প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

দ্বিতীয় অধ্যায় : আল-মাহদী, আন-হাদী, হারুন আর-রশীদ

দ্বিতীয় অধ্যায় – আল-মাহদী [৭৭৫-৭৮৫ খ্রি.], আল-হাদী [৭৮৫-৭৮৬ খ্রি.] ও হারুন-আর-রশীদ [৭৮৬-৮০৯ খ্রি.]

আল-মাহদী [৭৭৫-৭৮৫ খ্রি.]

সিংহাসনারোহণ

খলিফা আল-মনসুরের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র আল-মাহদী ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন। আল-মাহদী পিতার কঠোর ও রক্তপাতনীতি পরিত্যাগ করে উদার ও শান্তিপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেন। প্রজাবৎসল ও মহানুভব খলিফা হিসেবে তিনি অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ ব্যক্তিদের মুক্তিদান করেন উপরন্তু, ৭৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দে হজ্ব পালনের জন্য হেজাজীদের মধ্যে ৩ কোটি দিরহাম বিতরণ করেন। তিনি বহু মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কার করেন। কাদেরিয়া হতে জাবারা পর্যন্ত নির্মিত রাস্তার দুই পার্শ্বে তিনি সরাইখানা নির্মাণ এবং নিরাপত্তার জন্য প্রহরীর ব্যবস্থা করেন। ‘আমীন’ নামক এক শ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত করে দূর-দূরাঞ্চলের সংবাদ আহরণের ব্যবস্থা করেন। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন দানশীল ও সহিষ্ণু, অপরদিকে রাষ্ট্রের নিরপত্তার জন্য কঠোরতা অবলম্বন করতেও দ্বিধা করতেন না। আল-মাহদী খোরাসানের বিদ্রোহী নেতা ইউসুফকে বন্দী করেন এবং অনুরূপভাবে আলী সম্প্রদায়ের প্রধানমন্ত্রী ইয়াকুব-ইবন-দাউদকে কারারুদ্ধ করেন।

বিদ্রোহ দমন

মূর (Moore)-এর ‘লালারুখ’ রচনার প্রধান নায়ক ধর্মভ্রষ্ট হাশিম-ইবন-হাকিম আল-মাহদীর খিলাফতে খোরাসানে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কদাকার ও খর্বাকৃতি হাশিম সর্বদা মুখ ঢেকে রাখত বলে তাকে ‘অবগুণ্ঠনাবৃত ভণ্ড নবী’ (The Veiled prophet of Khorasan) বলে অভিহিত করা হয়। নিজেকে আল্লাহর অবতার বলে ঘোষণা করে সে ধর্ম এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। আল-মাহদী তার বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। পরাজিত হয়ে হাশিম কীশ নামক শহরে অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দেয়। তার শিষ্যগণ সাদা পোশাক পরিধান করত বলে তাদের ‘মূবাইয়ী’ অথবা ‘শ্বেতবস্ত্র পরিহিত’ বলা হয়।

কাম্পিয়ান সাগরের পূর্বদিকে জুরজান নামক স্থানে ‘মুহাম্মির’ অথবা লাল পোশাক পরিহিত এক ধর্মদ্রোহী জিন্দিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে খসরু নওশিরওয়ার রাজত্বকালে পারশ্যে মাজদাক (Mazdak) নামে এক ধর্মীয় নেতার আবির্ভাব হয়। পারস্য সম্রাট তাকে কঠোর হস্তে দমন করলেও তার প্রাচীন ‘নাস্তিকতাবাদী সাম্যবাদ’ (Old Nihilistic Communism) মনীর দর্শনের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যায়। এই অনৈসলামিক ভাবধারায় পুষ্ট জিন্দিকগণকে ধ্বংস করবার জন্য আল-মাহদী সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

বায়জানটাইনদের সঙ্গে যুদ্ধ

স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করে বায়জানটাইনগণ মুসলিম রাজ্যে লুটতরাজ শুরু করলে আল-মাহদী তদীয় পুত্র হারুনকে সমরাভিযানে প্রেরণ করেন। ৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে বায়জানটাইন সম্রাজ্ঞী আইরীন বাৎসরিক বিপুল কর প্রদানে স্বীকৃত হয়ে হারুনের সঙ্গে সন্ধি করেন। বায়জানটাইনদের উপর হারুনের সাফল্যের জন্য মাহদী সন্তুষ্ট হয়ে হারুনকে ‘আর-রশীদ’ (ন্যায়নিষ্ঠ) উপাধি দান করেন।

উত্তরাধিকারী মনোনয়ন ও মৃত্যু

৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে আল-মাহদী মৃত্যুবরণ করবার পূর্বে রাজমহিষী খায়য়ুরানের প্রভাবে তাঁর গর্ভজাত পুত্রদ্বয় মুসা এবং হারুনকে খিলাফতের পর পর উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেন। মাহদীর দশ বছর শাসনকালে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য সুসংহত এবং সুসমৃদ্ধ হয়।

আল-হাদী [৭৮৫-৭৮৬ খ্রি.]

ক্ষমতালাভ

পিতার মনোনয়নক্রমে মুসা ‘আল-মাহদী’ (পথ প্রদর্শক) উপাধি ধারণ করে ৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। ক্ষমতালাভ করে তিনি ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হন এবং হারুনের স্থলে তাঁর পুত্র জাফরকে মনোনীত করবার প্রচেষ্টায় হারুনের সমর্থক ও প্রধান উপদেষ্টা খালিদ বিন-বার্মাক ও তাঁর সহচরদের কারারুদ্ধ করেন। রাজদরবারের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে পড়লে হারুন স্বীয় নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করেন।

আল-হাদীর স্বল্পকালীন খিলাফতে সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মেসোপটেমিয়ার খারিজিগণ এবং মক্কা-মদিনার আলীপন্থিগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহীদের দমন করা হয়। কিন্তু মদিনার বিদ্রোহ দমনকালে ইমাম হাসানের প্রপৌত্র ইদ্রিস যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তানজিয়ারে পলায়ন করেন। বার্বারদের সক্রিয় সহায়তায় ইদ্রিস দূর পশ্চিমে (মাগরিব-উল-আক্সা) ইদ্রিসীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। আল-হাদী তাঁর মাতা খায়যুরানের শাসনকার্যে হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না; এতে রাজমাতা বিক্ষুব্ধ হন। ধর্মদ্রোহী মনীপন্থী (Manichaeans ) সম্প্রদায় বিদ্রোহী হলে আল-হাদী কঠোর হস্তে তাদের দমন করেন।

মৃত্যু

৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের নিকটবর্তী ঈশাবাদ নামক স্থানে বিহারকালে আল-হাদী এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি কৃত অপরাধের জন্য তাঁর মাতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পিতার ইচ্ছানুসারে তিনি তদীয় ভ্রাতা হারুনকে খলিফা মনোনীত করেন।

চরিত্র

আলহাদীর স্বভাব ছিল উগ্র এবং মেজাজ ছিল রুক্ষ। আল-হাদীর শাসনকালে আব্বাসীয় খিলাফতে পারস্য প্রভাব চরমতম স্তরে উপনীত হয়। তিনি সাহসী, উদার, উৎসাহী ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন।

হারুন-আর-রশীদ [৭৮৬-৮০৯ খ্রি.]

সিংহাসনারোহণ

৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৫ বছর বয়সে হারুন-আর-রশীদ (ন্যায়নিষ্ঠ) ভ্রাতা হাদীর মৃত্যুর পর বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। বার্নার্ড লুইস বলেন, “মনসুর কর্তৃক স্থাপিত সাম্রাজ্যে নানারূপ বিদ্রোহ-সংঘাত সত্ত্বেও হারুনের রাজত্ব পর্যন্ত সংঘবদ্ধ ছিল বলে মনে হয় এবং পরবর্তী শাসনে (৭৮৬-৮০৯) আব্বাসীয় ক্ষমতা চরম শিখরে উপনীত হয়।” ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, হারুনের পূর্বে ইসলামের ইতিহাসে এরূপ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় নি।

হারুন-আর-রশীদ খিলাফত লাভ করে আল-হাদী কর্তৃক কারারুদ্ধ ইয়াহিয়া ইবন- খালিদ বার্মাককে মুক্তি প্রদান করে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ইয়াহ্ইয়ার পুত্র ফজল এবং জাফর রাজদরবারে বিশেষ প্রভাব ও প্রতিপত্তি লাভ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, ইসলামী স্বর্ণযুগের প্রতিভূ আল-মামুনের জন্ম হয় তাঁর পিতার খিলাফত লাভের দিনেই হারুন তাঁর মাতা খায়যুরানের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করেন এবং তাঁকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ- সুবিধা দেন। খায়যুরানের পৃষ্ঠপোষকতায় হারুনের শিক্ষক ইয়াহ্ইয়া ও তাঁর বংশধরেরা বার্মেকী আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হন। আরব্যোপন্যাসের নায়ক হারুন-আর-রশীদ প্রজারঞ্জক শাসক হিসেবে যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেন।

বিদ্ৰোহ দমন

খারিজী বিদ্রোহ : সিংহাসনে আরোহণ করে হারুন সর্বপ্রথম খারিজীদের সর্বাত্মক বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। ৭৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দে মসুলে খারিজী বিদ্রোহ প্রকট আকার ধারণ করে এবং মেসোপটেমিয়ার আব্বাসীয় শাসনকর্তা হুরাইরা এই বিদ্রোহ দমন করতে না পারলে হারুন তাঁকে হত্যার আদেশ দেন। ওয়ালিদ-ইবন-তারিকের নেতৃত্বে অপর একটি বিদ্রোহ নাসিবিন, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং মেসোপটেমিয়ার হুলওয়ান পর্যন্ত চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকে। খলিফা হারুন-আর-রশীদ একটি বিরাট বাহিনী প্রেরণ করে রাষ্ট্রদ্রোহী ওয়ালিদকে পরাজিত এবং নিহত করেন। ওয়ালিদের মৃত্যুর পর তাঁর ভগ্নী লায়লা খারিজী বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দান করেন। শোকাভিভুত লায়লা ভ্রাতার রোমাঞ্চকর অভিযানের শোঁকগাথা রচনা করে কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর পরিচালনায় খারিজিগণ ইরাকে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। পরবর্তীতে তারা উপর্যুপরি কয়েকটি সংঘর্ষে খলিফার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। অবশেষে বীরশ্রেষ্ঠ লায়লা খলিফা হারুনের জনৈক সেনাপতির নিকট পরাজিত হন ও তাঁকে নারীসুলভ জীবনে ফিরে যাবার জন্য প্ররোচিত করা হয় এবং তিনি খলিফার বশ্যতা স্বীকার করেন। শৌর্যবীর্যের জন্য তাঁকে “আরবীয় জোয়ান অব আর্ক” (Arabian Joan of Ark) বলা হয়, যদিও ফ্রান্সের জোয়ানের এবং লায়লার শেষ পরিণতি একরূপ ছিল না। ৭৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে অপর একটি খারিজী বিদ্রোহ পারস্যে অরাজকতার সৃষ্টি করলে শাসনকর্তা আলী-ইবন-ঈশা কঠোর হস্তে তা দমন করেন।

মধ্য এশিয়ায় শান্তি স্থাপন : হারুন-আর-রশীদের খিলাফত বিস্তৃতি অপেক্ষা শান্তি ও সংহতিপূর্ণ সুশাসনের জন্যই অধিক সমাদৃত ছিল। আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে শত্রুমুক্ত ও সুসংঘবদ্ধ করে তিনি সেখানে নিরাপত্তা কায়েম করেন এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার উন্মেষের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেন। ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র কাবুল ও সানবাদ আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সাম্রাজ্যের সীমানা হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। এরপর খলিফা এশিয়া মাইনরের সীমান্ত অঞ্চলগুলো সাধারণ প্রদেশসমূহ হতে পৃথক করে ‘সুরক্ষিত অঞ্চল’ অথবা ‘আওয়াসিম’ নামকরণ করে তাকে সামরিক প্রশাসনের অধীনে আনেন। তিনি সিরিয়ার টুরসাসে পুনর্বসতি স্থাপন করে এটিকে একটি সুরক্ষিত দুর্গে পরিনত করেন।

খাজার বিদ্রোহ দমন : গ্রীকদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে খাজারগণ উত্তর দিক হতে সহসা আর্মেনিয়া আক্রমণ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ দ্বারা খলিফা হারুন-আর রশীদের রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে। খলিফা অতঃপর দুইজন সুদক্ষ সেনাপতি প্রেরণ করে বর্বর উপজাতিদের কঠোর হস্তে দমন করেন। এভাবে আর্মেনিয়ায় শান্তি এবং শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

আলীপন্থীদের সাথে সম্পর্ক : আব্বাসীয় খিলাফতের আলীপন্থীদের বিরোধিতা খুবই ন্যায়সঙ্গত ছিল। কারণ, তারা আল-আব্বাস এবং আল-মনসুর কর্তৃক প্রবঞ্চিত এবং নির্যাতিত হন। আল-মনসুর আলী বংশীয় ইব্রাহিম ও মুহাম্মদকে হত্যা করলে অপর ভ্রাতা ইয়াহিয়া দাইলাম অঞ্চলে আত্মগোপন করেন। খলিফা হারুনের রাজত্বে ইয়াহিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করলে জুরজান এবং পারস্যের বার্মেকী শাসনকর্তা ফজলকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। বার্মেকী পরিবার পারস্য-সম্ভূত বলে আলীপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। প্রকৃতপক্ষে আলী বংশীয় ইয়াহিয়াকে খলিফার বশ্যতা স্বীকার করতে প্ররোচিত করা হয়। এক চুক্তির মাধ্যমে হারুনের সাথে ইয়াহিয়ার মৈত্রী স্থাপিত হয়। কিন্তু সন্দেহপ্রবণ খলিফা হারুন বিদ্রোহের উৎসকে নির্মূল করবার জন্য ইয়াহিয়াকে কারারুদ্ধ করেন।

শিয়াদের বিদ্রোহে শঙ্কিত হয়ে খলিফা হারুন-আর-রশীদ সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক এবং পণ্ডিত ইমাম মুসা আল-কাজিমকে গ্রেফতার ও বন্দী করে বাগদাদে সিন্ধি ইবন- শাহিকের ভগ্নীর প্রহরাধীনে রাখেন। কয়েক বছর কারাবরণের পর ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের ইসনা আশারীয়া (Twelvers)-এর সপ্তম ইমাম ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলী-আর-রাজী ( সন্তুষ্টচিত্ত) শিয়াদের ইমাম নিযুক্ত হন। তিনিও পিতার মত শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং জ্ঞান-সাধক ছিলেন।

অন্যান্য বিদ্রোহ দমন

৭৯২ খ্রিস্টাব্দে মুদারীয় এবং হিমারীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সিরিয়া এবং সিন্ধু প্রদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। খলিফা হারুন এই বিদ্রোহ দমন করতে বলিষ্ঠ মনোবলের পরিচয় দেন। তাঁর আদেশে মুসাকে সিরিয়ায় এবং দাউদ মুহাল্লাবীকে সিন্ধু অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। বিদ্রোহাগ্নি নির্বাপিত হলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

মসুলে ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে আতাফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ দেখা দিলে খলিফা স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করে বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করেন। আক্রোশবশে খলিফা মসুল শহরের প্রাচীরগুলো ধ্বংস করে দেন।

আগলাবী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা

খলিফা আল-হাদীর আমলে ৭৮৫-৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার তানজিয়ারে ইদ্রিসী বংশ স্থাপিত হলে মুসলিম সাম্রাজ্য হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সর্বপ্রথম একটি স্বাধীন রাজবংশের সৃষ্টি হয়। আফ্রিকার আব্বাসীয় গভর্নরগণ শত চেষ্টা করেও ইদ্রিসী বংশকে ধ্বংস করতে পারেন নি। আব্বাসীয় সাম্রাজ্য হতে তানজিয়ার বিচ্ছিন্ন হলে আল-মনসুর ইয়াজিদ-বিন-হারসামাকে ৭৭২ হতে ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকর্তার পদে বহাল রাখেন। খলিফা হারুন-আর-রশীদ প্রখ্যাত সেনাধ্যক্ষ হারসামাকে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। প্রায় তিন বছর যোগ্যতার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করে তিনি শান্তি ও সংহতি কায়েম করেন। এই সময় দক্ষিণ আলজিরিয়ার জাব অঞ্চলের শাসনকর্তা ইব্রাহিম ইবন-আগলাব পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে খলিফার প্রীতিভাজন হন। এই প্রদেশের ব্যয়বহুল শাসন-ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে ইব্রাহিমের প্রার্থনা অনুযায়ী এবং হারসামার পরামর্শে খলিফা বাৎসরিক ৪০,০০০ দীনার কর প্রদানের অঙ্গীকারে উক্ত প্রদেশের শাসনভার তার উপর ন্যস্ত করেন। এভাবে ইব্রাহিম- ইবন-আগলাব ৮০০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় বংশানুক্রমিক আগলাবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ৯০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আগলাবী বংশ কায়রোয়ানের অদূরবর্তী আব্বাসীয়ায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে রাজত্ব করে। খুৎবা হতে আব্বাসীয় খলিফাদের নাম মুছিয়া ফেলা হয় এবং তাঁরা তাঁদের অনুমোদন লাভ করে আমীর পদবীতে সন্তুষ্ট থাকেন। এভাবে ক্রমশ উত্তর আফ্রিকা স্বায়ত্তশাসিত এলাকায় পরিণত হয়।

পরবর্তী ঘটনাবলী

৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে হারুনের মাতা খায়যুরানের মৃত্যু হলে বার্মেকী বংশের প্রতিনিধি ইয়াহিয়া রাজদরবারে স্বীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তি হারাতে থাকেন। মাতার মৃত্যুর পর খলিফা রাজকীয় সীলমোহর ইয়াহিয়ার পরিবর্তে তাঁর পুত্র ফজলকে অর্পণ করেন। শাসনকার্যে নিরুৎসাহ প্রকাশ করলে খলিফা ইয়াহিয়াকে পদচ্যুত করেন এবং তাঁর স্থলে ইয়াহিয়ার দুই পুত্র ফজল এবং জাফরকে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।

৭৯১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাজ্ঞ জুবাইদা এবং তাঁর ব্রাতা ঈসার প্রভাবে খলিফা হারুন তাঁর পাঁচ বছর বয়স্ক দ্বিতীয় পুত্র মুহম্মদকে ‘আল-আমীন’ উপাধি দান করে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আল-আমীনের পরবর্তী খলিফা হিসেবে হারুন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুল্লাহকে ‘আল-মামুন’ উপাধি দান করে ৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন দান করেন। তিনি আরও নির্দেশ দেন যে, আল-মামুনের পর তাঁর তৃতীয় পুত্র কাশিম ‘মুতামিম’ উপাধি গ্রহণকরে সিংহাসনে উপবিষ্ট হবেন। তবে একটি শর্ত থাকে যে, মামুনের নিকট কাশিম খলিফার অযোগ্য বিবেচিত হলে তিনি তাঁকে অপসারিত করতে পারবেন। হারুনের জীবদ্দশায় মামুন পূর্বাঞ্চল, আমীন পশ্চিমাঞ্চল এবং কাশিম মেসোপটেমিয়া ও সীমান্ত অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

৮০২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাজ্ঞী জুবাইদা এবং পুত্রদ্বয় আমীন ও মামুনকে নিয়ে খলিফা হারুন হজ্বব্রত পালন করবার উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করেন। এই হজ্বব্রত পালন সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমীনের চারিত্রিক দুর্বলতার কথা চিন্তা করে খলিফা হারুন তাঁর উত্তরাধিকারী সন্তানদ্বয়ের মধ্যে সদ্ভাব এবং ভ্রাতৃসুলভ মনোভাব রক্ষার্থে একটি শর্ত অরোপিত দলিল সম্পাদন করেন। আমীন ও মামুন কর্তৃক স্বীকৃত এই অঙ্গীকারপত্রটি যাতে রদবদল করা না যায় সেজন্য এটি পবিত্র কা’বাগৃহে সংরক্ষণ করা হয়। এই হজ্বের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জুবাইদা কর্তৃক মক্কাবাসীদের পানির অভাব দূরীভূত করবার জন্য এক লক্ষ দিনার ব্যয়ে একটি খাল খনন। ‘নহরে জুবাইদা’ নামে এই খালটি অদ্যাবধি তাঁর ধর্মপরায়ণতার স্বাক্ষর বহন করতেছে।

মুসলিম-বায়জানটাইন যুদ্ধ

আমীর আলী বলেন, “হারুন-আর রশীদের সাথে বায়জানটাইনদের যুদ্ধবিগ্রহ ছিল তাঁর রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ ঘটনা।” মাহদীর শাসনকালে বায়জানটাইনদের সঙ্গে এই চমকপ্রদ শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ’ পুনরায় শুরু হয়। দামেস্ক হতে রাজধানী বাগদাদে স্থানান্তরিত হওয়ার পর বায়জানটাইন সম্রাট প্রথম কনস্টান্টাইন আর্মেনীয়া এবং এশিয়া মাইনরে মুসলিম রাজ্যের সীমানায় অতর্কিত আক্রমণ করেন। বায়জানটাইন আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য মাহদী তদীয় পুত্র যুবরাজ হারুন এবং খালিদ বিন-বার্মাকের সেনাপতিত্বে এক লক্ষ সৈন্যের একটি শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করেন। মুসলিম বাহিনী বসফোরাসে সাফল্য অর্জন করে রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অবরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ভীত ও শঙ্কিত হয়ে চতুর্থ লিঁওর বিধবা সম্রাজ্ঞী আইরীন খলিফার নিকট সন্ধি প্রার্থনা করেন। বাৎসরিক ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার দিনার কর দানে স্বীকৃত হয়ে তিনি আব্বাসীয় খলিফার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করে বীরত্ব এবং ন্যায়নিষ্ঠার পরিচয় প্রদানের জন্য মাহদী হারুনকে ‘আর-রশীদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাঁকে তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা আল-হাদীর পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

সিংহাসনে আরোহণ করে খলিফা হারুনকে বায়জানটাইনদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিরুদ্ধাচরণের সম্মুখীন হতে হয়। বায়জানটাইনদের আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য তিনি একজন সুযোগ তুর্কী সেনাপতির নেতৃত্বে টুরসাসে (Tursus) একটি পৃথক সরকার গঠন করেন। বায়জানটাইনের সাথে মুসলমানদের প্রতি বছরই সংঘর্ষ চলতে থাকে। সৈন্যদের উৎসাহ দানের জন্য কখনও কখনও খলিফা স্বয়ং যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। ৭৯১- ৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে নৌবাহিনীর সহায়তায় ক্রীট এবং সাইপ্রাস অধিকৃত হলে বায়জানটাইন সেনাপতি বন্দী হন। অতপর ৭৯৭-৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফা স্বয়ং একটি বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দান করে ইফিসাস (Ephesus) এবং আনসিরা (Ancyra) দখল করেন। স্কুটারীর নিকটে খলিফা হারুন তাঁবু ফেললে রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অবরোধের সম্ভাবনায় বায়জানটাইন সম্রাজ্ঞী আইরীন (৭৯৭-৮০২ খ্রিস্টাব্দে) কর প্রদানে সম্মত হয়ে চার বছরের জন্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত করেন। যুদ্ধবন্দী বিনিময় করা হয় এবং ৪,০০০ বন্দী মুসলিম সৈন্যকে প্রত্যার্পণ করতে বাধ্য করা হয়। এটি ছিল কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আব্বাসীয় প্রচেষ্টা।

৮০২ খ্রিস্টাব্দে কোষাধ্যক্ষ নাইসিফোরাস (Niciphorus) আইরীনকে (Irene ) সিংহাসনচ্যুত করে বায়জানটাইন সম্রাটরূপে নিজেকে কনস্টান্টিনোপলে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ক্ষমতালাভ করে স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন এবং অবিবেচক নাইসিফোরাস ঔদ্ধত্য এবং বিশ্বাসঘাতকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে খলিফা হারুনের নিকট ৮০৩ খ্রিস্টাব্দে একটি অপমানজনক পত্র লিখেন। তাঁর পত্রটি ছিল এরূপ :

“রোমান সম্রাট নাইসিফোরাসের নিকট হতে আরবদের নৃপতি হারুনের নিকট আমার পূর্ববর্তী সম্রাজ্ঞী আপনাকে অহেতুক প্রভূত মর্যাদা দান করে স্বীয় প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ন করেন এবং নারীসুলভ দুর্বলতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য আপনার নিকট স্বীয় ঐশ্বর্য দান করেন! সুতরাং আপনি পত্রপাঠ মাত্র কালবিলম্ব না করে প্রেরিত অর্থের দ্বিগুণ অর্থ প্রত্যর্পণ করুন, অন্যথায় তরবারিই আপনার ও আমার মধ্যে মীমাংসা করবে।”

নাইসিফোরাসের অশালীন ও ঔদ্ধত্যমূলক পত্র পাঠ করে খলিফা হারুন-আর-রশীদ এরূপ ক্রোধান্বিত হলেন যে, সভাসদগণ ভীত হয়ে দরবার ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বায়জানটাইন সম্রাটের চিঠির প্রত্যুত্তরে তিনি এরূপ পত্র পাঠালেন :

“বিশ্বাসিগণের নেতা খলিফা হারুনের নিকট হতে রোমানদের কুকুর নাইসিফোরাসের নিকট লিখিত পত্র হে পৌত্তলিক মাতার সন্তান (তার মাতা ছিলেন নাস্তিক)। পত্রের উত্তর কানে শুনতে হবে না; স্বচক্ষেই অবলোকন করতে পারবে।”

পত্র প্রেরণ করবার সঙ্গে সঙ্গে খলিফা হারুন একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্বয়ং বায়জানটাইন সম্রাটকে সমুচিত শিক্ষাদানের জন্য কনস্টান্টিনোপলের দিকে অগ্রসর হন। কোনরূপ বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন না হয়েই তিনি হিরাক্লিয়া ও টিরানা অধিকার করলেন। নাইসিফোরাসকে যুদ্ধে পরাজিত করে তিনি তাকে শান্তিচুক্তি সম্পাদন এবং কর প্রদানে বাধ্য করেন। নাইসিফোরাস সন্ধি প্রার্থনা করলে খলিফা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। খলিফা রাক্কায় প্রত্যাবর্তন করলে নাইসিফোরাস পুনরায় চুক্তি ভঙ্গ করে প্রতি-আক্রমণ করলে খলিফা হারুন তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বার অভিযান পরিচালনা করে সমুচিত শিক্ষা দেন। গীবনের মতে, “তাঁর (নাইসিফোরাসের) অভিসন্ধিমূলক যুদ্ধনীতি ধূলিসাৎ হয়ে গেল এবং চল্লিশ হাজার নিহত গ্রীক সৈন্যের রণক্ষেত্র হতে নাইসিফোরাস তিনটি ক্ষতচিহ্নসহ পলায়ন করেন।” এবারও বিশ্বাসঘাতক বায়জানটাইন সম্রাট করদানে সম্মত হয়ে সন্ধির প্রস্তাব করলে সহৃদয় খলিফা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

কপটতা এবং ধৃষ্টতার প্রতীক নাইসিফোরাস খলিফার ট্রান্স-অক্সিয়ানার বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকার সুযোগে তৃতীয় বার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করেন এবং মুসলিম সীমান্তে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। হারুন ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে ১,৩৫,০০০ সৈন্যসহ রাই (Rai) অভিযান হতে বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে তৃতীয় বারের মত যুদ্ধাভিযান করেন। উত্তরে বিথিনীয়া (Bithynia) এবং পশ্চিমে মাইসীয়া (Mysia) ও কারিয়া (Caria) পর্যন্ত সমগ্র এশিয়া মাইনর জয় করে হারুন সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন। ইয়াজিদ-ইবন- মাখলাদ ইউফিসাস ও লিডিয়া, সুহরাবিল সাকালায়ে, থিরাসা, সিডারোপোলস ও নাইসীয়া অধিকার করে। খলিফা নাইসিফোরাসের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে হিরাক্লিয়া দখল করেন। তৃতীয় বার পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে হারুন দয়াপরাবশ হয়ে তাও মঞ্জুর করেন। হারুন এবার বর্ধিত কর ছাড়াও স্বয়ং সম্রাট নাইসিফোরাস এবং রাজপরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে কর প্রদানে বাধ্য করেন।

মূইর বলেন, “হারুন ঘন ঘন অন্যত্র ব্যস্ত থাকলে নাইসিফোরাস তাঁর সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করেন এবং প্রতিবারেই পরাজিত হন।” নাইসিফোরাস ধৃষ্টতা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা করলেও খলিফা হারুন প্রতিবারেই তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন। আমীর আলী বলেন, “বায়জানটাইন শাসনের অবসান ঘটলে এবং কনস্টান্টিনোপল মুসলমানগণ দখল করলে এটি পৃথিবীর শান্তি এবং সভ্যতার জন্য মঙ্গলজনক হত।” মুসলিম-বায়জানটাইন সংঘর্ষ অব্যাহত থাকায় উভয়ের মধ্যে ধর্মীয় সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মূইর বলেন, “এই সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহের তিক্ত পরিণতি ছিল ধর্মীয় ঘৃণাকে পুনরুজ্জীবিত করা।” এর পরবর্তীকালে সম্ভবত মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের ক্রুসেডের যুদ্ধ সংঘটিত করতে সাহায্য করে।

বার্মেকী বংশের উত্থান ও পতন

উত্থান : আমীর আলী বলেন, “তের বছর বার্মেকী পরিবার অকৃত্রিম বিশ্বস্ততা এবং অসাধারণ দক্ষতার সাথে খলিফা হারুনের সেবা করে।” গিলমানের মতে, “আবুল আব্বাসের খিলাফতে সুদূর খোরাসান হতে জাফর নামে বার্মেকী পরিবারের একজন প্রতিনিধি দরবারে আগমন করেন এবং খলিফাকে বিষধারণের উপযুক্ত একটি অঙ্গুরী প্রদান করে বিপদে এর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে জানান।” জাফর বলখের বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থাকায় তাঁর উপাধি ছিল বার্মাক (Barmak)। উল্লেখযোগ্য যে, জাফর স্ত্রী এবং পুত্র খালিদসহ ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে কুতাইবা-ইবন-মুসলিম কর্তৃক মধ্য-এশিয়া বিজয়ের সময় যুদ্ধবন্দীরূপে ধৃত হন।[১] পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাঁরা বন্দীদশা হতে মুক্তি লাভ করেন।

[১. হিট্টি বলেন, “খালিদের মাতা কুতাইবা ইবন-মুসলিমের বলখ অধিকারের (৭০৫ খ্রি.) সময় বন্দী হন, তাঁর পিতা বার্মাক ছিলেন সেখানকার প্রধান বৌদ্ধ মন্দিরের পুরোহিত।” (History of the Arabs, p. 294 )]

জাফর বার্মাকের পুত্র খালিদ ইবন-বার্মাক আব্বাসীয় খিলাফতের প্রারম্ভেই স্বীয় কর্মদক্ষতা ও রণকুশলতার জন্য যথেষ্ট প্রভাব এবং প্রতিপত্তি অর্জন করেন। আর মুসলিমের বাহিনীতে যোগদান করে আব্বাসীয় প্রচারণা এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আবুল আব্বাস তাঁকে রাজস্ব-বিভাগের প্রধান কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। খলিফা মনসুরের রাজত্বকালে তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন। নব-প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অতুলনীয় দুর্গপ্রাসাদ বাগদাদ এবং মাহদীয়া নামক অপর একটি নগরী নির্মাণের কার্যাবলী তিনি যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করেন। এই সময় তিনি মেসোপটেমিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে আল-মনসুর তাঁকে ৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শিয়াদের বিদ্রোহ দমনের জন্য তাবারিস্তানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি মসুলেও একটি উপজাতীয় বিদ্রোহ দমন করে কৃতিত্ব অর্জন করেন এবং সেখানে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শাসনকর্তার পদে বহাল ছিলেন। গিলমান বলেন, “পরিবারটির অফুরন্ত ঐশ্বর্য ছিল এবং খালিদ তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় অধিক ধার্মিক, বাগ্মী, সত্যভাষী এবং সাহসী ছিলেন। খালিদের প্রভাব এত মাত্রাধিক ছিল যে, আল-মনসুর বাগদাদ নির্মাণকালে উচ্ছ্বাসে মাদাইনের খসরুর প্রাসাদসমূহ হতে অপূর্ব স্তম্ভরাজি ও সামগ্রী সংগ্রহ করবার প্রস্তাব করলে তিনি তাঁর পরিকল্পনার বিরোধিতা করতে সাহসী হন।” খালিদের মাধ্যমে আব্বাসীয় দরবারে পারস্য প্রভাব অনুপ্রবেশ করে। তিনি উজির (Vizier) নামে পরিচিত না হলেও খলিফা আল- মনসুর এবং আল-মাহদীর আমলে উপদেষ্টার মর্যাদা লাভ করেন। আল-মাহদীর রাজত্বকালে তিনি যুবরাজ হারুনের সঙ্গে বায়জানটাইনে সম্রাজ্ঞী আইরীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি সুরক্ষিত দুর্গ দখল করেন। তিনি মাহদীর শিক্ষক হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। একথা অনস্বীকার্য যে, তিনি প্রখ্যাত বার্মেকী উজির পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর চারিজন প্রপৌত্র ফজল, জাফর, মুসা ও মুহাম্মদ খলিফা হারুন-আর-রশীদের প্রথম সতের বছর প্রকৃত অর্থে শাসনকার্য অপরিসীম দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালিত করেন। জ্ঞানী, বিচক্ষণ এবং দায়িত্বশীল ইয়াহিয়া খলিফা মনসুরের রাজত্বে আর্মেনিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। বালক হারুনের বহুমুখী প্রতিভার আভাস পেয়ে আল-মাহদী বুদ্ধিদীপ্ত ও কর্মঠ ইয়াহিয়ার উপর পুত্রের শিক্ষাভার অর্পণ করেন। হারুন ভক্তিভরে ইয়াহিয়াকে পিতা বলে সম্বোধন করতেন। কারণ, রাজ-পরিবারের সঙ্গে বার্মেকী পরিবারের অকৃত্রিম সদ্ভাব থাকায় শৈশবে হারুন ইয়াহিয়ার স্ত্রীর স্তন্য পান করেন। আল- মাহদীর মৃত্যুর পর আল-হাদী সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে পিতার মনোনয়নকে উপেক্ষা করে এবং হারুনের স্থলে তাঁর পুত্র জাফরকে মনোনীত করবার প্রচেষ্টা চালালে রাজমাতা খায়রান এবং উপদেষ্টা ইয়াহিয়া এর বিরোধিতা করেন। প্রকাশ্য বিরোধিতার জন্য আল- হাদী ইয়াহিয়াকে কারারুদ্ধ করেন। হারুন-আর-রশীদ খিলাফত লাভ করে ইয়াহিয়াকে মুক্তি দেন এবং প্রধান উজিরের (Vizier) পদে নিযুক্ত করেন। পারস্য প্রশাসনিক প্রভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে আব্বাসীয় খিলাফতে বার্মেকীগণ সর্বপ্রথম উজীর অথবা প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করে। হারুন-আর-রশীদ ইসলামের ইতিহাসে যে রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের সূচনা করেন তার কৃতিত্ব বহুলাংশে এই মার্জিত, বিচক্ষণ এবং দায়িত্বশীল বার্মেকী পরিবারের প্রাপ্য। প্রথম সতের বছরে (৭৮৬-৮০৩ খ্রি.) হারুন-আর-রশীদের শাসনের যে গৌরব ও সুনাম হয় তার মূলে ছিল সরকারের গুরুদায়িত্ব পালনে নিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচক্ষণতা এবং কর্মদক্ষতা। ইয়াহিয়া প্রজাদের মঙ্গলের জন্য সদা ব্যস্ত থাকতেন এবং খলিফাকে সুচিন্তিত পরামর্শ দান করতেন। আব্বাসীয় স্বার্থে গৃহীত কর্মপন্থাগুলো দ্বারা হারুনের রাজত্বে বার্মেকীদের অসামান্য প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসকগোষ্ঠী সৃষ্টি করেন। রাজমাতা খায়যুরানের মৃত্যুর পর ইয়াহিয়ার কর্মস্পৃহা হ্রাস পেতে থাকে। কারণ, তিনিই ছিলেন তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অতঃপর তিনি খলিফার নিকট রাজকীয় সীলমোহরাদি প্রত্যর্পণ করে অবসর গ্রহণ করেন। ৮০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানগণ সাম্রাজ্যের শাসনভার পরিচালনা করতে থাকেন।

ফজল-ইবন ইয়াহিয়া : ইয়াহিয়ার চার পুত্র ফজল, জাফর, মুসা ও মুহাম্মদ তাঁদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং দায়িত্বশীলতার জন্য হারুনের রাজত্বের প্রথম দিকে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন। তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততা দ্বারা আব্বাসীয় খিলাফতকে সেবা করেন এবং এর গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ফজল হারুনের বাল্যসাথী ছিলেন এবং শৈশবে একত্রে খেলাধূলা করলে উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতা জন্মায়। হারুন তাঁকে পরম স্নেহে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। কারণ, তিনি ফজলের মাতার স্তন্য পান করেন। ফজল প্রথমে খোরাসানের শাসনকর্তা হিসেবে ৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ইয়াহিয়া-বিন-আবদুল্লাহকে পরাজিত ও নিহত করেন। অতঃপর তিনি মিসরের শাসনকর্তা হিসেবেও প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। পিতা ইয়াহিয়া বার্ধক্যহেতু অবসর গ্রহণ করলে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা উজিরের পদ অলঙ্কৃত করেন। হিট্টির মতে, “রমজান মাসে মসজিদে বাতি জ্বালাবার প্রথা ইসলামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রবর্তন করেন। “

জাফর-ইবন-ইয়াহিয়া : ফজলের মত জাফরও হারুন-আর-রশীদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও নিত্যসহচর ছিলেন। খলিফা তাঁকে পুত্র মামুনের অভিভাবক নিযুক্ত করেন এবং এর ফলে যুবরাজের মধ্যে পারস্যের প্রভাব দেখা দিতে থাকে। তিনি যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে কয়েকটি প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সিরিয়ার গভর্নর থাকাকালীন তিনি হিমারীয় এবং মুদারীয়দের গোত্রীয় কলহ নিবারণের চেষ্টা করেন। ইয়াহিয়া বৃদ্ধ বয়সে তাঁর দুই পুত্র ফজল ও জাফরের হস্তে রাজকার্য অর্পণ করেন। ভ্রাতা ফজল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি পিতার অবসর গ্রহণের পর এবং হারুনের রাজত্বের শুরু হতে প্রায় ১৫ বছর মন্ত্রীত্ব করেন। পরবর্তী সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী বা উজিরের পদও অলঙ্কৃত করেন। ঐশ্বর্যসম্পন্ন বার্মেকী বংশ জাফরের নেতৃত্বে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে অসীম ক্ষমতা লাভ করে এবং শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, জনমঙ্গলকর কার্যকলাপের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। পূর্ব বাগদাদে বার্মেকী বংশের সদস্যগণ অতুলনীয় প্রাসাদ নির্মাণ করে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে থাকেন। ইউফ্রেটিসের তীরে ‘আল-জাফরী ভবন’ (al-Jafarei) নামে একটি অনিন্দ্যসুন্দর প্রাসাদ নির্মাণ করে জাফর স্থাপত্যকীর্তির অপূর্ব নিদর্শন রেখে যান। এই বাসভবনকে কেন্দ্র করে মামুনের সময়ে একটি অভিজাত বাসভূমি গড়ে উঠে। বার্মেকীগণ এই অঞ্চলে ‘আল-জাফরী’ প্রাসাদে জাঁকজমকের সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। মসজিদ, মাদ্রাসা, খাল, রাস্তাঘাট প্রভৃতি জনহিতকর কার্যের জন্য তাঁরা অজস্র অর্থ দান করেন। পরবর্তীকালে বার্মেকী বললে বদান্যতা বুঝাত। অসাধারণ কাব্যপ্রতিভা এবং বাগ্মীতার জন্য জাফর তৎকালীন আব্বাসীয় সমাজে সমাদৃত হন। আরবীয় ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ছিলেন ‘লেখক গোষ্ঠীর জনক’ (People of the Pen or Ahl-al-Qalam)। বেশভূষা, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি নিত্য নতুন প্রথা তিনি দরবারে প্রচলিত করেন। উচ্চ-কলার (High collars) সম্পন্ন পরিধেয় বস্ত্র তিনি প্রথম ব্যবহার করেন। ৮০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর সুশাসনে সাম্রাজ্যের সুখ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।

মুসা ও মুহাম্মদ : বার্মেকী বংশের অপর দুজন মুসা ও মুহাম্মদ হারুন-আর-রশীদের রাজত্বে বিভিন্ন প্রদেশে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সংহতি ও সমৃদ্ধিকে সুদূরপ্রসারী করেন। সতের বছর একনিষ্ঠ এবং আত্মমর্যাদামূলক শাসনে আব্বাসীয় খিলাফত বিশেষভাবে খলিফা হারুনের রাজত্বকালে স্বর্ণযুগে পরিণত হয়। গিলমান বলেন, “বার্মেকীগণ শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের রাজধানীতে বসবাস করবার জন্য উৎসাহিত করেন।”

বার্মেকীদের পতন

বার্মেকী বংশের উত্থান যেমন ছিল বিস্ময়কর; তাদের পতনও ছিল তেমনি আকস্মিক এবং দুর্ভাগ্যজনক। সুদীর্ঘ সতের বছর পর নিষ্ঠা, অবিচল আনুগত্য ও আত্মত্যাগ এবং অসাধারণ কর্মনৈপুণ্যের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করে যারা হারুনের রাজত্বে গৌরব, মর্যাদা ও সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেন তাদের রহস্যাবৃত এবং অভাবনীয় পতনের নজীর ইতিহাসে সত্যই বিরল। ঐতিহাসিকগণ বার্মেকী বংশের পতনের মূলে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন।

প্রথমত, নব-দীক্ষিত পারস্যের বার্মেকী পরিবার ইসলামের প্রতি অনুদার মনোভাব প্রকাশ করে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। জাফর বার্মেকী বলখের বৌদ্ধ মন্দিরে প্রধান পুরোহিত বা বার্মাক ছিলেন এবং যুদ্ধে পরিবারসহ বন্দী হলে স্বীয় স্বার্থে ইসলাম গ্রহণ করেন। খালিদ-ইবন-জাফর বার্মেকীর পারস্য জাতীয়তাবাদের প্রতি দুর্বলতা ছিল এবং পূর্ব- পুরুষের অনৈসলামিক ভাবধারা হতে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন না। ফলে পারস্য সাসানীয় প্রভাব অনুপ্রবেশ করতে থাকলে আব্বাসীয় দরবারে আরব প্রভাব তিরোহিত হয় এবং বিভিন্ন পারস্য আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে আব্বাসীয় বংশ পারসিককরণ (Persianization) হতে থাকে। আল-মনসুর সর্বপ্রথম পারস্যের শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেন; হাজীব (Chamberlain) এবং উজির (Vizier) পদগুলো পারস্য দেশ হতে অনুকরণ করা হয়। উপরন্তু, বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, হারুনের জ্যেষ্ঠ পুত্র মামুনের মাতা ছিলেন পারস্যবাসী। হারুনের সময় অনৈসলামিক পারস্য প্রভাব আব্বাসীয় খিলাফতে অনুপ্রবেশ করলে ইসলামের ধর্মীয় অনুভূতিতে একে আঘাতস্বরূপ মনে করা হয়। যে কারণে পারস্যের ভূতপূর্ব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বার্মেকী পরিবারকে দোষারোপ করা হয়। সম্ভবত এটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত হানে।

দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক জুরজী জায়দান বলেন, “বাৰ্মেকীগণ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং আলীর ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী নীতিতে তারা আস্থা স্থাপন করেন।” বলাবাহুল্য যে, শিয়া গোষ্ঠীর (Shiah faction) প্রধান কেন্দ্রস্থল (Stronghold) ছিল পারস্য এবং এর ফলেই বর্তমানেও পারস্য একমাত্র শিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আব্বাসীয় খলিফাদের প্রায় প্রত্যেককে শিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ দমনে তৎপর থাকতে হয়। মনসুরের খিলাফতে মুহম্মদ এবং ইব্রাহিমের নৃশংস হত্যা, ইমাম জাফর-আস-সাদিককে নির্যাতন, ইমাম মুসা- আল-কাজিমের কারাবরণ শিয়াদেরকে আব্বাসীয়দের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তোলে। পারস্য হতে উদ্ভূত বার্মেকী সম্প্রদায় শুধু শিয়া মতাবলম্বীই ছিলেন না বরং আব্বাসীয়-বিরোধী শিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। খালিদ প্রকাশ্যভাবে তাদের সমর্থন করতেন। জাফরের প্রাসাদে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা নিয়মিত সমবেত হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা করত। এর ফলে হারুন স্বভাবত তাদের আব্বাসীয়-বিরোধী কার্যকলাপে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন। শিয়া- প্রবণতা বার্মেকীদের পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

তৃতীয়ত, বার্মেকীদের শিয়া-প্রবণতার ফলে সুন্নী আব্বাসীয় খিলাফতে সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক উদারনৈতিক এবং অনৈসলামিক চিন্তাধারা অনুপ্রবেশ করে। মনসুর সর্বপ্রথম নিজেকে বিশ্ববাসীদের নেতা ‘আমীরুল মুমেনীন’ উপাধি ধারণ করে পার্থিব এবং ধর্মীয় উভয় ক্ষমতার সমন্বয় সাধন করেন। হারুনের খিলাফতে কুরআন ও হাদিসের পরিপন্থী মতবাদ প্রচারিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় শিয়া উদারপন্থী বার্মেকীদের পৃষ্ঠপোষকতায়। হারুনের রাজত্বে প্রধান বিচারক আবু ইউসুফ সর্বপ্রথম সুন্নী হানাফী আইন-কানুন লিপিবদ্ধ করেন কিন্তু বার্মেকীদের উদার অনৈসলামিক প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা সুন্নী ইসলামে আঘাত হানে। বার্মেকীগণ প্রকৃতপক্ষে একেশ্বরবাদী ছিলেন না; তাদেরকে ঈশ্বরবাদী (Theist) বলা হয়ে থাকে এবং তাদেরকে প্রচারিত ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদী (Heretic) বলেও অভিহিত করা হয়। সুন্নী ইসলামের ধারক ও বাহক হিসেবে খলিফা হারুন সম্ভবত বার্মেকীদের শিক্ষামূলক এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপকে পছন্দ করতেন না।

চতুর্থত, ইবন-খালদুনের মতে, বার্মেকীদের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তাঁদের অতুলনীয় বৈভব, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা, অপ্রতিহত প্রতিপত্তি। তিনি বলেন, “তারা যে প্রকারে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এবং রাজস্ব ব্যয়ের সমস্ত পদ্ধতি হস্তগত করে তাতে স্বয়ং হারুন-আর-রশীদকেও তাদের নিকট অর্থ প্রার্থনা করতে হত এবং কখনও কখনও সামান্য পরিমান অর্থও লাভ করতেন না।” তাদের প্রভাব ছিল অপরিসীম এবং তাঁদের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ সামরিক এবং বেসামরিক পদগুলোতে তাঁদের পরিবার অথবা অনুগামীদের মধ্য হতে যোগ্য শাসক নিযুক্ত করা হত। রাজ্যের সমস্ত মানুষ তাঁদের মুখাপেক্ষী ছিল এবং তাঁদের সম্মুখে মস্তক অবনত করতে হত। দরখাস্তকারী এবং পদপ্রার্থীদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা তাদের উপর নির্ভর ছিল। তাঁরা গ্রামে, শহরে এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র দান করতেন। তাদের স্তুতি সকলের মুখে কীর্তিত হত এবং তাদের প্রভু অপেক্ষা তাঁরা অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।”[১] অত্যধিক ও অবাঞ্ছিত বার্মেকী প্রতিপত্তিকে ধ্বংস করবার জন্য খলিফা হারুন বদ্ধ পরিকর ছিলেন; কারণ, তিনি মনে করতেন যে, ১৭ বছর ধরে তিনি প্রত্যক্ষ ক্ষমতা হতে বঞ্চিত ছিলেন। হিট্টি বলেন, “অভিভাবকত্ব হতে অবশেষে মুক্তিলাভের জন্য খলিফা উপযুক্ত সুযোগ পেলেন। একগুঁয়ে স্বভাবের হারুনের জন্য শিয়া বার্মেকীগণ অত্যধিক ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেন এবং তাঁর খিলাফতে দুটি সূর্য থাকতে পারে না।”

[১. ইবনে খালদুনের মতে হারুনের খিলাফতে কমপক্ষে ২৫০ জন বার্মেকী বংশের পদস্থ কর্মচারীকে নিয়োগ করা হয়।]

পঞ্চমত, বার্মেকীদের বদান্যতা, পরোপকারিতা, আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা, অসীম জনপ্রিয়তা, সাম্রাজ্যের একশ্রেণীর আমীর ও পদস্থ রাজকর্মচারীদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ, ঈর্ষা এবং প্রতিহিংসার উদ্রেক করে। আব্বাসীয় খিলাফতে পারস্য বার্মেকী বংশের প্রতিদ্বন্দ্বী আরব অভিজাত সম্প্রদায় প্রচণ্ড প্রচারণা শুরু করে। আরব এবং পারস্য ভাবধারা ও প্রভাবের দ্বন্দ্ব ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে এবং রাজগৃহাধ্যক্ষ (হাজীব) ফজল-বিন-রাবী আরব আমীরদের দলপতি হিসেবে খলিফা হারুনের নিকট স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যা অভিযোগ করতে থাকেন। বার্মেকী বংশের প্রতি ফজলের বিতৃষ্ণা এবং ষড়যন্ত্রের মূলে কয়েকটি কারণ ছিল; প্রথমত, পারস্য বার্মেকীগণ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করলে আরব গোষ্ঠী রাজদরবারে প্রভাব হারায় এবং প্রধানমন্ত্রী উজীর হিসেবে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য তাদের ঐশ্বর্য অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে আরবদের ঈর্ষা হতে থাকে। উল্লেখযোগ্য যে, উমাইয়াদের পতনে আরব প্রভাব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আব্বাসীয় খিলাফত পারসিকরণ হয়। দ্বিতীয়ত, বার্মেকী বংশের সদস্যরা ২৫০টি দায়িত্বপূর্ণ পদ লাভ করে এবং এরূপ জাঁকজমকভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে যে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০,৬৭৬,০০০ দিনার। তৃতীয়ত, জাফর প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হলে ফজল- বিন-রাবী মনঃক্ষুণ্ণ হন; কারণ, তিনি মনে মনে এই পদ লাভের আশা পোষণ করতেন। চতুর্থত, ফজল-বিন-রাবী বার্মেকীদের শিয়া প্রবণতার জন্য প্রচারণা এবং গোপন তৎপরতা আরম্ভ করেন। এর ফলে সুন্নী আরব গোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে বার্মেকীদের পতনকে ত্বরান্বিত করে। তারা হারুনের নিকট রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের মিথ্যা অভিযোগ করে বার্মেকীদের মূলোচ্ছেদ করবার চেষ্টা করে।

ষষ্ঠত, রাবী এবং তাঁর পরবর্তী ঐতিহাসিকগণ একটি ‘হারেমের ঘটনা’কে বার্মেকীদের পতনের অন্যতম কারণ বলে বর্ণনা করেন। খলিফা হারুন প্রধানমন্ত্রী জাফর এবং প্রিয় ভগ্নী আব্বাসার একত্রে সাহচর্য লাভের জন্য উভয়ের মধ্যে একটি নামেমাত্র (Nominal) বিবাহ সম্পাদন করেন এবং এরূপে নির্দেশ দান করেন যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে তারা গোপনে মিলিত হবে না। ঘটনাটির আরও উল্লেখ করা হয় যে, জাফর এবং আব্বাসা গোপনে দেখা-সাক্ষাৎ করতে থাকেন এবং পরিশেষে আব্বাসা একটি অবৈধ সন্তান[১] প্রসব করলে তাকে মক্কায় প্রেরণ করা হয়। খলিফা হজ্ব উপলক্ষে এবং বিশেষ করে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মক্কা গমন করেন এবং তাঁর নির্দেশ অমান্য করবার জন্য ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে বার্মেকী বংশের ধ্বংস সাধনের পরিকল্পনা করেন। অপর একটি ঘটনায় জানা যায় যে, আব্বাসা অন্তঃসত্ত্বা হলে জাফরের সাথে তিনি বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু ঈর্ষান্বিত খলিফার দৃষ্টিতে রাজার আদেশ অমান্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমতুল্য ছিল।

[১. এস. এম. ইমামুদ্দিন, মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৩।]

সূক্ষ্ম ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যমূলক এবং বিভ্রান্তিকর। ইবনে খালদুন এতে কোনরূপ গুরুত্ব আরোপ না করে বলেন, “আল-আব্বাসার ধার্মিকতা, বংশকৌলীন্য এবং পদমর্যাদার সঙ্গে এই অপবাদ সামঞ্জস্যহীন।”

সপ্তমত, বার্মেকী বংশের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল হারুন-আর-রশীদের ঈর্ষা এবং সন্দেহপরায়নতা। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “তিনি সন্দেহের অন্ধরোষ ও একক শাসনজনিত ক্রোধবশে অবিরত অপবাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে বহু যুগের বিশ্বস্ত সেবার কথা ভুলে গেলেন।” সতের বছর যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এবং বিচক্ষণ শাসনকার্যে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য সুদৃঢ় হয়ে সভ্যতার উন্মেষ হয়, তাদের নির্মমভাবে হত্যা খলিফা হারুনের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছে। তিনি হঠাৎ এক রাত্রে জাফর বার্মাককে হত্যার আদেশ জারি করেন। মসরুর নামে যে অনুচর খলিফা এবং জাফরের সঙ্গে নৈশ ভ্রমণে বের হত, তার দ্বারা খলিফা জাফরের শিরশ্ছেদ করালেন। ঐতিহাসিকদের মতে, জাফরের ছিন্ন মস্তক এবং দ্বিখণ্ডিত দেহ বাগদাদের সেতুর উপর ঝুলিয়ে রাখা হয়। বৃদ্ধ ইয়াহইয়া, ফজল, মুসা ও মুহাম্মদকে রাক্কায় কারারুদ্ধ করা হয়। ৩০,৬৭৬,০০০ দিনার মূল্যের বার্মেকী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে অনুতপ্ত এবং মর্মাহত ইয়াহিয়া এবং ৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ফজল কারগারে প্রাণত্যাগ করেন। মুসা ও মুহম্মদ পরবর্তী খলিফার আমলে মুক্তি লাভ করেন। খলিফা মামুন বার্মকীদের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি তাদের ফিরিয়ে দেন। আমীর আলী বলেন, “এই ঘটনা হারুন-আর-রশীদের গৌরবোজ্জ্বল রাজত্বকালের জ্যোতিকেই শুধু ম্লান করে নি, বরং তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনকে অনুশোচনা ও কৃতঘ্নতাজনিত বিবেক দংশনে তমসাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।”

বিদ্রোহ দমন

হারুন-আর-রশীদের রাজত্বের শেষের দিকে সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে সমরকন্দে রাফির নেতৃত্বে এক আশ্চর্য ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয়। সমরকন্দের সম্পদশালিনী এক মহিলা তার স্বামীর সাথে বাগদাদে অবস্থানকালে রাফি-বিন-লাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে ইসলাম পরিত্যাগপূর্বক রাফির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। পূর্বোক্ত স্বামী এই সম্পর্কে খলিফার দরবারে নালিশ করলে খলিফা রাফিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু রাফি কৌশলে কারাগার হতে পালিয়ে গিয়ে সমরকন্দে উপস্থিত হন এবং সেখানকার শাসনকর্তাকে নিহত করে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে বলখের শাসনকর্তা আলী-ইবনে-ঈশা ভয়ে নিজের রাজ্য ছেড়ে পলায়ন করেন। ফলে, অক্সাস নদীর অপর তীরের সমগ্র এলাকাই বিদ্রোহী নেতার করতলগত হয়। খলিফা এই সংবাদে তাঁর যোগ্য সেনাপতি হারসামাকে এক বিরাট বাহিনীসহ সেখানে প্রেরণ করেন। হারসামা প্রথমেই আলীকে বন্দী করেন এবং তার সমস্ত ধন-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাক্কায় খলিফার দরবারে প্রেরণ করেন। অতঃপর হারসামা সমরকন্দে রাফির বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বৎসর অভিযান চালিয়ে সমরকন্দ পুনর্দখল করেন।

অন্যদিকে সমরকন্দে বিদ্রোহের সুযোগে খারিজিরা ৮০৮ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানে গোলযোগ শুরু করলে পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠে। খলিফা তাঁর পুত্র কাশেমকে রাক্কায় এবং আমীনকে বাগদাদে রেখে নিজেই বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হন। মামুন খলিফার স্বাস্থ্যের অবনতি লক্ষ করে অভিযানে পিতার সাথে রওয়ানা হন। পারস্যে প্রবেশ করেই হারুন সৈন্যবাহিনীর একাংশ নিয়ে মামুনকে দ্রুত মার্ভের দিকে পাঠিয়ে দেন এবং নিজে আস্তে আস্তে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু তুস নগরীর নিকট সানাবাদ (Sanabad) পল্লীতে পৌঁছতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জীবনের শেষ মনে করে পরিবারবর্গের সকলের নিকট সংবাদ প্রেরণ করেন। ৮০৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ২৩ বছর ৬ মাস গৌরবের সাথে রাজত্বের পর কেবল দুদিন অসুস্থ থেকে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হারুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

হারুনের চরিত্র

হিট্টি বলেন, “ইতিহাস এবং উপাখ্যান সম্মিলিতভাবে হারুন-আর-রশীদের খিলাফতে বাগদাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সূচনা করে।”

হারুন-আর-রশীদকে আরব্য উপন্যাস-খ্যাত পৃথিবীর অন্যতম সম্রাট বলে অভিহিত করা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে খলিফা হারুন ছিলেন ধর্মভীরু এবং দয়াশীল। ধর্মীয় বিধি- নিষেধগুলো তিনি পালন করতেন। প্রত্যহ নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ব্যতীত তিনি প্ৰতি রাত্রে একশত রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। তেইশ বছরের রাজত্বে তিনি নয়বার হজ্বব্রত পালন করেন এবং প্রতি বারেই একশত আলেমসহ যাতায়াতের সমস্ত খরচ বহন করতেন। হজগমনে অপারগ হলে তিনি তাঁর স্থলে কমপক্ষে তিনশত লোককে মক্কায় হজ্ব পালনের নিমিত্তে পাঠাতেন। নিষ্ঠা, সততা, ধর্মপরায়নতা এবং উদারতা তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। গিলমান বলেন, “হারুন নিজেও অত্যন্ত গোঁড়া ছিলেন এবং ধর্মীয় অনুশাসনগুলো পালনে যেরূপ যত্নবান ছিলেন সেরূপ লংঘন করতেও তিনি ইতস্তত করতেন না।” সুন্নী ইসলামের আমীর হিসেবে তিনি শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত বার্মেকীদের ধ্বংস করতে দ্বিধা করেন নি।

আব্বাসীয় বংশের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা বিধান করবার জন্য তিনি কখনও কখনও নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করলেও খলিফা হারুন প্রকৃত অর্থে প্রজাহিতৈষী এবং ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। পরম বিশ্বস্ত বার্মেকী পরিবারের প্রতি নিষ্ঠুরতা এবং নির্যাতন তাঁর চরিত্রে কালিমা লেপন করলেও বলা যেতে পারে যে, সাম্রাজ্য এবং ধর্মের নিরাপত্তার জন্য ক্ষমতালোভী বার্মেকীদের তিনি নির্মূল করেন। তাঁর বদান্যতার সীমা ছিল না। আরব্য উপন্যাসে হারুনের দানশীলতা এবং প্রজাবাৎসল্যের অনেক কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য খলিফা হয়েও ছদ্মবেশে রাত্রিতে বাগদাদের পথে-প্রান্তরে ঘুরে লোকচক্ষুর অগোচরে প্রজাদের সুখ-দুঃখের সংবাদ নিতেন। ঐতিহাসিক তাবারীর মতে, “হারুন যাকাত ব্যতীত প্রতিদিন ১০০ দিরহাম দুঃস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হজ্ব যাত্রার সময় তিনি অনেক পরিবারের হজ্ব পালনের ব্যয় বহন করতেন।”

হারুন-অর-রশীদের চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। আমীর আলী বলেন, “তিনি ধর্মীয় কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান, মিতব্যয়ী, সাধুতা ও দানশীলতায় নিরহঙ্কার ছিলেন। রাজকীয় আড়ম্বর ও জাঁকজমকে পরিবেষ্টিত থাকবার অসাধারণ মোহ তাঁর ছিল এবং তিনি জনমনে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব দ্বারা সমাজে প্রভূত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন।” তিনি একদিকে যেমন ছিলেন বিজ্ঞ, দানবীর, মহানুভব, বিচক্ষণ এবং ন্যায়পরায়ণ, অপর দিকে ধৈর্যহীন, সন্দেহপ্রবণ এবং ঈর্ষাপরায়ণ। রাজোচিত গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও তাঁর চরিত্রে বংশানুক্রমিক সন্দেহ-প্রবণতা প্রকট ছিল। মনসুর ঈর্ষান্বিত ও সন্দেহজনকভাবে তাঁর চাচা আবদুল্লাহকে, শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্ম গুরু মোহাম্মদ এবং ইব্রাহিম এমনকি আব্বাসীয় সমর্থক আবু মুসলিমকে যেভাবে হত্যা করেন, ঠিক অনুরূপভাবে হারুন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসা-আল-কাজিম এবং বার্মেকী পরিবারের মূলোচ্ছেদ করেন। এই দুটি ঘটনা ব্যতীত হারুনের নিষ্ঠুরতার অপর কোন নজীর পাওয়া যায় না। আমীর আলী বলেন, “হারুন-আর-রশীদের চরিত্রে প্রধান দোষ ছিল তাঁর আকস্মিক সন্দেহপ্রবণতা এবং ধৈর্যহীনতা; এটি তাঁর স্বৈরতন্ত্রের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি ছিল।” হারুনকে ‘প্রাচ্যদেশীয় স্বৈরাচারী সম্রাট’ (Oriental despot) বলা যাবে না, কারণ তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য এবং সদগুণাবলি তাঁর দোষগুলোকে ঢাকা দিয়ে রেখেছে; অন্যথায় আব্বাসীয় সাম্রাজ্য একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করতে পারত না। মূইর বলেন, “আব্বাসীয় বংশের মধ্যে সম্ভবত হারুনই সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। আবু জাফরের মিতব্যয়িতা ব্যতীত হারুনের চরিত্রের সাথে তার সংযোগ ছিল।”

হারুনের কৃতিত্ব

হিট্টি বলেন, “নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশ্ব-পরিক্রমায় দু’জন নৃপতি ভাস্বর হয়ে রয়েছেন— পাশ্চাত্যে শার্লিমেন এবং প্রতীচ্যে হারুন-আর-রশীদ। উভয়ের মধ্যে নিঃসন্দেহে হারুন অধিকতর ক্ষমতাশীল এবং সংস্কৃতিবান ছিলেন।” হারুন আব্বাসীয় খিলাফতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিভাবান খলিফাই ছিলেন না বরং সমসাময়িক পৃথিবীর নৃপতিদের মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সমরকুশলী, প্রজারঞ্জক, বিদ্যোৎসাহী ও সুযোগ্য শাসক ছিলেন। আল-মনসুরের নগরী বাগদাদ হারুনের আমলে গৌরবের স্বর্ণশিখরে উপনীত হন।

সমরকুশলী : মূইর বলেন, “কোন খলিফাই হারুনের পূর্বে অথবা পরে হজ্বব্রত পালন, শাসনব্যবস্থা অথবা যুদ্ধাভিযান প্রভৃতি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে এত উদ্যমশীলতা ও কর্মতৎপরতা প্রকাশ করতে পারেন নি।” পিতা আল-মাহ্দীর খিলাফতে হারুন বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে তাদের সমুচিত শিক্ষা দেন। ক্ষমতালাভ করে তিনি অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা দূর করবার জন্য কখনও কখনও স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করতেন এবং অসামান্য দক্ষতা, রণকুশলতা, তেজস্বিতা ও নির্ভীকতার দ্বারা শত্রুদের দমন করেন এবং বিশাল সাম্রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা কায়েম করেন। আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, মসুল, এশিয়া মাইনরে বিদ্রোহাগ্নি প্রজ্বলিত হলে হারুন কঠোর হস্তে তা দমন করেন। এমনকি মৃত্যুকালেও তিনি খোরাসানে বিদ্রোহের মূলোৎপাটনে ব্যস্ত ছিলেন এবং তুসে প্রাণত্যাগ করেন। হারুনের অভ্যন্তরীণ নীতির প্রধান মূলমন্ত্র ছিল বিদ্রোহের উৎসগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সাম্রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করা। রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপকে নিশ্চিহ্ন করবার উদ্দেশ্যে মুসা-ইবন-কাজিমকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং কারাগারে তাঁর মৃত্যুতে আব্বাসীয় খিলাফতের একজন শক্তিশালী শিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী অপসারিত হয়।

বায়জানটাইনদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে হারুন-আর-রশীদ একটি বলিষ্ঠ ও ন্যায়সঙ্গত বৈদেশিক নীতির প্রবর্তন করেন। মুসলিম সার্বভৌমত্বের হুমকিস্বরূপ মনে করে তিনি বিশ্বাসঘাকত বায়জানটাইন সম্রাট নাইসিফোরাসকে সমুচিত শিক্ষাদানের জন্য একটি সুশৃঙ্খল এবং বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। যুবরাজ হিসেবে তিনি সম্রাজ্ঞী আইরীনের বিরুদ্ধে অভিযান করে কনস্টান্টিনোপল অবরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁর বীরত্বে এবং রণনৈপুণ্যে প্রীত হয়ে আল-মাহদী পুত্র হারুনকে “আর-রশীদ” অথবা ন্যায়নিষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন। সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি তিন বার কৃতঘ্ন নাইসিফোরাসকে পরাজিত, বশ্যতা স্বীকার ও কর প্রদানে বাধ্য করেন; কিন্তু তাঁর মহানুভবতার সুযোগ গ্রহণ করে প্রতিবারেই বায়জানটাইন সম্রাট সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করেন। ঐতিহাসিক গীবন ও বিশ্বাসঘাকতার জন্য নাইসিফোরাসের নিন্দা করেন এবং বলেন যে, রণক্ষেত্রে ৪০ হাজার সৈন্যকে ফেলে তিন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত বায়জানটাইন সম্রাট পলায়ন করেন। আমীর আলীর মতে, নাইসিফোরাসের প্রতি উদারতা প্রকাশ করে হারুন অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন। বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য তিনি সীমান্তের দুর্গগুলোকে সুরক্ষিত করে সৈন্য সমাবেশের ব্যবস্থা করেন। সৈন্যবাহিনীর নৈতিক ও শারীরিক উন্নতি বিধানের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।

সংগঠক : একথা অনস্বীকার্য যে, হারুন-আর-রশীদের উদার এবং প্রজামঙ্গলকর শাসন-ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যের সার্বিক উন্নতি সাধিত হয়। শাসন-ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার গুরুদায়িত্ব যোগ্যতা এবং মর্যাদার সঙ্গে পালনের ভার পারস্যের শিয়া মতাবলম্বী বার্মেকী পরিবারের উপর ন্যস্ত ছিল। তাঁর তেইশ বছরের রাজত্বে বার্মেকী বংশ সতের বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে সাম্রাজ্যের সুখ ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করে কৃষ্টি ও সভ্যতা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। বার্মেকীদের পারস্য প্রভাব হারুনের রাজত্বে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিরস্ত্রাণ, প্রধানমন্ত্রী (Vizier), হাজীব (Chamberlain), বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠান পারস্য দেশ হতে অনুকরণ করা হয়। শাসনব্যবস্থা পুনর্বিনাসের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শে বিভিন্ন প্রদেশে সুষ্ঠু কর্মচারী নিয়োগ এবং প্রতিটি কার্যের পর্যবেক্ষণ হত। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে অবলোকন করবার জন্য হারুন রাত্রিতে ছদ্মবেশে শহর পরিভ্রমণ করতেন। জনসাধারন, তীর্থযাত্রী এবং ব্যবসায়ীদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। মূলার বলেন, “পারস্য প্রথার ভিত্তিতে পৃথক বিভাগ (দিওয়ান), বিশেষভাবে সৈন্যবাহিনী, রাজস্ব এবং আয়কর, ডাক এবং প্রদেশসমূহ নিয়ে একটি সুপরিকল্পিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং নবম ও দশম শতাব্দীতে এটি ক্রশম সম্প্রসারিত হতে থাকে।” বায়জানটাইনদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ নির্মূল করবার জন্য হারুন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জোসেফ হেল বলেন, “হারুন-আর-রশীদের আমলে সম্পূর্ণরূপে সামরিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে একটি সীমান্ত প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়; বাসগৃহ এবং ঘাঁটিতে স্থায়ী ছাউনী নির্মিত হয়। তাঁর এবং তাঁর উত্তরাধিকারীদের সময়ে সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়, যার ফলে ক্রমাগত যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং জনমানবশূন্য এলাকাগুলো নতুন জীবন এবং উদ্দীপনায় মুখর হয়ে উঠে।”

প্রজারঞ্জক, জনদরদী এবং মহানুভব খলিফা হিসেবে হারুন-আর-রশীদ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। হারুনের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী জুবাইদা হজ্বব্রত পালনে মক্কায় আগত মুসলমানদের পানীয় কষ্ট দূর করবার জন্য ১ লক্ষ দিনার ব্যয়ে পঁচিশ মাইল দূর থেকে একটি খাল খনন করে পবিত্র নগরীতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এই খাল ‘নহর-ই-জুবাইদা’ নামে প্রসিদ্ধ। এটি নিঃসন্দেহে সম্রাজ্ঞী জুবাইদার ধর্মনিষ্ঠার পরিচায়ক। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট, সেতু, এতিমখানা, সরাইখানা প্রভৃতি নির্মাণ করে তিনি জনসাধারণের অশেষ কল্যাণ সাধন করেন। তাঁর প্রজাবাৎসল্যের অপূর্ব নিদর্শন ছিল ‘বিমারিস্তান’ অর্থাৎ হাসপাতাল। হিট্টির মতে, “খলিফা হারুনই সর্বপ্রথম জনসাধারনের সুচিকিৎসার জন্য বিমারিস্তান নির্মাণ করেন।” পরবর্তীকালে সমগ্র রাজ্যে কমপক্ষে ৩৪টি হাসপাতাল গড়ে উঠে। এছাড়া দাতব্য চিকিৎসালয় এবং বিশেষ রোগের জন্য ভিন্নতর হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়। আল-মাহদীর প্রবর্তিত জনসাধারণের অভিযোগ দূরীকরণ-বিভাগ (নজর-আল- মজলিস) হারুনের সময়ে সম্প্রসারিত হয়। এই বিভাগ জনসাধারণের দুঃখ-কষ্ট দূর করবার কাজে নিয়োজিত ছিল। হিট্টি বলেন, “ডি লেসেপের এক হাজার বছর পূর্বে হারুন নামে একজন আরব খলিফা সুয়েজের অন্তরীপ দিয়ে একটি খাল খননের পরিকল্পনা করেন।” গরীব-দুঃখীদের দুর্দশা লাঘবের জন্য নিয়মিত ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি হতে থাকে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের ফলে সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইবনে খালদুন বলেন, “রশীদ মিতব্যয়িতা ছাড়া অপর সকল বিষয়ে তাঁর পিতামহের পদক্ষেপ অনুসরণ করেন; কারণ দানশীলতা এবং মহানুভবতায় অপর কোন খলিফা তাঁকে অতিক্রম করতে পারেনি।”

কূটনীতিবিদ : আব্বাসীয় খলিফা হারুনের গৌরবোজ্জ্বল রাজত্ব ইসলামের ইতিহাসে একটি রোমাঞ্জকর অধ্যায় বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর সুনাম, সুখ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি তৎকালীন বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বহু রাজ্যের সাথে খলিফা হারুন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলিম খলিফা যিনি চীনের সম্রাট ফাগফুর (Faghfur) প্রেরিত রাষ্ট্রদূতকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে হারুন যে দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেন নবম শতাব্দীতে তা সত্যই বিরল ছিল। চীন এবং ভারতবর্ষ হতে কূটনৈতিক এবং উপঢৌকন আদান-প্রদানের মাধ্যমে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এর ফলে আব্বাসীয়দের গৌরব বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্সের নৃপতি শার্লিমেন (Charlemagne) এবং হারুনের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের মূলে বিশেষ একটি কূটনৈতিক কারণ ছিল। বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে হারুনকে মিত্র হিসেবে লাভ করবার জন্য শার্লিমেন যেরূপ ব্যগ্র ছিলেন, স্পেনের নব-প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া রাজত্বের বিরুদ্ধে শার্লিমেনকে মিত্র হিসেবে পাবার জন্য হারুনও তদ্রূপ উদগ্রীব ছিলেন। হিট্টি বলেন, “এই দুজনের মধ্যে নিঃসন্দেহে হারুন অধিকতর ক্ষমতাশালী এবং সংস্কৃতমনা ছিলেন। হারুন এবং শার্লিমেন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাষ্ট্রদূত এবং উপঢৌকন আদান-প্রদান করেন। হারুন অথবা এরন (Aaron) শার্লিমেনের নিকট যে সমস্ত মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদ, সুগন্ধিদ্রব্য এবং একটি জল-ঘড়ি (Water clock)। “ খলিফা হারুনের রাজত্বের ৭৯৭ হতে ৮০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে রাষ্ট্রদূত এবং উপঢৌকন আদান-প্রদান হতে থাকে।

বাগদাদের প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য

আব্বাসীয় খলিফা হারুন রূপকথার রাজকুমারের ন্যায় খ্যাতি অর্জন করেন এবং ঐশ্বর্য, বৈভব, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য এবং সুষমামণ্ডিত বাগদাদ নগরী সত্যই তাঁর আমলে একটি স্বপ্নপুরীতে পরিণত হয়। খতিব যথার্থই বলেন, “সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের দিক দিয়ে সমগ্র বিশ্বে এই নগরীর জুড়ি ছিল না।” (“A city with no pair throughout the whole world”)। আল-মনসুর প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ নগরী হারুনের রাজত্বে আরব্যোপন্যাসের খ্যাতি অর্জন করে। আল-মনসুরের গোলাকৃতি বাগদাদ শহরের এক-তৃতীয়াংশে সুরম্য রাজপ্রাসাদ, সুসজ্জিত হারেম, জাঁকজমকপূর্ণ দরবার, নয়নাভিরাম মিলনায়তন এবং আমীর-উমরাহদের প্রাসাদোপম হর্ম্যরাজি সত্যই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্যের নিকট প্রাচ্যের জাঁকজমক (Oriental splendour) বলতে যা বুঝাত তার সূচনা হয় খলিফা হারুনের রোমাঞ্জকর রাজত্বকালে। সম্রাজ্ঞী জুবাইদা খুবই সৌখিন ছিলেন; রত্নখচিত স্বর্ণ অথবা রৌপ্যনির্মিত পাত্র ব্যতীত তিনি তৈজসপত্র ব্যবহার করতেন না। রত্নখচিত জুতার ব্যবহার তিনিই প্রচলন করেন। কপালের দাগ ঢাকবার জন্য হারুনের ভগ্নী প্রথম যে রত্নখচিত স্বর্ণনির্মিত টায়রা ব্যবহার করতেন তা পরবর্তীকালে পৃথিবীতে একটি সৌখিন অলঙ্কারের মর্যাদা লাভ করে। রাষ্ট্রীয় উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হত; যেমন- খলিফার অভিষেক, রাজকুমারের বিবাহ, বৈদেশিক রাষ্ট্রদূতের আগমন ইত্যাদি। ৮২৫ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ মামুনের সঙ্গে আল-হাসান ইবন-সহলের অষ্টাদশবর্ষীয়া কন্যা বুরানের বিবাহে এরূপ অর্থ ব্যয় করা হয় যে, আরবি সাহিত্যে একে সর্বপ্রথম জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব বলে বর্ণনা করা হয়। রাজপ্রাসাদ ব্যতীত হারুনের সহচর এবং প্রধানমন্ত্রী জাফর ইউফ্রেটিসের পূর্ব তীরে ‘আল-জাফর’ নামে একটি সুষমামণ্ডিত প্রাসাদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে একে কেন্দ্র করে বাগদাদে সুদৃশ্য এবং জাঁকজমকপূর্ণ হর্ম্যরাজি নির্মিত হয়। জাফরও অত্যন্ত সৌখিন ছিলেন এবং শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত তিনি নানা ধরনের পোশাক-পরিচ্ছেদের প্রচলন করেন। আব্বাসীয় খলিফা হারুনের ঐশ্বর্যপূর্ণ রাজ্যের বিশেষ কিছু নজীর পাওয়া যায় রাজপরিবার এবং সভাসদদের অতুলনীয় বৈভব এবং আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রায়। বার্মেকীদের বাজেয়াপ্তকৃত সম্পত্তির মূল্য ছিল ৩ কোটি ৬ লক্ষ ৭৬ হাজার দিনার। হারুনের মাতা খায়যুরানের ব্যক্তিগত আয় ছিল বাৎসরিক ১৬ কোটি দিরহাম।

বিজ্ঞান ও সাহিত্যের উৎকর্ষ

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হারুন-আর-রশীদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর বিদ্যোৎসাহিত্য শুধু আব্বাসীয় যুগের নয় সমগ্র ইসলামের ইতিহাসে সভ্যতার একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। মার্জিত এবং রুচিসম্মত খলিফার অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসাবিদ্যা, সঙ্গীত, জ্যোতির্বিদ্যা, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-স্থাপত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানগণ অসামান্য অবদান রেখে যেতে সক্ষম হয়। গ্রুনিবাম বলেন, “মুসলিম সম্প্রদায়ের স্মৃতিতে হারুন-আর-রশীদের শাসনকালকে “খিলাফতের স্বর্ণযুগ’ বলা যেতে পারে।”

স্পুলার বলেন, “শিয়া-সম্প্রদায়ের পরিবর্তে তারাই (আব্বাসীয়গণ) রাসূলের প্রকৃত হাদিস সংরক্ষণে পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং তারা মুসলিম সমাজের রীতি-নীতিকে (যা আমল-আল-সুন্নী-ওয়াল-জা’মা অথবা সুন্নী নামে পরিচিত) ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেন।” উমাইয়া খলিফাগণ পার্থিব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন কিন্তু আব্বাসীয়গণ মুসলিম সম্প্রদায়কে ধর্মীয় এবং পার্থিব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান করেন। হারুন-আর-রশীদের রাজত্বে সুন্নী হানাফী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। আমীর আলী বলেন, “তাঁর (হারুন) আমলে সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারক আবু ইউসুফের নেতৃত্বে একদল আইনজ্ঞ হানাফী স্কুলকে সুষ্ঠু এবং সুসংহত রূপদান করেন।” হারুনের ধর্মপরায়ণতার জন্য মুসলিম ধর্মতত্ত্বের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। ধর্মতত্ত্বে যাঁরা অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মুসা আল-কাজিম, ইমাম আবু-ইউসুফ, হাম্মাদ ও সুফিয়ান-ইবন-উবাইনা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। হারুনের রাজত্বে হাদিসের উৎকর্ষ সাধিত হয়। ইমাম বুখারী বিখ্যাত মোহাদ্দিস ছিলেন। হাদিস চর্চা, সুন্নী ইসলামের উৎকর্ষ বিধান এবং হানাফী স্কুলের সংগঠন তাঁর খিলাফতের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।

বহু কবি, সাহিত্যিক, হাস্যরসিক, ব্যাকরণবিদ এবং আলেম ও ফকিহ হারুনের রাজদরবারকে অলঙ্কৃত করেন। খলিফাও স্বনামধন্য কবি ছিলেন এবং হিরাক্লিয়া হতে আনীত হেলেন নামক রোমান ধর্মযাজকের এক কন্যাকে তিনি প্রেম নিবেদন করে কবিতা রচনা করেন। হারুনের দরবারে সভাকবি এবং খলিফার পার্শ্বচর ছিলেন আবু-নুওয়াস (Abu Nuwas)। পারস্য গজলের অনুকরণে তাঁর গজলগুলো তাঁর কাব্য প্রতিভার সাক্ষ্য দান করে। হিট্টি তাঁকে “মুসলিম জগতের গীতি এবং সুর-সংক্রান্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি” বলে অভিহিত করেন। আবু-নুওয়াস জাগতিক বিষয়ের কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন ‘আর আবু-আল-আতাহিয়া’ (Abu-al-Atahiya) ধর্মীয় এবং অজাগতিক বিষয়ে তাঁর লেখনী ধাবিত করেন। অপরাপর কবির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মুসলিম-বিন- ওয়ালিদ যার স্তুতিবাদ সর্বজনবিদিত ছিল। খলিফা একদা তাঁর উদ্দেশ্যে রচিত একটি কাসিদার ( Sonnet) জন্য মারওয়ান ইবন আবি হাফসাকে ৫,০০০ দিনার খিলাত, একটি সুশ্রী ঘোড়া এবং দশটি গ্রীক ক্রীতদাস প্রদান করেন।

হারুন-আর-রশীদকে যথার্থই আরব্যোপন্যাসখ্যাত ইসলামের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর ব্যক্তিত্ব (Romantic personality) বলা হয়ে থাকে। বাগদাদ ব্যতীত হারুন যেমন অসম্পূর্ণ এবং অনাড়ম্বর থাকত, হারুন ব্যতীত আরব্যোপন্যাসও তেমনি অসম্পূর্ণ এবং অজ্ঞাত খাকত। আরব্যোপন্যাস বা এক সহস্র এবং এক রজনীর (Alf- Laylah-wa-Laylah) কাহিনী ‘সহস্র রাত্রি’ (Hazar Afsana) নামক একটি প্রাচীন পারস্য পুস্তকের উপর ভিত্তি করে লিখিত হয় এবং পরবর্তীকালে এতে গ্রীক, ভারতীয়, হিব্রু এবং মিসরীয় উৎস হতে বিভিন্ন উপাদান সংমিশ্রিত হয়। অরব্যোপন্যাসে হারুনের বিভিন্ন নৈশ অভিযানের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। স্পুলার বলেন, “এক সহস্র এক রজনী নামে আরব, পারস্য এবং ভারতীয় উপাখ্যান সম্বলিত কাহিনীর তিনিই অন্যতম প্রধান উপলক্ষ ছিলেন, যা তাঁর আমলে সংগৃহীত হতে থাকে এবং যা মিশরে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে সম্পূর্ণরূপে সংকলিত হয়নি।” গীবনের মতে, “আরব্যোপন্যাস ব্যতীত ‘রবিনসন ক্রুসো’ এবং সম্ভবত ‘গ্যালিভারের ভ্রমণকাহিনী’ রচিত হত না।”

হিট্টি বলেন, “এই যুগ পৃথিবীর ইতিহাসকে যে কারণে গৌরবোজ্জ্বল করেছে, তা হচ্ছে এই যে, এই আমলে ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বাপেক্ষা অধিক উৎকর্ষ সাধিত হয়।” যে সমস্ত বৈদেশিক প্রভাবের ফলে মুসলিম সভ্যতার উন্মেষ হয় তার মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভারতীয়, পারস্য, হেলেনীক-সিরীয় প্রভাব। খলিফা আল- মনসুরের রাজত্বে গ্রীক ও সংস্কৃত পুস্তক হতে আরবি ভাষায় অনুবাদের প্রচলন হয় এবং হারুনের সময়ে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারতায় সহায়ক হয়। ইসলামের প্রথম জ্যোতির্বিদ আল-ফাজারী মনসুরের আমলে সংস্কৃত পুস্তক ‘সিদ্ধান্ত’ অনুবাদ করেন। হারুনের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্যোতির্বিদ্যার উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাঁর প্রধান গ্রন্থগারিক আল-ফজল-ইবন-নওবক্ত ( Al-Fazl Ibn Nawbakht) জ্যোতিয়শাস্ত্রের উপর লিখিত কতিপয় পারস্য পুস্তক আরবিতে অনুবাদ করেন। হারুনের রাজত্বে গুরুত্বপূর্ণ আরবি ভাষায় অনুবাদ ছিল, ইউক্লিডের এলিমেন্ট (Ecuclid’s Element) এবং টলেমীর আল-মাজেস্ট (Al-Magest); আল-হাজ্জাজ-ইবন-ইউসুফ- আল-মাতার এই দুরূহ কার্য সমাধা করেন। অঙ্ক ও জ্যোতিষশাস্ত্রে বিভিন্ন পুস্তক অনুবাদের সাথে সাথে চিকিৎসা বিদ্যায়ও উৎকর্ষ সাধিত হতে থাকে। ইউহান্না-ইবন-মাসাওয়া (Yuhanna-Ibn-Masawayh), আনসিরা (Ancyra) এবং আমেরিয়াম (Amorium) হতে সংগৃহীত চিকিৎসাশাস্ত্রে লিখিত কতিপয় গ্রীক পুস্তক আরবিতে অনুবাদ করেন। হারুন মানকা নামক একজন ভারতীয় চিকিৎসককে বাগদাদে আমন্ত্রণ করেন। বাৰ্মেকী বংশ হারুনের রাজত্বে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে এবং আল-জাফরী প্রাসাদে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু অনারব পুস্তক আরবি ভাষায় অনুদিত হয়।

আব্বাসীয় আমলে চিকিৎসাবিদ্যার যথেষ্ট চর্চা ছিল। জনসেবার জন্য খলিফা হারুনের সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল নির্মিত হয়। ইবন-বক্‌ক্তিয়াশুকে (Ibn Bakhtiashu) জুন্দি শাহপুর হতে মনসুর নিজের চিকিৎসার জন্য বাগদাদে আনয়ন করেন এবং তাঁর পরিবার সাত পুরুষ ধরে (Seventh generation) খলিফাদের বিশিষ্ট চিকিৎসকরূপে সমাদৃত ছিলেন। হারুনের নির্মিত বাগদাদের হাসপাতালের প্রধান ছিলেন জুরজী ইবন-বক্তিয়াশু। বক্তিয়াশুর পুত্র জিব্রিল একজন ক্রিমিরোগগ্রন্থ ক্রীতদাসকে প্রকাশ্যে নগ্ন করে তাকে রোগমুক্ত করলে খলিফা তাঁকে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিযুক্ত করেন। নেস্টোরিয়ান বতিয়াও পরিবারের সাহায্যে আরব চিকিৎসাশাস্ত্রে গ্রীক প্রভাব অনুপ্রবেশ করে।

বলা বাহুল্য যে, আরব্যোপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক হারুন-আর-রশীদ সঙ্গীত ও নৃত্যের সমাদর করতেন। সঙ্গীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ভাঁড় চাটুকার, হাস্যরাসক (buffon ) তাঁর দরবারে উপযুক্ত সম্মান পেত। হারুন-আর-রশীদের মার্জিত এবং জাঁকজমকপূর্ণ দরবারে সঙ্গীতের চর্চা করা হত। অসংখ্য বেতনভোগী গায়ক ও গায়িকা সেখানে সঙ্গীতের চর্চা করতেন এবং খলিফার মনোরঞ্জন করতেন। ফারমার বলেন, “আরবদের নিকট সঙ্গীত বলতে যা বুঝাত তা ‘এক সহস্র এক রজনীর’ কাহিনীতেই প্রকাশ পেত। হারুনের দরবারে সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ইব্রাহিম আল-মাওসিলি (Ibrahim-al- Mawsilli) এবং খলিফা তাঁর সঙ্গীত সাধনায় এরূপ মুগ্ধ হন যে, তাঁকে ১৫,০০০ দিরহাম পুরস্কার ব্যতীত প্রতি মাসে নিয়মিত ১০,০০০ দিরহাম ভাতা প্রদান করতেন। অপর একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ইব্রাহিমের ছাত্র মুখারিক (Mukhariq)। কথিত আছে যে, একদা খলিফার সঙ্গে টাইগ্রীস নদীতে বিহারকালে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকলে নদীর পাড়ে মশাল হাতে করে বহু সঙ্গীতানুরাগীর আবির্ভাব হয়।

শিক্ষাদীক্ষা সম্প্রসারণের জন্য হারুন বিভিন্ন মাদ্রাসা ও স্কুল স্থাপন করেন। খলিফা তাঁর পুত্রদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্য প্রখ্যাত ব্যাকরণবিদ আসমাকে (Asma) নিযুক্ত করেন। প্রধান বিচারক আবু ইউসুফ ‘কিতাব-উল-খারাজ’ নামে রাজস্ব-ব্যবস্থার উপর একটি মনোজ্ঞ পুস্তক রচনা করেন। হারুন মনীষীদের সঙ্গ সর্বদা পছন্দ করতেন। ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের অন্যতম ছিলেন সুফিয়ান-আল-সওরী (Sufyan- al-Thauri), ধর্মপ্রাণ ফোজায়েল-ইবন-আয়য়াদ (Fudayl-ibn- Ayyad) এবং ইবন সারমাক (Ibn-Sarmak)। সমরাভিযানকালে খলিফা প্রাচীন সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উপর বহু পুস্তক সংগ্রহ করেন। হারুন শার্লিমেনকে যে জল-ঘড়ি (Water clock) উপহার দেন তা মুসলিম কারুকার্যের সাক্ষ্য বহন করে। শিল্প এবং স্থাপত্যে হারুনের বিশেষ অবদান ছিল। গোলাকৃতি বাগদাদ নগরীর অভ্যন্তরে মনসুর কর্তৃক নির্মিত মসজিদটি পোড়া ইট ও জিপসাম দ্বারা ৮০৮-৮০৯ খ্রিস্টাব্দে পুনঃনির্মিত হয়। বাগদাদের পরিবর্তে হারুন ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ হতে মনসুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাক্কার প্রাসাদ-দুর্গে বসবাস করতে থাকেন এবং পারস্য-স্থাপতের ছাপযুক্ত প্রখ্যাত কারুকার্যখচিত বাগদাদ ফটক নির্মাণ করেন। কৌণিক খিলানসম্বলিত রামলার জলাধার (Cistern of Ramla) শিলালিপি অনুযায়ী হারুন কর্তৃক নির্মিত হয়।

হারুন-আর-রশীদের রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্য গৌরব এবং ক্ষমতার স্বর্ণশিখরে উনীত হয়। এরূপ সমৃদ্ধি, বৈভব, শৌর্যবীর্য, ঐশ্বর্য, কৃষ্টি ও সভ্যতার উন্মেষ ইতিপূর্বে পরিলক্ষিত হয় নি। হারুনের মৃত্যুর সময় তাঁর রাজকোষে কমপক্ষে এক কোটি দিনার সংরক্ষিত ছিল। সৈয়দ আমীর আলী যথার্থই বলেন, “ঐতিহাসিক সমালোচনার সূক্ষ্ম কষ্টিপাথরে যে-কোন দিক দিয়েই বিচার করা হউক না কেন, হারুন-আর-রশীদ সর্বকালে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি এবং শাসকগণের অন্যতম বলে মর্যাদা লাভ করবেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *