প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

প্রথম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট

হযরত মুহাম্মদের (স) আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট

এ অধ্যায়ে আরব পটভূমির সেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর অধিক দৃষ্টিপাত করা হয়েছে যাতে তাঁর জীবনী ও কৃতিত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়। এই মূল্যায়ন অন্যান্য লেখক-ঐতিহাসিকদের রচনার ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, যারা মূলত প্রাচ্য ভাষাবিদ ও পর্যটক; তাদের সকলের প্রতি কৃতিজ্ঞতা স্বীকার করা সম্ভব নয়!

১. অর্থনৈতিক ভিত্তি

কোন পশ্চিমাদেশের লোকের কাছে আরবদেশি মরুভূমি এবং বেদুঈনদের বাসভূমি। মরুভূমিতে বসবাসকারী লোকদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুবই চমকপ্রদ। এ কথা সত্য যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর একেশ্বরবাদের ক্রমবিকাশে মরুভূমি কোন সৃজনশীল ভূমিকা রাখতে পারে নি। তবুও সামগ্রিকভাবে বিচার করলে মরুভূমি ইসলামের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বলতে গেলে বিশাল মরু-সমুদ্র অথবা তৃণভূমিতে মক্কা ও মদিনা যেন দুটি দ্বীপ। এর ফলে যাযাবরদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে শহরবাসীদের অবশ্যই যোগসূত্র ছিল। শহরে বসবাসকারীরা পূর্বে যাযাবর ছিল এবং তাদের বংশধরেরা মরুভূমিতে বসবাসকারী যাযাবরদের আচার-ব্যবহার সংরক্ষণ করেছিল। এর ফলে শহরবাসী আরবদের সাথে মরুবাসী যাযাবরদের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকবে তা বলাই বাহুল্য।

যাযাবর জীবনের সাথে পশু উৎপাদন ও পালন, বিশেষ করে উট অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আরবদেশের তৃণভূমি বিভিন্ন ধরনের ছিল। এর মধ্যে দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি, সে সমস্ত জমি যা গ্রীষ্মকালে শুষ্ক থাকে, বালুকাময় ধূ ধূ মরুভূমি কিন্তু শীতের মৌসুমে বৃষ্টি হলে যা আরবরা ‘রাবী’ বলে, কোন কোন নিম্নভূমিতে প্রাচর্যময় সবুজ ঘাস জন্মে। এই অঞ্চল উটের জন্য তখন হয়ে যায় স্বর্গ। এছাড়া এমন কতকগুলো অঞ্চল রয়েছে যেখানে সারা বছর কোন না কোন ধরনের গাছ ও গুল্মলতা জন্মায়, যা অধিকাংশই সুগন্ধিযুক্ত। এই দু ধরনের অঞ্চলের পরিবেশগত দিক থেকে যাযাবর জীবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যখনই প্রথম ধরনের অঞ্চলে সামান্য বৃষ্টিপাত হয় (যদিও বৃষ্টিপাত মাঝে মাঝে হয়) তখনই এখানকার জমিগুলো উটের জন্য চারণভূমিতে পরিণত হয়। কিন্তু গ্রীষ্মকাল শুরু হলে চারণক্ষেত্রগুলো শুকিয়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে পড়ে। তখন বাধ্য হয়ে যাযাবরেরা দ্বিতীয় ধরনের জমির দিকে চলে যায়। প্রথম ধরনের জমি বা মরুভূমিতে বসবাসকারী যাবাবরেরা খাদ্য ও পানীয়ের জন্য সম্পূর্ণরূপে উটের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় ধরনের জমিতে কুয়ো বা ওয়াদী থাকে, যা মানুষের পানির প্রয়োজন অপেক্ষা উটের পালের পানির প্রয়োজনীয়তা মিটায়। যাহোক, উটের দুধ এবং মরূদ্যান থেকে সংগৃহীত খেজুর প্রধান খাদ্যে পরিণত হয়। মাঝে মাঝে যাযাবর আরবগণ উট, ভেড়া বা দুম্বার মাংস খায়। অন্যান্য উপাদেয় খাদ্যশস্য ধনী ও বিত্তশালীদের জন্য।

মরুভূমিতে বসবাস করলেও যাযাবরেরা তাদের জীবিকার জন্য শহরবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। লুটতরাজ তাদের দৃষ্টিতে কোন অপরাধ নয়। এই লুটতরাজ মরূদ্যানে অথবা কাফেলায় হতে পারে। অতর্কিত আক্রমণ ও তস্কর বৃত্তিতে যেহেতু বেদুঈনগণ খুবই দক্ষ ছিল সেহেতু প্রায়ই দেখা যেত যে, কৃষিকর্মে এবং বাণিজ্যে নিয়োজিত লোকেরা মরুবাসী দুর্ধর্ষ ও লুণ্ঠনবৃত্তিতে পটু যাযাবর গোত্রদের নির্দিষ্ট হারে অর্থ দিত যাতে তাদের বাড়ি-ঘর, পশুপাল, জমিজমা এবং কাফেলা তাদের (যাযাবর গোত্রদের) আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। অনেক যাযাবর গোত্রের জন্য এ ধরনের অর্থ তাদের নিয়মিত আয়ের উৎস। এভাবে মরুভূমির যাযাবরেরা কৃষিনির্ভর সভ্যতার বহু উপাদান ভোগ করতে পারত।

মরূদ্যানে এবং পাহাড়ের কোন বিশেষ অংশে কৃষিকাজ হত। মরূদ্যানের প্রধান ফসল হচ্ছে খেজুর। আবার তায়েফের মত পাহাড়ী অঞ্চলে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হত। ইয়াসরিব, যা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময়ে মদিনা নামে পরিচিত ছিল, এক বিশাল এবং সমৃদ্ধশালী মরূদ্যান ছিল। এছাড়া কতিপয় ইহুদী কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল, যেমন খাইবার। অপরদিকে মক্কায় কোন কৃষিকাজ করা সম্ভব ছিল না (কারণ এটি ছিল পাহাড়ী অঞ্চল)। আমাদের এই তথ্যটি সবসময় মনে রাখতে হবে। যদিও বর্তমানের আলোচনায় আসে না, তবুও ইয়েমেন বা “সুখী আরব” (Arabia Felix) ছিল উর্বর কৃষিপ্রধান দেশ। সেখানে প্রাচীন কাল থেকে কৃত্রিম (বাঁধ) উপায়ে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়। এখন মনে করা হয়ে থাকে যে ইয়েমেন সেমিটিক জাতির আদি বাসস্থান ছিল। এ কারণে ইয়েমেনকে প্রথম আবাসভূমি অথবা ‘প্রথম পৃথক বাসস্থান’ বলা হয়ে থাকে। প্রাক-ইসলামী যুগের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ইতিহাস বা লোকগাথায় উত্তর আরবের সাথে উর্বর ও সমৃদ্ধশালী দক্ষিণ আরবের যে যোগাযোগ ছিল তার উল্লেখ আছে। এই যোগসূত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময়ে উদ্ভূত আরব সংস্কৃতির উন্মেষে নিঃসন্দেহে অবদান রেখেছিল। কিন্তু এই প্রভাবের পঠন-পাঠন আজ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয় নি।

অর্ধ শতাব্দী ধরে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মস্থান ছিল বাণিজ্যিক শহর, যা পাহাড়ী অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। এই শহরে নির্মিত একমাত্র মসজিদুল হারাম বা পবিত্র স্থানকে কেন্দ্র করে শহরটি গড়ে উঠে। আর কারণ এই যে, এটি ছিল রক্তপাত বা নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার নিরাপদ আশ্রয়। ভৌগোলিক দিক থেকেও শহরটি ছিল খুবই আদর্শ। এই শহরটি উত্তরে সিরিয়া থেকে দক্ষিণে ইয়েমেন এবং অন্যদিকে পশ্চিমে আবিসিনিয়া থেকে ইরাকের যাত্রাপথের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল। এ কারণে যাযাবরেরা কাফেলায় এ সমস্ত অঞ্চল থেকে মক্কায় আনা দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠনের জন্য আসত। প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কাবাসীগণ ব্যবসায়ী ছিল না। তারা ছিল মধ্যস্থতাকারী এবং খুচরা ব্যবসায়ী। তারা আমদানিকারক বা কাফেলায় ব্যবসায়ী ছিল না। কিন্তু খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দর মধ্যে ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত কাফেলায় ব্যবসা- বাণিজ্যের ওপর মক্কাবাসীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পথেই ভারতবর্ষের সৌখিন দ্রব্যাদি এবং দক্ষিণ আরবের সুগন্ধি মাল-মসলা পাশ্চাত্যে গিয়েছিল। তায়েফ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে মক্কার প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও, মক্কা তায়েফের চেয়ে অধিক সমৃদ্ধশালী ছিল।

মক্কা কেবলমাত্র একটি ব্যবসা কেন্দ্র ছিল না। পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান পাঠ হয়ে দাঁড়ায়। লামোর মত কতিপয় পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক মক্কার অর্থনীতি প্রসঙ্গে সন্দিহান হলেও এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মক্কায় বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকারের অর্থনৈতিক লেনদেন হত। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময়ে মক্কার অধিকাংশ অধিবাসী (নারী ও পুরুষ) ব্যবসায়ী ও অর্থলগ্নীকারক ছিল। মক্কার অধিবাসীগণ ক্রমশ লেনদেনের ক্ষেত্রে দক্ষ অর্থনীতিবিদদের সমতুল্য হয়ে উঠে। শুধু তাই নয়, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থ খাটানো প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তাঁরা কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেবলমাত্র ধনাঢ্য মক্কাবাসীরাই জড়িত ছিলেন না, পার্শ্ববর্তী গোত্রের অনেক অভিজাতবর্গও এতে অংশগ্রহণ করেন। কুরআন মরুভূমির পরিবেশের স্থলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমণ্ডলে আবির্ভূত হয়েছিল।

এ ছাড়া আর একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করা প্রয়োজন। হেজাজে নতুন ধর্মের আবির্ভাব এবং পরবর্তী পর্যায়ে পারস্য, সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় এর বিস্তারের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পরিবর্তন কি জড়িত? পণ্ডিতদের মতে, ইসলামের সম্প্রসারণের সাথে মরুভূমির অনুর্বরতা এবং দারিদ্র্য জড়িত। ক্ষণিকের জন্য আমরা অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা ভুলে থাকি। এক্ষেত্রে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, উল্লেখিত সময়ে (কুরআন অবতীর্ণ) মরুভূমি, তৃণভূমি ও মরূদ্যানে ভৌগোলিক অথবা আবহাওয়ার কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে। এসব অঞ্চলে জীবনযাত্রার মান ছিল সহনশীল পর্যায়ে। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুসারীগণ আরবদেশের বাইরে সমরাভিযান করে মরু অঞ্চলে বাস করতে ভালবাসতেন। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, পূর্বের তুলনায় যাযাবরেরা নেহায়েত খারাপ অবস্থায় ছিল না; বরং মক্কা ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হলে এর যে সমৃদ্ধি হয় তার ফলে যাযাবরেরা উপকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে আরবদেশ থেকে দলে দলে অধিবাসীগণ ইসলামের সামরিক অভিযানের সময় অন্য দেশে বসবাস শুরু করলে খাদ্যদ্রব্যের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমে যায়।

হেজাজে এ সময়ে ছোটখাটো কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উৎপাদন সামগ্রী যাযাবর এবং শহরবাসী আরবদের প্রয়োজন মিটায়। এমনকি, তায়েপে চামড়ার যে কারখানা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

২. মক্কার রাজনীতি

মক্কার বিত্তশালী বাণিজ্যিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সবসময় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল। এর ফলে, মক্কায় কয়েকটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। অর্থনৈতিক কারণে এ সকল সংস্থা সে সমস্ত আরব গোত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, যাদের সাথে মক্কার বাণিজ্যিক কাফেলা সংস্পর্শে আসে। এছাড়া, মক্কার রাজনৈতিক গোষ্ঠী সে সমস্ত শক্তিবর্গের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, যাদের বাজারে তারা কাফেলায় পণ্যদ্রব্য নিয়ে যেত। এ সমস্ত ঘটনা খুবই জটিল। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স) যেহেতু প্রথম থেকেই রাষ্ট্রনায়কের মতো আচরণ করছিলেন সেহেতু এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন।

(ক) কুরাইশদের রাজনৈতিক সংস্থাসমূহ

আরবী গ্রন্থাবলি থেকে কুরাইশ গোত্রের বিভিন্ন পরিবার এবং গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব ও কলহ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। পশ্চিমাদেশীয় লেখকগণ এ সমস্ত গোত্র-কলহ সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তি গল্প উল্লেখ করেন, যা অতিরঞ্জিত। তারা গোত্রকলহে অংশগ্রহণকারী চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব না গোত্রসমূহের শৌর্যবীর্য প্রকাশের একটি উপলক্ষ তা নিয়ে অধিক আলোচনা ব্যবস্থা রয়েছেন। কট্টর সমালোচকরা এ সম্পর্কে গুরুত্ব না দিলেও এ সমস্ত গোত্রীয় কলহ ও দ্বন্দ্বে ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে। কিন্তু এই গ্রন্থে এ দুরূহ সমস্যা আলোচনার কোন সুযোগ নেই। এ সমস্ত ঘটনা যে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় থেকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় তা হচ্ছে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময়ে কুরাইশদের মধ্যে পারিবারিক এবং গোত্রগত সম্পর্ক কেমন ছিল তা জানা। এই সম্পর্ক যে পরবর্তীকালে কত বিস্ময় ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় উমাইয়া গোত্রের সাথে আব্বাসীয় গোত্রের মধ্যে বৈরিতা। যাহোক, প্রাক-ইসলামী যুগের গোত্রীয় কলহ ও দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিকভাবে সত্য।

মক্কায় অবস্থিত পবিত্র স্থান বা দেবালয় খুবই প্রাচীন। এই পবিত্র স্থানটি বহু বছর যাবত বনু জুরহুম গোত্রের তত্ত্বাবধানে ছিল। এরপর এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে বনু খুজা। খুজা গোত্রের সাথে বনু বকর ইনব আবদ মানাত, ইবন কিনানা উপ- গোত্রের সম্পর্ক ছিল। খুজা গোত্র সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকলেও কিছু কিছু ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান, যেমন, “ইজাজা’ বনু সুফার সদস্যগণ পরিচালনা করত। কালক্রমে বনু খুজাও এর উপ-গোত্রীয়দের হাত থেকে মক্কার পবিত্র ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে কুসাই গোত্রের ওপর ন্যস্ত হয়। কুশাই একদিকে কিনানা ও কুদা গোত্রের সাথে এবং অন্যদিকে কুরাইশ গোত্রের কোন কোন উপ-দলের সাথে, যারা ঐক্যবদ্ধ বা প্রভাবশালী ছিল না, মৈত্রী স্থাপন করে ক্ষমতাসীন হন। মক্কায় প্রতিষ্ঠিত পবিত্র কা’বাগৃহও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহকে কেন্দ্র করে কুশাই বর্তমান মক্কা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।

কুশাই প্রথম কুরাইশ (যার অর্থ সওদাগর) আল-বিতর বা যারা পবিত্র কা’বাগৃহের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাস করে এবং কুরাইশ আল-জাওয়াহিরের বা যারা কা’বাগৃহের দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে, তাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেন। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এ ধরনের পার্থক্য ইসলামের পূর্বে ছিল এবং কুশাই কা’বাঘরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গৃহ নির্মাণ করে ‘কুরাইশ-আল-বিতর’-এর ভিত্তি স্থাপন করেন। কুশাই-এর বংশধরেরা এবং তার পর দাদা (কা’বের) বংশধরেরা ‘কুরাইশ-আল-বিতর’- এ বসবাস করতেন। আল-মাসূদী প্রদত্ত দুটি তালিকা নিচে দেওয়া হল :

‘কুরাইশ-আল-বিতা’-এর মধ্যে বিভেদ ও কোন্দল চরম আকারে দেখা দেয়। আবদ-আদ-দার কুশাই-এর উত্তরাধিকারী হলেও পরবর্তীকালে তার ভাই আবদ মান্নাফের পুত্র ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র আবদ শামসের সাথে কা’বাঘরের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ বাঁধে। এভাবে মক্কা নগরী বস্তুত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আবদ মান্নাফকে আসাদ, জুরা, তাইম এবং আল-হারিস বিন ফিহরের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র সমর্থন দেয়। অন্যদিকে, আবদ আদ-দারের সমর্থনে এগিয়ে আসে মাখজুম, সাহম, জুমা এবং আদি গোত্রসমূহ। ‘কুরাইশ আজ-জওয়াহির’ গোত্রভুক্ত আমির বিন লুয়াই এবং মুহারিব উপ- গোত্রদ্বয় নিরপেক্ষ ছিল্লুরাইশ বংশের এই দুই বিবদমান গোত্র যথাক্রমে ‘মুতাওয়াবুন’ এবং আহলাফ নামে পরিচিত ছিল (The Perfumed and the confederates )। এ কথা বলা প্রয়োজন যে, বংশগত দিক থেকে সব সময় গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় না, গোত্রের বাইরের সমমনা উপ-গোত্রও এক গোষ্ঠীতে যোগদান করতে পারে। কুশাই-এর পরিবার ও বিভক্ত কুশাই-এর তিনপুত্র আবদ-আদ-দার, আবদ-আল-উজ্জা (আসাদ) এবং আবদ মান্নাফ-এর মধ্যে সখ্যতা ছিল না। অনুরূপভাবে মুররাহ (কুশাই-এর দাদা)-এর পরিবার মাখজুম উপ-গোত্রের শত্রু ছিল। কুরাইশদের মধ্যে বিভেদ ও কোন্দল সংঘর্ষের পর্যায়ে পৌঁছার উপক্রম হয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে রক্তপাতের পূর্বে একটি সমঝোতা হয়। এর ফলে, আবদ আদ-দার মক্কা তথা কা’বা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের কিছু দায়িত্ব পেলেও আবদ মান্নাফের পুত্রগণ, বিশেষ করে আবদ শামস অধিক দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেন, যেমন- পানি সরবরাহ, খাজনা আদায় প্রভৃতি। দায়িত্ব ভাগাভাগির পর বিবদমান কুরাইশ গোত্র দুটি উপলব্ধি করে যে, সংঘাতের চেয়ে সমঝোতার দ্বারা অনেক কিছু পাওয়া যায়।

প্রাক-ইসলামী যুগে বিবদমান কুরাইশ গোত্রের মধ্যে সমঝোতা, সখ্যতা ও শান্তি বজায় রাখার জন্য ‘হিলফ-উল-ফুজুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এর শাব্দিক অর্থ “সাধু বা ধার্মিক ব্যক্তিদের সংঘ”। এটি মুতাওয়াবুনের (কুরাইশ আল-বিতাহ) দ্বারা গঠিত একটি সংঘ। ক্যাটানী এটিকে অন্যায় ও অপরাধ দমনের জন্য একটি সাধারণ সংস্থা বলেছেন, যা সঠিক নয়। আল-মাসুদীর মতে, বানু সাহমের আল-আস বিন ওয়াইলের কাছ থেকে একজন ইয়ামেনীর ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য হিলফ-উল-ফুজুল গঠিত হয়। এই সংঘে যারা যোগদান করে তারা হচ্ছে বনু হাশিম, বনু আল-মুত্তালিব, বনু আসাদ, বনু তাইম এবং সম্ভবত আল-হারিস বিন ফিহর গোত্র। এ সমস্ত গোত্র মুতাওয়াবুনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সংঘে বনু আবদ শামস এবং বনু নওফল যোগদান করেনি। কোন কারণে বনু নওফল এবং আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে। এই বিরোধে আল- মুত্তালিব আবদুল মুত্তালিব বিন হাসিমকে সমর্থন দেন। এর ফলে দেখা যায় যে, বনু আবদ শামস এবং বনু নওফল ‘হিলফ-উল-ফুজুল’-এর অন্তর্গত না হলেও তাঁরা হাশিম ও আল-মুত্তালিব অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী প্রমাণিত হয়। এটি ‘হিলফ-উল-ফুজুল’-এ মীমাংসার জন্য প্রেরিত একটি আপিলে প্রতীয়মান হয়, যা ইবন ইসহাক উল্লেখ করেন। উমাইয়া খলিফা মু’য়াবিয়ার খিলাফতে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও মদিনার গভর্নর আল-ওয়ালিদের সাথে হযরত আলীর পুত্র হোসেন (রা) (নবী করিমের (স) নাতি)-এর জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ বাধে। এই মীমাংসা আল-ওয়ালিদের স্বার্থে করা হলে হোসেন (রা) আপিল করেন। তখন ‘হিলফ-উল-ফুজুল’ এই মীমাংসার দায়িত্ব নেয় এবং হোসেন (রা)-কে আবদুল্লাহ ইবন আয-যুবাইর, আল-মিসওয়ার এবং আবদুর রহমান বিন ওসমান সমর্থন দেন। হিশাম, আসাদ, জুহরাহ এবং তাইম গোত্রের মিত্রতা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনায় আল-ওয়ালিদ তার দাবি ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে খলিফা আবদুল মালেকের, যিনি বনু উমাইয়া অথবা আবদ শামসের গোত্রভুক্ত ছিলেন, সাথে বনু নওফলের কথোপকথন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা ‘হিলফ-উল-ফুজুল’ নামের সংঘ অনেক আগেই পরিত্যাগ করেন।

গোত্র প্রধান আরব সমাজে গোত্রদের প্রাধান্য ছিল অপরিসীম এবং গোত্রদের সমর্থন এবং রাজনৈতিক ঐক্যজোটের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড জড়িত ছিল। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াতের সময়ে গোত্রদের মধ্যে নতুন জোটের সৃষ্টি হয়। এই রাজনৈতিক মেরুকরণ কতটুকু ইসলামের প্রভাবে হয়েছিল অথবা এতে মোটেই ইসলামের প্রভাব ছিল না, তা সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। তবে ধারণা করা হয় যে, এ সময়ে তিনটি রাজনৈতিক দল ছিল।

গ্রুপ ‘ক’ গ্রুপ ‘খ’ গ্রুপ ‘গ’
হাশিম
আল-মুত্তালিব
জুহরা
তাইম
আল-হারিস বিন ফিহর
আদি
আবদ শামস
নওফল
আসাদ
আমির
মাখজুম
সাহম
জুমা
আবদ আদ-দার

‘ক’ গ্রুপে ‘হিলফ-উল-ফুজুলে’র প্রাচীন সদস্যগণ ছিলেন : এই সংঘ থেকে ব আসাদ চলে যায় এবং আদি গোত্রে যোগদান করে। আদি গোত্র যা পূর্বে ‘গ’ গ্রুপে ছিল ‘ক’ গ্রুপে আসার অন্যতম কারণ এই যে, আদি গোত্রের সদস্য উমর বিন আল-খাত্তাবের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। অপর একটি কারণ হতে পারে যে, ‘খ’ গ্রুপের আবদ শামসের সাথে ‘গ’ গ্রুপের সদ্ভাব ও সখ্যতা। এক সময় আদি বংশের সাথে আবদ শামস বংশের তিক্ততা ও বৈরিতা ছিল। অবশ্য এই কোন্দল ও দ্বন্দের মূলে অর্থনৈতিক কারণ বিদ্যমান ছিল। ‘খ’ গ্রুপের সাথে ‘গ’ গ্রুপের সম্পর্ক নিবিড় ছিল এবং দুটি গোষ্ঠী একত্রে বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কাজ করত। আদ গোত্র ছেড়ে গেলেও ‘গ’ গ্রুপ পুরাতন আহনাফের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কুরাইশ বংশ

কুরাইশ বংশ

মক্কার অধিবাসীগণ যে বিভিন্ন গোত্রভুক্ত ছিল তার প্রমাণ এই যে, বদরের যুদ্ধে (খ্রিঃ ৬২৪) পৌত্তলিক কুরাইশগণ ‘খ’ ও ‘গ’ গ্রুপ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ‘ক’ গ্রুপের হাশিম গোত্রের আল-আব্বাস (নবী করিমের চাচা) এই যুদ্ধে যোগ দেন নি। এছাড়া তালিব বিন আবু তালিব গোত্রও এই যুদ্ধের বিরোধিতা করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। এছাড়া ‘ক’ গ্রুপের জুহরা এবং আদিও বদরের যুদ্ধে ইসলামের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করে নি। ‘ক’ গ্রুপের অন্যান্য সদস্যগণ পৌত্তলিক কুরাইশদের সমর্থন করেন নি। ‘ক’ গ্রুপের অন্যান্য সদস্যগণ পৌত্তলিক কুরাইশদের সমর্থন করেন নি। ‘ক’ গ্রুপের হাশিম গোত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও ‘খ’ গ্রুপের আমির নওফল এবং আসাদ গোত্রের সদস্যগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ‘গ’ গ্রুপের মাখযুম গোত্রের একজন সদস্য, যদিও তার মাতা বনু হাশিম (গ্রুপ ‘ক’) গোত্রের ছিলেন। বিদ্রোহ করে বদরের যুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। তায়েফ থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসার পর হযরত মুহাম্মদ (স) ‘খ’ গ্রুপের গোত্রদের, যেমন— জুহরা, আমির ও নওফল, সদস্যদের নিকট তার সাহায্য চান; ‘গ’ গ্রুপের নিকট তিনি সাহায্য চান নি। মাত্র দুজন ছাড়া যে সমস্ত মুসলমান আবিসিনীয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তারা হাশিম আল-মুত্তালিব জুহরা, তায়েম এবং আদি গোত্রের সদস্য ছিলেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গোত্রসমূহের মধ্যে কোন ঐক্য ও সমঝোতা ছিল না।

(খ) মক্কা নগরীর প্রশাসন ব্যবস্থা

মক্কার একমাত্র প্রতিষ্ঠিত সরকার ছিল সিনেট, যা ‘মালা’ নামে পরিচিত ছিল। এটি ছিল গোত্র প্রধান এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত একটি সভা। এ সভাটি পরামর্শ সভা হিসেবেই কাজ করত। এর কোন নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না। প্রত্যেক গোত্র ছিল স্বাধীন এবং গোত্র প্রধানের নেতৃত্বে গোত্রের কাজকর্ম পরিচালিত হত। এ কারণে গোত্র প্রধানদের সম্মিলিতভাবে গৃহীত (সর্বসম্মত) মত ‘মালার’ কার্যাদেশ হিসেবে গণ্য করা হত। বিদ্রোহী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীদের ক্ষেত্রে ‘মালা’ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। নবী করিম (স) ইসলাম প্রচার শুরু করলে মক্কার অভিজাতবর্গ ‘মালা’র মাধ্যমে বনু হাশিম এবং বনু আল-মুত্তালিবকে সমাজচ্যুত করে। এ পদক্ষেপ মূলত ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক, ধর্মীয় নয়।

মক্কার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘মালা’র প্রধান কার্যকারিতা ছিল সমমনা গোত্র প্রধানদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধী দলগুলোকে তাদের বিভেদ বা বৈষম্য পরিত্যাগে প্রভাবান্বিত করা। এভাবে ‘আহলাফ এবং মুতাওয়াবুন’ শ্রেণীর মধ্যে বিরোধ মিটানো হয় এবং বদরের যুদ্ধে নবী করিম (স)-এর বাহিনীর নিকট মক্কার পৌত্তলিকদের বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের পর পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করা হয়। ‘মালা’ ছিল প্রধান পরামর্শ সভা যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হত। এছাড়া, প্রত্যেক গোত্রের নিজস্ব পরামর্শ সভা ছিল যেখানে সমস্যাবলি সমাধানের জন্য আলোচনা হত। এ কারণেই আবু তালেব, (রাসূলের চাচা) হাশিম এবং আল-মুত্তালিব গোত্রদের হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নিরাপত্তা দানের জন্য আহ্বান জানাতে পেরেছিলেন।

বিভিন্ন আরবী গ্রন্থসূত্র থেকে জানা যায় যে, ‘মালা’র কতিপয় ঐতিহ্যবাহী দফতর ও কার্যপদ্ধতি ছিল। ‘মালা’র দফতরগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (ক) নাসী’ (সৌর ও চান্দ্র বৎসরের মধ্যে পঞ্জিকার সামঞ্জস্য বিধানের অধিকার; (খ) ‘সিকায়াহ’ (তীর্থযাত্রীদের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা); (গ) “রিফাদাহ’ (তীর্থ যাত্রীদের জন্য রসদ সংগ্রহকরণ); (ঘ) ‘লিওয়া’ (যুদ্ধের সময় পতাকা বহন)। এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখে এ কথা বলা যাবে না যে, ‘মালা’ একটি পৌরসভা ছিল : অন্তত গ্রিক এবং রোমানদের মত নাগরিক প্রশাসনে নিয়োজিত সংস্থার মত ‘মালা’ ছিল না। এ সমস্ত সংস্থা সমাজসেবামূলক মনে হলেও এগুলোকে অর্থকরী সংগঠন হিসেবেও গণ্য করা হতো। সিকায়াহের ক্ষেত্রে জমজমের পানি পান করার জন্য তীর্থযাত্রীদের একটি নির্দিষ্ট দাম দিতে হত। তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করা হত; কিন্তু কিভাবে কর আদায় করা হতো তা জানা যায় নি।

মক্কার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব নির্ভর করত দুটি বিষয়ের ওপর। প্রথমটি, তার গোত্র; দ্বিতীয়টি, তার ব্যক্তিগত যোগ্যতা। একটি গোত্রের ক্ষমতা ও প্রভাব নির্ভর করত সেই গোত্রের ধনসম্পদের ওপর। যদিও বাণিজ্যিক সম্প্রদায়ের সঠিক ধনসম্পদ সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয় (বিশেষ করে কাফেলা ভিত্তিক বহিঃবাণিজ্যের জন্য)। এর মুখ্য কারণ, ব্যবসার সাফল্য নির্ভর করত ব্যক্তিবিশেষ বা গোত্রের বাণিজ্যিক তৎপরতার ওপর। এ কারণে মুনাফা উঠানামা করত। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ব্যবসা বা ধনসম্পদ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূলধন হতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যিক সাফল্য নির্ভর করত ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত গুণাবলির ওপর। যেমন, তার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিচক্ষণতা, অন্যান্য উপজাতিদের সাথে তার কূটকৌশল, বৃহৎশক্তির (রাজ্য) প্রতিনিধিদের সাথে তার সুসম্পর্ক এবং সবশেষে তার নিজের গোত্রে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়তের সময় মক্কার রাজনীতিতে উমাইয়া গোত্রের দলপতি আবু সুফিয়ানের প্রভাব ও প্রতিপত্তির মূল কারণ এটি ছিল না যে, তিনি মক্কা বা ক’বার রক্ষণাবেক্ষণকারী ছিলেন বরং এর প্রধান কারণ ছিল, উমাইয়া গোত্রের আবদ সামসের ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্য (ব্যবসা ও তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে আদায়কৃত কর ভিত্তিক)। আবদ শামসের ব্যক্তিগত চারিত্রিক প্রভাবও এর জন্য দায়ী ছিল। উমাইয়া ছাড়া অপর যে গোত্র প্রভাবশালী ছিল তা হচ্ছে মাখজুম। এই গোত্রের উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন আল-ওয়ালিদ বিন আল-মুগীরা এবং আবু জহল, যারা মক্কার সামাজিক কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন।

মক্কায় আবু সুফিয়ানের যে অবস্থান ছিল তার সাথে এথেন্সের পেরিক্লিসের তুলনা করা যায়। এথেনী গণতন্ত্রের মত আবর গণতন্ত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার (egalitarian) ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি। মক্কার গোত্রপ্রথার গোত্রপ্রধান ছিলেন সর্বেসর্বা এবং গোত্রতন্ত্রে (tribalism) ব্যক্তিবিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। তবুও গোত্রীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে বয়োজ্যেষ্ঠ, বিচক্ষণ, সম্পদশালী, চরিত্রবান ব্যক্তিকে গোত্র প্রধান করা হত। গোত্রের সদস্যগণই ‘মালার’ সদস্য নির্বাচিত করতেন। সে দিক থেকে বিচার করলে এথেনী সংস্থা ekklesia-র তুলনায় মক্কার ‘মালা’ ছিল উন্নতমানের দায়িত্বসম্পন্ন সংস্থা এবং অধিকতর প্রগতিশীল। এ কারণে ‘মালার’ সদস্য নির্বাচনে গোত্রীয় সদস্যগণ ব্যক্তিবিশেষের চারিত্রিক গুণাবলি এবং তার অনুসৃত নীতির মূল্যায়ন করতেন। তারা বাহ্যিক প্রচার ও বাগাড়ম্বরের ভিত্তিতে পক্ষপাতিত্ব করতেন না। অপরপক্ষে, এথেনীয়গণ দেখতেন যে, প্রতিনিধিকারী ব্যক্তি সৎ এবং ন্যায়নিষ্ঠা কিনা, তাদের নৈতিক চরিত্র কি রকম? মক্কাবাসীরা নির্বাচিত ব্যক্তির দক্ষতা এবং নেতৃত্ব করার যোগ্যতা বিশেষভাবে বিচার করতেন। এ প্রসঙ্গে তৃতীয় সেকশনে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

(গ) কুরাইশ এবং আরব গোত্রসমূহ

মরুবাসী আরবদের মধ্যে আভিজাত্য এবং মর্যাদা নির্ভর করত সামরিক ক্ষমতার ওপর! গোত্রসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠতা নির্ধারিত হত কোন গোত্রের সদস্যদের সুরক্ষা করার ক্ষমতা এবং সে গোত্রের কোন সদস্যদের প্রতি অন্য কোন গোত্রের সদস্যদের দ্বারা অপমান, সংঘর্ষে আঘাত অথবা মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের প্রচেষ্টা। এসব বিচার বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদেশে কুরাইশ গোত্র সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল এবং এ কারণেই ইসলামী যুগে খলিফাদের একমাত্র কুরাইশ বংশ থেকে গ্রহণ করা হয়। কুরাইশদের এই অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্ব ৬২২ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হিজরর এক যুগ (দশ বছর) পূর্বে (৬১০ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে যখন থেকে কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণকারী হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর কাছ থেকে ওহী লাভ করে নবুওয়াত লাভ করেন। এই মনত্ব্য অতিরঞ্জিত মনে হলেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পশ্চিম এবং পশ্চিম-মধ্য আরবে কুরাইশ গোত্র ছিল সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী। কুরাইশদের এই শ্রেষ্ঠত্বের মূলে কি কারণ ছিল? ল্যামোর (Lammens) মতে, এই শ্রেষ্ঠত্বের মূলে ছিল হাবসী (কাল) দাসদের দ্বারা গঠিত সেনাবাহিনী (আবিসিনীয়)। কিন্তু তার এই যুক্তি সমর্থনযোগ্য নয় যা খণ্ডন করা হয়েছে Excursus A-তে গ্রন্থের শেষে। এটি সত্য কথা যে, কুরাইশগণ সামরিক প্রয়োজনে হাবসী সৈন্যদের যুদ্ধে নিয়োজিত করেছিল এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে তাদের গোত্রের বাইরে থেকে লুলাফা বা মিত্ৰ হিসেবে অন্য গোত্র থেকে মক্কার কুরাইশগণ সৈন্য সংগ্রহ করত। মূলত তারা ছিল অনিয়মিত তস্কর প্রকৃতির লোকজন। এই অনিয়মিত সৈন্যগণ সামান্য অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ করত। বদরের যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের ধনাঢ্য বণিকসম্প্রদায় যুদ্ধের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। তবে কোনক্রমেই তাদের ভীরু-কাপুরুষ বলা যাবে না। তাদের অনেকে রণক্ষেত্রে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কুরাইশ বংশের নবদীক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে, বিশেষ করে এ প্রসঙ্গে আলী এবং আমির হামযার কথা বলা যায়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে হিজরতকারী (মোহাজের) কুরাইশদের তুলনায় মদিনার সাহায্য প্রদানকারী আনসারগণ উন্নতমানের যোদ্ধা ছিলেন। সুতরাং এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, কুরাইশদের শ্রেষ্ঠত্ব ব্যক্তি হিসেবে তাদের শৌর্য-বীর্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল না।

কুরাইশদের মর্যাদার মূল উৎস ছিল সামরিক শক্তি, যার সাহায্যে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে পারত। এই সামরিক শক্তি একান্ত তাদের নিজস্ব ছিল না, বরং বিভিন্ন গোত্র, উপ-গোত্র ও সমমনা গোষ্ঠীদের দ্বারা গঠিত একটি কনফেডারেসী। এ ধরনের করফেডারেসী তারা কাফেলায় বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে গঠন করে। দক্ষিণে ইয়েমেন থেকে উত্তরে সিরিয়ায় কাফেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার প্রয়োজনে আরবদের প্রয়োজন ছিল অসংখ্য যাযাবরের, যারা পথপ্রদর্শক, রক্ষী উষ্ট্রচালক হিসেবে কাজ করত। মরুভূমির মধ্য দিয়ে কাফেলায় যাবার সময় ‘মক্কার কুরাইশগণ বিভিন্ন’ অঞ্চলে গোত্র প্রধানকে পানি ও রসদ সরবরাহ এবং নিরাপদ যাতায়াতের জন্য একটি নির্দিষ্ট হারে কর বা অর্থ প্রদান করত। এভাবে মরুভূমির যাযাবরেরা মক্কার বহিঃবাণিজ্যের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে এবং কোন গোত্রের লোকদের তারা সাহায্য করবে সে সম্বন্ধে তাদের ধারণা হয়। যাযাবরেরা সহজেই উপলব্ধি করে যে, মক্কার সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যই তাদের সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্য এবং মক্কার ক্ষতির অর্থ তাদের ক্ষতি। বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে মক্কার প্রভাবশালী গোত্র কুরাইশের সাথে অন্যান্য গোত্রের সখ্যতা ও ঐক্য স্থাপিত হয়। মক্কার গোত্রগুলোর সাথে মক্কার বাইরের গোত্রসমূহের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় তার ফলেই মক্কার বাইরে বসবাসকারী গোত্র প্রধানগণ ধনাঢ্য মক্কার ব্যবসায়ীদের জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে মুনাফা পেত।

একথা সত্য যে, মক্কার কনফেডারেসী অন্য গোত্র থেকে আগত সৈন্যদের অর্থ প্রদান করত। কিন্তু এ সমস্ত সৈন্যদের অনিয়মিত সৈন্য বলা যাবে না। তাদেরকে সুইস গার্ড অথবা ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নের সাথে তুলনা করা যাবে না। তারা মুক্ত আরব এবং সমতা ও সমান সুযোগের ভিত্তিতে কুরাইশ গোত্রের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলেছিল। আহাবিস নামে এক রহস্যজনক আরব গোত্র মক্কাবাসীদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিল। যখন বনু বকর বিন আবদ, মানাত বিন কিনানা গোত্রের সদস্য আল-বারাদ যে কাফেলা আক্রমণ করেন তার ফলেই ফিজারের (নিষিদ্ধ মাস) যুদ্ধ শুরু হয়। কাফেলা আক্রমণ করার সময় আল-বারাদের ধারণা ছিল যে, মক্কার বৈদেশিক নীতির অনুসরণে এই আক্রমণ করা হয় এবং তার ধারণা হয় যে, তার এই আক্রমণ মক্কার কুরাইশগণ সমর্থন জানাবে। কিন্তু পরে প্রতীয়মান হয় যে, এই আক্রমণ তার নিজ স্বার্থে পরিচালিত হয়, যাতে মক্কার কুরাইশদের কোন সমর্থন ছিল না।

কনফেডারেসীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি স্থাপন খুবই দুরূহ কাজ এবং সে ক্ষেত্রে অর্থ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু শুধুমাত্র অর্থ এই ঐক্য বজায় রাখতে পারে নি। উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের (আল-বারাদ) আক্রমণাত্মক মনোভাবকে সবসময় কূটকৌশল এবং নিছক বুদ্ধিমত্তা দ্বারা আয়ত্তে আনা সম্ভব। এ কাজ করতে হলে নিজের অনুভূতি বা চেতনাবোধকে আয়ত্তে আনতে হয়। এ ধরনের বিজ্ঞ এবং ধীর কূটনীতি-যা কুরাইশদের ভাষায় ‘হিলম’ নামে পরিচিত- বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সৃষ্ট কনফেডারেশন’কে স্থায়ী করতে সক্ষম হয়। ল্যামো বলেন, “এ ধরনের রাজনৈতিক প্রথা, যা কুরাইশদের “হিলম’ প্রতিফলিত পার্শ্ববর্তী যাযাবর গোত্রদের ওপর প্রাক-ইসলামী যুগের মক্কার প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত হয়।

(ঘ) মক্কার বৈদেশিক নীতি

মক্কার উত্তরে দুটি পরাক্রমশালী রাজ্যের অবস্থিতি ছিল, যথা- বায়জানটাইন এবং পারস্য সাম্রাজ্য। পশ্চিম দিকে ছিল আবিসিনীয়া অথবা ইথিওপিয়া। মূলত বাণিজ্যিক কারণে পার্শ্ববর্তী সাম্রাজ্যগুলোর আরবদেশের প্রতি আকর্ষণ ছিল। বায়জানটাইন সাম্রাজ্য প্রাচ্যদেশ থেকে সকল প্রকার সৌখিন দ্রব্যাদি আমদানি করার চেষ্টা করে। অপরদিকে, পারস্য উত্তরাঞ্চলের বাণিজ্য পথই, যা চীন থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, ভারতবর্ষ থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত পারস্য উপসাগরের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত সমুদ্র বাণিজ্যপথও নিয়ন্ত্রণ করে। পারস্য বায়জানটাইন সাম্রাজ্যে সিল্ক ও মশলা খুব চড়া দামে বিক্রি করত। কিন্তু যুদ্ধের সময় এ সমস্ত বাণিজ্য পথ বন্ধ হয়ে যেত। এর ফলে দক্ষিণ আরব বা ইয়েমেন থেকে উত্তরে সিরিয়া পর্যন্ত পশ্চিম আরব বা লোহিত সাগরের উপকূল দিয়ে মসলা পথ (spice route) অব্যাহত ছিল। এই বাণিজ্য পথে কাফেলায় দক্ষিণ আরবের সুগন্ধি দ্রব্যাদি উত্তরে নিয়ে যাওয়া হত। (প্রাচীন মিশরীয় ফেরাউনদের মমী করার সময় দক্ষিণ আরবের সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহৃত হয়।) লোহিত সাগর দিয়ে আবিসিনীয়ায় ব্যবসা থাকলেও এ পথে বহির্বাণিজ্য খুব কমই হতো।

৩. সামাজিক এবং নৈতিক পটভূমি

(ক) গোত্রীয় সংহতি এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য

মরুভূমির পরিবেশে বসবাসের জন্য গোত্রীয় সংহতি ও ঐক্য একান্ত অপরিহার্য। অসহনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং গোত্রীয় দ্বন্দ্ব-কলহের মোকাবেলার জন্য গোত্রের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে গোত্রপ্রীতি (আসাবিয়া) একান্ত জরুরী ছিল। মরুভূমিতে বসবাসের পূর্বেই আরবদের মেধ্য গোত্রপ্রথা প্রচলিত হয়। কিন্তু মরুভূমির বৈরী পরিবেশ গোত্রদের মধ্যে সংহতি জোরদার করে। যে গোত্র যত বড় তুলনামূলকভাবে ছোট গোত্র অপেক্ষা তার ক্ষমতা ও প্রভাব তত বেশি, আপাতদৃশ্যে এ কথা সটিক যে, বৃহত্তর গোত্র অধিক ক্ষমতার অধিকারী; কিন্তু গোত্রের মধ্যে যে অন্তঃদ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকে তার ফলেই এর সংহতি ও ঐক্য ব্যাহত হয়। এর ফলে বৃহৎ গোত্র ভেঙে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে বা গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মক্কার একটি গোত্রের ভাঙ্গনে। সাধারণত আরব গোত্র, গোষ্ঠী বা পরিবার ‘বনু ফুলান’ নামে অভিহিত হয়। ‘বনু ফুলান’ অর্থ ফুলানের সন্তান-সন্ততিরা। মক্কার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এক সময় বনু আবদ মান্নাফ খুবই প্রভাবশালী ছিল। এর পরবর্তী পর্যায়ে এই গোত্রের প্রাধান্য কমে যায়। এর কারণ বৃহদাকার ও শক্তিশালী বনু-আবদ মান্নাফের স্থলে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী উপ-গোত্রের সৃষ্টি একটি আবদ শামস এবং অপরটি হাশিম (বানু উমাইয়ার উদ্ভব হয় আবদ শামস থেকে এবং রাসূলুল্লাহর বংশের উদ্ভব হয় বনু হাশিম থেকে)। আবদ শামস এবং হাশিম উভয়ই আবদ মান্নাফের পুত্র ছিলেন। উল্লেখ্য, আরব ভূখণ্ডে প্রাক-ইসলামী যুগে সর্বাপেক্ষা রক্তক্ষয়ী গোত্রীয় যুদ্ধ (আইয়াম আল-আরাব) সংঘটিত হয় পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ও মিত্র উপ-গোত্রের মধ্যে।

প্রাক-ইসলামী যুগের প্রত্যেক গোত্র ছিল স্বাধীন। তারা অন্য গোত্রের কোন রাজনৈতিক প্রাধান্য বা প্রতিপত্তি স্বীকার করত না। এর ফলে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য এবং প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায়ই পার্শ্ববর্তী অন্য গোত্রের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হত। পরিস্থিতি এমন ছিল যে প্রত্যেক গোত্রের সদস্য অন্য গোত্রের সদস্যের প্রতি খড়গহস্ত ছিল। গোত্রের নিরাপত্তা এবং অখণ্ডত্ব রক্ষার জন্য এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এর ফলে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং সামরিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। বল প্রয়োগে গোত্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত। লুটতরাজ এজন্য আরবদের “জাতীয় খেলায়” পরিণত হয়।

রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দ্বারাই গোত্রীয় সংহতি বজায় রাখা সম্ভব ছিল। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রাচীন পন্থা। কিন্তু মরুভূমির অনুদার ও অসহনীয় পরিবেশে এটিই ছিল একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থা। কোন গোত্রের সদস্য অন্য কোন গোত্রের সদস্যকে হত্যা করে তাহলে সেই গোত্রকে খুনী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং এর শাস্তি “রক্তের পরিবর্তে রক্ত” অর্থাৎ ‘খুনের পরিবর্তে খুন’। কখনো কখনো অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার খুনের খেসারত বা ক্ষতিপূরণ, যা ‘দিয়াত’ নামে অভিহিত, দিয়ে বিরোধ মিটাত। অন্যথায় রক্তের পরিবর্তে রক্ত প্রথা গোত্রদের মধ্যে সমতা ও সমঝোতা বজায় রাখত।

গোত্রপ্রথা পুরুষ অথবা মহিলা সদস্যের ওপর নির্ভর করত। প্রাক-ইসলামী যুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে আরবদেশের গোত্রপ্রথা পিতা অপেক্ষা মাতা থেকে বেশি উদ্ভূত হয়েছে। গোত্র সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতো এক ধরনের কনফেডারেশন বা ‘হিলফ’- এর মাধ্যমে এবং গোত্রীয় সদস্যদের আনুগত্য প্রকাশ করতে হতো। অন্য পন্থা হচ্ছে ‘জিয়ার’ যার অর্থ নিরাপত্তা প্রদানের অঙ্গীকার করা। যারা কনফেডারেশনের সদস্য হতো তাদের বলা হতো ‘হালিফ’ অথবা ‘জার’, যার অর্থ মিত্র। তারা সকলেই একই গোত্রভুক্ত ছিল। কনফেডারেসী বা হিলফের সদস্য হতে হলে ক্ষমতা ও প্রভাবসম্পন্ন গোত্রের লোক হতে হতো। এদেরকে বলা হয় ‘তাহালুফ’। দুর্বল গোত্রগুলো তাদের অস্তিত্ব বজায়ের জন্য অন্য কোন শক্তিশালী গোত্রের সাথে মিত্রতা করত।

যদিও কোন বিশেষ গোত্র অথবা গোত্রসমূহের কনফেডারেশন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠন বলে ধরা গেলেও সকল আরবদের একই গোষ্ঠীভুক্ত ধরা যায় বিভিন্ন কারণে। আরবদের এই ঐক্য ও সংহতির মূলে তাদের একই ভাষা, একই কাব্যিক ঐতিহ্য, একই সাধারণ আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা এবং সর্বোপরি সাধারণ এক জাতি (সামরিক)। আরব এবং অনারব বা আজমদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার একমাত্র উপায় হচ্ছে ভাষা, ঠিক যেভাবে গ্রিক এবং বারবারই (অ-গ্রিক)-এর মধ্যে পার্থক্য বোঝা যেত। আরব ও সিরীয় মরুভূমি আরবদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। আরব শব্দের অর্থ ‘যাযাবর’। আরব জাতির পূর্বপুরুষ ছিলেন হয় আদনান অথবা কাহতান-এ দুটি গোত্র পরবর্তীকালে সংমিশ্রিত হয়ে পড়ে। পশ্চিমা গবেষকরা আরব জাতির এক বংশ থেকে উদ্ভূত হবার কথা বললেও তা কতটুকু সত্য তা বলা যায় না। তবে এই তথ্য আরবদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির যে সহায়তা করে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আরবরা এক জাতিভুক্ত এবং বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে অন্য জাতির চেয়ে পৃথক বা উন্নতমানের-এই তথ্য হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মদিনা পর্বের শাসনামলে বিশেষভাবে গুরুত্ব লাভ করে। এই তথ্যের ভিত্তিতে প্রাক-ইসলামী যুগ অপেক্ষা ইসলামী যুগের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল।

গোত্রীয় সংহতি ও ঐক্য সাধারণভাবে মক্কার নাগরিক সম্প্রদায়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। এই ঐক্য কুরাইশ গোত্রের মধ্যে সীমিত ছিল। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পর হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময়ে কুরাইশদের ঐক্যের স্থলে আরব ভূখণ্ডে সমস্ত গোত্র-গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘবদ্ধ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কোন ব্যক্তি বিশেষের নিরাপত্তা অথবা সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, সেই ব্যক্তির গোত্রের ওপর নির্ভর করত এবং প্রয়োজনে চুরি অথবা হত্যার প্রতিশোধ অন্য গোত্রের ওপর তারাই নিত। গোত্রীয় প্রধান বা দলপতির অনুমতি ছাড়া কেউ অন্য গোত্রের লোকের ওর হামলা করলে গোত্রীয় সংঘাত বেধে যেত। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মদিনায় অবস্থানের প্রথম দিকে একই অবস্থা বিরাজ করে। এ অবস্থা বিরাজ করায় হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কায় বিরোধিতা সত্ত্বেও ধর্মপ্রচার করতে পারেন। এর মূল কারণ এই যে, বনু হাশিম তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্য কোন গোত্রের সদস্য মক্কায় এসে বসবাস করতে চাইলে তাকে কুরাইশ গোত্রের কোন পরিবারের ‘হালিফ’ বা সহযোগী হতে হতো। এ দ্বারা কুরাইশ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।

যাহোক, আরব গোত্রীয় ঐক্য ও সংহতি কখনই চিরন্তন ছিল না। গোত্রের সদস্যগণ সকলেই নিঃস্বার্থ ছিল না; বরং তাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের ফলে তারা স্বার্থপর হয়ে উঠে। ল্যামোর মতে, এর মূল কারণ ছিল উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের স্বার্থপরতা। এ কারণে তারা কখনো কখনো গোত্রীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিত। এ ছাড়া, এমন কতকগুলো বাউগুলে লোক ছিল, যারা গোত্রীয় স্বার্থের বা পরিণতির কথা চিন্তা না করে অযথা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হত। এ সমস্ত লোকদের গোত্র থেকে বহিষ্কার করা হত এবং তারা ‘খালী’ নামে অভিহিত হত।

যদিও গোত্রীয় সংহতি ও ঐক্য গোত্রের মধ্যে একতা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি করে ছিল এবং দরফতির (শেখ) প্রাধান্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, তবুও কখনো কখনো একই গোত্রের কোন কোন সদস্য তাঁদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রকাশে দ্বিধা করতেন না। বিশেষ করে কবিদের ক্ষেত্রে এই স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল প্রকট। তাঁরা গোত্রের মানমর্যাদা, ঐতিহ্য ও গৌরব তাঁদের গীতিকবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। শুধু তাই নয়, এই গৌরব-মর্যাদা প্রকাশে তাঁর অবদানের কথা ও বলতেন। কখনো কখনো গোত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে কবিগণ তাঁদের ব্যক্তিগত গৌরব ও প্রাধান্য প্রকাশে দ্বিধা করতেন না। এর ফলে, তাঁদের মৃত্যুর পর গোত্রহীন অবস্থায় তাঁদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। একজন মানুষের শেষ পরিণতি কি? মৃত্যুই কী তার শেষ পরিণতি?

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রবণতা এবং গোত্রীয় সংহতির পরিপন্থী কার্যকলাপ মক্কার বাণিজ্যিক পরিবেশে দেখা যায়। যদিও গোত্র প্রথার ওপর সংহতি ও ঐক্য নির্ভর করত, তবুও কখনো কখনো একটি পরিবার গোত্রের মধ্যে থেকেও তার পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ও গ্রহণযোগ্য দলে পরিণত হতে পারে। যেমন, হাশিম গোত্রভুক্ত হয়েও আবু লাহাব হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করেন। ওসমান বিন আল-লুয়াইরিথ তার নিজস্ব গোত্রের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুসারীদের মধ্যে প্রথম দিকে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তারা গোত্র-প্রীতি ও আনুগত্য ছাড়াই ইসলাম কবুল করেন। এ সিদ্ধান্ত ছিল তাদের ব্যক্তিগত। প্রথম পর্যায়ে যারা মুসলমান হয়েছিলেন তারা পিতামাতার মতামত ছাড়াই তৌহিদে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। গোত্র সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসা-বাণিজ্যের অংশীদারিত্ব দ্বারা ব্যাহত হত।

একই সময়ে মক্কায় এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হল। এই পরিস্থিতি হচ্ছে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া একই সাধারণ জাগতিক স্বার্থের ওপর নির্ভর করে কুরাইশদের মধ্যে মেরুকরণ। কুরাইশ গোত্রভুক্ত না হলেও এ কারণে আহলাফ এবং মতায়াবুন গোত্র তাদের গোত্রীয় কলহ বন্ধ করে সংঘবদ্ধ হয়। একই কারণে বদরের যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর কুরাইশ ও অ-কুরাইশ গোত্রসমূহ তাদের গোত্র কলহ ও দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘জোট সরকার’ (Coalition Government) গঠন করে। এই ঐক্যের অসীম গুরুত্ব হচ্ছে এই যে, রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে গোত্রপ্রীতি প্রতিষ্ঠা না করে ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়।

আমরা যদি ইসলামের আবির্ভাবের সাথে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা চিন্তা করি তাহলে মক্কায় বিরাজমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিবর্তনের দিকে নজর দিতে হবে। মক্কার ঐশ্বর্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং তার সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের মূল উৎস হচ্ছে যাযাবর অর্থনীতি থেকে নাগরিক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির উত্তোরণ। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের সময় আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তি এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোন বিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি। এ সমস্ত ক্ষেত্রে মরুভূমির যাযাবরদের মন-মানসিকতা প্রতিভাত ছিল, যা যাযাবর সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল। হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গ যে সমস্যার সম্মুখীন হন তা মূলত মানুষের সচেতন মন-মানসিকতা এবং তাদের জীবনযাত্রার অর্থনৈতিক (যাযাবর) ভিত্তির মধ্যে বিদ্যমান বৈপরীত্য। এই সমস্যা সম্বন্ধে পরে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।

(খ) নৈতিক আদর্শ

গোল্ডযিহারের মতে, মরুবাসী আরবদের নৈতিক আদর্শ নির্ভর করে ‘মরুয়া’ বা পৌরুষত্বের ওপর। আর. এ. নিকলসন ‘মুরুয়ার’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “এটি হচ্ছে যুদ্ধে বীরত্ব, বিপদে ধৈর্য, প্রতিহিংসায় একাগ্রতা, দুর্বলদের রক্ষা এবং শক্তিশালী ব্যক্তিদের মোকাবিলা করা।” মরু অঞ্চলে আরবদের (যাযাবর) অস্তিত্ব বজায়ের জন্য এ সমস্ত গুণাবলি অপরিহার্য। বীরত্ব বা তেস্বিতা বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি আরবদের মধ্যে সে ধারণা ছিল না। আরবরা অযথা ঝুঁকি নিতে চাইত না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের রক্ত গরম হয়ে যেত; তারা সহসা কোন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তো না। এমনিতেই মরুজীবন ছিল অসহনীয়। এ কারণে প্রতিহিংসা গ্রহণ অর্থাৎ ‘রক্তের পরিবর্তে রক্ত’ এক মহান গুণ বলে বিবেচিত হয়। এ ধরনের প্রতিহিংসা গ্রহণ না করা দুর্বলতার লক্ষণ, যদিও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মৃত্যুবরণ করার ফলে গোত্রের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পেত। শক্তিধর কোন গোত্রের ক্ষমতার মোকাবিলা করাও এক মহান গুণ বলে বিবেচিত হয়। অবশ্য এ ধরনের কাজ সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করত। শক্তিধর গোত্র সবসময় দুর্বল গোত্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। শক্তিশালী গোত্রগুলো দুর্বল গোত্রগুলোকে রক্ষা করত এবং পক্ষান্তরে দুর্বল গোত্রগুলো ক্ষমতাবলে গোত্রগুলোর আনুগত্য স্বীকার করত। এটি এক ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা, যা দ্বারা রূঢ় ও অনুদার প্রকৃতির (মরুভূমি) সাথে তারা লড়াই করে বেঁচে থাকতে পারে। এর ফলে ক্ষমতাবান গোত্রগুলো আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে।

বদান্যতা ও অতিথিপরায়ণতা মরু অঞ্চলে বসবাসকারী আরবদের (বেদুঈন) মহৎ গুণ ছিল। এখনও আরবদের মধ্যে এ সমস্ত মহৎ গুণ বিদ্যমান। গোত্রপতির তাঁবুর বাইরে একগাদা ছাই প্রমাণ করত যে, তিনি মহৎ ও অতিথিপরায়ণ। ছাই-এর গাদা প্রমাণ করে যে, তিনি অতিথি আপ্যায়ন করেছেন। এই ঐতিহ্যবাহী গুণ মরুবাসী আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, যার মাধ্যমে তারা অন্য গোত্রের সাথে সখ্যতা ও সহমর্মিতা কামনা করতে পারতো যাতে তারা রূঢ় ও অসহনীয় প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বাঁচতে পারে। উপরন্তু, বদান্যতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে তা আতিশয্য বলে মনে হয়। যেমন, একজন বেদুঈন মহলার বাঁচার জন্য মাত্র একটি উটকে অতিথি সেবার জন্য জবেহ করা হয়। বদান্যতা ও অতিথিপরায়ণতা কখনো কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। বিশেষ করে প্রাক-ইসলামী যুগের আরব কবিদের মধ্যে মাত্রাধিক মদ্যপান এর প্রমাণ। এ সমস্ত আতিশয্য ও মাত্রাধিক আপ্যায়নে এ রকম কি ধারণা করা যেতে পারে যে, তারা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেন না। মরুভূমির অসহনীয় পরিবেশে ভবিষ্যতের ভয়াবহ দুরবস্থার কথা চিন্তা করা এবং তার বিরুদ্ধে সংযত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে চাইলে বেদুঈনগণ স্নায়ুর দুর্বলতায় ভুগে মরুভূমিতে মারা যেতেন অথবা মরুভূমি ত্যাগ করতেন অথবা অন্য কোন ক্ষমতাশালী গোত্রের প্রভাবাধীন থাকতেন, তাদের নিজস্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা হারিয়ে। ভবিষ্যতের চিন্তা করে বেদুঈনগণ কখনোই মরু অঞ্চলে বসবাস করতে পারত না। কারণ, মরুর পরিবেশের (লু বাতাস, মরুঝড়, শুষ্কতা ও অনুর্বলতার জন্য) কোন নিশ্চয়তা ছিল না। মরুর বালি, মরুর তাপ ও আবহাওয়া সদা পরিবর্তনশীল। অসাবধানতার মধ্যে সাবধানতা অবলম্বন মরুপরিবেশে এক বিশেষ গুণ ছিল এবং এ ধরনের কষ্ট, কাঠিন্য ও সহনশীলতার জন্য বেদুঈনরা প্রশংসিত হতেন।

আনুগত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা আরব জাতির মহৎ গুণ ছিল। নীতিগতভাবে তার গোত্রের কোন সদস্য কোন ব্যাপারে সাহায্য চাইলে আরবগণ তাৎক্ষণিকভাবে তার সাহায্যে এগিয়ে যেত। কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটনাটি বিচার-বিবেচনা না করেই তিনি এগিয়ে যেতেন সাহায্যের জন্য। কখনো কখনো দলপতির মতের বিরুদ্ধে তিনি গোত্রের সংহতির জন্য সাহায্য করতেন। গোত্রীয় সদস্যরা অন্য গোত্রের ধনসম্পদ লুটতরাজ করলেও তাদের নিজেদের গোত্রের মধ্যে সবসময় আনুগত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখত। এ ধরনের এক অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা জানা যায়। আস-সামাওয়ান বিন আদিয়া নামে এক ব্যক্তি এক আরব গোত্র দ্বারা আক্রান্ত হলে তিনি তাঁর পুত্রসন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন; তবুও তার কাছে গচ্ছিত ইমরুল কায়েসের অস্ত্রশস্ত্র হস্তান্তর করেন নি। এ ধরনের কাজের অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজতে গেলে বলতে হয় যে, অন্য গোত্রের প্রতি অপর এক গোত্রের আনুগত্য প্রকাশ, যা কৃত্রিমও হতে পারে।

প্রত্যেক গোত্রের সার্বভৌম স্বাধীনতা বজায় থাকায় মরুভূমিতে কোন কেন্দ্ৰীয় সরকারের বিধিবদ্ধ আইন বজায় ছিল না। আরব ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ মরু ও তৃণ অঞ্চলে কোন বিচক্ষণ ও শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত শাসক ছাড়া আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভবপর ছিল না। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অথবা পরে আরবদের মধ্যে আইন সম্বন্ধে কোন নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ছিল না : এমন কি মুসলিম ধর্মতত্ত্বে গ্রিক প্রভাব অনুপ্রবেশ করে নি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিধিবদ্ধ আইনের মূলে মুসলমানেরা জগতের সৃষ্টিকর্তার ঐশ্বরিক শাসনকে প্রাধান্য দেন, যা ঐশীবাণী হিসেবে নাজিল হয়েছে।

আইনের শাসন এবং ভাল-মন্দ সম্বন্ধে ধ্যান-ধারণা এসেছে গোত্রের প্রতি সম্মান, আনুগত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদর্শন থেকে। এরপর ব্যক্তির আনুগত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা স্থান পেয়েছে। গোত্রপ্রীতি (আসাবিয়া) এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। অতিথিপরায়ণ, গোত্র-মানসিকতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গোত্রের সদস্যের মহৎ গুণ। যাদের মধ্যে এ ধরনের গুণ নেই তারা নিকৃষ্ট। প্রাক-ইসলামী কবিদের কাব্যে এ ধরনের গুণের কথা জানা যায়। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, এ মহৎ গুণের অধিকারীরা খুব ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ছিল। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গোত্র-প্রীতি ও ঐক্যের বিরুদ্ধে কোন কাজ করত না। এর কারণ, এ ধরনের নিকৃষ্ট কাজ দ্বারা তারা তাদের গোত্রের অমর্যাদা করবে এবং তারাও ধিকৃত হবে। গীতি কাব্যগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে কবিদের গোত্রের বীর কাহিনী এবং তাদের মহত্বের বর্ণনা করে প্রশংসা এবং প্রতিপক্ষ গোত্রের পাপাচার ও অমর্যাদাকর কার্যকলাপের ব্যঙ্গ করে নিন্দা।

পুরুষত্ব বা বীরত্ব, যা মুরুয়া নামে অভিহিত, আরব সামাজিক কাঠামোতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আরবরা মুরুয়া প্রদর্শনকারী গোত্র সদস্যদের সম্মান করতেন। যে সমস্ত পরিবারে বীরপুরুষ রয়েছেন এবং যারা শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করতে পারেন তারা সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। একজন মানুষের যে মান-মর্যাদা রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে তার ক্ষমতা ও প্রভাব এবং এই মান-মর্যাদা পক্ষান্তরে নির্ভর করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত গুণাবলি এবং মুরুয়ার ওপর। আরবদের মধ্যে বংশপরস্পরায় কেউ ক্ষমতালাভ করতে পারত না। কারণ, স্বাধীনচেতা আরব গোত্রের মধ্যে এ ধরনের কোন আইন বিদ্যমান ছিল না। যোগ্য পিতা যদি গোত্রপতি হতেন এবং তার মৃত্যুর পর যদি দেখা যায় যে, পুত্রের গোত্রপতি হবার যোগ্যতা নেই এবং সে এই দায়িত্বপূর্ণ পদের জন্য অনভিজ্ঞ; তাহলে গোত্রের সদস্যগণ গোত্রের অস্তিত্বের স্বার্থে তাকে গোত্রপতি নির্বাচিত করতেন না। যিনি দলপতি হবেন তাকে অবশ্যই বুদ্ধিমান, জ্ঞানী, বিচক্ষণ হতে হয় এবং যে পরিবারে যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন, যিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়, তাকে ‘শেখ’ বা দলপতি নির্বাচিত করা হত। শেখকে অবশ্যই নৈতিক গুণাবলির অধিকারী হতে হত এবং গোত্রের সদস্যদের দ্বারা নিরঙ্কুশ ভোটে নির্বাচিত হতে হত। এভাবে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ আভিজাত্যের সাথে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন করে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র প্রচার করেন। একই সাথে মানুষের সাথে মানুষের সাম্যতা ও সমঝোতার নীতিও প্রদর্শন করেন।

এ. জে. টয়েনবী, যাযাবর বৃত্তির তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন যে, এটি এক স্ব-চারিত (tour de force) সমাজে ব্যবস্থা। যাযাবর বৃত্তি যেমন পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল ছিল ঠিক একইভাবে কৃষিকাজের ওপর পশুপালন (চারণভূমির জন্য) নির্ভরশীল ছিল। তিনি বলেন, “বছরের পর বছর যখন অনুর্বর মরূদ্যানের জীবনকে অসহনীয় করে তোলে এবং মরু ও তৃণভূমিতেও যখন এর বিস্তার ঘটে তখন যাযাবরবৃত্তির ওপর গড়ে ওঠা সভ্যতার দিকপালেরা বাধ্য হয়ে তৃণভূমিতে যেতে বাধ্য হন, তাদের সাময়িক আহারের জন্য নয়, জীবিকা অর্জনের জন্য। অনুদার প্রকৃতির মোকাবিলা করে শিকারী (যাযাবর তস্করেরা) এবং চাষীরা তাদের জীবনকে দুর্বিসহ মনে এরূপ ভয়াবহ প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন রক্ষার জন্য আরবদের হতে হয়েছে সংগ্রামী। এ কারণে যাযাবরবৃত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষকে হতে হয়েছে কঠোর সংযমী, এবং মুষ্টিমেয় কয়েকটি কাবিলাই যাযাবর জীবন গ্রহণ করতে পেরেছে, যাদের মধ্যে মুরুয়া এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রয়েছে। জীবনযাত্রার এই কঠিন সংগ্রামে যাযাবরদের কেবলমাত্র দৈহিক সহনশীলতাই নয়, নৈতিক গুণাবলিও বেশ ফলদায়ক ছিল। এ কারণে মরু জীবনযাপনে গোত্রদের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এর সাথে কোন গণ্যমান্য ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং তার আস্থার প্রতি (গোত্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে) বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত। মরুভূমির উত্তপ্ত পরিবেশে নিম্নমানের মনমানসিকতা ও কর্মকাণ্ড বর্জিত হয়ে স্বাভাবিক কারণে উচ্চ নৈতিকতা, গোত্রীয় সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ন্যায়নিষ্ঠা ও সহৃদয়তার ঐতিহ্য বিশেষ কার্যকরী ছিল। এর ফলেই, মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলি সোনা হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এই গ্রন্থের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ইসলামের মহত্ব প্রকাশ করা, যাতে মরু অঞ্চলের গুণাবলির সাথে হিব্রু-খ্রিস্টান একেশ্বরবাদের মতবাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

৪. ধর্মীয় এবং বুদ্ধিবৃত্তির পটভূমি

(ক) প্রাচীন ধর্মের অবলুপ্তি

প্রাক-ইসলামী যুগের আরববাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্বন্ধে সবচেয়ে তথ্যবহুল বিবরণ দেন নলডেকে Encyclopedia of Religion and Ethics-এ ‘Arabs (Ancient)’ প্রবন্ধে। এ ছাড়া, এ সম্বন্ধে বিবরণ পাওয়া যায় J. Wellhausen-এর Reste Arabische Heidentums শীর্ষক জার্মান ভাষায় লিখিত প্রবন্ধে। এই রচনাটির মূল উৎস ছিল ইবন আল-কালবীর “কিতাব আল-আসনাম”। H. Lammens-এর ফরাসী ভাষায় লিখিত প্রবন্ধ Le cite des Betyles et les processions religieuses chex les Arabes Preislamites. প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের ধর্মীয় অবস্থার বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যাবে। Dietlef Nielsen-এর বিতর্কিত তথ্যগুলো গ্রহণযোগ্য হয় নি। এ সমস্ত প্রবন্ধে বিভিন্ন দেব-দেবী এবং তাদের জড়িয়ে বিভিন্ন প্রকারের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্বন্ধে অনেক তথ্য রয়েছে। এ সম্বন্ধে কতিপয় শিলালিপি থাকা সত্ত্বেও আমাদের জ্ঞান খুব সীমিত। মূলত ইসলামী তথ্যসূত্র থেকেই এ সম্বন্ধে সবিশদ জানা যায়। এ কারণে অনেক তথ্যই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এ সমস্ত বিষয়াদি এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয় নি। এর মূল কারণ এই যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের সময় প্রাক-ইসলামী পৌত্তলিক ধর্ম তুলনামূলকভাবে অপরিবর্তিত ছিল।

প্রাক-ইসলামী যুগের ধর্মীয় মতবাদ একদিনে উদ্ভব হয়নি-বহু যুগের বিবর্তনে এটি প্রচলিত হয়েছে। যে সব বস্তু বিশেষভাবে উপাসনা করা হতো তা হচ্ছে পাথর ও গাছ। এ সমস্ত বস্তু দেব-দেবী হিসেবে পূজা করা হত না, বরং পাথর এবং গাছ ছিল দেব- দেবীর বাসস্থান। পরবর্তীকালে এ সমস্ত দেব-দেবীর ওপর বিভিন্ন গুণাবলি আরোপিত হয় বৈদেশিক প্রভাবের ফলশ্রুতিতে। কখনো কখনো তাদের সাথে সৌর-মণ্ডলের গ্রহ-নক্ষত্রের সম্পর্ক দেখানো হত। মরুবাসী যাযাবরদের এ সমস্ত দেব-দেবীতে বিশ্বাস ছিল না, কারণ তারা নিজেদেরকে কৃষিকাজে নিয়োজিত সম্প্রদায়ের দেবতা বলে মনে করত। মক্কায় মুহম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারে যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তারা কোন ধরনের বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল এবং কোন না কোন বিশেষ ধরনের ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানের (মক্কায় হাজ্জব্রত) সাথে জড়িত ছিল। অন্যদিকে, প্রাক-ইসলামী যুগে হজব্রত অব্যাহত ছিল। মক্কার পবিত্র স্থানসমূহ, যেমন- কা’বা পরিদর্শন, কাবার চারপাশে প্রদক্ষিণ, যা ‘হিরম’ নামে পরিচিত। কিন্তু পবিত্র মাসে ফিজারের যুদ্ধ প্রমাণিত করে যে, প্রাক-ইসলামী যুগের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানাদির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। মক্কা কনফেডারেসীর যখন অধঃপতন হল তখন মক্কার হারেমের অধিকর্তা আবু সুফিয়ান মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত উহুদের যুদ্ধে আল-লাত এবং আল-উজ্জা নামের দুই দেবীমূর্তি রণক্ষেত্রে নিয়ে যান। ঠিক অনুরূপভাবে ইসরাঈলগণ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে তাদের পবিত্র ধর্মীয় প্রতীক নৌকা (ark) যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান, সম্ভবত সৈন্যদের প্রেরণা প্রদানের জন্য। রণক্ষেত্রে দেবীর মূর্তি নিয়ে যাওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, প্রাক-ইসলামী আরব যুগের (আইয়াম-ই-জাহেলিয়া) পৌত্তলিকতার বিশ্বাস কত নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, যে সমস্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় তা ধর্মের অঙ্গ না হয়ে ম্যাজিক বা কুসংস্কারের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

(খ) গোত্রীয় মানবতা

প্রাক-ইসলামী যুগের প্রেক্ষাপটে পৌত্তলিকতার বিপরীতে গোত্রীয় মানবতা বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। এটি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের সময়ে এমন এক ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস যা ক্রমশ তার প্রভাব হারাচ্ছিল। এ ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রাক-ইসলামী যুগের কবিদের কবিতায় (মুয়াল্লাকা) লক্ষ্য করা যায়। কবিদের ভাষায় যা কিছু জীবনবোধে সাহায্য করে তাই গোত্রীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন- বীরত্ব, পৌরুষত্ব (মুরুয়া), বদান্যতা মানষের কর্ম প্রণালীতে প্রকাশিত মানবিক গুণাবলি একদিকে যেমন মহত্ব জাহির করে, অন্যদিকে গোত্রের অস্তিত্ব বজায়ে সহায়তা করে। এ সমস্ত গুণাবলিতে মানবতা প্রকাশ পায়। বর্তমান বা আধুনিক মানবতাবাদ যেখানে ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্র করে প্রচারিত হয়, প্রাক-ইসলামী যুগে মানবতাবাদ সেখানে গোত্রকেন্দ্রিক ছিল। জাতীয় পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে যে, কুরআনের প্রথম দিকের আয়াতসমূহে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কিছু বলা হয় নি; কিন্তু গোত্রীয় মানবতাকে ধর্মীয় মতবাদের পরিপন্থী হিসেবে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে (ইসলাম দ্বীন বা ধর্মকে মুরুয়ার বা গোত্রীয় সংহতির ওপরে স্থান দিয়েছে); পবিত্র কুরআনে নৈতিকতাকে অবশ্য প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

যাযাবর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গোত্রীয় সম্মান, মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ব। এ ছাড়াও যাযাবর জাতির অপর যে শ্রেষ্ঠত্ব তা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তাদের অসামান্য অবদান। এ প্রসঙ্গে বেদুঈনদের নৈরাশ্যবাদের কথা এসে পড়ে। এই নৈরাশ্যবাদ তাদের রূঢ় প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতিফলন, যদিও তা ছিল খুবই সীমিত। মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ড পূর্ব নির্ধারিত, একথা সীমিত অর্থে বেদুঈনরা বিশ্বাস করে। কোন কোন হাদিসে বর্ণিত আছে যে, মানুষের সমস্ত কার্যকলাপ পূর্ব নির্ধারিত (predestination)। প্রত্যেক বিশ্বাসী (মুমিন) মুসলমান একথা বিশ্বাস করেন এবং চারটি ক্ষেত্রে এই ভাগ্য নির্ধারণ সৃষ্টিকর্তা (আল্লাহ) পূর্বেই ঠিক করে থাকেন। এগুলো হচ্ছে- (ক) রিজক বা আহার, (খ) ‘আজল’ (হায়াত) বা জীবনকাল, (গ) সন্তানের লিঙ্গ ছেলে অথবা মেয়ে, (ঘ) সুখ বা দুঃখ। ভাগ্য নির্ধারণ কোন ধর্মের অংশ নয় এবং ভাগ্যকে কেউ দেবী হিসেবে উপাসনা করে না। ভাগ্য নির্ধারণ এক ধরনের বিজ্ঞান, যা দিয়ে কোন ঘটনা সম্বন্ধে পূর্বাভাষ দেওয়া যায়। মরুভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশে কোন কিছুরই পূর্বাভাস দেওয়া যায় না এবং সেগুলো মানুষের বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ প্রকৃতির উপর মানুষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মরুভূমিতে বসবাসকারী বেদুঈনদের প্রধান সমস্যা জীবিকা। কোন এক গোত্রের লোকেরা বৃষ্টিপাত উপভোগ করে, যার ফলে চারণভূমির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী বেদুঈন গোত্রের লোকেরা অনাবৃষ্টির ফলে খরা ও অনুর্বরতার সম্মুখীন হয়। মরুভূমির পরিবেশে আয়ু হয়ে যায় সীমিত। যে কোন সময় আকস্মিক আক্রমণে যে কোন বেদুঈন মৃত্যুবরণ করতে পারে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলেও আমরা মাতৃগর্ভের শিশুর লিঙ্গ জানতে পারি না। মরুভূমিতে যে কোন সময়ে যে কোন ধরনের মহাভাগ্যবিপর্যয় হতে পারে এবং নবী ইয়াকুবের মত যদি শারীরিক কষ্ট পায় তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মরুভূমির অনুদার পরিবেশে মুরুয়ার ধ্যান-ধারণার উপলব্ধি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে হয়ে থাকে। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, অভিজাত পরিবারে জন্ম হলে মহৎ কাজ করা সহজ, যদিও রক্তের পবিত্রতা ও উচ্চ বংশের ওপর মহৎ কাজ সবসময় নির্ভর করে না; নির্ভর করে নৈতিক গুণাবলির ওপর। আরবদের গোত্রীয় সংহতির জন্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কতটুকু ছিল তা সঠিক করে বলা যায় না। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর যৌবনকাল ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য, ধর্মীয় ক্ষমতার প্রতীক গোত্রীয় মানবতাবাদের উন্মেষে লাঘব হয়। এতকাল গোত্রীয় সদস্যগণ তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অপেক্ষা গোত্রীয় সংহতির প্রতি অধিক নিষ্ঠাবান ছিল। কিন্তু গোত্রীয় মানবতাবাদ ইসলামের আবির্ভাবে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে। গোত্রীয় মানবতাবাদ থেকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের উত্তোরণ সহজ ছিল না। এর মূল কারণ ছিল এই যে, ব্যক্তির অমরত্ব অপেক্ষা গোত্রের মহত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হত। এই গোত্র মহত্ব ও প্রাধান্য রক্তের পবিত্রতা বা আভিজাত্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, ইসলামের আবির্ভাবে এই কৌলিন্য প্রথা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে গোত্রীয় মানবতাবাদের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বত্তা-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার আদর্শে সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে

(গ) একেশ্বরবাদী মতবাদের উন্মেষ

ইসলামের মূলমন্ত্রের উন্মেষে হিব্রু-খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব সম্বন্ধে এখানে আলোচনার কোন অবকাশ নেই; তবে এটা বলা যুক্তিসঙ্গত হবে যে, পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীরা যে দৃষ্টিভঙ্গিতে এ বিষয়টি পর্যালোচনা করেন তা মোটেই সঠিক নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য লেখকেরা ইসলামের মূল ধর্মীয় তত্ত্বকে অর্থাৎ তাওহীদ অস্বীকার করেন। সে দিক থেকে বিচার করলে ইসলামের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই নিকৃষ্ট ও একপেশে। তারা তাদের মূল বক্তব্য লিখিত ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করেন; কিন্তু ইতিহাস ছাড়াও কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিকদের সৃজনশীল সাহিত্য রচিত হয়েছে, যা ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। ধর্মীয় মতবাদের উন্মেষে পূর্ববর্তী ধর্মের উপাদান থাকতে পারে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে ধর্মে মৌলিকতা নেই। এমোস অথবা হেযেকিয়েল পূর্ববর্তী ধর্ম থেকে উপাদান নিয়ে তাঁর ধর্মীয় মতবাদ সৃষ্টি করেন; কিন্তু এই নির্ভরশীলতার ওপর অধিক গুরুত্ব দিলে মৌলিকত্ব ও সৃজনশীলতা লাঘব হবে। মূলত ওহীর মাধ্যমে ইসলামের একেশ্বরবাদ (তাওহীদ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে ঐশীবাণীই ইসলামের মূল ভিত্তি।

মুসলমানদের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআন আল্লাহর কালাম বা আল্লাহর তরফ থেকে মহানবী (স)-এর কাছে জিরাঈলের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআনে প্রাক- ইসলামী যুগের আরবদের পৌত্তলিকতা এবং এর আচার-অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ আছে। কোন কোন আয়াতে প্রাচীন আরবের দেব-দেবী সম্বন্ধে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সমসাময়িক অনুসারীদের মধ্যে যে ধারণা ছিল তাও কুরআনে ব্যক্ত করা হয়েছে। একেশ্বরবাদের এসব তথ্যাদির সাথে ইহুদী-ক্রিস্টানদের মতবাদের সাদৃশ্য রয়েছে, যা পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীদের হৃদয়গ্রাহী। হিব্রু ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব যে ইসলামে রয়েছে তা গোঁড়াপন্থ মুসলমানও অস্বীকার করবেন না।

পবিত্র কুরআনের গোড়ার দিকের সূরাসমূহ পাঠে ধারণা হয় যে, এগুলো ইসলাম ধর্মে নব-দীক্ষিত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এমন কতকগুলো নতুন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যার সাথে আরবগণ পরিচিত ছিল না। যেমন- “সাকার” (৭৪), আল-কারিয়া (১০১), আল-হুতামা (১০৪) ইত্যাদি। তারা অবশ্য ‘হে প্রভু’ (Thy Lord) অথবা ‘আল্লাহ’ শব্দের সাথে পরিচিত ছিল। সূরা কুরাইশ-এ কা’বা প্ৰসঙ্গে পবিত্র ঘরের অধিকর্তা (আল্লাহ) সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মক্কার আধ্যাত্মিক ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন গোষ্ঠীদের মধ্যে একেশ্বরবাদের (হানিফ) মতবাদ প্রচলিত ছিল। ঈশ্বরের আরবী নাম হচ্ছে আল্লাহ, যা আল-ইলাহা থেকে উদ্ভূত। এই শব্দটি গ্রিক শক্ত theos-এর মত ঈশ্বরকে ইঙ্গিত করে। এই ঈশ্বর বা god অর্থাৎ ছোট ছোট দেবতা। অবশ্য কখনো কখনো গ্রিকগণ এই শব্দ দিয়ে মহান প্রতিপালক ঈশ্বর বা God কে বোঝাতে চান। সম্ভবত হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে পৌত্তলিক মক্কাবাসী কা’বার প্রধান বিগ্রহ (হুবাল)-কে আল্লাহ জ্ঞানে উপাসনা করতো। অনুরূপভাবে তায়েফের অধিবাসীগণ আল-লাত নামে এক দেবী-বিগ্রহের উপাসনা করত। ইহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে আল্লাহ যে মহান ঈশ্বর (God) তা স্বীকৃত। কিন্তু প্রাক-ইসলামী যুগে ব্যবহৃত ‘আল্লাহ’ এবং কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ-র মধ্যে স্বভাবত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কোন কোন পৌত্তলিক মক্কাবাসী ‘আল্লাহ’ অস্তিত্ব স্বীকার করলেও পৌত্তলিকতার সাথে একেশ্বরবাদের বৈপরীত্য থাকায় তারা একেশ্বরবাদী না হয়ে পৌত্তলিকই রয়ে গেল।

প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদেশে একেশ্বরবাদের মতবাদ মূলত ইহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রভাবে প্রচালিত হয়। বিভিন্ন সময়ে আরবগণ ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সংস্পর্শে আসে। উত্তরে প্রতাপশালী ও সমৃদ্ধ বায়জানটাইন এবং পশ্চিমে আবিসিনিয়া সাম্রাজ্য মূলত খ্রিস্টান ছিল। এমন কি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পারস্য (সাসানীয়) রাজ্যেও খ্রিস্টানদের বসবাস ছিল। পারস্যের করদ রাজ্য আল-হিরা, যার সাথে প্রাচীন আরবদের যোগাযোগ ছিল; পূর্ব সিরিয়া বা নেস্টোরিয়া গীর্জার কেন্দ্র ছিল। একেশ্বরবাদে পুষ্ট রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি (আল-হিরা) এবং তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা আরবদের প্রভাবান্বিত করে। আল-হিরার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী আরব বেদুঈনগণ ক্রমশ খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। কাফেলার সাথে সিরিয়ায় গিয়ে মক্কার বণিকগণ খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে জানতে পারেন। এমন কি খোদ মক্কায় খ্রিস্টানদের বসবাস ছিল। তারা কেউ কেউ বণিক ছিলেন, আবার অনেকে দাস। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব কতটুকু কার্যকরী ছিল তা বলা যায় না।

খ্রিস্টানদের মতো ইহুদীদের সাথে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবদের যোগাযোগ ছিল, তবে তেমন ঘনিষ্ঠ নয়। বিশেষ করে ইয়াসরিবে (মদিনা) বসবাসকারী ইহুদীদের সাথে পৌত্তলিক মদিনাবাসীদের সম্পর্ক ছিল। এ ছাড়া, আরব মরূদ্যানে কয়েকটি ইহুদী সম্প্রদায়ের (নাজরান) বসবাস ছিল। এমন কি দক্ষিণ আরবের উর্বর এলাকায় ইহুদীগণ সুদের ব্যবসা করতেন। তারা হয় হিব্রু উদ্বাস্তু ছিল; নতুবা হিব্রু ধর্ম গ্রহণকারী কতিপয় আরব গোত্র ছিল। উল্লেখ্য, এ সময় মক্কায় কোন ইহুদীর বসবাস ছিল না।

এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, যে সমস্ত ইহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে আরবদের যোগাযোগ ছিল তাদের ধর্মীয় মতবাদ ছিল অদ্ভুত ধরনের। যেমন, প্রতিষ্ঠিত খ্রিস্টান মতবাদের বিপরীতে পূর্ব সিরিয়ার ‘নেস্টোরিয়ান’ এবং সিরীয় ও আবিসিনিয়গণ মনোফিজাইট মতবাদ প্রচলিত করে। এই দুই মতবাদের প্রবক্তাগণ যিশুখ্রিস্ট সম্বন্ধে লিখিত অলীক মতবাদের (apocryphal) তুলনায় খুবই স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ প্রচার করেন। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে নেস্টোরিয়ান এবং মনোফিজাইট যতবাদ প্রচলিত ছিল। এ সময়ে আরব ভূখণ্ডে বসবাসকারী খ্রিস্টানদের মধ্যে ত্রিতত্ত্ববাদ (Trinity) অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর (God the Father), ঈশ্বরপুত্র যিশু (God the Son) এবং বার্তাবাহক ফেরেশতা জিবরাইল (God the Holy Ghost) প্রচলিত ছিল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন কর এবং ত্রিতত্ত্ববাদে আস্থা আনবে না।” (ওয়াট এখানে বার্তাবাহক ফেরেশতার স্থানে কুমারী মেরী, যিনি যিশু খ্রিস্টের জন্মদাত্রী মাতার কথা বলেছেন। তার ভাষ্য বোধগম্য নয়)। ত্রিতত্ত্ববাদ প্রসঙ্গে কুরআনে যে কথা বলা হয়েছে, তা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মতবাদের সমালোচনা। ইহুদীদের মতবাদ সম্বন্ধে বলা যায় যে, প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে যে হিব্রু ধর্ম প্রচলিত ছিল তা মূল ধারা থেকে বিচ্যুত অপভ্রংশ মাত্ৰ।

ইহুদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ছাড়াও প্রাক-ইসলামী যুগে আরব ভূখণ্ডে একেশ্বরবাদী একটি গোষ্ঠী ছিল, যাদের প্রভাব কোন অংশে কম ছিল না। এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী গ্রিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করত। যেমন- সাবিয়ান। অপর একটি গোষ্ঠীর নাম ‘হানিফ’। অবশ্য এ সময়ে পৌত্তলিকতার প্রভাবে একেশ্বরবাদের মতবাদ বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে নি। এতদসত্ত্বেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, হানিফ গোষ্ঠীর কোন ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলেও তারা যে এক আল্লাহর বন্দেগী করতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রাক-ইসলামী যুগের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ক্ষুদ্র এই ‘হানিফ’ গোষ্ঠী নতুন ধর্মমত প্রচলিত করে, যার প্রভাব একেবারে তুচ্ছ করার মতো নয়। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষার্ধে মক্কায় এমন অনেক বুদ্ধিজীবী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন যারা আরবদেশের গ্রহণযোগ্য ধর্মীয় মতবাদের শূন্যতা অনুভব করেন। এই শূন্যতা পূরণ করেছিল একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্ম (তাওহীদ)।

সবশেষে একথা বলা প্রয়োজন যে, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মমতের অনেক বিবর্তন হয়েছিল, যার ফলে কোন কোন মতবাদ ইসলামে অনুপ্রবেশ করে। এ প্রসঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী বা ভাগ্য নির্ধারণের সঙ্গে মহান আল্লাহর (God) সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া, মহান আল্লাহর ধ্যান-ধারণার পৌত্তলিক আরবদের মধ্যে এমনভাবে বিস্তার লাভ করে যে, তারা তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচার-অনুষ্ঠানে আল্লাহ বা মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ বা সমর্থনের কথা বলে। এর উল্লেখ পাওয়া যায় সূরা আ’রাফের (৭) ২৮ নম্বর আয়াতে- “যখন তারা কোন অশ্লীল আচরণ করে তখন বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এটি করতে দেখেছি এবং আল্লাহ আমাদেরকে যেটি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বল, “আল্লাহ অশ্লীল আচরণের নির্দেশ দেন নি। তোমরা কী আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলেছ, যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই?”

পয়গম্বরের ধ্যান-ধারণা ইসলামের আবির্ভাবের বহুপূর্ব থেকে প্রচলিত ছিল। হযরত ইব্রাহিম (আ) জেরুজালেম থেকে মক্কায় এসে কা’বাঘর নির্মাণ করেন এবং পুনরায় জেরুজালেমে ফিরে যান। এ ঘটনা কুরআন নাযিল (খ্রি. ৬১০) হওয়ার বহু পূর্বের অনুরূপভাবে কুরআনে আদ এবং সামুদ জাতির নবী হুদ এবং সালেহের যে কথা বলা হয়েছে, তাও ইসলাম আবির্ভাবের অনেক আগের ঘটনা। আদ ও সামূদ অবলুপ্ত প্রাচীন আরব জাতি (বায়দা)। নবুওয়াত বা পয়গম্বরের ধ্যানধারণা প্রাক-ইসলামী যুগে প্রচলিত হয়, সম্ভবত হিব্রু-খ্রিস্টান ধর্মীয় মতবাদের প্রভাবে। (ওয়াট এখানে বলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াতের পূর্বে বনু হানিফা গোত্রের মুসায়লিমা নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন— একথাটি সত্য নয়। কারণ, হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকালে (খ্রি. ৬৩২-৬৩৪) মুসায়লিমা ভণ্ড নবী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ধর্মত্যাগীদের (রিদ্দা) যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেন।)

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনবৃত্তান্ত আলোচনায় ইহুদী-খ্রিস্টান প্রভাব কতটুকু ছিল? তার অবতারণা নিরর্থক : বিশেষ করে এ সমস্ত প্রভাব কতটুকু সত্য তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে একথা নিশ্চিত যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় আরব ভূখণ্ডে ইহুদী-খ্রিস্টানদের বসবাস ছিল এবং এ ধরনের পটভূমিতে ইসলাম যে আবির্ভূত হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়। (খ্রিস্টান সাধু বাহিরা, হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সিরিয়ায় দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, ‘তিনি একদিন নবী হবেন।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *