শুদ্ধস্বর
বাস থেকে নেমে ঝিলম হাঁটার মধ্যে দৌড় মিশিয়ে দিল। বাড়ির দূরত্ব দু’মিনিটেরও নয়, তবু এত তাড়া কীসের? ঝিলম তো জানে, তার জন্য বাড়িতে কোনও আনন্দের খবর অপেক্ষা করে নেই। একটা বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। তা হলে কি ঝিলম সেইসব স্টুডেন্টদের মতো, অত্যন্ত খারাপ পরীক্ষা দিয়েও যারা রেজ়াল্ট আউটের দিন টেনশনে ভোগে? জানে ফেল করবে, তবুও? আসলে ওই চাপা উত্তেজনার মোড়কে থাকে ক্ষীণ একটা আশা! যদি ভুলক্রমে অন্য কারও নম্বর আমার মার্কশিটে লেখা হয়ে পাশ করে যাই… হয়তো সেরকমই একটা অনুকম্পা মেশানো প্রত্যাশা থেকে ঝিলম হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির গেট খুলল। প্রথমেই বাগান, মাঝে মোরাম বিছানো রাস্তাটা গিয়েছে মূল বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত। সেখানে পা দিয়েই ঝিলম টের পেল, দীপনদা আসেনি অথবা এসে ফিরে গিয়েছে। দীপনদার যেন গন্ধ পায় ঝিলম! বাসটা ফালতু ঝোলাল ডানলপে। বাড়ি ঢুকতে ঝিলমের পাক্কা আধঘণ্টা লেট।
ডোরবেল বাজাতে দরজা খুলে দিল মা। চটি ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে যায় ঝিলম। দীপনদার সঙ্গে আজ ওর দেখা হওয়াটা খুব জরুরি ছিল। কাঁধ থেকে কলেজব্যাগ নামিয়ে বিছানায় ছুড়ে দেয় ঝিলম। ঘুরে যায় ড্রেসিংটেবলের দিকে। আয়নায় দেখে মা জলের গেলাস নিয়ে ঢুকে এসেছে ঘরে। বলে, বাসে খুব ভিড় ছিল নাকি?
উত্তর না দিয়ে ঝিলম মায়ের হাত থেকে গেলাস নেয়। এক ঢোঁকে যতটুকু পারে জল খেয়ে ফেরত দেয় গেলাস। প্রশ্নটা দুটো কারণে করতে পারে মা। এক, তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দ্বিতীয়টা হল, ভিড় দেখে কয়েকটা বাস ছাড়ার জন্য তার বাড়ি ফিরতে বেশ খানিকটা দেরি। কোন কারণটা সঠিক, জানার উৎসাহ হয় না তার। ফিরে যাচ্ছে মা। এই মুহূর্তে ঝিলম যে ব্যাপারটা জানতে আগ্রহী, সেটাই জিজ্ঞেস করে, দীপনদা এসেছিল?
সামান্য ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝিমোনো গলায় মা বলে, এসেছিল। তোর জন্য একটা খাম রেখে গিয়েছে।
শুকনোমুখে ঘর ছাড়ে মা। মায়ের বিমর্ষতার কারণ ঝিলম নিজে। মা বোঝে, মেয়ে কী পরিমাণে দীপনের প্রেমে পড়েছে। শুধু মা কেন, দাদা, বাবা, কাজের লোক লক্ষ্মীদিও দিব্যি টের পায়। সম্প্রতি এটাও সকলে জেনেছে, দীপনদা এনগেজড। তার একজন আছে।
ড্রেসিং টুলে বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভেবে যাচ্ছে ঝিলম। মোটেই তাকে
কাহিল দেখাচ্ছে না। মাকে বরং ক্লান্ত দেখাচ্ছিল বেশি। তবু মুখটা ওড়না দিয়ে একবার মুছে নেয় ঝিলম। দীপনদার রেখে যাওয়া খাম নিয়ে কোনও কৌতূহল নেই তার। খামে কী
আছে, চিঠি? ঝিলম নিশ্চিত তাতে পজ়িটিভ কিছু লেখা নেই। প্রত্যাখান আছে। যে কথা দীপনদা মুখের উপর বলতে পারছিল না, সেগুলোই চিঠিতে লিখে দিয়েছে, সঙ্গে অবশ্যই গুচ্ছের সান্ত্বনা, যা সবচেয়ে বেশি অসহ্য!
টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ঝিলম। আয়নায় প্রতিবিম্বিত তার গর্জাস এবং এথনিক লুক সালোয়ার-কামিজ এখন উপহাসের মতো ঠেকছে। সাধারণত এত ঝকমকে ড্রেস পরে ঝিলম কলেজে যায় না। দীপনদা বলেছিল, তুমি ক্লাসিক্যাল গান গাও বলে চেহারার মধ্যেও একটা ধ্রুপদীভাব এসে গিয়েছে।
সেই ধ্রুপদিয়ানাকে শানিয়ে নিতে আজ এই ড্রেস। কিন্তু যার জন্য পরেছে ঝিলম, সে আর একটু অপেক্ষা করতে পারল না? ঝিলমকে চোখের দেখার আগ্রহটুকু নেই! ওয়ার্ডরোব খুলে ঝিলম টাওয়েল বের করে নেয়। ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমে ঢোকার আগে ভেসে আসে মায়ের গলা, এত বেলায় আবার মাথা ভেজাস না!
ঠান্ডা লেগে কালীপুজো চলে গিয়েছে। এখন অল্পস্বল্প হিম পড়ছে বিকেলে। মায়ের ভয়, মেয়ের গলা না বসে যায়! ঝিলম কিন্তু স্নান করবেই। শাওয়ারের অঝোর জলে সবচেয়ে ভাল আত্মগোপন করা যায়। কান্নাও হারিয়ে যায় সেই ধারায়। একে একে পোশাক খুলে ঝিলম আশ্রয় নেয় শাওয়ারের জলে। আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। এই প্রথম দীপনদার কাছে আলাদা সময় চেয়েছিল ঝিলম। বলেছিল, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। কোথাও একটু দেখা করবে?
অন্য কোথাও যাওয়ার কী দরকার! তোমাদের বাড়িতেই তো আসি আমি, বলেছিল দীপনদা।
বাড়িতে নিশ্চিন্তে কথা বলা যায় না। কখনও মা ঢুকছে, দাদা, বাবা…
ঝিলমের কথার মধ্যে হো-হো করে হেসে উঠেছিল দীপনদা। বলেছিল, কেন? তোমার কথা কি খুব লম্বা? কোনও ব্রেক চলবে না?
দীপনদার ওই সপ্রতিভতা আসলে অভিনয়। সে ভাল করেই জানে, কী ধরনের কথা বলতে চলেছে ঝিলম। এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই ব্যাপারটা হেসে হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা! ঝিলমেরও জেদ চেপে যায়। বলেছিল, ঠিক আছে। বাড়িতেই এসো, দাদা না থাকাকালীন। কথাটা নিরবচ্ছিন্নভাবে বলতে আমার ভাল লাগবে। কী? সাহস হবে তো আসার? নাকি দাদা, মানে তোমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার অজুহাত ছাড়া আসতে পারবে না?
একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল দীপনদা। বলেছিল, আসব।
তা আসার এই ছিরি! শাওয়ারের জল বন্ধ করে দেয় ঝিলম। একটু শীত-শীত করছে। টাওয়েল নিয়ে গা মুছতে থাকে। বাথরুমে একটা হাফসাইজ় আয়না আছে। কিছুদিন আগেও নিজের নগ্নরূপে বিভোর হত ঝিলম। ইদানীং তাকাতে ইচ্ছে করে না। শরীরে যখন পল্লবিত হচ্ছিল যৌবন, অন্যান্য মায়ের মতো ঝিলমকে নিয়ে কোনও টেনশনে ভোগেনি মা। আত্মীয় পরিজনের কাছে বলত, মেয়ে আমার একেবারেই মিশুকে নয়। ও আবার প্রেম করবে!
এই অমিশুকে ধরনটাকে স্কুল-কলেজের বন্ধুরা বলে এসেছে, ডাঁট! দেখতে সুন্দর, দারুণ গান গায়, বাবার পয়সা আছে… কারও ভুল ভাঙাতে যায়নি ঝিলম। অনেক কথা খরচ
করতে হত। অত এনার্জি ওর নেই। তবে ঝিলম কিন্তু আড়চোখে ছেলেদের দেখত। কান পাতত ওদের আলাপ-আলোচনায়, মন্তব্যে। কাউকেই ইমপ্রেসিভ মনে হয়নি। খামোকা সে কেন একজনকে ডেকে নেবে নিজের জগতে! সে তো গেট খোলা কোনও বাগান নয়। বাইশ বছরের জীবনে ঝিলম এই একবারই পথে বিছিয়ে রেখেছে ফুল। কিন্তু সেই মানুষটির যে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে ঝিলম। হাঁচি পড়ল একটা। কিচেন থেকে মা বলে উঠল, লাগালি তো ঠান্ডা? বারণ করলাম চুল ভেজাতে। দাঁড়া, গরম গরম কফি করে দিচ্ছি।
ঝিলমের বিছানাটা কারুকাজ করা একটা পালঙ্ক, ঠাকুরদার বিয়ের সময়কার। ঝিলম শখ করেই নিজের ঘরে নিয়েছে। এর উপর বসে রেওয়াজ করলে বেশ একটা পুরনো দিনের আমেজ এসে যায়। এখন সেখানেই বসেছে ঝিলম, পাশের টুল থেকে একটা ম্যাগাজ়িন তুলে ওলটাচ্ছে, মন দিয়ে দেখছে না কিছু। দীপনদার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল এই ঘরেই। বিছানায় বসে রেওয়াজ করছিল ঝিলম। তানপুরা ছাড়তে ছাড়তে চোখ বুজে গাইছিল মেঘমল্লার। গুরুজি বলেন, প্রত্যেক রাগের একটা রূপ আছে, গাইতে গাইতে সেটাকে আবিষ্কার করো।
বর্ষা এবার এসেছে দেরিতে। মল্লার গেয়ে মেঘলা আবহ তৈরি করতে পারছিল না ঝিলম। সেদিন রেওয়াজকালীন কেন জানি বছরের প্রথম বৃষ্টির গন্ধ পেয়েছিল সে। ভেবেছিল গান শেষ করে দেখবে, সত্যিই বৃষ্টি পড়ছে কি না। চোখ খোলার পর দেখেছিল তাকে, ঝাঁকড়া চুলে যার বৃষ্টির ছাঁট। অপার মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে ঝিলমের দিকে। আরে, কোথা থেকে এল এ? ছাদ ফুঁড়ে নামল নাকি? এর নাম কি মল্লার?
ঘরে ঢুকে আসল ব্যাপারটা ভাঙল দাদা। বলল, এ হচ্ছে দীপন। আমাদের আর্টক্যাম্পে ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দারুণ ছবি তোলে। আমার আঁকা দেখতে এসেছিল। তোর গান শুনে নেমে এল নীচে।
ঘোর কাটিয়ে দীপনদা তখন বলে উঠেছিল, আপনি তো এই বয়সে দারুণ গান!
ঝিলম লজ্জা লজ্জা ভাব করছিল। দাদা বলে উঠে, ওকে আবার আপনি-আজ্ঞে করছিস কেন? ক্লাসিক্যাল গায় বলে? মা-বাবা সবসময়ই হ্যান্ডল উইথ কেয়ার রাখে ওকে। তুই আর মাথায় তুলিস না। এদিকে আমি বাড়িতে একেবারেই পাত্তা পাই না।
দাদা মিথ্যে বলেনি। নিঃসঙ্গতা ঝিলমের প্রিয় সঙ্গী বলে মা-বাবা ঝিলমকে বড্ড আগলে আগলে রাখে। দু’জনের জোরাজুরিতে রবীন্দ্রভারতীতে গিয়ে মিউজিকে মাস্টার্স করতে হচ্ছে। তাতে নাকি ঝিলম একটু সামাজিক হবে! বাড়িতে এসে গুরুজি যা শিখিয়ে যান, সেটাই যথেষ্ট ছিল। দাদার স্বভাব ঝিলমের বিপরীত, বাইরে থাকতেই বেশি ভালবাসে। সার্কল বিরাট। মা-বাবা জানে, দুঃখ-কষ্টগুলো দাদা বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে বন্ধু পারবে।
শুরু হল দীপনদার যাতায়াত। দাদার সঙ্গে আড্ডা মারার পর পনেরো-কুড়ি মিনিটের জন্য ঝিলমের গান শুনতে আসত। রেওয়াজের মধ্যে চোখ খুলে ঝিলম যাকে দেখত, সে যেন পথভ্রষ্ট কোনও যুবরাজ! চলে এসেছে নির্জন এক দ্বীপে। এক মাথা অবিন্যস্ত চুল,
শার্টের দুটো বোতাম খোলা, বেশিরভাগ সময় জিন্স। ঝিলমের এতদিনের গাওয়া একাকী সুর টেনে নিয়ে এসেছে তাকে।
আগে ভ্রূ প্লাক করতে মা ঠেলে পাঠাত পার্লারে। ঝিলম এখন নিজেই যায়। রেওয়াজে বসার আগে আলতো লিপস্টিক ছোঁয়ায় ঠোঁটে। ইদানীং নতুন নতুন শাড়ি ভাঙা হচ্ছে। মা একদিন বাঁকাভাবে সোজা কথাটা জানতে চাইল, হ্যাঁরে, বাবলুর বন্ধুটা তোর জন্যই একটু বেশি বেশি আসছে নাকি বাড়িতে?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমিই জেনে নিয়ো, বলেছিল ঝিলম।
মা বলে, আমার জানতে চাওয়াটা মোটেই ভাল দেখায় না। কষ্ট করে দুটো কথা খরচ করে তুমি ব্যাপারটা নিজে পরিষ্কার হয়ে নিয়ো। বাস্তবজ্ঞান বলে কোনও বস্তু তো মাথায় নেই তোমার! অর্থাৎ প্রেমটাকে পাকা করে নিতে বেখেয়ালি মেয়ের হুঁশ ফেরাল মা। অত সরাসরি কি জানতে চাওয়া যায়! একটু ঘুরিয়ে ঝিলম একদিন দীপনদাকে বলল, তুমি তো উচ্চাঙ্গসংগীত নিয়ে সেভাবে চর্চা করো না! তোমার নিজের বিষয় নয়। তবু এত ভাললাগা আসে কীভাবে?
দীপনদা বলেছিল, এইসব রাগরাগিণী এককালে রাজা-বাদশাদের কেনা ছিল। দরবারের দেওয়ালে আছড়ে পড়ত গায়ক-গায়িকার বিষাদ ও আবেগ। তোমার গানে আমি সেই ইতিহাসের স্পর্শ পাই। বিশেষ করে তুমি যখন বাঁ হাতে কান আড়াল করে…
কথা কেড়ে নিয়ে ঝিলম বলেছিল, বাইজি মনে হয়? ভুল কিছু মনে হয় না। আমরা তো ইতিহাসের সেইসব দুঃখী বাইজিদের সুরই বহন করে চলেছি।
এই ধরনের দার্শনিক আলোচনার মধ্যে কি জিজ্ঞেস করা যায়, তুমি কি আমার প্রেমে পড়িয়াছ?
গত মাসে কলেজে অ্যানুয়াল ফাংশন ছিল। ঝিলম গাইবে।
দীপনদাকে বলেছিল, তুমি তো শুধু আমার রেওয়াজ শোনো। স্টেজে কেমন গাই শুনবে না?
অডিটোরিয়ামে এসেছিল দীপনদা। ঝিলম গাইতে গাইতে তাকে আবিষ্কার করে শ্রোতাদের একেবারে শেষ সারিতে। একটু চোখ নামিয়েছে ঝিলম। ফের তাকাতে দেখে, দীপনদা উধাও। পারফরম্যান্সের শেষে বন্ধু, গুণমুগ্ধদের ভিড় এড়িয়ে ঝিলম যখন একটু একা হয়েছে, দীপনদা পাশে এসে দাঁড়াল। বলেছিল, সুপার্ব গেয়েছ! কেয়া বাত! মনে হচ্ছিল পাকা কোনও গায়িকার সিডি শুনছি।
পুরোটা শুনেছ? তোমাকে একবারই মাত্র দেখলাম।
ঝিলমের কথার পিঠে দীপনদা বলেছিল, একটু শুনেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। অসাধারণ এক সন্ধে নামছিল। ঘরে ফিরছিল পাখি। গোটাটাই মনে হচ্ছিল তোমার সুর লয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঘটছে। তুচ্ছ মনে হচ্ছিল আমার ছবি তোলাকে। আমি ক্ষণিকের বাস্তব ছাড়া কতটুকুই বা প্রকাশ করতে পারি।
এটা যদিও বিনয়। ইতিমধ্যেই ঝিলমের বেশ ক’টা ভাল ছবি তুলে দিয়েছে দীপনদা। ঝিলম যে দেখতে এত সুন্দর, নিজেও জানত না! সেদিন প্রোগ্রাম শেষে একসঙ্গে বাড়ি
ফিরতে চেয়েছিল ঝিলম। দীপনদা বলল, জরুরি একটা কাজ আছে তার। ক্যাম্পাসটুকু পেরিয়েছিল দু’জনে। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাজুয়ালি দীপনদার হাতটা ধরেছিল ঝিলম। অযথাই পকেট থেকে মোবাইল বের করে কী যেন দেখল দীপনদা। আসলে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার ছল। ঝিলম তখন ভেবেছিল ক্যাম্পাসের অত স্টুডেন্টদের মধ্যে হয়তো অস্বস্তি বোধ করছে! এখন প্রকৃত সত্যটা জানে। পরদিন ছুটি ছিল কলেজ। দশ-বারোটা এসএমএস জমা হল মোবাইলে। মেয়ে সহপাঠীরা জানতে চেয়েছে, কে এই হ্যান্ডসাম? সত্যি করে বল।
ঝিলম কোনও রিপ্লাই দেয়নি। তবে পরদিন ক্লাসে ঢুকেই স্বীকার করে নিয়েছিল, হি ইজ্ আ ভেরি স্পেশ্যাল ফ্রেন্ড!
বান্ধবীরা বলাবলি করছিল, তাই বল। এমন ভাব করে থাকিস, যেন চোখ দিয়েও কোনও ছেলেকে স্পর্শ করিসনি। তা ছেলেরাই বা তোকে আনডিস্টার্বড রাখবে কেন? কেউ প্রপোজ করলে হ্যান্ডসামকে নিশ্চয়ই একবার দেখিয়ে দিস, তাই না? তবে মানতে হবে তোর চয়েস! ওর সঙ্গে কোনওদিন কাট্টি হয়ে গেলে বলিস প্লিজ।
সেভাবে ভাবই হল না তো ঝগড়া! ‘দীপন’ নামের এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল ঝিলম। দাদা ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে সতর্ক করতে গেল। কিন্তু ততদিনে যে অনেকটাই ভেসে গিয়েছে সে। বাইরের গল্প দাদা বড়-একটা করে না। কিছুদিন আগে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে বলল, বুঝলি বোন, আজ সলিড খাওয়া দাওয়া হল। কে খাওয়াল বল তো?
তোর সেই বন্ধুটা, যে আজ সকালে বাবার পকেট মেরেছে!
মোটেই না। খাওয়াল সন্দীপ্তা। দীপনের গার্লফ্রেন্ড, আই মিন প্রেমিকা। হেভি বড়লোকের মেয়ে। দেখতেও হাইফাই, নিজে গাড়ি চালায়। বলছিল, একদিন ট্রিট দেবে। আজ দিল সেটা।
গায়ে বাজ পড়া সত্ত্বেও গাছেরা যেমন আর্তনাদ করতে পারে না, ঠিক সেরকমই নির্বাক, বিধ্বস্ত হয়ে বসেছিল ঝিলম। তবে বাজটা সরাসরি তার গায়ে পড়েনি, বাড়ির কার্নিশটা যেন ভেঙে দিয়ে গিয়েছে, ব্যথাটা এই অজুহাতে ভুলতে চাইছিল সে। পরে সারাটা সময় নিজেকে বোঝাল, দাদা হয়তো পুরোটা ঠিক জানে না। সন্দীপ্তা ওর শুধুই বন্ধু। বোন দীপনের সঙ্গে বেশি জড়িয়ে গিয়ে ভবিষ্যতে যাতে ধাক্কা না খায়, তার জন্যই দাদার আগাম সতর্কতা। ঝিলমের ভাবনা আছড়ে পড়ল পরের দিনই। দীপনদা এসেছিল দাদার সঙ্গে আড্ডা মারতে। নীচের ঘরে গেয়ে যাচ্ছে ঝিলম, তার আসার নাম নেই। গান বন্ধ করে ঝিলম উঠে গিয়েছিল উপরে। দীপনদাকে বলেছিল, কী এতক্ষণ বকবক করছ! চলো না নীচে। হাত ধরে দীপনদাকে টেনেছিল ঝিলম। এবার কোনও ছলনা নয়, হাতটা স্পষ্টতই ছাড়িয়ে নিয়ে দীপনদা ঈষৎ গম্ভীর গলায় বলেছিল, তুমি যাও, আসছি।
তখন থেকেই ঝিলমের গলায় একটা কষ্ট দানা বেঁধে আছে। ঠিকমতো রেওয়াজ করতে পারছে না। সেদিন অনেক পরে দীপনদা এসেছিল ঘরে। ঝিলম তখনই আলাদা দেখা করার প্রস্তাব দেয়। ঠিক হয় বাইরে নয়। মঙ্গলবার বিকেলে বাড়িতেই আসবে দীপনদা। দাদা তখন বাড়ি থাকে না। এসেছিল, দেখা হল না।
কী রে, কখন কফি দিয়ে গিয়েছি, এখনও ছুঁসনি? ঠান্ডা হয়ে গেল যে…
মায়ের ডাকে চমকে সংবিৎ ফেরে ঝিলমের। বিছানার পাশের টুলে কফির কাপ আর একটা এনভেলপ। এটাই নিশ্চয়ই দিয়ে গিয়েছে দীপনদা। ঝিলম অবাক হয়, মা এগুলো কখন দিয়ে গেল। খেয়ালই পড়েনি। এত অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে!
দাড়া, কফিটা গরম করে এনে দিই, বলে মা কাপটা তুলে নেয়, চলে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে। পড়ে রইল খাম, যা হয়তো কফির চেয়েও ঠান্ডা। এনভেলপটা হাতে নেয় ঝিলম। অলসভাবে স্টেপলার মারা মুখটা খোলে। একটা মেয়ের ছবি, ব্যাকগ্রাউন্ডে গঙ্গা। সম্ভবত মিলেনিয়াম পার্ক। ছবির সঙ্গে একটা চিরকুটে দু’লাইনের চিঠি। ছবিটা সন্দীপ্তার। আমার তোলা। কেমন হয়েছে? সন্দীপ্তার কথা নিশ্চয়ই বাবলুর থেকে শুনেছ। ছবিটা ওকেই দিয়ো। বাকি সব বলা আছে।
দীপন
ছবি দেখিয়ে এভাবে প্রত্যাখ্যান আশা করেনি ঝিলম। বোঝা যাচ্ছে, খামটা শুধু শীতল নয়, এর মধ্যে একটা বরফের ছুরিও ছিল।
জানলার বাইরে পুরোপুরি সন্ধে নেমে গিয়েছে। খাম, ছবি নিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে ঝিলম। দাদা ফেরেনি। এখনই এগুলো ওর ঘরে গিয়ে রেখে আসবে। এই বিষয়ে কোনও কথা হোক, ঝিলম চায় না।
না চাইলেও প্রসঙ্গ সেই উঠলই খাবার টেবল-এ। ঘণ্টা দু’য়েক হল দাদা ফিরেছে, হাতমুখ ধুয়ে সোজা চলে গিয়েছিল স্টুডিয়োতে। টানা কাজ করে গিয়েছে। কাজটা কী, জানাল এখন। সন্দীপ্তার কাল জন্মদিন। ওর ছবিটা দাদাকে দিয়ে অয়েলপেন্ট করিয়ে দীপনদা গিফ্ট করতে চায়।
দাদাটা এত চালাক, কথাটা বলল ঠিক খাওয়া শেষ হওয়ার সময়। পাছে বোন না খেয়ে উঠে যায় ! না, ঝিলম ঠিক করে নিয়েছে, কোনও ধরনের সিন সে করবে না। মাথা নামিয়ে দাদার কথাটা শুনল। বুঝতে পারছিল মা কী নিদারুণ করুণাঘন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। বাবা অবশ্য সিচুয়েশনের গুরুত্ব বোঝেনি। খানিক উদ্বেগসহ দাদাকে বলল, কালকের মধ্যে নামাতে পারবি ছবিটা? রাত জাগতে হবে মনে হচ্ছে!
তা ছাড়া উপায় কী? বলে, হাত ধুতে উঠে গেল দাদা।
রাত তিনটের পরেও দাদার ঘরের আলো পড়ে রইল পিছনের বাগানে। গোটা রাত দাদা কোনওদিনই জাগতে পারে না। ঝিলম নিশ্চিত যে, আলো জ্বালা অবস্থায় দাদা ঘুমিয়ে পড়েছে। নির্ঘুম শয্যা থেকে উঠে আসে ঝিলম। ছবিটা কতদূর এগোল দেখতে হবে।
যা ভেবেছিল তাই। দাদা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়, আঙুলে ধরা রং মাখানো তুলি। পাশেই স্ট্যান্ডে সন্দীপ্তা। নদীটা রেখেছে দাদা, পার্কটাকে করে দিয়েছে জমিদারবাড়ির বারান্দা। কী ডিগনিফায়েড লাগছে সন্দীপ্তাকে। ওর হাসি দেখে মনেই হচ্ছে না, কষ্ট বা প্রত্যাখান বলে কোনও শব্দ ডিকশনারিতে আছে। অসম্ভব পরিতৃপ্ত, সুখী মুখ। হঠাৎই
যেন ছবিটা কথা বলে উঠল, খুব দুঃখ পেয়েছ ঝিলম? কিন্তু কী করার আছে বলো, ও অনেকদিন ধরেই আমার!
এত রাগ কোনওদিন হয়নি ঝিলমের, কানদুটো যেন গরম হয়ে পুড়ে যাচ্ছে! সন্দীপ্তা আর কিছু বলার আগেই ঝিলম ঝাঁপিয়ে পড়ে ছবিটার উপর। সব শক্তি দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে দেয় ক্যানভাসটা। ফোটোগ্রাফটা রাখা ছিল পাশের টুলে। ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে সেটাও। এরপরই ভারী মুশকিলে পড়ে যায় ঝিলম। এতসব জিনিস সরাবে কোথায়? লুকিয়ে তো ফেলতেই হবে। এই কীর্তি দেখলে বাড়ির লোক তাকে পাগল ভাববে।
মাথায় আসে বাগানের কথা। লাশ সরানোর ভঙ্গিতে নিঃশব্দে ছেঁড়া ক্যানভাস, ফোটোগ্রাফ নিয়ে সিঁড়ি ধরে নামতে থাকে ঝিলম। বাগান এখন প্রায় জঙ্গল হয়ে আছে, প্রচুর গাছ, টব, সেগুলোর পিছনেই গুঁজে দেবে সন্দীপ্তাকে।
অ্যাই বোন, বোন! শুনে যা।
দাদার ডাকে ঘুম ভাঙল সকালে। নিমেষে একটা ভয় ঝিলমকে জাপটে ধরল। ছবি উধাও দেখে দাদা নিশ্চয়ই হুলস্থুল বাধিয়েছে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে ঝিলম। অনেক বেলা অবধি ঘুমিয়েছে। ঘরময় আলো। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে দাদা এল ঘরে। বলল, ছবি কমপ্লিট। কাজ আছে, বেরোচ্ছি। দীপন এলে প্যাক করে দিস।
ঘর ছেড়ে চলে গেল দাদা। এতক্ষণে বিভ্রম কাটল ঝিলমের। না, ছবিটা শেষ পর্যন্ত নষ্ট
করেনি ঝিলম। করে কোনও লাভ হত না। সন্দীপ্তা থেকেই যেত দীপনদার কাছে! ঝিলমের মাথা এখন একদম ঠান্ডা। বিছানায় বসেই মায়ের উদ্দেশে গলা তোলে, মা, চা… আশ্চর্য হয়ে অনুভব করে গলায় দানা বাঁধা কষ্টটাও কখন জানি বিদায় নিয়েছে।
দাদা বেরোনোর বেশ খানিকক্ষণ পর দীপনদা এল। ঝিলম নিয়ে এসেছে দাদার স্টুডিয়োতে। ক্যানভাসের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে দীপনদা। বলল, রিয়েলি, বাবলু একটা জিনিয়াস! কী সুন্দর এঁকেছে না ছবিটা?
ঝিলম বলে, সন্দীপ্তাও যে খুব সুন্দর!
একটু যেন লজ্জা পেল দীপনদা। স্ট্যান্ড থেকে ক্যানভাসটা নামিয়ে ঝিলম ব্রাউন পেপারে র্যাপ করতে বসে। দীপনদাও হেল্প করছে। প্রথম বৃষ্টির গন্ধ এখনও দীপনদার শরীরে। কাজ করতে করতে ঝিলম অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, কাল আর-একটু ওয়েট করতে পারতে…
সরি, এমন একটা আর্জেন্ট ফোন এসে গেল।
কালকের কথাটা আজ বলি তা হলে?
ভ্রূ দুটো ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে দীপনদার। ঝিলম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। চোখ নামিয়ে বলে, কথাটা খুবই পুরনো। অনেক সময় না বললেও বলা হয়ে যায়। কিন্তু কিছু হাঁদাগঙ্গারামদের জন্য বলতেই হয়। চোখ তোলে ঝিলম। দীপনদা এবার রীতিমতো কনফিউজড। ধরতে পারছে না ঝিলম কী বলতে চলেছে। একইরকম নিরুত্তাপ গলায় ঝিলম বলে, আমি তোমায় ভালবাসি দীপনদা।
দৃশ্যতই দীপনদা ছিটকে একটু পিছিয়ে যায়। খুবই অপ্রতিভ লাগছে তাকে। খানিক আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু তুমি তো সবই জানো, মানে সন্দীপ্তার ব্যাপারটা।
ঝিলম বলে, সদ্য জেনেছি। তাতে কী হয়েছে? আমার ভালবাসাটা তো মিথ্যে হয়ে যায়নি। আমি আজীবন তোমার হয়েই থাকব। সন্দীপ্তা তোমাকে শুধু কাছে পাবে, এই যা।
দীপনদার ধন্দ এখনও কাটেনি। আক্ষরিক অর্থেই ‘হাঁ’ হয়ে তাকিয়ে আছে। ফের হাসে ঝিলম। বলে, তুমি যে ভয়টা পাচ্ছ, সেটাই ঘটবে। আমি কোনওদিনই বিয়ে করব না। তা হয় না ঝিলম, প্রায় আঁতকে উঠে বলে দীপনদা।
ঝিলম বলে, হয়। প্রেম কখনওই কারও কুক্ষিগত সম্পত্তি হতে পারে না। সন্দীপ্তারও না। প্রেমের ক্ষেত্রে ‘অধিকার’ শব্দটা বাতিল। কোনও মোনোপলি চলে না। এসব শুনে তুমি আবার আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়ো না। যদি দাও, তাতেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। আমি যেসব বাইজিদের উত্তরসূরি, তাদের জীবনেও অনেক না পাওয়া ছিল! খুবই বিপর্যস্ত লাগছে দীপনদাকে। বেচারা! ব্রাউন পেপারে মোড়া সন্দীপ্তার ছবিটা
এগিয়ে দেয় ঝিলম।
দাদার ঘরের জানলা দিয়ে বড় রাস্তা দেখা যায়। আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দীপনদার যাওয়া দেখল ঝিলম। দৃষ্টি ফেরত আনতে গিয়ে চোখ আটকাল বাগানে। কাল রাতে যেসব টবের আড়ালে গুঁজে দেবে ভেবেছিল সন্দীপ্তার ছবি, সেখানে এখন বেশ ক’টা কমলা রঙের জিনিয়া ফুল মাথা নাড়ছে…
উনিশ কুড়ি জানুয়ারি ২০১০