প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

সপ্তম অধ্যায় : পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ (৭২৪-৭৫০ খ্রি.)

সপ্তম অধ্যায় – পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ [৭২০-৭৫০ খ্রি.]

দ্বিতীয় ইয়াজিদ (৭২০-৭২৪ খ্রি.)

৭২০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ওমরের মৃত্যুর পর আবদুল মালিকের তৃতীয় পুত্র খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি আকাবার যুদ্ধে বিদ্রোহী ইয়াজিদ-বিন-মুহাল্লাবকে পরাজিত ও নিহত করেন। তাঁর দুর্বলতার সুযোগে খারিজি, বার্বার ও তুর্কীদের বিদ্রোহ প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। আব্বাসীয় প্রচারনীতি তার রাজত্বেই শুরু হয়। মদ্যপ ও লালসাগ্রস্ত দ্বিতীয় ইয়াজিদকে “অমিতব্যয়ী উমাইয়া সন্তান’ (Prodigal son of the Umayyads) এবং অধার্মিক স্বৈরাচারী শাসক উপাধি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ইয়াজিদ আমোদ-প্রমোদে এতই মত্ত থাকতেন যে, প্রমোদ কাননে ক্রীড়ারত অবস্থায় তাঁর প্রিয়তমা প্রণয়িনী গায়িকা হাব্বাবা হঠাৎ কণ্ঠে আঙ্গুর ফল আটকিয়ে মারা গেলে শোকাতুর দ্বিতীয় ইয়াজিদ তিন দিন প্রণয়িনীর শবদেহ কবর না দিয়ে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকেন এবং শোকে বিহ্বল হয়ে সপ্তম দিনে তিনিও মারা যান।

হিশাম (৭২৪-৭৪৩ খ্রি.)

খিলাফত লাভ : ৭২৪ খ্রিস্টাব্দে, দ্বিতীয় ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা হিশাম সিংহাসনে আরোহণ করে চরম রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হন। গোত্রকলহ, খারিজি বিদ্রোহ, বার্বার-রোমান ফ্রাঙ্কদের আক্রমণ এবং সর্বোপরি আব্বাসীয় আন্দোলন উমাইয়া বংশের ভিত্তিকে প্রকম্পিত করে তোলে। হিট্টির মতে, “হিশামের সময়েই উমাইয়াদের স্বর্নযুগের অবসান হয়।”

প্রশাসনিক নীতি : হিশাম মুদারীয়দের পরিবর্তে হিমারীয়দের প্রাধান্য দেন এবং ইয়েমেনী ভাবাপন্ন খালিদ-বিন-আবদুল্লাহ আল-বাসরীকে ইরাকের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। খালিদের ভ্রাতা আসাদ আল-হোবায়রাকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।

ইরাকে বিদ্রোহ দমন : ইরাকের নবনিযুক্ত শাসনকর্তা খালিদ মুদারীয় এবং হিমারীয় গোত্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। অমুলমান সম্প্রদায় সুখে- স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত। খালিদের খ্রিস্টান মাতা একটি গীর্জা নির্মাণ করলে ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং খারিজিদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগে এবং তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিন্তু যুদ্ধে বিদ্রোহী খারিজি নেতা বাহলুল পরাজিত ও নিহত হন। ফলে বিদ্রোহের অবসান হয়। ইরাকের পরবর্তী শাসনকর্তা ইউসুফ-বিন-ওমর আলীপন্থী জায়িদের বিরুদ্ধাচরণ সম্পূর্ণরূপে ধুলিসাৎ করেন।

খোরাসানে বিদ্রোহ দমন : জিজিয়া থেকে অব্যাহতি লাভের আশায় অক্সাস (Oxus) নদীর পূর্বদিকে সগোদের (Sogdians) অধিবাসিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কিন্তু হিশাম পুনরায় জিজিয়া কর আরোপ করলে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে হিশামের নির্দেশে আসাদ-আল-কাসরী সগোদের বিদ্রোহ দমন করেন; কিন্তু তুর্কী উপজাতীয় নেতা খাকানের নেতৃত্বে পুনরায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে খালিদের নিকট খাকান পরাজিত ও নিহত হন। খালিদ-আল-কাসরীর পদত্যাগের পর নসর ইবন- সাইয়ার খোরাসানের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

খাজারদের বিদ্রোহ দমন : আর্মেনিয়া এবং আযারবাইজানের খাজার সম্প্রদায় ৭৩১ খ্রিস্টাব্দে ইরাক ও মসুল আক্রমণ করে উমাইয়া শাসনকর্তাকে নিহত করে। হিশাম সাঈদ-আল-হারসীকে প্রথম পর্যায়ে এবং মাসলামা ও মারওয়ানকে পরবর্তী পর্যায়ে প্রেরণ করে খাজার বিদ্রোহ দমন করেন। রোমান আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য এশিয়া মাইনরে হিশাম মুয়াবিয়া ও সুলায়মান নামে দুই পুত্রকে প্রেরণ করেন।

উত্তর আফ্রিকায় বিদ্রোহ দমন : সোফরিয়া নামে একটি গোঁড়া খারিজি সম্প্রদায় উমাইয়াদের বিরুদ্দে উত্তর আফ্রিকায় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে। তারা বার্বারদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঞ্জিয়ারের শাসনকর্তাকে নিহত করে, কায়রোয়ান দখল করে এবং সম্ভ্রান্তদের যুদ্ধে (Battle of the Nobles) আরব অশ্বারোহীদের নিহত করে। হিশাম এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করবার জন্য সেনাপতি কুলসুম-বিন-আরাবকে প্রেরণ করেন; কিন্তু কুলসুম পরাজিত ও নিহত হন। অতঃপর ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে হানজালা বিন- সাফওয়ান বার্বার বিদ্রোহ দমনে প্রেরিত হন। হানজালা দক্ষতা ও কঠোরতার সাথে উত্তর আফ্রিকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। ৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহী বার্বারদের সমূলে উৎপাটিত করা হয়। আমীর আলীর ভাষায়, “ইসলামের ইতিহাসে এটি এমনি একটি সঙ্কট যা কখনও ভুলতে পারা যায় না।”

স্পেন ও ফ্রান্সের ঘটনাবলি : বিদ্রোহ দমন এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে খলিফা হিশাম উমাইয়া বংশকে সঙ্কটমুক্ত করবার চেস্টা করেন। দ্বিতীয় ওমরের শাসনকালে আস-সামাহ তুলুসের যুদ্ধে খ্রিস্টান ডিউকের নিকট পরাজিত ও নিহত হন। মুসলিম বিপর্যয়ের এই গ্লানি মোচনের জন্য এবং গোত্রীয় দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ৭২১ খ্রিস্টাব্দে তুলুসের যুদ্ধের পর সহকারী সেনাপতি আবদুর রহমান আল-গাফিকী সাময়িকভাবে শাসনভার গ্রহণ করেন। কিন্তু কয়েকমাস পরে আনবাসাহ শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারকল্পে আনবাসাহ পিরেনীজ অতিক্রম করে কারাকাসোনা, নিসিজসহ সমগ্র দক্ষিণ ফ্রান্স অধিকার করেন। অভিযানে তিনি নিহত হলে ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে আবদুর রহমানকে পুনরায় স্পেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠানো হয়। এ সময় পিরেনীজ পর্বতের অপরদিকে কার্ডোনের মুসলিম শাসনকর্তা ওসমান- বিন-আবুনিসা খ্রিস্টানদের সহায়তায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং আবদুর রহমানের ফ্রান্স অভিযানে বাধা প্রদান করেন। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক ওসমান বিন-আবু- নিসাকে ‘মুনুজা’ বলে অভিহত করেন। তিনি একুইটেনের ডিউককে ইউডিজের পরমাসুন্দরী কন্যা লাম্পেজীকে বিবাহ করেন এবং জামাতা-শ্বশুর সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করবার চেষ্টা করেন। ত্বরিত গতিতে আবদুর রহমান একদল সৈন্য দক্ষিণ ফ্রান্সে প্রেরণ করে মুনুজাকে পরাজিত ও নিহত করেন।

আবু নিসা মুনুজার বিদ্রোহ দমন দক্ষিণ ফ্রান্সে মুসলিম অভিযানের পথকে সুগম করে। একুইটেনের ডিউক মুসলিম বাহিনীর নিকট পর্যুদস্ত হলে তিনি ফরাসি সম্রাট চালর্স মার্টেলের দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে আবদুর রহমান চার্লস মার্টেলের বিশাল বাহিনীর সম্মুখীন হলেন এবং টুরসের যুদ্ধে খ্রিস্টান বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। বহু সংখ্যক আরব যোদ্ধা টুরসের রক্তাক্ত প্রান্তরে শাহাদাৎ বরণ করল আরব ঐতিহাসিকগণ একে ‘বালাতুস শুহাদা’ (শহীদদের মঞ্চ) বলে আখ্যায়িত করেন। টুরসের যুদ্ধকে পৃথিবীর পনেরটি যুগসন্ধিক্ষণকারী সংঘর্ষের অন্যতম বলে বর্ননা করা হয়েছে। এটি ইউরোপের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে; কারণ, এই যুদ্ধে খ্রিস্টানদের পরাজয় হলে সমস্ত ইউরোপ মুসলমানদের পদানত হত। মূইরের ভাষায়, “ফরাসি দেশ, তথা খ্রিস্টান জগতের ভাগ্য এই দিনটির ফলাফলের উপর নির্ভরশীল ছিল।”

আব্বাসীয় বিদ্ৰোহ : হিশামের রাজত্বে আবু মুসলিম নামক জণেক ইস্পাহানবাসী আব্বাসীয় বংশধর মুহাম্মদ-বিন-আলী এবং তার পুত্র ইব্রাহিমের সঙ্গে খোরাসানে প্রচারণা চালিয়ে আব্বাসীয়দের প্রচারণা নতুন উদ্দীপনা লাভ করে।

চরিত্র : দীর্ঘ ২০ বছর রাজত্ব করে হিশাম ৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে রুসাফায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তুর্কী, খারিজি, বার্বার, রোমান, খাজারদের বিদ্রোহ, শিয়া ও আব্বাসীয়দের ষড়যন্ত্র ধূলিসাৎ করে উমাইয়া বংশের অধঃপতনকে সাময়িকভাবে রোধ করেন। আরব ঐতিহাসকিগণ হিশামকে তৃতীয় এবং সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ উমাইয়া খলিফা বলে অভিহিত করেন এবং মুয়াবিয়া এবং আবদুর মালকের পরেই তাঁর স্থান নির্দিষ্ট করেন। ধর্মপরায়ণ, সহিষ্ণু, বিদ্যানুরাগী, বিচক্ষণ ও কর্তব্যজ্ঞানসম্পন্ন খলিফা হিশামকে ভন ক্রেমার সুযোগ্য উমাইয়া নৃপতিদের মধ্যে অন্যতম বলে অভিহিত করেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী সেলিম একজন ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি এবং তাঁর পুত্র জাবালা গ্রীক, পারস্য ভাষা থেকে কয়েকটি পুস্তক আরবিতে অনুবাদ করেন। যোদ্ধা ও বিদ্রোৎসাহী হিশাম রাজ্য বিস্তারে এবং শিশু সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর রাজ্যে অসংখ্য খাল, মসজিদ, সুরমা অট্টালিকা, রাজপ্রাসাদ ও উদ্যান নির্মিত হয়। স্নানাগার, বাসগৃহ ও মসজিদ সম্বলিত ‘খিরবত-আল মাফজার’ নামক প্রাসাদটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে। প্রজাবৎসল নৃপতি হিসাবে তিনি খ্যাতি অর্জন করলেও সংকীর্ণমনা, সন্দেহপ্রবণ, লোভী ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেও তাঁর চরিত্র কলুষিত হয়েছে। তিনিই শক্তিশালী গুপ্তচর প্রথা প্রচলিত করেন। আমীর আলী বলেন, “তিনি সহজেই মিথ্যা সংবাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে সন্দেহের যুপকাষ্ঠে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সেবকদের প্রায়ই হত্যা করতেন। বিলাসী নৃপতি হিসেবে হজ্ব পালনের সময় তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ বহনের জন্য ৬০০ উষ্ট্রের কাফেলা নিযুক্ত হত।”

দ্বিতীয় ওয়ালিদ (৭৪৩-৪৪ খ্রি.)

সিংহাসনারোহণ : হিশামের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা দ্বিতীয় ইয়াজিদের পুত্র দ্বিতীয় ওয়ালিদ ৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

কার্যাবলি : দ্বিতীয় ওয়ালিদের রাজত্বকারে রাজনৈতিকক বিশৃঙ্খলা চরম আকারে দেখা দেয়। তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর ভোগ-বিলাসী, অধার্মিক ও দুর্নীতিপরায়ণ। খালিদ-আল কাসরী এবং জায়েদ বিন-আলীর পুত্র ইয়াহিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ধার্মিকদের তিনি নির্যাতন করতেন। অবশ্য তিনি সঙ্গীতের একজন উঁচুদরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নিজেও ভাল বাঁশী বাজাতে পারতেন। প্রথম ওয়ালিদের পুত্র ইয়াজিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি দুর্গে অবরুদ্ধ ও নিহত হন।

তৃতীয় ইয়াজিদ (৭৪৪ খ্রি.)

৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতালাভ করে তৃতীয় ইয়াজিদ কতিপয় বিদ্রোহ দমন করেন। কিন্তু সৈন্যবাহিনীর বেতন হ্রাস করবার জন্য তাঁকে ‘মিতব্যয়ী ইয়াজিদ’ (Yazid the Retrencher) বলে আখ্যায়িত করা হয়।

ইব্রাহিম (৭৪৪ খ্রি.)

তৃতীয় ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা ইব্রাহিম সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি ছিলেন দুর্বল, অযোগ্য ও অকর্মণ্য। প্রথম মারওয়ানের পৌত্র দ্বিতীয় মারওয়ানের হস্তে আইন-আল-জারের (Battle of Ain-ul-Jar) যুদ্ধে ইব্রাহিম পরাজিত হন।

দ্বিতীয় মারওয়ান (৭৪৪-৭৫০ খ্রি.)

খিলাফত লাভ : ৬০ বছর বয়সে দ্বিতীয় মারওয়ান দামেস্কের সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর রাজত্বে বিদ্রোহ, দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। তিনি দামেস্ক হতে রাজধানী হাররানে স্থানান্তরিত করেন। গোত্রকলহ, খারিজি বিদ্রোহ এবং আব্বাসীয় আন্দোলন তাঁর রাজত্বে গোলযোগের সৃষ্টি এবং উমাইয়া খিলাফতের অবসান ঘটায়। সাময়িকভাবে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে বিদ্রোহ নির্মূল হলেও পরবর্তীকালে এটি মারাত্মক গৃহযুদ্ধের রূপ ধারণ করে। কুফায় ইবন-মুয়াবিয়া এবং হিমস, বালাবাক, দামেস্ক প্রভৃতি অঞ্চলে খারিজি নেতা আজ-জাহাককে পরাজিত করে দ্বিতীয় মারওয়ান শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেও পশ্চিমাঞ্চলে বার্বার ও খারিজি বিদ্রোহ চরম সঙ্কটের সৃষ্টি করে। মারওয়ানের বিপর্যয়ের মূলে ছিল আব্বাসীয় আন্দোলন এবং এর ফলে উমাইয়া বংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।

আব্বাসীয় আন্দোলন

উমাইয়া বংশের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আব্বাসীয়দের আন্দোলন। নবী করিমের চাচা আবু আব্বাস-বিন-আবদুল মুত্তালিব-বিন হাশিমের নাম হতে আব্বাসীয় বংশের নামকরণ হয়েছে। আবু আব্বাস চার পুত্র রেখে ৩২ হিজরীতে তথা ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। চার ভ্রাতাই সুদক্ষ যোদ্ধা ও সুশিক্ষিত ছিলেন। হাশিম বংশের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখবার নিমিত্ত উমাইয়াদের বহু চক্রান্ত তারা ধূলিসাৎ করতে চেষ্টা করেন। সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলীর পক্ষ সমর্থন করে তারা হাশিম গোত্রের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করেন। এই গোত্র হতে উদ্ভূত বলে ভ্রাতাগণ হযরত আলী এবং তাঁর বংশধরদের সমর্থন করেন। ইবন আব্বাস নামে পরিচিত আল-আব্বাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুল্লাহ কারবালার মর্মান্তিক ঘটনায় ভগ্নহৃদয়ে তায়েফে প্রাণত্যাগ করেন। হাদিসশাস্ত্রে তিনি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ইবন-আব্বাসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলী পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে আলীর মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র মুহাম্মদ- বিন-আলী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং উমাইয়াদের স্বৈরাচারী শাসন এবং অধার্মিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। উচ্চাভিলাসী এবং ক্ষমতালোভী মুহাম্মদই ছিলেন আব্বাসীয় আন্দোলনের উদ্যোক্তা।

মুহাম্মদ-বিন-আলী উমাইয়া বংশকে ধ্বংস করে আব্বাসীয় আধিপত্য বিস্তারের সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উমাইয়াদের অনাচার, অত্যাচার, অনৈসলামিক কার্যকলাপ, গোত্রপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব, বৈষম্যমূলক ব্যবহার, বিজাতীয় মনোভাবের ফলে উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে। মুয়াবিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, কারবালার হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড, আলীর বংশধর যায়েদের নৃশংস হত্যা, আলীর সমর্থকদের উপর নির্যাতন প্রভৃতি আব্বাসীয়দের আন্দোলনে প্রেরণ যোগায়। উমাইয়া বিরোধী হাশিম বংশের খিলাফতের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য মুহাম্মদ একটি নতুন মতবাদের উদ্ভাবন করেন। এই মতবাদ অনুযায়ী ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পর ইসলামের ধর্মীয় কর্তৃত্ব তাঁর পুত্র আলী অথবা জয়নুল আবেদীনের উপর ন্যস্ত না হয়ে হুসাইনের বেমাত্রেয় ভ্রাতা মুহাম্মদ-আল-হানিফার উপর অর্পিত হয়। তাঁর যুক্তি ছিল ইসলামের বিধান অনুসারে ছয় বছর বয়স্ক সন্তান জয়নুল আবেদীন ইমামতী করবার অনুপযুক্ত এবং যেহেতু নাবালক পুত্র পিতার উত্তরাধিকারী হতে পারে না সেহেতু জয়নুল আবেদীনের বৈমাত্রেয় বয়স্ক ভ্রাতা মুহাম্মদ আল-হানিফার উপর এই গুরুদায়িত্বভার ন্যস্ত করা উচিত। বিবি ফাতিমার মৃত্যুর পর হযরত আলী হানাফিয়া গোত্রের জনৈক মহিলার পাণি গ্রহণ করেন। তাঁরই গর্ভজাত সন্তান ছিলেন এই মুহাম্মদ। আল-হানিপার মৃত্যুর পর আবুল হাশেম নেতৃত্ব লাভ করেন। হাশেমের মৃত্যুর পর আব্বাসীয় বংশের খিলাফত দাবির উদ্যোক্তা এবং মতবাদ সৃষ্টিকারী আবুল আব্বাসের পৌত্র মুহাম্মদ-বিন-আলী-বিন আবদুল্লাহকে ইমামতী প্রদান করা হয়।

মুহাম্মদ বিন-আলী হাশিমী বংশোদ্ভূত বলে উমাইয়াদের স্থলে আব্বাসীয় প্ৰভূত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। প্রথমে গোপনে প্রচারণা চালিয়ে আহল- আল- বায়ত মহানবী (স)-এর পরিবারবর্গের সহানুভূতি লাভ করেন। উমাইয়াদের প্রতি শিয়াদের আজন্ম বিরাগ ও বিদ্বেষ থাকায় তারা মুহাম্মদের প্রচারণাকে সমর্থন করলে শিয়ারা উমাইয়াদের বলপূর্বক সিংহাসন দখলকারী (Usurper) বলে মনে করত। আব্বাসীয় আন্দোলন উমাইয়া বিরোধী সমস্ত সম্প্রদায় ও গোত্র; যথা- খারিজি, মাওয়ালী, শিয়া বা আলীর দলে সক্রিয় সমর্থন লাভ করে একটি সংঘবদ্ধ সর্বদলীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। আব্বাসীয় প্রচারকগণ উমাইয়া বিদ্বেষকে মূলধন করে নিজেদের স্বার্থে এই মর্মে প্রচার করতে থাকে যে, তারা মহানবী তথা ফাতেমীয় বংশীয়দের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছেন। আব্বাসীয়দের প্রতারণামূলক প্রচারণায় শিয়া সম্প্রদায় তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।

দ্বিতীয় ইয়াজিদের শাসনকাল থেকে আব্বাসীয়গণ প্রচারকার্য শুরু করে এবং খলিফা হিশামের আমলে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সুসংগঠিত আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন-আলী মৃত্যুবরণের পূর্বে তিনি ইব্রাহিম, আবুল আব্বাস (আস-সাফ্ফাহ) ও আবু জাফর (আল-মনসুর) নামে তাঁর তিন পুত্রকে পর্যায়ক্রমে ইসলামের ইমাম বা উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। মুহাম্মদের প্রচার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত গঠনমূলক। স্বীয় দলভুক্ত করবার জন্য তিনি মাওয়ালী, শিয়া, খারিজি এবং অপরাপর উমাইয়া বিরোধী সম্প্রদায়কে একীভূত করবার জন্য গুপ্ত সমিতি ও সাংগঠনিক দলের সৃষ্টি করেন। খোরাসান ও পারস্যের মাওয়ালীদের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রচারকার্য চালানো হয় এবং তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা আব্বাসীয়দের উমাইয়া-বিরোধী কার্যকলাপকে অনুপ্রাণিত করে। খারিজি ও শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরাগ ও সমর্থন জ্ঞাপন করে মুহাম্মদ তাদেরকেও আব্বাসীয় আন্দোলনের সপক্ষে আনতে সক্ষম হন। হিট্টি বলেন, “শিয়া, খোরাসানী এবং আব্বাসীয় শক্তির একীকরণের উমাইয়া বংশের অন্তিমকাল উপস্থিত হল এবং এটি শেষোক্ত সম্প্রদায়কে তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির সহায়তা করে।” তারা প্রচারক দর বা ‘দাই’ (Dia) বণিকের ছদ্মবেশে হজ্বযাত্রীদের বেশে বিভিন্ন স্থানে গমন করে উমাইয়া বিরোধী তৎপরতা শুরু করে। তাঁদের আন্দোলন এতই সঙ্গোপনে পরিচালিত হত যে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অনুসন্ধানকারী অথবা বিশ্বস্ত অনুচর ব্যতীত অপর কাকেও আব্বাসীয় প্রচারণার বিষয় জানোনো হত না। কখনও কখনও গোপনীয়তা ফাঁস হলে উমাইয়া নৃপতিদের হস্তে তাদের মৃত্যুবরণ করতে হত। আব্বাসীয় আন্দোলনকে সুসংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করবার জন্য ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিয়ে একটি সিনেট (Senate) গঠিত হয়। এর কাজ ছিল প্রতিনিধিদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা। এই সিনেট পরিচালনা করত ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল বা ‘নকীব’। এই কাউন্সিল বা নকীবের প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ-বিন-আলী।

আবু মুসলিম : ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মারওয়ান সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং এ বছরে আব্বাসীয় আন্দোলনের কর্ণধার মুহাম্মদ-বিন-আলীর মৃত্যুতে তাঁর পুত্র ইব্রাহিম আব্বাসীয়দের দলনেতা বা ইমামরূপে প্রচারকার্য পরিচালনা করেন। মুহাম্মদ জীবিত অবস্থায় তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ইব্রাহিমের প্রচারকার্য সাহায্যের জন্য আবু মুসলিম নামক একজন আরব বংশোদ্ভূত ইস্পাহানবাসীকে নিযুক্ত করেন। মুহাম্মদ মক্কা হতে এই তরুণ ক্রীতদাসকে ক্রয় করে মুক্তি দেন। মতান্তরে বার্নার্ড লুইসের মতে, “তিনি ছিলেন একজন ইরাকী মাওয়ালী।” যাহউক ইব্রাহীম তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা, শিষ্টাচার, বাগ্মিতা ও সৌজন্যবোধে অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে খোরাসানে আব্বাসীয় প্রচারনা ও জনমত গঠনের জন্য প্রেরণ করেন। ধৈর্যশীল, সংযমী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আবু মুসলিমের তৎপরতা ও সাংগঠনিক প্রচারণাই উমাইয়া বংশের পতনের অন্যতম কারণ। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে খোরাসান উমাইয়া বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিনত হয়। আব্বাসীয় গুপ্ত প্রতিনিধি এবং প্রচারক নিযুক্ত করে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে একটি সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। আমীর আলীর মতে, “মুদারীয় এবং হিমারীয়গণের মধ্যে যে আত্মগরিমা এবং তিক্ততা বিরাজমান ছিল তা সুকৌশলে আপন কাজে লাগাবার জন্য ম্যাকিয়াভেলীর মত চাতুর্য আবু মুসলিমের ছিল। এ জন্য উভয়পক্ষ থেকে যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বে থেকে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধন করতে সক্ষম হন।”

খোরাসানের উমাইয়া শাসনকর্তা নসর ইবন-সাইয়ার যখন কিরমানে খারিজি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ঠিক তখনই আবু মুসলিম আব্বাসীয়দের পক্ষে কালো পতাকা উত্তোলন করে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সর্বদলীয় সংঘবদ্ধ আব্বাসীয় বাহিনী আবু মুসলিমের নেতৃত্বে খোরাসানের রাজধানী মার্ভ অধিকার করে। আবু মুসলিমের প্রাণস্পর্শী বক্তৃতায় বহুলোক তাঁর পতাকাতলে সমবেত হয় এবং উমাইয়া শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালিত হয়। নসর এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে না পেরে খলিফার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। খলিফা অতঃপর ইরাকের শাসনকর্তাকে একদল সৈন্য প্রেরণ করবার আদেশ দেন; কিন্তু সৈন্য-সাহায্য পৌঁছার পূর্বেই ফরগানা ও সমগ্র খোরাসান আবু মুসলিমের হস্তগত হয় এবং নসর পরাজিত ও নিহত হন।

খোরাসানের পতন উমাইয়া রাজত্বের প্রতি একটি মারাত্মক আঘাতস্বরূপ। এর পতনে বিচলিত হয়ে খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান গুপ্তচরের মাধ্যমে সংবাদ পেলেন যে, আবু মুসলিম, ইব্রাহিম বিন-মুহাম্মদের প্রচারক ও প্রতিনিধি হিসেবে খোরাসানে উমাইয়া প্রভুত্ব বিলোপের কার্যে নিয়োজিত রয়েছে। এ সময় আবু মুসলিমকে লিখিত ইব্রাহিমের একটি ষড়যন্ত্রমূলক পত্র মারওয়ানের হস্তগত হলে ইব্রাহিমকে বন্দী করবার আদশে দেওয়া হয়। ইব্রাহিম রাজধানী হাররানের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে ইব্রাহিম তাঁর ভ্রাতাদ্বয় আবুল আব্বাস আল-সাফ্ফাহ এবং আবু জাফর আল-মনসুরকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। প্রাণভয়ে তাঁরা কুফায় আত্মগোপন করেন।

ইব্রাহিমের মৃত্যুতে আব্বাসীয় আন্দোলন ধ্বংস হল না; বরং আবু মুসলিমের রণকৌশলে এবং সমর দক্ষতায় উমাইয়া সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে এটি বিস্তার লাভ করে। আব্বাসীয় সমর্থকগণ মারওয়ানের নৃশংসতায় ক্রুদ্ধ ও বিচলিত হয়ে প্রবল উদ্দীপনা ও উৎসাহে উমাইয়া বংশের আধিপত্য বিনষ্ট করতে তৎপর হয়। আবু মুসলিম তার অধীনস্ত সেনাপতি কাহতাব এবং খালিদ ইবন-বার্মাককে রাই শহর অভিমুখে প্রেরণ করেন। ফোরাত নদী অতিক্রম করে তাঁরা ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত হন। ঐ স্থানে উমাইয়া শাসনকর্তা ইয়াজিদ আবু মুসলিমের বাহিনীকে বাধা দেন কিন্তু তিনি পরাজিত হন। এর ফলে কুফা আবু মুসলিমের অধিকারে আসে; অবশ্য এই যুদ্ধে কাহাতাবের সলিল সমাধি হয়। তার সুযোগ্য পুত্র হাসান কুফা দখলের সময় অশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। কুফা আবু মুসলিমের দখলে আসলে আবুল আব্বাস ও তাঁর পরিবারবর্গ আত্মগোপন পরিত্যাগ করে প্রকাশ্যভাবে বসবাস করতে থাকেন। অন্যদিকে আবু মুসলিমের অপর একজন সেনাপতি আবু আয়ুন মারওয়ানের পুত্র আবদুল্লাহকে পরাজিত করে পারস্যের নিহাওয়ান্দ এবং মেসোপটেমিয়া অধিকার করেন।

কুফার পতন আব্বাসীয়দের অভ্যুত্থানের সূচনা করে। ইব্রাহিমের মনোনয়ন অনুসারে ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণ বস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে আবুল আব্বাস কুফা মসজিদে গমন করেন এবং সেখানে খলিফা বলে ঘোষিত হন। ইরাকবাসী তাঁকে নিঃসঙ্কোচে সমৰ্থন জানায় এবং তিনি আনুগত্য লাভ করে শপথ গ্রহণ করেন যে, তিনি উমাইয়া নৃশংসতার উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।

খোরাসান, পারস্য ও ইরাকের পতনে দ্বিতীয় মারওয়ান ভীত ও শঙ্কিত হয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন। আবু আয়ুনের হস্তে তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর পরাজয় তাঁর বুকে শেলের মত বিধিল। খলিফা স্বয়ং পুত্রের পরাজয়ের গ্লানি মোচনের জন্য ৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ১,২০,০০০ সৈন্যসহ টাইগ্রীস নদী অতিক্রম করে জাব নদীর দিকে অগ্রসর হলেন। এদিকে আবু আয়ুনের সাহায্যার্থে আবুল আব্বাস একটি শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করেন এবং এই সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব তাঁর পিতৃব্য আবদুল্লাহর উপর অর্পণ করেন। মারওয়ান জাব নদীর পশ্চিম তীরে এবং আবদুল্লাহ পূর্ব তীরে শিবির স্থাপন করলেন। বহুদিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। জয়-পরাজয় প্রায় অনিশ্চিত থাকে। উমাইয়াগণ প্রথম দিকে বীরত্ব প্রদর্শন করে কিছু সুবিধা করতে পারলেও আব্বাসীয়দের প্রচণ্ড আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে থাকে। ইব্রাহিমের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহনকল্পে আবদুল্লাহ সৈন্যবাহিনীকে ক্ষিপ্ত করতে থাকেন। অবশেষে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জাবের যুদ্ধে ( Battle of the Jab) দ্বিতীয় মারওয়ান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে রণক্ষেত্র হতে প্রাণভয়ে পলায়ন করেন। তিনি প্রথমে মসুল এবং পরে হাররানে পলায়ন করেন এবং সিংহাসন পুনরুদ্ধারের অবাস্তব পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হলে পুনরায় দামেস্কে ফিরে আসেন। দামেস্ক হতে প্যালেস্টাইন গমনকালে আব্বাসীয়দের ঘেরা হাতে হন। বসরার এক গীর্জায় তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে তাঁকে গ্রেফতার ও পরে হত্যা করা হয়। আবুল আব্বাসের ভ্রাতা সালেহের নিকট ছিন্ন মস্তকটি প্রেরিত হলে তিনি তাঁর জিহ্বা কেটে বিড়ালকে ভক্ষণার্থে প্রদান করেন। আবুল আব্বাসের নিকট কুফায় এই মস্তকটি প্রেরিত হলে তিনি সানন্দে ‘আস-সাফা’ বা রক্তপিপাসু উপাধি গ্রহণ করেন।

আমীর আলী বলেন, “জাবের এই অবিস্মরণীয় যুদ্ধ উমাইয়া রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটায়।” হিট্টি বলেন, “এই যুদ্ধের পর সমগ্র সিরিয়া আব্বাসীয়দের পদানত হয়। সিরিয়ায় সমস্ত শহরের দরজা আবদুল্লাহ এবং তাঁর খোরাসান বাহিনীর জন্য উন্মুক্ত হতে লাগল এবং ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিল সামান্য বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উমাইয়া খিলাফতের রাজধানী দামেস্ক অধিকৃত হল। ৫ই আগস্ট দ্বিতীয় মারওয়ানকে হত্যা করা হলে উমাইয়া বংশের পতন হয় এবং আব্বাসীয় খিলাফত সূচিত হল।”

দ্বিতীয় মারওয়ানের চরিত্র

৬০ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করে তিনি যে কর্মদক্ষতা এবং মানসিক শক্তির পরিচয় দেন তা সত্যই বিরল। অসাধারণ ধৈর্যশীলতা ও দৈহিক শক্তির জন্য তাকে ‘আল-হিমার’ বা ‘গর্দভ’ আখ্যা দেওয়া হয়। তিনি সরল, অনাম্বর এবং কৃচ্ছ্রসাধনে জীবন কাটাতে পছন্দ করতেন। তাঁরা পূর্ববর্তী অনেক খলিফা অপেক্ষা তাঁর ব্যুৎপত্তি জ্ঞান, ন্যায়নিষ্ঠা এবং কর্মস্পৃহা অধিক ছিল। ইতিহাস ও দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী তাঁর খুবই প্রিয় ছিল। এ কারণে আমীর আলী বলেন, “তিনি উমাইয়া বংশের একজন অন্যতম সাহসী এবং শ্রেষ্ঠ খলিফা ছিলেন এবং উত্তম ভাগ্যলাভের যোগ্য ছিলেন। “

দ্বিতীয় মারওয়ানের কয়েকটি অমার্জনীয় চারিত্রিক দোষ ছিল। তিনি ছিলেন সংকীর্ণমনা, উগ্রপন্থী ও দাম্ভিক। আমীর আলী বলেন, “রাজনীতিবিদের ন্যায় উদারতা, সহিষ্ণুতা, বিবদমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আপোষ – – মনোভাব যদি তাঁর থাকত তা হলে এশিয়ার ইতিহাস অন্যরূপে লিখিত হত।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *