‘অজ্ঞতার যুগে’ আরব দেশ
(ক) আইয়ামে জাহেলিয়া
প্রাক-ইসলামিক যুগকে সাধারণভাবে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বলা হয়। ‘আইয়াম’ অর্থ যুগ এবং ‘জাহেলিয়া’ অর্থ তমসা, অজ্ঞতা, বর্বরতা বা কুসংস্কার। মনে করা হয়, আরবে যে যুগে কোন প্রকার কৃষ্টি, ধর্মগ্রস্থ অথবা সূক্ষ্ম ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনা ছিল না, সেই যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বলা হয়ে থাকে।
আইয়ামে জাহেলিয়া বা অজ্ঞতার যুগের সময়কাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কখন তমসার যুগ আরম্ভ ও শেষ হয়েছিল সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না, তবে কোন কোন ঐতিহাসিক মত পোষণ করেন যে, হযরত আদম (আ)-এর জন্ম হইতে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়ত প্রাপ্তি পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময়কালকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বলা হয়; অর্থাৎ ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী যুগ। এই মতবাদ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়; কারণ দিকভ্রষ্ট মানব জাতিকে ন্যায় ও সত্যের পথে চালিত করবার জন্য পৃথিবীতে অসংখ্য পয়গম্বরের আবির্ভাব হয়। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, ১,২৪,০০০ পয়গম্বর প্রেরিত হয়েছিলেন। আর এক মতবাদ অনুযায়ী হযরত ঈশা (আ)- এর তিরোধানের পর হতে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বলা হয়। শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ উন্নতির এইরূপ শিকরে উঠেছিল যে, সাধারণভাবে ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্ব যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বলা যেতে পারে না। নিকলসন অজ্ঞতার যুগকে ইসলামের আবির্ভাব-পূর্বের এক শতাব্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন। হিট্টি তাঁর অভিমত সমর্থন করে বলেন যে, নবী, ঐশী কিতাব, ধর্মীয় চেতনার অবর্তমানে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির এক শতাব্দী পূর্বে (৫১০-৬১০ খ্রিস্টাব্দ) আরব জাতির যে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক অধঃপতন ঘটে উহাকেই ‘অজ্ঞতার যুগ’ বলা হয়।
‘অজ্ঞতার যুগের’ বিস্তৃতি সম্বন্ধেও মতবিরোধ রয়েছে। কুরআন শরীফে (৩ : ১৪৮, ৫ : ৫৫, ৩৩ : ৩৩, ৪৮ : ২৬) অসংখ্য বার আইয়ামে জাহেলিয়ার উল্লেখ আছে, কিন্তু ইহা সমগ্র আরব উপদ্বীপে বিস্তার লাভ করেছিল কিনা তা জানা যায় না। উল্লেখযোগ্য যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের প্রাক্কালে উত্তর এবং দক্ষিণ আরবে সমৃদ্ধিশাল রাজত্ব কায়েম ছিল। উত্তরে ৬১১-১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঘাস্সানী ও সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত লাদি রাজ্য পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে রাজত্ব করে। মুসলিম সৈন্যবাহিনী হীরা শহরের সমৃদ্ধি দর্শনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, অবশ্য খালিদ-বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে হীরা অধিকৃত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, কুফা মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণে জিয়াদ হীরার অতুলনীয় প্রাসাদোপম হর্মরাজি হতে উপকরণ সংগ্রহ করেন। রাসূলুল্লাহ (স)-এর জন্মলগ্নে হিমাইয়ারী রাজ্য দখলকারী আবিসিনিয়ান খ্রিস্টান রাজা আবরাহা ৫৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে। অবশ্য সূরা ফিল-এর বর্ণনা অনুযায়ী আবরাহার বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ আরবে পারসোর সাসানীয় বংশের ‘সাটরাপী’ (Satrapy) শাসন কায়েম ছিল। সুতরাং হিট্টির মতে, “দক্ষিণ আরবের মত সুশিক্ষিত ও জ্ঞান- গরিমায় উন্নত সমাজকে অজ্ঞতা এবং বর্বরতা সংজ্ঞার আওতাভুক্ত করা যায় না। সুতরাং বলা যায় যে, আরবে দক্ষিণাংশের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামুদ্রিক ও স্কুল- বাণিজ্য পথ স্থাপিত হলে মিনাইয়ান, সাবিয়ান ও হিমাইয়ারী রাজ্য গড়ে উঠে এবং সভ্যতার বিকাশ হয়। অপরদিকে নুফুদের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে যে সম্রাজ্যের উত্থান হয়; যেমন- নাবাতিয়ান পালমিরান, ঘাসানী, লামিদ-তারা নিঃসন্দেহে সুসমৃদ্ধ ও সুসভ্য ছিল।
আরব উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণে সুসমৃদ্ধ রাজ্যের অভ্যুত্থান হলেও মধ্যে আরবের হেজাজ এবং নেজদ প্রদেশ ও নুফুদ অঞ্চল ছিল মরুবাসী যাযাবর আরব বেদুঈনদের প্রশস্ত বিচরণ ক্ষেত্র। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গোত্রকলহে লিপ্ত বেদুঈনগণ আধুনিক অর্থে সভ্যতার আলোকে উদ্ভাসিত হতে পারে নাই। আরববাসী বলতে সমগ্র আরব উপদ্বীপের অধিবাসীকে বুঝায়। কিন্তু প্রাক-ইসলামী যুগের আরব বলতে সাধারণত হেজাজ ও উহার পার্শ্ববর্তী অনুন্নত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অঞ্চলকেই বুঝায়। এর কারণ অন্যান্য এলাকার তুলনায় ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে হেজাজে শোচনীয় ও নৈরাশ্যজনক পরিবেশ বিরাজমান ছিল। সেখানে সুস্থ ও উন্নত জীবনযাত্রা, সুসংহত ও সুশৃঙ্খল শাসন ব্যবস্থা, নীতি ও মানবতাবোধ ও ধর্মীয় চেতনার অভাব ছিল। সুতরাং বিশেষ অর্থে আরববাসী বলতে হেজাজের অধিবাসী এবং ‘আরবি ভাষা’ বলতে হেজাজের কুরআনী ভাষাকেই বুঝতে হবে।
(খ) রাজনৈতিক অবস্থা
‘অজ্ঞতার যুগে’ আরবের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অতবি নৈরাশ্যজনক ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। উত্তরে বায়জানটাইন ও দক্ষিণে পারস্য শাসিত কতিপয় রাজ্য ব্যতীত সমগ্র আরব দেশ স্বাধীন ছিল। শহরবাসী আরব অপেক্ষা মরুবাসী যাযাবর বেদুঈনদের গোত্র-শাসন সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত হত না। আরবগণ বিভিন্ন গোত্রের বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের দলপতিকে বলা হত শেখ। সাহস, বিচার-বুদ্ধি, বয়স, পদমর্যাদা, আর্থিক অবস্থা ও অভিজ্ঞতা বিচার করে গণতান্ত্রক পদ্ধতিতে শেখ নির্বাচিত হত। গোত্র- প্রীতি ও অনুরাগ (আসাবিয়া) বেদুঈনদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলেও তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করত। গোত্রের সদস্যদের মধ্যে সদ্ভাব ও সৌহার্দ্য থাকলেও ভিন্ন গোত্রের প্রতি তারা শত্রুভাবাপন্ন ছিল। গোত্রের সদস্যদের কলহ বৈঠকে নিষ্পত্তি করা হত, কিন্তু ফৌজদারী আইন-কানুনের ব্যবস্থা না থাকায় শেখের প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল সীমিত। গোত্র-শাসন রাষ্ট্রীয় জীবনের মূল ভিত্তি হলেও তাদের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন শাস্তি ও নিরাপত্তার অভাব ছিল।
কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থা প্রচলিত না থাকায় গোত্র-কলহ এব ভয়াবহ আকার ধারণ করত। গোত্রের মান-সম্ভ্রম ও স্বার্থরক্ষার জন্য সদস্যগণ জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হত না। দীর্ঘকালব্যাপী গোত্রগত কলহ ও বিসংবাদ সাধারণত ‘আরবদের দিন’ (আইয়াম-আল-আরব-Ayyam-al-Arab) নামে পরিচিত। বীরত্ব, শৌর্যবীর্য প্রকাশের সুযোগ থাকলেই গোত্র-কলহ আরবে এক বিভীষিকাময় অরাজকতার সৃষ্টি করত। কবিতা রচনা করে যোদ্ধাদের উৎসাহ প্রদান করা হত সত্য কিন্তু অহেতুক রক্তপাতে বেদুঈনদের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠত। পানির নহর, তৃণভূমি ও গবাদিপশুকে উপলক্ষ করে এক গোত্রের সঙ্গে অপর গোত্রের খণ্ড যুদ্ধের সূত্রপাত হত।
কলহপ্রিয় আরব গোত্রগুলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে লিপ্ত থাকত। গোত্র-যুদ্ধের প্রধান মন্ত্র ছিল হত্যার ক্ষতিপূরণ অর্থাৎ “খুনের পরিবর্তে খুন” (Blood for Blood)। কখনও কখনও অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে খূন খেসারত বা ‘দিয়াত’ (Blood money) প্রদান করলে যুদ্ধের অবসান হত। প্রাক-ইসলামী যুগে আরব গোত্রের যুদ্ধ বিগ্রহের অসংখ্য নজির পাওয়া যায়। মদিনায় ‘আউস’ ও ‘খাজরাজ’ নামক দু’টি গোত্রের মধ্যে সংঘটিত লড়াইকে ‘বুয়াসের যুদ্ধ’ বলা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরতের অব্যবহিত পূর্বে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ছাড়া কুরাইশ ও তাদের মিত্র গোত্র কিন্দার সঙ্গে হাওয়াজিন গোত্রের যে যুদ্ধ হয় তাতে হযরত মুহম্মদ (স)-এর বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পবিত্র মাদে যুদ্ধ হয় বলে তাকে ‘আল-ফিজা’র (বিধি লঙ্ঘনের) দিবস বলা হয়। একটি উটকে কেন্দ্র করে চল্লিশ বৎসরব্যাপী বানু-বকর ও বানু-তাঘলিব গোত্রের মধ্যে যে বসূসের যুদ্ধ (হর্ব-আল- বসূস) সংঘটিত হয় তা প্রাক-ইসলামী যুগের একটি স্মরণীয় ঘটনা। ঘোড়দৌড়ের সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবস ও জুবাইয়ান গোত্রদ্বয়ের মধ্যে পৌত্তলিক যুগের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কয়েক শতাব্দী স্থায়ী ছিল। এই যুদ্ধে আনতারা বীরত্বের জন্য Achilles-এর সম্মান লাভ করেন। ঐতিহাসিক গীবনের মতে, অজ্ঞতার যুগে আরবে প্রায় ১,৭০০ যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়।
(গ) সামাজিক ও নৈতিক অবস্থা
গোত্র-ভিত্তিক আরব সমাজের দুইটি পৃথক শ্রেণী-মরুবাসী বেদুঈন ও শহরবাসী আরব-জীবনযাত্রার প্রাণীতে একই সূত্রে গ্রথিত। কারণ, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া ছাড়াও রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণা উভয়ের প্রায় একই রকম ছিল। মৌলানা আকরাম খান তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মোস্তফা-চরিতে’ বলেছেন, “প্রাক-ইসলামিক যুগে সেখানে যে বংশগত ও গোত্রগত কৌলীন্য প্রথার প্রভাব অপ্রতিহতভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। এই বংশমর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের লোকদের মধ্যে অহঙ্কার, ঘৃণা ও হিংসা-বিদ্বেষ যথেষ্টরূপে বিদ্যমান ছিল।”
প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবের সামাজিক জীবন পাপাচার, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অরাজকতা, ঘৃণ্য আচার-অনুষ্ঠান ও নিন্দনীয় কার্যকলাপে কলুষিত ও অভিশপ্ত হয়ে পড়ে। খোদাবক্স বলেন, “আরববাসীরা সুরা, নারী ও যুদ্ধে লিপ্ত থাকত এবং মুহম্মদ (স) সমগ্র আরব দেশকে মূর্খতা, বর্বরতা ও প্রকৃতি পূজায় নিমজ্জিত দেখতে পান।” অরাজকতাপূর্ণ আরব দেশে নারীর কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না, তারা অস্থাবর ও ভোগবিলাসের সামগ্রীরূপে গণ্য হত। বৈবাহিক বন্ধনের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করে পুরুষগণ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ও বর্জন করতে পারত এবং অবৈধ প্রণয়ের মত বিবেকবর্জিত কাজে ও তারা লিপ্ত হত। অপরদিকে নারীরাও একই সঙ্গে একাধিক স্বামী গ্রহণ করত। বহুপতি গ্রহণের ঘৃণিত প্রথা পরবর্তীকালে পুরুষ-প্রধান সমাজে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। ব্যভিচার সমাজ জীবনকে পাপ-পঙ্কিলতার শেষ স্তরে এরূপ নিমজ্জিত করে যে, স্ত্রী স্বামীর অনুমতিক্রমে পুত্র-সন্তান লাভের আশায় পর পুরুষের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হত। সম্পত্তি ভোগ করবার অধিকার নারীর ছিল না। কারণ মৃত পিতা অথবা স্বামীর সম্পত্তির অংশ হতে তারা বঞ্চিত ছিল। নারীদের প্রতি গৃহপালিত পশুর মত ব্যবহার করা হত। অভিজাতবর্গ দ্রুতগামী অশ্বের লেজের সঙ্গে জীবন্ত নারীকে বেঁধে খেলাচ্ছলে টেনে নিয়ে যেত; এর ফলে হতভাগ্য নারীর জীবনাবসান হত।
স্মরণাতীত কাল হতে আরব সমাজে দাস প্রথার প্রচলন ছিল। তাদের সামাজিক অধিকার অথবা ব্যক্তি-স্বাধীনতা ছিল না। পণ্যদ্রব্যের মত দাস-দাসীদের হাটে-বাজারে বিক্রি করা হত। আমীর আলীর মতে, “ভৃত্যই হউক আর ভূমিদাসই হউক তাদের ভাগ্যে ক্ষীণ আশা বা এক কণা সূর্যরশ্মিও কবরের এইদিকে (ইহজীবনে) জুটিত না।” দাসকে নির্মমভাবে নির্যাতন এবং দাসীকে উপপত্নী হিসাবে ব্যবহার করা হত। দাস- দাসীদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। প্রভুর অনুমতিক্রমে বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তা প্রভুর মালিকানায় চলে যেত।
প্রাক-ইসলামী সমাজ জীবনের সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য প্রথা ছিল নবজাত শিশু-সন্তানকে নিষ্ঠুরভাবে জীবন্ত কবর দেওয়া। কন্যা-সন্তানের জন্মকে আরববাসীরা অভিশপ্ত ও লজ্জাস্কর মনে করত। কুসংস্কার এবং কখনও কখনও দারিদ্র্যের কষাঘাতে কন্যা- সন্তানকে তারা জীবন্ত সমাধি দিতে কুণ্ঠিত হত না। কুরআন শরীফে তাই বলা হয়েছে “দারিদ্র্যের ভয়ে তুমি তোমার সন্তানদিগকে হত্যা করও না। আমি তাদের এবং তোমার জীবিকা সরবরাহ করে থাকি, নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মহাপাপ। “
অনাচার, নৈতিক অবনতি, ব্যভিচার আরব সমাজকে কলুষিত করে। লম্পট ও দুশ্চরিত্র আরববাসিরা পিতার মৃত্যুর পরে বিমাতাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করত। এরূপ ব্যভিচারমূলক (incestuous) বিবাহপ্রথা তৎকালীন বিশ্বে আর কোথাও ছিল কিনা সন্দেহ। স্বামীর মৃত্যুর পর তার কোন নিকটবর্তী আত্মীয়ের সঙ্গে স্ত্রীর পুনর্বিবাহ হত। মদ্যপান, জুয়াখেলা, লুঠতরাজ, নারী হরণ, কুসিদ প্রথা প্রভৃতি চরম নৈতিক অধঃপতনের স্বাক্ষর তাদের মধ্যে বিরাজমান ছিল। খ্রিস্টানগণ মদের একচেটিয়া ব্যবসা করত এবং ইহুদীরা ক্রীতদাসের ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল। ইরিনা (Irina) নামক এক প্রকার মদ সিরিয়ার খ্রিস্টান আরবগণ সর্বপ্রথম আরব দেশে প্রচলিত করে। কুসিদ প্রথা এরূপ চরম পর্যায়ে পৌছায় যে, ঋণগ্রহণকারী অর্থ পরিশোধ করতে সক্ষম না হলে মহাজন তার স্ত্রী এবং সন্তানদের হস্তগত করে দাস-দাসীরূপে বিক্রি করত। নৈতিক অবনতির অপর একটি জুলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় উহুদের যুদ্ধে বিধর্মী কুরাইশদের উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার উক্তি হতে, “তোমরা যদি অভিযান কর তা হলে আমরা তোমাদের সাদরে আলিঙ্গন করব এবং তোমাদের সঙ্গে যৌনাচারের ব্যবস্থা করব। কিন্তু তোমরা যদি পশ্চাদগমন কর তা হলে আমরা আনন্দ দান না করে তোমাদের পরিত্যাগ করব।” মৌলানা আকরাম খান তৎকালীন কলূষিত সমাজ জীবনের আলেখ্য প্রদান করে বলেন, “পুং মৈথুন, নারীর অস্বাভাবিক মৈথুন ও পশু মৈথুন তাদের মধ্যে প্রচলিত ও নির্দোষ বলে পরিগণিত হত।”
প্রাক-ইসলামী যুগে মক্কা ছিল আরব ভূ-খণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। মক্কা যে প্রাচীন ধর্মীয় স্থানরূপে পরিগণিত হত তার প্রমাণ টলেমীর বর্ণনায় পাওয়া যায়। দক্ষিণ আল-হেজাজের তিহায়ামা অঞ্চলে অবস্থিত মক্কা লোহিত সাগর হতে প্রায় আটচল্লিশ মাইল দূরে ছিল। কুরআন শরীফে মক্কাকে ‘কৃষির অনুপযুক্ত’ একটি শুষ্ক মরুময় পাহাড়ী অঞ্চল বলে অভিহিত করা হয়। কেবল ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে মক্কা খ্যাতি লাভ করে নি বরং বাণিজ্য কেন্দ্ররূপেও সমধিক পরিচিত ছিল। মক্কার গুরুত্ব বৃদ্ধির মূলে ছিল পবিত্র হেরেম শরীফ অর্থাৎ কা’বাগৃহে হজ্ব উদযাপন। এই উপলক্ষে প্রতি বৎসর অসংখ্য লোক মক্কায় আগমন করত এবং সেই সঙ্গে বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হয়। উত্তর-দক্ষিণ ‘সিল্ক রুট’ অপেক্ষা প্রাচীনতম মক্কা নগরী বাণিজ্য কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠে। বদর যুদ্ধের সময় গাজা হতে প্রত্যাবর্তনরত একদল কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে মুসলমানদের সংঘর্ষ বাধে। এই কাফেলায় এক হাজার উষ্ট্র ব্যবসায়ী সওয়ার ছিল এবং সঙ্গে ছিল ৫০,০০০ দিনার মূল্যের দ্রব্যসামগ্রী। কুরাইশগণ এই বাণিজ্যে নেতৃত্ব দান করেন এবং সম্পদশালী হয়ে উঠেন। কুরাইশ গোত্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে গঠিত হয় মক্কার বণিকশ্রেণী। মক্কার রাজনৈতিক সংগঠনের মূলে ছিল একটি মন্ত্রণা-সভা। এই সভা বিবদমান কুরাইশ গোত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করত। নগরবাসী কুরাইশগণ মরুবাসী বেদুঈন গোত্রসমূহের মধ্যে মৈত্রী বজায় রাখার প্রয়াস পান। মক্কার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল মন্ত্রণা- পরিষদ বা মা’লা। এই পরিষদের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা ছিল না, কেবল পরামর্শ দিতে পারত। স্বাধীন গোত্রগুলো নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী কাজ করত। এই মন্ত্রণা পরিষদের কার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কতিপয় দফতর ছিল। এই দফতরগুলোর মধ্যে নাসী (সৌর ও চান্দ্র বৎসরের মধ্যে পঞ্জিকার সামঞ্জস্য বিধানের অধিকার); সিকায়াহ (তীর্থযাত্রীদের প্রয়োজনে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা), রিফাদাহ্ (তীর্থযাত্রীদের জন্য রসদপত্র সংগ্রহকরণ) এবং লিওয়া (যুদ্ধের সময় পতাকা বহন) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(ঘ) ধর্মীয় অবস্থা
হযরত মুহম্মদ (স)-এর জন্মগ্রহণের প্রাক্কালে আরবে ধর্মীয় জীবন তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অজ্ঞতার যুগে আরবে চার ধর্মাবলম্বী লোক বসবাস করত- পৌত্তলিক জড়পূজারী ও অংশীবাদী গোষ্ঠী, ইহুদী, খ্রিস্টান ও হানিফ। আরবের অধিকাংশ লোকই ধর্মহীনতা, ঘৃণ্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা, জড়-পূজা, সৌর-পূজায় লিপ্ত ছিল।
প্রাক-ইসলামী যুগের কাব্য এবং আল-কালবীর “আল-আসনাম” (দেব-দেবী) হতে জানা যায় যে, মরুবাসী দুর্ধর্ষ বেদুঈনদের কোন বিশেষ ধরনের ধর্মবিশ্বাস ছিল না। হিট্টি বলেন, “ব্যবিলনবাসীদের মত পৌত্তলিক আরবগণের কোন পুরাণ-তত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব অথবা বিশ্বোৎপত্তির কোন তত্ত্ব-জ্ঞান ছিল না।” সেমিটিক ধর্ম-মতের মধ্যে বেদুইনদের ধর্মবিশ্বাস ছিল সর্বপ্রাচীন ও আদিম প্রকৃতির। তাদের মধ্যে জড় উপাসনার উন্মেষ দেখা দেয়। এর প্রধান কারণ ছিল এই যে, তারা কৃষিক্ষেত্র ও মরুভূমির ভিন্ন ভিন্ন অধিষ্ঠাত্রী দেব-দেবী রয়েছে বলে মনে করত। বেদুঈনদের এই জড়বাদী (Animistic) বিশ্বাসের ফলে তারা বৃক্ষ, কূপ, প্রস্তর ও গুহাকে পবিত্র বলে মনে করত। এই সমস্ত পবিত্ৰ জড়বস্তুকে তারা দেব-দেবী ও পূজারীর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত। প্রাণরক্ষাকারী মরুভূমির কূপ বেদুঈন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় ‘বাল’ (Bal) ঝর্ণার আত্মা বলে পরচিতি লাভ করে।
উইলিয়াম মূইর বলেন, “অনন্তকাল হতে মক্কা এবং সমগ্র উপদ্বীপ আধ্যাত্মিক অসারতায় নিমজ্জিত ছিল-সমগ্র অধিবাসী কুসংস্কার, বর্বরতা ও পাপাচারে ডুবে ছিল- তাদের ধর্ম ছিল ঘৃণ্য পৌত্তলিকতা এবং বিশ্বাস ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর পরিবর্তে অদৃশ্য একটি শক্তির কুহেলিকাপূর্ণ ভীতি।” উন্মুক্ত মরুপ্রান্তরে বসবাস করে আরব বেদুঈন সৌরজগতের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। দক্ষিণ আরবের স্বাধীন রাজ্যগুলোতে সূর্য ও চন্দ্র-দেবতার পূজা প্রচলিত ছিল এবং সম্ভবত বেদুঈনগণও অনুরূপ সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহের পূজা করত। চন্দ্র-পূজা বেদুঈনদের যাযাবর বৃত্তির পরিচায়ক। হিমাইয়ারী রাজ্যের অধিবাসীরা সূর্য দেবতার উপাসনা করত। লাখম ও জরহম গোত্র জুপিটার (Jupiter); কায়েস কুকুর- চন্দ্র (Dog – Star); আসাদ বুধ (mercury); তাই আগন্ত্য নক্ষত্রের (Canopus) উপাসনা করত। মক্কার মন্দির শনি- গ্রহকে (Saturn) উৎসর্গ করা হয়।
হযরত ইব্রাহিম (আ) এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য ধর্মপ্রচারকগণ পৃথিবীতে আল্লাহর একাত্ববাদ প্রচারের চেষ্টা করেন। কিন্তু হযরত মুহম্মদ (স)-এর জন্মের অব্যবহিত পূর্বে সমগ্র আরবে পৌত্তলিকতা এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কুরআন শরীফে উল্লেখ আছে, “মরুবাসী আরবগণ অবিশ্বাস ও ভণ্ডামিতে আত্মনিয়োগ করেছে।” (৯ : ৯৮) পৌত্তলিকতার অকাট্য প্রমাণস্বরূপ কুরআন শরীফে আল-লাত, মানাহ্ ও আল-উজ্জা নামে তিনটি প্রস্তর-মূর্তির উল্লেখ আছে (৫৩ : ১৯-২০)। ‘আল্লাহর কন্যা’ নামে বর্ণিত এই দেব-দেবী বস্তুত একটি প্রস্তরখণ্ড (Monolith) মাত্র। হেজাজ ও নেদ পৌত্তলিকতার প্রধান কেন্দ্র ছিল। হেরোডোটাস বর্ণিত আলি-লাত (Ali-lat)-ই ছিল তায়েফের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আল-লাত। প্রকৃতপক্ষে আল-লাত একটি চতুষ্কোণাকৃতি প্রস্তরখণ্ড। আল-উজ্জা মক্কাবাসীদের নিকট সর্বাধিক সমাদৃত ছিল। মক্কার নিকটবর্তী নাখলা নামক স্থানে তিনটি বৃক্ষবিশিষ্ট মন্দিরে আল-উজ্জার মক্কাবাসীদের নিকট সর্বাধিক সমাদৃত ছিল। মক্কার নিকবর্তী নাখলা নামক স্থানে তিনটি বৃক্ষবিশিষ্ট মন্দিরে আল-উজ্জার (Venus) উপাসনা হত; নরবলি ছিল অধিষ্ঠাত্রী দেবীর প্রধান আচার- অনুষ্ঠান। মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থান কুদায়েদ-এ ভাগ্যদেবী মানাহ্-এর মন্দির ছিল। আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা বলি প্রদানের উপযোগী কৃষ্ণ পাথরের এই মূর্তিকে অধিক সম্মান করত। এ ছাড়া কুরআন শরীফে ওয়াদ (Wadd), শুয়া (Suwa), ইয়াগুস (Yaghus), ইউক (Ya’uq) ও নম্র (Nusr) (৭১ : ২১-২২)-এর উল্লেখ রয়েছে। প্রাক-ইসলামী যুগের কোন কোন বিশিষ্ট নর-নারীও সম্মানার্থে দেব-দেবীর মূর্তিরূপে উপাস্য ছিল। কল্ব গোত্র মানুষ আকৃতির যে মূর্তি-পূজা করত তাই ওয়াদ নামে পরিচিত। নারীমূর্তি শুয়া ছিল হামদান গোত্রের অতি প্রিয় অধিষ্ঠাত্রী দেবী। মাজাহিদ গোত্রের সিংহমূর্তি ইয়াগুস, মুরাদ গোত্রের অশ্বাকৃতি ইউক, হিমাইয়ারী গোত্রের শকুনির মূর্তি নস্র প্রাক-ইসলামিক যুগের পৌত্তলিকতার জ্বলন্ত স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে। কুরআন শরীফে অপর যে দুটি দেবতার উল্লেখ করা হয়েছে উহা হল আল-জীব ও আল- তাগুত (৪ : ৫২)। বেদবী বিগ্রহের অসংখ্য প্রচলনে মনে হয় যে, প্রাচীনকালে আরবের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল।
একথা অবিসংবাদিত সত্য যে, প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে মক্কা আরবের সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনেতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেছিল। টলেমীর ম্যাকোরাবা (Macoraba) ও সাবিয়ান ম্যাকুরাবা (Makuraba) অধুনা মক্কাকেই নির্দেশ করেছিল; এর অর্থ দেবালয় অথবা ধর্মীয় স্থান হতে মনে হয় যে, হযরত মুহম্মদ (স)-এর জন্মের পূর্বেই এর ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মা’রিব ও গাজার মধ্যবর্তী বাণিজ্যপথে (Spice-route) অবস্থিত মক্কা শুধু শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যকেন্দ্রই ছিল না; বরং এর প্রাক-ইসলামী যুগের মন্দিরটি জাতীয় উপাসনালয়ের মর্যাদা লাভ করে। মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত আদমের তৈরি কা’বা মহাপ্লাবনের (The Deluge) পর হযরত ইব্রাহিম (আ) ও হযরত ইসমাইল (আ) কর্তৃক পুনঃনির্মিত হয় এবং এই সময় জীবরাঈল (আ) পবিত্র কৃষ্ণপ্রস্তরটি হযরত ইসমাঈলকে প্রদান করেন। বানু কোরাইজার পৌরহিত্যে সর্বপ্রথম মক্কার মন্দিরে দেব-দেবী স্থাপন করা হয় এবং এর সংখ্যা ৩৬০-এ পৌঁছায়। উল্লেখযোগ্য যে, ইবন-হিশামের মতে, আমর-ইবন লুহাই সর্বপ্রথম মেসোপটেমিয়া হতে আরব দেশে দেব-দেবীর মূর্তি আমদানি করেন। মক্কার উপাসনালয়ে সর্বপ্রধান বিগ্রহের নাম ছিল হোবল এবং এর আশেপাশে ভবিষ্যৎ গণনার জন্য কতকগুলো তীর রাখা হত। হোবল মনুষ্যাকৃতির একটি মূর্তি মাত্র। দক্ষিণ আরবের মিনাইয়ান ও সাবিয়ান শিলালিপিতে উল্লিখিত আল্লাহ্র স্থান ছিল মক্কার দেব-দেবীদের অনেক উপরে। কুরাইশ গোত্রের দেবতা হলেও আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও ত্রাণকর্তারূপে সম্মান করা হত। বিভিন্ন গোত্রের জন্য স্বতন্ত্র বিগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মক্কা নগরে প্রতিষ্ঠিত কা’বা মন্দির তাদের শ্রেষ্ঠতম ধর্মমন্দির বলে পরিগনিত হত। বৎসরের এক নির্দিষ্ট সময়ে মক্কায় তীর্থযাত্রা করে আরববাসী কা’বা (ছাদবিহীন চতুষ্কোণ মন্দির)-এর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ ও বলিদানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত।
মক্কার মন্দিরকে কেন্দ্র করে কুরাইশ গোত্র একচেটিয়া পৌরহিত্য করতে থাকে। এর ফলে তারা বংশ-মর্যাদা ও কৌলীন্যের দাবিদার ছিল। পৌরহিত্য, জীবজন্তু ও মানুষ বলিদান, মন্ত্র-তন্ত্র, জাদু, টোকা প্রভৃতি কুসংস্কারে প্রাক-ইসলামী আরববাসী আচ্ছন্ন ছিল। ভূত, প্রেত ভবিষ্যদ্বাণীতে তারা বিশ্বাসী ছিল। পরলোক সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা না থাকায় তারা জড়বাদীতে পরিণত হয়। ঐহিক সুখ ও শরাবে তারা আসক্ত ছিল। মস্তকবিহীন শর (আযলাম) নিক্ষেপ করে ভবিষ্যৎ গণনা করা হত এবং ভবিষ্যদ্বক্তা ‘কাহিন’ (Kahin) নামে অভিহিত হত।
রোমান সেনাপতি টাইটাস ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম শহর ধ্বংস করে প্যালেস্টাইন অধিকার করলে বহু সংখ্যক ইহুদী উত্তর আরবে আশ্রয় গ্রহণ করে। ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় ৭০০ বৎসর পূর্বে হিমাইয়ারী রাজা আবু কারিব আ’সাদ দক্ষিণ আরবে ইহুদী ধর্ম প্রবর্তন করেন। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইহুদী রাজা জুনুয়াস (Dhu – Nuwas ) বলপূর্বক ইহুদী ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেন। একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করলেও তিনি ইহুদী জড়বাদে আসক্ত হয়ে পড়েন; কারণ, ইব্রাহিম ও ভেড়ার একটি প্রস্তর মূর্তি কা’বা মন্দিরের অভ্যন্তরে স্থাপিত ছিল। হযরত মুহম্মদ (স)-এর জন্মের প্রাক্কালে উত্তর আরবের খায়বারে বানু নাজির, ফিদাকে বানু-কুরাইজা ও মদিনার নিকটে বানু কাইনুকা প্রভৃতি ইহুদী উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের প্রতি গভীর বিদ্বেষ প্রকাশ করায় রাসুলুল্লাহ (স)-কে ইহুদীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। তারা বিশ্ব-জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা সম্বন্ধে কোনরূপ সঠিক ধারণা দিতে অক্ষম ছিল এবং ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল।
ইহুদী ধর্মের মত খ্রিস্টান মতবাদ প্রাক-ইসলামী আরবে প্রচলিত ছিল। মূইর বলেন, “ধর্মীয় ক্ষেত্রে আরব-ভূমি খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের প্রচেষ্টায় ঘন ঘন আন্দোলিত হয়।” খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে দ্বিতীয় হিমাইয়ারী রাজ্যে ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রবর্তিত হয়। থিউফিলাস ইন্দাস এডেন ও হিমাইয়ারী রাজ্যে গীর্জা প্রতিষ্ঠা করেন। নাজরানে প্রধান খ্রিস্টান উপনিবেশ ছিল। কুরআন শরীফে বর্ণিত আছে : খ্রিস্টান আবিসিনিয়ান রাজা আবরাহা ৫৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে মক্কা অবরোধ করে ব্যর্থ হন। আল্লাহর অন্যতম গুণ ‘আল-রহমান’ ৫৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ আবরাহার একটি দক্ষিণ আরবের শিলা লিপিতে ‘রহমান- আন’ (Rahman-an)-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। দক্ষিণ আরব ছাড়া উত্তর আরবের সিরিয়া সীমান্তে ঘাস্সানী ও লামিদ রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হয়। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অন্তর্বিরোধ এবং যীশু ও মাতা মেরীর মূর্তিপূজার প্রবণতা ইসলামের আপোষহীন একেশ্বরবাদের অন্তরায় ছিল। উল্লেখযোগ্য যে, হযরত মুহম্মদ (স) মক্কা বিজয়ের পর কা’বা শরীফে প্রবেশ করলে মহাপুরুষ যীশু ও মাতা মেরীর একটি দেওয়াল-চিত্র দেখতে পান।
ধর্মীয় কুসংস্কার ও অনাচারের যুগেও আরব দেশ এক শ্রেণীর লোক একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা মূর্তিপূজার বিরোধীতা করে এবং পূর্ব পুরুষের নির্বুদ্ধিতা উপলব্ধি করে নিষ্কলুষ জীবনযাপন করেন। আরব দেশে প্রচলিত বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মতবাদ বিশ্লেষণ করে হানিফ সম্প্রদায় একেশ্বরবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, পরলোক ও সুখ-দুঃখ ভোগ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল।
ইবন-ইসহাকের মতে, প্রাক-ইসলামী যুগের বারজন মূর্তি উপাসনার পরিবর্তে হযরত ইব্রাহিমের হানিফিয়া (Hanifiyah) মতবাদ গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়। ইবন- কুতাইবার মতে, ছয়জন এই মতবাদ গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উমাইয়া বিন আবি স- সালত এবং আবু কাসেম বিন-আল আসলাত উল্লেখযোগ্য। ইসহাক বর্ণিত চারিজন নিজেদের হানিফ বলে অভিহিত না করলেও তারা এক সৃষ্টকর্তায় বিশ্বাস করতেন। এদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন কুরাইশ গোত্রের আসাদ বংশের ওয়ারাকা বিন নওফেল (বিবি খাদিজার চাচাত ভাই) এবং উমর বিন-আল-হুয়াইবিয়। মন্টোগোমারী ওয়াট বলেন, “রাসূলুল্লাহ (স)-এর জীবন বৃত্তান্ত ছাত্রদের জন্য তথাকথিত হানিফগণের তৎকালীন পরিবেশে একেশ্বরবাদ প্রচলনের নিদর্শন হিসাবেই গুরুত্ব বহন করবে।
(ঙ) অর্থনৈতিক অবস্থা
প্রতিকূল ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে আরববাসীদের অহরহ জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হত। মরুবাসী বেদুঈনদের আহার সংস্থানের জন্য লুঠতরাজ ও পশুচারণই একমাত্র জীবিকা ছিল। তাদের আর্থিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় সংখ্যাতত্ত্বে; কারণ, তারা ১০০০-এর উপর কোন সংখ্যা জানত না।
শহরবাসী আরবগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা অর্জন করত। প্রাক-ইসলামী যুগে মক্কা বহির্বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আরবের বাণিজ্য-পথে (Spice-route) অবস্থিত থাকায় মক্কাবাসিগণ সিরিয়া, পারশ্য, মিসর, ভারতবর্ষ ইত্যাদি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেন-দেন দ্বারা অর্থোপার্জন করত। মক্কা ও মদিনার সম্পদ ও সমৃদ্ধির জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য অনেকাংশে দায়ী। বিভিন্ন দেশের পণ্যদ্রব্য ‘উ-কায মেলায়’ বিক্রয় হত। উত্তরে গাজা হতে পণ্যসম্ভার নিয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে এক সহস্র উটের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বদরের যুদ্ধের অন্যতম প্ৰধান কারণ ছিল। কারণ, কুরাইশগণ তাদের স্বার্থরক্ষার্থে একটি বাহিনী নিয়ে মদিনা হতে মক্কায় কাফেলার নিরাপদে আগমনকে নিশ্চয়তা প্রদান করে। উল্লেখযোগ্য যে, এই কাফেলার সঙ্গে ৫০,০০০ দিনার মূল্যের ধনরত্নাদি ছিল। হযরত আবুবকর (রা), হযরত ওসমান (রা) ও বিবি খাদিজা (রা) মর্যাদাসম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে তাঁরা বহু অর্থ উপার্জন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, হযরত মুহম্মদ (স) বিবাহের পূর্বে বিবি খাদিজার বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরূপে সিরিয়ায় গমন করেন।
জাহেলিয়া যুগে ধনী আরবগণ বিশেষ করে ইহুদী সম্প্রদায় সুদের ব্যবসা করত। খাতক ঋণের দায়ে অনেক সময় সর্বস্ব হারাত, এমনকি অনাদায়ে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে মহাজন বলপূর্বক দাস-দাসীরূপে বিক্রয় করত। শোষণের এই ঘৃণ্য প্রথা (Usury) ইসলামে বর্জিত হয়। ইহুদী সম্প্রদায় ছাড়া মূর্তি নির্মাতাগণও আর্থিক সচ্ছলতার মধ্যে কালাতিপাত করত। পৌত্তলিকতার ব্যাপক প্রসারের ফলে বিগ্রহ নির্মাণ করে কারিগরগণ ইসলামের আবির্ভাবের প্রাক্কালে সামাজিক মর্যাদাও অর্জন করে।
হেজাজের প্রধান তিনটি নগরী মক্কা, মদিনা ও তায়েফ প্রাক-ইসলামিক যুগে খুবই সমৃদ্ধিশালী ছিল। দক্ষিণ হেজাজে নিম্নভূমিতে, লোহিত সাগর হতে প্রায় ৪৮ মাইল দূরে মক্কা নগরী ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। মক্কার প্রায় ৩০০ মাইল উত্তরে মদিনা শহর ইয়েমেন হতে সিরিয়া পর্যন্ত বাণিজ্যপথের সাথে সংযুক্ত। মক্কার তুলনায় মদিনা ছিল শস্য-শ্যামলা। বানু নাজীর ও বানু কুরাইজা নামক দু’টি ইহুদী গোত্রের চেষ্টায় মদিনায় কৃষিকার্য চলত। ৬০০০ ফুট উচ্চ তায়েফ মক্কার অভিজাত শ্রেণীর গ্রীষ্মকালীন আবাসে পরিণত হয়। এখানে তরমুজ, কলা, ডুমুর, আঙ্গুর, জলপাই, পীচ ও মধু উৎপন্ন হয়। তায়েফের আতরও খুব বিখ্যাত।
(চ) সাংস্কৃতিক অবস্থা
ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে আরবে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি অথবা সুরুচিপূর্ণ ও মার্জিত জীবনধারা গড়ে উঠে নাই। মক্কা, মদিনা ও অপরাপর কয়েকটি বর্ধিষ্ণু শহর ব্যতীত আরবের অধিকাংশ লোকই ছিল মূর্খ ও নিরক্ষর। ইহা সত্ত্বেও তাদের অসাধারণ স্মৃতিশক্তির ফলে প্রাক-ইসলামী যুগের লোক-গাঁথা, প্রবাদ, লোকশ্রুতি সংরক্ষিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, দ্বিতীয় হিজরীর পূর্বে উত্তর-আরবে লিখন পদ্ধতি প্রসার লাভ করে নাই। জুর্জী জিদান বলেন, “আরবগণ নিজেদের পিতা-পিতৃমহোদয়দের নাম বিশেষরূপে স্মরণ করে রাখতেন। আরবে এমন একটি সম্প্রদায় ছিল, যাদের উপর এই সমস্ত বংশ-বিবরণ স্মরণ করে রাখাই বিশেষ কর্তব্য বলে নির্ধারিত ছিল। প্রাক-ইসলামী যুগের আরববাসী তাদের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি বলে প্রায় এক লক্ষ্যের অধিক কবিতা সংরক্ষিত করে রাখে। তাদের সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়- খতিব বা বক্তা, শায়ের বা কবি এবং নেচ্ছাব বা বিভিন্ন গোত্রের বংশপরিচয় বা কুলজী বিশারদ।
হিট্টি বলেন, “পৃথিবীতে সম্ভবত অন্য কোন জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য-চর্চায় এত বেশী স্বতঃস্ফূর্ত একাগ্রতা প্রকাশ করে নি এবং লিখিত ও কথিত শব্দ দ্বারা আবেগাচ্ছন্ন হয় নি।” প্রাক-ইসলামী সাহিত্য পর্যালোচনা করলে আরবদের অজ্ঞ বলা যায় না; তাই তথাকথিত অজ্ঞতার যুগেও কাসীদা বা গীতি-কবিতা (Ode) রচনা করে তারা অশেষ কৃতিত্ব অর্জন করে। বাগ্মিতা ও গীতি-কাব্য রচনায় প্রাচীন আরবগণ সৃজনশীল মানসশক্তির পরিচয় প্রদান করে। অশ্বারোহণ, ধনুর্বিদ্যা এবং গদ্য ও পদ্যে অনর্গল বাগ্মিতার অধিকারীই সর্বগুণে গুণান্বিত হবার সম্মান দাবি করতে পারত।
লিখন পদ্ধতির সুষ্ঠু বিকাশ লাভ করতে না পারায় প্রাক-ইসলামী যুগের সাহিত্যে পদ্য-রচনার সংখ্যা ছিল খুবই কম। এজন্য জাহিলিয়া যুগে গীতি-কাব্যের (Qasidah) মত গদ্য-রচনা সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে নি। বংশ-বৃত্তান্ত, গোত্র-কলহ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস (আইয়াম-আল-আরব)-এ এর কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
প্রবাদ-বাক্য ও গদ্য-রচনা গীতি-কাব্যের তুলনায় অপ্রতুল ছিল। এতদসত্ত্বেও বিখ্যাত পন্ডিত আল-হাকিমের (Luqman) রচনায় আরবি প্রবাদ-বাক্য সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হয়েছিল। সর্বগুণে গুণান্বিত এইরূপ প্রাক-ইসলামী যুগে কয়েকজন নর-নারীর উল্লেখ আছে : যেমন- আখতাম-ইবন-সাইফি, হাজিব-ইবন-যুরাবা ও আল-কুস-এর কন্যা হিন্দা। তৎকালে বহুবিদিত দু’টি আরবি প্রবাদ ছিল : “মানুষের সৌন্দর্য তার জিহ্বার বাচনশীলতার মধ্যে নিহিত।” “বুদ্ধিমত্তা তিনটি বস্তুর উপর নিপতিত হয়েছে : ফরাসীদের মগজে, চীনাদের হস্তে এবং আরবীয়দের জিহ্বায়।”
আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আরবি গীতি-কাব্য অথবা কাসীদা সমসাময়িক কালের ইতিহাসে অতুলনীয়। ৫২২ হতে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে অসংখ্য গীতি- কাব্য রচিত হয় এবং কবিরা সেগুলো আবৃত্তি করতেন। কবিতা রচনার সাবলীল গতি ও স্বচ্ছ বাক্য-বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য থাকলেও উহার বিষয়বস্তু রুচিসম্মত ছিল না। যুদ্ধের ঘটনা, বংশ-গৌরব, বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুগের বিবরণ, উটের বিস্ময়কর গুণাবলি ছাড়াও নারী, প্রেম, যৌন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর গীতি-কাব্য রচনা করা হয়। হিট্টি বলেন, “কাব্য-প্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ।” প্রাক-ইসলামী কাব্য সাহিত্যের প্রথম পর্যায়ে মিলযুক্ত গদ্যের (‘সাজা’) সন্ধান পাওয়া যায়। কুরআন শরীফে এই ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কাব্য-চর্চার রীতির মধ্যে উষ্ট্রচালকের ধ্বনিময় সঙ্গীত (‘হুদা’) এবং জটিলতর ছন্দ রাজয্ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু কাসীদাই ছিল একমাত্র উৎকৃষ্ট কাব্য-রীতি। বসুস যুদ্ধে তাঘলিব বীর মুহালহিল সর্বপ্রথম দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। জোরালো, আবেগময়, সাবলীল ভাষা ও মৌলিক চিন্তাধারায় ইহা ছিল পুষ্ট। নিকলসনের মতে, “কবিতা সেই যুগে কিছু সংখ্যক সংস্কৃতমনা সুধীবৃন্দের শুধু বিলাসিতার বস্তুই ছিল না; বরং এটি ছিল তাদের সাহিত্য প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম।
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁদের বাগ্মিতা। জিহ্বার অফুরন্ত বাচনশক্তির অধিকারী প্রাচীন আরবের কবিরা মক্কার অদূরে উ-কাযের বাৎসরিক মেলায় কবিতা-পাঠের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। উ-কাযের বাৎসরিক সাহিত্য সম্মেলনে সাতটি ঝুলন্ত কবিতা (সব’অ-মু’অলকাত) পুরস্কৃত হয়। সোনালী হরফে লিপিবদ্ধ করে কবিতা দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হত বলে এগুলোকে মু’অলকাত বলা হয়। হিট্টি উ-কাযের মেলাকে “আরবের “Academic francise” বলে অভিহিত করেন।
–
প্রাক-ইসলামী যুগের কবিদের মধ্যে যশস্বী ছিলেন সাতটি ঝুলন্ত গীতি-কাব্যের রচয়িতাগণ। সোনালী হরফে লিপিবদ্ধ সাতটি কাব্য (Seven Golden Odes) রচনা করেন আমর ইবন-কুলসুম, লাবিদ-ইবন-রাবিয়া, আনতারা-ইবন-শাদদাদ, ইমরুল- কায়েস, তারাফা-ইবন-আল-আদ, হারিস ইবন হিল্লিজা ও জুহাইর ইবন-আবি-সালমা। এদের মধ্যে অসাধারণ প্রতিভাশালী ছিলেন ইমরুল-কায়েস। তিনি প্রাক-ইসলামী যুগের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। ইউরোপীয় সমালোচনাকগণও তাঁর উৎকৃষ্ট শব্দচয়ন, সাবলীল রচনাশৈলী, চমকপ্রদ স্বচ্ছ ছন্দ লহরীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘আরবদের শেক্সপিয়ার’ বলে অভিহিত করেন। আরবি ভাষার এরূপ প্রভূত উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধনে হিট্টি মন্তব্য করেন, “ইসলামের জয় অনেকাংশে একটি ভাষার জয়, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একটি ধর্মগ্রন্থের জয়।”
জোসেফ হেল যথার্থই বলেন যে, প্রাক-ইসলামী যুগের “শিক্ষা ও সংস্কৃতি আরবীয়দের নিজস্ব ও অপ্রভাবান্বিত সভ্যতা।” সব’অ-মু’ অলকাত ছাড়া তথাকথিত জাহেলিয়া যুগে অসংখ্য গাঁথা, সাহিত্য, বাকা ও গ্রন্থ প্রণীত হয়; যেমন– দিওয়ান আল-হামাসা, আল-মুফাজ্জালিয়াত ও কিতাব-আল-আগানী ইত্যাদি। আরবি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসাবে এগুলো সযত্নে সংরক্ষিত আছে। উল্লেখযোগ্য যে, তাকিব গোত্রের খালাব-ইবন-সালামাহ প্রতি সপ্তাহে একটি সাহিত্য মজলিসের ব্যবস্থা করতেন। ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনায় প্রাচীন আরববাসীদের যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে আরববাসীদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই প্রাচীন আরবি কবিতায় পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে। প্রাচীন আরবি কবিতা সম্পর্কে সয়ূতি বলেন, “কবিতা আরবদের সর্বজনীন পরিচয়ের স্বাক্ষরিত দলিল” (Public Register )।
অজ্ঞতার যুগের পাপ-পঙ্কিল সমাজ ব্যবস্থা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় মতবাদ, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা, অতিশপ্ত প্রথা ও অনুষ্ঠানের কথা বুঝতে হলে স্থান ও কাল সম্বন্ধে একটি সঠিক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ, আরবের অজ্ঞতা বা বর্বরতার যুগ বলে হযরত মুহম্মদ (স)-এর নবুয়ত লাভের এক শতাব্দী (৫১০-৬১০ খ্রিস্টাব্দ) পূর্বে হেজাজের অবস্থাকে বুঝায়। সামগ্রিকভাবে সমগ্র আরবের প্রাক-ইসলামিক যুগকে কখনই বর্বরতার যুগ বলা যেতে পারে না। আল্লাহ প্রেরিত মহাপুরুষের একেশ্বরবাদের আদর্শ হতে বিচ্যুত হয়ে সমগ্র মানব জাতি এক সঙ্কটজনক ও অভিশপ্ত অবস্থায় পতিত হয়। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ইহুদিগণ ধর্মগুরু প্রদর্শিত পথ ও একেশ্বরবাদের পথ তুলে পৌত্তলিকতার আশ্রয় গ্রহণ করে। খ্রিস্টানগণ হযরত ঈশা (আ)-এর প্রচারিত ধর্মমত হতে বিচ্যুত হয়ে ত্রিত্ববাদে (Trinity) বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। দক্ষিণ আরবে খ্রিস্টান, ইহুদী ও পরবর্তীকালে জরথুস্ত্র ধর্মের প্রভাবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক নৈরাশ্যজনক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই চরম দুর্গতিসম্পন্ন জাতিকে ন্যায় ও সত্যের পথে পরিচালিত করবার জন্য একজন মহাপুরুষের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। আমীর আলীর ভাষায়, “পৃথিবীর ইতিহাসে পরিত্রাণকারীর আবির্ভাবের এত বেশি প্রয়োজন এবং এমন উপযুক্ত সময় অন্যত্র অনুভূত হয় নি।” অবশেষে আল্লাহ মানব জাতিকে হেদায়েতের জন্য হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ পয়গম্বররূপে বিশ্বে প্রেরণ করেন। শুধু আরবের জন্য নহে, বরং সমগ্র বিশ্বে কুসংস্কারের কুহেলিকা ভেদ করে তৌহিদের বাণী প্রচার করবার জন্য তিনি মক্কায় ভূমিষ্ঠ হলেন। তিনি অনন্ত কল্যাণ ও স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আপোষহীন তৌহিদবাদের প্রতীক। সত্যই হিট্টি বলেন, “মহান ধর্মীয় ও জাতীয় নেতার আবির্ভাবের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হয়েছিল এবং সময়ও ছিল মনস্তাত্ত্বিকতাপূর্ণ।”
সমালোচনা
সামগ্রিকভাবে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরববাসীয়দের অকাট মূর্খ, বর্বর, অজ্ঞ ও নিরক্ষর বলা যেতে পারে না। অপরদিকে তাদের মধ্যে গোত্র-প্রীতি, সরলতা, কাব্যানুরাগ, ধর্মপ্রবণতা, আতিথেয়তা, বীরত্ব, স্বাধীনতাপ্রিয়তা, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, বদান্যতা, সাংস্কৃতিক মনোভাব প্রভৃতি প্রশংসনীয় গুণ ছিল। সমগ্র আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও উন্নতির কথা আলোচনা করলে প্রাক-ইসলামিক আরবদের কোনক্রমেই বর্বর বলা যেতে পারে না। তবে আপেক্ষিক অর্থে সমগ্র আরব এবং বিশেষ করে মক্কার ধর্মীয় অবস্থায় যে শূন্যতা বিরাজমান ছিল, তাকে তমসার যুগই বলা যায়।