প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

দ্বিতীয় অধ্যায় : মুয়াবিয়া (৬৬১-৬৮০ খ্রি.)

দ্বিতীয় অধ্যায় – মুয়াবিয়া [৬৬১–৬৮০ খ্রি.]

প্রথম জীবন

কুরাইশ বংশের উমাইয়া গোত্রে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন উমাইয়া দলপতি এবং কা’বার রক্ষক আবু সুফিয়ান। তাঁর মাতা হৃদয়হীনা হিন্দা, যিনি রাসূলে করীমের চাচা বীরশ্রেষ্ঠ আমির হামজা উহুদের যুদ্ধে নিহত হলে তাঁর হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ করেন। ইসলামের চরম শত্রু আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়াও রাসূলের তীব্র বিরোধিতা করেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর তিনি তাঁর পিতার সাথে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইসলামের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। মুয়াবিয়া অহী লিখবার জন্য রাসূলের ব্যক্তিগত সহকারী নিযুক্ত হন। তাঁর ভগ্নি উম্মে হাবিবার সাথে মহানবীর বিবাহ সম্পাদিত হলে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়। মুয়াবিয়ার ভ্রাতা ইয়াজিদ ইয়ারমুকের যুদ্ধে নিহত হন।

হযরত ওমরের খিলাফতে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্তির পর হতে মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তাঁর ভ্রাতা ইয়াজিদের মৃত্যুর পর খলিফা ওমর তাঁকে সিরিয়া প্রদেশের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। কর্মদক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে তিনি সমগ্র সিরিয়ায় সুশাসন কায়েম করেন ও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেনর তিনি নির্ভীকতা ও সামরিক দক্ষতার সঙ্গে সিরিয়াকে বায়জানটাইন আক্রমণ হতে রক্ষা করতে সমর্থ হন। তিনি খলিফা ওসমানের সময়ে সর্বপ্রথম একটি ক্ষুদ্র নৌবাহিনী গঠন করে দ্বীপাঞ্চলে মুসলিম প্রাধান্য বিস্তৃত করবার চেষ্টা করেন। তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে মুসলমানগণ সাইপ্রাস ও রোডস দ্বীপ দখল করেন। হযরত ওসমানের হত্যাজনিত গোলযোগের সময় হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। খলিফা ওসমানের আত্মীয় ও গোত্রীয় সদস্য বলে তিনি নিহত খলিফার পোশাক ও তাঁর স্ত্রী নাইলার কর্তিত আঙ্গুলি প্রদর্শন করে হযরত আলীর বিরুদ্ধে বানু উমাইয়াদের উত্তেজিত করেন। সিফফিনের যুদ্ধে এই অসন্তোষ ও অন্দদ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। দুমার আপোষ- মীমাংসা বৈঠকে তিনি আমর ইবন-আল-আসের সহায়তায় একটি কূটনৈতিক অভিসন্ধির মাধ্যমে হযরত আলীকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের একচ্ছত্র খলিফার মর্যাদা হতে বঞ্চিত করেন। হযরত আলীর হত্যা ও তাঁর পুত্র ইমাম হাসানকে পরাজিত করে সন্ধিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে মুয়াবিয়া খিলাফত লাভ করেন এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।

সিংহাসনে আরোহণ

৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ইমাম হাসানকে খিলাফতের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে মুয়াবিয়া ইসলামী সাম্রাজ্য তথা দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন। মূইর বলেন, “মুয়াবিয়ার দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ খিলাফতের সমাপ্তি এবং রাজতন্ত্রের সুচনা করে।” যে পন্থাই অবলম্বন করে থাকুন না কেন, মুয়াবিয়াকে অভিজ্ঞ শাসক, সুনিপুণ কূটনীতিবিদ, নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে। ক্ষমতালাভ করে তিনি উমাইয়া প্রতিপত্তির প্রাণকেন্দ্র প্রাদেশিক রাজধানী দামেস্ককে নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানীতে রূপান্তরিত করেন। কুফা থেকে রাজধানী দামেস্ক স্থানান্তরিত করবার মূলে বিবিধ কারণ ছিল; যথা- কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চপলমতিত্ব; সিরিয়ার উমাইয়াদের সমর্থন লাভের সম্ভাবনা, নব-প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের মধ্যস্থলে অবস্থিত থাকায় বিদ্রোহ দমন এবং প্রশাসনিক কার্যাবলি তদারকের সুবিধা। আমীর আলী যথার্থই বলেন, “উমাইয়াদের সিংহাসনে আরোহণে কেবল শাসক গোষ্ঠীর পরিবর্তনই হল না, এটি পূর্বনীতিগুলো পরিবর্তন করে এমন কতকগুলো অনুশাসনের প্রচলন করল যা সাম্রাজ্যের ভাগ্য এবং রাষ্ট্রের উন্নতিতে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে।”

হযরত ওসমানের হত্যার পর সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য, সংহতি ও শান্তি ব্যাহত হয়। খলিফা হযরত আলীর সংকটপূর্ণ শাসনকালেও এই গোলযোগের অবসান হয় নি I সিফিনের রণক্ষেত্রে হযরত আলীর সৈন্যদলে যে বিভেদ সৃষ্ট হয় তার মূলে ছিল দুমার মীমাংসা বৈঠকের সিদ্ধান্ত। এই বৈঠকের রায় মানতে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর হুকুমের উপর নির্ভর করে একদল সৈন্য খলিফা আলীকে ত্যাগ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ‘খারিজি’ নামে পরিচিত এই দলত্যাগী বিদ্রোহীগণ নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খলিফা হযরত আলীর নিকট পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু মুয়াবিয়ার শাসনকালে তারা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে ইরাকে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। খারিজিগণ কালদিয়া অধিকার করে এবং ইরাকে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করবার চেষ্টা করে। মুয়াবিয়া কঠোর হস্তে খারিজি বিদ্রোহ দমন করেন। বসরা, আহওয়াজ প্রভৃতি স্থানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিনি অরাজকতা বন্ধের প্রয়াস পান।

প্রাচীন কৌলীন্য প্রথায় আরবের লোকেরা সাধারণত দুভাগে বিভক্ত ছিল : কাহতান বা হিমারীয় বংশ এবং অপরটি হযরত ইব্রাহিমের পুত্র ইসমাইলের বংশ। কাহতান বংশের আদি বাসস্থান ছিল ইয়েমেনে এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশের অন্যতম ব্যক্তি আব্দুস সামসের পুত্র হিমায়ের নামানুসারে তারা হিমারীয় বলে অভিহিত হত। হিমারীয় বলতে সাধারণত দক্ষিণ আরব বংশসম্ভূত মনে করা হয়। অপর গোত্রটি হেজাজে বসবাস করতে থাকে। তাঁরা মাদের পৌত্র মুদার হতে উদ্ভূত বলে মুদারীয় নামে অভিহিত। উত্তর আরবের গোত্রসম্ভূত এই মুদারীয়গণ হিমারীয়দের মত সভ্যতার আওতাভুক্ত ছিল না। হিট্টি বলেন, “কাহতান অথবা হিমারীয়গণ আরবিয় আরব (Arabian Arabs) এবং মুদারীয়গণ হেজাজ, নেজদ, নাবাতীয় ও পালমিরা অঞ্চলে বাস করত বলে দক্ষিণ আরবদের মত বিশুদ্ধ আরব রক্তের অধিকারী ছিল না এবং সেজন্য তাদের দেশীকৃত আরব (Arabicized Arabs) বলা হত।” মুদারীয় গোত্রভুক্ত বিভিন্ন বংশের মধ্যে অন্যতম ছিল বানু কুরাইশ, বানু কায়েস, বানু বকর, বানু তাঘলিব ও বানু তামীম। হিমারীয়দের আমলে ব্যবসা ও বাণিজ্য দ্বারা আর্থিক উন্নতি ও সভ্যতার উন্মেষ হয় কিন্তু মুদারীয়গণ ছিল যাযাবর এবং কুরাইশদের আবির্ভাবের পূর্বে তাঁদের জীবনযাত্রাও ছিল নিম্নমানের। ইসলামের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শে রাসূলে করীম এই দুই গোত্রের বিরোধ দূর করতে সক্ষম হন। হযরত ওমরের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতি লাভ করে। এ দুই গোত্রের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে মুয়াবিয়া নিজের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করেন। মুদারীয়দের উপর তিনি নির্ভর করলেও কখনও হিমারীয়দের উপর নির্যাতন করতেন না। সিরিয়ায় শাসনকর্তা নিযুক্ত হবার পর হতে খিলাফত লাভের পূর্ব পর্যন্ত তিনি দক্ষতার সাথে দুই গোত্রের দ্বন্দ্ব নিরোধের চেষ্টা করেন। হযরত ওসমানের খিলাফতে সিরিয়ার কোন গোলযোগ দেখা দেয় নি। এতেই মুয়াবিয়ার সুযোগ্য শাসনকার্যের পরিচয় পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য যে, মুদারীয়গণ বসরায় ও হিমারীয়গণ কুফার বসবাস করতে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেক প্রদেশেই এ দুই গোত্রের লোকদের বসবাস ছিল। আমীর আলী যথার্থই বলেন, “ধূর্ত ও শাসক দক্ষ মুয়াবিয়া এই দুই গোত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে সক্ষম হন” (to hold the balance between them)। পরবর্তীকালে অপদার্থ খলিফাদের আমলে এই দুই গোত্রের দ্বন্দ্ব ও কোন্দল প্রকট আকার ধারণ করে। মুয়াবিয়ার প্রধান কৃতিত্ব ছিল গোত্রীয় হিংসা ও বিবাদ দমন করে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। হিট্টি বলেন, “বিশৃঙ্খলার ভিতর হতে মুয়াবিয়া শৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং একটি শান্তিপূর্ণ মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।”

প্রশাসনিক ব্যবস্থা

বিদ্রোহ দমন করবার পর নব-প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া সাম্রাজ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করবার মানষে মুয়াবিয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। কারণ, তিনি সহজেই বুঝতে পারেন যে, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে রাজ্য বিস্তার করা সম্ভবপর নয়। মুয়াবিয়ার একক প্রচেষ্টায় প্রাথমিক পর্যায়ে উমাইয়াদের সামরিক ও রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করা দূরূহ ছিল। হিট্টির মতে, “খলিফা মুয়াবিয়ার সাফল্যের মূলে তাঁর চারিপার্শ্বে অনুগামীবর্গের অবদানও কম ছিল না, বিশেষ করে উর্বর মিসরের শাসনকর্তা আমর ইবন-আল-আস; বিক্ষুব্ধ কুফার প্রশাসক আল মুগীরা-আল-শু’বাহ, বিদ্রোহী বসরার শাসনকর্তা জিয়াদ ইবন-আবিহ্। এই তিনজন তাঁদের নেতা মুয়াবিয়াসহ আরব মুসলমানদের চারটি রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি বলে পরিচিত।” তায়েফের অধিবাসী মুগীরা হযরতের সময় থেকেই একজন যোগ্য শাসক ও সুদক্ষ কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই চতুর উচ্চাভিলাসী ব্যক্তি হযরত আলীর নিকট পরাজিত হলেও মুয়াবিয়ার রাজত্বে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি তাঁর সুযোগ্য শাসনে কুফাবাসীদের বিদ্রোহ সমূলে উৎপাটিত করে স্বীয় কর্মদক্ষতার পরিচয় দেন। কপট ও শক্তিশালী মুগীরার অবদান ছিল প্রধানত দুটি-প্রথমত, মুয়াবিয়ার সাথে জিয়াদের সমঝোতা এবং দ্বিতীয়ত, তার প্ররোচনায় ইমাম হুসাইন (রা)-কে খিলাফতের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে ইয়াজিদকে মুয়াবিয়ার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা।

মুয়াবিয়ার শাসনকালে জিয়াদ ইবন-আবিহ অশেষ কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করেন। জিয়াদ ছিলেন মুয়াবিয়ার পিতা আবু সুফিয়ানের জারজ সন্তান; কারণ তার মাতা ছিলেন তায়েফের একজন ভ্রষ্টা রমণী ও আবু সুফিয়ানের উপপত্নী। কিন্তু নীচ পরিবেশ হতে দক্ষতা ও অধ্যবসায় গুণে তিনি হযরত আলীর খিলাফতে বসরা এবং ইসতাখরের (পারসিপলিস) শাসনকর্তার মর্যাদা লাভ করেন। বুদ্ধিমত্তা, বাগ্মিতা ও কর্ম প্রতিভার জন্য তিনি সে যুগে একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদরূপে পরিচিত ছিলেন। মুগীরার প্ররোচনায় জিয়াদ মুয়াবিয়ার সাথে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে উপঢৌকন নিয়ে দামেস্ক গমন করেন এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেন। মুয়াবিয়া জিয়াদকে দলভুক্ত করে স্বীয় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রথমত, জিয়াদকে প্রকৃত ভ্রাতা (Legitimate brother) হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন এবং দ্বিতীয়ত, গোলযোগপূর্ণ বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ধর্মীয় অসন্তোষ ও কলহ বসরায় চলতে থাকলে জিয়াদ এক হাজার সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর সাহায্যে উহাকে দমন করে শান্তি স্থাপন করেন। মুগীরার মৃত্যুর পর তিনি জিয়াদকে একই সঙ্গে বসরা ও কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তাঁর অন্যতম কীর্তি ছিল রাজ্য সম্প্রসারণ এবং কুফা ও বসরায় প্রাথমিক ও অনাড়ম্বর মসজিদ দুটিতে মার্বেল স্তম্ভ ব্যবহার দ্বারা সম্প্রসারণ ও সংস্করণ।

একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আমর-ইবন-আল-আসের কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যতীত মুয়াবিয়া কখনই উমাইয়া রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন না। হযরত আলীর সিফফিনের যুদ্ধের বিজয়কে তিনি ধূর্ততা ও শঠতার বলে কূটনৈতিক পরাজয়ে পরিণত করেন এবং পরবর্তীকালে দুমার মীমাংসা বৈঠকে নীতিজ্ঞান ও বিবেকবর্জিতভাবে হযরত আলীকে খিলাফত হতে বঞ্চিত করে মুয়াবিয়ার রাজত্বের সূচনা করেন। তাঁর সামরিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় হযরত ওমরের শাসনকালে। তিনি মিসর জয় করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। ফুসতাতে নতুন রাজধানী স্থাপিত হয় এবং তিনি মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। হযরত ওসমানের সময় তিনি কিছুকাল শাসনকার্য পরিচালনা করেন। পরে মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে মিসরে অভিযান করে খলিফা আলীর খিলাফতের শেষের দিকে প্রদেশটি দখল করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আমর সম্বন্ধে মূইর বলেন, “খিলাফতের পরিবর্তনে আমরের চেয়ে অপর কেহই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নি। যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসী, পরামর্শে ধূর্ত, কথায় ও কাজে রুক্ষ, নীতিজ্ঞানশূন্য আমরের বুদ্ধি বলেই মুয়াবিয়া হযরত আলীর উপর বিজয়ী হন এবং পরিণামে উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজ্য বিজয়

খিলাফত লাভ করে রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর মুয়াবিয়া অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, বিদ্রোহ, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দমন করেন এবং সুযোগ্য শাসকগোষ্ঠীর নিযুক্তি দ্বারা সমগ্র রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, রাজ্যবিস্তারের পূর্বশর্ত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান। এ কারণেই হিট্টি বলেন, “মুয়াবিয়ার শাসনকালে খিলাফত কেবল সুসংহতই হয় নি; বরং এর আঞ্চলিক বিস্তৃতিও সাধিত হয়েছিল।” মুয়াবিয়ার সুদক্ষ সেনানায়কদের পরিচালনায় হযরত ওমরের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃতি লাভ করে।

পূর্বাঞ্চল বিজয়

উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করবার পরপরই মুয়াবিয়া রাজ্যজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর মূলে প্রধান কারণ ছিল বিদ্রোহী উপজাতীয়দের দমন করে রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করা। তিনি আফগানিস্তান ও পারস্যের অধিকৃত অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করে সীমান্ত উপজাতিদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। ৬৬২ খ্রিস্টাব্দে হীরাতে বিদ্রোহ দেখা দিলে কঠোর হস্তে তা দমন করা হয়। এর দুই বছর পরে গজনী, কাবুল, বলখ, কান্দাহার প্রভৃতি এলাকায় অনুরূপ অভিযান প্রেরণ করে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং উমাইয়া প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাল্লাবের নেতৃত্বে ৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী সিন্ধুনদের তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে জিয়াদের এক পুত্র বুখারা দখল করেন। এর পর সমরকন্দ ও তিরমিজ উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে মুসলিম আধিপত্য উমাইয়া রাজত্বকালে পূর্বদিকে সমরকন্দ ও বুখারা এবং দক্ষিণ দিকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

পশ্চিমাঞ্চল বিজয়

পূর্ব দিকের মত মুয়াবিয়ার সাম্রাজ্য পশ্চিম দিকেও সম্প্রসারিত হয়। উত্তর আফ্রিকা বিজয়ের ফলে মুসলিম সাম্রাজ্যে নতুন অঞ্চল সংযোজিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, হযরত ওমরের শাসনকালে মিসর বিজিত হয় এবং ফুসতাত নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে মুসলমানগণ সর্বপ্রথম উত্তর আফ্রিকা বিজয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। খলিফা ওসমানের সময় আরব সৈন্যবাহিনী বার্কা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। বায়জানটাইন সম্রাট গ্রেগরী পরাজিত হন এবং বাৎসরিক কর প্রদানে স্বীকৃত হয়ে আনুগত্য স্বীকার করেন। হযরত ওসমানের খিলাফতে গোলযোগ ও খলিফা আলীর সময় গৃহযুদ্ধে। সুযোগে রোমীয় সম্রাট পরিত্যক্ত অঞ্চলগুলো পুনর্দখল করেন এবং অধিবাসীদের উপর নির্যাতন করতে থাকেন। মিসরের শাসনকর্তা খলিফা মুয়াবিয়াকে এই বিষয়ে অবগত করেন। খলিফা ১০,০০০ সৈন্যসহ ওকবা-বিন-নাফিকে ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় প্রেরণ করেন। শৌর্য ও বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ওকবা রোমানদিগকে পরাজিত করে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা রাজধানীতে পরিণত হয়। ওকবার বীরত্ব ও কৃতিত্বের কথা স্মরণ করেই ঐতিহাসিক গীবন তাঁকে ‘আরব আলেকজান্ডার’ (Arab Alexander) উপাধিতে ভূষিত করেন। আমীর আলী বলেন, “উত্তর আফ্রিকার হিংস্র ও যুদ্ধপ্রিয় জাতিসমূহের সাথে সংঘর্ষে আরবগণ যে অদম্য সাহস ও অপ্রতিহত উদ্দীপনা প্রদর্শন করে তা অন্য কোন দেশ বা জাতি করতে পারে নি।”

উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে মুয়াবিয়ার রাজত্বকালে ওকবা সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কিন্তু বিজিত রাজ্যগুলো সুসংহত করবার পূর্বেই রোমান ও বার্বারদের যৌথ আক্রমণে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর আকস্মিক বীরত্ব সর্বজনবিদিত। অভিযান পরিচালনা করে রণোত্ত ওকবা আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে উপনীত হয়ে দুঃখ করে বলেন, “হে আল্লাহ! যদি এই বিশাল সমুদ্র আমার অন্তরায় না হত, তা হলে আমি আরও দেশ জয় করতে পারতাম এবং তোমার ধর্ম ও নামের মহিমা প্রচার করতাম।”

কনস্টান্টিনোপল অবরোধ

খলিফা মুয়াবিয়া মুসলিম রাষ্ট্রের সম্প্রসারণে অশেষ কীর্তি রেখে গেছেন। তিনি সর্বপ্রথম নৌবাহিনী গঠন করে সিসিলি ও রোড্স দখল করেন। বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের শক্তিশালী নৌবহরের মোকাবিলা করবার জন্য তাঁকে নৌবাহিনী গঠন করতে হয়। আরবদের নৌধ্যক্ষ (Admiral) আবদুল্লাহ-বিন-কায়েস রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। মুয়াবিয়াও নৌবহন গঠন করে সিরিয়ার উপকূলভাগ রক্ষা করবার প্রয়াস পান। ৬৬২ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া আর্মেনিয়ার রোমানদিগকে পর্যুদস্ত করে আর্মেনিয়া দখল করেন এবং আকবা নামক স্থানে একটি পোতাশ্রয় স্থাপন করেন। ৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া এই পোতাশ্রয় হতে বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নৌ-অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানে নেতৃত্ব দান করেন মুয়াবিয়ার অযোগ্য ও বিলাসপ্রিয় পুত্র ইয়াজিদ। নৌ ও স্থল বাহিনীর যুগপৎ আক্রমণ এবং বলুদিন অবরোধের পরও কনস্টানিটনোপল অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মহামারী, খাদ্যাভাব, বিশৃঙ্খলা ও ইয়াজিদদের অসুস্থতার জন্য মুসলমানগণ কনস্টান্টনোপল জয় করতে পারে নি। তাঁরা শুধু সিজিকাস (Cyzicus) নামক ভূমধ্যসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ দখল করতে সমর্থ হয়। উল্লেখযোগ্য যে, বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবার জন্য তিনি ৫০০ রণতরী নিয়ে একটি বিশাল নৌ-বহর গঠন করেন। এর ফলেই ভূমধ্যসাগরে মুসলিম নৌ-বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়; যার ফলে উপর্যুপরি কয়েকটি দ্বীপে ইসলামের পতাকা সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়।

ইয়াজিদের মনোনয়ন

৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মুয়াবিয়া তদীয় পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে অনুসৃত নির্বাচন পদ্ধতিতে যে আমূল পরিবর্তন আনেন তার ফলেই বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বসরার শাসনকর্তা মুগীরার প্ররোচনায় তিনি ইমাম হাসানের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির অবমাননা করে নিজ ও গোত্রীয় স্বার্থে ইয়াজিদকে মনোনীত করেন। এই ব্যাপারে তিনি ইরাকীদের সমর্থন লাভে সমর্থ হন। আমীর আলী বলেন, “ইরাকীদের ঘুষ দিয়ে অথবা ফুসলিয়ে কিংবা বলপ্রয়োগ করে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। গণতন্ত্রের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুয়াবিয়ার বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই প্রচেষ্টায় মক্কার ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ তীব্র বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে হুসাইন-ইবন-আলী, আবদুল্লাহ- ইবন-যুবাইর, আবদুল্লাহ-ইবন-ওমর এবং আবদুর রহমান-ইবন-আবুবকর বিরোধীদের অন্যতম ছিলেন। ইয়াজিদকে মনোনীত করবার পর মুয়াবিয়া ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

মুয়াবিয়ার চরিত্র

মুয়াবিয়া শঠতার বশবর্তী হয়ে খিলাফত লাভ করলেও তাঁকে ইসলামের ইতিহাসে একজন অনন্য প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শাসকরূপে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি গৌরববর্ণ, দীর্ঘাকৃতি ও স্থূলকায় দেহের অধিকারী ছিলেন। তাঁর চরিত্রেও বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী গুণাবলির সমাবেশ দেখা যায়।

ঐতিহাসিক মাসুদী মুয়াবিয়ার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্বন্ধে একটি আলেখ্য রেখে গেছেন। তাঁর মতে, “ফজরের নামাজের পর তিনি নগরপালের নিকট হতে বিবরণ শ্রবণ করতেন। অতঃপর তাঁর মন্ত্রী ও সভাসদগণ রাষ্ট্রী পরিচালনার বিভিন্ন কার্য নিয়ে আসতেন। প্রাতঃরাশের সময় বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তাদের নিকট হতে প্রেরিত পত্রাদি একজন কর্মচারী তাঁকে পাঠ করে শুনাতেন। জোহরের নামাজের পর তিনি মসজিদে মকসুরায় বসে বিভিন্ন অভাব-অভিযোগ শুনতেন ও সেগুলো মীমাংসার চেষ্টা করতেন। সন্ধ্যায় তিনি মন্ত্রিপরিষদের সাথে আলোচনা করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতেন। আহারের পর তিনি রাত্রে অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকতেন। তাঁর জীবনযাত্রার প্রণালী দেখে মনে হয় যে, তিনি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল কার্যপদ্ধতির মাধ্যমে দিন অতিবাহিত করতেন।”

মুয়াবিয়া যেমন কঠোর ও হৃদয়হীন ছিলেন তেমনি আবার উদার, দয়ালু ও সুবিচারক ছিলেন। বিনয়, মার্জিত রুচি ও সংযম তাঁর চরিত্রের ভূষণ ছিল। তিনি জাতি- ধর্ম-নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোকদের সমান সুযোগ-সুবিধা দান করতেন। তাঁর রাজত্বে খ্রিস্টান প্রজাগণ সুখে-শান্তিতে বাস করত। ভূমিকম্পে খ্রিস্টানদের এডিসার গীর্জা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তিনি উক্ত গীর্জা পুনর্নির্মাণের সকল প্রকার ব্যবস্থা করতে কুণ্ঠিত হন নি। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে মুয়াবিয়া একটি পার্থব সাম্রাজ্য (Secular state) প্রতিষ্ঠা করলে মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। ভনক্রেমার বলেন, “সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়া উদার অন্তঃকরণ ও মনের অধিকারী ছিলেন। বায়জানটাইন সীজারদের নিকৃষ্ট ধর্মান্ধতার তুলনায় খ্রিস্টানদের প্রতি তাঁর মনোভাবের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল।”

খলিফা মুয়াবিয়ার চরিত্রে বিচিত্র গুণের সমাবেশ দেখা যায়। প্রথম জীবনে ইসলাম ধর্ম গ্রহনকরে তিনি রাসূলে করীমের ব্যক্তিগত সহকারী ও হযরত ওমরের খিলাফতে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে স্বীয় দক্ষতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন। শাসক হিসেবে ধূর্ত, কপট ও অমিতব্যয়ী হলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কলুষিত ছিল না। খোলাফায়ে রাশেদূনের মত সরল ও অনাম্বর জীবনযাত্রার পরিবর্তে পারস্য ও বায়জানটাইন প্রভাবে তিনি সর্বপ্রথম জাঁকজমক, আড়ম্বরপূর্ণ, বিলাস-বাসন, অমিতব্যয়িতা, সমারোহপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেন। তিনি মকসুরায় নামাজ পড়তেন এবং উপবিষ্ট হয়ে খোৎবা পাঠ করতেন-এটি সুন্নাহর পরিপন্থী ছিল। প্রথম চারজন খলিফা দেহরক্ষী নিযুক্ত করাকে অনৈসলামিক প্রথা মনে করতেন। মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করেন। তাঁর শাসন ও জাঁকজমকপূর্ণ দরবার প্রতিষ্ঠায় পারস্য ও বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি মসজিদের মধ্যে সর্বপ্রথম খলিফার জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠ অথবা মকসুরা নির্মাণ করেন। মুয়াবিয়ার অপর একটি অভিনব প্রচেষ্ঠা ছিল মদিনা মসজিদ থেকে রাসূলে করীমের প্রচার বেদী বা মিম্বার দামেস্কে স্থানান্তর করা। অবশ্য তাঁর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারক, সুযোগ্য শাসক, অসাধারণ বাগ্মী, প্রতিভাশালী সংগঠক, দক্ষ কূটনীতিবিদ, কৃষ্টির পৃষ্ঠপোষক, উদার সহিষ্ণু ও দরদী নেতা মুয়াবিয়া ইসলামের ইতিহাসে একটি অনন্য প্রতিভা সন্দেহ নেই। কিন্তু আমীর আলীর মতে, “তিনি ছিলেন ধূর্ত, অসৎ, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন, কৃপণ অথচ প্ৰয়োজনবোধে অস্বাভাবিক উদার এবং যাবতীয় ধর্মীয় কার্যে বাহ্যিকভাবে নিষ্ঠাবান। কিন্তু তাঁর কোন পরিকল্পনা অথবা আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থতায় কোন মানবীয় অথবা ধর্মীয় নীতিই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারত না। সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পর তিনি যাবতীয় শত্রুকে আপনার পথ হতে অপসারিত করে অত্যন্ত অধ্যবসায় সহকারে সাম্রাজ্যে সুশাসনের জন্য আত্মনিয়োগ করেন।”

মুয়াবিয়ার কৃতিত্ব

সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠাতা : মুইর যথার্থই বলেছেন, “দামেস্কে মুয়াবিয়ার সিংহাসনারোহণ খিলাফতের সমাপ্তি এবং রাজতন্ত্রের প্রারম্ভ সূচনা করে।” বিবেকশূন্য চক্রান্তকারী, কূটনৈতিক, দুরভিসন্ধির বশবর্তী হয়ে মুয়াবিয়া শুধু দুমার মীমাংসা বৈঠকে হযরত আলীকে খিলাফত হতে বঞ্চিত করেন নি, বরং কুরআন ও হাদিসের আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রথম ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সমাধি রচনা করেন। “আরব সীজার’ নামে খ্যাত মুয়াবিয়া ধূর্ততা, কপটতা ও অসাধুতার আশ্রয় গ্রহণ করে ইমাম হাসানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির অবমাননা করে মৃত্যুর পূর্বে শুধু নিজের অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে মনোনীত করেন নি; রং ছলে, বলে ও কৌশলে আরব জাহানে জনসাধারণের আনুগত্য অর্জন করেন। স্বামীর আলীর মতে, “ইমাম হাসানের পদত্যাগের পর মুয়াবিয়া ইসলামের একজন ঘোষিত এবং কার্যত শাসক হলেন এবং ষড়যন্ত্রের সাহায্যে তাঁর জীবনের অবসান টিয়ে তিনি অবিসংবাদিত, অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং একচ্ছত্র (De jure) নৃপতি হলেন। যা হউক একথা অনস্বীকার্য যে, বিচক্ষণতা, অসাধারণ ব্যুৎপত্তিজ্ঞান, কর্মদক্ষতা ও অধ্যবসায়ের বলে মহানবীর একজন ব্যক্তিগত সহকারীর পদ হতে মুয়াবিয়া শুধু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাই হলেন না; বরং ইসলামী রাষ্ট্রের ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থাকে সংরক্ষিত করলেন। যদিও তিনি ইসলামের মৌলিক আদর্শ হতে বিচ্যুত ছিলেন তবুও তিনি বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ৯০ বছরব্যাপী উমাইয়া খিলাফতের সূচনা করেন। হিট্টি বলেন, “এরূপে মুয়াবিয়া কেবল নতুন এক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, হযরত ওমরের পরে খিলাফতের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন।”

সমরনেতা : ইসলামের সম্প্রসারণে মুয়াবিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। বিশ বছরকাল সিরিয়ায় শাসনকার্য পরিচালিত করে তিনি শুধু স্বীয় প্রতিপত্তিই সুপ্রতিষ্ঠিত করেন নি বরং একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করে উত্তর আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াস পান। হিট্টি বলেন, “যোদ্ধা হিসেবে তিনি হযরত আলী অপেক্ষা নিকৃষ্ট হলেও সামরিক সংগঠক হিসেবে তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে অদ্বিতীয় ছিলেন।” ওকবা-ইবন-নাফী উত্তর আফ্রিকা হতে বায়জানটাইনদের বিতাড়িত করে কায়রোয়ানে প্রাদেশিক রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করেন। “আরব আলেকজান্ডার’ ওকবার অসীম বীরত্বে মুয়াবিয়া উত্তর আফ্রিকায় স্বীয় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। নৌবহর গঠন করে মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ সিসিলি, রোড়স, সিজিকাস দখল করে সাগরে মুসলিম প্রভুত্ব কায়েম করেন। কনস্টানটিনোপল বিজয়ে ব্যর্থ হলেও তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম নৌবহর গঠন করে অশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। খলিফা ওসমানের শাসনকালে তিনি বায়জানটাইন নৌবহরের মোকাবিলা করবার জন্য বুসর- ইবন-আবি-আবতার-এর নেতৃত্বে একটি নৌবাহিনী গঠন করেন। স্থলে বিশাল পদাতিক বাহিনী যেভাবে বায়জানটাইন আক্রমণ প্রতিহত করে সেরূপ বায়জানটাইনদের সমুদ্রাভিযানকে প্রতিহত করে সিরিয়ার উপকূলকে রক্ষা করার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়। এ কারণে হিট্টি যথার্থ বলেন, “মুয়াবিয়ার শাসনকালে শুধু সংহতি বিধানই নহে; বরং খিলাফতের আঞ্চলিক বিস্তৃতিও হয়েছিল।”

শাসক : সুদক্ষ এবং প্রতিভাবান শাসক হিসেবে মুয়াবিয়া অশেষ খ্যাতি অর্জন করেন সত্য; কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক রদবদলের অভিযোগ করা হয়েছে। হিট্টির ভাষায়, “তিনি গতানুগতিক বহু সরকারি কার্যাবলির বিলোপ সাধন করেন এবং বায়জানটাইনদের পূর্ব প্রবর্তিত শাসন কাঠামোর উপর একটি স্থায়ী এবং সুসংহত রাষ্ট্র গড়ে তোলেন।” মিসরে আমর-ইবন-আল-আস, কুফায় মুগীরা ইবন-সুবাহ, বসরায় জিয়াদ ইবন-আবিহ শাসনকার্যের গুরুদায়িত্ব লাভ করে নব প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া খিলাফতকে সুদৃঢ় ও সুসংবদ্ধ করেন। মুয়াবিয়া এবং এই তিনজন বিচক্ষণ শাসককে হিট্টি “আরব মুসলমানদের চারটি রাজনৈতিক প্রতিভা” বলে অভিহিত করেন।

মুয়াবিয়া সূক্ষ্ম রাজনীতিজ্ঞ ও সুশাসক হিসেবে অক্ষয় কীর্তি অর্জন করেন। চারিত্রিক দুর্বলতা এবং বংশীয় পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও একথা স্বীকার করতে হবে যে, তিনি ছিলেন ধীরস্থির, হিসাবী, মেধাবী, ধৈর্যশীল, দূরদর্শী এবং কর্মঠ। তাঁর অনুসৃত নীতিগুলো বৃহত্তর ইসলামের স্বার্থে প্রয়োগ করা হলে ইসলাম, রাষ্ট্র ও ধর্ম আরও সুসংহত হত, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রশাসনিক কাঠামো গঠিত হয়েছিল উমাইয়া বংশের স্বার্থে।

মুয়াবিয়া খোলাফায়ে-রাশেদূনের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী নীতিগুলো সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাৎ করে পারস্য ও বায়জানটাইন শাসন পদ্ধতির প্রভাবে প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করেন। তিনি পরামর্শ সভা অথবা মজলিস-উস-শূরা বাতিল করেন এবং নির্বাচনের পরিবর্তে মনোনয়ন দ্বারা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে তাঁকে একটি বংশের প্রতিষ্ঠাতা (Father of a dynasty) বলে অভিহিত করা হয়। সুশাসন প্রবর্তনের জন্য তিনি অনেকাংশে কৃতিত্বের অধিকারী। কেন্দ্রীয় শাসন প্রবর্তনের জন্য তিনি রাজধানী দামেস্কে একটি সচিবালয় বা সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠা করেন। শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজধানীতে একটি কেন্দ্রীয় পরামর্শ সভা গঠন করেন এবং প্রদেশসমূহ থেকে প্রতিনিধিগণ এই পরামর্শ সভায় যোগদান করে খলিফাকে বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করতেন। শাসনের কেন্দ্রীয়করণের দ্বারা সমগ্র রাজ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভবপর হয়েছিল। আরবি ভাষার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে কার্যনির্বাহ করা হত কিন্তু প্রদেশগুলোতে গ্রীক, ফারসি ও আরবি ভাষা ব্যবহৃত হত। হিট্টি যথার্থই বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি হতে তিনি একটি সুসংঘবদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে তোলেন।” বার্নাড লুইস বলেন, “তাঁর গোত্রের (উমাইয়া) প্রচলিত শাসন পদ্ধতির ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা (ইয়াজিদের মনোনয়ন) একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল। এ ক্ষেত্রে তিনি সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা প্রদর্শন করলেও আরব শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।”

মুয়াবিয়া ইসলামী রাষ্ট্রে সর্বপ্রথম কতকগুলো অভিনব শাসন পদ্ধতি প্রচলন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম ডাক বিভাগ (Al-barid) স্থাপন করেন। উট ও ঘোড়ার সাহায্যে তিনি সরকারি ও বেসরকারি চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রতি ১১ মাইল অন্তর একটি করে ডাকঘর স্থাপিত হয়। ডাক বিভাগের (দেওয়ান-উল-বারিদ) প্রধান কর্মকর্তাকে বলা হত সাহিব-উল-বারিদ। হযরত ওমরের সময়ে গুপ্তচর প্রথা প্রচলিত ছিল, মুয়াবিয়া এটিকে সম্প্রসারিত করেন। গুপ্তচরদের প্রধান কর্তব্য ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয় সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহ করে খলিফাকে অবহিত করা।

প্রশাসনিক সংস্কারের অন্যতম পদক্ষেপ ছিল রাজস্ব বিভাগের পুনর্গঠন। মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম রাজস্ব বিভাগকে প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বিভাগে পরিণত করেন। কারণ, অর্থনৈতিক ব্যাপারে তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তার হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না। সাহিব-উল-খারাজ বা রাজস্ব সচিব নামে এক প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত করে খলিফা রাজস্ব আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর ফলে একদিকে যেমন প্রাদেশিক গভর্ণরদের ক্ষমতা হ্রাস পায়, অপরদিকে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক উন্নতি ও সচ্ছলতার সূচনা হয়। মুয়াবিয়ার শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রেজিস্ট্রি বিভাগ স্থাপন করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে নিয়মিত যে সমস্ত চিঠিপত্র আদান-প্রদান হত সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। খলিফার বিধানগুলো এই বিভাগ কর্তৃক রেজিস্ট্রি করা হত এবং আসল আদেশটি খলিফার মোহরাঙ্কিত হয়ে প্রদেশে প্রেরণ করা হত। জালিয়াতি বন্ধ করবার জন্য দিওয়ান-উল-খাতাম বা রেজিস্ট্রি বিভাগ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এবং এটি প্রতিষ্ঠা করে খলিফা বিচক্ষণতার পরিচয় দেন।

উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠা দৃঢ়করণের মূলে ছিল একটি সুসংঘবদ্ধ ও সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী গঠন। মুয়াবিয়ার রাজত্বের প্রধান সমর্থক ছিল সিরিয়াবাসী-সিরিয়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং মিশরীয় আরব অধিবাসিগণ। হিট্টি বলেন, “তিনি তাঁর নির্ভরযোগ্য সিরীয় বাহিনীকে ইসলামের যুদ্ধের ইতিহাসে একটি প্রথম সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত করেন।” প্রাচীন গোত্রভিত্তিক সৈন্য বাহিনীর পরিবর্তে তিনি জাতি-ধর্ম- নির্বিশেষে একটি সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্রীয় সমরবাহিনী গঠন করেন। এর ফলে তাঁর খিলাফতে পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকা হতে পূর্বে সমরকন্দ ও সিন্ধু নদের অববাহিকা পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পায়। মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতার কথা উল্লেখ করে হিট্টি বলেন, “অপরাপর খলিফা অপেক্ষা মুয়াবিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সর্বাধিক মাত্রায় প্রকাশ পায়।” (“In Mu’awiyah the sense of finesse politique was developed to a degree probably higher than in any other Caliph.”)

সংগঠক : রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা ও সম্প্রসারক হিসেবেই মুয়াবিয়া ইসলামের ইতিহাসে সমাদৃত হন। তিনি বিজিত অঞ্চলে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সমগ্র দেশকে সুসংঘবদ্ধ করেন। সংগঠক হিসেবে তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদের পরিচয় দেন। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁকে “আরবদের মধ্যে শুধু প্রথমই নহেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি” (“Not only the first but also one of the best of the Arab kings”) বলে অভিহিত করা হয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী মুয়াবিয়া অবশ্য ধূর্ত, ধর্মভয় বিবর্জিত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন এবং স্বীয় অবস্থা নিরাপদ করবার জন্য যে কোন প্রকার অন্যায় কাজ করতে তিনি সংকোচ বোধ করতেন না। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারিত করবার জন্য হত্যাই ছিল তাঁর চিরাচরিত রীতি। নবীর দৌহিত্র্যকে তিনি বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। হযরত আলীর অসম সাহসী সেনাপতি মালিক-উল-আসতারও অনুরূপভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। স্বীয় পুত্র ইয়াজিদের উত্তরাধিকার নিষ্কণ্টক করবার জন্য হযরত আলীর জীবিত পুত্র ইমাম হুসাইনের সাথে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেও তিনি পশ্চাৎপদ হন নি। “যা হউক তিনি ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমান এবং অধার্মিক ছিলেন। তিনি আরব মুসলিম অঞ্চলে রাজত্ব করেন এবং রাজদণ্ড প্রায় নব্বই বছর তাঁর পরিবারের হস্তগত ছিল।” বংশ ও গোত্রীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুয়াবিয়া আমর ও মুগীরার মাধ্যমে জিয়াদকে হস্তগত করতে দ্বিধা করেন নি। আমরকে মিসরের শাসনভার অর্পণের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে নিজ দলভুক্ত করেন। অনুরূপভাবে পিতার অবৈধ সন্তান জিয়াদকে আপন ভ্রাতার মর্যাদা প্রদান করে প্রথমে বসরা ও পরে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। উমাইয়া রাজত্ব ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পরিপন্থী ছিল এবং তিনি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে আরবের জাতিগত ও গোত্রীয় মনোভাবের ভিত্তিতে একটি পার্থিব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মুয়াবিয়া আরব গোত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে কোন্দল, দ্বেষ ও অরাজকতাকে নির্মূল করেন; মুদারীয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ গোত্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী হিমারীয় গোত্রের মধ্যে সদ্ভাব রক্ষা করতে সমর্থ হন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, তিনি নিরপেক্ষ গোত্রীয় নীতি অনুসরণ করেন। মারওয়ানকে হেজাজের গভর্নর নিযুক্ত ব্যতীত তিনি তাঁর স্বগোত্রীয় কোন ব্যক্তিকে উচ্চ সামরিক এবং প্রশাসনিক পদে অধিষ্টিত করেন নি। আমীর আলীর ভাষায়, “মুয়াবিয়া মুদারীয়গণের সমর্থনের উপর নির্ভর করলেও তাদের এবং হিমারীয়দের মধ্যে মোটামুটি ক্ষমতাসাম্য এবং একে অন্যের উপর যাতে অত্যাচার করতে না পারে তা বন্ধ করবার পক্ষে তীক্ষ্ণ ধী-সম্পন্ন ছিলেন।” তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় স্বগোত্র বহির্ভুত মহিলার পাণিগ্রহণে। বানু কায়েস গোত্রীয় হয়েও তিনি সিরিয়ার বানু কালব গোত্রের সমর্থন লাভের আশায় এই গোত্রের নেতা বাহদালের কন্যা কবি মায়মুনাকে বিবাহ করেন এবং তাঁর গর্ভজাত পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়া শিল্প সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঐতিহাসিক শিবলী নোমানের মতে, “তিনি বিখ্যাত খ্রিস্টান চিকিৎসক ইবন আসালকে (Ibn Uthal) দরবারে আমন্ত্রণ করেন এবং হিস প্রদেশের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন।” তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে লিখিত কয়েকটি পুস্তক আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। অপর একজন খ্রিস্টান আল-আখতাল (Al-Akthal) মুয়াবিয়ার সভাকবি ছিলেন। উদারতা, সহিষ্ণুতা, সৌজন্যমূলক ব্যবহার, ধর্মীয় নিরপেক্ষতায় তিনি তাঁর সমসাময়িক রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কনস্টানস এবং গোনেটাস অপেক্ষা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন।

নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক বিচারে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, মোটের উপর মুয়াবিয়ার রাজত্বকালে একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ সমৃদ্ধি ও শান্তি বজায় ছিল, অপরদিকে বিদেশেও তেমনি সাফল্য অর্জিত হয়।” প্রজাতন্ত্র ধ্বংস ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুয়াবিয়া ধৃষ্ঠতা প্রদর্শন করলেও স্মরণ রাখতে হবে যে, উমাইয়া খিলাফতের মাধ্যমে মুসলিম আধিপত্য ও প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। কেনেথ ডব্লিউ মরগান বলেন, “খিলাফতের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে গৃহযুদ্ধ এড়াতে হলে বংশানুক্রমিক নীতি কায়েম করা ব্যতীত আর কোন বিকল্প পথ নেই।” অনৈসলামিক ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী কার্যকলাপে জড়িত হলেও ইসলামের ইতিহাসে শাসক, সমরনায়ক ও সংগঠক হিসেবে তিনি একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থান দখল করে রয়েছেন। হিট্টি বলেন, “তিনি তাঁর উমাইয়া উত্তরাধিকারীদের জন্য নম্রতা, উদ্যম, বিচক্ষণতা ও রাজনীতিজ্ঞানের একটি অনবদ্য নজির রেখে গেছেন। অনেকে এর সমকক্ষ হতে চেষ্টা করেন, কিন্তু খুব কমই সফল হন। তিনি আরব নৃপতিদের মধ্যে কেবল প্রথমই ছিলেন না, তিনি তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠও ছিলেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *