পড়বে। কাজের প্রেশারে থাকো একটা মেমরি স্লিপ করে যেতেই পারে।
অর্ক কী সূত্রে কথাটা বলছে, বুঝতে একটু সময় লাগে রাতুল সেনের। উনি চলে গিয়েছিলেন নিজের ইয়াং এজ-এ। ফেরত আসেন কাগজের ছবিটাতে। সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে ছেলেকে বলেন, ড্রাইভারকে ফোন করে দে গাড়িটা বের করে রাখুক। আমি ঝট করে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন রাতুল সেন। চোখ বুজে থাকার ফলে প্লেয়ারের ছবিটা যেন আরও ভেসে উঠছে মনে। হাফ বাস্ট ছবিটার এখন একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে ফেলেছেন কল্পনায়। এমনকী গতকালের খেলার মাঠেও চলে গেছেন। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন কী অসম্ভব দক্ষতায় অরূপ বাগচী মোহনবাগানের একের পর এক শট আটকে দিচ্ছে, ফিস্ট করে দিচ্ছে… দৃশ্যগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল পড়ে জীবনে যতটুকু ফুটবল খেলেছেন, বেশির ভাগ সময় গোলকিপিং করেছেন। বেলঘরিয়ার সেই পুরনো পাড়া, চড়কডাঙা মাঠ, বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে, কাগজের ছবিটার সঙ্গে কি রাতুলবাবুর নিজের মুখের মিল আছে? স্ত্রী এবং ছেলে এখনও সেটা টের পায়নি।
তড়িঘড়ি হাতে শাওয়ার বন্ধ করেন সেনসাহেব। বাথরুমের আয়নার সামনে জলে ভেজা মুখ নিয়ে দাঁড়ান। আয়নার মুখটা বড় আবছা, মিল খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা, নিজেকে চিনতেই বেশ অসুবিধে হয় রাতুল সেনের।
অফিসে এক ঘণ্টা হয়ে গেল। কাজে মন বসছে না। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাংলা কাগজটা ব্রিফকেসে নিয়ে রেখেছেন মি. সেন। গাড়িতে বসে সারাক্ষণ ভেবে গেছেন ছেলেটার কথা। কোথায় দেখেছেন? খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ছেলেটার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, আবার হবেও। কেন মনে করতে পারছি না, আমার ব্রেনের ক্ষমতা কি কমে আসছে? অচিরেই কি আমি আমার পদের অযোগ্য হয়ে পড়ব!— নিজেকে নিয়ে রীতিমতো অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকেন এক সময়ের মেধাবী ছাত্র রাতুল সেন। এই অসহায় অবস্থায় থেকে নিষ্কৃতি পেতে তিনি আশ্রয় নেন এক দার্শনিক যুক্তির, ফুটবলটা খুব মন দিয়ে খেলতেন রাতুল, গোলকিপার হিসেবে এলাকায় বেশ নাম হয়েছিল। একই সঙ্গে পড়াশোনাতেও ভীষণ ভাল ছিলেন। ব্রাইট ছেলে বলতে যা বোঝায় আর কী। একটা সময় এল যখন তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে খেলবেন নাকি পুরোপুরি পড়াশোনায় মন দেবেন? মধ্যবিত্ত সংসারের জোয়াল টানতে থাকা ক্লান্ত বাবা অসহায় কণ্ঠে পরামর্শ দিলেন, পড়াশোনাটাই মন দিয়ে কর। খেলে রোজগার করতে গেলে অনেক প্রতিভা লাগে।
বাবার কথা শিরোধার্য করলেন রাতুল। নিজের আদৌ খেলার প্রতিভা আছে কি না যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। লেখাপড়াটা কাজে লাগল। বাবা মা শেষ জীবনটা সুখে কাটিয়েছেন। ওঁরা গত হতে রাতুল উঠে এসেছেন কসবার নতুন ফ্ল্যাটে। খুবই ঝাঁ চকচকে কমপ্লেক্স। দামি এনক্লেভে বড়সড় ফ্ল্যাট নিয়েছেন রাতুল। মধ্যবিত্তের অভূতপূর্ব উত্থান। তবু কি মনের মধ্যে রয়ে গেছে কোনও অতৃপ্তি, আমি তো ভাল গোলকিপার হতে পারতাম। বড় দলকে আটকে দিলে কাগজে ছবি বের হত। যেন রূপকথার নায়ক! আজকের সুপ্রতিষ্ঠিত রাতুল সেন
হেরে গেছেন কাগজে ছবি বেরোনো গোলকিপারের কাছে। এই সব জটিল মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক কারণের জন্যই অরূপ বাগচীকে বড্ড চেনাচেনা লাগছে।
চেম্বারের পুশডোর ঠেলে ঢুকল অনির্বাণ। মি. সেনের পি এ। সদাব্যস্ত বসকে নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়েছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসে। সমীহ এবং আশঙ্কা মিশিয়ে জানতে চায়, এনিথিং রং স্যার, আপনি এভাবে বসে আছেন!
ম্লান হাসি হাসেন রাতুল। বস-এর মুখে অপরিচিত এক্সপ্রেশন দেখে খুবই অবাক হয় অনির্বাণ। সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নামায় টেবিলে, ডিরেক্টরদের পক্ষ থেকে কোনও বাঁশ দেওয়া নোট আসেনি তো? চোখ আটকে যায় বাংলা নিউজ পেপারটায়। যেটা এ টেবিলে মায় গোটা অফিসে বড় বেমানান।
বাংলা কাগজ দেখে আশ্চর্য হচ্ছ তো? বস-এর গলা শুনে মুখ তোলে অনির্বাণ, বিস্ময়টা লেগেই আছে চোখে, রাতুল সেন কাগজটা অনির্বাণের দিকে ঠেলে দিয়ে বলেন, বাংলা কাগজ পড়ো তুমি?
পড়ি, স্যার। বাড়িতে। বলে কাগজটাকে তুলে নেয় অনির্বাণ।
আজ খেলার পাতাটা দেখেছ?
চোখ বুলিয়েছি। কেন স্যার, কোনও স্পেশাল নিউজ আছে?
রাতুল সেন বলেন, খেলার পাতাটা খোলা আছে, দেখো তো স্পেশাল কিছু পাও কিনা।
খুঁটিয়ে খেলার পাতা দেখতে থাকে অনির্বাণ। একটু পরে বলে, কই স্যার, তেমন কিছু দেখলাম না।
সামান্য হতাশ দেখায় মি. সেনকে। বলেন, স্ট্রেঞ্জ। ছবি দিয়ে অত বড় খবরটা তোমার কিছুই মনে হল না। কোথাকার কোন অখ্যাত এক ছেলে কোটি টাকার টিমকে একা রুখে দিল, তুমি এতটুকু অবাক হলে না।
সেক্রেটারিশিপ পড়া অনির্বাণ ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বলছে, ইয়েস স্যার, সত্যিই এটা খুবই বড় খবর। এখনও বাঙালি ছেলেদের মধ্যে অনেক ভাল ফুটবলার আছে। কেন যে বড় ক্লাবগুলো বিদেশি প্লেয়ারদের পেছনে ছোটে একটু থামে অনির্বাণ। ফের বলে, আমি আসলে ভাবতে পারিনি আপনি খবরটাকে— এত গুরুত্ব দিচ্ছেন। খেলা নিয়ে আপনাকে কখনও কিছু বলতে… কথা থেমে যায় অনির্বাণের। বস-এর দৃষ্টি ঝুলছে শূন্যে! অনির্বাণের কোনও কথাই হয়তো শুনছেন না।
কাগজের পাতায় আর একবার চোখ বোলায় অনির্বাণ, চট করে একটা কথা মাথায় ক্লিক করে। জানতে চায় বস-এর কাছে, স্যার, এই অরূপ বাগচী কি আপনার কোনও রিলেটিভ অথবা এমনি খুব চেনা জানা?
যে কথাটা বলল না অনির্বাণ, সেটা হচ্ছে নিজের আত্মীয় গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে আপনার এত আক্ষেপ?
বস-এর গলায় কিন্তু অন্য সুর, সেটাই বড় মুশকিল হয়েছে, জানো অনির্বাণ। ছেলেটাকে
আমার ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। সকাল থেকে এই নিয়ে খুব ডিসটার্বড আছি।
মনে মনে প্রমাদ গোনে অনির্বাণ, বস-এর মুডটা মোটেই অফিস আওয়ারের পক্ষে উপযুক্ত নয়। বিনয় মিশিয়ে পরামর্শ দেয়, স্যার, এরকম তো সবার হয়। ধরুন কোনও একটা নাম, মনে পড়তে পড়তেও পড়ছে না। তখনকার মতন সেটা নিয়ে আর না ভাবাই উচিত। পরে একসময় ঠিক মনে পড়ে যাবে। আপনি সামনে থেকে পেপারটা তুলে রাখুন
তো। আজ সাড়ে চারটেয় ডিলার্সমিট। আপনাকে এক্ষুনি কম্পিউটার নিয়ে বসতে হবে।
ডিলারদের সঙ্গে মিটিং-এ বসে মি. সেন সারাক্ষণ ভেবে গেলেন ছেলেটার কথা। চেনাজানা পার্টিদের সঙ্গে ছেলেটার মুখটাও মেলানোর চেষ্টা করছিলেন, হয়তো ওদেরই কারুর আদলে মিশে আছে অরূপ বাগচী। তাই এত পরিচিত লাগছে। নিষ্ফল হয়েছে সেই প্রয়াস।
রাতুল সেন এখন নিজের গাড়িতে বাড়ি ফিরছেন। চেহারায় বিপুল ক্লান্তির ছাপ। পাশে বসে আছে অনির্বাণ। ওকে ড্রপ করে দেবেন বালিগঞ্জে। অনির্বাণও মনে মনে খুব আপসেট, মিটিংটা একদম জমেনি। বস অন্যমনস্ক ছিলেন। কোম্পানির বিজনেস ভাল মতোই হ্যাম্পার হবে।
সিটে এগিয়ে বসা রাতুল সেন জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। সন্ধে ওতরাতে দোকান বাজারের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। মুষড়ানো গলায় রাতুল বলে উঠল, তুমি আমার একটা কাজ করে দেবে অনির্বাণ?
কী কাজ স্যার?
ছেলেটার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে দেবে?
কোন ছেলেটার স্যার?
গোলকিপার। যার ছবি আজ কাগজে বেরিয়েছে। বিষম বিস্ময়ে অনির্বাণ বলে ওঠে, ও মাই গড, আপনি এখনও ছেলেটাকে ভুলতে পারেননি।
নিরুপায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন রাতুল সেন।
অনির্বাণ এবার বেশ সিরিয়াস হয়ে যায়। নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে বলে, স্যার একটা কথা বলব? সাজেশন ধরতে পারেন।
বলো।
আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে আপনার নার্ভের বিশ্রাম প্রয়োজন। কোম্পানির হাজারটা ঝামেলা সামলাতে হয় আপনাকে। কোনও একটা বিষয় নিয়ে ভেতরে ভেতরে টেনশনে আছেন, ওপর থেকে বুঝতে পারছেন না। আননোন অ্যাংজাইটি থেকে পালাতে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গোলকিপারকে নিয়ে।
রাতুল সেন মনে মনে তারিফ করেন পি. এ. র। সত্যি ইয়াং জেনারেশন এখন কত আপটুডেট, মনের গতি প্রকৃতির ওপর কী অগাধ জ্ঞান। জিজ্ঞেস করেন, আমার এখন তা হলে কী করা উচিত?
পেগ তিন চারেক যদি ড্রিঙ্ক করেন, অনেকটা রিল্যাক্স লাগবে।
রাতুল সেন ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন, সামনে কোনও বার দেখলে যেন গাড়ি দাঁড় করায়।
অনির্বাণের প্রেসক্রিপশনে কাজ হয়েছে। তবে ডোজ একটু বেশিই লাগল। এখন গোলকিপারের মুখ অনেকটাই আবছা, জলছবির মতন। নেশা উড়ে গেলে ছবিটা আবার ফিরে আসবে কিনা, জানেন না রাতুল সেন। আপাতত বেশ রিলিফ বোধ করছেন।
ওফ, গোলকিপারটা যেন ডাকটিকিটের মতো সেঁটে গিয়েছিল চেতনায়। কী যেন নাম ছেলেটার? মনে পড়ছে না দেখে ভারী নিশ্চিন্ত বোধ করেন রাতুল সেন।
অনেকদিন পর ফুল আউট হয়ে বাড়ি ফিরছেন রাতুল। ছেলে বড় হওয়ার পর থেকে হয়তো এই প্রথম। রুমা রাগারাগি করবে। কিন্তু কী আর করা যাবে। অনির্বাণ বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল, রাতুল রাজি হননি। অনির্বাণেরও যথেষ্ট নেশা হয়ে গেছে।
কখন যে কমপ্লেক্সের গেট পেরিয়ে গাড়িটা মি. সেনের এনক্লেভের সামনে দাঁড়িয়েছে টের পাননি। ড্রাইভার গেট খুলে অপেক্ষা করছে। অনেক কষ্টে সিট থেকে উঠে গাড়ির বাইরে আসেন রাতুল। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে হাঁটু মুড়ে যায়। ড্রাইভার ঝট করে সাহেবকে ধরে নিয়েছে। মনে মনে ড্রাইভারকে থ্যাঙ্কইউ বলেন রাতুল।
প্রায় পাঁচ দশ হাইট, ওজন চুরাশি কেজি, ড্রাইভারের ওপর পুরো শরীরটাই ছেড়ে দিয়েছেন সেনসাহেব। বেচারি অতিকষ্টে বাবুকে নিয়ে যাচ্ছে লিফটের দিকে। এমন সময় কে যেন এসে রাতুলের ভার ভাগ করে নিল। ডানদিকে ড্রাইভার, বাঁদিকে সহৃদয় কেউ। ঝাপসা চোখে লোকটাকে দেখেন মি. সেন যেন কারেন্ট লাগে। সেই গোলকিপার!
চকিতে ওর কাঁধ থেকে হাতটা তুলে নেন রাতুল সেন। সঙ্গে সঙ্গে টাল খান বেদম। না, তাঁর কোনও ভুল হচ্ছে না। এই সেই মুখ, অবিকল এক। ছেলেটার পরনে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক। কমপ্লেক্সের ভেপার ল্যাম্পের আলোতে সব কিছু স্পষ্ট। জড়ানো গলায়
মি. সেন ছেলেটিকে বলেন, তোমার আজ ছবি বেরিয়েছে কাগজে।
ছেলেটি কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আমার কেন ছবি বেরোবে স্যার।
তুমি কি ফুটবল খেলো?
না স্যার, আমি এই কমপ্লেক্সের সিকিউরিটিতে আছি।
ও, তা হলে এই ব্যাপার, তোমার সঙ্গেই আমি ছেলেটিকে গুলোচ্ছিলাম! আচ্ছা আমার আগে তোমাকে একথা কেউ বলেনি, মানে এই কমপ্লেক্সের কোনও লোক? না স্যার, কেউ তো কিছু বলেনি। সমস্ত টেনশন জল হয়ে নেমে যাচ্ছে রাতুল সেনের মাথা থেকে। এখন তিনি শুধু ড্রাইভারের সাহায্য নিয়েই এগিয়ে যেতে পারছেন লিফটের দিকে।
সিকিউরিটি গার্ড ফের গেটে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে ধিক্কার দেয় নিজেকে, কী দরকার ছিল বক্স ছেড়ে অতটা এগিয়ে যাওয়ার, আর একটু হলেই লোকটা গোল দিয়ে দিত। সত্যিই ভদ্রলোক ছাড়া এই কমপ্লেক্সের আর কেউ তাকে চিনতে পারেনি। সিকিউরিটি গার্ডের দিকে কেই বা মন দিয়ে তাকায়। তাকালে ক্ষতিই হত, অরূপ বাগচীকে নিয়ে সবাই নাচানাচি করলে, চাকরিটা খোয়াতে হত নিশ্চয়ই। এজেন্সি এত হাইফাই লোক রাখতে চায় না।
নিজের চাকরি নিয়ে অরূপের কোনও হীনম্মন্যতা নেই। সকালে ময়দানে প্র্যাকটিসে যায়, রাতে গেটপাহারা দেয়। এই ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে তাদের পাড়ার মাঠেই। বারপোস্ট কোথায় ছিল এখন ঠিক ঠাহর করতে পারে না। কমপ্লেক্সের গেটটাকে গোলপোস্ট ভেবে নিয়ে সারারাত একা পাহারা দেয়। এত ক’টা আধো জাগ্রত বিত্তবান মানুষের দায়িত্ব তার কাঁধে। এ কি কম বড় কথা!
নতুনপথ এইসময় শারদ ২০০৭