প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

প্রথম অধ্যায় : হযরত আবু বকর (রা) (৬৩২-৬৩৪ খ্রি.)

প্রথম অধ্যায় – হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) [ ৬৩২-৬৩৪ খ্রি. ]

হযরত আবুবকর (রা) এর প্রথম জীবন

হযরত আবুবকর (রা) ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত কুরাইশ বংশের তায়িম গোত্রে পবিত্র নগরী মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য নাম ছিল আবদুল্লাহ ও কুনিয়া এবং ডাক নাম আবুবকর। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ‘সিদ্দিক’ অর্থাৎ সত্যবাদী এবং ‘আতিক’ অর্থাৎ দানশীল নামে পরিচিত হন। হযরত (স) কে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল বলে পুরুষদের মধ্যে তিনি প্রথম বিশ্বাস করেন এবং রাসূলাল্লাহর মেরাজ গমন তিনি বিনা দ্বিধায় ও অকপটে বিশ্বাস করেন বলে মহানবী (স) তাঁকে ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। হযরত আবুবকরের পিতা ও সমান ইতিহাসে সাধারণত আবু কোহাফা নামে পরিচিত এবং প্রাক-ইসলামী যুগে তিনি সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মাতার নাম ছিল উম্মুল খায়েল সালমা। তাঁর পিতামাতা উভয়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

হযরত মুহাম্মদ (স) এর বাল্যসাথী হযরত আবুবকর (রা) ধীর-স্থির, পরোপকারী, অতিথিপরায়ণ এবং জ্ঞানী ছিলেন। চারিত্রিক পবিত্রতা ও মহত্ত্বের জন্য তিনি আরববাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। অপরের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন তাঁকে বিচলিত করত। সত্যবাদিতা ও সরলতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। হযরত আবুবকর এবং রাসূলুল্লাহ প্রাক ইসলামী যুগের অন্যতম ব্যক্তিদ্বয় যাঁরা মদ্য স্পর্শ করে নি। এই সমস্ত কারণে তিনি মহানবীর অতি প্রিয় সহচররূপে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। নিরক্ষর আরব-বাসীদের মধ্যে তিনি অন্যতম শিক্ষিত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। বংশ-পঞ্জী সম্বন্ধে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। কাপড়ের ব্যবসা করে তিনি পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করেন এবং ইসলাম গ্রহণের পর তা মুসলমানদের সেবায় নিঃস্বার্থভাবে ব্যয় করেন। কুরাইশদের মধ্যে অন্যতম ধনশালী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সম্পদ ছিল ৪০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা (দিরহাম)। নিঃসন্দেহে মক্কার কুরাইশদের মধ্যে তিনি প্রভাবসম্পন্ন, সম্পদশালী, শিক্ষিত ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।

৬১০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নিকট থেকে ঐশীবাণী লাভ করে উদাত্ত কণ্ঠে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আহ্বান জানালে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে হযরত আবুবকরই প্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।

ব্যবসা উপলক্ষে তিনি ইয়েমেনে অবস্থানকালে হযরত মুহাম্মদ (স) নবুয়ত লাভ করেন এবং সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে ইসলামে দীক্ষিত হন। মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিবি খাদিজা ও বালকদের মধ্যে হযরত আলী সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হযরত আবুবকর দ্বিধাহীন ভাবে এবং দ্রুত ইসলামে দীক্ষা লাভ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর প্রচারের ফলে ওসমান, যুবাইর, আবদুর রহমান ইবন আউপ, সা’দ ইবন-আবি-ওয়াক্কাস ইসলামে দীক্ষিত হন। তাঁর মতো উম্মুল খায়েরও তাঁর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বেলালসহ তিনি সর্বমোট সাতজন দাস-দাসীকে ক্রীতদাসের শৃঙ্খলমুক্ত করে স্বাধীনতা প্রদান করেন।

হযরত মুহাম্মদ (স) এর একনিষ্ঠ সেবক ও অনুরক্ত সাহাবী হযরত আবুবকর (রা) তাঁর সমস্ত জীবনকে ইসলামের সেবায় উৎসর্গ করেন। ধন-সম্পত্তি ইসলামের জন্য নিঃশেষে দান করে তিনি তৃপ্তি লাভ করেন। মহানবী বলেন, “আবুবকরের ধন-সম্পত্তি ব্যতীত অন্য কাহারও সম্পদ আমার উপকারে আসে নি।” হিজরতের পূর্বে তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি ছিল মাত্র ৫,০০০ রৌপ্যমুদ্রা, (দিরহাম)। কুরাইশদের বাধা সত্ত্বেও হযরত আবুবকর নিজ গৃহের আঙ্গিনায় মোসাল্লা নির্মাণ করে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “তাঁর আর্থিক ও ধর্ম প্রচারের আত্মত্যাগ তাঁকে মহানবীর মতই প্রিয় করে যে, ধর্মগুরু স্বয়ং তাঁর শিষ্যের গৃহে গমন করতেন।” হযরত ওমর (রা) বলেন, “ইসলামের সেবায় আবুবকরকে কেহ অতিক্রম করতে পারে নি।” একদা প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি নির্মমভাবে কুরাইশদের দ্বারা প্রহৃত হন। ইসলামের স্বার্থে তিনি মহানবীর আদেশে স্বদেশ ত্যাগ করে সুদূর আবিসিনিয়ায় নির্বাসিত জীবনযাপন করতেও প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু কুরাইশদের নির্যাতনে সহ্য করেও তিনি হযরতের প্রিয় সঙ্গীরূপে মক্কায় অবস্থান করেন।

ইসলামের মহানবীর প্রতি হযরত আবুবকরের গভীর শ্রদ্ধা এবং অনুরাগের বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। বিবি খাদিজা পরলোকগমন করলে হযরত মুহাম্মদ (স) মানসিক যন্ত্রণায় বিমূঢ় হয়ে পড়লে হযরত আবুবকর তাঁর নয় বৎসর বয়স্কা কন্যা বিবি আয়েশাকে নবীর সাথে বিবাহ দেন। উল্লেখযোগ্য যে বিবি আয়েশার বিবাহ জনৈক যুবাইর ইবন- মুতীনের সাথে স্থির হলেও হযরতের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ তিনি উক্ত বিবাহ বাতিল করে দেন।

হযরত মুহাম্মদ (স) এর পার্শ্বচর হযরত আবুবকর ইসলামের জন্য সমস্ত দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরতের সময় হযরত আবুবকর মহানবীকে সঙ্গদান করেন এবং সত্তর পাহাড়ের গুহায় উভয়ে একত্রে আত্মগোপন করে থাকেন। তিন দিন এবং তিন রাত গুহায় অবস্থান করার সময় হযরত আবুবকর গোপনে রাসূলুল্লাহর জন্য আহারের ব্যবস্থা করেন। মদীনায় গমনের পর ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মাণের জন্য তিনি একখণ্ড জমি ক্রয় করেন। নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধাভিযানে তিনি মহানবীকে সাহায্য করেন। মহানবী স্বয়ং যে সমস্ত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন, হযরত আবুবকরও তাতে সক্রিয় অংশ গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেন। বদর, উহুদ, খন্দক ও হুনাইনের সক্রিয় অংশ গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেন। বদর, উহুদ, খন্দক ও হুনাইনের যুদ্ধে তিনি অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরাককাষ্ঠা দেখান।

হুদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদনে তাঁর বিশিষ্ট অবদান ছিল। তাবুক অভিযানে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পত্তি যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। মক্কা বিজয়ে তিনি হযরত মুহাম্মদ তাঁর অসীম মর্যাদা ও প্রতিপত্তি পরিলক্ষিত হয় মহানবীর অসুস্থকালে ইমামতীর মাধ্যমে। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স) অসুস্থ হয়ে পড়লে পর পর তিন দিন হযরতের নির্দেশে হযরত আবুবকর ইমামতী করেন। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, এতে মহানবীর মনোবাঞ্ছা এভাবে প্রকাশ পায় যে, তিনি হযরত আবুবকরকে তাঁর উপযুক্ত উত্তরাধিকারী বিবেচনা করেন।

খলিফা নির্বাচন

হযরত মুহাম্মদ (স) এর ওফাতের পর সমগ্র মুসলিম জাহানে চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা উদ্ভব হয়। খোদা বক্সের ভাষায়, “হযরতের ইন্তেকালে ইসলাম জগতে এক ভয়াবহ এবং সংশয়পূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।” একদিকে তৌহিদবাদ অপরদিকে নব- প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। হযরতের মত অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অভাবে কি প্রকার মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তা উপলব্ধি করে হযরত ওমর (রা) উন্মুক্ত তরবারি হাতে দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, “যে বলবে হযরত মারা গেছেন, আমি তাঁর শিরচ্ছেদ করব।” হযরতের ইন্তেকাল সম্বন্ধে একটি কুরআনের আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, “মুহাম্মদ (স) পয়গম্বর ব্যতীত আর কিছুই নহেন এবং তাঁর পূর্বের সমস্ত পয়গম্বরগণ ইন্তেকাল করেছেন। (৩ : ১৪৩) হযরতের ওফাতের পর হযরত আবুবকর (রা) বিবি আয়েশার গৃহে গমন করে দেখিলেন যে, হযরত সত্যই ইন্তেকাল করেছেন। রাসূলুল্লাহর কপালে চুম্বন করে হযরত আবুবকর আক্ষেপ করে বললেন, “জীবিত অবস্থায় আপনি যেমন মিষ্ট ছিলেন, মৃত্যুর পরও আপনি তেমনি মিষ্ট রয়েছেন। অতঃপর সমবেত বিভ্রান্ত সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা যদি হযরত মুহাম্মদ (স) এর উন্নত হয়ে থাক তা হলে নিশ্চিতরূপে জানবে যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে এবং যারা আল্লাহর উপাসনা কর তারা জানবে যে, তিনি (আল্লাহ) চিরজীবী এবং মৃত্যুহীন।” হযরত আবুবকর হযরত মুহাম্মদ (স) এর নিশ্চিত মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে মুসলমানদের বাস্তবতাকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেন।

হযরত মুহাম্মদ (স) এর ওফাতের পর রাসূলের কোন জীবিত পুত্র সন্তান না থাকায় এবং কোন উত্তরাধিকারী মনোনীত না হওয়ায়, মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব নিয়ে একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হিট্টির মতে, “সুতরাং ইসলামকে সর্বপ্রথম খিলাফত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।” গণতান্ত্রিক ভাবধারায় প্রভাবান্বিত হয়ে রাসূলে করীম মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খলিফা অথবা প্রতিনিধি নির্বাচনের দায়িত্ব সমগ্ৰ মুসলমানদের উপর ন্যস্ত করে যান। খলিফা নির্বাচনে মুসলমানগণ ঐক্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয় নি এবং রাসূলের ওফাতের সাথে সাথে খিলাফত প্রশ্নকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দল গঠন শুরু হয়ে যায়। খলিফার দাবীদার যে কয়েকটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকে, তাদের মধ্যে মোহাজেরিন এবং আনসারগণ ছিল প্রধান। ইসলামের সংকটাপন্ন অবস্থায় সাহায্য এবং নবী করীমকে মদীনায় আশ্রয়দান করবার অজুহাতে আনসারগণ “ছাকিফা-বনি-সায়িদা” নামক কক্ষে সমবেত হয়ে খাজরাজ গোত্রের দলপতি সা’দ-বিন-আবু ওবায়দাকে মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত করবার জন্য দাবি জানান। অপরদিকে মোহাজেরগণ দাবি করেন যে, যেহেতু তাঁরা সর্বপ্রথম ইসলামে দীক্ষিত হন সেহেতু তাদের মধ্য থেকে খলিফা নির্বাচন করতে হবে। হযরত আলীর সমর্থকগণ প্রচারণা শুরু করে যে, হযরত আলী নবী করীমের চাচাত ভাই এবং জামাতা, তিনি নবীর অতি প্রিয় পাত্র এবং আপনদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন; এই সমস্ত কারণে আলী খিলাফতের ন্যায্য অধিকার। এছাড়া অভিজাত এবং সম্পদশালী মক্কার কুরাইশ বংশ পরবর্তী যুগে ইসলামের নেতৃত্ব দান করেন বলে তারাও দাবি করেন যে, তাদের মধ্য হতে খলিফা নির্বাচন করতে হবে।

খিলাফতকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জটিলতা চরমে পৌঁছলে হযরত আবুবকর হযরত ওমরকে সাথে নিয়ে আনসারদের নিকট গমন করেন এবং তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ইসলামের যুগসন্ধিক্ষণে আনসারদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র কুরাইশ বংশোদ্ভূত কোন ব্যক্তিকেই আরবের লোকেরা খলিফা বলে মেনে নিবে। কুরাইশ বংশে নবী করীমের জন্ম।” কুরাইশদের প্রভাব- প্রতিপত্তি, শৌর্যবীর্য, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ক্ষমতার কথা স্মরণ করে হযরত আবুবকর (রা) এই ধরনের উক্তি করেন। এতে আনসারগণ প্রস্তাব করেন যে, কুরাইশ এবং আনসারদের মধ্যে থেকে দুইজন উত্তরাধিকারী নির্বাচন করা হউক। হযরত ওমর (রা) এর প্রতিবাদ করে বলেন যে, “এক খাপে দুটি তরবারির স্থান হতে পারে না।” অনৈক্য, রাজনৈতিক অরাজকতাও অচলাবস্থা দূরীকরণের জন্য হযরত আবুবকর (রা) আবু ওবায়দা অথবা হযরত ওমরকে খলিফার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন। হযরত আবুবকরের বয়োজ্যেষ্ঠতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, সামাজিক কার্যকলাপ এবং ব্যক্তিগত প্রভাবের জন্য তাঁরা উভয়ে তাদের দাবি প্রত্যাহার করেন। এর পর প্রাচীন আরব প্রথা অনুযায়ী হযরত ওমর হযরত আবু বকরের হস্ত চুম্বন করে আনুগত্য স্বীকার করে তাঁকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন এবং অপর সাহাবীগণ দলে দলে এসে তাঁর নেতৃত্ব স্বীকার করেন। অপরদিকে আনসার দলের আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরাও হযরত আবুবকরকে খলিফারূপে স্বীকার করে নেয়। একমাত্র সা’দ বিন আবু ওবায়দা ব্যতীত অপর দলপতিগণ এবং মুসলিম জনতা তাঁকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে খলিফারূপে সমাদর জানাল। হযরত আবু বকরের খলিফা নির্বাচন প্রাক- ইসলামিক যুগের গণতান্ত্রিক রীতি-নীতিরই প্রতিফলন।

হযরত আবুবকরের নির্বাচনের যথার্থতা

হযরত আবুবকরের নির্বাচনে মুসলিম বিশ্বের প্রথম ভয়াবহ সংকট দূরীভূত হয়। কতকগুলো কারণে তাঁর খিলাফত প্রাপ্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ন্যাসঙ্গত ছিল; যেমন- (১) হযরত আবুবকরকে খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে নবী করীমের সুস্পষ্ট কোন নির্দেশ না থাকলেও পরোক্ষ ইঙ্গিত ছিল। কারণ, হযরত আবুবকরকে রাসূলের অসুস্থতার সময় নামায পরিচালনা করতে বলা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানই কেবলমাত্র ইমামতি করবার যোগ্য ছিলেন; (২) নবী করিম একবার সাহাবীদের উদ্দেশ করে বলেন, “নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মধ্যে প্রেম-ভক্তিতে আবুবকরকে শ্রেষ্ঠ মনে করি। আজ থেকে এই মসজিদের সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে যাক; শুধু খোলা থাকুক আবুবকরের দরজা।” এতে হযরত আবুবকরের ইসলাম-প্রীতি ও রাসূলের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য প্রমাণিত হয়; (৩) খলিফা পদপ্রার্থী ব্যক্তিদের মধ্যে হযরত আবুবকরই ছিলেন সর্বাপেক্ষা যোগ্য। বয়োজ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা, ধর্মপরায়ণতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, স্থিরমতিত্ব, বিজ্ঞজনোচিত সূক্ষ্ণদৃষ্টি, ব্যক্তিগত প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আবুবকর নির্বাচিত হন; (৪) আমীর আলী হযরত আলীর পক্ষ সমর্থন করে বলেন, “হযরত আলী খিলাফতে অধিষ্ঠিত হলে পরবর্তীকালের অনেক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক তিক্ততা ও রক্তক্ষয় এড়ানো সম্ভব হত।” এই মতবাদ খুব ভ্রান্তিকর, কারণ হযরত আবুবকরের তুলনায় হযরত আলী ছিলেন বয়সে তরুণ এবং অভিজ্ঞতায় অপরিপক্ক। হযরত আলীর মধ্যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার যথেষ্ট অভাব ছিল। উপরন্তু, ন্যায়সঙ্গত দাবিদার (Legitimists) দলের একমাত্র যুক্তি ছিল হযরত আলী ছিলেন রাসূলে করীমের জামাতা। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স) স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে কায়েম করবার জন্য তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন নি।

উদ্বোধনী ভাষণ

হযরত আবুবকরের (রা) খিলাফত লাভের ফলে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সঙ্কটময় পরিস্থিতির পরিসমাপ্তি ঘটে। খলিফা নির্বাচিত হয়ে তিনি সমবেত মুসলিম জনতার উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দান করেন- “আমি আপনাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নই, আপনাদের সকলের পরামর্শ এবং সহায়তাই আমার বিশেষভাবে কাম্য। আমি ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে কাজ করলে আপনারা আমাকে সমর্থন করবেন, অন্যায় পথে চললে সদুপদেশ দান করবেন। সত্যের অনুসরণ ও মিথ্যার বর্জন আপনাদের কাম্য। আমার দৃষ্টিতে ধনী-নির্ধন, সবল-দুর্বল সকলেই সমান এবং সকলের সাথেই আমি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে চাই। আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অনুশাসন মোতাবেক কাজ করলেই আপনারা আমাকে মেনে চলবেন; অন্যথায় আমি আপনাদের আনুগত্য দাবি করতে পারব না।”

হযরত আবুবকরের উদ্বোধীন ভাষণ মুসলিম জাহানের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ ছিল এই যে, স্বেচ্ছাচারী নীতির পরিপন্থী এবং গণতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হযরত আবুবকর (রা) পরামর্শ দ্বারা সমস্যা সমাধানের নীতি নির্ধারণ করেন। দ্বিতীয়ত ইসলামী শাসন প্রবর্তন করতে তিনি যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এতে ছিল। তৃতীয়ত, তিনি সামাজিক বৈষম্য দূর করে ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করবার প্রতিজ্ঞা করেন। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “অত্যুৎকৃষ্ট এই বক্তৃতার প্রতিটি শব্দই ছিল বুদ্ধিদীপ্ত এবং এর মুসলিম জাহানের নিকট আলোকের দিশারীস্বরূপ।”

আরবের অবস্থা

খিলাফতে অধিষ্ঠিত হবার পর হযরত আবুবকর (রা) কে নানারূপ জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। জনৈক আরব ঐতিহাসিক তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, “আরব সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়ে উঠে। ধর্মদ্রোহিতা এবং অসন্তোষ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিধর্মী এবং ইহুদীগণ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল এবং মুসলমানগণ রাখালবিহীন মেষকুলের ন্যায় ইতস্তত বিচরণ করতে থাকে। তারা সংখ্যায় ছিল নগণ্য কিন্তু তাদের দুশমন ছিল সংখ্যাতীত।” নব-দীক্ষিত আরব বেদুঈনদের অনেকে ইসলাম বর্জন করে পৌত্তলিকতায় ফিরে যায়। রাসূলে করীমের অন্তর্ধানে সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে বিদ্রোহ, অসন্তোষ, হিংসা, বিদ্বেষ, কোন্দল, উস্কানিমূলক তৎপরতা উত্তেরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবদ্দশায় তাঁর পালিত পুত্র জায়েদ-বিন-হারিস মুতা যুদ্ধে নিহত হন। হারিসের মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তিনি সিরিয়ায় একটি যুদ্ধাভিযান প্রেরণ করতে মনস্থ করেন এবং হারিসের পুত্র উসামাকে উক্ত বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ মনোনীত করেন। রাসূলে করীমের মৃত্যুতে উসামার অভিযান স্থগিত হয়ে যায় এবং হযরত আবুবকরের খিলাফতে তিনি পুনরায় অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।

সিরিয়া অভিযান

আরব ভূ-খণ্ডের উত্তরে অবস্থিত সিরিয়া ও ফিলিস্তিন রাজ্য ছিল বায়জানটাইন সাম্রাজ্যভুক্ত; শাসনকর্তা খ্রিস্টান হলেও এই প্রদেশদ্বয়ের অধিবাসী ছিল আরবি ভাষা ভাষী আরব। দক্ষিণ সিরিয়ার শাসকর্তা ছিলেন একজন আরব খ্রিস্টান। মুতা অভিযানে মুসলিম সেনাধ্যক্ষ জায়েদ-বিন-হারিস শত্রুপক্ষের আক্রমণে নিহত হন। এই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ এবং আরবের উত্তরে ইসলামের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠাকল্পে রাসূলে করীমের মনোনীত জায়েদ-পুত্র উসামাকে হযরত আবুবকর সিরিয়া অভিযানে প্রেরণ করেন। জুরাফ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে উসামা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। উসামার সেনাপতিত্বকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ দেখা দেয়। ইসলামের প্রতি গোত্রসমূহের বৈরীভাব এবং মদীনা সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে নেতৃস্থানীয় মুসলমাগণ উসামাকে সিরিয়ায় প্রেরণ যুক্তিসঙ্গত মনে করলেন না। উপরন্তু, তাঁরা উসামার মত একজন তরুণ ও অনভিজ্ঞ সেনাপতির উপর অভিযান পরিচালনার ভার অর্পণ করাকে সমীচীন নয় বলে মনে করেন। কিন্তু রাসূলে রকীমের নির্দেশ এবং অভিপ্রায় পূর্ণ করবার জন্য হযরত আবুবকর তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ৭০০ সৈন্য নিয়ে উসামা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রথমে কোজা গোত্রের লোকজনকে আক্রমণ করে উবনা নামক স্থানে গমন করেন। উবনা ভূ-মধ্যসাগরের নিকট আসকালন এবং জাফ্ফার মধ্যবর্তী শহর। সিরিয়া অভিযান সাফল্যমণ্ডিত হয় এবং দুই মাস পরে উসামা বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। সিরিয়া অভিযানে একদিকে বিদ্রোহী গোত্রসমূহ বুঝতে পারে যে, নব-প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্র রাসূলের মৃত্যুর পরও শক্তিশালী এবং সুসংবদ্ধ, অপরদিকে আবুবকরের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা এবং রাসূলে করীমের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের ফলে মুসলমানদের মনে আত্মবিশ্বাস এবং অনমনীয় মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। এরূপ মনোভাব থাকার ফলেই ইসলাম ধ্বংসকারী ভণ্ড নবীদের নির্মূল করা সম্ভব হয়।

মদীনার রক্ষণাবেক্ষণ

সিরিয়ায় অভিযান প্রেরিত হলে হযরত আবুবকর মদীনাকে সুরক্ষিত করার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। হযরত আলী, যুবাইর ও তালহাকে প্রহরী দলের অধিনায়ক নিযুক্ত করে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র মদীনাকে রক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করেন। বিদ্রোহী আরব গোত্র বানু আরস ও বানু জুবিয়ান উসামার সিরিয়া অভিযানে মদীনা অরক্ষিত রয়েছে মনে করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রাবাধা ও ধুলকাশাতে বিদ্রোহীরা সমবেত হলে হযরত আবুবকর স্বয়ং সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেন এবং বিদ্রোহী বেদুঈনদের যুদ্ধে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। বেদুঈন গোত্রগুলোকে পরাজিত করে হযরত আবুবকর (রা) মদীনাকে সুরক্ষিত করেন। হযরত আবুবকরের দৃঢ়সংকল্প এবং তেজোদ্দীপ্ত কার্যকলাপে ইসলামের সংহতি বজায় থাকে।

রিদ্দা’ বা স্বধর্মত্যাগীদের যুদ্ধ

সূচনা : হিট্টি বলেন, “স্বল্পকাল স্থায়ী হযরত আবুবকরের খিলাফত (৬৩২-৩৪ খ্রিস্টাব্দ) রিদ্দা বা স্বধর্মত্যাগীদের যুদ্ধের দ্বারা ব্যাপত ছিল।” হযরত মুহাম্মদ (স) এর ওফাতের সাথে সাথে হেজাজ ব্যতীত প্রায় সমগ্র আরব দেশে ইসলাম ধর্ম এবং নব- প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ শুরু হয়। ইসলাম ধর্মের যোগসূত্র ছিন্ন করে ধর্মত্যাগী এই সমস্ত গোত্রের দলপতিরা নিজেদেরকে সর্বদিক থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করল, ধর্মত্যাগীগণ ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মাথা তুলল, খ্রিস্টান ও ইহুদীগণ ঔদ্ধতের সীমা লঙ্ঘন করল এবং নগণ্য সংখ্যক ধর্মভীরু অসংখ্য শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় রাখালবিহীন মেষপালের মত যত্রতত্র বিচরণ করতে লাগল।” সমগ্র আরব দেশে চরম অর্ন্তবিপ্লবের সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ ইসলাম ধর্ম বর্জন এবং খলিফার আধিপত্যকে অস্বীকার করে ইসলামের বিরুদ্ধে একটি সুসংঘবদ্ধ আন্দোলন পরিচালিত করে। তারা স্বীয় গোত্রদের স্বধর্ম ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে একটি প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনা করে। এটিই স্বধর্মত্যাগী আন্দোলন ( Apostasy movement) এবং স্বধর্মত্যাগী ভণ্ড নবীদের বিরুদ্ধে ইসলামের সংঘবদ্ধ অভিযানকেই ‘রিদ্দার’ যুদ্ধ বলা হয়।

বিদ্রোহের কারণ : ইসলামের বিরুদ্ধে আরব গোত্রগুলো প্রকাশ্য বিদ্রোহ এবং ধ্বংসকারী সশস্ত্র বিপ্লবের অনেকগুলো কারণ ছিল :

(১) হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবদ্দশায় আরব উপদ্বীপের মোট এক তৃতীয়াংশ লোকও ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেনি। দীর্ঘকাল যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকায় রাসূলে করীম বিভিন্ন কারণে সমগ্র আরব-জাতিকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারেন নি; এই কারণগুলো হল : (ক) সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব; (খ) সময়ের স্বল্পতা, যেমন- তাঁর দেহত্যাগের মাত্র দুই এক বৎসর পূর্বে তাঁর প্রত্যক্ষ কর্মক্ষেত্র হেজাজ প্রদেশের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে; (গ) সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ধর্ম প্রচার ব্যবস্থার অভাব।

(২) প্রাক-ইসলামী যুগের আরববাসীদের গোত্রপ্রীতি (Asabiyah), তীব্র স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রাসূলে করীমের ওফাতের পর পুনরায় প্রকট আকারে প্রকাশ পেতে থাকে। কোন দলপতি ইসলামে দীক্ষিত হলেই মনে করা হত যে, ঐ গোত্রের সদস্যরা প্রকারান্তরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ৬৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিনিধি প্রেরণের বৎসরে আরব গোত্রের দলপতিগণ রাসূলের আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামে দীক্ষিত হন। এক্ষেত্রে একথা মনে করা মারাত্মক ভুল হবে যে, গোত্র প্রধানদের সাথে সাথে সমগ্র আরববাসী ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল। ইসলামের আবির্ভাবে গোত্রপ্রীতির পরিবর্তে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ (Islamic brotherhood), সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রাধান্য লাভ করতেই বেদুঈনদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ আঘাত লাগে। গোত্রের লোকজন দলপতিকে অন্ধের মত অনুসরণ করে এবং গোত্রপতির ধর্মত্যাগের সাথে সাথে তাঁরাও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

(৩) হযরত মুহাম্মদ (স) প্রাক-ইসলামী যুগের ঘৃণ্য এবং কলুষিত প্রথাগুলো নিশ্চিহ্ন করে আরব ভূখণ্ডে সমাজ, ধর্ম, স্বজনপ্রীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। অসংযত, পাপাসক্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবনের পরিবর্তে ইসলাম একটি সুষ্ঠু, সংহত, সুসংবদ্ধ ও উন্নত জীবনের সন্ধান দেয়। ইসলামের অজেয় শক্তি এবং রাসূলের অসামান্য ব্যক্তিত্বের নিকট উচ্ছৃঙ্খল এবং বন্ধনহীন উপজাতি ও বেদুঈনগণ শির নত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাসূলের মৃত্যুর পর আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন স্থানে তৌহিদ ইসলামের বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। কারণ তারা মনে প্রাণে তৌহিদ বাদে বিশ্বাস করতে পারে নি এবং ইসলামের সংস্কারমূলক ব্যবস্থা তাদের চরিত্রে কোন রেখাপাত করে নি।

(৪) ইসলামের নৈতিক শাসন এবং রুচিসম্মত ও মার্জিত জীবনযাত্রায় অনুশাসনমুক্ত স্বাধীনচেতা আরববাসীরা অভ্যস্ত ছিল না। চিরদিনই তারা ছিল দুরন্ত বাধা-বন্ধনহীন। ইসলামের বিধিব্যবস্থা এবং নৈতিক শৃঙ্খলাকে তারা ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্তরায় মনে করত। যতদিন রাসূল-জীবিত ছিলেন ততদিন তারা মাথা উঁচু করতে সাহস করেনি। ব্যভিচারী ও মদ্যপায়ী আরব গোত্রের লোকেরা রাসূলের সময়ে সংযত থাকলেও তাঁর ইন্তেকালের পর তারা তাদের পূর্বের ঘৃণ্য এবং অসংযত জীবনযাত্রায় ফিরে যায়। মৌলানা মুহম্মদ আলী বলেন, “যারা সর্বশেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং এর গুরুত্ব ও আদর্শ সম্বন্ধে বিশেষ কোন ধারণা যাদের ছিল না তারা পুনরায় গোত্রীয় ধর্মে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং আর একবার ইসলামের আধিপত্যের বিরোধিতা করল।”

(৫) বন্ধনহীন আরব জাতি ইসলামের আবির্ভাবে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় একটি সুসংবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হয়। মদীনা ছিল ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু আরব গোত্রসমূহ কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে থেকে মদীনার প্রাধান্য এবং কর্তৃত্বকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। হিট্টি বলেন, “রাজধানী হেজাজের প্রাধান্য ও তাদের ঈর্ষার এবং (রিদ্দার যুদ্ধের) বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল।” মক্কাবাসীরা প্রাক-মুসলিম যুগে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত; কিন্তু মক্কার স্থলে মদীনায় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হলে মক্কাবাসীদের মধ্যে অনেকেই মদীনার প্রাধান্যে অসন্তুষ্ট হয়।

(৬) ইসলামী অনুশাসন মোতাবেক সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে যাকাত প্রদান রিদ্দা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। স্বাধীনতাপ্রিয় আরব গোত্রের লোকেরা বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত প্রদান করাকে তাদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যে এবং স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ কালে মনে করে। ইতিপূর্বে কোন সরকারকে তারা যাকাত প্রদান করে নি এবং এতে অভ্যস্তও ছিল না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা এই নূতন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হতে পারে নি এবং এ থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য নেজদ গোত্রের লোকেরা হযরত আবুবকরের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করে। বিত্তশালী বেদুঈন এবং ভণ্ড নবীগণ এই কর দিতে অস্বীকার করে। মৌলানা মুহম্মদ আলী বলেন, “জাতীয় সংহতির পরিপন্থী এবং ইসলামের অমোঘ বিধানের অন্তরায় কোন কার্যকলাপকে হযরত আবুবকর বরদাস্ত করেন নি। ধর্ম হিসেবে ইসলামের এবং জাতি হিসেবে মুসলমানদের নিরাপত্তা” বিধান করতে তিনি দৃঢ়সংকল্প ছিলেন।

(৭) হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর শ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী হিসেবে অসামান্য মর্যাদা এবং অপরিসীম প্রভাব সমগ্র আরব জাহানে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তা দেখে কিছুসংখ্যক স্বার্থান্বেষী, ধূর্ত এবং ফন্দীবাজ আরব গোত্রপতি মনে করে যে, নবুয়ত একটি লাভজনক এবং মর্যাদা-সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান (Institution)। আল্লাহর ওহী ব্যতীত নবুয়ত প্রাপ্তি সম্ভব নয়- একথা ভুলে কতিপয় দলপতি স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজেদেরকে ভণ্ডনবী (Apostate) বলে দাবি করে এবং আরব গোত্রসমূহে মিথ্যা প্রচারণ শুরু করে। এমনকি তারা ঐশীবাণী প্রাপ্ত বলে দাবি করে। তারা মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে দিকভ্রষ্ট আরবগণকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে।

(৮) ভণ্ড নবী, স্বার্থান্বেষী আরব গোত্রপতি, ধর্মভ্রষ্ট বেদুঈন ছাড়াও রিদ্দা যুদ্ধের উস্কানি দিয়েছিল ইহুদী এবং খ্রিস্টান প্রভৃতি মুসলিম বিদ্বেষী ধর্ম সম্প্রদায়সমূহ। ইহুদী এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায় ইসলামের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল এবং ধর্ম ও রাষ্ট্র হিসেবে তারা সর্বদা বিরুদ্ধাচরণ করত। তাদের উস্কামূিলক এবং স্বার্থান্বেষী কার্যকলাপে ইসলাম বিরোধী আন্দোলন একটি সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সূচনা করে।

ভণ্ডনবী

স্বধর্মত্যাগী স্বার্থান্বেষী ভণ্ড নবীদের আবির্ভাবে নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্ম এবং রাষ্ট্র একটি যুগসন্ধিক্ষণের সম্মুখীন হয় এবং ইহুদী ভিত্তিও প্রকম্পিত হয়ে উঠে। রাসূলের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ইসলামকে ইতিপূর্বে এরূপ কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় নি এবং হযরত আবুবকর বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার সাথে এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন। যে সমস্ত স্বধর্মত্যাগী মুসলমান নিজেদের ভণ্ডনবী বলে দাবী করে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আসাদ আনসি, মুসায়লামা, তোলায়হা ও সাজাহ।

গোত্রপতি এবং বিত্তশালী আসাদ আনসি ইয়েমেনে রাসূলের জীবদ্দশায় দশম হিজরীতে নবুয়ত দাবী করে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইয়েমেন থেকে মুসলিম প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করে সে নাজরান এবং ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে। অতঃপর সে পাশ্ববর্তী গোত্রপ্রধানদের সহযোগিতার একটি শক্তিশালী সৈন্যদল গঠন করে সমগ্র দক্ষিণ আরব অধিকার করে। রাসূল (স) এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সাদ-ইবন-জবলকে নিযুক্ত করেন। রাসূলের ওফাতের দুই একদিনের মধ্যেই সাধনার শাসনকর্তার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফিরোজ দায়লামী নামক একজন তার আত্মীয় আসাদ আনসিকে হত্যা করে। হযরত আবুবকরের খেলাফত লাভের সংবাদে ইয়েমেনে পুনরায় বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য ভণ্ডনবীগণ তৎপর হয়ে উঠে।

মধ্য আরবের ইয়ামামার বনু হানিফা গোত্রে অপর একজন ভণ্ডনবী মুসায়লামার জন্ম হয়। স্বলিখিত বাণীকে ঐশীবাণী বলে প্রচার করে সে নবুয়ত দাবী করে এবং নবী করীমকে একটি লিখিত পত্রে সে জানায় যে, ধর্ম প্রচার এবং আরব ভূমিতে শাসনকার্য নির্বাহের জন্য সে রাসূলের সমতুল্য। রাসূল (স) মুসায়লামার প্রবঞ্চনা, ভণ্ডামি এবং ধর্মদ্রোহিতায় বিচলিত হন এবং একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে তাকে ধর্ম এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। ভণ্ডনবীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিল মুসায়লামা। হযরত আবুবকর খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর সে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করলে তাকে হত্যা করা হয়।

উত্তর আরবের বনু আসাদ গোত্রের দলপতি তোলায়হা ছিল নেজদ এর একজন বিখ্যাত যোদ্ধা। সে নানা প্রকার প্রচারণা দ্বারা আরববাসীদের বিভ্রান্ত করে এবং নিজেকে নবী বলে দাবী করে। সে মদীনার বেদুঈন সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে যাকাতবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে এবং প্রতিষ্ঠিত শাসন-ব্যবস্থা ও ধর্মীয় মতবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। খালিদ কর্তৃক পরাজিত হয়ে সে সিরিয়ায় আত্মগোপন করে।

খোদার বাণী লাভের দাবিদারদের মধ্যে চতুর্থ ছিল মধ্য আরবের বনু ইয়ারবু উপগোত্রের সাজাহ নাম্নী এক নাছারা মহিলা। আরব ভূ-খণ্ডে স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন শুরু হলে সাজাহ স্বার্থসিদ্ধির জন্য খ্রিস্টান উপজাতিদের সাহায্যে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। বনু তামিম এবং বনু ইয়ারবু গোত্রকে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে সাজাহ বনু ইয়ামামার দলপতি ভণ্ডনবী মুসায়লামার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বধর্মত্যাগী আন্দোলনকে জোরদার করে।

স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন দমন : হযরত মুহাম্মদ (স) এর ওফাতের পর স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন ছিল নব-প্রতিষ্ঠিত মদীনা প্রজাতন্ত্রের এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি একটি বিরাট হুমকিস্বরূপ। এটি ছিল একেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিকতার চ্যালেঞ্জ দীন (Din) এবং মুরুওয়ার (Muruwwa) মধ্যে শক্তি পরীক্ষা; আলো এবং অন্ধকার, সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব। ঐতিহাসিক মূরই বলেন, “সমগ্র উপদ্বীপের আরবরা স্বধর্মে ফিরে যাচ্ছিল।” ঠিক এমন সময় হযরত আবুবকর কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হয়ে কঠোর নীতি অবলম্বন করে এ সমস্ত, বিভ্রান্তকারী ভণ্ডনবীদের নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তিনি বিদ্রোহীদের ইসলামের পতাকাতলে ফিরে আনার জন্য আরব ভূ-খণ্ডে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান করার দুরূহ কার্যে নিয়োজিত হন। ভণ্ড প্রচারকদের আবির্ভাবে শাসন-ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়লে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়; শাসক এবং ধর্ম প্রচারকগণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন, ধর্মভীরু মুসলমানগণ আততায়ীদের হস্তে প্রাণ হারাতে থাকে। এহেন অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য কালবিলম্ব না করে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি সহজেই উপলব্ধি করেন যে, বিশ্বজয়ের পূর্বে আরব দেশকে সর্বপ্রথম আরববাসীদের জয় করতে হবে।

সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে হযরত আবুবকর (রা) খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। উপরন্তু, উসামার অনুপস্থিতিতে মদীনা অরক্ষিত থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। এই সুযোগে ধর্মত্যাগী আরব গোত্র বনু আস ও বনু জুবিয়ান নিকটবর্তী মরু অঞ্চল হতে দুই দলে বিভক্ত হয়ে রাবাধা ও ধুলকাশার দিকে যাত্রা করে। ভণ্ডনবী তোলায়হার প্ররোচনায় এই দুই গোত্র মদীনার উপকণ্ঠে হানা দেয়। হযরত আবুবকর (রা) হযরত আলী, তালহা ও জুবাইরের সহায়তায় মদীনা রক্ষার তার নিজ হাতে গ্রহণ করে ধুলকাশা (Dhul Qassah) নামক স্থানে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে বিদ্রোহীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এই সাফল্যের ফলে নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি এবং আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। মুসলমানদের মনে নূতন আশার সঞ্চার হয়। তামিম ও তা’য়ী গোত্রের লোকেরা মদীনায় এসে রাজস্ব দিয়ে যায়। এদিকে বেদুঈনগণ রাবাধায় (Rabadah) ফিরে গিয়ে কয়েকজন মুসলমানকে হত্যা করে। সিরিয়া অভিযানের পর উসামা মদীনায় ফিরলে হযরত আবুবকর তাঁর উপর রাজধানী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করে একদল সৈন্য সাথে নিয়ে রাবাধার বেদুঈনদের আক্রমণ করেন। তাদের অনেকেই বন্দী ও নিহত হয়। আবস ও জুবিয়ান গোত্রের লোকজন বুজাখায় পলায়ন করে ভণ্ডনবী (Veiled Prophet) তোলায়হার সৈন্যের সাথে মিলিত হয়। তাদের পশুচারণ ক্ষেত্রও মুসলমানগণ দখল করেন। এভাবে হযরত আবুবকরের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মদীনার কেন্দ্রীয় শাসনের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

মদীনা সুরক্ষিত হলেও ভণ্ডনবীদের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচারণ এবং অনৈসলামিক, কার্যকলাপ ইসলাম ধর্ম ও নব-প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে তোলে। সাহস ও দৃঢ় মনোবল হতে হযরত আবুবকর বিদ্রোহীদের ধ্বংস করে ইসলামের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সৈন্যদলকে ১১টি বিভাগে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেকটি বিভাগকে একজন অভিজ্ঞ সেনাপতির অধীনে আনয়ন করেন : (১) বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ-বিন- ওয়ালিদকে প্রথমে তোলায়হা ও পরে মালিক-বিন-নুবিয়ার বিরুদ্ধে; (২) ইকরামা-বিন- আবু জেহেলকে মুসায়লামার বিরুদ্ধে; (৩) সুহরাবিল ইকরামার সাহায্যে রয়েছেন; ( 4 ) মোহাজির-বিন-আবি উমাইয়াকে ইয়েমেন এবং হাজরামাউথ বিজয়ে পাঠান হল; (৫) একটি সৈন্যদলকে সিরিয়া সীমান্ত প্রহরায় রাখা হল; (৬) আম্মান বিদ্রোহ দমনে প্রেরিত হয় অপর একটি সৈন্যদল; (৭) মাহ্র্রাহ এর বিদ্রোহ দমনে প্রেরিত হয় একটি সৈন্যদল; (৮) কোজা গোত্রের বিদ্রোহ; (৯) বনু সালাম গোত্রের বিদ্রোহ; (১০) হাওয়াজিন গোত্রের বিদ্রোহ দমনে একটি করে সৈন্যদল প্রেরিত হয়; (১১) মদীনাকে রক্ষার জন্য একটি সৈন্যবাহিনী সদাপ্রস্তুত রাখা হয় এবং মদীনা থেকে প্রধান সেনাপতিরূপে হযরত আবুবকর (রা) দক্ষতা এবং দৃঢ়তার সাথে বিদ্রোহ দমন অভিযান পরিচালনা করেন।

সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডকে ইসলামের পতাকাতলে আনবার জন্য হযরত আবুবকর (রা) কে এক বৎসর (৬৩২-৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ) ধরে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়। আরবের উত্তর- পূর্বাঞ্চলে এবং পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী বাহরাইন হতে শুরু করে লোহিত সাগরের উপকূলস্থ ইয়েমেন প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার অভিযান পরিচালিত হয়। হযরত আবুবকর (রা) সেনাপতিদের নির্দেশ দেন যে, যদি বিদ্রোহী গোত্র স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে আত্মসম্পূর্ণ করে তা হলে যেন তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ-বিন-ওয়ালিদের যুদ্ধ-কৌশল ও তেজস্বীতায় ভণ্ডনবী তোলায়হা বুজাখার যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। প্রাণভয়ে তোলায়হা সিরিয়ায় আত্মগোপন করেন; কিন্তু হযরত আবুবকর (রা) বনু আসাদ গোত্রকে ক্ষমা প্ৰদৰ্শন করলে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আরবে ফিরে আসে। খলিফা হযরত ওমর (রা) এর সময়ে তোলায়হা ইরাক অভিযানে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ‘আল্লাহর তরবারি’ বুজাখায় এক মাস অবস্থান করে আসাদ ও গাতাফান গোত্রের আনুগত্য লাভ করেন এবং তাদের রাজস্ব প্রদানে বাধ্য করেন। অতঃপর খালিদ বনু তামিম গোত্রের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে এর উপগোত্রীয় নেতা মালিক-বিন-নুবিয়াকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। এই উপগোত্র ইয়ারবু নামে পরিচিত ছিল এবং মেসোপটেমিয়া হতে আগত মহিলা ভণ্ডনবী সাজাহকে কেন্দ্র করে একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সাজাহর পূর্ব-পুরুষগণ ইয়ারবু উপগোত্র থেকে উদ্ভূত। বনু তামিমের কয়েকটি গোত্র এবং অন্যান্য কয়েকটি খ্রিস্টান গোত্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে সাজাহ মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। কয়েকটি সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে সাজাহ উপগোত্রগুলোর সাথে সন্ধি করে এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভণ্ডনবী মুসায়লামাকে আক্রমণ করে পরাজিত ও বন্দী করে। কিন্তু পরিশেষে তার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়। এদিকে খালিদ ইয়ারবু উপগোত্রকে আক্রমণ করে মালিক-বিন- নুবিয়াসহ কিছুসংখ্যক লোককে বন্দী করেন এবং ঘটনাস্থলে সে নিহত হলে বনু তামিম গোত্র খালিদের নিকট আত্মসম্পূর্ণ করে।

হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবদ্দশায় মধ্য-আরবের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হানিফা গোত্রের দলপতি মুসায়লামা ইসলাম ধর্ম বর্জন করে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কুরআনের ভাষা নকল করে জনসাধারণকে সে বিভ্রান্ত করত। রাসূলের ওফাতের পর প্রায় ৪০,০০০ লোকের একটি বিদ্রোহী দল গঠন করে সে নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। ভণ্ডনবীদের মধ্যে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রথমে ইকরামা ও সুহরাবিলকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু মুসায়লামা মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে স্বীয় ক্ষমতা এবং তথাকথিত নবুয়ত কায়েম করে। হযরত আবুবকর (রা) এতে বিচলিত হয়ে বীরশ্রেষ্ঠ খালিদকে মুসায়লামার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যুদ্ধ-বিপর্যয়ে ইসলামের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবার আশংকায় খালিদ বীর বিক্রমে মুসায়লামাকে আক্রমণ করে এবং ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়ামামার যুদ্ধে (Battle of Yamamah) তাকে পরাজিত করেন। পরাজিত হয়ে শত্রুপক্ষ একটি বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করলে সেখানে মুসায়লামাসহ অসংখ্য লোক নিহত হয়। এ কারণে আরব ঐতিহাসিক তাবারী একে ‘মৃত্যুর বাগান”(The Battle of the Garden of Death) বলে উল্লেখ করেন। স্বধর্মত্যাগীদের এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সাধারণত ইয়ামামার (কঠিন) যুদ্ধ নামে পরিচিত। জোসেফ হেল বলেন, “কঠিনতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধসমূহের মধ্যে ইয়ামামার যুদ্ধ অন্যতম ছিল।” ইয়ামামার যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসায়লামা বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করলে ওয়াহশি নামক একজন মুসলিম নিগ্রোর হাতে নিহত হয়।

ইসলামের ইতিহাসে ইয়ামামার যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর বিদ্রোহী বনু হানিফা গোত্রের লোকজন পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, খলিফার আনুগত্য স্বীকার করে। ফলে, ইসলামের প্রথম সঙ্কট কেটে যায় এবং এর ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। এই যুদ্ধে ৩০০ কুরআন আবৃত্তিকারী (হাফেজ) মৃত্যুবরণ করলে সর্বপ্রথম হযরত আবুবকর (রা) এর সময়ে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফের বাণীগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এই যুদ্ধে দুই হাজার মুসলমান শহীদ হন। অপরদিকে শত্রুপক্ষের দশ হাজার সৈন্য হতাহত হয়। এরূপে সকল ভণ্ডনবীকে দমন করা হয়। তোলায়হা এবং সাজাহ অনুতপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং মুসায়লামা ও আসাদ নিহত হয়।

মধ্য ও উত্তর আরবে ভণ্ড নবীদের বিদ্রোহ দমন করে হযরত আবুবকর (রা) দক্ষিণ ও পূর্ব আরবের বিদ্রোহী গোত্রদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হযরত মুহাম্মদ (স) এবং বাহরাইনের মুসলিম শাসনকর্তা মুনযিরের মৃত্যুর পর বনু বকর গোত্র ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এদিকে ইসলামে বিশ্বাসী বনু আবদ-আল-কায়েস বনু বকরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বনু বকর পারস্যের এবং বনু আবদ-আল-কায়েস মুসলমানদের সাহায্য প্রার্থনা করে। মুসলমান সৈন্যবাহিনী বনু বকর ও পারস্যের সম্মিলিত বাহিনীকে পর্যদস্ত করে। দাবার যুদ্ধক্ষেত্রে হোজাইফা ও ইকরামার সহায়তায় ওমানের বিদ্রোহ দমন করা হয়। হোজাইফা ওমানের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ইক্রামা আরবের এই পূর্বাঞ্চল হতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে মাহরাহ দখল করেন।

দক্ষিণ ইয়েমেনে ভণ্ড নবী আসাদের মৃত্যু হলেও তার অনুচরেরা পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে। খলিফা অনন্যেপায় হয়ে এই বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব অর্পণ করেন মোহাজির-বিন-আবি উমাইয়ার উপর। বিদ্রোহীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং শাসকদের আত্মকলহের ফলে সম্মিলিত মুসলিম বাহিনী ইসলামভুক্ত গোত্রের সাহায্যে সহজেই বিদ্রোহীদের ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। মোহাজির ও ইকরামা হাজ রামাউতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই প্রদেশের কিন্দা গোত্রের নেতা আল-আসাথ-বিন-কায়েস ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু রাসূল (স) এর ওফাতের পর ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে বিদ্রোহী হয়। ইকরামা পূর্ব এবং মোহাজির পশ্চিম দিক হতে অগ্রসর হয়ে আল-আসাথকে পরাজিত করেন। বন্দী হয়ে মদীনায় প্রেরিত হলে আল-আসাথ খলিফার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে পারস্য ও ইরাকে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করেন। হাজরামাউত দখলের সাথে সাথে রিদ্দার যুদ্ধের অবসান হয়। এরূপে সমগ্র উপদ্বীপে কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে হযরত আবুবকর ইসলামের ঐক্য এবং মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং ইসলামকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেন।

ইসলামের অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে যে সমস্ত আরব গোত্র যাকাত প্রদান হতে বিরত ছিল, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা যাকাত দানে স্বীকৃত হয়।

স্বধর্মত্যাগীদের যুদ্ধের গুরুত্ব : ইসলামের ইতিহাসে রিদ্দা বা স্বধর্মত্যাগীদের যুদ্ধের পরিণাম ছিল খুবই সুদূরপ্রসারী এবং গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে হিট্টি বলেন, “বিশ্বজয়ের পূর্বে আরববাসীকে আরবদেশকেই প্রথমে জয় করা হয়েছিল।” (“Arabia had to conquer itself before it could conquer the world”) সামরিক শক্তি হিসেবে ইসলাম রিদ্দার যুদ্ধে সর্বপ্রথম সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি বহিবিশ্বে জয়ের প্রধান সহায়ক ছিল। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান থাকিলে মুসলমানগণ কখনই ইসলামের প্রভুত্ব বিস্তারে সাফল্য লাভ করতে পারত না। বিদ্রোহ দমনে মুসলিম সেনাপতিগণ আত্মবিশ্বাস রণকৌশল এবং উচ্চতর সাংগঠনিক মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন, যার ফলে ভণ্ড নবীদের ধ্বংস করা সম্ভবপর হয়।

রিদ্দার যুদ্ধে ইসলামের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরনায়ক খালিদ-বিন-ওয়ালিদের অবদান অনস্বীকার্য। উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খালিদ অসি ধারণ করলেও পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তিনি মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেন। রাসূলে করীম তাঁকে “আল্লাহর তরবারি” (Sword of Allah) উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর অসামান্য যুদ্ধকৌশল, দক্ষতা, তেজস্বীতার ফলেই ভণ্ড নবীদের নির্মূল করা সম্ভব হয়। ভন ক্রেমার বলেন, “খালিদের অসীম তেজস্বীয়তা এবং আবুবকর (রা) বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দিলে ইসলামের শত্রুগণ রিদ্দা যুদ্ধে জয়লাভ করিত।” খালিদ ব্যতীত ইকরামা, মোহাজির প্রমুখ সেনানায়কদের ঐকান্তিক এবং সংঘবদ্ধ চেষ্টায় ইসলাম সঙ্কট হতে রক্ষা পায়।

“হযরত আবুবকরের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, অনমনীয় মনোভাব, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সামরিক বিচক্ষণতা, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ব্যতীত শিশু মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যেত। রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি এবং ধর্মের মূল অনুশাসন ও আদর্শ সংরক্ষণের জন্য খলিফা যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। উইলিয়াম মূইর একথা চিন্তা করে বলেন, “আবুবকর ব্যতীত ইসলাম বেদুঈন গোত্রসমূহের সহিত আপোষ করতে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত অথবা অঙ্কুরেই তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হত।”

রিদ্দার যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় না হলে ইসলাম হয়ত চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেত। এই সম্পর্কে মূইর বলেন, “এতে পরাজয় ইসলামের পক্ষে যেমন হত মারাত্মক, তেমনি বিজয় ছিল গতি পরিবর্তনশীল।” স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন ধূলিসাৎ হলে আরব ভূ-খণ্ড হতে পৌত্তলিকতা চিরতরে বিলুপ্ত হয় এবং তৌহিদবাদ দৃঢ়রূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অনৈসলামিক কার্যকলাপ ধ্বংস হলে ইসলামের অনুশাসনের প্রতি মুসলমানগণ অনুরক্ত হয়ে উঠে। প্রতারক, প্রবঞ্চক, বিশৃঙ্খলাকারী এবং বিভেদ সৃষ্টিকারীদের চরম আঘাত হেনে খলিফা হযরত আবুবকর (রা) মদীনার কেন্দ্রীয় শাসনকে যেমন সুদূরপ্রসারী করেন তেমনই ইসলামের শত্রুদের নির্মূল করে ধর্মকে কণ্টকহীন করেন। রিদ্দার যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ধর্মদ্রোহীদের যুদ্ধ এবং ইহা প্রাক-মুসলিম আরব ধর্মমতের প্রতি ইসলামের সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ ছিল। এই প্রসঙ্গে ওয়াট বলেন, “রিদ্দার যুদ্ধ ইসলামের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন এবং সেহেতু এটা ছিল অনৈসলামিক।” রিদ্দার যুদ্ধের পরিণতিস্বরূপ বলা যায় যে, আরব জাতি মরুপ্রান্তে সীমাবদ্ধ না থেকে ক্রমশ ইসলামী আভিজাত্যে (সামরিক) রূপান্তরিত হয়। মূইরের এ ভাষ্য পরবর্তী সমরাভিযানগুলোই প্রমাণ করে।

খোদাবক্স বলেন, “রাসূলের ওফাত ইসলামের জন্য একটি ভয়াবহ এবং দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসের সূচনা করে।” হযরত আবুবকরের নেতৃত্বে শিশু ইসলামী রাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের হাত হতে চিরতরে রক্ষা পেয়ে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। খলিফা আরবের বিভিন্ন গোত্রের উস্কানিমূলক কার্যকলাপ নিশ্চিহ্ন করে সমগ্র আরব-ভূখণ্ডকে ঐক্যবদ্ধ এবং ইসলামের আওতাভুক্ত করেন। রিদ্দা যুদ্ধের ফলে মুসলমানগণ পারস্য ও বায়জানটাইন সাম্রাজ্যদ্বয়ের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব উক্ত অমুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করে পুনরায় ইসলামের ছায়াতলে এসে তাদের যুদ্ধ-স্পৃহা এবং রণকৌশল দ্বারা ইসলামের বিজয়কে সুদূরপ্রসারী করে; যেমন- তোলায়হা এবং আল-আসাথ। অর্থনেতিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বিদ্রোহী গোত্রদের যাকাত দিতে বাধ্য করায় রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক সংগঠনের পথ প্রশস্ত হয়।

সমরাভিযান (৬৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দ)

হযরত আবুবকরের (রা) খিলাফতে রিদ্দা যুদ্ধ ব্যতীত অপর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি। অন্তবিপ্লব ধ্বংস করে খলিফা আরব ভূ-খণ্ডের উত্তরপূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে কালদিয়া ও সিরিয়া প্রদেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। ধর্মের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই দুই প্রদেশের জনসাধারণ ছিল আরবদের স্বগোত্রীয়। কালদিয়া ছিল পারস্য সাসানিয়া রাজ্যের অন্তর্গত এবং সিরিয়া ছিল বাজানটাইন সাম্রাজ্যের শাসনাধীন। খলিফা ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান করে পারস্য সীমান্তে বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্য ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে সেনাধ্যক্ষ মুসান্নাকে (Muthannah) একটি বিশাল সৈন্যবাহিনীসহ প্রেরণ করেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, রাজ্য জয়ের লিপ্সায় মুসলমানগণ ইরাক ও সিরিয়া আক্রমণ করে। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, খলিফার সৈন্য প্রেরণ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই না। সীমান্ত রক্ষা এবং উস্কানিমূলক কার্যকলাপকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের সীমান্তে সৈন্যবাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অভিযানের মূল কারণ ব্যাখ্যা করে মূইর বলেন, “স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন দমন করার সাথে সাথে প্রথমে কালদিয়া এবং পরে সিরিয়ার দুর্ধর্ষ সীমান্ত উপজাতিদের সাথে সংঘর্ষের ফলে বৈদেশিক যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হল।”

ইসলামের যুদ্ধাভিযান কখনই আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ নীতির ফলস্বরূপ ছিল না। আত্মরক্ষা, প্রতিরক্ষা, রাষ্ট্র ও ধর্মের নিরাপত্তা বিধানে খলিফা আরুকরকে যুদ্ধাভিযান করতে হয়। যুদ্ধাভিযানের প্রধান কারণ ছিল, পারস্য ও বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের নৃপতিদ্বয় বিদ্রোহী আরব গোত্রগুলোকে সাহায্য করত। যেমন- বাহরাইনে বিদ্রোহ দেখা দিলে পারস্য সম্রাট বিদ্রোহীদের সাহায্যের জন্য সৈন্য প্রেরণ করে। খ্রিস্টান মহিলা ভন্ডনবী সাজাহ এবং তোলায়হা বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের সমর্থনে ইসলামের বিরুদ্ধে অসি ধারণ করার ধৃষ্টতা প্রকাশ করে। মূইর বলেন, “কালদিয়া এবং দক্ষিণ সিরিয়া আরব-ভূখণ্ডের অন্তর্গত ছিল। এই অঞ্চলের পৌত্তলিক এবং খ্রিস্টান গোত্রগুলো আরব জাতিসস্তুত ছিল এবং সহজে নূতন বিধানের (ইসলাম) আওতাভুক্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্ত গোত্র মুসলিম বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ লিপ্ত হলে তারা তাদের সম্রাট কর্তৃক সাহায্য লাভ করত অর্থাৎ পশ্চিম দিকে কাইসার (বায়জানটাইন নৃপতি) এবং পূর্বে খসরু (সাসানিয়ার রাজা) কর্তৃক সাহায্য লাভ করত। এভাবে সীমান্তে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়ে তাকে এবং ইসলাম পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি বৃহৎ শক্তির সহিত এক আত্মঘাতী সমরে জড়িত হয়ে পড়ে। “

পারস্য অভিযান : ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত আবুবকর (রা) মুসান্নার নেতৃত্বে ৮,০०0 সৈন্যের একটি বাহিনী পারস্য সীমান্তে প্রেরণ করে উস্কানিমূল তৎপরতা বন্ধের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের একটি বিশাল বাহিনী আল-কাতিফ অঞ্চলে তাঁহার গতিরোধ করলে খলিফা বীরশ্রেষ্ঠ খালিদকে ১০,০০০ সৈন্যসহ মুসান্নার সাহায্যে প্রেরণ করেন। খলিফা খালিদকে দুইদিক থেকে দুটি বাহিনী পরিচালিক করে পারস্য সেন্যবাহিনীর মোকাবেলার আদেশ দেওয়া হয়। প্রথম বাহিনী নিয়ে খালিদকে ইউফ্রেটিস উপকূলে উবুল্লা নামক স্থানে অভিযানের নির্দেশ দেন এবং সেখান হতে পশ্চিম তীরবর্তী শত্রুবাহিনীকে অপসারিত করে কালদিয়ার রাজধানী হীরার দিকে অগ্রসর হতে পরামর্শ দেন। অপর বাহিনী নিয়ে আইয়াজকে দুমার বিদ্রোহ দমন করে হীরায় খালিদের বাহিনীর সাথে মিলিত হতে পরামর্শ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে মুসান্না এবং খালিদের সম্মিলিত বাহিনী উবুল্লার হাফির নামক স্থানে পারস্য বাহিনীর সঙ্গে প্রথম সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হাফির নামক স্থানে যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে ইহা ‘হাফির’ বা শৃঙ্খলের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মুসলিম বাহিনীর তীব্র আক্রমণে পারসিক বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করতে চেষ্টা করলে পারসিক সেনাধ্যক্ষ হরমুজ তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণে একে “শৃঙ্খলের যুদ্ধ” (Battle of Chains) বলা হয়। খালিদ ও হরমুজের মধ্যে দ্বৈতযুদ্ধ সংঘটিত হলে খালিদ হরমুজকে নিহত করেন এবং এর ফলে পারস্য সৈন্য সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। মুসলিম বাহিনী ইউফ্রেটিসের তীর পর্যন্ত পারস্য বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে এবং তাদের অসংখ্য ধনরত্ন মুসলমানদের হস্তগত হয়। মুসান্না শত্রুর পশ্চাদগমন করতে করতে এক পারসিক রাজকন্যার দূর্গ (The Lady’s Castle) অধিকার করেন। পারস্য সম্রাট মুসান্নার বিরুদ্ধে একটি নূতন বাহিনী প্রেরণ করলে খালিদ তড়িৎগতিতে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং মুসান্না ও খালিদের সম্মিলিত বাহিনী ওয়ালাজার যুদ্ধে পারসিকদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। বাহমানের নেতৃত্বে গঠিত পারস্য বাহিনী খালিদের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে উলিসের দিকে পশ্চাদগমন করে। অপর একটি পারসিক সৈন্যবাহিনীকে উলিসের যুদ্ধে পরাজিত করে খালিদ হীরা নগর অধিকার করেন। হীরার শাসনকর্তা প্রাণভয়ে পলায়ন করলে খ্রিস্টান জনসাধারণ খলিফার বশ্যতা স্বীকার করে এবং জিজিয়া দানের অঙ্গীকার করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি সম্পাদন করে। হীরায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তার খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং খালিদ এক বৎসর এই নগরীর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। জিজিয়া প্রদান করলে হীরায় অমুসলমানগণ জিম্মিতে পরিণত হয় এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব খলিফা গ্রহণ করেন। ইত্যবসরে ইউফ্রেটিসের পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্ব দিকের বদ্বীপের নিম্নাংশ মুসলমান সেনাপতির অধিকারে আসে। অতঃপর ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী শহর আনবারা খালিদ দখল করেন। কিছু দূরে অবস্থিত আইন-উত-তামর এবং দুমায় মুসলিম শাসন সম্প্রসারিত হয়।

সিরিয়ায় অভিযান

রাসূলে করীম (স)-এর জীবদ্দশায় রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস মুসলিম দূতকে সম্মান প্রদর্শন করেন, কিন্তু কালক্রমে মুসলিম রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণে রোমান সম্রাট ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেন। রোমান সম্রাট সিরিয়ার আরব গোত্রগুলোকে আরব সীমান্ত আক্রমণে সাহায্য প্রদান করতেন এবং রাসূলের ওফাতের পর রিদ্দার যুদ্ধে ইসলামকে ধ্বংস করার চেষ্টায় খ্রিস্টান সম্রাট সচেষ্ট হয়। মুসলমান বণিকগণ সিরিয়ায় উৎপীড়িত হতেন। এটা ছাড়া সুহরাবিল নামক একজন খ্রিস্টান প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুসলিম দূতকে মুতায় হত্যা করে। এ সমস্ত কারণে খলিফা আবুবকর (রা) মুসলমানদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান, মুসলিম রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষা এবং বিদ্রোহী গোত্রের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের জন্য সিরিয়ায় অভিযান প্রেরণ করেন। বাণিজ্যিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ করে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সিরিয়া অভিযান আবশ্যক ছিল। আরব-ভূ-খণ্ড ক্রমবর্ধমান মুসলমান জনসাধারণকে খাদ্য সম্ভার দিতে না পারার জন্যই শুধু অর্থনৈতিক কারণে সিরিয়া অভিযান করতে হয় বলেও অনেকের মত পোষণ করেন। এতদ্ব্যতীত বালাজুরীর মতে, ধর্মযুদ্ধে যোগদান করার জন্য খলিফা মক্কা, তায়েফ, নেজদ এবং হেজাজের অধিবাসীদিগকে আহ্বান জানান। অনেকে রণক্ষেত্রের ঐশ্বর্য প্রাপ্তির আশায়, আবার অনেকে শহীদ হয়ে স্বর্গীয় পুরস্কারের (বেহেস্ত) আশায় মুসলিম সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবুবকর সর্ব প্রথম উসামার নেতৃত্বে সিরিয়া সীমান্তে অভিযান প্রেরণ করেন। প্রতিশোধমূলক এই অভিযান রাসূলে করীমের অন্তিম ইচ্ছায় প্রেরিত হয়। অতপর ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের হযরত আবুবকর (রা) মুসলিম সৈন্য দলকে তিন ভাগে বিভক্ত করে একটি সুপরিকল্পিত উপায়ে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আমর –ইবন-আল- আস, ইয়াজীদ-ইবন-আবু সুফিয়ান ও সোহরাবিল-ইবন-হাসানকে তিনটি দলের সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। প্রত্যেক দলে ৩,০০০ সৈন্য ছিল। আইলাহ থেকে প্যালেস্টাইনের দিকে, ইয়াজীদ ও সোহরাবিল তাবুকের পথে এবং পরবর্তীকালে আবু উবায়দা অপর একটি বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মরু সাগর ও আকাবা উপসাগরের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত উপত্যাকায় বায়জানটাইনদের সাথে মুসলিম বাহিনীর প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয়। এ যুদ্ধে ইয়াজীদের বাহিনী প্যালেস্টাইনের শাসনকর্তা সারগিয়াসের বাহিনীকে পরাজিত করে। বায়জানটাইন বাহিনী ঘাজ্জার দিকে পলায়ন করে। কিন্তু মুসলিম বাহিনী ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণরূপে বায়জানটাইন বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। সারগিয়াসের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে বায়জানটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস (Heraclius) তার ভ্রাতা থিওডোরাসের (Theodorus) অধীনে একটি বিশাল বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ইত্যবসরে খলিফার আদেশে খালিদ হীরা থেকে সিরিয়া গমনপথে মারজরাহিত নামক স্থানে বায়জানটাইন বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ঘাস্সানীয় সৈন্যদের এই যুদ্ধে পরাস্ত করে খালিদ বুসরার দিকে অগ্রসর হন। বুসরার শাসনকর্তা জাবালা এই শহর দখলে মুসলিম বাহিনীকে সহায়তা করেন। এর পর তিনি আবু উবাইদা, ইয়াজীদ ও সোহরাবিলের সাথে মিলিত হয়ে হিরাক্লিয়াসের ২,৪০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মুসলিম সৈন্যদলে মাত্র ৪০,০০০ সৈন্য থাকা সত্ত্বেও বীর-বিক্রমে যুদ্ধ করে বায়জানটাইন সম্রাটের ভ্রাতা থিওডোরাসকে মুসলিম সেনাপতিগণ পরাজিত করেন। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জুলাই এই যুদ্ধ আজনাদাইন প্রান্তরে সংঘটিত হয়। হিরাক্লিয়াস এন্টিওকে প্রত্যাবর্তন করলে সমগ্র প্যালেস্টাইনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

সিরিয়া বিজয়ের সুসংবাদ যখন হযরত আবুবকর (রা) এর নিকট পৌঁছায়, তখন তিনি কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত। এক পক্ষকাল পীড়া ভোগের পর ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে আগস্ট (১৩ হিজরীর ২২ শে জমাদিউস-সানি) হযরত আবুবকর ইন্তেকাল করেন।

ত্রাণকর্তা হিসেবে হযরত আবুবকর

হযরত আবুবকরের খিলাফত ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র দু’ বৎসর ৩ মাস ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম রাষ্ট্রকে সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, প্রতারণা, ভণ্ডামি, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, ধর্ম ও দেশদ্রোহিতার সঙ্কটময় পরিস্থিতি তিনি যোগ্যতা ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেন। এরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় আবদুল্লাহ-বিন-মাসউদের ভাষায়, “এরূপ সঙ্কটের দিনে হযরত আবুবকরের মত খলিফা না থাকলে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র কোনটাই রক্ষা পেত না; মুসলমানদের ধর্ম ও সমাজের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠত।” ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে যে রাসূলের পার্শ্বচর হিসেবে এবং রাসূলের ওফাতের পর প্রথম খলিফা হিসেবে তাঁর দান ছিল অপরিসীম। এ কারণেই মূইর বলেন, “আবুবকর না থাকলে বেদুঈন গোত্রগুলোর সাথে আপোষ- মীমাংসা করতে করতে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত অথবা এ সম্ভাবনাও বেশী ছিল যে, জন্মের পূর্বেই তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হত।” রাসূলের জীবনসহচর, বন্ধু ও উপদেষ্টা হিসেবে হযরত আবুবকর (রা) খিলাফত লাভের পূর্বেই ইসলামের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেন। ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক হযরত আবুবকর বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম দীক্ষিত হন এবং মেরাজ শরীফে বিশ্বাস স্থাপন করেন বলে রাসূলে করীম (স) তাঁকে ‘সিদ্দিক’ বা ‘সত্যবাদী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ধর্ম এবং রাসূলের জন্য তিনি পৌত্তলিকদের হস্তে প্রহৃত হন। রাসূলের সাথে তিনি সঙ্গী এবং দেহরক্ষী হিসেবে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনা মসজিদ নির্মাণ এবং বহু যুদ্ধাভিযানে নিঃসঙ্কোচে তিনি অঢেল অর্থ ইসলামের সেবায় দান করেন। প্রাথমিক যুদ্ধগুলোতেও তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন; এমনকি মদীনা রক্ষার দায়িত্বও তিনি স্বহস্তে গ্রহণ করেন। হযরত ওমর (রা) বলেন, “আবুবকরকে ইসলামের খেদমতের ব্যাপারে কেহই অতিক্রম করতে পারবেনা।” রাসূলে করীম (স) স্বয়ং বলেন, “যদি আল্লাহ ব্যতীত আর কাকেও বন্ধু বলতাম, তাহলে আবুবকরকেই বন্ধু বলতাম।”

রাসূলের ওফাতের পর বিভ্রান্ত মুসলমানদের হযরত আবুবকর (রা) যে নেতৃত্ব দান করেন তা তাঁর কৃতিত্বেরই পরিচায়ক। রাসূলের অসুস্থতায় তিনিই ইমামতি করেন। ধর্মীয় কার্যকলাপে নেতৃত্ব তাঁর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা এবং মুসলমানদের শ্রদ্ধার ফলশ্রুতি। খিলাফতকে কেন্দ্র করে যে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তা সুষ্ঠু সমাধান করে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ইসলামের ধারক এবং বাহক হিসেবে তিনি ধর্মীয় অনুশাসনগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন এবং কোন প্রকার ভীতি, বিদ্বেষভাব ও বিরুদ্ধাচরণ তাঁকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারে নি। কয়েকটি বেদুঈন গোত্র যাকাত প্রদানে অস্বীকার করলে তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে ইসলামী রাষ্ট্রকে ইসলামী বিধান অনুযায়ী কর প্রদানে বাধ্য করেন। তিনি দ্বীনকে ‘মুরুওয়ার’র ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেন। ভণ্ডনবীদের সমুচিত শিক্ষা দিয়ে তিনি ইসলামের বুনিয়াদ সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। আমীর- উল-মুমেনীন হিসেবে হযরত আবুবকর (রা) আরব-ভূ-খণ্ড থেকে প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, ভণ্ডামি এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপকে ধ্বংস করে ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। মৌলানা মুহম্মদ আলী বলেন, “প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামের তরীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য।”

রাষ্ট্র সংগঠক এবং পরিচালক হিসেবে হযরত আবুবকর (রা) অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। অন্তবিপ্লব, হিংসা, দ্বেষ, গৃহযুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা যখন সমগ্র আরব জাতিকে গ্রাস করার উপক্রম করে তখন তিনি যুদ্ধাভিযান এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেন এবং ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে সক্ষম হন। কেন্দ্রীয় শাসন গোত্র শাসনের ঊর্ধ্বে স্থান পায় এবং সমগ্র আরব গোত্র মদীনা থেকে পরিচালিত খলিফার শাসনের আওতাভুক্ত হয়। একই সমাজ ব্যবস্থার গণ্ডীর মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট জীবন-যাত্রার সুযোগ লাভ করে। খলিফা আবুবকর সহজেই বুঝতে পারেন যে, বিশ্বজয়ের পূর্বে আরব দেশকে সর্বপ্রথম আরববাসীদের জয় করতে হবে। কারণ, সুংসহত এবং সুগঠিত রাষ্ট্র ব্যতীত পার্শ্ববর্তী শত্রুভাবাপন্ন পারস্য এবং বায়জানটাইন সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা সম্ভবপর নয়। হযরত ওমরের সময় ইসলাম ধর্মের প্রচার এবং রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ আবুকরের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং বলিষ্ঠ সামরিক ব্যবস্থার জন্যই কার্যকর হয়।

হযরত আবুবকরের সময় কুরআন শরীফের বাণীগুলো সংগৃহীত হয়। রাসূলের করীমের নিকট ঐশীবাণী প্রেরিত হলে তিনি সাহাবীদের লিখে রাখিতে অথবা মুখস্থ রাখতে বলতেন। ভণ্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে পরিচালিত ইয়ামামার যুদ্ধে বহু সংখ্যক হাফেজ শহীদ হলে হযরত ওমরের পরামর্শে হযরত আবুবকর রাসূলে করীমের ব্যক্তিগত সচিব যায়েদ-বিন-ছাবিতকে (Zaid Ibn Thabit) কুরআনের বাণীগুলো সংগ্রহ করে পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করে রাখবার নির্দেশ দেন। হযরত আবুবকরের ইন্তেকালের পর এই পবিত্র গ্রন্থ খলিফা ওমরের নিকট ছিল এবং পরে তাঁর কন্যা ও রাসূলের স্ত্রী বিবি হাফসার নিকট সংরক্ষিত ছিল। হযরত ওসমানের খিলাফতে বিবি হাফসার নিকট সংরক্ষিত আসল কুরআনের কপি থেকে সংকলন করে কুরআন শরীফ প্রকাশ করা হয়।

ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সেবা এবং আত্মোৎসর্গ করবার জন্য হযরত আবুবকরকে “ইসলামের পরিত্রাণকর্তা” (Saviour of Islam) বলা হয়।

হযরত আবুবকরের চরিত্র

ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর (রা) চারিত্রিক মাধুর্যের জন্য সর্বজনবিদিত ছিলেন। শারীরিক গঠনের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন গৌরবর্ণ, ক্ষীণ এবং বেঁটে। তাঁর ললাট ছিল প্রশস্ত। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে দুই এবং পরে দুই বিবাহ করেন। আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান ও মুহাম্মদ নামে তাঁর তিনটি পুত্র সন্তান এবং আসমা, আয়েশা (রাসূলের পত্নী) ও উম্মে কুলসুম নামে তিনটি কন্যা ছিল। তিনি সহজ-সরল ও অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন এবং খলিফা হবার পরেও তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার- ব্যবহার কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি। পূর্বের ন্যায় তিনি একই রকম সাদাসিধা পোশাক পরিধান করতেন, একই উষ্ট্রের চামড়া নির্মিত তাঁবুর গৃহে বাস করতেন এবং একই ব্যবসায়ের আয়ের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তীকালে বন্ধু-বান্ধবের অনুরোধ তিনি বার্ষিক বেতন হিসেবে বায়তুল মাল হতে ৬,০০০ দিরহাম গ্রহণ করতে স্বীকৃত হন। মূইর বলেন, “মুহাম্মদ (স) যদি একজন স্বজ্ঞান প্রতারক হতেন তা হলে তিনি কখনই এমন একজনের বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব লাভ করতে পারতেন না যিনি কেবলমাত্র বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং জ্ঞানীই ছিলেন না, বরং সমস্ত জীবন একনিষ্ঠ এবং সৎ ছিলেন।”

কুরাইশ বংশসম্ভূত হযরত আবুবকর (রা) ছিলেন অসাধারণ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী। বংশমর্যাদা, উদারতা এবং চারিত্রিক মাধুর্যের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাঁর একনিষ্ঠ সেবা এবং সততার জন্য রাসূল (স) তাঁকে ‘সিদ্দিক’ বা সত্যনিষ্ঠ উপাধি প্রদান করেন। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে, শান্তি-সংগ্রামে হযরত আবুবকর (রা) রাসূল (স) কে ছায়ার মত অনুসরণ করেন। তাই মহানবীর সমস্ত জ্যোতি, আদর্শ, ধ্যান- ধারণা জীবনাদর্শের বহু বৈশিষ্ট্য তাঁর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর ঈমানের দৃঢ়তা, ন্যায়পরায়ণতা, অসীম ধৈর্য, কঠিন সংযম, স্থিরচিত্ততা ব্যতীত ইসলাম ভণ্ডনবীদের বিদ্রোহে ধ্বংস হয়ে যায়। মূরই বলেন, “আবুবকর খিলাফত স্বল্পমেয়াদী হলেও মুহাম্মদ (স) এর পর আর কারও জীবনে তাঁর পূর্ণ জীবনপদ্ধতি এমন মূর্তরূপ পরিগ্রহ করে নি।”

হযরত আবুবকরের চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় যাওয়া যায় তাঁর নিরপেক্ষ বিচারে, নির্ভীক রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় এবং দৃঢ় নীতি বাস্তবায়নে। রাসূলের করীমের ভরণ- পোষণ ফিদাক নামক সম্পত্তির আয় থেকে নির্বাহ করা হত। রাসূলের ওফাতের পর হযরত ফাতেমা (রা) উত্তরাধিকারী হিসেবে ফিদাক দাবি করলে খলিফা তা মঞ্জুর করতে অস্বীকার করেন এবং তা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। ইসলামের পরিত্রাণকারী খলিফা আবুবকর (রা) রাষ্ট্র সংগঠক হিসেবে যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেন। আমীর আলী বলেন, “তিনি তাঁর গুরুর ন্যায় আচার-ব্যবহারে অনাড়ম্বর ছিলেন। তিনি বিনীত অথচ দৃঢ় ছিলেন এবং নূতন রাষ্ট্রের শাসনকার্যে ও জনসাধারণের কল্যাণে তিনি সর্বশক্তি নিয়োজিত করেন।”

ধর্মীয় মতবাদে হযরত আবুবকর (রা) যেমন ছিলেন অটল তেমনি রাষ্ট্রীয় কার্যনির্বাহে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রপন্থী এবং নির্ভীক। খলিফা নির্বাচিত হয়ে তিনি উদ্বোধনী ভাষণে মুসলমানদের নিকট থেকে পরামর্শ এবং ভুল-ত্রুটির জন্য সংশোধন কামনা করেন। তিনি মনে-প্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। এই কারণে মজলিস-উস-শূরা বা মন্ত্রণা পরিষদ গঠন করে তিনি কুরআন ও হাদিসের বিধান অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্র প্রধান এবং মুসলিম জাহানের আমীর। ধর্মীয় ও পার্থিব কার্যকলাপের সুষ্ঠু সমন্বয় তাঁর চরিত্রে দেখা যায়। নম্র স্বভাবের জন্য তিনি বলতেন, “আমাকে আল্লাহর খলিফা বলবে না, আমি কেবল আল্লাহর রাসূলের খলিফা।” মৌলানা মুহাম্মদ আলীর মতে, “রাজতন্ত্রকে দেশের আইনের অধীন এবং দেশের আইনকে জনাসাধারণের ইচ্ছার অধীন করে আবুবকর (রা) প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের গোড়াপত্তন করেন এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও সম-অধিকার প্রদান করেন।”

রাসূলে করীমের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে হযরত আবুবকর (রা) এর চারিত্রিক মাধুর্য প্রস্ফুটিত হয়েছিল। রাসূলে করীমের অন্তর্ধানে ইসলামী রাষ্ট্রে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তখন তিনি দিকভ্রষ্ট এবং বিভ্রান্ত মুসলিম জাহানকে কাণ্ডারীর মত নির্দিষ্ট গতিতে পরিচালিত করে অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছে। সরল, অকপট, দানশীল, ধর্মভীরু, বিচক্ষণ, পরিশ্রমী, দূরদর্শী হযরত আবুবকর (রা) স্বীয় কন্যা বিবি আয়েশার সাথে রাসূলের পরিণয়ের মাধ্যমে মহানবীর সাথে আত্মিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। হযরত আলী (রা) বলেন, “রাসূলের করীমের পর আবুবকর এবং ওমর শ্রেষ্ঠ মুসলমান ছিলেন।” মৌলানা মুহাম্মদ আলী যথার্থই বলেছেন, “তাঁর নম্রতা এবং একনিষ্ঠ অনাড়ম্বর জীবন, মহান নীতিজ্ঞান, ইস্পাত-কঠিন সংকল্প, অবিচল অধ্যবসায় এবং সর্বোপরি অটল বিশ্বাস প্রভৃতি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ইসলামের ইতিহাসে তাঁর স্থান মহানবীর পরেই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *