প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

ষষ্ঠ অধ্যায় : ইসলামী রাষ্ট্রের : রূপরেখা মদিনা সনদ

ষষ্ঠ অধ্যায় – ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা : মদিনা সনদ

হিজরতের পর হযরত মুহাম্মদ (স) প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব ছিল কলহ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত মদিনাবাসীদের মধ্যে একটি ভ্রাতৃ সংঘ গঠন করে নিরাপত্তা ও শান্তি বিধানের প্রয়াস। বুয়াসের যুদ্ধে আউস এবং খাজরাজ গোত্রদ্বয় জড়িত হয়ে পড়ে এবং বনু কুরাইজা ও বনু নাজির আউস এবং বনু কাউনুকা খাজরাজের পক্ষে সমর্থন করে। এর ফলে মদিনার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি জটিল ও শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং মদিনাবাসিগণ সংশয়, উদ্বেগ ও অস্থিরতার মধ্যে কালাতিপাত করতে থাকে। ধর্মীয় অধঃপতন ও হতাশা, সামাজিক অসন্তোষ ও কুসংস্কার এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মদিনাবাসীগণ একজন মহাপুরুষ ও ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স) ত্রাণকর্তা হিসেবে মদিনায় আগমনে ইয়াসরিববাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নবী করিম মদিনায় প্রাণভয়ে ভীত পলাতক উদ্বাস্তু (fugitive) ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন সম্মানিত অতিথি নব-জাগরণের অগ্রনায়ক, ভবিষ্যৎ ইসলামী কমনওয়েলথের প্রতিষ্ঠাতা, মিলনের অগ্রদূত, আশার আলো ও বিশ্ব মানবের ত্রাণকর্তা।

ইবনে ইসহাক ‘সিরাতুন নবী’ গ্রন্থে মদিনা সনদের বিস্তারিত বিবরণ দেন। এই সনদকে সাধারণভাবে Constitution of Medina বলা হয়। মদিনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার জন্য নবী করিম একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপনের সংকল্প করেন। আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়কে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা এবং অমুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তুলার জন্য তিনি ৪৭টি শর্ত সম্বলিত একটি সনদ প্রণয়ন করেন। এটি ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদ বা Charter of Medina নামে অভিহিত।

ইবন ইসহাক বলেন, “মহান আল্লাহ প্রেরিতপুরুষ (আল্লাহর শান্তি তার উপর বর্ষিত হোক এবং আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেন একটি কিতাব (সনদ) রচনা করেন যা আনসার এবং মোহাজেরীনদের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করে। এই সনদের মধ্যে যে ইহুদী সম্প্রদায়কে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জান ও মালের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। সে সাথে তাদের উপর কতিপয় দায়িত্ব এবং অধিকার প্রদান করা হয়।” সনদটি এরূপ-মহান আল্লাহ তায়ালার, যিনি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল, নামে এই সনদ লিখিত হলো।

এই সনদটি নবী করিম মুহাম্মদ (স) কর্তৃক লিখিত। এটি মুসলমানদের আনসার এবং মোহাজেরীনদের মধ্যে সম্পাদিত হয়। শুধু তাই নয় যারা এই সন্ধিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং যারা ইসলামের জন্য অস্ত্র ধারণ করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ তারাও মদিনা সনদের আওতাধীন। এই সনদে মোট ৪৭টি শর্ত ছিল।

(১) মদিনা সনদের স্বাক্ষরদানকারী ইহুদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ সমান অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সাধারণ জাতি (কমনওয়েলথ) গঠন করবে।

(২) মক্কা থেকে আগত কুরাইশ বংশীয় মোহাজেরগণ তাদের পূর্ব প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ‘দিয়াত’ (blood money) অর্থাৎ খুন খেসারত দিতে হবে এবং কোন মোহাজের বন্দী হলে তাকে অর্থের বিনিময়ে (ransom) মুক্ত করতে পারবে।

(৩) বনু আউয গোত্রও তাদের পূর্ব রীতি অনুযায়ী ‘দিয়াত’ প্রদানে বাধ্য থাকবে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র বা উপগোত্র (তাইফা) বন্দিদের মুক্ত করতে সাহায্য করবে।

(৪) বনু-ল-হারিস গোত্রের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

(৫) বনু সাঈদা গোত্রের জন্যও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

(৬) বনু যুসাম গোত্রের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

(৭) বনু-ন-নাজ্জার গোত্রের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

(৮) বনু আমর বিন আউফ গোত্রের জন্য একই নিয়ম প্রয়োগ করা হবে। (৯) বনু-ন-নাবিথ গোত্রের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

(১০) বনু ‘ল-আউস গোত্রের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

(১১) বিশ্বাসীগণ তাদের মধ্যে ঋণগ্রস্তকে অবশ্যই সাহায্য করবে এবং প্রয়োজনে ‘দিয়াতে’র ব্যবস্থা করবে।

(১২) কোন বিশ্বাসী অপর কোন বিশ্বাসীর দোসরকে (মাওলা) তার (অপর বিশ্বাসী) অনুমতি ছাড়া মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না।

(১৩) ধর্মভীরু বিশ্বাসীগণ তাদের মধ্যে যারা অন্যায় করবে অথবা অবিচার করবে অথবা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এমনকি যদি তাদের কোন সন্তানও হয় সেক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম হবে না।

(১৪) বিশ্বাসীগণ অপর কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাঁরা কোন অবিশ্বাসীকে সাহায্য করতে পারবে না।

(১৫) মদিনা সনদে স্বাক্ষরদানকারী সকল গোষ্ঠী মহান আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা ‘জিম্মা’ প্রদান করা হবে। বিশ্বাসীগণ পরস্পর পরস্পরকে (ইউযির)’ নিরাপত্তা দান করতে বাধ্য থাকবে। এ সমস্ত বিশ্বাসী তাদের অনুগত গোত্রদেরকে নিরাপত্তা দান করবে।

(১৬) ইহুদী সম্প্রদায় যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাসীদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক বজায় রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে বিশ্বাসীদের মত সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ইহুদীরা বিরোধিতা করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সমস্ত সুবিধা ভোগ করবে।

(১৭) সকল বিশ্বাসীদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন শাস্তি বজায় থাকবে। যদি ইসলামের বিরুদ্ধে কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তি অস্ত্রধারণ করে তাহলে মুসলিম উম্মা একতাবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযান (‘জিহাদ’) করবে।

(১৮) সামরিক অভিযানকালে সৈন্যগণ তাদের বাহন (ঘোড়া বা উট) পরিবর্তন

করতে পারবে।

(১৯) যদি কোন বিশ্বাসী রণক্ষেত্রে শহীদ হয় তাহলে অন্যান্য বিশ্বাসীগণ তার প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। মহান আল্লাহ সব সময় তাদের নিরাপত্তা ও হেদায়েত দিবেন। (২০) কোন মুশরীক বা অবিশ্বাসী বিধর্মী কুরাইশদের সাথে সন্ধি স্থাপন করতে পারবে না, কিংবা মদিনাবাসীগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কুরাইশদের সাহায্য করতে পারবে না।

(২১) যদি কোন ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করে এবং এই হত্যা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় তাহলে হত্যাকারীকে প্রতিশোধমূলকভাবে হত্যা করার বিধান আছে। অবশ্য যদি হত্যাকারীর কোন আত্মীয় ‘দিয়াত’ বা blood money প্রদান করে তাহলে হত্যাকারীকে মুক্তি দেয়া হবে। সমস্ত বিশ্বাসী একতাবদ্ধভাবে হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

(২২) যে বিশ্বাসী মদিনা সনদে আস্থা রেখেছে এক আল্লাহর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং রোজ কিয়ামত সম্বন্ধে সঠিক ধারণা আছে সে ইসলাম বিরোধী দুষ্কৃতকারীকে সাহায্য করবে না অথবা আশ্রয় দিবে না। যে ইসলামের শত্রুকে সাহায্য করবে বা আশ্রয় দিবে তার উপর আল্লাহর গজব পড়বে। শুধু তাই নয়, রোজ কিয়ামতে তার উপর লানাৎ বর্ষিত হবে এবং সে ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হবে।

(২৩) স্বাক্ষরকারীগোষ্ঠী যদি কোন বিষয়ে মতানৈক্য প্রকাশ করে তাহলে তার সমাধানের জন্য পবিত্র কুরআন এবং নবী করিমের (হাদিস) ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে।

(২৪) বিশ্বাসীদের মত বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে ইহুদীদের স্ব স্ব যুদ্ধ ব্যয়ভার বহণ করতে হবে।

(২৫) বিশ্বাসীদের মত ইহুদী গোষ্ঠী বনু আউফ উম্মার অন্তর্ভুক্ত। পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় বিনা দ্বিধায়, নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যদি কোন গোষ্ঠী সন্ধিচুক্তির শর্ত অমান্য বা অবজ্ঞা করে তাহলে তার উপর অভিশাপ বর্ষিত হবে এবং তার পরিবারও অভিশপ্ত হবে।

(২৬) বনু আউফের মত ‘বনু ন-নাজ্জার গোত্রীর ইহুদীদের উপর একই শর্ত আরোপিত হবে।

(২৭) বনু -ল-হারিস গোত্রের উপর একই শর্তে আরোপিত হবে।

(২৮) বনু সাঈদার ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রতি একই শর্ত আরোপিত হবে।

(২৯) বনু জুসাম গোত্রের ইহুদীদের জন্য একই শর্ত আরোপিত হবে।

(৩০) বনু ‘ল-আউস গোত্রের ইহুদীদের উপর একই শর্ত আরোপিত হবে। (৩১) বনু সালাবা গোত্রের ইহুদীদের জন্য একই শর্ত আরোপিত হবে। (৩২) বনু সালাবা গোত্রের উপগোত্র জাফনার ইহুদীদের ক্ষেত্রে এই শর্ত আরোপিত হবে।

(৩৩) বনু আউফের মত বনু আশ-শুতাইবা গোত্রের ইহুদীদের জন্য একই শর্ত প্রযোজ্য হবে। বিশ্বাসঘাতকদের কোন ছাড় দেয়া হবে না।

(৩৪) বনু সালাবা গোত্রের যে সমস্ত উপগোত্র আছে তাদের জন্য একই নিয়ম প্রয়োগ করা হবে।

(৩৫) ‘বিতানা’ গোষ্ঠীর ইহুদীগণ যাদের সাথে মদিনার ইহুদীদের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই তাদের ক্ষেত্রেও এক আইন প্রযোজ্য হবে।

(৩৬) নবী করিমের পূর্ব অনুমতি ছাড়া মদিনাবাসীগণ কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না। কিন্তু যদি কোন বিশ্বাসী আহত হয় তাহলে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার তার থাকবে। কেউ যদি আকস্মিকভাবে (‘ফাতাকা’) কোন অঘটন ঘটায় তাহলে এরজন্য সে দায়ী থাকবে।

(৩৭) ইহুদীদের খরচ ইহুদীরা চালাবে; অন্যদিকে মুসলমানগণ তাদের খরচ তারা নিজেরাই চালাবেন। অবশ্য উভয় সম্প্রদায় প্রয়োজনে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যয় ‘নেসার’ বহন করবে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে প্রকৃতবন্ধুত্ব (‘না’শ ওয়া নাশিহান’) এবং তাদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় থাকবে, কোন প্রকারে ষড়যন্ত্র থাকবে না।

(৩৮) যতদিন পর্যন্ত যুদ্ধবিগ্রহ চলতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত ইহুদীগণ যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে।

(৩৯) ইয়াসরিবের উপত্যাকা সনদে স্বাক্ষরদানকারীদের জন্য পবিত্র থাকবে। (৪০) নিরাপত্তালাভকারী প্রতিবেশী (জার) মুসলিম সমাজের সুনজরে থাকবে যতদিন সে কোন অনিষ্ট না করে অথবা কোনপ্রকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হয়।

(৪১) তাঁর গোত্রের অনুমতি ছাড়া কোন মহিলাকে প্রতিবেশী সুলভ নিরাপত্তা প্রদান করা হবে না।

(৪২) এই সনদে স্বাক্ষরদানকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে অথবা নবী করিমের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।

(৪৩) বিধর্মী কুরাইশ সম্প্রদায়কে কোনপ্রকার প্রতিবেশী সুলভ নিরাপত্তা দান করা হবে না।

(৪৪) মদিনা শহর আক্রান্ত হলে সনদে স্বাক্ষরদানকারী সম্প্রদায় প্রতিহত করবে। (৪৫) স্বাক্ষরদানকারী সম্প্রদায়কে যখন কোন যুদ্ধ বিরতি চুক্তি করতে বলা হবে তারা তখন তা করবে।

(৪৬) আউস গোত্রের ইহুদীগণ এবং তাদের মিত্ররা সনদে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য গোত্রের মত সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে।

(৪৭) কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে সে দায়ী থাকবে। এই সনদে বর্ণিত কার্যাবলী মহান আল্লাহর সুবিচার ও মহত্ত প্রকাশ করছে। এই সনদ কোন দোষী ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দিবে না। মহান আল্লাহ সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। সনদের শর্ত ভঙ্গকারীর উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে।

মদিনা সনদের সঠিক তারিখ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে ঐতিহাসিকগণ বলেছেন যে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে এই সনদ সম্পাদিত হয় অর্থাৎ বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের হিংস্রতা এবং ইহুদীদের ষড়যন্ত্র এবং মোনাফেক গোষ্ঠীর চক্রান্ত যখন প্রকট আকারে দেখা দিল তখন নবী করিম এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সনদে বিভিন্ন ইহুদী গোত্রের কথা বলা হলেও মদিনার প্রধান তিনটি গোত্রের-বনু কাইনুকা, বনু নাজির এবং বনু কোরাইজা-উল্লেখ নেই। মন্টোগোমারী ব্যাখ্যা করেন যে, উল্লেখিত তিনটি প্রধান ইহুদী গোত্র সনদে যে ইহুদী গোত্রের কথা বলা হয়েছে তার অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও বনু নজির এবং বনু কুরাইজা আল-আউস এবং খালাবা ইহুদী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইবনে ইসহাক তাঁর ‘সিরাতুন নবী’ গ্রন্থে ৬৭ ছোট-বড় ইহুদী গোত্রের উল্লেখ করেন।

সনদের প্রয়োজনীয়তা

‘মদিনা সনদ’ প্রণয়নে হযরত মুহাম্মদ (স) রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ধর্মীয় এবং সামাজিক জীবনেও এর প্রভাব কম ছিল না। হিজরতের পর দ্বিধাবিভক্ত মদিনাবাসীদের আত্মকলহে তিনি দুঃখবোধ করেন এবং জরাজীর্ণ পরিবেশকে নতুন আদর্শে অনুপ্রাণিত করার জন্য এই সনদ জারি করেন। এর প্রয়োজনীয়তা ছিল বিবিধ। প্রথমত, শতধাবিভক্ত মদিনাবাসীদের গৃহযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মুসলমানও ইহুদী নাগরিকদের সমান অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করা। তৃতীয়ত, স্বদেশত্যাগী মোহাজেরিনদের মদিনায় বাসস্থান ও জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা করা। চতুর্থত, মুসলমান এবং অমুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী, সদ্ভাব ও পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলা। পঞ্চমত, মদিনায় ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সর্বজনীন ধর্ম প্রচার ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।

সনদের গুরুত্ব

রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, নৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মদিনার সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান (first written constitution of the world)। ইতিপূর্বে আইন ছিল স্বৈরাচারী শাসকের ঘোষিত আদেশ এবং সরকার ছিল ব্যক্তি- কেন্দ্রিভূত। সর্বপ্রথম মহানবী জনগণের মঙ্গলার্থে আইনের শাসন (Rule of Law) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃতপক্ষে একে মহাসনদ বা Magna Carta বলা যেতে পারে। মূইর বলেন, “ইহা হযরতের অসামান্য মাহাত্ম্য ও অপূর্ব মননশীলতা; শুধু তৎকালীন যুগেই নহে, বরং সর্বযুগে ও সর্বকালের মহামানবের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।

মদিনা সনদ মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়কে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে হিংসা, দ্বেষ ও কলহের অবসান ঘটায়। তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল একরূপ এবং বিপদে তারা একে অপরকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। ইসলামী প্রজাতন্ত্র সংরক্ষণে স্ব স্ব গোত্র যুদ্ধ-ব্যয় বহন করার ব্যবস্থা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দূরদর্শিতা ও অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতার পরিচায়ক।

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করে মদিনা সনদ এক তুলনাবিহনী রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। দীর্ঘকালব্যাপী পরিচালিত বুয়াসের যুদ্ধ হযরতের মদিনায় আগমনে অবসান হয় এবং রক্তের ভিত্তির পরিবর্তে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মদিনাবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপিত হয়।

মদিনা সনদ গোত্রপ্রথার বিরোপ সাধন করে। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ( Islamic brotherhood) ভিত্তিক হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উপর সমাজ ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। স্বৈরাচারী শাসন অথবা শেখতন্ত্র (Sheikhdom)-এর পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রে স্বীকৃতি লাভ করে। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সহ-অবস্থানে ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম ও রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ঐশীতন্ত্রের (Theocracy) আবির্ভাবও হয় একই কারণে। হিট্টি বলেন, ‘মদিনা প্রজাতন্ত্রই পরবর্তীকালে বৃহত্তর ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল স্থাপন করে।”

মদিনা সনদ মুসলমান ও অমুসলমানদের ধর্মে পূর্ণ স্বাধীনতারও নিশ্চয়তা বিধান করে। মদিনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা একে অপরে ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। হযরত মুহাম্মদ (স) এই শর্ত দ্বারা যে মহানুভবতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন তা বিশ্বের ইতিহাসে সত্যই বিরল। সর্বগুণান্বিত, সর্বশ্রেষ্ঠ, যুগান্তকারী এই মহাপুরুষ তৎকালীন বিশ্বে ধর্ম ও রাজনীতির সমন্বয়ে যে ইসলামী উম্মা অথবা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন উত্তরকালে এটি বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য স্থাপনে সহায়তা করে। এস.এ.কিউ. হুসাইনী বলেন, “ইসলামী বিপ্লব গোত্রভিত্তিক আরববাসীদের নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করে। অনিশ্চিত জীবিকাসম্বলিত আরব যাযাবরগণ আল্লাহর পথে নিয়মিত সৈনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করল।” সুতরাং মদিনা সনদ হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সমাজ সংস্কারের এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে। বার্নার্ড লুইস বলেন, “এই দ্বৈত মতবাদ (ধর্ম ও রাজনীতি) ইসলামী সমাজে মজ্জাগত ছিল এবং মুহাম্মদ (স)- এর উম্মা বা প্রজাতন্ত্র ছিল এর ভিত্তি। সময় ও কাল বিচারে এটি ছিল অবশ্যম্ভাবী। প্রাচীন আরব সম্প্রদায়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যম ছাড়া ধর্ম প্রকাশিত ও সংগঠিত হবার কোন উপায় ছিল না। অপরদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার ধারণা থেকে বঞ্চিত আরবদের কেবল ধর্মই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হতে পারে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *