প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

ষষ্ঠ অধ্যায় : সুলায়মান এবং দ্বিতীয় ওমর (৭১৫-৭২০ খ্রি.)

ষষ্ঠ অধ্যায় – সুলায়মান এবং দ্বিতীয় ওমর [৭১৫-৭২০ খ্রি.]

সুলায়মান (৭১৫-৭১৭ খ্রি.)

সিংহাসন লাভ : মৃত্যুর পূর্বে আবদুল মালিক তার চার পুত্রকে পর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এই চারজন হলেন প্রথম ওয়ালিদ, সুলায়মান, দ্বিতীয় ইয়াজিদ ও হিশাম। প্রথম ওয়ালিদ তাঁর রাজত্বকালে পিতার মনোনয়ন অমান্য করে স্বীয় পুত্রকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু ওয়ালিদের মৃত্যুর পূর্বেই তাঁরপুত্র দেহত্যাগ করলে স্বভাবত তাঁর ভ্রাতা সুলায়মান ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

প্রাথমিক কার্যাবলি : ক্ষমতা লাভ করে সুলায়মান ইরাকের কারাগার হতে হাজ্জাজ কর্তৃক বন্দীকৃত অসংখ্য ব্যক্তিকে মুক্তিদান করেন। এর জন্য তিনি ‘মিফতা-হুল খায়ের’ বা ‘আশীর্বাদের কুঞ্জি’ নামে অভিহিত হন। তিনি আরব হিমারীয়দের প্রতি উদারতা এবং মুদারীয়দের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করতেন। হাজ্জাজ কর্তৃক নিযুক্ত রাজস্ব আদায়কারীদের বরখাস্ত এবং করভার লাঘব করে সুলায়মান ইরাকীদের সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করেন। হযরত আলীর বংশধর এবং সমর্থকদের প্রতি তিনি অনুরাগী ছিলেন। এভাবে সুলায়মান তাঁর পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাদের বংশ-স্বার্থসম্ভূত নীতি বর্জন করে রাজতন্ত্রকে বিপন্ন করেন।

আবদুল মালিক এবং ওয়ালিদের দক্ষিন হস্ত হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ সুলায়মানের খিলাফত লাভের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন; কিন্তু সুলায়মান তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি বিজাতীয় মনোভাব পোষণ করেন। ইয়াজিদ-বিন-মুহাল্লাবের প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য সুলায়মান হাজ্জাজের প্রতি বিরূপ ছিলেন। খলিফা ওয়ালিদের পুত্রকে উত্তরাধিকারী মনোনয়নে হাজ্জাজ সমর্থন করায় তিনি তাঁর প্রতি ঘৃণার প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে খলিফা সুলায়মান হাজ্জাজের জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র সিন্ধু বিজেতা মুহাম্মদ-বিন-কাসিম এবং মধ্য এশিয়া বিজয়ী খ্যাতনামা বীর কুতাইবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। খলিফা ক্রোধান্বিত হয়ে স্পেন বিজয়ী মুসা ও তারিককে লাঞ্ছিত করেন। যে বীরদের সমবেত চেষ্টায় ইউরোপে ইসলাম বিস্তার লাভ করে, তাঁদের শেষ জীবন খুব মর্মান্তিক দুঃখ-কষ্টে অতিবাহিত হয়। সুলায়মান মুসার পুত্র এবং স্পেনের শাসনকর্তা আবদুল আজিজকেও হত্যা করেন। সুলায়মানের এহেন দুর্ব্যবহার ও নিষ্ঠুরতা উমাইয়া রাজত্বের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।

কনস্টান্টিনোপল অভিযান

সুলায়মানের রাজত্বকালে কনস্টান্টিনোপল অভিযান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্পেনের মত অপর একটি রাজ্যজয়ের নেশায় এবং গ্রীক সেনাপতি লিও কর্তৃক প্রবঞ্চনাপূর্ণ অনুপ্রেরণায় সুলায়মান ৭১৬-৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাতা মাসলামার নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপলে অভিযান প্রেরণ করেন। মুসলিম সৈন্যবাহিনী হেলেস্‌পন্ট অতিক্রম করে শহরটি বিরোধ করলে ভীত ও সন্ত্রস্ত গ্রীকগণ তাদের সম্রাট তৃতীয় থিওডোসিয়াসকে অপসারিত করে লিঁওকে সিংহাসনে বসান। প্রতারক লিঁও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে কনস্টান্টিনোপলকে রক্ষা করেন। লিঁওর বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এবং খলিফার প্রয়োজনীয় সাহায্য ও উৎসাহের অভাবে মুসলিম অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সুলায়মান ৭১৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেন।

চরিত্র

বলিষ্ঠ দেহ ও সুস্বাস্থ্যের অধকারী সুলায়মান ইসলামের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত চরিত্র (Enigmatic figure)। তাঁর চরিত্রে বিপরীত গুণাবলির সংমিশ্রণ ছিল। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন নিষ্ঠুর, অকর্মণ্য ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ, অন্যদিকে তেমনি ছিলেন সদাশয়, স্পষ্টভাষী ও আবেগপ্রবণ। একদিকে তিনি যেমন ‘হারেমে’ ভোগ-বিলাসে কালাতিপাত করতেন, অপরদিকে ধার্মিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে দ্বিধা করতেন না। বিবাহ, তালাক, পাক-প্রণালী তাঁর দরবারের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। তিনি ভোজনবিলাসী খলিফারূপেও পরিচিত ছিলেন। একদিকে তিনি হাজ্জাজ কর্তৃক বন্দীকৃত অসংখ্য লোককে মুক্তি দিয়ে ‘আশীর্বাদের চাবি’ (The key of blessing) উপাধি লাভ করেন; অপরদিকে মুহাম্মদ-বিন-কাসিম, কুতাইবা ও আবদুল আজিজকে নির্মমভাবে হত্যা এবং মুসা ও তারিকের মত বীর যোদ্ধাদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনে নিজ চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন।

ওমর-বিন-আবদুল আজীজ (দ্বিতীয় ওমর) (৭১৭-৭২০ খ্রিস্টাব্দ)

খিলাফত লাভ

খলিফা সুলায়মানের মৃত্যুর পর ৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মনোনয়নক্রমে ওমর-বিন- আবদুল আজীজ খিলাফত লাভ করেন। খলিফা ওমরের পিতা আবদুল আজীজি আবদুল মালিকের ভ্রাতা ছিলেন এবং মাতা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) দৌহিত্রী। হযরত ওমরের সঙ্গে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য থাকায় ওমর-বিন-আবদুল আজীজ সাধারণত ‘দ্বিতীয় ওমর’ বলে পরিচিত, তাঁরা উভয়েই ধর্মপ্রাণ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সরল প্রকৃতির ছিলেন।

উমাইয়া বংশের ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমরের অভিষেক সত্যই একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বর্বরতা, ষড়যন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, বিলাসিতা, অনাচার ও অধর্ম যখন সমস্ত উমাইয়া খিলাফতকে গ্রাস করতে থাকে তখন তিনি শাসনভার গ্রহণ করেন। প্রশাসক হিসেবে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন। কারণ, খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বে তিনি হেজাজের শাসনকর্তারূপে যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেন। ন্যায়পরায়ণতা, সরলতা, চারিত্রিক মাধুর্য, ধর্মপরায়ণতা, প্রজাবাৎসল্য দ্বারা তিনি অত্যাচারী উমাইয়া খলিফাদের স্বেচ্ছাচারী নীতি বর্জন করে খোলাফায়ে রাশেদূনের মৌলিক ইসলামী আদর্শগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াস পান। এই কারণেই তাঁকে ‘উমাইয়া সাধু’ (Umayyad Saint) বলে অভিহিত করা হয়।

প্রশাসনিক নীতি

দ্বিতীয় ওমর সর্বজনীন মানবতাবোধ উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরপেক্ষ শাসন-নীতি প্রণয়ন করেন এবং সাম্রাজ্যে সুখ-শান্তিও নিরাপত্তা বিধানের জন্য পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাদের সাম্রাজ্যবাদী, স্বৈরচারী ও স্বার্থান্বেষী নীতি বর্জন করেন। দ্বিতীয় ওমরের শাসন নীতির প্রধান বেশিষ্ট্য ছিল : প্রথমত, সমর নীতির (Expansionist policy) পরিবর্তে শান্তি ও সংরক্ষণ নীতি (Pacifist policy) অনুসরণ করা; কারণ তাঁর মতে, সংরক্ষণ করতে না পারলে রাজ্য সম্প্রসারণ শুধু নিরর্থকই নহে বরং বহু সমস্যার সূচনা করে। সুলায়মানের রাজত্বকালে স্পেন ও সিন্ধু বিজয়ী বীরদের শোচনীয় পরিণতিতে তিনি ব্যথিত হন; উপরন্তু, এতে মুসলমান আধিপত্য খর্ব হবার উপক্রম হয়। দ্বিতীয়ত, তিনি স্বজনপ্রীতি, দল, গোত্রপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব নীতি বর্জন করেন। প্রজাবৎসল ও ধর্মভীরু খলিফা উমাইয়া বংশের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ না করে সকল শ্রেণীর লোকদের সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা দান করেন।

শাসন-ব্যবস্থার পুনর্গঠন : ন্যায়পরায়ণ, ধর্মভীরু ও প্রজাবৎসল খলিফা দ্বিতীয় ওমরের রাজ্য শাসনের মুলমন্ত্র ছিল মানবতার সেবা এবং জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রজাপালন। অভ্যন্তরীণ শাসন-ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য তিনি অত্যাচারী, লোভী ও অযোগ্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের পদচ্যুত করে রাষ্ট্রের তথা জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য বিশ্বস্ত, ন্যায়নিষ্ঠ এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন। এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দেন; কারণ তিনি দলীয়, গোত্রীয় ও বংশীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ছিলেন। সততা, নিরপেক্ষতা ও জনকল্যাণকর নীতির বশবর্তী হয়ে তিনি হিমারীয় এবং মুদারীয় প্রতিদ্বন্দ্বী আরব দল দুটি হতে উপযুক্ত শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফাগণ মুদারীয় গোত্রের এবং সুলায়মান হিমারীয় গোত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। দ্বিতীয় ওমর মুদারীয় গোত্রের আদি-বিন-আরতাতকে বসরার, আবদুল হামিদ-বিন-আবদুর রহমানকে কুফার, ওমর-বিন-হুরায়রাকে মেসোপটেমিয়ার এবং জাবের-বিন-আবদুল্লাহকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। অপরদিকে হিমারীয় গোত্রের সামাহ-বিন-মালিককে স্পেনের এবং ইসমাইল-বিন-আবদুল্লাহকে কায়রোয়ানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

দ্বিতীয় ওমরের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ছিল তিনি দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ন্যায়-নীতি ও নিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে শাসনকর্তাদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করতেন। কোন প্রকার দুর্বলতা তাঁর নীতিজ্ঞান ও কর্তব্যবোধকে আচ্ছন্ন করতে পারে নি। প্রত্যেক শাসনকর্তার কার্যকলাপের উপর তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন। খোরাসানের শাসনকর্তা উমাইয়াপন্থী ইয়াজিদ-ইবন-মুহাল্লাবকে তিনি নির্যাতন এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করবার অভিযোগে পদচ্যুত ও কারারুদ্ধ করেন। অযোগ্যতার জন্য স্পেনের শাসনকর্তা আল-হুরকেও পদচ্যুত করা হয়।

কল্যাণকর শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিতীয় ওমর নবনিযুক্ত প্রশাসকদের নির্দেশ প্রদান করেন, “তোমাদের জানিয়ে রাখা কর্তব্য যে ন্যায়পরায়ণতা ও মহানুভবতা দ্বারাই ধর্মের প্রতিফলন হয়ে থাকে; কোন পাপকেই লঘু করে দেখা উচিত নয়; জনাকীর্ণ স্থানকে জনশূন্য করতে চেষ্টা কর না; প্রজাদের সাধ্যাতীত কোন কিছুই আদায় করবার চেষ্টা কর না; তারা যা দিতে পারে তাই গ্রহণ কর; জনসংখ্যা এবং ঐশ্বর্য যাতে বৃদ্ধি করা যায় তার চেষ্টা কর; নম্র ও নিষ্ঠুরহীনভাবে শাসন কর; উৎসব উপলক্ষে কোন উপঢৌকন গ্রহণ কর না; প্রজাদের সাধ্যাতীত কোন কিছুই আদায় করবার চেষ্টা কর না; তারা যা দিতে পারে তাই গ্রহণকর; জনসংখ্যা এবং ঐশ্বর্য যাতে বৃদ্ধি করা যায় তার চেষ্টা কর; নম্র ও নিষ্ঠুরহীনভাবে শাসন কর; উৎসব উপলক্ষ্যে কোন উপঢৌকন গ্রহণ কর না; জনসাধারণের মধ্যে যে সমস্ত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বিতরণ করা হয়েছে তার মূল্য গ্রহণ কর না; পর্যটক, বিবাহ, উষ্ট্রের দুগ্ধের উপর কোন কর ধার্য কর না; যে ইসলাম ধৰ্ম সানন্দে গ্রহণ করেছে তাকে জিজিয়া দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি কর না।” ন্যায়নিষ্ঠা, কর্তব্যজ্ঞান, জনকল্যাণ, ইসলামের প্রতি অনুরাগ, সাম্য ও সমতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে খলিফা দ্বিতীয় ওমর খোলাফায়ে রাশেদূনের পঞ্চম ধর্মপ্রাণ খলিফা বলে সমাদৃত হন।

ভোগ বিলাসের প্রতি দ্বিতীয় ওমর ঘৃণ্য পোষণ করতেন এবং সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। কথিত আছে যে, খলিফা হবার পূর্বে তিনি অগাধ সম্পত্তির (৫০,০০০ টাকা মূল্যের) মালিক ছিলেন; কিন্তু খিলাফত লাভ করে তিনি মাত্র ২০০ টাকা মূল্যের সম্পত্তি রেখে অবশিষ্ট অংশ জনকল্যাণে উৎসর্গ করেন। স্বয়ং দৃষ্টান্ত দেখিয়ে খলিফা তাঁর বংশের উমাইয়াগণকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিকট সমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ফাতিমাকে পিতা ও ভ্রাতাদের নিকট হতে প্রাপ্ত মনিমুক্তা খচিত অলঙ্কারাদি বায়তুল মালে জমা দিতে বলেন এবং তাঁর আদেশ সানন্দে পালন করা হয়। খলিফার নির্দেশে রাজকীয় অশ্বশালার অশ্বগুলো নিলামে বিক্রয় করে সংগৃহীত অর্থ বায়তুল মালে গচ্ছিত রাখা হয়।

খলিফা দ্বিতীয় ওমর রাসূলে করীম এবং আলীর বংশধরদের প্রতি বিশেষ সদয় এবং সহানুভূতিশীল ছিলেন। মদিনার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মহানবীর ‘ফিদাক’ নামে একটি উদ্যান ছিল; কিন্তু মারওয়ান ঈর্যাবশে উহা আত্মসাৎ করেন। খিলাফত লাভ করে দ্বিতীয় ওমর তা মহানবীর পরিবারবর্গকে প্রত্যার্পণ করেন। এ থেকেই তাদের ভরণ-পোষণ চলত। খলিফার মহানুভবতার আরও নজির পাওয়া যায় হযরত আলীর পরিবারের প্রতি সদয় ব্যবহারে। উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় হযরত আলীর প্রতি পূর্ববর্তী প্রত্যেক উমাইয়া খলিফা ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করতেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রম দেখা যায় দ্বিতীয় ওমরের খিলাফতে। মুয়াবিয়ার রাজস্ব হতে উমাইয়া খলিফা এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ শুক্রবার জুমা নামাজের পর মিম্বার হতে খলিফা আলী ও তাঁর বংশধরদের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণের যে ঘৃণ্য প্রথা প্রচলিত করেছিলেন দ্বিতীয় ওমর তা রহিত করেন। উপরন্তু, আবদুল মালিক কর্তৃক বাজেয়াপ্তকৃত তালহার সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারীদের ফেরত দেওয়া হয়।

উমাইয়া খিলাফতের চরম শত্রু খারিজি সম্প্রদায় দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বে শান্তি ভঙ্গ করে নি। তিনি তাদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের দাবি-দাওয়া ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করে তাদের সাথে বোঝাপড়া করেন; কারণ তিনি শান্তিপ্রিয় ছিলেন ও রক্তপাত নীতির বিরোধিতা করেন। তিনি কুফার শাসনকর্তাকে নির্দেশ দেন, “যদি খারিজিগণ দেশে গোলযোগ বা রক্তপাত না করে তা হলে তাদেরকে আক্রমণ কর না। “ খারিজিগণ খলিফা দ্বিতীয় ওমরের বশ্যতা স্বীকার করে; কারণ, তাদের মতে, তিনি খোলাফায়ে রাশেদূনের আদর্শবাদী ছিলেন।

মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ়করণের জন্য দ্বিতীয় ওমর গোত্রীয় কোন্দল এবং আরব-অনারব বৈষম্য দূরীভূত করবার প্রয়াস পান। তিন মনে করেন যে, সাম্রাজ্যের সকল শ্রেণীর জনসাধারণ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, শুভেচ্ছা ও সহযোগিতায় না থাকলে শোষক ও শোষিত গোষ্ঠীর সৃষ্টি হবে। এ কারণে তিনি আরব মুসলিম এবং অনারব মুসলিম অথবা মাওয়ালীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করবার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নব-দীক্ষিত মাওয়ালিগণ আরব মুসলমানদের মত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারত না; যদিও তারা যুদ্ধ এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কার্যে সক্রিয় অংশগ্রহণ করত। তারা মুসলমানদের ন্যায় ভাতা (Pension) পেত না। ন্যায়পরায়ণতা এবং সুক্ষ্ম- বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন খলিফা ওমর এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্ত বৈষম্য নির্মূল করবার প্রচেষ্টা করেন। খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বে হাজ্জাজ আয় বৃদ্ধি ও কৃষিকার্যের উন্নতির জন্য মাওয়ালীদের উপর খারাজ ও জিজিয়া কর ধার্য করেন। দ্বিতীয় ওমর মাওয়ালীদের জিজিয়া কর থেকে অব্যাহতি দেন। আরব মুসলমানদের খারাজ দিতে হত না বলে মাওয়ালীদেরও এই কর মওকুফ করা হয়। উপরন্তু, তাদের পেনসনের ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে খোলাফায়ে রাশেদূনের সময় থেকে যুদ্ধরত আরবদের সন্তান- সন্তুতিগণের জন্য পেনসন বা ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। মুয়াবিয়ার সময়ে এই নীতি কিছুটা লাঘব করা হয়, কিন্তু আবদুল মালিক নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ভাতা প্রদান বন্ধ করে দেন। মহামতি দ্বিতীয় ওমর বদান্যতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মাওয়ালীদের ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেন।

দ্বিতীয় ওমরকে মহানুভবতা এবং উদারতার মূর্ত প্রতীক বললে অত্যুক্তি হবে না। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তিনি সকলের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রদর্শন করতেন। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। নতুন ধর্মমন্দির নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও তিনি মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পুরাতন ইহুদীদের সিনাগগ (Synagogue), খ্রিস্টানদের গীর্জা ও পারসিকদের অগ্নি উপাসনাগুলো (Fire temple) ধ্বংস করেন নি, বরং সেগুলো সংস্কার ও বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায় কর্তৃক সংরক্ষণের অনুমতি দেন। আমীর আলী বলেন যে, “প্রাচীন আত্মসমর্পণ রীতি অনুযায়ী তাঁরা (মুসলমানগণ খ্রিস্টানদের যে সমস্ত গীর্জা ও ইহুদীদের ধর্মমন্দির ( সিনাগগ ) লাভ করেছিল তিনি সেগুলো তাদের প্রত্যর্পণ করেন।” দামেস্কের খ্রিস্টানগণ খলিফা ওয়ালিদ কর্তৃক সেন্ট জনের গীর্জাটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করবার কথা উল্লেখ করলে খলিফা ওমর তাদেরকে মুসলমানদের অধিকৃত সেন্ট থমাসের গীর্জাটি ব্যবহার করবার অনুমতি প্রদান করেন। আইলা, সাইপ্রাস ও নাজরানের খ্রিস্টানদের বার্ষিক দেয় করও তিনি লাঘব করেন। নাজরানের খ্রিস্টানদের আর্থিক দুর্গতি উপলব্ধি করে তিনি তাদের বার্ষিক কর দুই হাজার থেকে কমিয়ে দুইশত বস্ত্ৰখণ্ডে ধার্য করেন।

ধর্মীয় নীতি : উদারনৈতিক খলিফা দ্বিতীয় ওমর ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। ধর্মের অনুশসানগুলো তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করতেন। ইসলামকে সর্বজনীন ধর্মে রূপান্তরিত করবার জন্য দ্বিতীয় ওমর আত্মনিয়োগ করেন। অস্ত্রের বলে ধর্মপ্রচার অসম্ভব জেনে এবং অন্য ধর্মে কোনরূপ হস্তক্ষেপ ইসলামের বিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ থাকায় তিনি শান্তিপূর্ণভাবে এবং ধর্মীয় প্রভাবের দ্বারা ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করেন। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, একমাত্র ইসলামের একেশ্বরবাদ ও সাম্যবাদ প্রজাদের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উন্নতি বিধান করতে পারে। ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্টের উদ্দেশ্যে এবং অমুসলমানদের ধর্মান্তরিত করবার জন্য জিজিয়া কর প্রদান হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আবদুল মালিকের রাজত্বে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ইরাকী অনারব মুসলমান মাওয়ালীদের জিজিয়া প্রদানে বাধ্য করেন। ইসলামের বিধান অনুযায়ী কেবল অমুসলমানগণ জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীতে যোগাদন হতে অব্যাহতি লাভের জন্য রাজকোষে জিজিয়া প্রদান করত। দ্বিতীয় ওমর এই ঘৃণ্য প্রথার বিলুপ্তি সাধন করেন এবং অনারব নব-দীক্ষিত মুসলমানদের আরব মুসলমানদের সমতুল্য মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দান করেন। এর ফলে খোরাসান, মধ্য এশিয়ার বোখারা, সমরকন্দ, খাওয়ারিজম, নিশাপুর প্রভৃতি স্থানের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ধর্ম প্রচারকগণ মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তৌহিদের বাণী প্রচার করে অমুসলমানদের ধর্মান্তররিত করতে লাগলেন, এমনকি দুর্ধর্ষ বার্বার জাতির মধ্যে ইসলাম প্রচারিত হয়। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র গড়ে উঠে। এভাবে দলে দলে অমুসলমান ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকলে মিসরের শাসনকর্তা অভিযোগ করেন যে, প্রজাদের অবাধে ধর্মান্তর অব্যাহত থাকায় শীঘ্রই রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়বে। এর প্রত্যুত্তরে খলিফা বলেন, “আল্লাহ তাঁর রাসূলকে ধর্মপ্রচারক হিসেবে প্রেরণ করেন; কর আদায়কারীরূপে নহে।” অনুরূপভাবে খোরাসানের শাসনকর্তা নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ঈমান পরীক্ষার জন্য তাদের খাৎনা করবার তাগিদ দিলে, খলিফা এই বলে তাকে ক্ষান্ত করেন যে, “মানুষকে সত্য ধর্মে আহ্বান করবার জন্য মুহাম্মদকে পাঠানো হয়, খৎনা করবার জন্য নহে।” ইসলাম প্রচারের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে মূইর বলেন, “খোরাসান ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে পরিতৃপ্ত বিশ্বাসীদের দ্বারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ধর্মকে সংহত এবং তরবারিকে পরিহার করাই ছিল ওমরের নীতি এবং তাঁর অল্প ও ক্ষণস্থায়ী রাজত্বের মধ্যে এই নীতিতে তিনি সাফল্য লাভ করেন।

বৈদেশিক নীতি

খলিফা দ্বিতীয় ওমর শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বলে তাঁর রাজত্বকালে কোন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযান প্রেরিত হয় নি। তিনি সমরনীতি, রক্তপাত ও সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণকে ঘৃণা করতেন এবং তিনি প্রকৃতই একজন শান্তিবাদী (Pacifist) ছিলেন। রাজ্য বিস্তার অপেক্ষা বিজিত রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনকেই তিনি তাঁর প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করতেন। এ কারণে পূর্ববর্তী খিলাফতে প্রেরিত সমস্ত সামরিক অভিযানগুলোকে তিনি বন্ধ করে দেন। সেনাপতি মাসলামাকে কনস্টান্টিনোপল হতে অবরোধ উঠিয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করবার আদেশ দেন। আল-হুরের শাসনকালে স্পেনে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে খলিফা তাঁর স্থলে আল-সামাহকে শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। আল-সামাহ একজন সুযোগ্য প্রশাসক ছিলেন; তাঁর সময়ে স্পেনে ভূমি জরিপ, আদমশুমারি, সেতু ও রাজপথ নির্মাণ, পয়ঃপ্রণালী খনন প্রভৃতি বহু জনকল্যাণকর কার্য সম্পন্ন হয়। তিনি সারাগোসায় একটি অপূর্ব সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন। বিদ্রোহী খ্রিস্টানদের সমুচিত শিক্ষাদানের জন্য আল-সামাহ্ একটি বিশাল বাহিনী গঠন করেন। কিন্তু পিরেনীজ পর্বতমালা অতিক্রম করে তিনি ফ্রান্সের দক্ষিণাংশে অভিযান পরিচালনা করলে কুইটেনের রাজধানী তুলোস ( Toulous) -এ প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে খ্রিস্টান রাজা ডিউক উডেস ফ্রান্সের সম্রাট চার্লস মার্টেলের সহায়তায় মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে আল-সামাহ্ নিহত হলে আবদুর রহমান সেনাপতিত্ব গ্ৰহণ করে মুসলিম সেনাবাহিনীকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সমর বিজয় খিলফা দ্বিতীয় ওমরের সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরব ছিল না। বিজিত অঞ্চলকে সুসংঘবদ্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম করাই ছিল তাঁর প্রধান নীতি।

রাজস্ব নীতি : দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বকালে বহুসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলে তাদের জিজিয়া কর প্রদান হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর ফলে রাজকোষে অর্থসংকট দেখা দেয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য খলিফাকে রাজস্ব-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতে হয়। অর্থনৈতিক সংকট দূরীভূত করবার জন্য তিনি বিভিন্ন বলিষ্ঠ পন্থা অবলম্বন করেন।

প্রথমত, রাজকোষের আয় বৃদ্ধি রজন্য দ্বিতীয ওমর তাঁর পূর্ববর্তী খলিফাদের অনুকরণে বিজিত অমুসলমানদের উপর ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য জিজিয়া নামে একটি কর প্রদানে বাধ্য করেন। ইসলামের বিধান অনুযায়ী এই কর কেবল অমুসলমানদের উপর নির্ধারিত ছিল, কিন্তু হাজ্জাজ নব-দীক্ষিত মুসলিম মাওয়ালীদের উপরও এই কর ধার্য করেন। ওমর ইসলামের অনুশাসনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে জিজিয়া কর উঠিয়ে দিয়ে কেবল ইহুদী, খ্রিস্টান, অগ্নি উপাসকদের নিকট হতে জিজিয়া আদায় করেন। এতে আয় সীমিত হলেও খলিফার ধার্মিকতা ও উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়।

দ্বিতীয়ত, কোন মুসলমানকে ভূমি রাজস্ব বা খারাজ প্রদান করতে হত না; তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের এক-পঞ্চমাংশ খারাজের পরিবর্তে এক-দশমাংশ উশর দিতে হত। খারাজ হতে অব্যাহতি লাভের আশায় অমুসলমানগণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। কারণ, ধর্মান্তরের ফলে জিজিয়া ও খারাজ হতে অব্যাহতি পাবার সম্ভাবনা ছিল। খলিফা নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ভূমি-রাজস্ব এবং জিজিয়া প্রদানে বাধ্য করেন; কারণ মাওয়ালিগণ গ্রাম ছেড়ে শহরে আগমন করলে খারাজ হতে মুক্তি পেত; অপরদিকে সৈন্যদলে যোগদান করলে সরকারকে ভাতা প্রদান করতে হত। এ কারণে হাজ্জাজ মাওয়ালীদের গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষিকার্য সম্পাদন করতে বাধ্য করেন। খলিফা দ্বিতীয় ওমর নির্দেশ দেন যে, যদি কোন অমুসলমান ইসলাম গ্রহণ করে তবে তার জমি তার গ্রামের কোন অমুসলমান ভাইকে প্রদান করে শহরে যেতে পারে। এর ফলে ভূমিহীন হয়ে মাওয়ালিগণ ভূমি-রাজস্ব হতে অব্যাহতি পায়। মুসলমানদের খারাজ দিতে হত না কিন্তু অমুসলমান ভূ-স্বামীই ভূমি-রাজস্ব দিতে বাধ্য হত। এভাবে সরকারের আয় বৃদ্ধি পায়।

তৃতীয়ত, যে সমস্ত নব-দীক্ষিত মুসলমান গ্রাম ছেড়ে শহরে যেত না তাদেরকে খারাজের সমতুল্য পরমাণ অর্থ রাজকোষে প্রদান করতে হত। আরব মুসলমানগণের তুলনায় অনারব মুসলমানগণকেও অধিক ভূমি-রাজস্ব দিতে হত। এর ফলে সরকার দেউলিয়া হওয়ার দায় হতে অব্যাহতি পায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, আরব মুসলমানগণকে ভূমির উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ খারাজ হিসেবে প্রদান না করে এক- পঞ্চমাংশ উশর হিসেবে সরকারকে দিতে হত। মুসলমান এবং মাওয়ালীদের খারাজ দিতে বাধ্য করে খলিফা অর্থনৈতিক সংকট হতে রক্ষা পাবার চেষ্টা করেন।

দ্বিতীয় ওমর রাজস্ব-ব্যবস্থা বহুলাংশে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের রাজস্ব নীতির উপর ভিত্তি করে সংস্কার করেন। হযরত ওমর আরব জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আরবদের অনারব অঞ্চলে জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করেন। সৈন্যদের জায়গীরের পরবর্তে নিয়মিত রাজকোষ হতে ভাতা প্রদান করা হয়। হযরত ওসমান আরব মুসলমানদের সর্বপ্রথম ইরাক ও সিরিয়ায় জমি ক্রয় করে বসবাস করবার অনুমতি দেন। মুসলমানগণ জমি ক্রয় করলে অমুসলমানদের দেয় উক্ত জমি হতে খারাজ নতুন ভূস্বামীদের দিতে হত না; এর ফলে রাজকোষে অর্থাভাব দেখা দিল। হাজ্জাজ অবশ্য খারাজ কর হতে লব্ধ সরকারি আয় বৃদ্ধির জন্য মাওয়ালীদের গ্রামে ফিরে কৃষিকার্য করতে বাধ্য করেন। কিন্তু দ্বিতীয় ওমর এরূপ কঠোরতা অবলম্বন না করে ধর্মীয় উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনা করে ৭১৮-৭১৯ খ্রিস্টাব্দে আইন জারি করে অমুসলমানদের নিকট থেকে মুসলমানদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করেন। এর ফলে খারাজ আদায় হতে থাকে এবং রাজকোষের আয় বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় ওমরের শাসন নীতির সমালোচনা

ধর্মপ্রাণ, প্রজাবৎসল ও বিচক্ষণ খলিফা দ্বিতীয় ওমরের শাসন-ব্যবস্থা জনকল্যাণমূলক, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে প্রবর্তিত হলেও এর বিরূপ সমালোচনা করা হয় এবং এর নিষ্ফলতাকে উমাইয়া বংশের পতনের জন্য দায়ী করা হয়। হিট্টি বলেন, “সদিচ্ছায় অনুপ্রাণিত হলেও দ্বিতীয় ওমরের শাসননীতি ফলপ্রসূ ছিল না।”

দ্বিতীয় ওমরের শাসনব্যবস্থাকে প্রগতিশীল বলা না গেলেও এটি যে জনমঙ্গলকর, রক্ষনশীল ছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই। ঐতিহাসিক ব্রাউন বলেন, “খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে বিখ্যাত ওমর ইবন-খাত্তাবের সময় যে শাসনপদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তা দ্বিতীয় ওমর হুবহু অনুসরণ করেন। কিন্তু তাঁর শাসনপদ্ধতি সাফল্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত রক্ষণশীল, এমন কি প্রতিক্রিয়াশীলও ছিল।” খলিফা দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বকালের বৈশিষ্ট্যগুলো মোটামুটি নিম্নরূপ ছিল : (ক) গোত্রীয় ভারসাম্য রক্ষা করে গোত্রকলহ নির্মূল করা; (খ) ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণা দান; (গ) সম্প্রসারণ অপেক্ষা সংরক্ষণ নীতিতে আত্মনিয়োগ; (ঘ) ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রদর্শন দ্বারা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব এবং মৈত্রী স্থাপন; (ঙ) রাজস্ব-ব্যবস্থার সংস্কার দ্বারা রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টা; (চ) রাসূলে করীম (স)-র পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন; (ছ) দল ও গোত্র নির্বিশেষে রাষ্ট্রের মঙ্গলার্থে উপযুক্ত শাসনকর্তার নিযুক্তি।

খলিফা দ্বিতীয় ওমরের শাসন নীতি এবং প্রশাসনিক কার্যাবলির বিশ্লেষণ করলে এটি রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল কি-না তা প্রমাণিত হবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তাঁর রাজত্বকালে আরব-অনারব, হিমারীয় মুদারীয়, শিয়া-সুন্নী, খারিজি, মাওয়ালী প্রভৃতি গোষ্ঠী শান্ত ও তুষ্ট ছিল এবং তারা কলহ, দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ, অনাচার, গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি অসামাজিক ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্য হতে বিরত ছিল। ন্যায়-নীতি ও সহানুভূতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তিনি সকল দল, শ্রেণী, গোত্র, বংশ, সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। মূইর বলেন, “দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বকালে কোন চাঞ্চল্যকর ঘটনা না ঘটলেও আকর্ষণীয় ঘটনার অভাব ছিল না। রক্তপাত, ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাকতার মধ্যে তাঁর রাজত্বকাল ছিল একটি স্বস্তিজনক অধ্যায়।” খলিফা নিজের এবং তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য যা ভাল মনে করতেন তাই করতেন।

ন্যায়নিষ্ঠা, ধর্মপরায়ণতা এবং কর্তব্যজ্ঞানের বশবর্তী হয়ে দ্বিতীয় ওমর শাসনকর্তাদের রদবদল করেন। উমাইয়া বংশীয়দের গোত্র-প্রীতি, স্বজন-প্রীতি ও পক্ষপাত-নীতি বিশ্লেষণ করলে রাজবংশের প্রতি তাঁর আনুগত্যের অভাব রয়েছে বলে মনে হয়। তিনি একদিকে যেমন হিমারীয় গোত্রের সামাহ্-বিন-মালিককে স্পেনে এবং ইসমাইল-বিন-আবদুল্লাহকে কায়রোয়ানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন, অপরদিকে তেমনি মুদারীয় গোত্রের আদ-বিন-আরতাতকে বসরায়, আবদুল হামিদ বিন-আবদুর রহমানকে কুফায় এবং অমর-বিন-যুবাইরকে মেসোপটেমিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। দ্বিতীয় ওমরের নিরপেক্ষ ও উদার শাসননীতি রাষ্ট্র ও প্রজার মঙ্গলার্থে হলেও মুদারীয় গোত্র তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করতে থাকে। তহবিল তসরূপের অভিযোগে তিনি উমাইয়া সমর্থক মুহাল্লাবের পুত্র ইয়াজিদকে খোরাসানের শাসনকর্তার পদ হতে অপসারিত করেন। তাঁর পরবর্তী খলিফাগণ তাঁর মত দল ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকলে উমাইয়া বংশের পতন সহজে হত না।

সর্বত্যাগী রাজর্ষির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে খলিফা দ্বিতীয় ওমর প্রথম ওমরের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ন্যায়পরায়ণতা, ধার্মিকতা ও সরলতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন বলে তাঁকে খোলাফায়ে রাশেদূনের পঞ্চম খলিফা বলা হয়। হাশেমী বংশের প্রতি তাঁর সহানুভূতির নিদর্শনস্বরূপ তিনি মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত হযরত আলী ও তাঁর বংশের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণের ঘৃণ্য প্রথা বাতিল করেন। মারওয়ান কর্তৃক আত্মসাৎকৃত ‘ফিদাক’ নামক বাগানটি তিনি রাসূলে করীমের পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে দেন। ওমরের এহেন উদারনীতি ‘অভিযোগকারীদের’ মতে শিয়া সম্প্রদায়কে প্রেরণা দান করে এবং তাঁর শক্তি বৃদ্ধিপূর্বক আব্বাসীয়দের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করে উমাইয়া বংশের অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। নিরপেক্ষ, উদার এবং সততার নীতি ওমরের উত্তরাধিকারীগণ বর্জন করে উমাইয়া বংশীয় নীতি অনুসরণ করলে শিয়া, খারিজি, মাওয়ালী এবং সর্বশেষ আব্বাসীয়গণ ক্রুদ্ধ হয়ে উমাইয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। খলিফা দ্বিতীয় ওমরের সদিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর নীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আমীর আলী বলেন, “ওমর কর্তৃক অনুসৃত সত্য এবং নিরপেক্ষ বিচার উমাইয়া বংশের স্বার্থের বিরোধী ছিল। তারা বুঝতে পারল যে, ক্ষমতা এবং প্রভাব দ্রুত তাদের হস্তচ্যূত হচ্ছে।” উমাইয়াগণ দ্বিতীয় ওমরের ধর্মপরায়নতা, সততা, নিরপেক্ষতায় ভীত ও শঙ্কিত হয়ে খলিফার একজন ভৃত্যকে উৎকোচ দ্বারা তাঁকে হত্যার জন্য প্ররোচিত করে। দাইর সীমান ( Dair Siman) নামক স্থানে ৭২০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ওমর আততায়ীর হস্তে নিহত হন।

ইসলামকে সর্বজনীন ধর্মে রূপান্তরিত করবার নিমিত্ত দ্বিতীয় ওমর নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ‘জিজিয়া’ কর প্রদান হতে অব্যাহতি দেন। রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ যে কর প্রবর্তন করেন ধর্মপ্রাণ ওমর তা বাতিল ঘোষণা করলে দলে দলে অমুসলমান ইসলামে দীক্ষিত হয়। শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় নীতির ফলে মধ্য এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার অধিবাসিগণ তৌহিদে বিশ্বাস স্থাপন করে। ইসলাম প্রচারে উমাইয়া বংশের শক্তি ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় এবং রাজ্যের সর্বত্র ইসলামের বিস্তৃতির জন্য ‘উমাইয়া সাধুর’ যথেষ্ট কৃতিত্ব ছিল। ওমরের ধর্মনীতির প্রতিক্রিয়া ছিল প্রধানত দুটি- প্রথমত, দলে দলে অমুসলমান ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলে রাজকোষ ‘জিজিয়া’ কর হতে বঞ্চিত হয়ে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়; কারণ নব-দীক্ষিত মুসলমানগণকে জিজিয়া প্রদান করতে হত না। ওমর খারাজ বৃদ্ধি করলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে ইসলাম প্রচারের ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয় নি। দ্বিতীয়ত, হিট্টি বলেন, “বার্বার এবং পারস্যবাসীরা ধর্মান্তরিত হলে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করতে পারবে এই আশায় ইসলাম ধর্মগ্রহন করে।” সুতরাং বলা যেতে পারে যে, ইসলামের মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে বার্বার ও খোরাসানবাসী ইরাকী মাওয়ালিগণ ধর্মান্তরিত হয় নি। স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে তৌহিদবাদে বিশ্বাস স্থাপন করে। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, খলিফা হিশামের সময়ে খোরাসানে সগোদিয়া উপজাতিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করবার পর জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করলে তারা বিদ্রোহ ঘোষনা করে। দ্বিতীয় ওমরের ধর্মপ্রেম সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নি। কারণ, রাজস্ব হ্রাসে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা মিসরের শাসনকর্তা তাঁকে অবহিত করলে খলিফা বলেন যে, “আল্লাহ তাঁর রাসূলকে ধর্মপ্রচারক হিসেবে প্রেরণ করেন, কর আদায়কারীরূপে নহে।” যারা সুযোগ ও সুবিধা সন্ধানী তারাই যে কেবল ইসলাম গ্রহণ করে তা ঠিক নহে। কারণ, একথা অবিসংবাদিত সত্য যে, ধর্মত্যাগী বিদ্রোহ ঘোষণাকারীরা ঈমানদার মুসলমান ছিল না, তারা ছিল মুনাপেক। নিষ্ঠাবান ও ধর্মপ্রাণ খলিফা অমুসলমানদের রাজকার্য হতে অব্যাহতি দেন বলে অভিযোগ করা হয। কিন্তু ধর্মীয় উদারতা ও সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক দ্বিতীয় ওমর ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেন নি; বরং তিনি তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ধর্মমন্দিরগুলো সংস্কারের অনুমতি দেন। এমনকি তাঁর সময়ে স্পেনের সারাগোসায় খ্রিস্টানদের একটি গীর্জা নির্মিত হয়। তাঁর রাজত্বকালে খ্রিস্টান ও ইহুদীদের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হবার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং ধর্মীয় নীতি রাজস্ব নীতির পরিপন্থী হলেও তা ন্যায়, সততা, উদারতা ও সহিষ্ণুতার উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়।

খলিফা দ্বিতীয় ওমর ছিলেন শান্তিপ্রিয়; সাম্রাজ্যবাদী রণনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। সিংহাসনে আরোহন করে তিনি সমরাভিযান বন্ধ করে দেন। স্পেন ও ফ্রান্সে আন-সামাহ্-এর অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়; কারণ, খলিফা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের নীতি অনুসরণ করে সমগ্র রাজ্যে শান্ত-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্টার চেষ্টা করেন। খোদাবক্সের মতে, দ্বিতীয় ওমরের সময়ে রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। তিনি বলেন, “দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বের পূর্বেই প্রথম ওমর সুষ্ঠুভাবে সামরিক সংগঠনের কার্য সমাধা করেন। প্রথম ওয়ালিদের খিলাফতে আরব বিজয় এমন সুবিস্তৃত হয় যার অধিক সম্প্রসারণ অথবা ব্যাপকতা সম্ভবপর ছিল না।” সম্প্রসারণ নীতি বর্জনে সামরিক শক্তি হ্রাস পায় এবং সৈন্যবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লে পরবর্তীকালে শিয়া, খারিজি, বার্বার, মাওয়ালীদের বিদ্রোহ দমন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এরূপ অভিযোগ সত্য নহে; কারণ পরবর্তী খলিফা হিশামের সময় আবদুর রহমান বীরবিক্রমে ফ্রান্সে মধ্যভাগে অগ্রসর হয়ে কৌশলগত নির্বুদ্ধিতার জন্য টুরসের যুদ্ধে খ্রিস্টানদের নিকট পরাজিত হন সত্য কিন্তু তাঁর শাসনকালে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সম্পূর্ণরূপে দমন করা হয়। উপরন্তু, বলা যেতে পারে যে, দ্বিতীয় ওমর সমরনীতির পরিবর্তে সংগঠন পদ্ধতিকে অধিক গুরুত্ব দেন। আমীর আলীর মতে, “সম্প্রসারণে নয় বরং তাঁর কর্তৃত্বাধীনে ন্যস্ত বিশাল সাম্রাজ্যের সংগঠনই ওমরের প্রধান লক্ষ্য ছিল।” প্রজাবৎসল, জনদরদী, ধর্মপ্রাণ দ্বিতীয় ওমর সংস্কারমূলক কার্যকলাপের দ্বারা সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্টা করতে সক্ষম হন। খোদাবক্স বলেন, “পশ্চিমে পিরেনীজ এবং পূর্বে মধ্য এশিয়ার মালভূমি ইসলামের সামরিক অভিযানের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতা ছিল। এতে মনে হয় যে, অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উপযুক্ত সময় এসেছে।“

হাজ্জাজ যে সমস্ত মাওয়ালীকে কৃষিকার্য করতে বাধ্য করে খারাজ অথবা ভূমি- রাজস্ব এবং জিজিয়া-এই উভয় কর আদায় করতেন, তাদের সাথে আপোষ-মমিাংসা করে রাজ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ওমর রাজস্ব-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন। নব-দীক্ষিত মাওয়ালীদের জিজিয়া কর হতে আব্যাহতি দেন; কিন্তু তাদেরকে খারাজ প্রদান করতে হত। রাজস্ব-ব্যবস্থার সংস্কারের মূলে তাঁর ধর্মপ্রচারের অনুরাগ মূর্ত হয়ে উঠে একথা ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে স্বীকার করেন। স্পুলার বলেন, “দ্বিতীয় ওমরের নির্দেশনামায় কেবল সরকারি অর্থনীতির উপর এর অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া হয় এবং তাঁর এই নীতির মূলে ধর্মপ্রবণতার উপলব্ধি না করেই বিচার করা হয়।” অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে, ধর্মপ্রচারের নিমিত্ত প্রবর্তিত রাজস্ব-নীতি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে ত্বরান্বিত করে, কারণ রাজকোষ রাজস্ব হতে বঞ্চিত হয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। সূক্ষ্ম বিচারে প্রমাণিত হবে যে, এই ধারণা সত্যই বিভ্রান্তিকর। প্রথমত, জিজিয়া কর হতে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল ইসলামের বিধান অনুসারেই; কারণ জিজিয়া কেবল বিজিত বিধর্মীদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামরিক বাহিনীতে যোগদানের অব্যাহতি লাভের জন্য প্রদান করতে হত। কিন্তু এর অব্যাহতিতে রাজস্ব-আয় হ্রাস পায় নি। অবশ্য বার্নাড লুইস বলেন,

“দ্বিতীয় ওমরের সংস্কারের ফলে ব্যয় বৃদ্ধি এবং রাজস্ব হ্রাস পায়।” বলা বাহুল্য যে, রাজস্ব-ব্যবস্থার সংস্কারে রাষ্ট্রের আয় হ্রাস পায় নি; কারণ, মুসলমানগণের যাকাত ও ৭১৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত জমি হতে উশর (এক-দশমাংশ) এবং খারাজ আদায় হত। নব-দীক্ষিত মুসলমানদের অথবা মাওয়ালীদের খারাজ; অমুসলমানদের জিজিয়া এবং খারাজ দিতে হত। ৭১৯ খ্রিস্টাব্দের পর যদি কোন অমুসলমান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তা হলে তার জমি তার স্বগোত্রীয় অমুসলমানদের নিকট অর্পণ করতে হত। উপরন্তু, ৭১৯ খ্রিস্টাব্দের পর অমুসলমানদের নিকট হতে মুসলমানদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে ভুমি-রাজস্ব খারাজ বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় ওমরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তাঁর ত্রুটিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা ও সংস্কার উমাইয়া বংশের পতনকে ত্বরান্বিত করে। প্রকৃতপক্ষে তাঁকে উমাইয়া রাজতন্ত্রের ধ্বংসের জন্য দায়ী করা যায় না। কারন, ওয়েলহাউসেনের মতে, “এটি (উমাইয়া রাজবংশ) তার রাজত্বে পূর্ব হতেই টলমলে অবস্থায় ছিল।” রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্যই অভিনব পন্থা প্রণয়ন করে ইসলামের প্রচার, গোত্রীয় ভারসাম্য, শান্তি-শৃঙ্খলা, সংহতি ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। রাজস্বব্যবস্থার ফলে সাময়িক অর্থসঙ্কট দেখা দিলেও হিশামের সময়কার সমৃদ্ধি লক্ষ্য করে বলা যায় যে, তাঁর সময়ে উমাইয়াদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে নি। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় ওমরের অযোগ্য উত্তরাধিকারিগণ বিশেষ করে ওয়ালিদ, তৃতীয় ইয়াজিদ, মারওয়ান উমাইয়া বংশের পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী। দ্বিতীয় ওমরের শান্তি, মৈত্রী এবং সংহতির নীতি অনুসৃত হলে উমাইয়া খিলাফতের দ্রুত অধঃপতন হত না।

দ্বিতীয় ওমরের চরিত্র

সরল, অনাড়ম্বর, ন্যায়নিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ন, ধর্মানুরাগী, সহনশীল এবং বিচক্ষণ খলিফা হিসেবে ওমর ইবন-আবদুল-আজীজ উমাইয়া রাজবশের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। ‘খোলাফায়ে রাশেদূনের’ আদর্শ এবং জীবনধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় ওমর সর্বত্যাগী-রাজর্ষির ন্যায় জীবনযাপন করতেন। তিনি আড়ম্বর ও জাঁকজমক মোটেই পছন্দ করতেন না। ভোগবিলাসী, আড়ম্বরপ্রিয়, ক্ষমতালোভী, দুরাত্মা উমাইয়া খলিফাদের তুলনায় তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পূর্ণ পৃথক থাকায় এবং আদি ও অকৃত্রিম ইসলামের আদর্শকে মনে প্রাণে গ্রহণ করায় তাঁকে ‘উমাইয়া সাধু’ (Umayyad Saint ) এবং ‘পঞ্চম ধর্মপ্রাণ খলিফা’ (The fifth pious khalifa) বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর জীবনি লেখকগণ বলেন যে, তিনি শতচ্ছিন্ন ও মলিন পোশাক পরিধান করে জনসাধারণের সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে মেলামেশা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। সাধুতা, পবিত্রতা এবং ধর্মনিষ্ঠায় তিনি যে কোন উমাইয়া খলিফা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি শাসনভার গ্রহণ করে তাঁর স্ত্রী ফাতিমা, তাঁর পিতা ও ভ্রাতার নিকট হতে যে সমস্ত মূল্যবান স্বর্ণখচিত অলঙ্কার এবং দ্রব্যসামগ্রীর বিক্রয়লব্ধ অর্থ পান তা রাজকোষে জমা দেন। বায়তুল মালকে খোলাফায়ে রাশেদূনের মত তিনি জনগণের সম্পত্তি বলে মনে করতেন; কিন্তু অন্যান্য উমাইয়া খলিফাগণ একে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেন। রাষ্ট্রীয় অশ্বশালার অশ্বগুলো বিক্রয় করে এর অর্থ তিনি রাজকোষে জমা দেন। নিজ সংসারের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি বায়তুল মাল হতে কেবল দৈনিক দুই দিরহাম (পঞ্চাশ পয়সার কাছাকাছি) গ্রহণ করতেন।

৭১৭ হতে ৭২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর রাজত্ব করে দ্বিতীয় ওমর উমাইয়া যুগের অশান্তি, অরাজকতা, অনাচার ও অহেতুক রক্তপাতের স্থলে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি-শৃঙ্খলা, সমৃদ্ধি ও সংহতির একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ের সূচনা করেন। হিট্টি বলেন, “ওমর ধর্মতত্ত্ববিদদের প্রভাবাধীন ছিলেন। উমাইয়া যুগে অধর্ম এবং অনাচারের পরিপন্থী ধর্মানুরাগ এবং কঠোর সংযমের জন্য তিনি যুগ যুগ ধরে খ্যাতি অর্জন করেন।” তিনি ধর্মশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য এবং ইসলামের একজন শ্রেষ্ঠ আলেমের মর্যাদা লাভ করেন। কুরআন এবং হাদিসের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে তিনি শাসনকার্য নির্বাহ করতেন। তিনি ইসলাম প্রচার ও একে সঞ্জীবিত করবার প্রয়াস পান। তাঁর অকৃত্রিম ধর্মানুরাগ এবং ধর্মপ্রচারের অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে মুজাদ্দিদ বা সঞ্জীবক বলা হয়ে থাকে। প্রজাবৎসল, জনদরদী, পরোপকারী খলিফা দ্বিতীয় ওমর জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর প্রজাদের আর্থিক সাহায্য এবং প্রয়োজনে আশ্রয় দান করতেন। তিনি হাশিমী বংশের প্রতি অবিচার বন্ধ করেন। তিনি রক্তপাতের বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর রাজত্বে খারিজি, মাওয়ালী, শিয়া সম্প্রদায় সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত। পরবর্তীকালে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা উমাইয়া বংশের পতনে তৎপর হয়ে উঠে। তিনি আরব ও অনারবদের বৈষম্য দূর করে সর্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করেন। মাওয়ালীদের ভাতা প্রদান করে তাঁদের বিদ্রোহকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। আমীর আলী বলেন, “অকৃত্রিম ধর্মানুরাগ, তীক্ষ্ণ বিচার-বুদ্ধি, অবিচলিত নীতিজ্ঞান, সহিষ্ণুতা এবং সরলতা তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল।”

ধর্মনিরপেক্ষতা দ্বিতীয় ওমরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। ইসলামে তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল; কিন্তু তাঁকে ধর্মান্ধ অথবা গোঁড়া মুসলমান বলা যেতে পারে না। তিনি খ্রিস্টান ও ইহুদীদের ধর্মমন্দির সংস্কারের অনুমতি দেন; উত্তর সারাগোসায় একটি নতুন গীর্জা নির্মাণ, গুতায় (Ghutah) সেন্ট থমাসের গীর্জার পুনঃব্যবহার করবার অনুমতি দান করেন; আইলা এবং সাইপ্রাসের খ্রিস্টানদের কর হ্রাস করেন; নাজরানের খ্রিস্টানদের ২০০০ খণ্ড বস্ত্রের পরিবর্তে ২০০টি বস্ত্র বাৎসরিক কর হিসেবে প্রদানের ব্যবস্থা করেন। স্পুলার বলেন, “পূর্ববর্তী খলিফাদের অপরাধ-প্রবণতার পরিবর্তে তাঁর ধর্মপরায়নতা কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক খ্রিস্টানদের অধিকারকে সম্মান করতে সাহায্য করে।”

উমাইয়া খিলাফতে দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বকাল স্বল্পকালীন হলেও বহুদিক থেকে এটি বিশেষ গুরত্বপূর্ণ। পরবর্তী খলিফাদের অযোগ্যতা, অকর্মণ্যতা, অসাধুতা, অসভ্যতা এবং বিলাসপরায়ণতার যুগে তিনি ছিলেন সাধুতা ও ধর্মপরায়ণতার মূর্ত প্রতীক এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর কর্মপদ্ধতিতে ভাস্কর হয়ে রয়েছে। এ কারণেই তাঁকে পরবর্তী উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা যেতে পারে। ‘উমাইয়া সাধু’ সত্যই একটি অবিস্মরণীয় ব্যতিক্রম। মূইর যথার্থই বলেন, “দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বে কোন প্রকার চাঞ্চল্যকর (সামরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে) ঘটনা সংঘটিত না হলেও রক্তপাত, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে স্বীয় এবং জনগণের মঙ্গলার্থে আত্মোৎসর্গকৃত দ্বিতীয় ওমরের রাজত্ব ছিল স্বস্তিকর এবং শান্তিপ্রদ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *