প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

চতুর্থ অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাংগঠনিক ক্ষমতা

চতুর্থ অধ্যায় – হযরত মুহাম্মদের (স) সাংগঠনিক ক্ষমতা

গোত্র প্রথা বনাম ইসলামী ঐক্য

৬৩০ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নবী করিম (স) সমগ্র আরব ভূখণ্ডে ইসলাম বিস্তার করে মদিনা প্রজাতন্ত্রের অধীনে আনার এক অসাধারণ সাংঘঠনিক ক্ষমতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করেন। আরব গোত্রসমূহকে একতাবদ্ধ করে একটি সুসংবদ্ধ মুসলিম উম্মায় পরিণত করাই ছিল তাঁর মূখ্য উদ্দেশ্য। বিভিন্ন গোত্রের সাথে পৃথক পৃথকভাবে সংযোগ স্থাপন করে তাদের ইসলামের ছায়া তলে নিয়ে আসা ছিল অসীম দূরদর্শিতার কাজ। বৈরী মনোভাবাপন্ন এবং কখনো কখনো হিংস্রপরায়ণ (মাখযুম) গোত্রের সাথে আলাপ- আলোচনা এবং প্রয়োজনে সমরাভিযান দ্বারা তাঁদের অনুগত্য লাভ ইসলামের ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে নবম ও দশম হিজরী অর্থাৎ নবী করিমের জীবদ্দশার শেষ দুইবছর (৬৩০-৬৩২) ইসলামের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

নবী করিমের আরব গোত্র ও উপ-গোত্রদের সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান ছিল এবং তিনি কোন কৌশলে কোন গোত্র বা উপগোত্র (tribe-clan) কিভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করবেন তা জানতেন। নবম হিজরীকে ইবনে হিশাম প্রতিনিধি প্রেরণের বছর বা ‘সানাত-উল-উফুদ’ বলেছেন। ‘ওয়াফদ’ আরবি শব্দ-এর অর্থ প্রতিনিধি। মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। এতদসত্ত্বেও তিনি মনে করেন যে, তাঁর আরদ্ধ কাজ বা মিশন সম্পন্ন হয়নি, এর মূল কারণ বিভিন্ন বিধর্মী আরব গোত্র তখনও ইসলামের ছায়াতলে আসেনি। শুধু তাই নয় বিদ্রোহী বা বৈরীমনভাবাপন্ন আরবগোত্রসমূহ, যারা আরব ভূখণ্ডে দূর-দূরাঞ্চলে বাস করত তারা তখনও বায়েত গ্রহণ করেনি। কোন কোন অঞ্চলে ভণ্ড নবীরও আবির্ভাব ঘটে, যেমন ইয়েমেনে আল-আসাদ, ইয়ামামায় মুসাইলিমা এবং আসাদ গোত্রের তোলাইহা ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। এমতাবস্থায় নবী করিম বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরব গোত্রীয় প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য আহ্বান জানান। মক্কা ও মদিনার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থিত অসংখ্য বিধর্মী আরবগোত্র নবী করিমের কাছে প্রতিনিধি পাঠাতে থাকে। মন্টোগোমারী ওয়ার্ট প্রতিনিধি প্রেরণের ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেন। নবী করিম আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত বিধর্মী গোত্রগুলোকে ইসলামে দীক্ষিত হবার আহ্বান জানিয়ে দলপতিদের কাছে পত্র লিখেন। নবী করিমের আমন্ত্রনে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিধি দল মদিনায় আসতে থাকে। ওয়াট এ সমস্ত প্রতিনিধি দলের বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

মক্কা ও মদীনার পশ্চিমাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গোত্র প্রতিনিধি প্রেরণ করে তারা হচ্ছে খোজা, কিনান, মুযাইনা, যুহাইনা, আজদ, সানুহ। মক্কা ও মদীনার পূর্বাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গোত্র প্রতিনিধি পাঠানো হয় তারা হচ্ছে খুজামা, তাই, মুহারিব, হুদাইন, গাতাফান, সুলাইম, হাওয়াজিন ও জু’মা, তাকিফ।

মক্কা-মদিনার উত্তরে অবস্থিত যে সমস্ত গোত্রসমূহ প্রতিনিধি দল মদিনায় প্রেরণ করে তারা হচ্ছে সা’দ, হুদায়েম, জুদাহ, কুদাহ, বাহরা, লাখম, গাসসান এবং কালব। মক্কার, দক্ষিণে অবস্থিত গোত্রগুলো হচ্ছে খাতাম, মাদহিজ, বাজিলা, হামদান, আল হারিস, মুরাদ, কিনাদ, হিমায়র, হাদরামাউথ এবং আককা।

অপরাপর যে সমস্ত গোত্র মদিনায় প্রতিনিধি পাঠায় তারা হচ্ছে মহারাহ, আজাদ, উমান, হানিফা, তা’মীম এবং ওয়ইল, বকর, তাগলিব।

প্রতিনিধি বছরের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, নবী করিমের আমন্ত্রণক্রমে উপরোল্লিখিত গোত্রসমূহ মদিনায় প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। অবশ্য একথা বলা যাবে না যে, মদিনায় আগমন করে সকল বিধর্মী গোত্রের লোকেরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, অনেক পৌত্তলিক ও খ্রিস্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মাহরাহ এবং ইয়েমেনের খ্রিস্টানগণ তৌহিদে বিশ্বাস স্থাপন করেন। খ্রিস্টান গোত্র বনু হানিফা, বনু তাঘলিব, বনু হারিস, বনু কিন্দা নবী করিমের কাছে প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে বাৎসরিক জিজিয়া কর প্রদানের অঙ্গীকার করেন। তাবুক থেকে বায়জানটাইন বাহিনী পলায়ন করলে আইলাহ এর খ্রিস্টান শাসনকর্তা এবং মাকনী আজরুহ ও জাররা মরুদ্যানের ইহুদী সম্প্রদায় মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি করে। এ অঞ্চলের ইহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় মুসলমানদের নিকট থেকে নিরাপত্তা লাভ করে বাৎসরিক নির্দিষ্ট হারে জিজিয়া কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

কুরাইশদের মিত্র বনু আসাদ ছাড়া বনু কাবও নবী করিমের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। ইয়েমেনের বাজিলা গোত্রের নিজস্ব কা’বা জুল খালাসা মন্দির ছিল। একশত পঞ্চাশজন লোক নিয়ে বাজিলা গোত্রের দলপতি জাবির বিন আবদুল্লাহ নবী করিমের কাছে আগমন করে বায়েত গ্রহণ করেন। নবী করিম জুল খালাসার মন্দির সম্বন্ধে জানতেন। তিনি জাবিরকে ঐ মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। জাবির মন্দির ধ্বংস করতে গিয়ে বাজিলা এবং এর উপগোত্র খাতামের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। পরিশেষে বিধর্মীগণ আত্মসমর্পন করলে মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়। নবী করিম পরবর্তীকালে বিশ্বস্ত জাবিরকে আরও কয়েকটি পৌত্তলিক গোত্রের বিরুদ্ধে পাঠান এবং তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেন। শাস্তিপূর্ণ উপায়ে এবং প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে সমগ্র আরব ভূখণ্ড ইসলামের ছায়াতল (Islamization) করার প্রয়াস পান নবী করিম (স)। তিনি প্রত্যেক গোত্রের প্রধানের কাছে সন্ধিপত্র পাঠান, ইসলাম ধর্ম গ্রহণে আহ্বান জানান এবং যে সমস্ত গোত্র ইসলাম কবুল করে তাদের কাছে ইসলামের মূল নীতি ও আদর্শ শিক্ষা দান করার জন্য একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিযুক্ত করেন। মন্টোগোমারী ওয়াটের ভাষায় মহানবী গোত্র, উপগোত্র এবং ছিটমহলে পত্র প্রেরণ করে দূতের মাধ্যমে সমগ্র আরব দেশে ইসলাম প্রচার করে Pax Islamica বা বৃহৎ ইসলামি পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেন। এ সমস্ত পত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, যদি তারা ইসলাম কবুল করে তাহলে তাদের মদিনা প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দান করা হবে। যদি তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত না হয় তাহলে তারা জিম্মি হিসেবে জিজিয়া কর প্রদান করবে এবং মদিনা প্রজাতন্ত্র তাদের জান-মাল রক্ষা করবে।

নবী করিম শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মান্তরীত করার যে নীতি গ্রহণ করেন তা কার্যকরী হয়। ধর্মান্তরীত না হলেও মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে জিজিয়া কর প্রদানপূর্বক শান্তিপূর্ণসহ অবস্থান করার সুযোগ লাভ করে বহু ইহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়। কিন্তু বিধর্মী বৈরীমনোভাবপন্ন বেদুঈন গোত্রের প্রতি নবী করিম কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যে সমস্ত গোত্র বা উপগোত্র ইসলামের ধ্বংসে লিপ্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, বাজিলা গোত্রের নব-দীক্ষিত মুসলমান জাবির বিন আবদুল্লাহকে জুল খালাসায় প্রেরণ করেন সেখানকার মন্দির ধ্বংস করার জন্য। এছাড়া তিনি দক্ষিনাঞ্চলে ইয়েমেনে তিনটি অভিযান প্রেরণ করেন। বিশ জনের একটি দল তাবালা অঞ্চলে খাতাম গোত্রের বিরুদ্ধে পাঠানো হয়। খালিদ বিন ওয়ালিদকে ৬৩১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই-আগস্ট মাসে নাজরানে পাঠানো হয়। এ অভিযানে কোন রক্তপাত হয় নি, তবে অসংখ্য পৌত্তলিক বেদুঈন ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করে। হযরত আলী (রা) তিনশত সৈন্যসহ বৈরীভাবাপন্ন মাদহীজ এবং জুবাইদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। এই অভিযানের ফলে বিদ্রোহীগণ ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হয়। বিধর্মীগণ দলে দলে ইসলাম ধর্মে যে দীক্ষা লাভ করতে থাকে তাঁর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে নবী করিম যখন মক্কায় অভিযান করেন তখন তাঁর সাহাবীদের সংখ্যা ছিল ১০,০০০। তাবুকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে অভিযানকালে তাঁর সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০,০০০-এ। নবী করিমের জীবদ্দশায় আরব ভূখণ্ড থেকে পৌত্তলিকদের মন্দির ধ্বংস করা হয়। শুধু আল-লাত, মানাত এবং উজ্জার মন্দিরই নয়, জুল খালাসা খাওলান এবং ধুবার গোত্রের মন্দিরগুলোও ধ্বংস করা হয়।

মক্কা বিজয় এবং প্রতিনিধি প্রেরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তা নিঃসন্দেহে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মন্টোগোমারী ওয়াট যথার্থই বলেন, “The whole of Muhammad (sm) work may be regarded as the building on religious foundations of a political, social and economical sytem and his tribal policy was merely an aspect of this.” “নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনের মোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় আদর্শের (তৌহিদ) ভিত্তিতে আরবদেশে একটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা। এই সংগঠনে তাঁর গোত্রদের প্রতি অনুসৃত নীতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।” যদিও সমগ্র আরবদেশ নবী করিমের জীবদ্দশায় ইসলামের ছায়াতলে একত্রীভূত হয়েছিল বলা যাবে না তবুও তিনিই বৃহত্তর ইসলামি সংগঠনের (Pax Islamica) ভিত্তি স্থাপন করেন। “The framework of unity had been built )। গোত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না হলে অনেক কমে যায়। এর ফলে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহুদী ও খ্রিস্টান সম্পদ্রায়ের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ইবন ইসহাক বলেন, “বিভিন্ন গোত্র থেকে প্রেরিত প্রতিনিধিদের প্রতি নবীর সৌজন্যসূচক ব্যবহার তাদের অভিযোগের প্রতি সজাগ দৃষ্টি তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করবার মত মেধা সমগ্র উপদ্বীপে তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি মহান, সদাশয় ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরূপে খ্যাতি অর্জন করেন।” প্রতিনিধি প্রেরণের বৎসর ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে এটি কেবল ইসলাম প্রচারেই সহায়তা করেনি বরং এটি সমগ্র আরব জাতিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিতে সুসংবদ্ধ করে শক্তিশালী বায়জানটাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করবার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ দান করে। হিট্টি বলেন, “দৃঢ় বিশ্বাস, বরং সুযোগ-সুবিধার জন্য গোত্রগুলো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে; ইসলাম ধর্ম কেবল মৌখিক স্বীকৃতি এবং যাকাত দানেই সন্তুষ্ট ছিল।” একথা সত্য যে, পৌত্তলিকতা একটি উন্নত ধরনের ধর্ম বিশ্বাস এবং নৈতিক আদর্শে পরিণত হতে পারেনি। আরব বেদুঈনগণ ইসলামের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন প্রণালী, কঠোর নৈতিক আদর্শ এবং সূক্ষ্ম ধর্মীয় অনুভূতি সাময়িকভাবে গ্রহণ করে, কারণ হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফতে কতিপয় আরব গোত্র ইসলাম বর্জন করে ধর্মদ্রোহিতা শুরু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *