বিউটি স্পট
তৃণাকে নিয়ে একটা গল্প লেখা উচিত। তৃণা আমার প্রেমিকা। আমি লেখক নই। তৃণা আমার জন্য যা করল, প্লটটা কোনও লেখককে দিলে হয়তো লুফে নেবে। ‘হয়তো’ এই কারণে বলছি, প্লটটার মধ্যে একটা গরিব মেয়ের প্রেমিকের জন্য আত্মত্যাগের ব্যাপার আছে। এসব আজকাল গল্প-উপন্যাসে চলে কি না, জানি না। লাস্ট কবে গল্পের বই পড়েছি মনে নেই। তবে তৃণার সঙ্গে সিনেমা দেখি। আর কখনও বাড়িতে আলগোছে টিভি, তৃণার মতো কোনও চরিত্র সিনেমা সিরিয়ালে দেখা যায় না। লোকে ওসব খায় না এখন। এককালে খেত। বাস্তবধর্মী ছবির ঢল নেমেছিল সিনেমায়। আমার বাবার মতো আবেগসংযত মানুষকেও দেখেছি নিষ্পলক হয়ে কাঁদতে। আমরা তখন পাশে সেনগুপ্তদের বাড়িতে টিভি দেখতে যেতাম। ভাল কোনও সিনেমা থাকলে কাকাবাবু বাবাকে ডেকে নিয়ে যেতেন।
দিদির থেকে আমার বয়সের গ্যাপ অনেকটা। আমার পরে বোন। দিদি কলেজে ঢুকতে আমার প্রাথমিক শিক্ষক বাবা ইনস্টলমেন্টে টিভি কিনলেন। ধিঙ্গি মেয়ে পরের বাড়িতে টিভি দেখতে যাওয়া ভাল দেখায় না। বাবার পছন্দসই প্রোগ্রাম দেখতে দিত না দিদি। বলত, পরদায় বাস্তবটা দেখে কী হবে! সেটা কীরকম, আমরা তা জানি। সবসময় ফেস করছি। রংচঙে সিনেমা দেখে কিছুক্ষণের জন্য সেসব ভুলে থাকাই ভাল।
বাবার উত্তর ছিল, সত্যকে ভুলে থাকলে আখেরে নিজেরই ক্ষতি। লড়াই করার প্রস্তুতি থাকে না।
দিদি তর্ক জুড়ত। দারিদ্র্যকে ফলাও করে দেখানোর মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। বিদেশে প্রাইজ পাওয়ার জন্যই ডিরেক্টররা ওই সব গরিব মার্কা ছবি তৈরি করে। পৃথিবীসুদ্ধু লোক দেখে আমরা কত গরিব। এভাবে নিজের দেশকে অপমান করার কোনও মানে হয় না।
দিদির যুক্তিটা আমার মনে ধরেছিল খুব। বড় হয়ে যখন কলকাতার কলেজে পড়তে আসি, ফরেনারদের গরিব মানুষের ছবি তুলতে দেখলে মাথা গরম হয়ে যেত। একবার এক বিদেশিকে টানা তিন মিনিট বাংলায় গালাগাল দিয়েছিলাম।
আমাদের বাড়িতে একদিন মাছ, একদিন ডিম, মাসের প্রথম রোববার মাংস বরাদ্দ ছিল। এই সামান্য আয়োজনের ছাপ দিদির আচার-ব্যবহারে পড়ত না। পাড়ার গাড়িওলা বাড়ির একমাত্র মেয়ে সুছন্দাদির সঙ্গে এমনভাবে মিশত, যেন আমাদের গাড়িটা আপাতত গ্যারেজে গেছে। দিদির ধরনটা পাড়ার অনেকেই রপ্ত করে নিল ধীরে ধীরে। গরিব বড়লোক আলাদা করার উপায় নেই। দেনার দায়ে বিকিয়ে গিয়ে পাড়ার দু’জন সুইসাইড করার পর জানা যায়, ভিতর ভিতর তারা কত গরিব হয়ে গিয়েছিল। আমাদের অবস্থা কিন্তু পড়েনি।
সমস্ত সঞ্চয় শেষ করে দিদি বোনের বিয়ে দিয়ে বাবা মারা গেছেন। আমি চাকরি করি কয়েল ফ্যাক্টরিতে। মাসে আমাদের বাড়িতে খাওয়ার মেনু একই আছে। ‘অভাব’ শব্দটা আমাদের বাড়ির চেনা টিকটিকির মতো। এ ব্যাপারে আমাদের কোনও আত্মগ্লানি নেই। বাবা তৈরি করে দিয়েছিলেন এই মনোভাব। মা সংসারের টানাটানি নিয়ে অনুযোগ করতে গেলে বলতেন, গীতা, তোমার যা আছে, ততটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে শেখো। এর পর যদি আমায় আয় বাড়াতে হয়, ভিক্ষে ছাড়া উপায় নেই। তোমার ছেলেমেয়েরা তখন ভিখিরিসন্তান বলে পরিচিত হবে।
দিদির বিয়ে সিনেমায় দেখা বড়লোক ঘরে হয়নি। দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। আমরা জানি, পঞ্চাশ হাজার টাকার চেয়ে দামি কোনও রোগ হলে মৃত্যু মেনে নিতে হবে। এই নিয়ে বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা না করে আমরা মোটামুটি সুখেই আছি। কারও কাছে হাত পাতছি না, মার্কেটে কোনও লোন নেই। যদিও কিছুদিন হল জেনেছি, এ দেশের প্রতিটি শিশু কত লক্ষ টাকার লোন মাথায় নিয়ে নাকি জন্মায়। সে হোক গে, ডাইরেক্ট শোধ তো দিতে হচ্ছে না।
আমাদের মতো আপাতত স্বস্তি নিয়ে এ দেশে অনেক পরিবার দিনযাপন করছে। এর মধ্যে লক্ষণীয় কিছুই নেই। তাই আমাদের নিয়ে কোনও সিনেমা, গল্প হয় না। তবু এই বাঁধাগতের জীবনধারাকে কেউ কেউ হঠাৎ অদ্ভুত ব্যঞ্জনাময় করে তোলে। তৃণা সেরকমই একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রেমিকার প্রতি আমার এই গদগদ ভাব দেখে যে-কোনও মানুষ ভাবতেই পারে, স্ত্রৈণর রোলমডেল হতে চলেছি। তাদের ভ্রান্তি কাটাতে বলি, তৃণা সামনের কয়েক বছরের মধ্যে বিয়ে চায় না। না চাইতেই সময় দিয়েছে আমাকে।
বিষয়টা এবার একটু ভেঙেই বলা যাক। তৃণা আর আমার প্রেম পাঁচ বছরের। তিন বছরের মাথায় আমি চাকরি পাই। তৃণা তখন গ্র্যাজুয়েশনের লাস্ট ইয়ার। ভয় ছিল পাশ করেই হয়তো বিয়ের জন্য চাপ দেবে। দিল না। বলল, তোমার যা রোজগার, এতে সংসার চালানো যাবে না। আমি কিছু একটা করলে তখন বিয়ে করব।
পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগল তৃণা। গত পরশু ও ‘কিছু একটা পেয়েছে’। প্যারাটিচারের চাকরি। মাইনে কাছাকাছি তিন হাজার।
খবর যখন দিল আমি যথাসম্ভব একটা নকল উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম ওর পরের প্রস্তাবের জন্য: ‘চলো, এবার আমরা বিয়ে করে ফেলি।’
আমাকে অবাক করে তৃণা অন্য কথা বলে। বুলানকে বাড়ি নিয়ে এসো। একস্ট্রা খরচ যা লাগবে আমি দেব।
আমি জিজ্ঞেস করি, আমাদের বিয়ে! কবে করব আমরা?
সে পরে দেখা যাবে। আগে তো মা-মেয়ে বাঁচুক।
সত্যি বলতে কী, এই কথাটা অনেকদিন ধরেই আমি ভাবছিলাম। মুখ ফুটে তৃণাকে বলা হয়নি। বুলান আমার ছোট বোন। ভুল বিয়ে হয়েছে। আমাদের সংসারে একমাত্র বেহিসেবি ঘটনা। যে ক্ষতি ওর জীবনে হয়েছে, পূরণ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। দিনের পর দিন বোনের কষ্ট দেখেশুনে কাঁহাতক চুপ করে বসে থাকা যায়। তবু নির্বিকার
থাকতে হচ্ছিল। আমার যা মাইনে, হঠাৎ দু’জনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া অসম্ভব। বাবার পেনশনের যে অংশটুকু মা পায়, নিজের ওষুধ খরচাতেই চলে যায় পুরোটা। বোন তার এগারো বছরের মেয়েকে নিয়ে সপ্তাহের এক-দু’দিন বাপের বাড়িতে আসে, নিজের দুর্ভাগ্যের কথা শোনায়, কাঁদে। কিন্তু কখনও নিজের মুখে বলে না, শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসব। এই গুণটা হয়তো বাবার থেকেই পেয়েছে। সবচেয়ে কাছের লোকের সামনেও হাত পাতবে না। ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে মা বলতে পারে না, মিঠিকে নিয়ে এখানেই থেকে যা। তা হলে মা বড়জোর দু’মাস বাঁচবে। সুইসাইডের সংখ্যা একটা বাড়বে পাড়ায়। লোকে অবশ্য বুঝবে না। কিন্তু বুলান কী করে এটা মেনে নেবে! একমাত্র আমি যদি বলি, চলে আয় এখানে, তখন হয়তো বেচারি আসার ব্যাপারে জোর পাবে মনে। আমি ভরসা দিতে পারিনি। এই মাইনেতে বোন এসে জুটলে প্রেমিকার বিয়েতে পিঁড়ি ধরতে হবে।
আমার সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উড়িয়ে তৃণা যে সিদ্ধান্তটা নিল, তা নিয়ে একটা ছোটখাটো উপন্যাসও নামিয়ে দেওয়া যায়। লেখক যদি সেখানে আমার ক্যারেক্টারটা ‘অকর্মার ধাড়ি’ হিসেবে দেখায় আপত্তি করব না।
তৃণার ইচ্ছেটা গত কাল মাকে জানিয়েছি। অনেক দিন পর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল মায়ের মুখ। আজ কারখানা ছুটির পর বাসে চেপে বোনকে আনতে বেরিয়ে পড়েছি। হয়তো এরকম একটা দিনের জন্য বুলান গত বেশ কিছু বছর ধরে অপেক্ষা করছে, আর দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। ভাগনি মিঠির চেহারাটাও হয়েছে মায়ের অনুসারী। ওর বয়সে বুলানের চেহারা কী সুন্দর ছিল! মা সদা সতর্ক থাকত ওর পোশাক নিয়ে। আমি চোখে চোখে রাখতাম, এই বুঝি পাড়ার কোনও ছেলের প্রেমে পড়ে গেল। এখন মনে হয় ভুলই করেছি। ওরকম কিছু হলে এই বিয়েটার থেকে অন্তত ভাল হত। সেই সব ভুল কতটা কী শোধরানো যাবে, জানি না। আপাতত যেটা অবশ্যকর্তব্য, বুলানকে ওবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসা। নয়তো রোগা হতে হতে বোনটা কোনওদিন মিলিয়ে যাবে।
এত সহজে বোনের কষ্ট তৃণার বোধগম্য হওয়ার কারণ, ওর শৈশব কেটেছে নিদারুণ দারিদ্র্য লাঞ্ছনায়। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। বিধবা মা আয়ার কাজ ধরলেন। এখন ট্রেইন্ড নার্স। আছেন সরকারি হাসপাতালে। তৃণাকে কোলে নিয়ে ওর মা একসময় যেতেন লোকের বাড়িতে রোগীর দেখাশোনা করতে। তার একটা চিহ্ন এখনও তৃণার চিবুকে লেগে আছে। কাটা দাগ। কোনও এক পেশেন্টবাড়ির কুকুর ছোট্ট তৃণার ঠোঁটের নীচটায় কামড়ে দেয়। ক্ষুধার্ত তৃণা কুকুরকে দেওয়া বিস্কুটটা তুলে খেতে গিয়েছিল। ঘটনাটা বেদনাদায়ক হলেও ওই দাগটা তৃণার মুখটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। কী বলব, বেশ ব্যক্তিত্বময়ী সেক্সি টাইপ লাগে। চিহ্নটা না থাকলে ওকে নিপাট সরস্বতী ঠাকুর মার্কা লাগত। দাগটার ওপর আঙুল ছুঁইয়ে আমার ভাবনাটা তৃণাকে একদিন বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কী করে হল?
তৃণা বলেছিল, এই দাগটা নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল। আমার আগের দু’জন প্রেমিকসমেত সকলকেই বলেছি, ছোটবেলায় পড়ে গিয়ে কেটে গিয়েছিল। তোমাকে
সত্যিটা বলতে ইচ্ছে করছে। তখনই কুকুরে কামড়ানো ঘটনাটা বলে তৃণা। শুনে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় আমি বলেছিলাম, তখন তোমার খুব লেগেছিল, না? কাঁদছিলে খুব?
উত্তরে সেদিন কিছু বলেনি তৃণা। মুখ নিচু করে বসে ছিল। বেশ কিছুদিন পর বলে, তোমাকে আমি এত ভালবাসি কেন জানো? চার বছর বয়সে আমি যখন কুকুরের কামড়টা খাই, দেখেছিলাম, আমার রক্তপাত নিয়ে মা যতটা না আতঙ্কিত, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত ছিল পেশেন্টবাড়ির কুকুরের থেকে বিস্কুট নেওয়ার অপরাধটা চাপা দিতে। আমার ভীষণ অভিমান হয়েছিল তখন। এত বছর পর সেই অভিমান তুমি ভাঙালে। জানতে চেয়েছ, কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম সেই সময়? তোমাকে আমার ছেলেবেলার সহচর মনে হয় তারপর থেকে। আমার জন্যই আড়ালে কোথাও ছিলে!
কোনও লেখক যদি এই অংশটুকু তৃণার গল্পের মধ্যে স্থান দেয়, আমি তা হলে সামান্য গ্লোরিফাই হই। আমার মতো ছেলে মহান হওয়ার সুযোগ বড় একটা পায় না। বাসটা বোনের শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। টানটান উত্তেজনা বোধ করছি। ও-বাড়িতে দশ মিনিটের বেশি থাকার ইচ্ছে নেই আমার। ভগ্নীপতি সঞ্জয়কে এতক্ষণ সহ্য করা বেশ কষ্টকর। আপাদমস্তক একটা রাস্কেল। অনেকদিন হয়ে গেল বোন আমাদের ওখানে যাচ্ছে না। কেমন আছে এখন, কে জানে?
বুলানকে ফোন করে ‘নিতে আসছি’ বলে রাখতে পারলে ভাল হত। রেডি থাকত মিঠিকে নিয়ে। ফোনের রাস্তা রাখেনি সঞ্জয়। ল্যান্ডফোন তো কবেই উঠিয়ে দিয়েছে, বুলানকে একটা মোবাইল সেট দিয়েছিলাম, সেটাও বিক্রি করে মদ খেয়ে ফেলেছে। এইভাবে বাড়ির অনেক কিছুই বিক্রি করে চলেছে সঞ্জয়। বিয়েতে পাওয়া খাট, আলমারি, ফ্রিজ ভ্যানিশ। এখন নিজের বাড়ির জিনিসপত্তরে হাত দিয়েছে। একদিন দরজা জানলার গ্রিল, পাল্লাও খুলে বেচে দেবে। তবু আমার বোন কোথাও উড়ে যেতে পারবে না। কারণ, তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
সঞ্জয়কে নেশা ছাড়ার জন্য অনেক বুঝিয়েছি। কড়া কথাও বলেছি। মাতালের শেষতম অস্ত্র ‘কান্না’ দিয়ে সঞ্জয় সব ম্যানেজ করে ফেলেছে। বলেছে, তোমার বোনকে জিজ্ঞেস করে দেখো, মেয়ের মাথায় হাত রেখে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি মাল খাওয়া ছেড়ে দেব। কিন্তু মদ তো সে প্রমিস করেনি। আমাকে খেয়ে চলেছে অবিরাম।
বুলানকে কখনও মারধর করে না সঞ্জয়। সেই শক্তিও আর নেই। কটু কথাও বলে না। পুলিশ দিয়ে ওকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করে কোনও লাভ হবে না। গুঁতো খেয়ে হাসপাতালে যাবে। খরচ সামলাতে হবে আমাকে। এসব বুঝেশুনে ওর মা পালিয়ে গেছে বড় মেয়ের কাছে। বাবা ছেলের বিয়ের আগে মারা গেছেন। মনের সুখে নিজেকে ধ্বংস করে চলেছে সঞ্জয়। যখন বিয়ের জন্য কথাবার্তা চলছিল, ওর এই অ্যাডিকশানের কথা আমরা জানতে পারিনি। মিউজিক নিয়ে এম এ করেছে। স্কুলে গান শেখায়। বাড়িতে গান শিখতে আসে ছাত্রছাত্রী। নেশার কারণেই খুইয়েছে চাকরিটা। গলায় এখন আর সুর খেলে না। তাই টিউশানিও নেই। মদ খরচ আর সংসার চালায় বাড়ির নীচে দুটো দোকানঘর ভাড়ার টাকায়। অন্য কোনও কাজের খোঁজে বাড়ি থেকে বেরোতে চায় না সঞ্জয়, দোহাই
দেয় শরীরের। আসলে মনের শক্তিও নিঃশেষ। পাড়ার রিকশাওলা ওকে মদ কিনে এনে দেয়। বাংলা, চুল্লু, সবই চলে। রিকশাওলারা প্রসাদ পায়।
এসে গেল বটতলা স্টপেজ। নেমে আসি বাস থেকে। ফেরার সময় ট্যাক্সি করে নেব। বুলান, মিঠি যখন একেবারের জন্য চলে আসছে, কিছু মালপত্তর তো থাকবে। তৃণাকে বলেছি সন্ধেবেলায় আমাদের বাড়িতে আসতে। বোন, ভাগনিকে নিয়ে ফেরত আসার বীরত্বপূর্ণ দৃশ্যটা ওকে দেখাতে চাই।
সঞ্জয়রা থাকে দোতলায়। সদর সর্বদা হাটখোলা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মাংস রান্নার সুবাস পাচ্ছি। বেশ আশ্চর্য হই। এত ঘটা করে রান্না তো এ বাড়িতে হওয়ার কথা নয়! বোনের বাড়ির চা পর্যন্ত মুখে তোলা যায় না।
ওপরে উঠে এলাম। ডানহাতি ঘরটার দরজা বন্ধ, ভিতরে পুরুষ আড্ডার এলোমেলো হাসি কথা। রান্নাঘরের সামনে আসি। স্টোভের উনুনে মাংস কষছে বোন। গ্যাসের ব্যবস্থা সঞ্জয় অনেক আগেই ইলোপ করে দিয়েছে। কী রে, তুই!
আমাকে দেখে অবাক হয়েছে বুলান। আগমনের হেতু বলার আগে একটু সময় নিই। বারান্দায় বাল্বের হলুদ আলোতে পড়ছিল মিঠি। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। ওর দিকে চোখ পড়তে দেখি, প্রকৃতির নিয়মে শীর্ণ শরীরেও ঘটেছে যৌবনের কুণ্ঠিত প্রকাশ। মিঠি আমাকে দেখে হাসছে না। হাসা শেখেনি বেচারি। চাউনিতে সর্বক্ষণ ত্রস্ত ভাব। বুলান বলে ওঠে, আজকের দিনে এসে ভালই করেছিস। রাতের খাওয়া সেরে বাড়ি যাবি। সঞ্জয়ের বন্ধুরা একগাদা মাংস এনেছে।
বাড়িতে মদের আড্ডা কবে থেকে শুরু হল? জানতে চাইলাম।
আর বলিস না। কিছুদিন ধরে এই এক হয়েছে। মাসে ছ’-সাত দিন লেগেই আছে। প্রচুর বাজারপত্তর কিনে দেয় সঞ্জয়ের বন্ধুরা। আমায় রাঁধতে হয়।
পাশের ঘরের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এল নেশায় ঝুল হয়ে যাওয়া সঞ্জয়। আমাকে দেখে অনেক চেষ্টা করেও বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফোটাতে পারল না মুখে। গলায় ফুটল: আরে, বিধান যে ! কখন এলে? টেরই পাইনি। চলো, আজ তোমার সঙ্গে আমার কিছু হায়ার লেভেলের বন্ধুর আলাপ করাব। তোমরা তো বলো, আমি লোয়ার ক্লাসের লোকের সঙ্গে মাল খাই.…..
সঞ্জয়ের জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি এমন ভাব করে থাকি, ও যেন ইনভিজিবল ম্যান। বুলান সঞ্জয়কে বলে, বেশি কথা বোলো না। কী লাগবে বলো?
সঞ্জয় টাল খেয়ে দু’পা এগিয়ে আসে। বলে: প্লিজ বুলান, এক বাটি মাংস দাও না। আমাদের চাটফাট সব ফিনিশ।
তুমি যাও। মিঠিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসবার চেষ্টা করে সঞ্জয় টলমল পায়ে চলে যায় ঘরে। বুলান বাটিতে মাংস তুলতে থাকে। ওর শিরা ওঠা হাতের দিকে তাকিয়ে কেন জানি হঠাৎ
বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার সেই আত্মবিশ্বাস ভরা গলা নকল করে বলি, কাপড়জামা গুছিয়ে নে। এবার থেকে তুই আর মিঠি ও-বাড়িতেই থাকবি।
বুলান আমার দিকে তাকাল। চোখে এতটুকু খুশি চলকাল না। মিঠির উদ্দেশে মাংসের বাটিটা বাড়িয়ে দিল বলল, যা দিয়ে আয়।
মেঝেতে পড়ে থাকা কাপড় তুলে নিয়ে বাটিটা ধরে এগিয়ে গেল মিঠি। সেকেন্ডখানেকের মধ্যে পাশের ঘর থেকে ভেসে এল উল্লাস। গরম মাংস পৌঁছেছে মাতালদের আসরে।
তাড়া দিই বুলানকে, কী হল, ফটাফট রেডি হ।
বুলান বলে, আমি যাব না।
কেন, এই সংসারে আর তোর কী পাওয়ার আছে?
সাত পুরনো শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে বুলান বলে, সঞ্জয়ের বন্ধুদের কল্যাণে এই যে মাসে ছ’-সাত দিন মেয়েটা মাংস খেতে পাচ্ছে, ও-বাড়িতে তো সেটা জুটবে না।
আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকি বুলানের দিকে। বোনের বিরুদ্ধে বলারও কিছু খুঁজে পাই না। বুলান বলে, একটু বস। তোর জন্য চায়ের জল চাপাই। আমিও খাব। বিকেলে খাইনি। মাথা ধরে আছে।
মিঠিটা ও-ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। আমার কীরকম যেন টেনশন হতে থাকে।
সন্ধে উতরে গেছে। বাড়ি ফিরলাম। আমাকে একা ফিরতে দেখে মা, তৃণা দু’জনেই অবাক। তৃণা উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কী হল, ওরা এল না?
মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি কলতলার দিকে এগিয়ে যাই। হাতেপায়ে জল ঢালতে ঢালতে ভাবি, কী উত্তর দেব তৃণাকে? তোমার আত্মত্যাগের কোনও মূল্য নেই। ছোটবেলায় কুকুরের থেকে খাবার ছিনিয়ে নিতে গিয়ে একটা বিউটি স্পট উপহার পেয়েছিলে। আজ ভাগনিকে ছেড়ে এলাম অনেক দাঁতের সামনে। অসংখ্য বিউটি স্পট নিয়ে ভয়ানক সুন্দরী হয়ে উঠবে মেয়েটা। দাগগুলো কীসের কেউ জানতেই পারবে না!
রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, আগস্ট ২০০৮