পাড়ার মেয়ে
তীর্থঙ্কর
বহু রুক্ষ শহর, শুকনো মাঠ, প্রান্তর, খাঁ খাঁ গ্রাম ছেড়ে এসে ট্রেনটা এখন ক্রমশ বিভিন্ন শেডের সবুজের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। দু’পাশে জলা, খেত জমি, ঝোপ, গাঢ় ছায়া সমেত বড় বড় গাছ।
রাজধানী এক্সপ্রেসের ঠুলি পরা জানলা থেকে চোখ সরিয়ে পিউ জিজ্ঞেস করে, ওয়েস্ট বেঙ্গল ঢুকে গেলাম, না?
পিউয়ের মুখে রোমাঞ্চ। মাথা নেড়ে সায় দিই আমি। পিউ কিশোরী বেলায় এক-দু’বার কলকাতায় এসেছে। কবেকার সেই স্মৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে বাইশ বছরের চোখ। আমার সে সবের বালাই নেই। প্রায় সাড়ে তিন বছর বাদে কলকাতায় ফিরলেও মনে হচ্ছে গতকালই এ রাস্তা দিয়ে দিল্লি গিয়েছি। লাইন ধারে কলাগাছগুলো এরকম ভঙ্গিতেই ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যেন মঙ্গল কামনা করছিল প্রবাসে পাড়ি দেওয়া সন্তানের।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেল থেকেই আমি হোমসিক বলে ধিকৃত। ছুটিতে একবার শোভাবাজারের বাড়িতে ফিরলে আর হস্টেলে যেতে চাইতাম না। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউএর পর চাকরি হল দিল্লিতে। স্বভাবতই মা খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। আদৌ চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে পারব কি না! আমি ততদিনে কেরিয়ারের বাস্তব দিকটা বুঝে গিয়েছি। মাকে আশ্বস্ত করেছিলাম এই বলে, এখন ক’বছরের জন্য যাই। শুনেছি কোম্পানি কলকাতায় একটা সেক্টার খুলছে। যে করে হোক বদলি হয়ে চলে আসব।
সেই সেক্টার আজও খোলেনি। তবে ডানকুনির কাছে জমি নেওয়া আছে। কোনওদিন হয়তো খুলতেও পারে। ততদিন পর্যন্ত মা-বাবা থাকবেন কিনা সেটাই বড় ব্যাপার।
দিল্লি যাওয়ার সময় একটা বুদ্ধি দিয়েছিল বাবা। বলেছিল, খুব প্রয়োজন ছাড়া একদম কলকাতায় আসবি না। কারও বিয়ে টিয়েতেও নয়। আমারই বরং মাঝে মধ্যে তোকে গিয়ে দেখে আসব। সেইমতো সাড়ে তিন বছরে দু’বার মা-বাবা দিল্লিতে ঘুরে গিয়েছে। আর আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি, আসলে মা-বাবা নয়, আমি শোভাবাজার সিক। সেখানকার পাড়া, মাঠ, প্রাচীন বাড়ি, গলি, কলোনি, গঙ্গার ধার, ধুলো মাখা বাস ট্রাম আমাকে ডাকে। সেই ডাক এমনই অমোঘ দিল্লির প্রথম কয়েকমাস কিছুতেই সুস্থিতি পাচ্ছিলাম না। তার মাঝেই একদিন বিশেষ এক ঘটনায় প্রচণ্ড ধাক্কা খাই মনে। সেদিনই অফিস থেকে ফেরার
পথে কলকাতার টিকিট কিনে বিজনদার বাড়ি যাই। বিজনদা অফিসে আমার সিনিয়র। ওর বাড়িটাই তখন দিল্লিতে আমার একমাত্র আড্ডার জায়গা। সে যাত্রায় বিজনদা আর নীলা বউদি আমার কলকাতা ফেরা আটকায়। ঘটনাটা ঘটেছিল এরকম, সকালবেলা সিডি প্লেয়ারে অরুণ ভাদুড়ীর হংসধ্বনি চালিয়ে শেভ করেছিলাম। আমার পাঁচতলার ভাড়ার ঘরে তখন হাঁসের পালকের মতোই সাদা রোদ। এমন সময় একটা চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। মহিলা কণ্ঠ! ইনিয়ে বিনিয়ে কেউ কাঁদছে। সম্ভবত নীচে থেকেই উঠে আসছে শব্দটা। গানের ভলিউম কমিয়ে ছিটকে গেলাম ঝুল বারান্দায়। আমাদের পাশের বাড়ির চাতালে, খাটে সাজানো একটি মৃতদেহ। বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। খাট ঘিরে গুটি কয়েক শোকাচ্ছন্ন মানুষ। ওদের মধ্যে একজন বৃদ্ধাই শুধু কাঁদছেন। সম্ভবত ওঁর স্ত্রী। এঁরা বাঙালি। চিত্তরঞ্জন পার্কের বেশিরভাগই তো বাঙালি। তবু মৃতদেহ ঘিরে কেন এত কম ভিড়, বৃদ্ধাই বা এত চাপা স্বরে কাঁদছেন কেন? যেন অভিজাত প্রতিবেশীদের কথা খেয়াল রেখেই তাঁর এই কুণ্ঠা। শোকের কান্না, হা-হুতাশের কান্না, দিল্লিতে এসে এত চাপা হয়ে যায়! ওইটুকু কান্নাই কি বৃদ্ধের সারা জীবনের সঞ্চয়! যাঁর মৃতদেহ তাঁকে জীবিত অবস্থায় চোখে পড়েনি। অথচ পাশেই থাকতেন। কোথায় বাড়ি ছিল তাঁর? ভবানীপুর? নাকি আরও পিছিয়ে গেলে নোয়াখালি।
তোয়ালেতে মুখ মুছে নেমে এলাম নীচে। মৃতদেহের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধের মুখে কষ্টের ছাপ। এ কি অসুখের নাকি দেশে না ফিরতে পারার কষ্ট? বৃদ্ধকে মনে মনে বললাম, আমি খুব দুঃখিত। এত ক’টা মাস পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও আপনার সঙ্গে আমার আলাপই হল না।
কোনও হরিধ্বনি ছাড়াই নিঃশব্দে তিনি মহাপ্রস্থানে গেলেন। দিল্লির আকাশে বৃষ্টি ভরা মেঘ ঘনাল। গাড়ি চালিয়ে অফিস যাচ্ছি। বৃষ্টি নামল অঝোরে। গাড়ির সামনের উইন্ড স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বারবার চোখ মুছছি আমি। খানিক পরেই ভুলটা ধরে ফেলে, ওয়াইপারটা চালু করে দিলাম। জানলার স্ক্রিন একটু নামিয়ে দিয়েছি, ভেজা মাটির গন্ধ। কার ডেকে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার। তক্ষুনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম কলকাতায় ফিরে যাব। সন্ধেবেলা সব শুনে বিজনদা বলল, চল, জমিয়ে কয়েক রাউন্ড স্কচ খাই। টোটাল ডিপ্রেশান হাওয়া হয়ে যাবে।
নীলা বউদি এসে বাধা দেয়। বলে, কেন মিছিমিছি ছেলেটাকে স্পয়েল করছ। নিজে তো গেছই।
বিজনদা নিজের জন্যেই পেগ বানাল। হাতে গ্লাস তুলে বলল, প্রথম প্রথম আমারও তোর মতো হত। একা থাকি। যা হোক, তা হোক রাঁধি, খাই। অফিস যাই। বাড়ি ফিরে এসে গান চালিয়ে দিই বিশাল ডেকে। কদাচিৎ টিভি দেখি। তখন এত বাংলা চ্যানেল ছিল না। বাজার দোকান যাই, বাঙালি মুখচোখ দেখি। চিত্তরঞ্জন পার্কের রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে কান খোলা রাখি, যদি কোনও বাড়ি থেকে গলা খোলা বাঙালির হাসি শুনতে পাই অথবা কোনও বাচ্চা মেয়ের কণ্ঠে হারমনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের রেওয়াজ। কিছুই শুনতে পাই না। এমনকী, চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িগুলো থেকে উঁচু স্বরে বলা কোনও
বাংলা কথা রাস্তায় এসে পৌঁছোয় না। শালা, মানিকতলা বাজারের পাশে মানুষ হওয়া আমি ক্রমশ যেন কালা হয়ে যাচ্ছিলাম। মাকে চিঠি লিখলাম। একটা ঝগড়ুটে টাইপের মেয়ে দেখো। বিয়ে করব। তারপর তোর নীলা বউদি এসে জীবনটা বদলে দিল।
বাজে বোকো না তো। বলে আড্ডায় এন্ট্রি নিয়েছিল নীলা বউদি। তারপর বলে, আসলে তীর্থঙ্করদের ব্লক তো নতুন, পাড়া অ্যাটমোসফেয়ার তৈরি হতে আরও কিছু বছর লাগবে। আমাদের ব্লকে যেমন ফিলই হয় না কলকাতার বাইরে আছি। তা ছাড়া তীর্থটার দোষও আছে। এত ইন্ট্রোভার্ট! কারও সঙ্গে মিশতেই চায় না। এরকম নানা কথায় আড্ডা গড়িয়ে যেতে বউদি একসময় বলে, কামিং উইকএন্ডে আমাদের বাড়ি চলে আসবে। তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।
বউদি নিয়ে গিয়েছিল ওদের পাশের ব্লকে সেনগুপ্তদের বাড়ি। অর্থাৎ পিউদের বাড়ি। নিউ দিল্লির পুরনো বাসিন্দা ওরা। কলকাতায় আত্মীয়স্বজন বলতে এক জ্যাঠা। বালিগঞ্জে সেই জ্যাঠার বাড়িতেই ছোটবেলায় দু’-একবার এসেছিল পিউ। এতদিন পর আবার যাচ্ছে। তবে আমাদের বাড়ি ঘুরে যাবে।
তো যা বলছিলাম, সেনগুপ্তদের বাড়ি গিয়ে দেখি, অনূঢ়া বিদুষী দুই বোন। পিউ আর মউ। অতিদ্রুত জানা গেল ছোট বোন মউ অলরেডি এনগেজড। পিউ রহস্যময় কারণে এখনও একা। রহস্য ভেদ করার চেষ্টা না করে আমি জড়িয়ে পড়লাম নীলা বউদির অ্যারেঞ্জ করে দেওয়া প্রেমে। এবং ধীরে ধীরে বুঝলাম পিউ আমার থেকে অনেক ম্যাচিয়োর্ড অথচ রোমান্টিক মেয়ে। ও আমার মন বুঝে দিল্লির শ্রেষ্ঠ নির্জন জায়গাগুলোয় নিয়ে গেল। তুঘলকাবাদ সেইরকমই একটা ভাঙা ফোর্ট। সেখানে অনেক গন্তব্যহীন সিঁড়ি। ভাঙা চোরা দেওয়ালের চৌহদ্দি ধসে যাওয়া ছাদ নিয়ে পাতাল কারাকক্ষ। বহু যুগ আগে এই সার সার কারাকক্ষে কোনও আলো ঢুকত না। আজ ঢোকে।
সেই ইতস্তত অন্ধকার কুঠুরির ভেতর চোখ চালিয়ে আমার হঠাৎই মনে হয়েছিল, হয়তো আমারই কোনও পূর্বপুরুষ এই কুঠুরিতে বসে এক চিলতে আলোর জন্য হতাশ্বাস ফেলতেন। তাঁর হয়ে আমি ওখানে দাঁড়িয়ে নাড়ি অবধি দীর্ঘ নিশ্বাস নিলাম। আমার বিপন্ন বিহ্বলতা চোখ এড়ায়নি পিউয়ের। সঙ্গে সঙ্গে অজুহাত তৈরি করে সে বলে, আর ভাল্লাগছে না। কী গন্ধ বাদুড়ের! চলো ওপরে যাই।
প্রাচীন সিঁড়ি ভেঙে উঠে দেখি, আমাদের থেকে পনেরো-বিশ হাত দূরে ভগ্ন পুরাকীর্তির ওপর একটা ময়ুর হেঁটে যাচ্ছে। সেদিন ছিল প্রকৃতির রন্ধনশালায় সদ্য আঁচ লাগা বিস্তীর্ণ বিকেল। সুদূর ইতিহাস যেন হেঁটে আসছিল পায়ে পায়ে। পিউয়ের মোহাবিষ্ট ভঙ্গিতে এমন কোনও উসকানি ছিল, নাকি ইতিহাস মাখা বিকেলের মধ্যে ময়ূরের হেঁটে যাওয়া দেখে আমিই চিরাচরিত সংশয় ভেঙে পিউকে একটা চুমু খেয়েছিলাম। উত্তরে ও আমাকে বলেছিল, টেস্টলেস।
এ কথার মানে কি আমাকে আরও একবার কিস করো, নাকি সত্যিই টেস্টলেস। আবার আমি গভীর সংশয়ে পড়লাম। ময়ূরটা ততক্ষণে বেশ দূরে চলে গিয়েছে। লাফিয়ে উঠছে ভাঙা পাঁচিলে। পিউ আমার বুকে লগ্ন হতে হতে বলেছিল, আমি তো তোমায় দিল্লির অনেক কিছু দেখালাম। তুমি আমায় কলকাতা দেখাবে না?
কেউ কলকাতা দেখতে চাইছে, আমি কি আর আপ্লুত না হয়ে পারি। তবে বেশ দেরি হয়ে গেল পিউকে কলকাতা দেখাতে। প্রায় তিন বছর। ইতিমধ্যে বাবা-মা এসে পিউকে আশীর্বাদ করে গিয়েছে। এই মাসেই আমাদের বিয়ে। পাত্রীর জ্যাঠার বাড়িতেই বিয়েটা হবে। বিয়ের পর দিন পনেরোর ছুটিতে আমরা কোথাও যাব না। পিউকে ঘুরিয়ে দেখাব আমাদের শোভাবাজারের রাজবাড়ি, খরপট্টির ঘাট, গিরিশ ঘোষের বাড়ি রেখে রাস্তার সরে যাওয়া। এখন শ্রাবণ মাস। কুমোরটুলিতে নিয়ে যাব খড়ের দেবীমূর্তি দেখাতে। রবিবার যাব পাখিহাটে। অবশ্য জানি না এখনও হাটটা বসে কিনা। বহু পাখি তো বিরল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ির পাশের কলোনির বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব পিউয়ের। ও আশ্চর্য হয়ে দেখবে শোভাবাজারে কোনও শ্রেণি বৈষম্য নেই। এখানে কারও বিয়ে হলে পাড়া জুড়ে উলুধ্বনি ওঠে। কেউ মরে গেলে প্রতিটি মানুষ শোকাচ্ছন্ন হয়। বড় বড় প্রাচীন বাড়ি, রাস্তা গলি, গঙ্গার ঘাটের ইতিহাস এখনও ততটা পুরনো হয়নি।
আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই প্রতাপদের টালির চালের বাড়িতেও নিয়ে যাব। খেলার মাঠে বিকেল ফুরিয়ে প্রতাপদের বাড়ি যেতাম জেঠিমার হাতে গড়া গরম রুটি আর বাটিচচ্চড়ি খেতে। প্রতাপের বোন মাতন হাঁ করে দেখত আমার আট ন’টা রুটির অবলীলায় গলাধঃকরণ। তখন বুঝতাম না মাতনের ওই বিস্ময়ের মধ্যে কিছুটা অসহায়তাও মিশে থাকত। ওদের রাতের খাবারে হয়তো ভাগ বসিয়ে ফেলতাম আমি। ওরা কেমন আছে, কে জানে! জেঠিমা নেই হস্টেলে থাকতেই দেখেছি। বছর খানেক আগে মা চিঠিতে লিখেছিল, প্রতাপের বিয়ে হয়েছে। তারপর আর ওদের কোনও খবর পাইনি বা নেওয়া হয়নি। কেমন আছে জেঠু, মাতন? খেপি মাতন! যেদিন ও জানল আমি দিল্লি চলে যাচ্ছি, সরাসরি আমার ঘরে উপস্থিত।
তীর্থদা তুমি নাকি দিল্লি চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ। কেন, তোর কোনও আপত্তি আছে? দিল্লিতে কী আছে, যা কলকাতায় নেই?
বড় বড় অফিস আছে, প্রচুর কলকারখানা, ভাল চাকরি। এখানে সে সব কিচ্ছু নেই। তার মানে তুমি সারা জীবন দিল্লিতেই থাকবে!
তাই হয়তো থাকতে হতে পারে। তবে কলকাতায় আসার একটা সুযোগ আছে। কীরকম! সাগ্রহে জানতে চেয়েছিল মাতন।
ডানকুনিতে জমি কিনেছে কোম্পানি। ফ্যাক্টরি, অফিস চালু হলেই চলে আসব। মাতন হতাশ হয়ে বলেছিল, সেও তো অনেক দূর। তুমি রোজ বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে পারবে?
পারব রে বাবা, পারব। তখন আমার গাড়ি থাকবে। চল ছাদ থেকে তোকে দেখাই, কলকাতার কোন দিকে ডানকুনি।
মাতনকে ছাদে নিয়ে এসে গঙ্গার ওপারে আঙুল তুলে ছিলাম, ওই তো উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর পরেই ডানকুনি। আসলে মাতনকে দেখানোর ছলে নিজেকেও কিছুটা আশা দেখাচ্ছিলাম আমি।
ওখানে কি কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে?
ঠিক জানি না। বোধহয় হয়েছে।
হঠাৎ সুর পালটে মাতন বলেছিল, ঠিক আছে বাবা, অত চিন্তা করতে হবে না। দিল্লিতে গিয়ে মন দিয়ে চাকরিটা করো। আমি মাঝে মধ্যে ডানকুনিতে গিয়ে দেখে আসব কাজ কতদূর এগোল। মিস্ত্রিরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কি না। দিলেই তোমাকে জানাব। বলা শেষ করে খিলখিল করে হাসছিল মাতন। আমিও হেসে ফেলেছিলাম। পাক্কা খেপি। সত্যি মাতন তোর মতন খেপি সারা দিল্লিতে একটাও নেই।
হাওড়া ঢোকার আগে ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়াই। পিউ বলে, কী হল!— চলো, লাগেজ নিয়ে নেমে পড়ি। আর ভাল লাগছে না।
পিউ হাসছে। অতি মার্জিত, শিক্ষিত, অভিজাত হাসি। হাসতে হাসতেই বলে, বাড়ির জন্য এত ছটফট করে কী লাভ। সেই তো দিল্লিতেই ফিরে যেতে হবে।
মাতন
এখন বোধহয় গরমকাল নয়। তবু যে কেন এত গরম করে আমার কে জানে! শাড়ি ফাড়ি গায়ে রাখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। আমি একটা যুবতী মেয়ে।
জমিদারবাড়ির গিন্নিমা যেদিন থেকে আমার গলায় এই মাদুলিটা পরিয়ে দিল, গরম লাগা শুরু হল সেদিন থেকেই। গিন্নিমা আমায় দু’বেলা খেতে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে মাদুলির দিকে। হয়তো এই মাদুলির মধ্যেই ঘুমিয়ে আছেন ঈশ্বর। উনি জেগে উঠলেই আমি ভাল হয়ে যাব।
আমি কিন্তু খুব একটা খারাপ নেই। পাছে দু’বেলা খাবারটা বন্ধ হয়ে যায়, সেই ভয়ে মাদুলিটা পরে থাকি। গরম করলেই বড্ড বাড়ির কথা মনে পড়ে, ঠান্ডা মেঝে, বিয়েতে পাওয়া দাদার নতুন ফ্যান। আরামগুলো নিয়ে দাদা যে কোথায় চলে গেল! দেশের সরকার বলেছে, আমাদের পাড়াটা নাকি বেআইনি। পাড়া ভেঙে কারখানা হবে। কাজ কিন্তু কিছুই এগোয়নি। মাঝে মধ্যে বাড়ির সামনে যাই, ঢোকা হয় না। নিচু হয়ে গিয়েছে দরজা। ছাদটা দেবে গিয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই বাড়ির দশা খারাপ হতে থাকে। দাদা যদি বা সারাতে গেল, এসে গেল সরকারি চিঠি। দাদা ভয়ে পালাল।
সরকার এখনও খবর পায়নি আমরাই আসলে এ দেশের নয়, আমার বাবা এসেছিল খুলনা থেকে। আমাদের পাড়ার সবাই ওপার বাংলার। সবাই চলে গিয়েছে পাড়া ছেড়ে। যাওয়ার সময় কেউ কেউ নিজেদের বাড়ি ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। আমাদের বাড়িতে ঢুকতে গেলে এখন হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। বাড়ি তো আর গুহা নয় যে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারব না!
তাই আমি এখানেই ভাল আছি। জমিদারবাড়ির এই পেছনের বাগানে। এখানে দিঘি ঘিরে বনজঙ্গল। ভাঙা ঘোড়ার গাড়ির পাহাড়, একটা ভাঙা পালকিও আছে। এদিকে বড় একটা
কেউ আসে না। একটা বুড়ো দারোয়ান আমার খেয়াল রাখে। বেচারা গরিব। সকালের চা বিস্কুট ছাড়া আর কিছু খেতে দিতে পারে না। আমি কিছু মনে করি না তাতে। ওর কথামতো বাগানটা ঝাঁট দিই। রাত হলে গাছতলায় শুয়ে পড়ি। অন্ধকারে অশ্বত্থ পাতার খসে পড়ার শব্দ পাই। সেই শব্দে আমার অতীত হারিয়ে যায়। কিছুই আর মনে করতে পারি না। বুঝতে পারি না এটা গরম না বর্ষাকাল।
কাল সারারাত ফুলঝুরির মতো জ্বলেছিল তারারা। চাঁদও ভীষণ স্পষ্ট। এত তাপ, ভাল করে ঘুমোতেই পারিনি। এখন চাঁদ, তারা ঘুমিয়েছে। পাখি সব করে রব। অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ি থেকে উঠে বসি। একবার যেতে হবে দিঘির পাড়ে দেবীর মন্দিরে। ওই দূরে দেবীর মন্দিরে রাতের প্রদীপের আলো জ্বলছে। ঘুমন্ত টগর গাছ থেকে টুপটাপ ফুল পড়ছে দেবীর দালানে। মন্দিরের সামনে এসে দেখি, দেবী জেগেই আছেন। দেবীর উত্থিত হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার শরীরে ঠান্ডা নেমে আসে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা ছোট্ট মেয়ের মুখ। মুখটা খুব চেনা চেনা। মেয়েটা ঘুরতে ঘুরতে এই মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াত।
হাত জোড় করে চোখ বুজে দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করত বাবা। চোখ খুললে মেয়েটা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করত, বাবা তুমি ঠাকুরের কাছে কী চাও? কিছুই চাই না রে৷ ঠাকুরকে শুধু বলি, বড় অসময় তুমি টেনে নিলে এদের মাকে। যেখানেই রেখে থাকো, ভাল রেখো। ভুলিয়ে রেখো সংসারের মায়া।
মেয়েটার তখন মনে হত ওই দেবী মূর্তির পেছনেই মা আছে। একদিন মেয়েটা সুযোগ বুঝে দেবীমূর্তির পেছনে গহন অন্ধকার ও রহস্যের মধ্যে মাকে খুঁজতে গিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল! কী যেন নাম ছিল মেয়েটির।
আমি জানি নামটা একদিন না একদিন মনে পড়বেই। সেদিন খুব শীত পড়বে। ভোরবেলা দল থেকে হারিয়ে যাওয়া একটা তারা আকাশের শেষপ্রান্তে বসে শীতে তিরতির করে কাঁপবে। বাবা এসে বলবে, মা একটু চা খাবি? শীত করছে?
রোজ দেবদালান পরিষ্কার করার পর, বুড়ো দারোয়ান প্রায় বাবার মতোই ডেকে চা দেয়। তারপর এমন অদ্ভুতভাবে তাকায় যেন দূরবিন লাগিয়েছে চোখে। জিজ্ঞেস করে, কী রে, নাম মনে পড়ে? কোনও আত্মীয়র বাড়ি? কিচ্ছু মনে পড়ে না! আমি মরে গেলে কী হবে তোর? বাগানটাও তো বাবু বেচে দেবে শুনছি। মনে করার চেষ্টা কর।
এসব কথাতেই আমার আরও গোলমাল পাকিয়ে যায়। দারোয়ান কী মনে পড়ার কথা বলছে? এই বুড়োও কি আমাদের কাছে কোনও টাকা পায়? একসময় পৃথিবীর সবাই আমাদের কাছে টাকা পেত৷ কে যে আমাদের হয়ে এত ধার করেছিল কে জানে। বাবা মৃত্যুশয্যায় দাদাকে বলেছিল, প্রতাপ, অনেক ধার রেখে গেলাম। শোধ না করতে পারলে, পালিয়ে যাস। নইলে অপমানে জেরবার হয়ে, সময়ের আগেই আমার মতো চলে যেতে হবে।
…মনে মনে আমি বুড়ো দারোয়ানকে বলি, আমি তোমার টাকা শোধ করে দেব। বাবার ধার সন্তানের শোধ করা কর্তব্য। তুমি আর এ ব্যাপারে দাদাকে কিছু বোলো না। ও আর কত করবে বলো! ধার শোধ করতে গিয়ে নগদ নিয়ে বিয়ে করল।
কোনও সুরাহার আগেই বউদির কোলে এল একটা ছোট্ট বাচ্চা। কম পড়ে গেল বাড়ির জায়গা। বউদি আমাকে রান্নাঘরে শুতে বলত। রান্নাঘরে বড্ড গরম। আমি রাগ করে বেরিয়ে এলাম। ভেবেছিলাম ক’দিন মামার বাড়ি গিয়ে থাকব। রাস্তাটা কিছুতেই মনে করতে পারি না। শেষমেশ জমিদারের এই বাগানে ঢুকে পড়লাম।
ছোট্ট মেয়েটা একবার বাবার হাত ধরে মামার বাড়ির থেকে একটু দূরে তেপান্তরের মাঠে গিয়েছিল। আকাশ যেখানে ঢালু হয়েছে, একটা ট্রেন চলছিল ঢিমে তালে। ট্রেন যাচ্ছে কিন্তু তেমন এগোচ্ছে না।
বাবা ট্রেনটা এগোতে পারছে না কেন? খালি চলেই যাচ্ছে।
এই ট্রেনটা পৃথিবীকে পাক দিচ্ছে মা।
ট্রেনের সেই ঢিমে তালে যাওয়া আমি ইচ্ছে করলেই দেখতে পাই। বিকেলে দিঘির পাড়ে বসে দেখি, ওপারের জলে চলন্ত ট্রেনের ছায়া পড়েছে। ট্রেনের জানলায় আলো। জানলায় খুব চেনা একটা ছেলের মুখ। মুখটা খুব অসহায় লাগে। বাড়ি হারিয়ে ফেলেছে বোধহয়। আমি জানি ছেলেটা এ অঞ্চলের। কারখানা বানানো শিখতে গিয়েছিল। ও হয়তো এখানে ফিরে আসতে চাইছে, চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও। বেচারা জানেই না আমাদের এলাকায় প্রচুর কারখানা হবে। আমাদের বাড়ি ভেঙে হবে কারখানা। ক’দিন আগেই দুপুরবেলা জমিদারের পেয়াদা এসেছিল। মাপামাপি করছিল বাগানটা। আমাকে দেখে বলল, ভাগ এখান থেকে। আমি বলি, কেন! কী হবে এখানে? ওরা বলে, কারখানা হবে। কারখানা। অগত্যা বলতেই হয়, তোমরা এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? এখানকার একজন তো গিয়েছে কারখানা বানানো শিখতে। সে ফিরে আসুক।
ওরা শোনে না। ওদের ফিসফিসানির মধ্যে আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, ওরা এখানে বাচ্চা তৈরির কারখানা করবে। সেই বাচ্চা একদিন ভাল ডাক্তার হবে। দারুণ ইঞ্জিনিয়ার। রাগী মিলিটারি… ওদের আলোচনা শোনার আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমি অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করি। আমার কানে বাজে পৃথিবী পাক খাওয়া সেই ট্রেনটার ঝমাঝম আওয়াজ। ট্রেন আসছে। আসবেই।
নাঃ, দেবদালান পরিস্কার হয়ে গেল, এখনও দারোয়ান চা নিয়ে এল না। এরকম এক এক দিন হয়। সেদিন বাইরের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আমাকে। ওখানে ক’টা লোক থাকে, সূর্য উঠলেই কীরকম যেন পাগল পাগল হয়ে যায়। আমার পেছনে লাগে। শাড়ি ধরে টানে। একদিন তো গায়ে গরম চা ছুড়ে দিয়েছিল। মাদুলিটা গলায় ছিল ভাগ্যিস। জোর বেঁচে গিয়েছি।
দুপুরবেলা গিন্নিমাকে মাদুলির মাহাত্ম্যটা বলতে গেলাম, বুঝতেই পারল না। ভেবেছিলাম হয়তো বলবে, সকালের চা-টা আমার কাছেই খেয়ে নিস। তার বদলে একই রকম করুণ চোখে মাদুলির দিকে চেয়ে রইল। আমিও আর কথা এগোলাম না। বাধোবাধো লাগছিল। সারাদিন যেখানেই ঘুরি না কেন, খিদে পেলে তো এখানেই আসতে হয়। আর কত বোঝা চাপাব। গিন্নিমা যে কীসের ধার শোধ করছে সেটাও বুঝতে পারি না।
তীর্থঙ্কর
ঘণ্টা দুয়েক হল বাড়ি ফিরেছি। এখন আমি ছাদে। নীচে মাতনদের কলোনিটা দেখে মনে হচ্ছে তুঘলকাবাদের সেই ভাঙা পাতাল কারাকক্ষ। কিছুদিন আগে যেন মারাত্মক ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছে এখানে। অথচ আশপাশের বাড়িগুলো অটুট।
পিউকে নিয়ে বাড়ি ঢুকতেই হইহই পড়ে গেল। আমার কাজিনরা সকাল থেকেই বাড়িতে জমা হয়েছে। সবাই মেতে গেল পিউকে নিয়ে। তখনই খটকা লেগেছিল। এদের মধ্যে তো আর একজনের থাকার কথা। তাকে দেখছি না কেন?
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মাকে জিজ্ঞেস করলাম মাতনের খবর। মা আমার আড়ালে নিয়ে গিয়ে যা বলল, শুনে তো আমি থ! মাতনদের বেআইনি কলোনি গর্ভমেন্ট ভেঙে দিচ্ছে। প্রতাপ বউ বাচ্চা নিয়ে বেপাত্তা। জেঠু মারা গিয়েছেন। মাতন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। পাগল হয়ে গিয়েছে।
প্রথমেই রাগ হয় প্রতাপের ওপর, এত অমানুষ হয়ে গিয়েছে, বোনের চিকিৎসা পর্যন্ত করায়নি। তারপর মাকে বলি, তুমি আমায় একটা খবর দিতে পারলে না!
মাতনকে খুঁজে বার করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নইলে হয়তো দেখব আমার বউভাতের দিন বাড়ির গেটে আর পাঁচটা ভিখিরির সঙ্গে মাতনও দাঁড়িয়ে আছে।
মাতন
বড় বড় গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে আসা আলোর তলোয়ার বাগানটাকে যেন গিঁথে ফেলেছে। সেই তলোয়ার কেটে, ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছি দিঘির দিকে।
বুড়ো দারোয়ান ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এল, কী রে আজ এত তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে গেল তোর!
উত্তরে আমার লজ্জা পেয়ে হাসা উচিত। ইচ্ছে করছে না। গাল দুটো পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। গিন্নিমা আজ খেতে দিয়ে বড্ড তাড়া দিচ্ছিল, তাড়াতাড়ি খা। মেলা কাজ আছে আমার।
ও বাড়িতে আজ কেউ আসবে, তাই এরকম করছিল গিন্নিমা। কিন্তু কাউকে খেতে দিয়ে কখনওই তাড়া দেওয়া উচিত নয়। গলায় আটকে যাবে না! সন্ধে ফুরোলে খেলাধুলো সেরে এসে সাত ঋষি যখন অন্ধকার ঘিরে আকাশে খেতে বসে, অন্ধকার মা কি তাড়া দেয়? এক ঋষি তো ভীষণ পেটুক, আট-ন’টা রুটি খেয়ে নেয় অনায়াসে।
বিকেল ফুরিয়ে এল। এখনও দিঘির জলে পৃথিবী পাক দেওয়া ট্রেনের দেখা পেলাম না। ট্রেন কি আর আসবে না। বুড়ো দারোয়ান ডাকছে, এই মেয়ে, কোথায় গেলি। দেখ তোকে কে খুঁজছে।
এখন আবার কে এল ! দিঘির পাড় থেকে উঠে আসি। যে আমায় খুঁজতে এসেছে, তাকে
চিনি না। ছেলেটা আমাকে দেখে রিকশা ডেকে নিয়ে এল। আমি আর সে এখন হাতে টানা রিকশায় বসেছি। বুড়ো দারোয়ান ‘দুর্গা দুর্গা’ বলছে। জানি পেছন ফিরে তাকাতে নেই, তবু দেখি, দিঘির জলে সিঁদুর লাগা মেঘ।
রিকশার হাতল তুলে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রিকশাওলা। কিন্তু এ কী, ঘণ্টির বদলে মুখে হুন হু না আওয়াজ করছে কেন! এটা কি রিকশা নয়, এই বাগানের ভাঙা পালকিটাই কি সারিয়ে নিয়ে এসেছে ছেলেটা? দূরে কোথাও কি সানাই বাজছে!
শারদীয় সংবাদ প্রতিদিন, ২০০৩