কবি অনন্তচাঁদ
‘আধুনিক কবি’। আরেকজন বলল, ‘অনন্তচাদ’। আবার একই গলায়, ‘আধুনিক কবি’ অন্যজন, ‘অনন্তচাঁদ’। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন অনন্তচাদ, মল্লিকদের রকে বসে পাঁচছ’জনের একটা ছোকরার দল আওয়াজ দিচ্ছে তাঁকে। ডাক্তারের জবাব দেওয়া বাতিল চশমার কুয়াশা ভেদ করে চেনার চেষ্টা করলেন ছেলেগুলোকে। চোখ দিয়ে নয়, যেন মন দিয়ে চিনলেন। নতুন ব্যাচ। ক’দিন আগেও এরা হাফপ্যান্ট পরে মল্লিকদের মাঠে ফুটবল খেলত। তখন এদের ওপরের ব্যাচটা আওয়াজ দিত। সেই ব্যাচটা হঠাৎ ফিকে হয়ে গেছে। বোধহয় যে যার পেটের ধান্ধায় চাকরি বা ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই কিছুদিন বিরাম ছিল। আবার আজ থেকে শুরু হল নতুন ব্যাচ। এরকম পাঁচ-ছ’ ব্যাচ দেখা হয়ে গেল অনন্তচাদের। পরম্পরা চলছে। চলুক, কবে শেষ হয় দেখা যাক। অনন্তচাঁদ মুখ ঘুরিয়ে চলতে শুরু করেছেন। এখন আর কেয়ার করেন না। প্রথম দু’ব্যাচের সঙ্গে লড়ার চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি। উলটো ওঁকে খ্যাপানোর নামটা আরও ছড়িয়ে পড়েছিল, বেপাড়ায় গিয়েও আওয়াজ খেতেন, ‘আধুনিক কবি অনন্তচাদ’। কে প্রথম চালু করেছিল নামটা? নিশ্চয়ই কোনও নিরীহমুখী পাঠক। পাঠকটা তার আশপাশেরই কেউ, তাকে একবার হাতে পেলে দেখে নিতেন অনন্তচাদ। কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই চেনার, এ যেন বোটানিকাল গার্ডেনের বটগাছের চারার মতো চারিয়ে গেছে, আসল গাছটাকে চেনার জো নেই।… যাই হোক, এখন আপাতত লাইব্রেরি ঘাটে পৌঁছোতে হবে তাড়াতাড়ি, নরেন এতক্ষণে হয়তো ঘাটে চলে গেছে। অনন্তচাদ পা চালান, হাঁটার মধ্যে অল্প অল্প দৌড় মেশাতে থাকেন। নরেনকে মিস করা চলবে না। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় গিন্নিকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঠাকুরের পটে মাথা ঠেকিয়ে এসেছেন। বাড়ির ঠাকুরের প্রতি তাঁর ভরসা কম। অনন্তচাঁদ জানেন গৃহদেবতা তাঁর মতোই সীমিত ক্ষমতার অধিকারী। চলতে চলতে বাঁদিকে শীতলামাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার পড়ল, বিশাল দোকান, প্রচুর মিষ্টি। দোকানের মাঝে একটা থাম, থামে পেতল দিয়ে গাঁথা লাল তেলতেলে শীতলার মূর্তি, প্রাচুর্যের মধ্যে ওই মূর্তি মানায়, ভক্তি জাগে। লোকচক্ষুর অগোচরে শীতলার দিকে তাকিয়ে আধো চোখ বুজে, বুকে ডানহাতের মুঠি ঠেকালেন। এরপরই লাইব্রেরির মাঠ, পাশে গঙ্গার ঘাট।… ওই তো দেখা যাচ্ছে, নরেন ঘাটের ওপরের সিঁড়িতে বসে আছে। বাতাস ইতিমধ্যেই ওর চুল ঘেঁটে দিয়েছে। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামাতে নরেনকে বেশ মানিয়েছে, ওকে দেখে নিজের যৌবন বেলা মনে পড়তে চাইছে অনন্তচাদের। ঘাটে শেষ বিকেলের আলো। নরেনের কাছে জায়গাটা নতুন, ফলত ও একটু মোহমুগ্ধ। ঘাটের অন্যান্য সিঁড়িতে ছোট ছোট দল।
বুড়োর দল, ছোকরার দল, মাঝবয়সিদের দল। আর আছে মেলানো-মেশানো একটা দল। দলগুলোর সবাই অনন্তচাদকে চেনে, উনিও ওদের চেনেন। সবাই এখানকার পুরনো লোক, যখন তখন সেই আওয়াজটা উঠতেই পারে, তা হলেই নরেনের কাছে প্রেস্টিজ পাংচার। মিশন হ্যামপার হতে পারে। আজ বিকেলের আলোটা নিভতেই চাইছে না। একটু সন্ধে ধরে এলে তবেই নরেনের কাছে যাওয়া যাবে। কিন্তু ততক্ষণে ও যদি অধৈর্য হয়ে উঠে পড়ে… অনন্তচাঁদ একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে গঙ্গার হাওয়া আড়াল করে বিড়ি ধরালেন। বেশ সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। এর আগেরগুলো সামান্য অসতর্কতায় ফসকে গেছে। নরেন বীরনগরে নতুন এসেছে। উঠতি লেখক। পৈতৃক বাড়ি টালিগঞ্জে। বীরনগরে ব্যাঙ্কে পোস্টিং পেয়ে এসেছে। টালিগঞ্জ থেকে বীরনগর বেশ দূর, তাই এখানেই একটা ঘর ভাড়া করে থাকে। নরেনের সঙ্গে ব্যাঙ্কেই আলাপ। অনন্তচাঁদ একদিন ছোটমেয়ের টিউশনির টাকা মেয়েরই রেকারিং-এ জমা দিতে গিয়েছিলেন। মেয়ের সময় হয় না। সারাদিনে পাঁচটা টিউশনি করে, বাড়ি গিয়ে পড়ায়। প্রত্যেক বাড়ি অ্যাভারেজ দু’ঘণ্টা। ক্যাশ কাউন্টারে নতুন ছেলে দেখে অনন্তচাদের চোখ শিকারির মতন জ্বলে উঠেছিল। নতুন ও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ছেলে দেখলেই অনন্তচাদ কবি থেকে শিকারি হয়ে যান। ছোট মেয়েটাকে যে করেই হোক একটা প্রতিষ্ঠিতর সঙ্গে ঝোলাতে হবে। আগের মেয়ে দুটোর বিয়ে ঠিকঠাক হয়নি। বড়টার প্রথম বিয়ে টেকেনি, আবার বিয়ে করেছে। খুব একটা সুবিধের মধ্যে থাকে না বোধহয়। লোকমুখে শুনেছেন, মেয়েটা নাকি বেলা-অবেলায় কলকাতায় চাকরি করতে যায়। তবে রক্ষে কখনও বাপের বাড়ি এসে ওঠে না। মেজ মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে দিয়ে গেছে। উইথ টু নাতিস। ছোটমেয়ে লাগাতার টিউশনি করে আর রোগা হয়ে যায়। ছোট মেয়েটাকে একটা ভাল বিয়ে দিতেই হবে, এবার আর হারতে রাজি নন অনন্তচাঁদ।’ বিকেলের সূর্যের মতো ঢলে যাচ্ছে ছোট মেয়ের রূপ। অনন্তচাঁদ দৌড় শুরু করেছেন পড়ন্ত সূর্যের দিকে, যে করে হোক ছোট মেয়ের সিঁথির জন্যে লাল রং জোগাড় করতেই হবে, নইলে অস্তরাগ হবে কী করে?… এত সবের মধ্যে কী করে কবিতা লিখবেন অনন্তচাদ? লোকাল ছেলেছোকরারা তো এসব বুঝবে না, যেহেতু অনন্তচাদ কবি হতে পারেননি, মানে প্রতিষ্ঠিত কবি। বড় কাগজে কখনও লেখা বেরোয়নি। একসময় একটু ধরে বেঁধে কাউকে কাউকে কবিতা শোনাতেন, তাই আজ তাঁর পেছনে থেকে আওয়াজ ওঠে, ‘আধুনিক কবি অনন্তচাদ। আরে তোরা তো আধুনিক ছেলে। কেউ একজন বাপ কা বেটা এগিয়ে আয়, আমার ছোটমেয়ের ভার নে। বুক বাজিয়ে প্রতিজ্ঞা কর, কোনও অবস্থাতেই মেয়েকে বাপের বাড়ি ফেলে যাবি না। হুঁ, সে মুরোদ নেই। খালি মজা মারতে ওস্তাদ।… গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া অনন্তচাদের ঢোলা পাজামায় এসে ফতফত করছে। মাথা জোড়া টাকের ওপর দিয়ে হাওয়া কেঁদে যাচ্ছে, চুলের সঙ্গে খেলতে পারল না বলে। এমন সময় পাশ দিয়ে ভারী চেহারার একটা ছেলে বলতে বলতে গেল, কী অনন্তদা, কবিতা ভাবছেন?
মিঠে আওয়াজ। ছেলেটা বোধহয় প্রথম দিককার ব্যাচের। আওয়াজ দিচ্ছে, তবে একটু আলতো করে। আলো কমে আসছে, সন্ধের সঙ্গে হাঁটি হাঁটি পা পা করে অনন্তচাদ নরেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
কী ব্যাপার অনন্তদা! এত দেরি? আমি তো ভাবলাম আর এলেনই না।
অনন্তচাদ নরেনের পাশে বসতে বসতে বললেন, লিখতে লিখতে আটকে গিয়েছিলাম। কিছুতেই শেষ পয়ারটা গোছাতে পারছিলাম না (মিথ্যে বললেন অনন্তচাদ! কারণ কারখানা বন্ধ হওয়ার পর রোজকার মতন আজ বিকেলেও স্ত্রীকে আটা মেখে দিচ্ছিলেন)। আপনি বুঝি সন্ধেবেলাতেই লেখেন?
হ্যাঁ। তুমি?
রাত্তিরে। যখন চরাচর ঘুমে ডুবে যায়, তখন উঠে বসি। তবে সেটা আমি না অন্য কেউ জানি না!
অনন্তচাদ ভাবেন, এ তো আদ্যোপান্ত কবি! কিন্তু ছোটমেয়েটা তো আবার মায়ের ধরন পেয়েছে, নরেনকে কবি থেকে আটা মাখিয়েওলা না করে দেয়। সে যাই হোক এখন আপাতত সন্ধের গঙ্গায় ঘাপলা জাল ফেলতে হবে খুব নিভৃতে, আচ্ছা নরেন, এই লেখালিখিতে তোমার পারিবারিক মদত আছে না বাগড়া আছে?
না না বাড়ির লোক আমাকে উৎসাহই দেয়। তবে কাগজে রেগুলার নাম ছাপা না দেখলে সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করে।
তোমার মা-ই বোধহয় লেখার উৎসাহ দেন বেশি, নাকি?
আমার মা নেই। সেই ছোটবেলায় হারিয়ে গেছে।
অনন্তচাঁদ পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলেন না, হারিয়ে গেছে মানে কী? মারা গেছেন? নাকি আবার ফিরে আসবেন দজ্জাল শাশুড়ির ভূমিকায়।
বাবা এখনও চাকরি করেন?
হ্যাঁ। বাবা ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি ছাড়াও নিজের একটা কন্সালটেন্সি ফার্ম আছে।
বাঃ, তোমার ভাইবোনেরা কে কী করে?
আমার কোনও সহোদর নেই, আমি একা।
অনন্তচাদ মনে মনে বললেন, বাঃ বাবা বাঃ। তবে মুখে রইল কবির অটুট উদাসীনতা, যেন ধরা না পড়ে যান। পাত্র হিসেবে নরেন তো একেবারে হিরের টুকরো ছেলে, একে ছাড়া চলবে না। অনন্তচাঁদ বেশ বাবু হয়ে বসে নিয়ে প্রথম তিরটি ছাড়লেন, নাও নরেন, তোমার একটা কবিতা শোনাও। (অনন্তচাঁদ জানেন, কবি সব থেকে বেশি খুশি হয়, তার কবিতা কেউ শুনতে চাইলে। এমনকী অনেক কবি আত্মহত্যার দিনও পিছিয়ে দেয়।)
না না আগে আপনি শোনান।
আমি কী শোনাব, আমরা পুরনো লোক। এখন তো তোমরা বলবে। চলো শুরু করো। শুনবেন, তা হলে শুনুন। এটা সাপ্তাহিক ‘কবিতা ভাষা’তে বেরিয়েছিল, গভীর নিঃশব্দে তুমি নতজানু হও। ধীরে নত করা শির। সিঁথির রাঙাপথে ত্রি শিরা কাচের বর্ণচ্ছটা…
অনন্তচাদ আউট। মাথায় কিছু ঢুকছে না। অথচ এককালে ঢুকত। কত সন্ধে কেটেছে বড় বড় কবির সঙ্গে, সম্পাদকের সঙ্গে। কলকাতা থেকে থোকা থোকা কবি এসেছে ‘বীরনগর
কবি সম্মেলনে’। একবার সজলদা, কবি সজল সেন থেকে গিয়েছিলেন অনন্তচাদের বাড়িতে। সেদিন, প্রায় রাত জুড়ে কবিতা পাঠ হয়েছিল। সজলদা তখন সন্ধের মৌতাতে মাতোয়ারা। নেশার অতল থেকে অনন্তচাদের কবিতাগুলিকে বাঃ বাঃ করে যাচ্ছিলেন। এক একটা কবিতা পড়া শেষ হয়, আর সজলদা জড়িয়ে ধরেন অনন্তচাদকে। তারপর ভোর হলে, সজলদা ফোলা মুখে জল ছিটিয়ে সুরমাকে বললেন, বউঠান আসি, গতরাতে আপনি যা রান্না করে খাইয়েছেন না, কোনও দিনও ভুলব না। আবার হয়তো দুম করে চলে আসব কখনও।
অনন্তচাদের স্ত্রী এক মুখ উৎসাহ নিয়ে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আসবেন, যেদিন খুশি। সজলদা আর কোনওদিনই আসেননি। কিন্তু তিনি ওই যে একবারই এসেছিলেন, তাতেই অনন্তচাদ নিজের বাড়িতে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান।
গঙ্গার ওপর জলপুলিশের স্টিমারের আলো ঘুরছে। ঘাটেও এসে পড়ছে আলোর চাবুক। অনন্তচাদ মাথা নিচু করে নিচ্ছেন, মুখ নিচু করে নিচ্ছেন, পাছে ঘাটের অন্যান্যরা তাঁকে দেখে ফেলেন। নরেন কবিতা বলে যাচ্ছে। অনন্তচাঁদ বাঃ বাঃ করে যাচ্ছেন। একসময় কবিতা শেষ হল। শেষ কবিতাটা সূর্যগ্রহণ নিয়ে। কাল সূর্যগ্রহণ। আজ আকাশ নিকষ কালো। এত কালো যে, অনন্তচাদের বন্ধ কারখানার কালো শাটারকেও হার মানায়।
না অনন্তদা এবার আপনি শোনান, বলল নরেন।
অনন্তচাদ একবার ভাবলেন বলবেন, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল ঘর থেকে বেরোনোর মুখে সুরমার নির্দেশ, দেখো মেয়ের বিয়ের ধান্ধা করতে গিয়ে ভ্যাড়ভ্যাড় করে নিজের কবিতা বলে যেয়ো না।
একটা ছোট্ট ঢোক গিলে অনন্তচাদ বললেন, না ভাই তোমার কবিতাগুলো জাত কবিতা।
এখনও রেশ কাটেনি। এক্ষুনি আমার কবিতা বলে আমেজটা নষ্ট করতে চাই না। জলপুলিশের আলোয় নরেনের মুখ একটু খুশি খুশি মনে হল। তোষামোদে হিটলার পর্যন্ত গলে যেত, তো এই কচি কবি কোন ছাড়!
আচ্ছা অনন্তদা, আপনি কলকাতার কাগজে লেখা পাঠান না কেন?
আর ভাল লাগে না। তা ছাড়া এখন যারা বড় কাগজে কবিতা বিভাগ দেখে, তারা তো আমার থেকে বয়সে ছোট, আমার কবিতা মন্দ হলেও শুধু নাম দেখেই ছেপে দেবে। এটা আমি ঠিক পছন্দ করি না।
মুখে অনন্তচাদ যা বললেন তার উলটোদিকে মনে অন্য ছবি ভাসছিল, সেই সজলদা যিনি সেই রাতে দু’বার একস্ট্রা নেশাটা বমি করে ভাসিয়ে দেবার পর বলেছিলেন, ভাই অনন্ত, তুমি আমার অফিসে এসো, সঙ্গে কবিতাও এনো। কবিতা বিভাগের রন্তর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।
সজলদার বমি পরিষ্কার করতে করতে অনন্তচাদ সে রাতে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। এক শুভদিন দেখে বাড়ির ঠাকুরের পটে মাথা ঠেকিয়ে কিছু কবিতা নিয়ে সজলদার অফিসে গিয়েছিলেন। খানিকক্ষণ চোখ কুঁচকে থাকার পর সজলদা চিনতে পারলেন। তারপর অত্যন্ত অকবি সুলভ মুখে কবিতাগুলো চেয়ে নিয়ে বলেছিলেন, আমি রন্তকে দিয়ে দেব। পছন্দ, অপছন্দ ওর ব্যাপার।
সেদিন খুব সিরিয়াস ছিলেন সজলদা। কেন ছিলেন? ঘরের ঠান্ডা মেশিন কি ওঁর চোয়াল আড়ষ্ট করে দিয়েছিল? উনি এক চিলতে হাসতেও পারেননি। সে কবিতা ছাপা হয়নি। তারপর থেকে অনন্তচাদ শুধু ডাকে কবিতা পাঠিয়েছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। তখন কবিতা মনোনীত না হলে ফেরত আসত। উনি সেই ফেরত কবিতা বাড়ি অবধি আসতে দিতেন না, পোস্টাফিস থেকেই চিঠিপত্তর কালেক্ট করে নিতেন। পোস্টাফিসে তাঁর খাতির বেড়ে গিয়েছিল, কত চিঠি আসে বলে কথা।… এসব ভাবনার মাঝে একটা অল্পবয়সির দল অনন্তচাদের পেছনে দিয়ে নীচের ধাপে চলে গেল। অনন্তচাদের পিঠ বেয়ে শিরশিরে ভয় সাপের মতো মগজে সেঁধিয়ে গেল। নরেনের সঙ্গে এই নিভৃত আলাপচারিতার ফাঁকে দলটা যদি আওয়াজ দেয়। ভাবতে ভাবতেই আওয়াজ উঠল ‘আধুনিক কবি’ (একটু পজ দিয়ে) ‘অনন্তচাদ’ বলার মুখে, অনন্তচাদ খকখক করে কেশে নিলেন, যাতে নরেনের কানে না পৌঁছোয় আওয়াজটা। তারপর বললেন, চলো নরেন ওঠা যাক। এখনই!
হ্যাঁ ভাই, বাড়িতে কিছু কাজ আছে।
বেশ জমে উঠেছিল কিন্তু আড্ডাটা। বিভূঁইয়ে এসে আপনার মতো মানুষ পেয়ে যাওয়া বেশ ভাগ্যের ব্যাপার।
অনন্তচাঁদ বিগলিত হাসিটা তড়িঘড়ি করে সেরে নিয়ে বললেন, চলো চলো, এখানে বেশিক্ষণ বসে থাকলে ঘোর লেগে যাবে। এই গঙ্গার ঘাট আমাদের বীরনগরের গর্ব। তাই তো এখানে এত কবি আর কবির কদর।
ঘাটের তলা থেকে আবার আওয়াজ উঠল আধুনিক কবি পরের শব্দটা দু’জনের কাছে এসে পৌঁছোল না। তার আগেই ওঁরা বিপদসীমা অতিক্রম করে গেলেন।
বাড়ি ফিরে অনন্তচাঁদ এক গ্লাস জল চেয়ে বিছানার ওপর ধপাস করে বসলেন। জল এখন চাওয়াই যায়, কাজ অনেকটা এগিয়েছে। দ্যাট ইজ দ্য ফিফথ অপারেশন। আগেরগুলো কেউ কবি ছিল না। ফলে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ ছিল প্রমোটরের চামচা, কেউ ক্যারাটে শিক্ষক। আর একজন তো রাজনৈতিক পার্টির হোলটাইমার। আরও নানারকম। প্রত্যেকের সঙ্গে আলাপ জমাতে অনন্তচাদকে অনেক হোমওয়ার্ক করতে হয়েছে, তাদের বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে হয়েছে। তবুও শেষমেষ অকৃতকার্য। প্রত্যেক অসফলতার ধাপে ধাপে সুরমা বুড়ি হয়ে যাচ্ছে। অনন্তচাদের কিরণের পাশে সুরমাকে এখন অবাস্তব লাগে। অনন্তচাঁদ বলেন, সুরমা, সব সময় সংসার সংসার কোরো না, একটু লেখাপড়া করো। মনটা বাড়বে, ভাল থাকবে।
সুরমা শুনেছে। সে এখন শুধু পাত্রী চাই শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন পড়ে, কথামৃত পড়ার সময় পায় না। সন্তোষীমাতা ছাড়াও আরও দুটো ব্রত পালন করে, তখন পাঁচালি পড়তে হয়। সেও তো এক ধরনের পড়া। সন্ধেবেলায় সুরমা যখন গলায় আঁচল দিয়ে দুলে দুলে ব্রতকথা পড়ে, তখন তার আন্তরিকতা দেখে মনে হয়, সে যেন শুধু নিজের সংসারের জন্যে নয়, তাবৎ গৃহস্থের মঙ্গলের জন্যেই ব্রতকথা পড়ছে। সেই কমদামি ধূপের গন্ধ, হলুদ প্রদীপ
আলো, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ, সুরমার গুনগুন করে পড়া ব্রতকথা, সব মিলিয়ে একটা অসাধারণ কবিতা। সে কবিতার প্রথম লাইনটা খোঁজেন অনন্তচাদ। বাড়ির না সারাতে পারা টিভিটার জন্যে তাঁর কোনও আক্ষেপ হয় না, অচল টিভির পরদা জুড়ে বিনা আলোয় এক দুর্বোধ্য কবিতা ফুটে ওঠে।
সুরমা জল নিয়ে এল। জল হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে আজ কী হল না হল জানার ইচ্ছে। অনন্তচাদকে একটু ঠান্ডা হতে দিচ্ছে। অনন্তচাদের উদাসীন মুখ। অনেকদিন পর সাকসেস বোধহয় আসছে। এ সময় নির্লিপ্ত থাকার মজাই আলাদা।
কতদূর কী হল? গম্ভীর গলায় জানতে চাইল সুরমা।
মেরে এনেছি।
কী মেরে এনেছ?
কবিকে?
অ্যা এ পাত্রটা আবার কবি!
তো কী! দারুণ সফট হার্ট। নিশ্চয়ই নগদ নেবে না। বাবা-মা’র খবর নিয়েছ?
হ্যাঁ, বাবা বেঁচে আছে, ভাল রোজগার করেন। মা হারিয়ে গেছে।
কোথায়?
জানি না।
বামুন না কায়েত?
জানি না।
নিজেদের বাড়ি?
বলতে পারছি না।
ধ্যাত্তেরি নিকুচি করেছে। তা হলে কী এতক্ষণ ভ্যাজারাং করে এলে? যা কিছু জানতে চাই তাতেই জানি না।
শুধু জানি, ছেলেটা একটা কবি।
সুরমা মুখ ঝটকিয়ে বললেন, আধুনিক না অতি আধুনিক? এ প্রশ্নের মধ্যে আবার সেই ছেলে-ছোকরাদের আওয়াজটা উঠে আসছে দেখে অনন্তচাঁদ বাস্তবে ফিরে এলেন। বললেন, কী কথা বলব বলো? কোথাও একটু বসার উপায় আছে, দু’দণ্ড কথা বলার উপায় আছে? যেখান সেখান থেকে আওয়াজ দিয়ে দিচ্ছে চ্যাংড়ার দল। এরা আমায় পাগল করে দেবে। ভাবছি, এবার পিঠে পোস্টার ঝুলিয়ে বেরুব, তাতে লেখা থাকবে, ‘বিশ্বাস করুন, আমি আর কবিতা লিখি না।’
তাতে ওরা আরও খেপাবে। তুমি একদিন ছেলেটার বাড়ি যাও না। হ্যাঁ, তাই যাব ভাবছি।
এমন সময় ছোট মেয়েটা ফিরল, টিউশনি থেকে। চেহারা হয়েছে ঠিকে ঝিয়ের মতো। ক্লান্তিতে নুয়ে গেছে। মেজমেয়ের ছেলে দুটো দৌড়ে তাদের মাসির কাছে গেল। রোজ কিছু না কিছু চাই। কোথায় পাবে এত পয়সা? তবু হাসে, হেসে কিছু না কিছু ওদের দেয়।
তারপর মুখ হাত ধুয়ে এসে কিছু খেতে খেতে ওদের পড়াতে বসে। বিচ্ছু দুটো কিছুতেই অনন্তচাঁদের কাছে পড়তে বসতে চায় না। বলে, দাদু খালি উলটো পালটা গল্প বলে, কিচ্ছু বোঝা যায় না। মেজ মেয়েটা রান্নাঘরে বসে আছে। ও যে বাড়িতে আছে তা বোঝা যায় না। সারাদিনে বোধহয় দু’-একটা কথা বলে। কোনও কোনও দিন তাও না। ছোটমেয়েটা ফিরলে বাড়িটা তবু ঘর ঘর লাগে। বাচ্চাগুলো কিচিরমিচির শুরু করেছে। ছোটমেয়েটাও বকবক করছে, বাড়ি ফেরার ক’মিনিটের মধ্যেই ওর ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। এই হয়তো ওর মাকে বলছে, ওমা এটা করোনি কেন? ওটা করোনি কেন? অ্যাই মেজদি, তুই এখনও চুল বাঁধিসনি কেন? মেয়েটা দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে আর গলায় জোর বাড়ছে। সাজও বাড়ছে। গতসপ্তাহে বিউটি পার্লারে গিয়েছিল। টিউশনির টাকায় কি বিউটি পার্লারের খরচা চালাতে পারবে? আরও কি টিউশনি ধরবে?… কে জানে! তবে ঘরের এই হইচইয়ের মধ্যে অনন্তচাদ বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করেন। খাটের ওপর পেছন ঘষটে বিবর্ণ জানালার দিকে এগিয়ে যান। জানলা গলে আকাশ, ঝাঁক ঝাঁক তারা। কাল সূর্যগ্রহণ। নক্ষত্রদের বিরাট উৎসব। সমস্ত নক্ষত্র আজ পরম আনন্দে সাজছে। চাঁদ গেছে লজ্জায় লুকিয়ে। অনন্তচাদের মনে কবিতা বুড়বুড়ি কাটে। আঙুলগুলো অনিচ্ছাতেও নড়ে। হঠাৎ ছোটমেয়ে বলে, জানো বাবা, আমার বন্ধুরা কাল সূর্যগ্রহণ দেখতে ডায়মন্ডহারবার যাচ্ছে। আমিও ভাবছি যাব।
অনন্তচাদ বললেন, ভালই তো, ঘুরে আয় না। একটা রেয়ার এক্সপেরিয়েন্স হবে। লোকে বলছে, আগামী একশো বছরে আর এরকম সূর্যগ্রহণ হবে না। কী সব বলছে, ডায়মন্ড রিং হবে! দিনের বেলাতেই রাত নেমে আসবে। কাক ভুল করে কা কা করে বসবে। দারুণ হবে না রে?
গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। রাস্তার ওপর আলোটা ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে। মিউনিসিপ্যালিটির এবড়োখেবড়ো রাস্তার বাঙ্ময় ধুলোগুলো ক্রমশ নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে আবহাওয়ার অজানা পরিবর্তন দেখে। রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনন্তচাঁদ আর তাঁর ছোটমেয়ে রানি
রানিকে সুরমা ডায়মন্ডহারবারে যেতে দেয়নি। সুরমার কথামতো অনন্তচাঁদ তাঁর ছোটমেয়েকে নিয়ে চলেছেন নরেনের বাড়ি। সময়টা ভালই বেছেছে সুরমা, সবাই সূর্যগ্রহণ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, সেই সময় টুক করে ঢুকে যাবেন নরেনের বাড়ি। বাবা আর মেয়ে দু’জনেই মাথা নিচু করে হাঁটছে, যেন কোনও গোপন অভিযান। নরেনের ভাড়াবাড়িটা বাজারের ওপরই, তবে অন্যদিনের মতো ভিড়-ভাট্টা থাকবে না নিশ্চয়ই। মেয়েটার মন খারাপ ডায়মন্ডহারবার যেতে পারেনি বলে। বাধ্য মেয়ের মতো বাবার পিছু পিছু হাঁটছে। চারপাশে আলোর মধ্যে এক অলৌকিকতা শুরু হয়ে গেছে, আলোর শরীরে লেগেছে অসময়ে অস্তরাগ। এ ঠিক গোধূলি নয়, যেন গোধূলির দিদি। যেরকম দিদি খুব ছোটবেলায় সবাইয়ের হারিয়ে যায়। সেই দিদি ফিরে এসেছে আজ। তবে বোবা। প্রকৃতি বোবা হয়ে গেছে।
নিঃশব্দে নরেনের দরজার সামনে দাঁড়ান অনন্তচাঁদ। অনেক সাহসে ভর করে দরজার কড়া নাড়েন। মনে হয় যেন কোনও অতীতের কড়া নাড়ছেন। কড়ার শব্দটাও ভিন্ন।
দরজা খুলে যায়। দরজা খুলেই নরেনের একমুখ হাসি, আসুন অনন্তদা। নরেন রানিকে এখনও দেখতে পায়নি। রানি অনন্তচাদের আড়ালে।
আজ তো দারুণ দিনে এসেছেন, সঙ্গে কবিতা এনেছেন নিশ্চয়ই।
না। তবে কাকে এনেছি দেখো। এ আমার মেয়ে রানি।
অনন্তচাদ মেয়েকে এনে নরেনের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। রানিকে দেখে নরেনের চোখ স্থির, চোখে অপার বিস্ময়। অবাক হলেন অনন্তচাদ, রানি তো তত সুন্দরী নয়। এত মুগ্ধ হওয়ার কী আছে! তাকালেন মেয়ের দিকে। আরে, সত্যিই তো রানিকে আজ দারুণ দেখতে লাগছে! এ কি গোধূলির দিদির ছড়ানো রঙের জন্য?
রানি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নরেনের দিকে। অনন্তচাদ স্পষ্ট দেখতে পেলেন, রানির চোখে ক্রমশ কত না বলয় তৈরি হচ্ছে, ধীরে ধীরে তৈরি হল ডায়মন্ড রিং। অনন্তচাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন নিজের কবিতার দিকে। এসব কবিতার তো ছাপার আগেই মৃত্যু হয়ে যায়।
মুক্তকণ্ঠ (বাংলাদেশ) ১৯৯৮