গরবিনি

গরবিনি

ড্রাইভার মনে হয় সদ্য ফায়ারব্রিগেড থেকে রিটায়ার করেছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে চালাচ্ছে ট্যাক্সি। অথচ তেমন কোনও তাগাদা দেয়নি নিরুপম। সে তো আসলে একটা সংসারে আগুন জ্বালাতে যাচ্ছে, নেভাতে নয়। ইতিমধ্যে ড্রাইভারকে দু’বার সতর্ক করেছে,আস্তে ভাই, ধীরে চালাইয়ে। অ্যাকসিডেন্ট হো জায়গা।

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বুড়ো ড্রাইভার বলে, ক্যায়া বাবু, আপ ইতনা কম উমর কা হোতে হুয়ে লেড়কি য্যায়সে ঘাবড়াতে হ্যায়! ছত্রিশ সাল হো গিয়া কলকাতা মে ট্যাক্সি চালা রাহা হুঁ। অ্যাকসিডেন্ট উতনা আসানি সে…

হয়তো তাই। নিরুপমই বোধহয় গ্রামে থেকে গতি হারিয়ে ফেলেছে। একটা বড় তেরাস্তার মোড় পার হল ট্যাক্সি। ঠিকানা মতো এটাই বেলেঘাটা সি আই টি মোড়। আর একটু এগোলেই জোড়ামন্দির। নিরুপম ওখানেই নামবে।

সুকিয়া স্ট্রিটের নার্সিংহোম থেকে গভীর চিন্তামগ্ন মুখ নিয়ে বেরিয়ে ট্যাক্সিটা ধরে নিরুপম। ভেবেছিল পথটুকু একাগ্রচিত্তে দুঃখের আরাধনা করবে। যে দুঃসংবাদ সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার উপযুক্ত অভিব্যক্তি যেন চোখেমুখে থাকে। ট্যাক্সিওলা সেই প্রস্তুতির সময়টাই দিল না।

এসে গেছে জোড়ামন্দির। পাশে গলি। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করছে, অন্দর যাঁয়ু?

না। দরকার নেই। বলে, ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে আসে নিরুপম। চারপাশে বেলা এগারোটার ঝলমলে রোদ। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বলে রোদে তেমন তেজ নেই। রাস্তার ওপারে সকাল উতরানো ভাঙা সবজি বাজার। পাকা দোকান টোকানগুলোয় ঢিলেঢালা ভাব। ধূসর সরকারি লাল বাস স্টপেজ থেকে সতেজ স্কুল ছাত্রছাত্রীদের টপাটপ পেটে পুরে নিচ্ছে। গলির মোড়ে খবরের কাগজের হকার। অনেক কাগজ রয়ে গেছে তার। নিরুপম গিয়ে দাঁড়াতেই সে বলে, কী দেব, বাংলা না ইংরেজি?

না দাদা, রাধামাধব দত্ত লেনটা কোথায়, কাইন্ডলি যদি একটু বলেন…

নিরুপমের কথায় হকারদাদার উৎসাহে ভাটা। গলির দিকে হাত তুলে বলে, সোজা চলে যান। ফার্স্ট ক্রসিং-এর বাঁ দিকে। ধন্যবাদ দেওয়ার বদলে লোকটার কাছে একটা কাগজ কেনা উচিত। কোনওটাই না করে গলি ধরে হাঁটতে থাকে নিরুপম। দুঃসংবাদের দূতের হাতে খবরের কাগজ মানায় না।

প্রথম মোড়টা এখনও অনেকটাই দূরে। এইটুকুর মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাবে নিরুপম। চারদিকে ঝলমলে আলো বাতাসের মধ্যে অনায়াসে মুখটা বিষণ্ন করে নেয় সে।

এমনিতে নিরুপমের চোখে মুখে একটা স্থায়ী দুঃখী ভাব আছে। এটা তার জন্মগত কি না জানে না। কৈশোরগত অবশ্যই। কেননা ছোটবেলায় যখনই সে একমনে বসে কোনও কিছু লক্ষ করত, যেমন ধরা যাক, সুকিয়া স্ট্রিটে তাদের আদিবাড়ির দুর্গাঠাকুর গড়ার কাজ, জেঠুর বাগান পরিচর্যা, রাঙা কাকির দুলে দুলে ব্রতকথা পড়া… স্কুল ছুটির দিনগুলো এভাবেই বেশ উপভোগ করত সে। কিন্তু নিজের অজান্তে এমন এক এক্সপ্রেশান মুখে এসে জমত, ভুল বুঝতেন বড়রা। আন্তরিক উদ্বেগে জানতে চাইতেন, কী রে, মা-বাবার জন্য মন খারাপ করছে? পুরো ছুটিটা থাকতে পারবি তো এখানে!

নিরুপম সজোরে ঘাড় হেলালেও, তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। ‘আহা রে’ ভাব করে তাকাতেন। এই করুণাটুকুর কারণ জ্যাঠা কাকাদের কাছে যথেষ্ট ন্যায্য হলেও, নিরুপমের কখনই নিজেকে বঞ্চিত মনে হয়নি। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে নিরুপমের বাবাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন ঠাকুরদা। নিরুপমদের বেশ একটা বংশ গৌরব আছে। ঠাকুরদার বাবা ছিলেন পরাধীন আমলে কলকাতার নামী লোক। মস্ত বড় উকিল। সুকিয়া স্ট্রিটে তাদের প্রাসাদতুল্য পুরনো বাড়ি। যৌথ সংসার। নিরুপমের বাবা এ সব ছেড়ে স্ত্রীর প্রস্তাবে ডানকুনির গরলগাছায় সংসার পাতেন। পুরোপুরি গ্রামাঞ্চল। প্রচুর গাছপালা, পুকুর, মাঠ… জায়গাটা রক্তে মিশে গেছে নিরুপমের। কলকাতায় এলেই বরং হাঁফ ধরে যায়। বাবা বছর দুয়েক হল গত হয়েছেন। নিরুপম আর মা ওখানেই থাকে। মায়ের উদ্যোগে বাড়ি লাগোয়া নতুন নার্সারি স্কুল তৈরি হয়েছে। মা, নিরুপম ছাড়াও রাখতে হয়েছে আরও দু’জন দিদিমণি। দিনদিন ছাত্রছাত্রী বাড়ছে। গরলগাছার এক স্কুলে নিরুপমের বাবা শিক্ষকতা করতেন। যাতায়াত করতেন কলকাতার বাড়ি থেকে। মেজ পুত্রের জন্য মেয়ে পছন্দ করতে ভুল হয়েছিল ঠাকুরদার। পাত্রী শিক্ষাদীক্ষায় মাজা ঘষা। যাকে বলে ঝকঝকে তকতকে। বনেদি শ্বশুরবাড়ির প্রাচীন রীতিনীতির সঙ্গে বনবে কেন! সেখানকার অন্দরমহল বাহিরমহল গ্রাহ্য না করে মা লাইব্রেরিতে বই বদলানো, বাজার দোকান করত। এমনকী বাড়ির একটা সামান্য অংশ স্কুল খোলার জন্য চেয়েছিল মা। এম এ পাশ করাটা জলে যাচ্ছে মনে হয়েছিল মায়ের।

এ সব নিয়ে নানান খিটিমিটি লেগে থাকত বাড়িতে। বাবা একসময় বিরক্ত হয়ে অথবা পরিস্থিতি বিচার করে চলে গিয়েছিল গরলগাছায়। সেখানে গুছিয়ে বসতে না বসতেই বাবা খবর পান, পিতা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন। বিষয় সম্পত্তি কিছুই পাবেন না বাবা। সহজভাবেই বাবা সংবাদটা সহ্য করেন। যেন এরকম তো ঘটারই কথা। বাবা আর কোনওদিন সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে যাননি। ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে ঠাকুরদাও কখনও আসেননি গরলগাছায়। কিন্তু অসম্ভব এক আকাঙ্ক্ষায় বাবা গরলগাছার একতলার বাড়িতে একটা ঘর ঠাকুরদার জন্য করেছিলেন। বাবার ধারণা ছিল ঠাকুরদা নিজের ভুল বুঝতে পেরে, শেষ বয়সটা মেজ ছেলের কাছে কাটাবেন। যথারীতি তা হয়নি। ঘরটা বাড়তি হয়ে গিয়েছে নিরুপমদের। তবে এ কথাও ঠিক, ওই ঘরটা চিরকালই অনুপস্থিত অভিভাবকের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে।

বড়দের মধ্যে যাই হোক, পুরনো বাড়িতে ছিল নিরুপমের অবাধ যাতায়াত। ও বাড়ির

গুরুজনরা চাইতেন নিরুপম অন্তত আসুক। বাবা মা-ও বাধা দিতেন না। নিরুপমের মুখে দুঃখী ভাবটার কারণ হয়তো এক বাড়ি ভাইবোন ছেড়ে একা একা থাকা। এই নিরীহ, ভালমানুষ ভাবটা বংশের মর্যাদা রক্ষায় আজ ভীষণ কাজে লাগবে।

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ধাঁধায় নিরুপম ভুগত, বিষয় সম্পত্তি থেকে বাদ দেওয়া মানে কি বংশ গৌরবটাও কেড়ে নেওয়া? বোধহয় নয়। তাই তো এবার জ্যাঠামশাইয়ের বড়ছেলে, মানে বাবলুদার বিয়েতে আসার জন্য যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল, মা একটা নতুন ধুতি নিয়ে এসে বলল, বিয়ের দিন ধুতি পাঞ্জাবি পরিস। তোদের বনেদি বাড়ির এটাই রেওয়াজ। আর এই নে তোর বাবার হিরে বসানো সোনার আংটিটা। তোর ঠাকুরদা বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। নিজের আঙুল থেকে খুলে ছেলেকে বিয়েতে আশীর্বাদ করেছিলেন।

মা এল না। জ্যাঠামশাই, জেঠিমা নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করাতেও না। মায়ের ভীষণ জেদ।… এ সব ভাবতে ভাবতে কখন যেন মোড় ঘুরে গেছে নিরুপম। দুটো বাড়ির পরেই সেই তিনতলা হলুদ বাড়ি। নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে জ্যাঠা ছবির মতো ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। বর্ণনার মধ্যে যেটা ছিল না, সেটা দেখে নিরুপমের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। বাড়িটার পাশেই এক চিলতে মাঠ, সেখানে প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধা হয়ে গেছে। সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েবাড়ি। দু’দিন পরেই বিয়ে।

খালি গা, কালো ভুলো কয়েকটা ছেলে বাঁশের খাঁচায় দুলছে। যেমন নিরুপমের বুকের পাঁজর ধরে দুলছে ভয় আর আশঙ্কা। শুনেছে মেয়েবাড়িও যৌথ পরিবার। এরকম মারাত্মক একটা সংবাদ অতকটা লোকের সামনে গিয়ে বলতে হবে। ক্ষোভে, হতাশায় মানুষগুলো যদি হঠাৎ রেগে গিয়ে নিরুপমকে মারধর শুরু করে। এই পলকা শরীর কি ধকল নিতে পারবে। জ্যাঠাকে একবার বলেছিল নিরুপম, ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিন।

জ্যাঠামশাই রাজি হলেন না। বললেন, তা হয় না, এটা সঠিক শিষ্টাচার নয়। এই ধরনের খবর সশরীরে গিয়ে দিয়ে আসা উচিত। এ ব্যাপারে তুই হচ্ছিস উপযুক্ত আদর্শ পাত্র। তোর চেহারার মধ্যে এক ধরনের সহজ সরল ভাব আছে। আর তা ছাড়া গোটা ব্যাপারটা তুই যখন সামলাচ্ছিস, এইটুকুই বা বাকি থাকে কেন?

অশুভ সংবাদের আবার শিষ্টাচার! এটাও কি বনেদিয়ানার অঙ্গ?

অজান্তেই হলুদ বাড়ির কলিং বেলে হাত উঠে গেছে নিরুপমের। বিচ্ছিরিভাবে বেজে উঠল বেল। যেন একরাশ বাসন পড়ে গেল ভেতর বাড়িতে। বুক ধড়ফড় করে নিরুপমের। মুখের অভিব্যক্তিটা সামলানো দায় হয়ে যায়।

খুলে গেল দরজা। সামনে দাঁড়িয়ে সম্ভবত কাজের মেয়ে। উঁচু করে পরা শাড়ি। জল হাত শাড়িতে মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?

সুবোধ ব্যানার্জির বাড়ি তো এটা?

হ্যাঁ।

ওঁকে একটু ডেকে দেবেন।

কোথা থেকে আসছেন আপনি?

সুকিয়া স্ট্রিট থেকে।

দপ করে আলো জ্বলে উঠল কাজের মেয়ের চোখে, ও ছেলেবাড়ি! আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। আমি এক্ষুনি মামাবাবুকে ডেকে দিচ্ছি।

মেয়েটা তড়িঘড়ি করে দৌড়োল বাড়ির ভেতরে। নিরুপম সোফায় গিয়ে বসে। সাধারণ মধ্যবিত্তের বৈঠকখানা। বেশ পরিচ্ছন্ন। যৌথ সংসারে কোনও ঘরে রেডিয়োতে এফ এম বাজচ্ছে। বাতাসে পাঁচমিশালি রান্নার গন্ধ। ভেতরে উঠোন অথবা কলতলায় বসে কাক ডাকছে বিচ্ছিরি ভাবে। এই সবই নির্বিঘ্ন দৈনন্দিন শব্দ। যখনই খবরটা দেবে নিরুপম, মুহূর্তে সমস্ত কিছু ওলোটপালোট হয়ে যাবে। সেই অভিঘাত নির্বিকার চিত্তে সহ্য করতে হবে নিরুপমকে। বংশ মর্যাদা রক্ষার দায় আজ তার কাঁধে। তবু ভাল আজ উইক ডেজ। বাড়ির ছেলেরা নিশ্চয়ই কাজে বেরিয়ে গেছে। মেয়ের বাবা বাড়িতে। সদ্য রিটায়ার করেছেন।

মলিন লুঙ্গির ওপর বেমানান চকচকে পাঞ্জাবি, এটা গলাতেই যা একটু সময় লেগেছে। সুবোধবাবু এসে পৌঁছোলেন, হ্যাঁ বলুন।

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমি হচ্ছি পাত্রের খুড়তুতো ভাই।

বুঝেছি। তোমরাই তো গরলগাছায় থাকো। তা বলো বাবা, কী ব্যাপার? সম্ভবত মেয়ের মা এসে দাঁড়ালেন চৌকাঠে। আধ ঘোমটা দেওয়া শাড়ি। চোখেমুখে সন্ত্রস্ত ভাব।

নিরুপম বলেই ফেলে কথাটা, কাল রাতে জ্যাঠামশাইয়ের ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়।

জমাট নৈঃশব্দ্য। কাকটাও আর ডাকছে না। স্লো মোশানে বহুতল ভেঙে পড়ার মতো সুবোধবাবু এবং তাঁর স্ত্রী সোফায় নিজেদের ছেড়ে দিলেন। চোখে সব আশা শেষ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি।

পজটুকু পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নিরুপম বলে, জেঠু এখন নার্সিংহোমে। আই সি ইউতে রাখা হয়েছে।

নিরুপমের কথা শেষ হতেই সুবোধবাবু ছোট্ট ছেলের মতো হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন। মেয়ের মা মাথা রেখেছেন দু’হাতের তালুতে। চোখের জলে কোল ভিজে যাচ্ছে। এই কোলেই মানুষ করেছিলেন মেয়েকে।

দৃশ্যটা এতটা হৃদয় বিদারক হবে ভাবতে পারেনি নিরুপম। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর জ্যাঠামশাই যদি মারা যেতেন, এঁরা এত কাঁদতেন না। এখন নার্সিংহোমে ভরতি হতেই এত বিলাপ। তা হলে কি নিকটজনের মৃত্যুর থেকেও মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়া আরও শোকের।

নিরুপমকে ধন্দের মধ্যে রেখে মেয়ের মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ভেতর বাড়ির দিকে দৌড়ে যান। ভীষণ আনচান শুরু করেছেন সুবোধবাবু। মুখে একটাই কথা, এখন কী হবে, এখন কী হবে!

দায়িত্ব মোটামুটি শেষ নিরুপমের। এবার ঘটনা প্রবাহ যে দিকে যাবে, গা ভাসিয়ে দেবে সে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় এসে যে দাঁড়াল, বলে না দিলেও বোঝা যায় এ-ই পাত্রী।

মায়ের কাছে খবরটা নিশ্চয়ই পেয়েছে। কিন্তু ততটা বিপর্যস্ত লাগছে না। বাবাকে একবার দেখে নিয়ে নিরুপমের দিকে তাকায়। কী ধার চাউনিতে! একেই বোধহয় বলে নরুনে চাউনি। নিরুপমের শরীর বেয়ে শিরশিরে একটা ভয় নেমে যায়। একদম উদ্বেগহীন গলায় মেয়েটি জানতে চায়, কোন নার্সিংহোমে ভরতি করা হয়েছে ওঁকে?

সুকিয়া স্ট্রিটের কাছেই। আমাদের এক চেনাজানা নার্সিংহোমে। বলেই নিরুপম মনে মনে

জিভ কাটে, চেনাজানা নার্সিংহোম বলাটা বোধহয় ভুল ডেলিভারি হয়ে গেল। মেয়েটি এবার তার বাবার উদ্দেশে বলে ওঠে, যাও। ওঁকে দেখে এসো। ঘরে বসে কাঁদলে চলবে।

মেয়ের আদেশে সংবিৎ ফেরে সুবোধবাবুর। সঙ্গে সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, এক্ষুনি একবার যেতে হয়। তুইও চল না আমার সঙ্গে।

না, সেটা ভাল দেখায় না। তুমি আর মা যাও।

এত বড় অঘটনের মধ্যেও মেয়েটির ঠান্ডা মাথা দেখে অবাক হয়ে যায় নিরুপম। সমর্থনে বলে ওঠে, উনি ঠিকই বলছেন। আপনার স্ত্রী যদি যেতে চান, চলুন। পারলে বাড়ির অন্য কোনও পুরুষকে নিন।

সেই ভাল। দেখি অজয় ফাঁকা আছে কিনা। বলে সুবোধবাবু ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

মেয়েটি বলে, আপনি কি চা খাবেন?

বিস্ময়ে মাথা নাড়ে নিরুপম। এই অবস্থাতেও আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি রাখতে চায় না কন্যা।

ট্যাক্সিতে নিরুপম ছাড়াও মেয়েবাড়ির তিন জন। মেয়ের বাবা, মা আর কাকা। ইনিই অজয়বাবু। সুবোধবাবুর থেকে ছাপোষা চেহারা। মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। বোঝাই যাচ্ছে এদের যৌথপরিবার তেমন আঁটোসাঁটো নয়। থাকলে সুবোধবাবু পোড় খাওয়া শক্তপোক্ত আত্মীয় সঙ্গে নিতেন। কন্যাপক্ষের এই দুর্বল টিম, নিরুপমদের নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনায় চিড় ধরাতে পারবে না। তাই হয়তো নিরুপম এখন কিছুটা রিল্যাক্স। অবশ্য মাঝেমধ্যেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে পাত্রীর চেহারা। মেয়েটিকে ঠিক কেমন দেখতে, মানে ভাল, খারাপ না মাঝারি বুঝে উঠতে পারেনি নিরুপম। বিয়ের দিন উদ্দেশ্য করে প্রতিনিয়ত ত্বক পরিচর্চা করেছে আন্দাজ করা যায়। সারা শরীর জুড়ে বারবার ধোয়া দেবদালানের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল। বড় চওড়া লাগছিল মেয়েটির নিজর্ন সাদা সিঁথি।

মেয়েটার সঙ্গে কোনও পূর্বপরিচয় ছিল না নিরুপমের। শত্রুতা তো নয়ই তবু কেন মেয়েটিকে ঠেলে দিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ভাবনার মাঝে পেছন সিট থেকে সুবোধবাবু বলে ওঠেন, আচ্ছা, ওঁকে বড় কোনও নার্সিংহোমে শিফট করা যায় না? খরচা যা লাগে, না হয়…

কী, হচ্ছে কী! বলে, স্বামীকে সামলান মেয়ের মা। দেখতে দেখতে এসে গেল সুকিয়া স্ট্রিটের নার্সিংহোম। বল এখন নিরুপমদের কোর্টে।

জ্যাঠামশাইয়ের অভিনয় প্রতিভার ওপর নিরুপমের যথেষ্ট আস্থা আছে। তাই সে দৃঢ় পদক্ষেপে সুবোধবাবুদের নিয়ে নার্সিংহোমের দিকে এগিয়ে যায়।

আই সি ইউতে জ্যাঠামশাইকে দেখে বেরিয়ে এসেছেন সুবোধবাবুরা। শরীর জুড়ে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। ভিজিটার্স জোনে নিরুপমদের বাড়ির লোকজন। জ্যাঠামশাইয়ের পরিবার আর নিরুপম ছাড়া সবাই জানে হার্ট অ্যাটাকটা সত্যি। তাই সবার আচরণে নির্ভেজাল উৎকণ্ঠা। সুবোধবাবু ঠিক করে উঠতে পারছেন না, কার সঙ্গে কী কথা বলবেন।

এমন সময় বাবলুদাকে হঠাৎ দেখা গেল। অভিনয় গুণে বাবলুদাও বাবার থেকে পিছিয়ে নেই, উদ্বেগে ভারী হয়ে আছে মুখ-চোখ। বাবলুদাকে দেখে দৌড়ে গেলেন সুবোধবাবু একটু তফাতে দাঁড়িয়ে নিরুপম শুনতে পায়, সুবোধবাবু বলছেন, আমাদের তো ভীষণ বিপদ হয়ে গেল বাবা। এখন কী করা যায়?

‘কী করা যায়’, মানে! বিরক্ত হয়ে বলে বাবলুদা।

আসলে সব বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্ন হয়ে গেছে। দূরের আত্মীয়স্বজন বিয়েতে আসার জন্য রওনা দিয়েছে।

আপনি কি বলতে চান, বাবাকে এই অবস্থায় রেখে আমি বিয়ে করতে যাব? আশ্চর্য লোক তো আপনারা!

না, মানে… আমতা আমতা করছেন সুবোধবাবু। মেয়ের মা এগিয়ে যান বাবলুদাকে বোঝাতে। নিরুপম সরে যায় দূরে। বাবলুদা এখন প্রচুর মিথ্যে অজুহাত দেবে। শুনতে ভাল লাগবে না নিরুপমের। এমনিতেই সে অপরাধ বোধে ডুবে আছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে বিয়ে পণ্ড হয়ে যাওয়া মেয়েটার মুখ। নিরুপম ঠিক করে রেখেছে, বিয়ে ভেস্তে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে গেলে আজই সে গরলগাছায় ফিরে যাবে।

ভাবনা হোঁচট খায় নন্দাকে দেখে। করিডর ধরে হেঁটে আসছে। কী সাহস মেয়েটার! সব জেনেশুনে জ্যাঠামশাইকে দেখতে এসেছে, না কি দেখতে এসেছে নিজের জয়। এই প্রহসনের নেপথ্য নায়িকা হচ্ছে এই নন্দা। দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই, কাল রাতে দু’-তিনবার আত্মহত্যা করতে ছুটেছিল সে। নিরুপমের বড় পিসির মেয়ে নন্দা। বছর চারেক হল বিধবা হয়ে বড়পিসি সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে উঠেছে। অসময়ে পিতৃহারা মেয়েটা এরকম একটা সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসে আছে, বাড়ির কেউ টের পায়নি। গতরাতে বিচ্ছিরি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে জানতে পারল নিরুপম। রাতে শুতে যাওয়ার সময় বাবলুদা বলল, নিরু তুই আমার সঙ্গে শো।

তখন নিরুপম বোঝেনি, বাবলুদা আসলে তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ অবধি গল্প করছিল বাবলুদা। একটা সময় ঘুমের ভান করতে হয় নিরুপমকে। তার কিছুক্ষণ পরেই ঘটে আসল ঘটনাটা। দরজায় খটখট। আওয়াজের মাত্রা বাড়ার আগে বাবলুদা উঠে যায় দরজা খুলতে। চোখ বন্ধ থাকলেও, কান সজাগ ছিল নিরুপমের। দরজা খোলার পর স্পষ্ট নন্দার গলা। ওদের কথোপকথন পুরোটা বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করা যাচ্ছিল, নন্দা ভয়ংকর কিছু ঘটাতে চাইছে। বাবলুদা অসহায়ভাবে

বোঝাচ্ছে নন্দাকে। বলছে, দে, আমার হাতে দে। এ কী করছিস তুই!

নন্দার হাতে ঘুমের ট্যাবলেট বা আরও মারাত্মক কিছু ছিল। দু’বার বাথরুমের দিকে ছুটে গেল নন্দা। বাবলুদা দৌড়োল বাঁচাতে। আবার ফিরে এল ওরা। জোর তর্কাতর্কি। বাবলুদা বলছে, তুই ক’দিন আগে বললি, কেউ মেনে নেবে না আমাদের সম্পর্ক। আমার বিয়েটা করে নেওয়া উচিত।

হিসহিসিয়ে নন্দা বলে ওঠে, আজ অন্য কথা বলছি। চলো, আমার সঙ্গে মরবে চলো। খুব ভালবাসতে না আমাকে!

বাবলুদা সতর্ক করে, আস্তে, নিরুপম জেগে যাবে। আমি দেখছি কী করা যায়। যাওয়ার সময় নন্দা শাসিয়ে গেল, তুমি যখনই বিয়ে করতে বেরোবে, আমি এইগুলো খেয়ে নেব, বলে দিলাম।

তখনকার মতো ঝগড়া শেষ হল। নিরুপণের হতভম্ব অবস্থা। সহজেই অনুমান করতে পারছে; তাদের পরিবারে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে চলেছে। বিছানায় ফিরে এসে বাবলুদা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম আসে না নিরুপমের। বাবলুদা কি একই সঙ্গে দুটো সম্পর্ক চালাতে চাইছে? নইলে এত জটিল এবং মারাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল কী করে!

ভোর হতেই নিরুপম জেঠু-জেঠিমাকে নিয়ে মিটিং-এ বসল। নিরুপমের বক্তব্য, এ বিয়ে এক্ষুনি ভেঙে দেওয়া উচিত। তা না হলে হয়তো বিয়ের দিনই বাড়িতে একটা অঘটন ঘটে যাবে। যদি না-ও ঘটে, মিছিমিছি পরের বাড়ির মেয়েকে নিয়ে এসে অপমানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না।

জেঠিমা কোনও কথা শুনতে রাজি নন। বলেন, ঘুমচোখে কী শুনতে কী শুনেছিস তুই। এত কষ্ট করে ছেলেকে রাজি করালাম বিয়েতে, তুই আর শুভ কাজে বিঘ্ন ঘটাস না।

জেঠিমার কথা কানে নিলেন না জ্যাঠা। কপালে অসংখ্য চিন্তার ভাঁজ জমা হল। বললেন, আমি এরকমই কিছু একটা আন্দাজ করেছিলাম। নন্দা-বাবলুর ঘনিষ্ঠতা আমার চোখে একটু বেসামাল ঠেকত। কিন্তু সেটা যে এরকম নোংরা পর্যায়ে চলে যাবে ভাবতেই পারিনি। এখন বুঝতে পারছি বিয়ের কথা বললে কেন এড়িয়ে যেত বাবলু। একটু থামে জেঠু। তারপর চিরাচরিত ভঙ্গিতে জেঠিমাকে বলে, আচ্ছা, তুমি তো মা, তোমার চোখে এসব পড়েনি? না কি পড়েছে। বিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবেছিলে। একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়েকে বিপদে ফেলতে তোমার বাধল না।

এখন তো সব দোষ আমার। চিরকালই তো আমাকে দুষেছ। ছেলে যেন শুধু আমার একার।

শুরু হয়ে গেল কান্নার লং প্লে। জ্যেঠামশাই এসবে অভ্যস্ত বলেই বোধহয় জেঠিমার কান্না অগ্রাহ্য করে নিরুপমের কাছে জানতে চাইলেন, কী করা যায় বল তো তা হলে?

তখনই মিথ্যে অসুস্থতা দেখিয়ে নার্সিংহোমে ভরতি হওয়ার প্ল্যানটা দেয় নিরুপম। জ্যাঠা এক কথায় রাজি। বলেন, সামনেই নিরাময় নার্সিংহোম। আদিত্য মালিক। আমার ছোটবেলার বন্ধু। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সত্যিই নার্সিংহোমে ভরতির ব্যাপারটা নিখুঁত হল। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেল জেঠুকে। স্ট্রেচারে শুয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার আগে জ্যাঠার অভিনয় দীর্ঘদিন মনে থাকবে নিরুপমের। বাড়ির অন্য মেম্বাররা আসল ব্যাপারটা টেরই পেল না। পরিবারের দুই সদস্য বাবলুদা আর নন্দা তখন আশ্চর্যজনক ভাবে অনুপস্থিত ছিল।

পরে নিশ্চয়ই বাবলুদাকে জেঠিমা সব কিছু বলেছে। বাবলুদা মারফত নন্দাও জেনেছে। ওরা দু’জনেই মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছে নিরুপমকে। মুখে কিছু বলতে পারছে না। বাবলুদার কাছে ধ্যাতানি খেয়ে মেয়ের বাড়ির তিন জন অনাহুতর মতো এদিক ওদিক ঘুরছেন। নিরুপমের মায়া হয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ওঁদের কাছে।

আর্ত কণ্ঠে সুবোধবাবু বলেন, আমি যে কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কোনও ছেলেও নেই যে এ সময় পাশে দাঁড়ায়।

এখন তো আর কিছু করার নেই। প্রার্থনা করুন জ্যাঠা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুস্থ হয়ে উঠুক।

সে তো বটেই। কিন্তু আমরা যে…

কথা কেড়ে নিয়ে মেয়ের মা বলেন, তুমি একবার আমাদের সঙ্গে বাড়ি যাবে বাবা। মেয়ের সঙ্গে বসে কিছু একটা শলা পরামর্শ করা যাবে। ওইটুকু মেয়ে হলে কী হবে। ওর বুদ্ধিতেই আমরা চলি। ছেলের বাড়ির পক্ষ থেকে তুমি থাকলে।

কাজ অবশ্য উদ্ধার হয়ে গেছে। সরল মানুষগুলোকে খানিক স্তোক দেওয়াই যায়। নিরুপম বলে, চলুন, আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি।

নিরুপম এখন পাত্রী মানে সহেলির ঘরে। শলা পরামর্শের কথায় গা করেনি সহেলি। নিরুপমকে বলে, আপনি একবার আমার ঘরে আসতে পারবেন?

না করার কোনও কারণ নেই। সহেলিকে অনুসরণ করে নিরুপম এ ঘরে এসে বসেছে। সহেলি গেছে চা আনতে। এখন আর তত অস্বস্তি বা অপরাধবোধে ভুগছে না নিরুপম। এ ঘটনায় সে তো নিমিত্ত মাত্র। দ্বিতীয়বার এ বাড়ি ঢোকার আগে প্যান্ডেলের দিকে চোখ গিয়েছিল, বিয়ে উতরে যাওয়া ফাঁকা ম্যারাপ মনে হয়েছে। বাঁশ ধরে দোল খেতে কোনও বাচ্চাকে দেখা যায়নি।

চা মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকল সহেলি। অন্য সময় হলে নিরুপম নিশ্চয়ই ‘এ কী এত কেন’ বলত। এখন চুপ করে রইল। সহেলিও কিছু বলছে না। টেবিলে খাবার রেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিরুপমের দিকে চেয়ে আছে। ফের অস্বস্তি শুরু হয়েছে নিরুপমের। হঠাৎ সহেলি বলে ওঠে, এ রকম একটা ঘটনা ঘটবে আমি জানতাম।

‘মানে’! বলে ফেলাটা সতর্কভাবে আটকায় নিরুপম। কিন্তু চোখে ফুটে ওঠে। দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সহেলি বলে, মেয়েটা জিতে গেল।

কোন মেয়েটা? এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না নিরুপম। সহেলি বলে যাচ্ছে, বিয়ে পাকা হয়ে যাওয়ার পর থেকে মাঝেমধ্যেই মেয়েটার ফোন আসত। কখনও বলে,

আমি বাবলুদার বিয়ে করা বউ। কখনও বা, আমাদের সন্তান আছে। একদিন বলল, আগের কথাগুলো মিথ্যে। বাবলুদা আমাকে ঠকিয়েছে। আমি প্রেগনেন্ট। মেয়েটার নাম কী, কোথায় থাকে কিছুই বলত না।

পাথরের মতো বসে আছে নিরুপম। এ সব কী শুনছে সে। নন্দা এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে ছিল!

সহেলি উঠে যায় জানলার কাছে। বাইরে নীল আকাশ। একটা চিল অলস উড়ানে পাক খাচ্ছে সেখানে। জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে সহেলি বলে, মাকে বলেছিলাম, জানেন। মা বলল, আমাদেরই কোনও রিলেটিভ ঈর্ষায় এ সব করছে। এত বড় বংশে বিয়ে হচ্ছে, সহ্য করতে পারছে না।

বিয়ের তখন এত ঝোঁক আমার, মায়ের কথা বিশ্বাস করে ফেললাম। তা ছাড়া আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই আমাদের শত্রু।

কিন্তু আবার যখন ফোন এল, আমি আপনার দাদাকে ফোন করে সব জানালাম। উনি পাত্তা না দিতে বললেন। তার পরেও ফোন এসেছিল। আমি খুব খারাপ ব্যবহার করেছি মেয়েটার সঙ্গে। ফোন আসা বন্ধ হল। ভাবলাম, আপদ গেল। ভাবিনি এরকম চরম আঘাত আসবে। যদি বা এল, বিয়ের দু’দিন আগে।

সহেলি ফিরে এসেছে জানলা থেকে। নিরুপমের গলা শুকিয়ে কাঠ। সামনে চা জুড়োচ্ছে। উলটো দিকের চেয়ারে বসে সহেলি বলে, আপনাকে দেখে যতটা সাধাসিধে মনে হয়, আপনি তা নন। মেয়েটার ব্যাপারে আপনি সব জানতেন। তবু কেমন নিরীহ মুখ নিয়ে জ্যাঠামশাইয়ের শরীর খারাপটা বলতে এলেন।

মাথাটা নিজে থেকেই কখন যেন হেঁট হয়ে গেছে নিরুপমের। সহেলি বলছে, আর একটা ছোট কাজ আপনাদের বাকি আছে। আমাকে অপয়া বলে, বিয়েটা পুরোপুরি ক্যানসেল করে দেওয়া।

কথা শেষ হতেই অসহ্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল ঘরটা। ভেতরের উঠোনে কাকটা ফিরে এসেছে। কাঃ কাঃ করে ডাকছে। নিরুপম শুনছে, যাঃ যাঃ। দুয়ো দিচ্ছে কাকটা।

খানিক নীরবতার পর সহেলি বলে ওঠে, আসলে কী জানেন, অত্যন্ত সাধারণ দেখতে আমি। পড়াশোনা শিখে মা-বাবার বোঝা হয়ে আছি। বহু পাত্রপক্ষ আমাকে দেখে নাকচ করে গেছে। এতই ক্যাবলা, একটা প্রেমও করে উঠতে পারিনি। আপনাদের বাড়ির লোক আমাকে পছন্দ করাতে আমি স্বপ্নে ভাসছিলাম। সম্ভ্রান্ত বংশ, দেনাপাওনা নেই। তাই হয়তো ফোনের অশুভ সংকেত আমি গ্রাহ্য করিনি। এটাকে কি আপনি লোভ বলবেন?

চমকে মুখ তোলে নিরুপম। সহেলি কি নিরুপমকে বন্ধু ভেবে ভুল করছে। প্রতিপক্ষর কাছে সমবেদনা চাইছে কেন? সহেলি বলে চলেছে, বড় মুখ করে বন্ধুদের বলে বেড়িয়েছি, অমুক ফ্যামিলিতে আমার বিয়ে হচ্ছে। তারা এখন…

সহেলির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে নিরুপম। এখনও কেন নদীর দেখা নেই? নাকি কান্নাটুকুই সহেলির আত্মমর্যাদা, অযথা অপচয় করবে না।

সন্ধের আগেই সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি ঘুরে, নিজেদের গরলগাছার বাড়িতে চলে এসেছে নিরুপম। অসময় ফিরতে দেখে মা তো থতমত। গভীর উদ্বেগে জানতে চায়, কী ব্যাপার রে, ফিরে এলি! তোর সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেছে ওরা?

না। বিয়ে ভেস্তে গেছে।

সে আবার কী! পুরোটা খুলে বল কী হয়েছে?

বলছি। বলে, হাত-পা ধুতে বাথরুম ঢুকেছিল নিরুপম।

এখন বিছানায় বসে চা-মুড়ি খেতে খেতে মাকে সবিস্তারে সব বলছে। বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে উই ঝিঁঝিপোকার কোরাস। শান্ত, নিরালা নিজস্ব পরিবেশে নিরুপম এখন অনেক স্বচ্ছন্দ। বিগত প্রহসনে নিজের ভূমিকা, ন্যায় অন্যায় সবটাই ভাগ করে নিচ্ছে মায়ের সঙ্গে।

শ্বশুরবাড়ির পরিত্যাজ্য পুত্রবধূর মুখে উল্লাসের বদলে অসহায় আক্ষেপ। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে নিরুপমের বৃত্তান্ত।

, কথা শেষ করে নিরুপম বলে, বুঝলে মা, আমাদের সমস্ত ভণ্ডামি ধরে ফেলার পরেও, মেয়েটা কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি আমার সঙ্গে। অদ্ভুতভাবে তাকিয়েছিল আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে ঘেন্না ছিল না। করুণা ভিক্ষাও নয়। এমন কিছু একটা ছিল ওই চাউনিতে, আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না। একসময় সহেলি নিজেই খেয়াল করিয়ে দেয় বাড়ির কথা। আমি পালিয়ে বাঁচি।

এই গম্ভীর পরিবেশে হঠাৎই মিচকি হেসে ওঠে মা। বলে, ওই দৃষ্টিটাই হচ্ছে শুভদৃষ্টি। বুঝলি বোকা।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে মা। বলছে, দুটো ফোন করতে হবে।

কাকে?

তোর জ্যাঠা আর মেয়েবাড়িতে। মেয়ে বাড়িতে বলব, প্যান্ডেল না খুলতে। দিনটাও একই থাকবে।

নিরুপমকে কিছু বলতে না দিয়ে পাশের ঘরে, মানে সেই বাড়তি ঘরে গেল মা। ঠাকুরদা কোনওদিন আসবে বলে যে ঘরটা করেছিল বাবা। ও ঘরেই ফোন থাকে।

ও ঘরের কথায় কান পাতে নিরুপম। ফোন নয়। মা যেন ঠাকুরদার সঙ্গে পরামর্শ করছে। আজ নিশ্চয়ই ঠাকুরদা আশীর্বাদ করছেন মাকে।

আনন্দলোক, ডিসেম্বর ২০০৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *