প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

অষ্টম অধ্যায় : উমাইয়াদের পতন

অষ্টম অধ্যায় – উমাইয়াদের পতন

গ্রুনিবাম বলেন, “উমাইয়া রাজত্বকে (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) সাধারণভাবে খিলাফতের ভূমধ্যসাগরীয় যুগ বলা যেতে পারে। এই যুগে দারুল ইসলামের দ্বিতীয় বৃহৎ সম্প্রসারণ হয়। খিলাফতকে রক্ষা এবং সম্পদশালী করতে হলে কি ধরনের বুদ্ধিবৃত্তি এবং প্রশাসনিক সংক্রান্ত কাঠামো প্রয়োজন তা এই যুগে উপলব্ধি করা হয়। একে জাতীয়- রাষ্ট্র হিসেবে আরবদের আত্ম-ধ্বংসের যুগও বলা যেতে পারে।” উমাইয়া বংশের অবনতি ও পতনের মূলে বিবিধ কারণ ছিল :

(ক) প্রাকৃতিক নিয়ম : প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিক ইবন খালদূন বলেন, “যে-কোন রাজবংশের স্থিতিকাল একশত বছর এবং ক্ষমতাসম্পন্ন রাজবংশকেও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা এবং ক্রম অবনতি ও পতন এই তিনটি নির্দিষ্ট অধ্যায়কে অতিক্রম করতে হবে।” ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া বংশ প্রথম ওয়ালিদের রাজত্বে গৌরব ও সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে এবং ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জাবের যুদ্ধে দ্বিতীয় মারওয়ানের পরাজয়ের ফলে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং ইবন-খালদূনের সংজ্ঞা অনুযায়ী উমাইয়া খিলাফত মোটামুটি নব্বই বছরকাল বিস্তৃত ছিল।

ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী ইবন-খালদূন বলেন, “দ্বিতীয় পুরুষদের যুগে মারওয়ান ছিলেন প্রথম শ্রেণীর অন্তর্গত এবং তাঁর গুণাবলি ছিল সুপরিচিত। আবদুল মালিকের পুত্রগণ একের পর এক ক্ষমতার অধিকারী হলেন। তাঁদের অসাধারণ ধর্মভীরুতা সুবিদিত। তাঁদের মাঝামাঝি সময়ে রাজত্ব করেন ওমর-ইবন-আবদুল আজীজ। তিনি যত্ন ও একাগ্রতার সঙ্গে প্রথম চারি খলিফার ও সাহাবীদের পথ অনুসরণ করবার চেষ্টা করেন। তাঁর পর আসলেন পরবর্তী যুগের উমাইয়া খলিফাগণ। জাগতিক বিষয়ে তাঁরা রাজশক্তির চাহিদা অনুযায়ী কার্য করতেন। তাঁরা সচেতনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন না এবং পূর্ববর্তী খলিফাদের কাজকর্মের মধ্যে যে সততা ও নির্ভরশীলতা ছিল তা তাঁরা ভুলে গেলেন। এর ফলে লোকজন তাঁদের কার্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে লাগল এবং উমাইয়াদের বিরুদ্ধে আব্বাসীয় প্রচারণাই তারা গ্রহণ করল।”

(খ) ইসলামের মৌলিক আদর্শে আঘাত : আমীর আলী বলেন, “উমাইয়াদের সিংহাসনারোহণ শুধু শাসক বংশের পরিবর্তনই সুচিত করে নি, বরং একটি নীতির আমুল পরিবর্তন এবং কতকগুলো নতুন অবস্থার সৃষ্টি করে।” শঠতা, ষড়যন্ত্র এবং নৈতিক জ্ঞানহীনতার বশবর্তী হয়ে মুয়াবিয়া হযরত আলীকে খিলাফত হতে বঞ্চিত করে বলপূর্বক ক্ষমতা লাভ করলে ইসলামের মৌলিক আদর্শে অনুপ্রাণিত ধর্মভীরু সাহাবিগণ উমাইয়া বংশের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করতে থাকেন। মুয়াবিয়ার ক্ষমতা লাভ হাশিমী গোত্রের উপর উমাইয়া গোত্রের প্রাধান্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে এবং কেবল দ্বিতীয় ওমর ব্যতীত সকল উমাইয়া খলিফা হাশিমী গোত্রের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করেন। মুয়াবিয়া সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আলীকে তাঁর সাথে রণে ক্ষান্ত দিতে বাধ্য করে ক্ষমতা লাভ করেন। ইমাম হাসানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক ইমাম হুসাইনকে বঞ্চিত করে স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন, হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যায় ইয়াজিদের ষড়যন্ত্র, কারবালার যুদ্ধে ইয়াজিদের খিলাফতে ইমাম হুসাইনের শাহাদাত বরণ এবং তাঁর পরিবারের অবমাননা, মারওয়ানের ষড়যন্ত্রমূলক অভিসন্ধিতে গণতন্ত্রের মাধ্যমে মজলিস-উস-শূরা কর্তৃক খলিফা নির্বাচনের পরিবর্তে বংশানুক্রমিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা, ইয়াজিদ কর্তৃক পবিত্র কা’বা গৃহের ধ্বংস সাধন এবং মদিনার অপবিত্রকরণ প্রভৃতি কারণ বুদ্ধিজীবী এবং আদর্শবাদী বা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে। মদিনায় লুণ্ঠন সম্বন্ধে বলা হয় যে, “ইসলামের উপর এর দ্রুত প্রতিফলন হল নিষ্ঠুর, ভয়াবহ ও বীভৎস। কা’বার অগ্নিসংযোগের ফলে কা’বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পবিত্র কৃষ্ণপ্রস্তর ত্রিখণ্ডিত হয়ে যায় এবং কা’বা গৃহ ক্রন্দনরতা রমণীর ভগ্ন হৃদয়ের রূপ লাভ করে।” উমাইয়া খলিফাদের ইসলামের মৌলিক আদর্শের উপর আঘাত ও হাশিমী বংশের প্রতি বৈরীভাব তাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে।

(গ) খিলাফতের পার্থিবকরণ : উমাইয়া খিলাফতের পতনের অন্যতম কারণ ছিল গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তন, নির্বাচনের স্থলে মনোনয়ন, খোলাফায়ে রাশেদূন অর্থাৎ ন্যায়নিষ্ঠ ও ধর্মপরায়ণ খিলাফতের পরিবর্তে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বায়তুল মালকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করা (দ্বিতীয় ওমর ব্যতীত)। উমাইয়া খিলাফতের দুটি বৈশিষ্ট্য ইসলামের মৌলিক আদর্শের পরপন্থী ছিল। প্রথমত, ইসলামকে পার্থিবকরণ, যার ফলে খলিফা বা জনপ্রতিনিধি মালিক অথবা রাজায় রূপান্তরিত হন এবং দ্বিতীয়ত, ইসলামের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের (Universal brotherhood) পরিবর্তে রক্ত, গোত্র, বংশীয় স্বার্থে আরব জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। বার্নার্ড লুইস বলেন, “তাঁর (মুয়াবিয়া) সমাধান ছিল তত্ত্বমূলক ইসলামী রাষ্ট্রের পরিবর্তে আরব গোত্রীয় কৌলীন্যের ভিত্তিতে একটি আরব রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।” এভাবে খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে প্রচলিত ইসলাম গণতান্ত্রিক আদর্শ উমাইয়া পার্থিবকরণ ও রাষ্ট্রীয়করণের চাপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে শিয়া, খারিজি এবং পরবর্তীকালে মাওয়ালী ও আব্বাসীয়গণ উমাইয়াদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

(ঘ) সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব : খিলাফতের উত্তরাধিকারী নিয়োগের সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট নীতির অভাবই উমাইয়া বংশের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। খলিফাগণ কোন ক্ষেত্রে শুধু জ্যেষ্ঠ পুত্র, কোন ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে সকল পুত্রকে, আবার কেউ ভ্রাতুষ্পুত্রকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে রাজবংশে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং আত্মকলহের সূচনা করেন। পক্ষান্তরে, এটি উমাইয়া খিলাফতের বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিপন্থী হলেও মুয়াবিয়া জ্যেষ্ঠপুত্র ইয়াজিদকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দেন সত্য, কিন্তু এই নীতি তাঁর পরবর্তী খলিফাগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন নি। ইবন খালদুনের মতে, “বায়োজ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেই খলিফা নিযুক্ত করা যেতে পারে”-এই নীতি পরবর্তীকালে খণ্ডিত হয়। চৌদ্দজন উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে কেবল প্রথম মুয়াবিয়া, প্রথম ইয়াজিদ, প্রথম মারওয়ান এবং আবদুর মালিকের মৃত্যর পর তাঁদের পুত্রগণ সরাসরি উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হয়ে খিলাফত লাভ করেন। এই নীতির অবমাননা করেন মারওয়ানী শাখার প্রতিষ্ঠাতা প্রথম মারওয়ান। তিনি তাঁর দুই পুত্র আবদুল মালিক এবং আবদুল আজীজকে যথাক্রমে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আবদুল মালিক ক্ষমতা লাভ করে ভ্রাতাকে বঞ্চিত করে স্বীয় পুত্রদ্বয় প্রথম ওয়ালিদ এবং সুলায়মানকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। প্রথম ওয়ালিদ সনাতন পদ্ধতি অনুযায়ী ভ্রাতা সুলায়মানের পরিবর্তে তাঁর পুত্রের অনুকূলে মনোনয়ন দানের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালান। সুলায়মান পিতৃব্য-পুত্র ওমর-ইবন-আব্দুল আজীজকে, দ্বিতীয় ওমর আব্দুল মালিকের তৃতীয় পুত্র দ্বিতীয় ইয়াজিদকে এবং ইয়াজিদ তাঁর ভ্রাতা হিশামকে মনোনীত করেন। হিশামের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বিতীয় ওয়ালিদ পরবর্তী খলিফা হন এবং দ্বিতীয় ওয়ালিদকে সিংহাসনচ্যুত করে তৃতীয় ইয়াজিদ জোরপূর্বক খিলাফত লাভ করেন। সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান আব্দুল মালিকের ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। এইরূপ অনিশ্চিত, অনির্ধারিত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনোনয়ন-নীতির ফলে ক্ষমতা লাভের জন্য সিংহাসনকে কেন্দ্র করে অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, রাজদরবারের ষড়যন্ত্র (Court intrigue) শুরু হলে উমাইয়া বংশের স্থায়িত্ব ও ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।

(ঙ) খলিফাদের বিলাসিতা : উমাইয়া বংশের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রথম ধর্মপ্রাণ খলিফাদের কুরআন এবং হাদিস অনুসৃত আদর্শ, মতবাদ, নীতি, জীবন- পদ্ধতি ও আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তে উমাইয়া খলিফাগণের জাঁকজমক, আড়ম্বর, বিলাস-বাসন ও ভোগ-লালসার প্রতি আকর্ষণ। বিলাস-বাসনের মাত্রা এরূপ ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, খলিফাগণ রাজধানী দামেস্ক ব্যতীত সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য প্রমোদ-প্রাসাদ (Pleasure castle ) নির্মাণ করেন। রাসূলে করীম ও খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে নির্মিত সাধারণ ও অনাড়ম্বর ইমারতের পরিবর্তে উমাইয়া আমলে জাঁকজমকপূর্ণ এবং বৃহদাকার স্থাপত্য-রীতির উদ্ভব হয়। ক্রেসওয়েল যথার্থই বলেন যে, পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ আরব বেদুঈনদের জীবন-পদ্ধতিতে অনুরক্ত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁরা মরুভূমিতে অনেক প্রমোদ প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এ সমস্ত প্রাসাদে শয়নকক্ষ, স্নানাগার এবং দেওয়াল চিত্রাবলি (কখনও কখনও নগ্ন চিত্রাবলি, কুসাইর আমরা, হাম্মা-আস-সারক) হতে খলিফাদের ভোগ-বিলাসের ধারণা পাওয়া যায়।

আরবি সাহিত্যে সর্বপ্রথম প্রেমের কবিতা (Poet of Love) আবির্ভাব হয় এবং উমর ইবন-আবি-রাবিয়াকে প্রথম প্রেম-সংক্রান্ত ( Erotic Poetry) আরব কবি বলে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় ইয়াজিদ এবং দ্বিতীয় ওয়ালিদের রাজদরবারে পারস্যবাসী ইবন-মুহরিজ এবং মদিনাবাসী মা’বাদ এবং মহিলা গায়িকা জামিলা সঙ্গীতশাস্ত্র পারদর্শী ছিলেন এবং তাদের সঙ্গীত দ্বারা পাপিষ্ঠ ও দুরাত্মা উমাইয়া খলিফাদের মনোরঞ্জন করতেন। জোসেফ হেল বলেন, “বায়জানটাইন সাম্রাজ্য বিলাসদ্রব্যাদি সরবরাহ করত; মক্কা সঙ্গীতশিল্পীদের সরবরাহ করত এবং বসরা ও কুফা মনের খোরাক জোগাত।” উল্লেখযোগ্য যে, কাব্যরসিক প্রথম ইয়াজিদ সর্বপ্রথম দামেস্কের রাজদরবারে সঙ্গীতচর্চা এবং সঙ্গীতের যন্ত্রাদির প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে সঙ্গীত উমাইয়া জীবনকে এরূপ বিষাক্ত করেছিল যে, দ্বিতীয় ইয়াজিদ রাজসভার গায়ক মা’বাদের সঙ্গীতে বিভোর হয়ে নৃত্য করতেন। তিনি হাবীবা এবং সাল্লামাহ নামে দুইজন গায়িকার সাহচর্যে এতই মগ্ন থাকতেন যে, হাবীবার মুখে খেলাচ্ছলে একটি আঙ্গুর দিলে তা গলায় আটকিয়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। এতে তিনি এতই শোকভিভূত হয়ে পড়েন যে অল্প দিনের মধ্যেই তাঁরও মৃত্যু হয়। হিশামের উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় ওয়ালিদ মাসাত্তা নামে একটি অতুলনীয় প্রমোদ-প্রাসাদ নির্মাণ করে ভোগ-বিলাসে নিমগ্ন থাকতেন। প্রাসাদের মধ্যবর্তী একটি চৌবাচ্চা পানি ও মদে পরিপূর্ণ থাকত এবং মা’বাদের সঙ্গীত শ্রবণে খলিফা এতই আত্মবিভোর এবং দিশেহারা হয়ে যেতেন যে, তিনি শিরস্ত্রাণ পরিত্যাগ করে চৌবাচ্চায় লাফিয়ে পড়তেন এবং অঞ্জলিপূর্ণ করে আকণ্ঠ মদ্য পান করেছেন।

দ্বিতীয় ওমর ব্যতীত সমস্ত উমাইয়া খলিফাই মৃগায়, মদ, নারী ও সঙ্গীতের প্রতি আসক্ত ছিলেন। মুয়াবিয়ার অযোগ্য পুত্র প্রথম ইয়াজিদ নিয়মিত মদ্য পান করতেন এবং এই অনৈসলামিক প্রথা রাজদরবারে প্রথম প্রকাশ্যভাবে সংঘটিত হতে থাকে বল তাকে ‘মদ্যপায়ী ইয়াজিদ’ (Yazid of wines) বলে অভিহিত করা হয়। অধর্ম, অনাচার এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপ কখনও কখনও মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। দ্বিতীয় ওয়ালিদ একদিকে কুরআন শরীফ খুললে “সমস্ত বিপথগামী নৃপতি ধ্বংস হবে” আয়াতটি নজরে পড়লে তিনি আক্রোশবশে তীর-ধনুকের সাহায্যে পবিত্র গ্রন্থটি ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন।

জোসেফ হেল বলেন, “উমাইয়া রাজত্বের শেষের দিকে পুরুষ ও রমনীর অবাধ মেলামেশা যখন গুপ্ত প্রেম এবং ষড়যন্ত্রে পরিণত হল তখনই আমরা সহসা হারেম প্রথা এবং নপুংসকদের প্রভুত্বের সূচনা দেখতে পাই।” ভন ক্রেমার বলেন, “ওয়ালিদের সময় হারেম প্রথা প্রচলিত হয় এবং বায়জানটাইনদের প্রথার অনুকরণে তাঁর অন্তঃপুরে নপুংসক প্রহরী রাখবার প্রথাও চালু হয়।” এভাবে অনৈসলামিক কার্যকলাপ- মদ্যপান, সঙ্গীত, হারেম ও নপুংসক প্রথা প্রবর্তনের ফলে খিলাফতের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে।

ক্রীতদাস প্রথম উমাইয়া খিলাফতের সমাজ জীবনকে কলুষিত করে। আমীর আলী বলেন, “এটি আদর্শের অধঃপতন ঘটায় এবং নৈতিক বন্ধনকে ক্ষীণ করে।” উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মুয়াবিয়ার পিতা আবু সুফিয়ানের অবৈধ সন্তান জিয়াদ সম্ভবত তায়েফের একজন গণিকার পুত্র, এই কারণে সৈয়দ আমীর আলী তাকে ‘জারজ সন্তান’ (The Bastard) বলে অভিহিত করেন। দ্বিতীয় ওমর ব্যতীত মোটামুটি সকল খলিফার উপপত্নী (Concubine) ছিল। তৃতীয় ইয়াজিদ ইসলামের সর্বপ্রথম খলিফা যিনি একজন ক্রীতদাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দুজন উত্তরাধিকারীও অনুরূপভাবে জন্মগ্রহণ করেন। হিট্টি বলেন, “সভ্যতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পাপসমূহ বিশেষভাবে মদ, নারী এবং সঙ্গীত মরুভূমির সন্তানদের আকৃষ্ট করে এবং নবীন আরব সমাজের জীবনীশক্তিকে ক্ষীন করতে থাকে। “

(চ) খলিফাদের অযোগ্যতা, মন্ত্রীদের অদক্ষতা ও সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতা : প্রথম উমাইয়া খলিফাগণ যেরূপ বিচক্ষণ, কর্মদক্ষ এবং সংগঠক ছিলেন পরবর্তী খলিফাগণ বিশেষ করে মারওয়ান বংশীয় নৃপতিগণ ছিলেন অযোগ্য, অপদার্থ ও পাপাসক্ত। দ্বিতীয় ইয়াজিদের পর হতে উমাইয়াদের অধঃপতন শুরু হয় কিন্তু হিশাম স্বীয় দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা এবং কূটনৈতিক ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এই অধঃপতনকে সাময়িকভাবে রোধ করতে সক্ষম হন; কিন্তু তাঁর মৃত্যু উমাইয়া বংশের পতনকে ত্বরান্বিত করে। উল্লেখযোগ্য যে, ৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে হিশামের মৃত্যু হতে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জাবের যুদ্ধে দ্বিতীয় মারওয়ানের পরাজয় ও হত্যা পর্যন্ত আট বছরে চারজন খলিফা— দ্বিতীয় ওয়ালিদ (৭৪৩-৪৪), তৃতীয় ইয়াজিদ (৭৪৪ এপ্রিল-সেপ্টেম্বর), ইব্রাহিম (৭৪৪ খ্রি.) এবং দ্বিতীয় মারওয়ান (৭৪৪-৫০ খ্রি.) রাজত্ব করেন। এই সমস্ত দুর্বল, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী এবং চরিত্রহীন নৃপতিগণ অভ্যন্তরীণ অরাজকতা দমন করতে অক্ষম ছিলেন। একদিকে মন্ত্রীদের স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থলোলুপতা এবং অকর্মণ্যতা; অপরদিকে সৈন্যবাহিনীর অদক্ষতা ও অসন্তোষ উমাইয়া পতনকে ত্বরান্বিত করে। একথা অনস্বীকার্য যে, প্রথম যুগের উমাইয়া সৈন্যাধ্যক্ষ আমর, মুসা, তারিক, কুতাইবার তুল্য কোন সেনাপতি উমাইয়া যুগের শেষের দিকে ছিলেন না। এর জন্য দ্বিতীয় ওমরের অসামরিক এবং শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতিই (Pacifist policy) অনেকাংশে দায়ী; কারণ এই নীতি উমাইয়া সামরিক ক্ষমতাকে সীমিত করে।

(ছ) আরব-অনারব বৈষম্য : উমাইয়া রাজত্বে অনারবদের প্রতি আরবদের বৈষম্যমূলক আচরণ ও মনোভাব উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। ইসলামের সাম্য, মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হলে উমাইয়া খলিফাগণ আরব ও অনারবদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারতেন না। বিজিত অঞ্চলে আরব প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে অনারবগণ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে। দ্বিতীয় ওমরের শাসনকাল ব্যতীত উমাইয়া যুগে অনারবগণ কেবল পদাতিক বাহিনীতে যোগদান করতে পারত। তারা ইসলাম গ্রহণ করেও জিজিয়া (হাজ্জাজের শাসনকালে) এবং খারাজ দিতে বাধ্য থাকত। তারা আরবদের মত নির্দিষ্ট ভাতা পেত না। পারস্যবাসীরা ইসলামের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেও আরবদের মত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারত না। কিন্তু প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী গর্বিত পারস্যবাসী আরবদের বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। উমাইয়া পতনের বীজ এভাবে খারিজি, মাওয়ালী ও আব্বাসীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম পারস্যের খোরাসানে ছড়াতে থাকে। ভন ক্রেমার বলেন, “অন্য যে-কোন ঘটনা অপেক্ষা শাসিত প্রজাদের প্রতি উমাইয়া খলিফাগণের বিমাতাসুলভ আচরণ উমাইয়া বংশের অস্তিত্বকে বিপদসঙ্কুল করে তুলেছিল। এটি এমন ভয়াবহ সামাজিক বিদ্রোহের সুচনা করেছিল যা শুধু উমাইয়াগণের বিরুদ্ধে নহে, সমস্ত আরব শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল।

(জ) হাশিমীয় ও উমাইয়া কলহ : রাসূলে করীমের জন্মের পূর্বেই কুরাইশ বংশের দুই শাখা হাশিমী ও উমাইয়া বংশধরদের মধ্যে কলহ চলতে থাকে। উমাইয়া রাজত্বে এই দুই গোত্রের দ্বন্দ্ব অহেতুক রক্তপাতের সুত্রপাত করে। আবু সুফিয়ানের বিরোধিতা, তার পত্নী হিন্দা কর্তৃক নবী করীমের চাচা আমীর হামজার কলিজা ভক্ষণের বীভৎসতা, ওসমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে হযরত আলীর বিরোধিতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ইমাম হাসানকে বিষপ্রয়োগে হত্যার ষড়যন্ত্র, কারবালার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে ইয়াজিদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ, হযরত আলী এবং তাঁর পরিবারের প্রতি অভিসম্পাত প্রথা প্রবর্তন প্রভৃতি হাশেমী গোত্রের প্রতি উমাইয়া গোত্রের হিংসা, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব এবং বিরুদ্ধাচরণের উজ্জ্বল প্রমাণ। গোত্রীয় কোন্দল থেকেই ইসলাম শিয়া এবং সুন্নী এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীকালে খারিজি, শুবাইয়া (মাওয়ালী), প্রতিশোধ গ্রহণকারী (Penitent) প্রভৃতি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। মদিনা হতে দামেস্কে রাজধানী স্থানান্তর, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, কুরআন ও হাদিসের নীতির স্থলে অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রভৃতি রক্ষণশীল ইসলামী ভাবধারার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ বলা যেতে পারে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র আরব সাম্রাজ্যে পরিণত হয় এবং উমাইয়াগণ গোত্রীয় স্বার্থকে ধর্মীয় আদর্শের উপরে স্থান দিত। গ্রুনিবাম বলেন, “মুয়াবিয়া খিলাফতকে একটি সাধারণ রাজতন্ত্রে পরিণত করেন।”

(ঝ) মুদারীয় এবং হিমারীয় গোত্রীয় দ্বন্দ্ব : বার্নার্ড লুইস বলেন, “যে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতায় উমাইয়া শাসনের পতন হল তা ছিল আরব গোত্রসমূহের ক্রমাগত দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা।” ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে উত্তর আরবের গোত্রগুলো ইরাকে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। সেখানে তারা টাইগ্রীস নদীর তীরে ‘দিয়ার-ই-রাবিয়া’ (রাবিয়া গোত্রের বাসভূমি) এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ‘দিয়ার-ই-মোজার’ (মোজারী গোত্রের আবাসভূমি) প্রতিষ্ঠিত করে। দক্ষিণ আরবের গোত্রগুলো সিরিয়ায় বসবাস করতে থাকে। এরা ইয়েমেনী বা হিমারীয় বলে পরিচিত। এদের মধ্যে প্রধান গোত্র ছিল কালব। খোরাসানের আরবগণ অধিকাংশই আসে উত্তর আরব হতে। মুয়াবিয়ার উমাইয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠার ফলে রাসূলে করীম (স) ও ধর্মপ্রাণ খলিফাদের আমলে যে গোত্রকলহ বন্ধ ছিল তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। বস্তুত গোত্র এবং রাজবংশের স্বার্থে উমাইয়া খলিফাগণ সুপ্ত বিদ্বেষকে উস্কানি দ্বারা জাগিয়ে তোলেন এবং এক গোত্রকে অপর গোত্রের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেন। দ্বিতীয় ওমর ইয়েমেনী, সিরিয়াবাসী এবং মুদারীয় ইরাকবাসীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হন। মা’দের বিরুদ্ধে মুদার হতে উদ্ভূত মুদারীয় গোত্রের শাখা হেজাজের বানু-কুরাইশদের সঙ্গে দক্ষিণ আরব ও হিমারীয়দের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অপ্রতিহত গতিতে চলে। অধিকাংশ উমাইয়া খলিফা মুদারীয়দের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন; কিন্তু হিশাম এতে সুষ্ঠু, নির্দিষ্ট এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ গোত্রনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন নি। গোত্রনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মুয়াবিয়ার প্রতিষ্ঠিত রাজ্যকে গোত্রীয় রাষ্ট্র (Tribal state) বলে অভিহিত করা হয়। বায়জানটাইন ঐতিহাসিক থিওফেনাস (Theophanes) মুয়াবিয়াকে রাজা বা সম্রাটের পরিবর্তে ‘প্রথম উপদেষ্টা’ অথবা Proto-symbolous বলে আখ্যায়িত করেন।

গোত্রকলহ উমাইয়া বংশের ইতিহাসকে রক্তাক্ত এবং বিভীষিকাপূর্ণ অধ্যায়ের দিকে ঠেলে দেয়। হিমারীয় গোত্রের লোকের বাগান থেকে একজন মুদারীয় একটি তরমুজ চুরি করলে দামেস্কের দুই গোত্রের মধ্যে দুই বছরব্যাপী রক্তাক্ত সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। সুদূর স্পেনেও এই দ্বন্দ্ব বিস্তৃত হয়। মুবিনা নামক স্থানে একজন মুদারীয় এক ইয়েমেনীয় লোকের বাগান হতে একটি দ্রাক্ষালতা কুড়াবার অজুহাতে সেখানে কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধ হয়। এই গোত্রকলহ সাহারা মরুভূমির প্রান্তরে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় এবং সিসিলির সমুদ্র সৈকতেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে উমাইয়া কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হয়ে রাজবংশের পতনকে ত্বরান্বিত করে। এই দ্বন্দ্ব হিশামের রাজত্বে ফ্রান্সে মুসলমানদের সমরাভিযানকে ব্যাহত করে এবং স্পেনের উমাইয়া খিলাফতকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

(ঞ) সাম্রাজ্যের বিশালতা এবং দ্বিকেন্দ্রীকরণ : স্পুলারের মতে, “বিজয়ের ফলে সাম্রাজ্যের সীমানা সুদূরপ্রসারী হলে আয়তনের জটিলতা বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় শাসক ব্যতীত অপর কোন শাসকের আমলে বিচ্ছিন্নতাবাদ উদ্ভূত না হয়ে পারে না।” আরব ভূখণ্ডের বাইরে ইসলাম প্রসারিত হয় সর্বপ্রথম হযরত ওমরের খিলাফতে; কিন্তু আল-ওয়ালিদের রাজত্বকালকে ইসলামের সম্প্রসারণের যুগ বলা হয়ে থাকে। চীন সাম্রাজ্যের সীমান্ত থেকে ফ্রাঙ্কো সম্রাটের এলাকা অবধি মুসলিম সাম্রাজ্যে বিভিন্ন মতবাদ, সমাজ, জাতি ও ধর্মাবলম্বী প্রজাগণ বসবাস করতে থাকে। ইসলাম গ্রহণ করলেও স্বার্থান্বেষী নব-দীক্ষিতগণ তৌহিদ বর্জন করতে দ্বিধা করত না। খোরাসানের সগোদ জাতির উপর হিশাম পুনরায় জিজিয়া কর ধার্য করলে তারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে গোত্রীয় ধর্মে আস্থা স্থাপন করল। গ্রুনিবাম বলেন, “জনসংখ্যার বৃদ্ধি বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অবস্থান সৃষ্টি করে।” বিশাল উমাইয়া সাম্রাজ্যে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, অগ্নিউপাসক, শুবাইয়া, পৌত্তলিক, মুসলমান প্রভৃতি সম্প্রদায় বসবাস করতে থাকে। উত্তর আফ্রিকা, লেবানন ও স্পেনে খ্রিস্টানগণ উমাইয়া খিলাফতের বিরোধিতা করে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, দ্বিতীয় ওমরের শাসনকাল ব্যতীত উমাইয়া খিলাফতে মোটামুটিভাবে দারুল হরব এবং দারুল-ইসলামের মধ্যে বিশেষ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। অবশ্য একথা সত্য যে, খ্রিস্টানদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে, এমনকি খ্রিস্টান মহিলাকে বিবাহ করতে উমাইয়া খলিফাগণ ইতঃস্তত করতেন না। মুসলমান এবং অমুসলমানদের বিবাহ উমাইয়া বংশের পতনের অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে। সিংহাসনকে কেন্দ্র করে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, রাজ দরবারের ষড়যন্ত্র এবং গুপ্তহত্যা চলতে থাকে। রক্তের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে বংশীয় কৌলীন্যের অবনতি ঘটে এবং পক্ষান্তরে রাজবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

(ট) শিয়া সম্প্রদায়ের অসন্তোষ ও বিরোধিতা : উমাইয়া বংশের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ, প্রথম উমাইয়া খলিফাগণ হযরত আলী, ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের উপর যে নির্যাতন পরিচালিত করেন তাতে শিয়া সম্প্রদায় তাদের প্রতি কখনই আনুগত্য স্বীকার করে নি। ‘অনুশোচনাকারী’ দলের নেতা মুখতার প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে আবদুল মালিকের রাজত্বে অশান্তি সৃষ্টি করে। মক্কা ও মদিনার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা দ্বারা রাসূলে করীমের বংশধরদের দাবিকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করবার চেষ্ঠায় মুখতার ব্যর্থ হলেও তিনি ইমাম হুসাইনের হন্তা ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে নিহত করেন। লুইসের মতে, “মুখতারের বিদ্রোহ রক্তাক্ত সংগ্রামেই পরিসমাপ্ত হল; কিন্তু তাঁর প্রচারিত খিলাফতের দাবি সম্পর্কিত ভাবধারা সুদৃঢ় হয় এবং উমাইয়া খিলাফতের পরবর্তীকালে মুহাম্মদ ইবন-আল-হানাফিয়া এবং বিবি ফাতেমার বংশোদ্ভূত হযরত আলীর অসংখ্য সমর্থক এবং মিথ্যা প্রচারকগণ ইসলামের একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মুসলমানের আনুগত্য দাবি করে।” ক্ষুব্ধ, নির্যাতিত এবং বঞ্চিত শিয়া সম্প্রদায় সর্বপ্রথম ইরাকে প্রচারণা করে জনসমর্থন লাভ করে এবং উমাইয়াদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিরোধী শিয়া মতবাদ পারস্যে বিস্তৃতি লাভ করে এবং মাওয়ালী ও আব্বাসীয়গণ একে মূলধন করে উমাইয়া বংশের ধ্বংস সাধন করে।

(ঠ) খারিজিদের বিরুদ্ধাচরণ : সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আলী দলত্যাগ করে (খারাজ) যে সম্প্রদায় মুয়াবিয়া প্ররোচিত দুমার মীমাংসায় অনাস্থা স্থাপন করে তাদেরকে খারিজি বলা হয়। উমাইয়া রাজত্বের অভ্যুত্থান হতে পতন পর্যন্ত এই সম্প্রদায় সততা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। বলপূর্বক খিলাফত দখল, রাসূলে করীমের বংশের প্রতি অবমাননা প্রভৃতি কারণে উমাইয়াদের পার্থিব শাসন পদ্ধতিতে তারা ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। মুয়াবিয়া ও আবদুল মালিকের কঠোরতা এবং নৃশংসতা সত্ত্বেও খারিজি বিপ্লবকে ধূলিসাৎ করা সম্ভব হয় নাই। এজন্য বহু বছর পর হিশামের রাজত্বে পুনরায় খারিজি বিদ্রোহ তীব্রতর আকার ধারণ করে। জিয়াদ-ইবন-আবীহ এবং হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ নির্যাতন ও রক্তপাত সত্ত্বেও খারিজিদের দমন করতে পারেন নি। খারিজিগণ আযরাকী এবং শুবাইয়া নামেও পরিচিত ছিল। পূর্বদেশীয় শাসনকর্তারূপে হাজ্জাজ শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েমের জন্য ঐতিহাসিকদের মতে কমপক্ষে ১,১২,০০০ লোককে হত্যা করেন। এই নজিরবিহীন নৃশংসতা ও বর্বরতা উমাইয়াদের বিরুদ্ধে উমাইয়া বিরোধী সম্প্রদায়গুলোকে শক্তিশালী করে। উমাইয়া বংশের পতনে তারা মাওয়ালী এবং আব্বাসীয়দের সঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।

(ড) আব্বাসীয় আন্দোলন : উমাইয়া সাম্রাজ্যের সর্বত্র যখন বিদ্রোহ, কলহ, গৃহযুদ্ধ ও অসন্তোষের দাবানল জ্বলে উঠে তখন আব্বাসীয়গণ প্রচারণাকার্য শুরু করে। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচা আল-আব্বাসের বংশধরগণ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে খিলাফত দাবি করেন। তাঁরা প্রচারণা করতে লাগলেন যে, হযরত আলী ও আব্বাসের বংশধরগণ উভয়েই হাশিমী বংশের অন্তর্ভুক্ত। মর্মর সাগরের তীরে হুমাইয়া নামক একটি নিরাপদ গ্রামকে কেন্দ্র করে প্রথমে এই ‘উমাইয়া বিরোধী আব্বাসীয় গুপ্ত প্রচারণা’ শুরু হয়। অনারব মুসলমানগণ এবং বিশেষ করে পারস্য-মুসলমানদের অসন্তোষের যথেষ্ট কারণ ছিল। আরব মুসলমানের অনুরূপ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়ে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের পর্যায়ে গণ্য হয়। গ্রুনিবাম বলেন, “ধর্মান্তরিত হবার ফলে মাওয়ালিগণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা লাভ করতে পারে নাই, যদিও মহানবীর গণতান্ত্রিক বাণীতে তাদের অনুরূপ অধিকার প্রদানের প্রতিশ্রুতি ছিল। মাওয়ালী যোদ্ধাগণ ভরণ-পোষণ বাবদ ভাতা এবং লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির অংশ পেত, কিন্তু অবসর ভাতা পেত না। আরবগণ অশ্বারোহী যোদ্ধা ছিল, কিন্তু তাঁরা পদব্রজে যুদ্ধ করত।” হিট্টি যথার্থই বলেন, “এই সমস্ত অসুখী নব-দীক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে শিয়া আব্বাসীয় মতবাদের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে।” ইরাক হতে শিয়া মতবাদ পারস্যের মাওয়ালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশেষ করে খোরাসান অঞ্চলে এটি আব্বাসীয় প্রচারণার রূপ ধারণ করে। পুনরায় হিট্টি বলেন, “শিয়া, খোরাসানবাসী এবং আব্বাসীয় শক্তির সমন্বয়ে উমাইয়া রাজত্বের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসল। আবু মুসলিম নামক একজন ইরানী মাওয়ালীর ঐকান্তিক প্ররোচনায় আব্বাসীয়দের প্রচারণা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং প্রকাশ্যে উমাইয়া প্রভুত্ব খণ্ডন করবার প্রয়াস প্রায়। আবু মুসলিমের দূরদর্শিতা, কর্মদক্ষতা, রণনৈপুণ্য ও অসাধারণ ব্যক্তি ব্যতীত আব্বাসীয়গণ খিলাফত লাভ করতে পারত না।” আমীর আলী বলেন, “যে অহমিকা এবং তিক্ত সম্পর্ক মুদারীয় এবং হিমারিয়গণকে উত্তেজিত করেছিল তাকে সুকৌশলে আপন কাজে লাগাবার জন্য ম্যাকিয়াভেলীর মত দূরদর্শিতা আবু মুসলিমের ছিল।” আব্বাসীয় বংশের নেতা ইব্রাহিম-ইবন-মুহাম্মদ-বিন-আলী আবু মুসলিমকে তাঁর প্রতিনিধি ও প্রচারক নিযুক্ত করলে তিনি আলী, ফাতেমী, সুন্নী, মাওয়ালী, খারিজি প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়কে স্বীয় পতাকাতলে আনয়ন করেন। খোরাসানে আব্বাসীয়গণ শোক নির্দেশক কাল পতাকা উড্ডীন করে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে মার্ভ দখল করেন। মারওয়ান কর্তৃক ইব্রাহিম নিহত হলে উমাইয়া বিরোধী কার্যকলাপ আরও সুসংঘবদ্ধ হয় এবং আবু মুসলিম ইরাক অধিকার করেন। অতঃপর ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে কুফা মসজিদে আবুল আব্বাসকে খলিফা বলে ঘোষণা করা হয়। খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি জাব নদীর পূর্বতীরে উমাইয়াদের সঙ্গে আবু মুসলিমের বাহিনীর সংঘর্ষ হয় এবং দ্বিতীয় মারওয়ান পরাজিত ও পরে নিহত হন। এরূপে উমাইয়া রাজ্যের পতন হয়। উমাইয়া বংশের পতনের ফলাফল উল্লেখ করে হিট্টি বলেন, “আরববাদী নীতির পতন হল। কিন্তু ইসলাম অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকল এবং আন্তর্জাতিক ইসলামের ছদ্মবেশে ইরানীদের বিজয়-কেতন চলতে থাকে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *