প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

তৃতীয় অধ্যায় : প্রথম ইয়াজিদ ও দ্বিতীয় মুয়াবিয়া (৬৮০-৬৮৪ খ্রি.)

তৃতীয় অধ্যায় – প্রথম ইয়াজিদ ও দ্বিতীয় মুয়াবিয়া [৬৮০-৬৮৪ খ্রি.]

প্রথম ইয়াজিদ (৬৮০-৬৮৩ খ্রি.)

সিংহাসনারোহণ : ইমাম হাসানের সাথে সম্পাদিত সন্ধি-চুক্তিতে মুয়াবিয়ার পর ইমাম হুসাইনের খিলাফত লাভের শর্ত সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত হলেও মুয়াবিয়া এর অবমাননা করে স্বীয় অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়ার মৃত্যু হলে ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। খিলাফতে অভিষিক্ত হয়ে ইয়াজিদ মদিনায় যাঁরা আনুগত্য প্রদর্শনে অনীহা প্রকাশ করেন তাঁদের বশ্যতা স্বীকার করবার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। হযরত আবুবকর ও হযরত ওমরের পুত্রগণ ইয়াজিদের আদেশ মেনে নিলেও আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইর এবং ইমাম হুসাইন অস্বীকার করে মদিনা ত্যাগ করে মক্কা গমন করেন।

ইয়াজিদের সাথে ইমাম হুসাইনের বিরোধ : মহানবীর দৌহিত্র এবং হযরত আলীর কনিষ্ঠ পুত্র ইমাম হুসাইন ছিলেন ধর্মপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, উদার, নম্র, সৎ ও অকপট। অপরদিকে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ ছিলেন পাপাসক্ত, অত্যাচারী ইন্দ্রিয়পরাণ, নীতিজ্ঞানহীন, মদ্যপায়ী ও হৃদয়হীন। ভনক্রেমারের মতে, “মুয়াবিয়ার মত জ্ঞানী ও বিচক্ষণ পিতার পক্ষে তাঁর অযোগ্য ও পাপাসক্ত পুত্রকে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন ঐতিহাসিকদের নিকট সত্যই দুর্বোধ্য।” ইয়াজিদের উত্তরাধিকারকে আরব গোত্র এবং ইমাম হুসাইন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অন্যায় বলে অভিহিত করেন। তাঁরা দামেস্কে প্রতিনিধি প্রেরণ করে মুয়াবিয়ার চুক্তি ভঙ্গ এবং ইয়াজিদের উত্তরাধিকারকে মানবতাবিরোধী ও নীতিজ্ঞানহীন পদক্ষেপ বল প্রতিবাদ করেন। অকৃত্রিম ও মৌলিক ইসলামী আদর্শের ব্যুহ মক্কা ও মদিনায় মহানবীর দৌহিত্রের খিলাফত লাভ ন্যায়সঙ্গত বলে জনমত গঠন করা হয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থাকে কার্যকর করবার জন্য অধার্মিক ও দুরাত্মা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হযরত আলীর সমর্থকগণ ইমান হুসাইনকে সমর্থন করতে থাকে। এর ফলে হিট্টির ভাষায়, “মৃত আলী জীবিত আলী অপেক্ষা বেশি কার্যকর প্রমাণিত হল” (“All dead proved more effective than Ali living”)।

দুর্নীতিপরায়ণ, অত্যাচারী ও পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের কুশাসনে কুফাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং নিজেদের স্বার্থে ইমাম হুসাইনকে সমর্থন জ্ঞাপন করে। চঞ্চল, চপলমতি ও অস্থিরমতি ইরাকীদের প্রতি আস্থা না রাখবার জন্য ইমাম হুসাইনের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষিগণ তাঁকে অনুরোধ করেন। আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইর খলিফা হবার মানসে ইমাম হুসাইনকে কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কুফার গমন করবার জন্য প্রলুব্ধ করেন। কুফার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবার জন্য ইমাম হুসাইন তাঁর চাচাত ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে প্রেরণ করেন। কুফাবাসিগণ মুসলিমকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আগমন করবার জন্য পত্র দ্বারা অনুরোধ জানায়। কিন্তু পরে চঞ্চলমতি ও বিশ্বাসঘাতক কুফাবাসী তাদের শাসনকর্তা ওবায়দুল্লাহ-বিন-জিয়াদের পক্ষ সমর্থন করে এবং মুসলিম নিহত হন।

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা

কারবালা যুদ্ধের কারণ : প্রথমত, মুয়াবিয়ার শঠতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা কারবালা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ। ইমাম হাসানের সঙ্গে সন্ধিতে স্বাক্ষর করে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম হাসানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইমাম হুসাইন খলিফা হবেন। কিন্তু ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর এক বছর পূর্বে তিনি পবিত্র সন্ধিচুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। গোত্রীয় ও বংশীয় প্রভাবে তিনি এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, মদিনার পরিবর্তে দামেস্কে রাজধানী স্থাপনে সিরিয়ার গুরুত্ব হেজাজ অপেক্ষা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মৌলিক ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী কার্যকলাপে মক্কা ও মদিনার ধর্মভীরু, সৎ ও নিষ্ঠাবান সাহাবিগণ উমাইয়াদের অনাচার ও অনুদার মনোভাবের তীব্র নিন্দা করেন। সিংহাসন, নপুংসকদের দ্বারা রক্ষীবাহিনী, হারেম প্রথা, মদ্যপান, বিলাস-বাসন এবং ব্যভিচারে আদর্শ মুসলমানগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। ইয়াজিদ তার পিতা মুয়াবিয়ার মত সুদক্ষ শাসক ছিলেন না। কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নৃশংসতা তার চরিত্রকে কলুষিত করে। তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানেন। এ কারণে মক্কা ও মদিনার লোকেরা ইমাম হুসাইনকে সমর্থন করেন।

তৃতীয়ত, ইয়াজিদ পিতার গুণাবলির অধিকারী না হলে ইমাম হুসাইন তাঁর পিতা বীরোত্তম হযরত আলীর নির্ভীকতা, বীরোচিত স্বভাব, ন্যায়নিষ্ঠা, অকপট, উদার ব্যবহার ও ধর্মপ্রবণতা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। উমাইয়া বংশের নৃপতিদের মত তিনি অসাধুতা ও ষড়যন্ত্রের কৌশল জানতেন না। সিডিলট সত্যই বলেন, “উমাইয়া বংশধরগণ যে ষড়যন্ত্রমূলক কৌশলে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি (ইমাম হুসাইন) সেই গুণটিই কেবল জানতেন না।” লুইস অবশ্য বলেন, “ইয়াজিদ পিতার মত দক্ষ এবং সুযোগ্য শাসক ছিলেন”। আরব ঐতিহাসিকগণের মতে, “তিনি প্রথম বছর হুসাইন-বিন- আলীকে হত্যা, দ্বিতীয় বছর মদিনা লুণ্ঠন এবং তৃতীয় বছর কাবাগৃহের অবমাননা করেন।”

চতুর্থত, বার্নার্ড লুইস বনে, “জিয়াদ এবং বিশেষ করে তার পুত্র ওবায়দুল্লাহর কুশাসনে ইরাকি আরবদের সিরিয়ার আধিপত্যের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি করে এবং হযরত আলীর পুত্র হুসাইনের স্বপক্ষে আন্দোলন পরিচালিত করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থের জন্য আবদুল্লাহ-ইবন-যুবাইর ইয়াজিদের বিরোধিতা করে ইমাম হুসাইনকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে প্ররোচিত করতে থাকেন; অপরদিকে কুফাবাসীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে ইমাম হুসাইন সম্পূর্ণ আস্থা রেখে মারাত্মক ভুল করেন।

৪৫৬

পঞ্চমত, কারবালার যুদ্ধের অপর একটি কারণ কুফাবাসীদের কপটতা, অস্থিরমতিত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যাবলি। ইমাম হুসাইন স্বীয় চাচাত ভাই মুসলিমকে কুফার পরিস্থিতি যাচাই করবার জন্য কুফায় প্রেরণ করলে ওবায়দুল্লাহ কর্তৃক তিনি নিহত হন। কুফাবাসিগণ ইমাম হুসাইনকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ইয়াজিদের পক্ষ অবলম্বন করে। ইমাম হুসাইন কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেন নি।

হৃদয়বিদারক ঘটনা

ইমাম হুসাইন মুসলিমের পত্রে কুফাবাসীদের সাহায্যে আশ্বস্ত হয়ে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রী, পুত্র-পরিজন নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মুসলিমের হত্যা ও কুফাবাসীদের ইয়াজিদের পক্ষে যোগদানের বিচলিত না হয়ে তিনি রাজধানীর সন্নিকটে উপনীত হলে তামীম গোত্রের লোকেরা বাধা দান করে। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালায় ইমাম হুসাইন তাঁবু ফেললে প্রথমে ওমর ইবন-সা’দ বাধা দেন এবং পরে ওবায়দুল্লাহ ইমাম হুসাইন ও তাঁর পরিবারকে অবরুদ্ধ করেন। রক্তপাত বন্ধের জন্য ইমাম হুসাইন তিনটি প্রস্তাব করেন : প্রথমত, হয় তাকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হউক; নতুবা দ্বিতীয়ত, তুর্কী সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেওয়া হউক; তৃতীয়ত, অথবা ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তাঁকে দামেস্কে প্রেরণ করা হউক। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইমাম হুসাইনকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেন।

৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই অক্টোবর (৬০ হিজরীর ৯ই মহররম) কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হন। ইমাম হুসাইনের দলে ছিল মাত্র কয়েকজন অনুচর এবং কয়েকটি আরব গোত্রের সদস্যবৃন্দ। ওবায়দুল্লাহ তাদেরকে ফোরাত নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করলে ইমাম হুসাইনের শিবিরে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। ১০ই মহররম যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ভ্রাতুষ্পুত্র কাশেম প্রথমে শাহাদাত বরণ করেন এবং পরে পিপাসার্ত ইমাম হুসাইন পুত্র আসগরকে নিয়ে ফোরাত নদীতে পানি পানের জন্য অগ্রসর হলে শত্রুরা শরবিদ্ধ করে। শত্রুদের অপর একটি শরের আঘাতে তাঁর (ইমাম হুসাইনের) বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়। নিষ্ঠুর ও পাপিষ্ঠ সীমার তাঁর শিরশ্ছেদ করতে উদ্যত হলে ইমাম হুসাইনের নির্দেশে ঘাড়ের উপর তরবারি হেনে তাঁর মস্তকটি বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং তিনি ১০ই মহররম শাহাদাত বরণ করেন। একমাত্র পুত্র জয়নুল আবেদীন ব্যতীত পরিবারের সকল পুরুষই শহীদ হন। ইমাম হুসাইনের ছিন্ন মস্তক দামেস্কে প্রেরিত হয়। ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যার্পণ করলে কারবালায় দেহসহ তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এডওয়ার্ড গীবন বলেন, “সেই দূরবর্তী যুগে ও আবহাওয়ায় হুসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের অন্তরেও সমবেদনা সঞ্চার করবে।

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার গুরুত্ব : কারবালার নৃশংসতা সমগ্র মুসলিম জাহানে ত্রাসের শিহরণ জাগিয়ে তুলে। ন্যায়, সত্য, ধর্মনিষ্ঠার জন্য ইমাম হুসাইন আত্মাহুতি দেন। এই আত্মাহুতি সর্বকাল, সর্বদেশে একটি গৌরবোজ্জ্বল আদর্শরূপে পরিগণিত হয়। বলপূর্বক খিলাফত দখলকারী দুরাত্মা ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার না করে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবন বিপন্ন করেন। তিনি অসত্য ও অসাধুতার সাথে আপোষ করেন নি। গিলমান সত্যই বলেন, “ইমাম হুসাইনকে শহীদের সম্মান প্রদান করা হয়; তিনি উমাইয়াদের ঘৃণার শিকার হন এবং স্বজাতির স্বার্থে আত্মদান করেন।”

কারবালার বিষাদময় ও শোকাবহ হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব ইসলামের ইতিহাসে অপরিসীম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে সিংহাসনকে নিষ্কণ্টক করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টকোণে একে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, কারবালার যুদ্ধে জয়লাভ উমাইয়া বংশের জন্য ছিল পরাজয়ের নামান্তর। যে হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার বশবর্তী হয়ে উমাইয়াগণ হাশিমীদের খিলাফত হতে বঞ্চিত করে ছলে, বলে ও কৌশলে প্রজাতন্ত্র ধ্বংস করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ঠিক একই হিংসা ও ঘৃণার ফলেই উমাইয়া বংশ মাত্র ষাট বছরের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড উমাইয়াদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে রাসূলে করীমের আদর্শের প্রতি পদাঘাত বলে মনে করা হয়। এর ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হয়।

কারবালা প্রান্তরে হত্যাকাণ্ডকে উমাইয়াগণ হযরত ওসমানের হত্যার এবং পক্ষান্তরে বানু হাশেম গোত্রের উপর প্রতিশোধ বলে গণ্য করত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, উমাইয়াদের ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জাবের যুদ্ধে পরাজিত করে বানু হাশেম গোত্রের প্রতি যে অবিচার ও প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল আব্বাসীয়গণ তারই প্রতিশোধ গ্রহণ করে। বলা বাহুরৱ্য যে, এই ঘটনা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একটি বিপর্যয় সৃষ্টি করে। মূইর বলেন, “কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা কেবল খিলাফতের ভাগ্যই নির্ধারণ করে নি, এটি খিলাফত ধ্বংসের অনেক পরে মুসলিম জাহানের ভাগ্য নির্ধারিত করে।”

সিফ্ফিনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে তাদের নামকরণ হয় ‘সিয়াত আলী’ (Shiat Ali) অথবা আলীর দল এবং দলত্যাগী বা খারিজি সম্প্রদায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কারবালার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর হতে ইসলামে শিয়া ও সুন্নী নামে দুটি বিবদমান দলে বিভক্তির সূচনা হয়। হিট্টি বলেন, “হুসাইনের রক্তে তাঁর পিতার রক্ত অপেক্ষাও অধিকতর শিয়া মতবাদের বীজ নিহিত ছিল বলে প্রমানিত হয়েছে।” ১০ই মহরম শিয়া মতবাদের জন্মলাভ ঘটে। শিয়া মতবাদ অনুযায়ী রাসূলে করীমের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন হযরত আলী ও ইমাম হুসাইন। তাদের মতে, প্রথম তিনজন খলিফা হযরত আলীকে অন্যায়ভাবে খিলাফত হতে বঞ্চিত করেন। অপরদিকে সুন্নিগণ হযরত আবুবকর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান এবং হযরত আলীকে বৈধ খলিফা বলে স্বীকার করে এবং হযরত আলীর প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি প্রদর্শন করে উমাইয়াদের অনাচার ও নির্যাতনকে নিন্দা করে। সুন্নীদের মতে, ইয়াজিদ পাপীষ্ঠ ও অত্যাচারী হলেও প্রতিষ্ঠিত খিলাফতের বিরুদ্ধাচরণ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমকক্ষ। যা হউক, শিয়া-সুন্নীর আচার-অনুষ্ঠানে পার্থক্য ও মতামতের অনৈক্য ইসলামের সংহতি চিরতরে বিনষ্ট করে। শিয়া সম্প্রদায় কর্তৃক ১০ই মহররমকে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

বার্নাড লুইস বলেন, “এই ঘটনার (কারবালার যুদ্ধ) কোন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না; এর পরবর্তী ফলাফল ছিল বিস্ময়কর।” একই কথার প্রতিধ্বনি করে আমীর আলী মন্তব্য করেন, “কারবালার নির্মম হত্যাকাণ্ড ইসলামী দুনিয়ার সর্বত্র ত্রাসের সঞ্চার করে এবং পারস্যে এক জাতীয় চেতনাবোধের উন্মেষ ঘটায়। এই চেতনাবোধ পরবর্তীকালে উমাইয়াদের ধ্বংস সাধনে আব্বাসীয় বংশধরগণকে সহায়তা করে।” আল-মুখতারের ব্যর্থ বিদ্রোহ এবং পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় আবু মুসলিমের প্রচারণা এবং সর্বশেষে মধ্যযুগে পারস্যে শিয়া মতবাদের উদ্ভব প্রভৃতির সূত্রপাত হয় কারবালার রক্তাক্ত প্রান্তরে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, পারস্যের মাওয়ালিগণ কর্তৃক আরব শাসনের কবল হতে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা আব্বাসীয় বংশের প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করে।

কারবালার এই জঘন্য নিধনযজ্ঞ মক্কা ও মদিনার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উমাইয়া নৃশংতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলে। যে কুফাবাসী ইমাম হুসাইনকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সাহায্য দানে বিরত ছিল, তারাই ইয়াজিদের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। বসরাতে খারিজি দলও ইমাম হুসাইনের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হয়। এছাড়া আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইর খিলাফত দাবি করলে ইয়াজিদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হবার উপক্রম হয়। আবদুল্লাহ ইমাম হুসাইনকে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে প্ররোচিত করেছিলেন। পরে কারবালার যুদ্ধে ইমাম হুসাইন শাহাদাত বরণ করলে তিনি নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। মক্কা ও মদিনার অধিবাসী ইয়াজিদের নৃশংসতার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বিদ্রোহী হয়ে উঠে এবং আবদুল্লাহকে সমর্থন করে। ইয়াজিদ সংবাদ পেয়ে আবদুল্লাহর নিকট একজন দূত প্রেরণ করে তাঁকে দামেস্কে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইয়াজিদের কুমতলব বুঝতে পেরে তাঁর দূতকে বন্দী করে রাখেন।

ইয়াজিদের অনৈসলামিক কার্যকলাপে ধর্মভীরু মুসলমানগণ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে উঠেন। মক্কা ও মদিনাবাসী ইয়াজিদের পদত্যাগ দাবি করে এবং ইয়াজিদ কর্তৃক নিযুক্ত শাসনকর্তাকে বিতাড়িত করে দেয়। ইয়াজিদ ক্রুদ্ধ হয়ে মুসলিম-ইবন-উকবার নেতৃত্বে একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে হারবা নামক স্থানে দুই দলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সংখ্যাধিক্যহেতু মদিনাবাসিগণ ইয়াজিদের বাহিনীর নিকট পরাজয় বরণ করে। এ যুদ্ধে রাসূলের বহু সাহাবী প্রাণত্যাগ করেন। তিনদিন ব্যাপী ইয়াজিদের বর্বর সৈন্যগণ মদিনায় লুণ্ঠন ও অত্যাচার করে। রাসূল ও প্রথম খলিফাগণ যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ এবং অপরাপর ইমারত নির্মাণ করেন সেগুলো বিনষ্ট হয়। আমীর আলীর মতে, “যে শহর নবীকে আশ্রয় দান করেছিল এবং যা তাঁর জীবন ও নবুয়ত দ্বারা পবিত্র হয়েছিল তা এক্ষণে জঘন্যভাবে অপমানিত হল। নবীর বিপদের সময় যারা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তাঁরা এক্ষণে ন্যাক্কারজনক নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হলেন।”

মদিনাকে ধ্বংস ও অপবিত্র করে ইয়াজিদের রণোন্মত্ত বাহিনী মক্কার দিকে অগ্রসর হয়। আবদুল্লাহ নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করলে দুই মাস ধরে এই পবিত্র নগরী অবরোধ করে রাখা হয়। ইতোমধ্যে মুসলিমের মৃত্যু হলে সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন হুসাইন-ইবন-নুসাইর। ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২০শে সেপ্টেম্বর মক্কা দখল করে পবিত্র কা’বার অগ্নিসংযোগ করে ক্ষতিসাধন করা হয়। ইত্যবসরে ইয়াজিদের মৃত্যু সংবাদ মক্কায় পৌঁছলে খলিফা বাহিনী দামেস্কে প্রত্যাবর্তন করে। এর ফলে কা’বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা পায়। মদিনা লুণ্ঠন ও কা’বায় অগ্নিসংযোগ দুরাত্মা ইয়াজিদের অপর দুটি অপকীর্তি। হিট্টি বলেন, “অবরোধের ফলে কা’বাগৃহ অগ্নিসংযোজিত হয়, পবিত্র কৃষ্ণপ্রস্তর ত্রিখণ্ডিত হয়ে যায় এবং কা’বাগৃহ ক্রন্দনরতা রমণীর ভগ্নহৃদয়ের রূপ লাভ করে।” আল-ফাখরী, ভনক্রেমার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে ইয়াজিদের ক্ষণস্থায়ী রাজত্বের প্রধান তিনটি দুষ্কর্ম ছিল; প্রথম বৎসর ইমাম হুসাইনকে কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে হত্যা, দ্বিতীয় বছর মদিনা শহরে লুঠতরাজ এবং তৃতীয় বছর পবিত্র কা’বায় অগ্নি-সংযোগ দ্বারা অবমাননা। ইসলামের ইতিহাসে এই তিনটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই নিষ্ঠুর, ভয়াবহ এবং বীভৎস। এরই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন সুসংঘবদ্ধ হয়।

চারি বছর রাজত্ব করবার পর ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়াজিদ ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ইয়াজিদ ব্যক্তিগত জীবনে পাপাসক্ত ও দুশ্চরিত্র ছিলেন। নিষ্ঠুরতা, অধার্মিকতা, মদ্যপান ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা তাঁর চরিত্রকে কলুষিত করে। কারবালার নৃশংসতার জন্য খলিফা ইয়াজিদকে দায়ী করা হয়, কিন্তু মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের অধিনায়ক ছিলেন নিষ্ঠুর ও দুরাত্মা ওবায়দুল্লাহ। কারবালা হতে কয়েক শত মাইল দূরে অবস্থিত দামেস্কে খলিফা ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন নি। উপরন্তু, ইমাম হুসাইনের ছিন্ন মস্তকসহ তাঁর পরিবার- পরিজনকে দামেস্কে বন্দীরূপে হাজির করা হলে ইয়াজিদ তাঁদের মুক্ত করে সসম্মানে মদিনায় প্রেরণ করেন। তাঁর রাজত্বে এই বর্বরোচিত হত্যালীলা সংঘটিত হওয়ায় তাকে দোষারোপ করা হয়। অবশ্য একথা স্বীকার করতেই হবে যে, হাশেমী বিদ্বেষ তাঁর মজ্জাগত ছিল এবং উমাইয়া বংশের নিরাপত্তার জন্য সিংহাসনকে তিনি কন্টকমুক্ত করতে চান।

বার্নাড লুইস বলেন, “ইয়াজিদ রাজোচিত গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। তিনি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং তাঁর পুত্র খালিদ গ্রীক বিজ্ঞানের অসংখ্য পুস্তক সংগ্রহ করেন।” ইবন-কাতিরের মতে, ইয়াজিদ উদারপন্থী ও বাগ্মী ছিলেন। এতদসত্ত্বেও অনৈসলামিক কার্যকলাপ ও মৌলিক ইসলামী আদর্শকে ধ্বংস দ্বারা ইয়াজিদ নিঃসন্দেহে উমাইয়া বংশকে অসংখ্য শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত হতে সহায়তা করেন এবং পক্ষান্তরে এর অধঃপতনের সুচনা করেন।

দ্বিতীয় মুয়াবিয়া (৬৮৩–৬৮৪ খ্রি.)

৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া সিংহাসনে আরোহন করেন। রুগ্ন ও নম্র স্বভাবের খলিফা মাত্র তিন মাস শাসনকার্য পরিচালনা করেন। আবু সুফিয়ান বংশের শেষ খলিফা দ্বিতীয় মুয়াবিয়া অপদার্থ ও অকর্মণ্য ছিলেন এবং তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আবদুল্লাহ মক্কা, মদিনা, মিসর ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। এর ফলে উমাইয়া বংশ দুর্বল ও ধ্বংস হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর আবু সুফিয়ানের পিতা হারবের নামানুসারে হারবীয় বংশের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মারওয়ান-বিন-হাকামের নাম হতে হাকামীর শাখা খিলাফত লাভ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *