বনবাসী
লিলুয়ার একটা লেদ কারখানায় কাজ করে বাপি। হেভি খাটনি। ডিউটি শেষে যখন সাড়ে আটটার লোকাল ধরে, শরীরে হাড়গুলো আর হাড় থাকে না, রবারের পাইপ হয়ে যায়।
আজ শনিবার। বেশিরভাগ অফিসে হাফ ছুটি। ফাঁকা ছিল ট্রেন। বসার জায়গা পেয়েছে বাপি। চোখের পাতা লেগে গিয়েছিল। চারটে স্টেশন কখন পার হয়ে গেছে টের পায়নি। মল্লিকপুরের গন্ধ নাকে আসতেই বোধহয় জেগে ওঠে। তাড়াতাড়ি নেমে আসে ট্রেন থেকে।
ডেলি প্যাসেঞ্জার দৌড়োচ্ছে অটো ধরতে অথবা সাইকেল গ্যারেজে। বাপি হাঁটছে ঢিমে তালে। কী হবে জলদিবাজি করে, জগাদা বাবুগোছের লোকেদের সাইকেল ছাড়বে আগে। তারা সব কাছাকাছি থাকে। তারপর গ্রাম এলাকার, সব শেষে লঙ্কাডিঙির বাসিন্দা। উপেক্ষাটা সয়ে গেছে বাপির। তাদের এলাকার অনেকে অবশ্য এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে বসে। লাভ হয় না কিছু।
গ্যারেজে পৌঁছে একটা বিড়ি ধরায় বাপি। একে একে সব প্যাসেঞ্জার বেরিয়ে গেল। বাপির সাইকেল গড়িয়ে নিয়ে এল জগাদা। বলল, খবর শুনেছিস?
কী খবর? বিড়ি ফেলে উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চায় বাপি। প্রথমেই বাড়ির কথা মাথায় আসে। এতক্ষণ বাইরে থাকে, বউ-বাচ্চার কিছু হয়নি তো? তোদের বাবা ধরা পড়েছে।
কথাটার মধ্যে প্রচণ্ড খোঁচা আছে। এখন গায়ে লাগল না। বাপি জিজ্ঞেস করে, কোথায়, কখন?
মিলনী মাঠে ফাইনাল খেলা ছিল। ঘাপটি মেরে বসে ছিল সাপোর্টারদের মধ্যে। থানার নতুন অফিসার এসে ধরে।
রবার অবস্থা থেকে হাড়গুলো ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। অদ্ভুত একটা আনন্দ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। মনের ভাবটা মুখে আসতে দিচ্ছে না বাপি। জগাদার হাত থেকে সাইকেল নিয়ে উঠে বসে। জগাদা ফের বলে, ক’টা দিন তোদের এলাকায় প্রচুর ঝামেলা হবে। প্রায়ই রেড করবে পুলিশ। নতুন অফিসারটা হেভি ডেসপারেট।
প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগিয়ে যায় বাপি। পুলিশ যত ইচ্ছে রেড করুক। সব থেকে বড় কথা, ভজন ধরা পড়েছে। মারাত্মক গুন্ডা। হয়তো কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্তু ধস খেয়ে থাকবে কয়েক মাস। ভজন বাপিদের এলাকার বাবা। স্টেশন এলাকার দাদা। গ্রাম সাইডে কাকা। মল্লিকপুর জায়গাটা অদ্ভুত, সাইকেলে মেন রাস্তা ধরে এগোলে তিন মিনিটে
শহর শেষ। আরও মিনিট চারেক মফসল। দু’মিনিট পরেই ফুরিয়ে যায় গ্রাম। তারপর বনজঙ্গল, জলা জায়গা। আরও দূরে হাইওয়ে। ওপারে সূর্য অস্ত যায়।
বাপি থাকে লঙ্কাডিঙিতে। জলার মধ্যে একটা দ্বীপ। পঁচিশ ঘরের বাস। মেন রাস্তার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে বাঁশের সাঁকো। বাপিরা ভোট দেয়। তবু এক ধরনের অবহেলা পেয়ে থাকে ডাঙার মানুষের কাছে। তার অবশ্য অনেক কারণও আছে। বাপির পৈতৃক ভিটে স্টেশন থেকে দু’মিনিট। রাস্তার গায়েই। সাইকেল চালিয়ে এসে পড়েছে বাড়িটার সামনে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখে, তার ছোটবেলার তিনতলার প্রাসাদ। জানলা গলে উথলে পড়ছে সাদা আলো। নীচের তলায় দুটো দোকানঘর। সিমেন্টের ডিলার বড়দা। মেজদার ওষুধের দোকান। দুই দাদাকে মাথা নিচু করে খদ্দের সামলাতে দেখল বাপি। দাদারা ছোটভাইকে দেখতে পেল না। ওরা বোধহয় জানে না ভজন ধরা পড়ার খবরটা। এত বড় ঘটনা, মল্লিকপুরের সবারই এই নিয়ে আলোচনায় মেতে থাকার কথা। বড়দাকে আজ অবিকল বাবার মতো লাগল। টাক পড়েছে মাথায়। বাবার টাক এত চকচক করত না। বিজনেসটার যথেষ্ট উন্নতি করেছে বড়দা।
মফস্সলে এসেও ‘ভজন’ ধরা পড়ার কোনও আভাস পাওয়া গেল না। কোথাও কোনও ছোটখাটো জটলা নেই। স্বাভাবিক গতিতে চলছে সব কিছু। ভজন ছিল এলাকার ত্রাস। তোলা আদায়, খুন, বোমাবাজিতে জানান দিয়ে রাখত তার অস্তিত্ব। ওর মস্তানির ঝাঁঝে বহু ভদ্রলোক বাড়ি বেচে দিয়ে চলে গেছে। নতুন লোক আসতে ভয় পায়। ভজন না থাকলে এখানকার ব্যবসায়ীরা আরও উন্নতি করতে পারত। ওকে সরিয়ে দেওয়ার মতো গুন্ডা এলাকায় তৈরি হল না, হবেও না। রাসু মস্তানকে খুন করে সেই যে মল্লিকপুরের দখল নিয়েছে, মারা না যাওয়া অবধি তার অবসান নেই। লোকাল নেতা থেকে শুরু করে ভজন চ্যানেল ফিট করে ফেলেছে মন্ত্রী পর্যন্ত। পার্টিকে জেতানোর দায়িত্ব তার। তবু পুলিশ তাকে কেন ধরল বোঝা যাচ্ছে না!
গ্রাম এলাকায় এসে পড়েছে বাপি৷ লাইটপোস্টের নজরদারি শেষ। গৃহস্থবাড়ির ইলেকট্রিক আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। স্কুল পড়ুয়ার গলা ভেসে আসছে। হুস করে একটা অটো বেরিয়ে গেল। পেছনে ভ্যানরিকশা। দূরে সেবাসদনের দালানে এখনও রুগির ভিড়। কোনও ছন্দপতন নেই। জগাদার খবরটা কি উড়ো? বছর দুয়েক আগে পেটি কেসে ভজনকে দু’বার ধরেছিল পুলিশ। ভজনের তখন রাজনৈতিক পার্টির সঙ্গে ভাব ভালবাসা শুরু হয়েছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ভজনের ছেলেরা এলাকা সরগরম করে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছিল তাকে। আজ ছেলেগুলোকেও দেখা যাচ্ছে না। জগাদা কি ঢপ মারল? বলছিল পুলিশ অফিসারটা হেভি সাহসী… আলো জ্বলে ওঠা মনটা ক্রমশ নিভে আসছে বাপির। ঠিক লঙ্কাডিঙির অন্ধকারের মতো। ওখানে কারেন্ট যায়নি। ভজনই দেয়নি যেতে। বড়সড় অপরাধ করে এসে ভজন লঙ্কাডিঙিতে আত্মগোপন করে থাকে। একবার তো বাঁশের সাঁকোটাও ভেঙে দিয়েছিল। দ্বীপের লোকেরা তালডোঙায় চেপে পার হত জলা। ভজনের মুখের ওপর কেউ কিছু বলতে পারে না। ভজন লঙ্কাডিঙির বাপ।
নিজের বাবা খেদিয়ে দেওয়ার পর বাপি ঠাঁই নিয়েছিল লঙ্কাডিঙিতে। তখন এলাকার এত
বদনাম ছিল না। জমি জবরদখল করে পল্লি। গরিব গুরবোর বাস। প্রধান পেশা মাছধরা। সব পরিবার বাঙাল। ঝাল খেত বেশি। নাম হয়ে গেল লঙ্কাডিঙি। ঝালটা যে কত অসহনীয় দ্বীপের পঁচিশঘর এখন হাড়ে হাড়ে টের পায়।
ভজন যদি সত্যিই ধরা পড়ে থাকে, বাপিদের পাড়ায় তার একটা প্রভাব পড়বেই। অন্য এলাকার মতো উদাসীন হয়ে থাকবে না মানুষজন।
বাঁশের পোলের সামনে এসে সাইকেল থেকে নামল বাপি। ওপারে অন্ধকার। চালাবাড়িগুলো থেকে উঁকি মারছে লণ্ঠন, টেমির আলো। যেন লঙ্কাডিঙির চোখ। কী ভিতু ভিতু চাউনি! গাছপালার ওপর দিকটা বেশ পরিষ্কার। সেজেগুজে চাঁদ উঠেছে আকাশে। সাঁকোর ওপর দিয়ে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মচমচ শব্দ ওঠে। সাঁকোটা যেন বলে, তাড়াতাড়ি বাড়ি যা, বউ ছেলে পথ চেয়ে আছে।
বাড়ি ঢোকার আগে এলাকার কারও সঙ্গে দেখা হওয়া জরুরি। জগাদার খবরটার সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে। কাঁচা রাস্তায় এসে সাইকেলে উঠে বসে বাপি৷ একটাও মানুষ চোখে পড়ছে না। খানিক দূরে সুবোধদার দোকান খোলা রয়েছে এখনও। লঙ্কাডিঙিতে ওই একটাই দোকান। যাবতীয় জিনিস পাওয়া যায়, এমনকী খবরও। সেটা ফাউ। দোকান গুছোচ্ছিল সুবোধদা। সাইকেল থেকে নেমে দুটো সিগারেট চায় বাপি৷ গোটা প্যাকেট কখনও কেনে না। বড়লোক বাড়িতে মানুষ হওয়ার স্মারক, সারা দিনে দুটো সিগারেট। বাকিটা বিড়িতেই চালিয়ে নেয়।
সুবোধদা সিগারেট দিল। কিন্তু ভজনের খবর দিল না। খোঁচাতেই হয় বাপিকে, হ্যাঁগো, শুনলাম ভজনকে পুলিশে ধরেছে, খবরটা সত্যি?
সত্যি। এবার মনে হয় সহজে ছাড়বেও না।
লম্ফের আলোর মতো দপ করে ওঠে মন। ভ্রূ কুঁচকে বাপি জিজ্ঞেস করে, কেন এ কথা বলছ?
কেউ শোনার নেই। তবু একটু চাপা গলায় সুবোধদা বলে, ধরেছে দুপুরে। থানাতেই আছে। কাল আবার রবিবার। সোমবারের আগে কোর্টে তুলবে না। ভজনের চ্যালারা সব মল্লিকপুর ছেড়ে হাওয়া। বেছে বেছে তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে পুলিশ অফিসার। নতুন এসেছে থানায়। শুনছি ভীষণ মাথা গরমে লোক। চামচেগুলোর বাড়ি গিয়ে বিরাট হম্বিতম্বি করছে। জগাদার খবরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। মনে মনে পুলিশ অফিসারকে বাহবা দেয় বাপি। থানায় গিয়ে একবার চেহারাটা দেখে আসলে হত। সেয়ানে সেয়ানে লেগে গেছে মনে হচ্ছে। মুখ থেকে অজান্তে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে যায়, কী নাম অফিসারের? সুকল্যাণ রায়। যে-কোনও সময় আমাদের এখানে ধরপাকড় করতে আসতে পারে। একটু সজাগ থাকিস। ভজনের চ্যালাদের তো পাবে না। দেখা গেল তোদের মতো ইয়াং ছেলেদের তুলে নিচ্ছে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলছিল বাপি, পকেটে রেখে দোকানের সামনে থেকে সরে এল। সাইকেলে আর উঠল না। গড়িয়ে নিয়ে চলল বাড়ির দিকে। পুলিশ তাকে ধরবে কি না, সেই নিয়ে কোনও চিন্তা হচ্ছে না। ধরলে ধরবে। থানা-পুলিশের ব্যাপারে লঙ্কাডিঙির
লোকেদের কোনও আড়ষ্টতা নেই। মেন যেটা চিন্তার, ভজন কতদিনের জন্য ভেতরে গেল? চামচেরা উধাও মানে, বড় কিছু একটা ঘটেছে। মল্লিকপুর জুড়ে নাড়াচাড়া ফেলেছে সুকল্যাণ রায়। নামটা বেশ! আহা, লোকটা নিজের নাম সার্থক করুক। বড় অপমানে, গ্লানিতে দিন কাটে লঙ্কাডিঙির বাসিন্দাদের। মল্লিকপুরের সবাই বলাবলি করে, লঙ্কাডিঙি হচ্ছে ভজনের বিছানা। ইচ্ছেমতো এর তার ঘরে ঢুকে যায়। অন্যের বউ, বোনের সঙ্গে শোয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় তাদের স্বামী, বাবা-দাদারা।
এই গুজবের কিছুটা সত্যতা আছে। কয়েকটা বাড়িতে ভজন নিয়মিত মেহফিল বসায়। যেসব মেয়ের সঙ্গে শোয়, তাদের একটা নামও দেওয়া হয়েছে, পাগলি। সেসব বাড়ির পুরুষেরা ভজনের দলের একনিষ্ঠ সদস্য। ওদের জন্যই লঙ্কাডিঙির এত বদনাম। ডাঙার মানুষরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। জগাদা সব থেকে দেরিতে সাইকেল দেয়।
বাপি যখন প্রথম লঙ্কাডিঙিতে আসে, কত সুন্দর ছিল জায়গাটা। গাছপালা ঘেরা শান্ত ছোট্ট দ্বীপ। উঠোন নিকানো পরিপাটি কুঁড়েঘর। হাঁস, মুরগি, ছাগল চরে বেড়াত নির্বিবাদে। এখন তো ভজনের চ্যালারা ইচ্ছেমতো সেগুলো তুলে নেয়। জেনারেটর চালিয়ে রাতভর ফিস্ট করে। জাম্বো স্পিকারে গান বাজে, মাল খায়। শিয়ালদের সঙ্গে কম্পিটিশন করে ধুয়ো তোলে। লঙ্কাডিঙিতে ইলেকট্রিক না থাকলেও, একসময় বাসিন্দাদের মুখে উজ্জ্বল হাসি ছিল। এখন দিনের বেলাটাকেও কেমন যেন অন্ধকার মতো লাগে। ভজনই বিষিয়ে দিল এলাকাটা। রবরবা যত বাড়তে থাকল ভজনের, বাড়িয়ে দিল লঙ্কাডিঙিতে থাকার মেয়াদ। বোমা, বন্দুক সবই এখানে। এলাকার গরিব লোকগুলো বিপদ না বুঝেই মিশে গেল ওর দলে। ভদ্রলোকেরা মল্লিকপুরের মানচিত্র থেকে ছেঁটে দিল লঙ্কাডিঙিকে।
একটা ব্যাপারে ভজনের সঙ্গে বাপির খুব মিল। দু’জনেই মল্লিকপুর শহর এলাকার ছেলে। অমিল হল, বাপি নিজের বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা খেয়ে এখানে সংসার পেতেছে। ভজনের ঘর-সংসার বউ-বাচ্চা শহরেই আছে। লঙ্কাডিঙি ওর প্রমোদকানন। শালা, কোন স্কুলে পড়াশোনা করেছে, কে জানে! হয়তো বাপিদের স্কুলেই। এমন বিষধর হয়ে উঠবে, তখন বোঝা যায়নি।
একই এলাকার প্রায় সমবয়সি দুটো মানুষের মধ্যে এত তফাত হয় কী করে, ভগবান জানেন! এক্সট্রা কী আছে ভজনের? তিনটে হাতও নেই, চোখ সেই দুটো। আছে শুধু সাহস। সেটা এমন একটা অদৃশ্য বস্তু, ঠিক বাগে আনা যায় না।
সাহস যদি থাকত বাপির, বাবা, দাদারা কি এভাবে বঞ্চিত করতে পারত? বাপির দোষ বলতে, নিচু ঘরের কলোনির মেয়েকে বিয়ে করেছে। বাড়িতে ঢুকতে দিল না বাবা। অথচ বড়বউদি নিজেমুখে স্বীকার করেছে, স্বপ্না বাড়ির দুই বউয়ের থেকেই অনেক সুন্দর। এমনকী বাপির বোনেদের থেকেও।
তিন ভাই, তিন বোন বাপিরা। বাপি সবার ছোট। ও যখন ক্লাস ফোর, মা মারা গেল। মানুষ হয়েছে দিদিদের কাছে। এক এক করে বিয়ে হল দিদিদের। বাপি ছিল বড়বউদির জিম্মায়। বিজনেসে সদা ব্যস্ত বাবার কোনও লক্ষ ছিল না ছোট ছেলের প্রতি। হায়ার সেকেন্ডারিতে ব্যাক পেয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিল বাপি। বাড়ির কারও তাতে হেলদোল
নেই। একটা ছেলেকে ঘরে বসিয়ে খাওয়ানোর সামর্থ্য তাদের আছে। ফলে যা হয়, আঠেরো-উনিশ বছর থেকে ‘আড্ডা’ বাপির ধ্যানজ্ঞান। বড়বউদির প্রশ্রয়ে হাতে কিছু পয়সাও থাকত। বাপির তখন সবথেকে কাছের বন্ধু তপা। রেলপাড়ের বস্তিতে ওদের বাড়ি। বড়লোকের বখা ছেলের একটা গরিব ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকবেই। তপারা গরিব হলেও ছোটলোক ছিল না। বাড়ির সব মেম্বার কিছু না কিছু রোজগার করত। ক্লাস সেভেন অবধি পড়ে তপার বোন স্বপ্না ঢুকেছিল টিপ কারখানায়। ওদের বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে কবে থেকে যেন প্রেম হয়ে গেল স্বপ্নার সঙ্গে। তপা সোনার কাজ শিখে বম্বে পাড়ি দিয়েছে। কাকা-কাকিমা বুঝে গেছে, বাপি-স্বপ্নার সম্পর্কটা বিয়ে অবধি গড়াবে। তপার বাবা পোড় খাওয়া লোক। বড়লোকের বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলে, মেয়ে সুখী হবে না, ভাল করেই জানত। তাই বাপিকে অফার দেয়, আমার কারখানায় চলো, তোমায় কাজ শেখাব।
তপার বাবা বাপির হাতের কাজের গুরু। নামকরা অভিজ্ঞ ফিটার। বেলুড়ের এক কারখানায় কাজ করত। বাপি সেখানে বেশিদিন থাকেনি। শ্বশুর, জামাই এক কারখানায় কাজ করা ভাল দেখায় না। লিলুয়ার কারখানার চাকরিটা বাপি নিজেই জোগাড় করেছিল। স্বপ্না চাপ দিতে থাকল বিয়ের জন্য। সব ধরনের সম্পর্কই তখন ওর সঙ্গে হয়ে গেছে। এ বিয়ে, বাড়িতে মেনে নেবে না বাপি জানত। আলাদা থাকার কথাও ভাবতে পারছে না। পাকা বাড়ির আরাম ভোলে কী করে! বড়বউদিকে গিয়ে গোটা ব্যাপারটা বলল। বউদি ভালমানুষ। পরামর্শ দেয়, একেবারে বিয়ে করে এনে তোলো। ফেলতে পারবেন না বাবা। কালীঘাটে বিয়ে করে স্বপ্নাকে নিয়ে বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল বাপি। কেউ বরণ করতে এল না। বাবার কড়া নির্দেশ, নিচু জাতের বস্তির মেয়েকে কিছুতেই ঘরে তোলা যাবে না। পাশেই ছোটবেলার বন্ধু সুশান্তর বাড়ি। ওদের বাড়িতে বউ নিয়ে একরাত কাটাল বাপি। সুশান্তই খবর জোগাড় করল, লঙ্কাডিঙিতে সস্তায় গোটা বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। দিন যেতে বাপি সে বাড়ি কিনে নিয়েছে। একটা বিষয়ে অন্তত সে দাদাদের থেকে
এগিয়ে রইল, নিজের রোজগারে বাড়ি হল একটা। ছেলের আঁতুড় হল এখানেই। একদু’বার বড়বউদির সঙ্গে দেখা হয়েছে রাস্তায়। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদেছে বউদি। একবার বলেছিল, আমার জন্যই লঙ্কাপুরীতে থাকতে হচ্ছে তোমাদের।
ভুল শুধরে বাপি বলেছে, লঙ্কাপুরী নয়, লঙ্কাডিঙি।
ওই একই হল। বলে, বাপিকে দেড়শো টাকা দেয়। বলে, বাচ্চাটার জন্য দিলাম। একদিন গিয়ে মুখ দেখে আসব। আসা হয়ে ওঠেনি বউদির। লঙ্কাডিঙির বদনামের কারণেই হয়তো এড়িয়ে গেছে।
বাবা মারা যাওয়ার পর কিছু একটা বন্দোবস্ত হবে ভেবেছিল বাপি। সম্পত্তির ছাঁটকাট নিশ্চয়ই পাবে। মৃত্যুর খবর শুনে গিয়েছিল শ্মশানে। বডি পুড়ে যাওয়ার পর বড় দুই ভাইয়ের মতো গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে কাছা নিতে যাচ্ছিল, বড়দা বলল, বাবা কিন্তু তোকে কিছুই দিয়ে যায়নি। ক্রিয়াকর্ম করবি কি না ভেবে দেখ।
কোরা কাপড় ছুড়ে ফেলে, ঘাটের জামাপ্যান্ট পরেই লঙ্কাডিঙিতে ফিরেছিল বাপি। স্বপ্না বলল, বাবার কাজটাও করতে দিল না?
বাপি বলেছিল, বাবার সম্মানের কথা ভেবে আমিই করলাম না। দুই দাদা নেড়া হল। নিজের মাথার চুলটাকে আজও কেমন অপবিত্র, বাসি বাসি লাগে বাপির। ভাবে, একবার নেড়া হয়ে নেবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পালটায়, সময় করে গয়ায় যাবে। মাথা কামিয়ে পিণ্ড দেবে প্রেতশিলায়। বাপির জন্যই বাবা হয়তো পৃথিবীর কাছাকাছি ঘুরছে। আত্মাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? যতই হোক, আজ তার জন্যই তো জগতের আলো, বাতাস, গন্ধ ভোগ করছে বাপি। এই বিশাল সম্পত্তি তো বাবাই দিয়েছে তাকে। খামোকা একবার আকাশটা দেখে নেয় বাপি। তারারা ঘন হয়েছে মাথায়। যেন বাপিরই পূর্বপুরুষ।
সদরে পৌঁছোল বাপি। ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং শব্দে বাজাল ঘণ্টি। এটাই তার বাড়ি ফেরার সাইন। উঠোন থেকে তাতানের গলা ভেসে আসছে, বাবা এসেছে, বাবা এসেছে!
বাপি না ফেরা অবধি ছেলে ঘুমোতে যায় না। সদর দরজা খুলে গেল। স্বপ্নার এক হাতে ঝুলছে লন্ঠন। আলো এসে পড়েছে মুখে। ভজন ধরা পড়ার খবরটা কি জানে? সাইকেল নিয়ে চৌকাঠ পার হচ্ছে বাপি। স্বপ্না বলল, এত দেরি হল…?
লেট ছিল ট্রেন। অবলীলায় মিথ্যে বলে, পাঁচিলের গায়ে সাইকেল ঠেসান দিয়ে রাখল বাপি। তাতান এসে গেছে পায়ের কাছে, কোলে তুলে নেয় বাপি। তিরিক্ষি স্বরে স্বপ্না বলে ওঠে, সেই বাইরের হাত-পায়ে ছেলেকে কোলে নিলে! কতবার বলেছি, হাত-মুখ ধুয়ে, বাইরের কাপড় ছেড়ে ওকে আদর করবে। বাচ্চার সংসারে কিছু নিয়মকানুন থাকে।
মায়ের অপছন্দটা তাতান বোধহয় বোঝে। মাকে রাগিয়ে মজা পায়। তাই এখন হাসছে। আড়াই বছরেই ওস্তাদ হয়ে গেছে ব্যাটা! মা হওয়ার পর প্রথম দিকে এতটা শুচিবাই ছিল না স্বপ্নার, ইদানীং যেন বাড়ছে। সারাদিন ঝাঁট দেওয়া মোছামুছি নিয়ে থাকে। মাসে দুটো ঝাঁটা লাগে সংসারে।
তাতানকে বারান্দায় বসিয়ে কুয়োতলায় হাত-মুখ ধুতে যায় বাপি।
যত রাতই হোক ডিউটি থেকে ফিরে এক কাপ চা বাপির চাই। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে চায়ের অপেক্ষাতেই বসে আছে বারান্দায়। ছেলেটা গায়ে পিঠে খেলছে। ‘পড়াশোনা করেছ আজকে?’ ‘মাকে জ্বালাওনি তো?’ যা জিজ্ঞেস করে বাপি, সবেতেই ‘হ্যাঁ’ করে তাতান। বাপি মনে করার চেষ্টা করে, সে কি কোনওদিন বাবার কোলে উঠেছে এভাবে? বোধহয় না। ছ’নম্বর সন্তান এবং খুব সম্ভবত ভুলবশত তার আগমন। তিরিশ বছর আগেও কেউ শখ করে ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম দিত না। তাই তো বাপিকে বঞ্চিত করতে এতটুকু বাধেনি বাবার।
নাও ধরো। বারান্দায় চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল স্বপ্না।
ভজনের খবরটা জানে কি না এখনও বোঝা যাচ্ছে না। জানলে ভাল লাগত ওর। প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে তোলে বাপি, পাড়ায় কী সব গন্ডগোল হয়েছে শুনছি।
কই, জানি না তো। বলে, তাতানকে নিজের কাছে নেয় স্বপ্না। চায়ে চুমুক মেরে বাপি বলে, দু’নম্বরি ছেলেগুলো নাকি পুলিশের ভয়ে পালিয়েছে। হবে হয়তো।
ভজন ধরা পড়েছে জানো তো?
কাপে আরও দু’বার চুমুক দিয়ে বাপি বলতে থাকে, সুবোধদা বলছিল, সাবধানে থাকতে। পুলিশ ভজনের ছেলেদের না পেয়ে আমাদের মতো ইয়াংদের তুলে নিয়ে যেতে পারে।
তুমিও পালাও তা হলে। দায়সারাভাবে বলে উঠে গেল স্বপ্না। হয়তো কোনও কারণে মেজাজ খারাপ। না হওয়ার কিছু নেই। মন ভাল রাখার কী এমন বন্দোবস্ত করে রাখতে পারে বাপি? কারেন্ট নেই বলে ঘরে ফ্যান, টিভি নেই। লঙ্কাডিঙির পাঁচটা বাড়িতে সেসব আছে। ব্যাটারিতে চলে। ওরা ভজনের হয়ে কাজ করে। বাপিদের বিনোদন বলতে এফ এম রেডিয়ো। ঘর থেকে সেটা নিয়ে এসে ফের বারান্দায় বসে বাপি। তাতান পিছু পিছু ঘুরছে। গরম সহ্য করতে পারে না বেচারি। এখন কিছুতেই ঘরে থাকবে না। বাবা ছোটবেলায় ফ্যানের হাওয়ায় মানুষ হয়েছে, রক্তধারায় অভ্যেসটা চলে গেছে ছেলের মধ্যে।
রেডিয়োটা চালিয়ে দিল বাপি৷ ‘ধুম’ সিনেমার গানটা দিয়েছে। হেভি হিট করেছে মার্কেটে। চোখ বুজে গান শুনছিল, সদরে ঠকঠক। একটু চমকে ওঠে বাপি, এখন কে এল? রেডিয়ো অফ করে গলা তুলে জানতে চায়, কে?
আমি রে বাপি। নগেন।
হতাশ হয় বাপি, শালা নগেন মাতাল। কিছুক্ষণ আগডুম বাগডুম বকে বাড়ি যাবে। কোনও এক অজানা কারণে নগেন রিকশাওলা বাপিকে খুব পছন্দ করে। রিকশা ফাঁকা থাকলে রাস্তা থেকে বাপির বউ-বাচ্চাকে তুলে নেয়, ভাড়া নেয় না। উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা খোলে বাপি।
নগেনের মুখটা অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই খুশিখুশি যেন। মিটিমিটি হাসছে। বাপি জানতে চায়, কী ব্যাপার, হাসছ যে বড়।
বলছি, বলছি। বিরাট ক্যাচাল। হাসিমুখে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় নগেন। ধপ করে বসে পড়ে সেখানে। নেশায় ঝুলে আছে মাথা। এখন চা দিতে চাইলে খাবে না। পাছে নেশা কেটে যায়। বাপি সামনে এসে বসতে মাথা তোলে নগেন। বলে, এমন একটা খবর দেব না এখন, শুনলে পুরো বোমকে যাবি।
ভজন ধরা পড়ার খবরটা আমি জানি। বলে বাপি।
ধুর ধুর, ও খবর ঠোঙা হয়ে গেছে এতক্ষণে। আসল খবরটা শোন, ভজনকে কোমরে দড়ি বেঁধে এলাকা ঘোরাবে পুলিশ।
থ মেরে যায় বাপি। খবরটা বিশ্বাস হতে চায় না। ছবিটা সে কল্পনাই করতে পারছে না। প্রায় ছ’ফুট হাইট ভজনের। হাতে পায়ের তেমনি মাসল। চাউনি কী চোখের, তাকিয়ে থাকা যায় না! হাতে দশ আঙুলে আটটা আংটি। সোনার বালা, গলায় ছোট বড় দুটো সোনার চেন… তাকে কিনা পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে তারই এলাকায় ঘোরাবে। নগেন মাতাল বোধহয় একটু বেশিই চাপিয়ে ফেলেছে আজ। বাপি বলে, খবরটা কি তোমার চুল্লুর ঠেকে পেলে?
না রে, না। এ একেবারে ঘোড়ার মুখের কথা।
ঘোড়াটা কে?
শুনেছি।
নগেন বলতে থাকে, প্যাসেঞ্জার নিয়ে থানায় যেতে হয়েছিল। আমার চেনা হাবিলদার আছে একজন। জিজ্ঞেস করলাম, ভজনকে রেখেছে কোথায়? বলল, থানার জেলেই আছে। বেধড়ক ক্যালাচ্ছে নতুন অফিসার। কাল এলাকা ঘোরাবে।
এবার যেন একটু বিশ্বাস হচ্ছে বাপির। নগেনের কথা জড়াচ্ছে না। জ্বলজ্বল করছে চোখমুখ। মনে হচ্ছে খবরটা বানানো নয়। নগেন আরও বলে যাচ্ছে, গোটা মল্লিকপুর হাঁটাবে। নিয়ে আসবে আমাদের এখান অবধি। কাল তো রবিবার, অফিসবাবুরাও থাকবে এলাকায়। পুলিশ বুঝিয়ে দেবে, ভজন যত বড়ই দাদা হোক, সরকারের থেকে বড় নয়।
কেমন একটু যেন নার্ভাস লাগতে শুরু করেছে বাপির। কাল এলাকায় একটা বড়সড় অশান্তি হবেই। ভজনের ছেলেরা বোমাফোমা ছুড়ে ছিনিয়ে নেবে তাদের নেতাকে। পুলিশও গুলি ছুড়বে। যা তা কাণ্ড হবে একখানা! নগেন এখনও থামেনি, বলে যাচ্ছে, আমি ভাবছি, আমাদের এলাকাটা ভজনকে আমার রিকশায় ঘোরাব। যতই হোক, ও আমাদের এলাকার রাজা। ওর অপমান, আমাদেরও অপমান। নতুন অফিসারকে রিকোয়েস্ট করব সবাই মিলে।
কথাটা ব্যঙ্গ করে বলছে নগেন। বিদ্রূপটা লঙ্কাডিঙির বাসিন্দার উদ্দেশে, নাকি ভজনের? ধরতে পারে না বাপি। প্রসঙ্গ হালকা করতে বলে, তোমাদের রিকশা তো সাঁকো দিয়ে আসতে পারবে না এপারে। কী করে ঘোরাবে?
চিন্তিত হয়ে পড়ে নগেন। মাতাল লোক। ভুলেই গেছে, লঙ্কাডিঙির চার রিকশাওলা তাদের গাড়ি রাখে ওপারে। আকাশপাতাল ভেবে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নগেন। বলে, স্পেশাল একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
সদরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নগেন, সামান্যই টলছে। ‘স্পেশাল’ কী ব্যবস্থা করবে, সে-ই জানে!
নগেনমাতাল চলে যাওয়ার পর খোলা সদরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল বাপি। তাতানের কথা খেয়াল হয়, কখন যেন পাশ থেকে চলে গেছে ছেলেটা। ফের বাপির মন চলে যায় নগেনের খবরে। সত্যিই কি তা হলে সুদিন ফিরছে লঙ্কাডিঙির? চোরের মতো কোমরে দড়ি বাঁধা ভজন আর কি কোনওদিন স্বমহিমায় এলাকায় ফিরতে পারবে? উলটোটাও হতে পারে, এই অপমানে আরও খতরনাক হয়ে উঠবে সে। জেলে তাকে বেশিদিন রাখা যাবে না। নিজের জন্য বড় উকিল দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। মাথায় আছে মন্ত্রীর আশীর্বাদ। নাকি আশীর্বাদী হাতটা একটু সরে গেছে? তাই এত দুর্দশা ভজনের? গা-টা ধুয়ে নাও। খেতে দেব।
স্বপ্নার ডাকে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বাপি। বউয়ের মুখের দিকে তাকায়। একই রকম ভাবলেশহীন মুখ। নগেনের সব কথা নিশ্চয়ই শুনেছে, যা চেঁচিয়ে কথা বলে! তবু কী করে এত নির্বিকার আছে স্বপ্না? কুয়োতলার নির্জনতায় এসে দাঁড়াল বাপি। পাঁচিলের ওপারে ঝাঁকালো গাছের সারি। কালো ডালপাতার ভেতর জোনাকি। ঝিঁঝি, উইচিংড়ের কোরাস শুরু হয়েছে। থেমে যাচ্ছে হঠাৎ। আকাশের মেঘ খেয়ে ফেলেছে অর্ধেকের বেশি চাঁদ। কপিকলে জল তুলে বালতি উপুড় করে মাথায়। শীত শীত করে। কারুর থেকে খবর পেয়ে
তবেই পুলিশ ধরেছে ভজনকে। ইনফর্মারটা কে? কপালে বিচ্ছিরি মৃত্যু লেখা আছে তার। রাসু গুন্ডাকে কুপিয়ে খুন করেছিল ভজন। বডি পড়ে ছিল লাইন ধারে। বাপি নিজের চোখে দেখেছে সেই বডি। তারপর কত লাশ যে এ দিক ও দিক ফেলেছে ভজন, তার কোনও হিসেব নেই। পুলিশ অফিসারটার কপালেও দুঃখ আছে।
পরের দিন সকাল থানার সামনে বড়সড় দুটো ভোমরার মতো কালো সুমো গাড়ি। একটার মাথায় লাল আলো। আন্দাজ করা যায় লালবাজার থেকে এসেছে। গাড়ি দুটো ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়।
অস্থির পদক্ষেপে আই সি সুকল্যাণ রায় বেরিয়ে এলেন থানা থেকে। বয়স পঁয়ত্রিশছত্রিশ। মিলিটারি জওয়ানের মতো হাট্টাগোট্টা চেহারা। টুপিটা একবার খুলে, ফের পরলেন। একটু দমে গেল জনতা। বড্ড অল্প বয়সে টাক পড়েছে।
সুকল্যাণ ভিড় দেখে বেশ খুশি হয়েছেন। যাক, খবরটা তার মানে ছড়িয়ে গেছে। এই ভিড়টাকে আজ তাঁর ভীষণ প্রয়োজন। মিডিয়ার লোকজনকে দেখা যাচ্ছে না। আসবে ঠিক। কাল দু’জন ফোন করেছিল। সাংবাদিকদের সঙ্গে সুকল্যাণের সম্পর্ক ভালই। যত ক্রাইমপ্রোন অঞ্চলেই সুকল্যাণের বদলি হয়। এলাকা ঠান্ডা করার ব্যাপারে তাঁর হাতযশ আছে। রিপোর্টাররা তাঁকে তো পছন্দ করবেই। কাল ফোনে এক সাংবাদিক বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলল, আপনি যেখানে, খবর সেখানে। কাল সকাল সকাল চলে যাচ্ছি স্যার।
এখন বেলা হতে চলল। সি আই ডি ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন এসেছেন। চা-টা খেয়ে বেরোতে দেরি হচ্ছে তাঁদের। ভজনকে বানিয়ে রাখা আছে। কোমরে দড়ি বেঁধে ইন্সপেক্টর, কনস্টেবলের টিম রেডি। ভেতর ভেতর একটা উত্তেজনায় ফুটছে তারা। ভজন এতদিন দাপিয়ে বেড়িয়েছে এলাকা। পুলিশকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। কয়েকজনকে পয়সা দিয়ে কিনেও রেখেছিল। ভজনের জমানা শেষ করতে মল্লিকপুর থানা আই সি-র আন্ডারে নিয়ে আসা হয়। মাত্র একমাস হল এখানে এসেছেন সুকল্যাণ। রাঘব বোয়ালটাকে তুলে ফেলেছেন জালে। তবে ভজন যে কত বড় মস্তান টের পেয়েছেন কাল সন্ধেবেলা। লকআপে নাডু নামে দাগি ক্রিমিনাল ঢোকানো ছিল। বেশ ষণ্ডাগুন্ডা চেহারা। তাকে পাঁচশো টাকা দিয়ে সুকল্যাণ বলেছিলেন, ভজনকে একটু মালিশ করে দিস তো। কাল ওকে নিয়ে বেড়াতে বেরোব।
আসলে নিজের হাতে মারতে চাইছিলেন না। মারার সময় মাত্রাজ্ঞান থাকে না। বেশ কয়েকবার ওপর মহল তাঁকে সতর্ক করেছে। নাড়ু রাজি হল না। কেঁদে কেটে একশা। বলল, আমি স্যার পারব না। আজ বাদে কাল ভজন জামিনে ছাড়া পাবেই। প্রথমেই কেটে ফেলবে আমাকে।
অগত্যা আস্তিন গোটাতেই হল সুকল্যাণকে। বেদম পিটিয়েছেন। এখনও টনটন করছে হাত। শালার ফিগারটা রাবণের মতো। একটু দুমড়ে মুচড়ে না নিলে প্রবলেম আছে। রাস্তায় বার করলে হয়তো দড়ি, কনস্টেবল সুদ্ধু দৌড়ে পালাবে।
সি আই ডি কর্তারা বেরিয়ে এসেছেন থানার বারান্দায়। পেছনে ভজনকে নিয়ে এ এস আই, কনস্টেবলের দল। শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন সুকল্যাণ। থানার চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা
পাবলিকের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। উপস্থিত জনতার দিকে এগিয়ে যান সুকল্যাণ। মোলায়েম গলায় বলেন, আপনারা এখানে ভিড় করবেন না। স্টেশনের কাছে চলে যান। ওখান থেকেই হাঁটানো হবে। ভিড়টা একটু পেছাল। পুরোপুরি চলে গেল না। জনগণের ওপর আজ বেশি চোটপাট করা যাবে না। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণটা তাই বজায় রেখেছেন সুকল্যাণ। এদের ওপরই নির্ভর করছে আজকের অভিযানের সার্থকতা।
পুলিশ বোঝাই দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল স্টেশন রাস্তায়। লাল আলো লাগানো প্রথম গাড়িতে সি আই ডি কর্তার সঙ্গে ছিলেন সুকল্যাণ। মুখোমুখি বসেছিল ভজন। কালশিটে পড়া ফোলা থোবড়া। চোখের পাতা তুলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। ওই অবস্থাতে খানিক আগে সুকল্যাণকে শাসিয়েছে, স্যার, আমাকে ঘোরাচ্ছেন ঘোরান। এলাকায় গায়ে হাত দেবেন না। হিউম্যান রাইটসের কথাটা খেয়াল থাকে যেন। জেলের ভেতর থেকেই কেস করে দেব আপনার এগেনস্টে।
হুমকিটা তখন হজম করে গেছেন সুকল্যাণ। গাড়ি থেকে এখন ঘাড় ধরে নামালেন ভজনকে। ঠাটিয়ে একটা চড় কষালেন জনসমক্ষে। ভজন ঘুরে গিয়ে পড়ল অটো রিকশার স্ট্যান্ডে। দুই কনস্টেবলের হাত থেকে দড়ি ছেড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ধরল তারা।
কোমরে দড়ি বাঁধাটাই মানবাধিকারে মানা, সেটা ভাল করেই জানেন সুকল্যাণ। সঙ্গে এটাও জানেন, ভজন টাইপের অপরাধীর ক্ষেত্রে মানবাধিকার মুখ ঘুরিয়ে রাখেন। ভজনকে এলাকা ঘোরানোর অর্ডার ওপর মহল থেকে এসেছে। সম্ভবত মন্ত্রিমহলের নির্দেশ। মনে হচ্ছে ভজনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন কোনও মন্ত্রী। ভজনের মনোবল ভেঙে দিতে এবং এলাকার মানুষের মনে সাহস জোগাতে আজকের এই অপারেশন। ক্রিমিনাল হিসেবে ভজনের গুরুত্ব যথেষ্ট। লোকাল থানা ছাড়াও, সি আই ডি অফিসাররা আছেন। যেটা সুকল্যাণের একদমই পছন্দ হচ্ছে না। এতটা মর্যাদা তিনি দিতে রাজি নন লোকাল গুন্ডাকে। চারটে কনস্টেবল হলেই তাঁর চলে যেত। রাস্তার দু’পাশে থিকথিক করছে ভিড়। ভজনকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পুলিশের দল। পুলিশের গাড়ি দুটো গড়িয়ে আসছে পেছন পেছন। সুকল্যাণ জনতার উদ্দেশে বলে চলেছেন, শুধু দাঁড়িয়ে দেখলে হবে? হারামিটার পেছনে কষিয়ে লাথি মারুন। কোনও ভয় নেই, আমরা আছি। কম জ্বালিয়েছে আপনাদের!
জনগণ যেন কালা হয়ে গেছে। এতটুকু তাতানো যাচ্ছে না। সকলের চোখেমুখে অবিশ্বাস, ভয়। অনেকটা লকআপে থাকা নাড়ুর মতো,ভজনের গায়ে হাত দেওয়ার সাহসই পেল না। তবু ভজন তখন সোজা ছিল, বেঁকে নুয়ে গেছে এখন। একটা পা টেনে টেনে হাঁটছে। তা সত্ত্বেও ভয় কাটছে না জনতার। আই সি সুকল্যাণ চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, মারুন, মারুন, এত ভয় কীসের! আপনারা ভয় পান বলেই তো…
চলমান ভিড়টার মধ্যে বাপিও আছে। থানা থেকেই ছিল। পুলিশ অফিসারের অসহায়তা দেখে বড্ড খারাপ লাগছে তার। সত্যি, শহরের লোকগুলো একদম ভেড়ুয়া। এখানে প্রফেসর, ডাক্তার, উকিল, পার্টির নেতা, কত ধরনের মান্যগণ্য মানুষ থাকে। সময় বিশেষ ভজন এদের মধ্যে অনেক লোককে চমকেছে। ইচ্ছেমতো চাঁদার বিল কাটা। গায়ের জোরে
স্কুলে অ্যাডমিশন করানো। ঘরের মেয়ে বউকে টিটকিরি মারা। মালফাল খেয়ে বেশ কয়েকবার হাত, আঁচল টানার কেসও আছে। সবাই কি সব ভুলে গেল! শহরে যদি এই অবস্থা হয়, গ্রাম, মফস্সলের লোকেরা তো ভজনের ওপর একটুকু ঝাল মেটাতে পারবে না।
পুলিশ অফিসারের চেষ্টায় কোনও ভাটা নেই। টিভি ক্যামেরা ছবি তুলতে গিয়েছিল তাঁর, ধাতানি দিয়ে সরিয়ে দিলেন। লাফালাফি করেই যাচ্ছেন। ভজনকে লাথি ঘুষি মারছেন কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর। ঘামে ভিজে গেছে জামা। টুপি খুলে পড়ছে। বলে যাচ্ছেন, এই সুযোগ আর কোনওদিন পাবেন না। রাগ মেটানোর হয়, এখনই মিটিয়ে নিন। কত বছর জেলে থাকবে ঠিক নেই। প্রচুর কেস আছে এর নামে। জামিনে যদি ছাড়াও পায়, এলাকায় ঢুকলেই এনকাউন্টার করে দেব।
‘কাকস্য পরিবেদনা!’ মল্লিকপুরের মানুষ যেন জন্ম বোবা-কালা! পুলিশের সঙ্গে তারা শুধু হেঁটে যাচ্ছে। একপেশে নাটক দেখে বোর হয় টিভির লোক। চলে যায় ক্যামেরা গুটিয়ে। হাঁটানোর শুরুতে বেশ ধস খেয়ে গিয়েছিল ভজন; এখন ফিরে এসেছে চোখের আগুন।
বাপির ঘাড়ের কাছে কে যেন বলে উঠল, কী বুঝছিস?
মাথা ঘুরিয়ে দেখে, নগেন রিকশাওলা। বাপি বলে, কী আর বুঝব, ফালতু টাইম নষ্ট। বেকার চেঁচাচ্ছে অফিসার। এখানে কারুর ধক আছে ভজনের গায়ে হাত দেওয়ার? পাশে হাঁটতে হাঁটতে নগেন বলে, আমি কিন্তু শালা গরম খেয়ে গেছি। আমাকে মাইরি ধরে রাখ। এনি টাইম ভজনকে কেলিয়ে দিয়ে আসতে পারি।
পিন মারা সুরে বাপি বলে, সে কী গো, তুমিই না রাত্তিরে বলছিলে, ভজনকে রিকশায় চাপিয়ে ঘোরাবে লঙ্কাডিঙি।
ওর ডেডবডি ঘোরাব শালা। শুয়োরের বাচ্চা কম অপমান করেছে আমাদের? বউবাচ্চার সামনেই কলার ধরে নেয়। ওর চ্যালাদের দিনের পর দিন নিজেদের ঘরে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। খুনেগুলোকে খাওয়াও, পরাও…
নগেনের হাতটা ধরব ধরব করেও ধরছে না বাপি। নেশা ছাড়াই নগেন রিকশাওলার চোখ আজ লাল। যে-কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ভজনের ওপর।
পড়ছে না। কার ভরসায় ঝাঁপাবে? ভজন ধরা পড়লেও, সাঙাতরা তো বাইরে আছে। মিশে আছে এই ভিড়ের মধ্যে। ভজনকে নিয়ে পুলিশের দল ফিরে গেলেই, ওরা পিঠের চামড়া তুলে নেবে নগেনের।
দেখতে দেখতে শহর ফুরিয়ে গেল। দুটো কালো গাড়ি পেছনে নিয়ে মিছিলটা চলছে শোক মিছিলের মতো। বাপির আসল বাড়ির সামনে দিয়ে যখন দলটা যাচ্ছিল, দোকানের বাইরে এসেছিল বড়দা, মেজদা। কিছুক্ষণ দেখল, ফিরে গিয়ে মন দিল কাজে। বাপি নিশ্চিত, দুই দাদাই ভজনকে তোলা দিত। এখন এমন ভাব করল, যেন চেনেই না।
মেঘের কালো ছায়ার মতো ভেসে মিছিলটা পার করল মফস্সল, গ্রাম। কোথাও এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি, মানে একটা লোকও হাত দেয়নি ভজনের গায়ে। সেবাসদনের সামনে
দিয়ে আসার সময় দেখা গেল, ডাক্তার নার্সরা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দলটাকে দেখছে। বছর খানেক আগে এরা সামান্য হলেও সোচ্চার হয়েছিল ভজনের দলের বিরুদ্ধে। ভজনের চামচেরা সেবাসদনের ফ্রিজে বিয়ারের বোতল রাখতে গিয়েছিল। ওষুধ রাখার দামি ফ্রিজটা ইউনিসেফের দান করা। বিয়ার রাখতে দেবে না হাসপাতালের কর্মচারীরা। সেই নিয়ে তুমুল কিচাইন। এম এল এ এসে ব্যাপারটার মীমাংসা করে। মীমাংসা বলতে ওই আর কী, চামচেদের নতুন ফ্রিজ কিনে দিতে হয়।
ভিড়টা পৌঁছে গেছে লঙ্কাডিঙির কাছাকাছি। বাপি ভেবেছিল, বাঁশের সাঁকো দেখে পুলিশ বোধহয় ফিরে যাবে। গেল না। সাঁকোর ওপর দিয়ে চলেছে সবাই। ককিয়ে ককিয়ে কাঁদছে বাঁশের সেতু। ভেঙে না যায়!
লঙ্কাডিঙির মেঠো রাস্তা দিয়ে চলেছে দলটা। পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে রইল সাঁকোর ওপারে। নতুন অফিসার এখন বেশ ক্লান্ত। গোটা রাস্তায় কেউ তাঁর কথা শোনেনি। বাপি ক্ষীণ আশা করেছিল গ্রাম সাইডে গরিব মানুষগুলোর কেউ একজন অফিসারের ডাকে সাড়া দিয়ে ফেলবে। কত অনুযোগ শুনেছে তাদের মুখে, অভাবে পড়লে জমি বেচতে পারে না তারা। ভজনের ভয়ে কেউ কেনে না। পাইকার ভেড়ে না চাষির কাছে। আত্মহত্যা ছাড়া তাদের আর কোনও পথ খোলা নেই। আজ সত্যিই তারা মৃতের মতো স্থির, শুয়ে থাকার বদলে দাঁড়িয়ে ছিল, এই যা।
অফিসারের হয়ে একজন ইন্সপেক্টর এখন চেঁচাচ্ছে। একই ডায়লগ, মারুন ক্রিমিনালটাকে। উচিত শিক্ষা দিন। শালা নিজেকে ডন মনে করে। পুলিশ কী জিনিস, আজ ওকে বুঝিয়ে দেব।
পায়ের তলায় লঙ্কাডিঙির মাটি পেয়ে ভজন এখন অনেক ফ্রি। শান সে হাঁটছে। চোখ আর আগের মতো জ্বলছে না। ঠোঁটে ওর সেই বিষাক্ত হাসি। স্পষ্ট চোখে তাকাচ্ছে আশপাশের লোকের দিকে। মাথা নিচু করে নিল নগেন, বাপি।
পঁচিশ ঘরের কচিকাঁচারা দৌড়ে এসে জমা হচ্ছে ভিড়ে। মেয়েবউরা এসে দাঁড়াচ্ছে দোরগোড়ায়। লোকজনের ফাঁক দিয়ে বাপি দেখল, তাতানকে কোলে নিয়ে স্বপ্না দাঁড়াল সদরে।
ইন্সপেক্টর একই কথা বলে যাচ্ছে। মিছিলের মাথায় জড়ো হয়েছে একদল কাক। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছে। বাপিদের বাড়ি ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভিড়। সঙ্গে যাচ্ছে বাপি। আর একটু পরেই জমি শেষ লঙ্কাডিঙির। তারপর জলা। ওখানে পোঁতা আছে ভজনের অনেক অপরাধ। শীতে বিদেশি পাখি আসে জলায়। ওপারে সূর্য অস্ত যায়। সপ্তাহান্তে কলকাতা থেকে ট্যুরিস্ট পার্টি আসে। নিমগাছের ছায়ায় বসে পড়েছে বাপি। টায়ার্ড লাগছে বেশ। নগেনের উৎসাহের শেষ নেই, এঁটে আছে মিছিলের সঙ্গে। বাপিকে বলে গেল, ভজনের পাগলিদের দেখতে হবে না? কোমরে দড়ি বাঁধা নাগরকে দেখে, কেমন হয় ওদের মুখ… ফিরে আসছে দলটা। ক্লান্ত চোখ তুলে বাপি দেখল, অফিসার এখনও হাল ছাড়েননি। নতুন উদ্যমে লোকজনকে তাতাচ্ছেন। এই লাস্ট চান্স। সাঁকো পেরোলেই পুলিশের গাড়ি। ফিরে যেতে হবে ওঁদের। ব্যর্থ হবে গোটা অপারেশন… ভাবনার মাঝে ভিড়ের মধ্যে ভীষণ একটা
চঞ্চলতা লক্ষ করল বাপি। গাছতলা থেকে ছিটকে উঠে যায়। ভজন কি পালানোর চেষ্টা করছে?
না। ভিড়ের মধ্যে সিঁধিয়ে গিয়ে বাপি দেখে, ভয়ানক সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। স্বপ্না ঝাঁটা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভজনের ওপর। বেদম মারছে। অফিসার উত্তেজিত হয়ে বলছেন, মারুন, আরও মারুন।
অফিসার তো জানেন না, কত বড় বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে বাপির। ক’দিন আগে কেনা নারকেল ঝাড়ুটা ফেলে স্বপ্না এবার এলোপাতাড়ি হাত চালাচ্ছে। লাফিয়ে উঠে খামচে ধরল ভজনের চুল। নামিয়ে নিয়ে আসছে মাথা। কেউ হাততালি দিচ্ছে না। কাকগুলো আবার চলে এসেছে ভিড়ের মাথায়। কাঃ কাঃ করেই যাচ্ছে। ভজনকে লাথি মারছে স্বপ্না। থুতু ছুড়ে দিল মুখে।
পা থরথর করে কাঁপছে বাপির। এক্ষুনি পালিয়ে যাওয়া উচিত, পারছে না। মনে এক চিলতে আশা, লঙ্কাডিঙির আরও অনেকের তো ভজনের ওপর রাগ আছে, যদি সবাই মিলে মারতে শুরু করে ভজনকে। স্বপ্নার দিকে আলাদা করে আঙুল তুলবে না কেউ।
সেরকম কিছুই হল না। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে তাতান। ছেলের কান্না হুঁশ ফেরাল স্বপ্নার। এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। উলটো রথের মতো মিছিল ফিরতে শুরু করেছে। বাপি দৌড়োচ্ছে আগে। পালাচ্ছেই বলা যায়। মাথায় ঘুরছে একটাই কথা, সবাই জেনে গেল, সবাই জেনে গেল।
গ্রাম, মফস্সল ছাড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে যাচ্ছে বাপি। প্রথমে যাবে পৈতৃক বাড়িতে। বড়দাকে বলবে, স্বপ্না তাতানকে নিয়ে কয়েকটা দিন থাকব এখানে। মল্লিকপুরের বাইরে বাড়িভাড়া পেলেই চলে যাব।— বড়দা যদি রাজি না হয়, যাবে শ্বশুরবাড়ি। দু’বাড়িতেই আজকের ঘটনার কিছু বলবে না। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এ খবর তাদের কানে পৌঁছোবেই। তার আগে ক’দিন থাকার পারমিশনটা বার করে নিতে হবে। ভাড়া বাড়ি খুঁজতে কিছু সময় তো লাগবে। এই সিদ্ধান্তটা তার আগেই নেওয়া উচিত ছিল। লঙ্কাডিঙির বাড়িটার লোভ ছাড়তে পারেনি। সামান্য চাকরি করে তিনকাঠা জমিবাড়ির মালিক সে। লঙ্কাডিঙির বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত আশা করে, ভজনের জমানা বেশিদিন চলবে না। আচমকাই খুন হয়ে যাবে একদিন। যেমনটা এলাকার দাদাদের ক্ষেত্রে হয়। তখন বিদ্যুৎ আসবে লঙ্কাডিঙিতে। রাস্তা পাকা হবে। প্রাইমারি স্কুল খুলবে সরকার। চারগুণ দাম বেড়ে যাবে জমি বাড়ির।
ভজনের সঙ্গে বাপির মুখ পরিচিত ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। ওদের দলের কারুর সঙ্গেই আলাপ ছিল না তেমন। চাকরি, ঘর-সংসার নিয়েই থাকত বাপি। লঙ্কাডিঙির অনেকেই এরকম থাকে। অন্তত চেষ্টা করে।
ছেলের তখন এক বছর। সন্ধে উতরানো এক রাতে ভজন এল বাপিদের সদর দরজায়। ওর ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাপি। ভজনের চোখে মুখে মদের গন্ধ নেই। ঠোঁটে বিষাক্ত হাসি, ভাল আছিস বাপি? তোর বউয়ের হাতে চা খেতে এলাম।
না, মানে চা। আসলে… আমতা আমতা করছিল বাপি। কোমর থেকে রিভলভারটা বার
করে ভজন একবার পিঠটা চুলকে নিয়েছিল। তারপর বলে, জানি, মেয়েবাজ বলে বদনাম আছে আমার। পাঁচ-ছ’টা পাগলি পুষি লঙ্কাডিঙিতে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলে মন ভরে না। আমি তো তোরই মতো শহরের ছেলে, অশিক্ষিত মেয়েগুলোকে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না।— একটু থেমে বলেছিল, তুই ঘণ্টাখানেক বাইরে ঘুরে আয়। তেমন কিছু ক্ষতি করব না তোর বউয়ের।
বাপিকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি ভজন। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছিল ভিটের বাইরে। রাস্তার ওপারে আবছা অন্ধকারে বাপি যেন দেখতে পেয়েছিল ভজনের সাঙাতদের।
একঘণ্টার কিছু আগেই ফিরে এসেছিল বাড়ি। কোনও চিহ্ন ছিল না ভজনের। অন্যান্য রাতের মতোই সংসারের কাজ গোছাচ্ছিল স্বপ্না। ভজনের কথা বাপি আর কখনও তোলেনি বাড়িতে। স্বপ্নার ব্যবহারে একটু হয়তো বদল এসেছিল। সামান্য তিরিক্ষি ভাব। এই রুক্ষতা লঙ্কাডিঙির সকল বাসিন্দার মধ্যে কম বেশি আছে। শুচিবাইটা কি তখন থেকেই শুরু হয়? বাপি আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে, খুব ক্ষতি কিছু হয়নি। দেখা গেল, হয়েছে। গভীর ক্ষত। না হলে এত মারাত্মক আক্রোশে শোধ নিত না স্বপ্না। কী ভীষণ বিপদ ডেকে আনল, লঙ্কাডিঙির পাগলিদের দলে নাম উঠে গেল ওর।
বাপিকে দেখে এলাকার লোক এবার থেকে মনে মনে ছিঃ ছিঃ করবে। বাঁকা হাসি হাসবে। ভজনের ছেলেরা স্বপ্নাকে ছেড়ে দেবে না। মেরেই ফেলবে হয়তো। কাল ভোর ভোর বউ-বাচ্চাকে নিয়ে লঙ্কাডিঙি ছেড়ে পালাবে বাপি।
রাত দশটা নাগাদ শহর থেকে ফিরে এল বাপি। বাঁশের সাঁকোতে পা রাখতে, সাঁকো বলল, ব্যবস্থা হল?
বাপি মনে মনে বলে, হল। বাড়ি গিয়ে সোজা বড়বউদির কাছে উঠলাম। বললাম, কাল এ বাড়িতে চলে আসছি। হপ্তাখানেক থাকব। অন্য কোনও ডিমান্ড নেই। দূর সম্পর্কের আত্মীয়র মতো রেখো।
বউদি আশার কথা শোনাল, এক সপ্তাহ কেন, এবার হয়তো তোমার বড়দা পাকাপাকিভাবে তোমাদের এখানে এনে রাখবে। ইদানীং প্রায়ই তোমার কথা বলে। ‘ছেলেটা তো খারাপ পথে যায়নি। মন দিয়ে চাকরি, ঘর-সংসার করছে, বাবা ওর প্রতি অবিচার করেছেন।’— একটু থেমে বউদি বলেছিল, তোমাদের ‘বনবাস’ পর্ব বোধহয় শেষ হল। যতই হোক রক্তের টান বলে কথা! ও যে-কোনওদিন তোমাদের গিয়ে নিয়ে আসবে। রেডি থেকো।
কিন্তু কাল কী হবে? সেই ভাবনা নিয়ে বাপি গেল শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুর বলল, আপত্তির কিছু নেই, থাকো ক’টা দিন। বরাবরের জন্য রয়ে যেয়ো না। নিজেরই সম্মানে লাগবে।
বাড়ির সামনে এসে পড়েছে বাপি। হাটখোলা সদর দেখে বুক ফাঁকা হয়ে যায়! স্বপ্নাকে তুলে নিয়ে গেল ভজনের ছেলেরা? তাতান কোথায়? কি
দৌড়ে উঠোনে আসে বাপি। না, মনে হচ্ছে সেরকম কিছু ঘটেনি। ঘরের দরজা, জানলা
বন্ধ। ভেতর থেকে চুঁইয়ে আসা আলোতে বাপি দেখে, বারান্দাময় গরিব গরিব চটি। সবই লেডিস। দু’-চারটে হাওয়াই আছে। সাইজ দেখে বোঝা যায় এগুলোও মেয়েদের। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের গুনগুন গল্পগাছা। লঙ্কাডিঙির সব মেয়ে কি জড়ো হয়েছে বাপিদের বাড়িতে। এতজন যখন, ভজনের পাগলিরাও নিশ্চয়ই আছে।
দরজায় টোকা দেয় বাপি। ভেতর থেকে কোনও এক মেয়ের গলা ভেসে আসে, কে? আমি।
আমি কে?
বাপি।
কোন বাপি?
নামটা সত্যি বড্ড কমন। লঙ্কাডিঙিতেই তিনটে বাপি আছে। ভজনের দলেও বোধহয় আছে একটা। ভেতর থেকে আসা প্রশ্ন শুনে বোঝা যাচ্ছে, ঠিকঠাক পরিচয় দিতে না পারলে দরজা খোলা হবে না। লঙ্কাডিঙির সব মেয়ে পাহারা দিচ্ছে স্বপ্নাকে। ওদের পুঞ্জীভূত আক্রোশ স্বপ্না এতদিন সযত্নে জমা করে রেখেছিল মনে। বাপির এখন বলা উচিত, আমি স্বপ্নার বর। তাতানের বাবা।- বলার মতো জোর পায় না গলায়। কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে হয়ে আছে। তাই তো ওরা চিনতে পারল না। সিগারেট খেতে হবে একটা। আজ নেওয়াও হয়নি সুবোধদার দোকান থেকে।
বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে বাপি। উঠনে ফটফট করছে চাঁদের আলো। বড় মনোরম লাগে নিজের ভিটেটা। মনে মনে বড়বউদির উদ্দেশে বলে, বড়দাকে বোলো, বনবাসে তাদের বাড়ির বউ নিরাপদেই আছে।
সানন্দা, পুষ্পাঞ্জলি ২০০৬