প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫ – ৭১৫ খ্রি.)

পঞ্চম অধ্যায় – প্রথম ওয়ালিদ [ ৭০৫-৭১৫ খ্রি.]

প্রথম ওয়ালিদের সিংহাসনারোহণ

খলিফা আবদুল মালিকের মৃত্যুর পর ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ওয়ালিদ নির্বিঘ্নে মুসলিম সাম্রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। মারওয়ানের মনোনয়ন অনুযায়ী আবদুল মালিকের ইন্তেকালে তদীয় ভ্রাতা আবদুল আজীজ উত্তরাধিকারী ছিলেন। কিন্তু আবদুল মালিকের মৃত্যুর পূর্বে তিনি দেহত্যাগ করলে ওয়ালিদ পিতার মনোনয়ন অনুযায়ী দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন। মূইর বলেন, “ওয়ালিদের রাজত্বকাল দেশে এবং বিদেশে খুবই গৌরবময় ছিল।” (“The reign of Walid was glorious both at home and abroad”)

প্রাথমিক কার্যাবলি

খিলাফত লাভ করে প্রথম ওয়ালিদ শাসনকার্য নিজ হস্তে পরিচালনার সর্বপ্রকার দায়িত্ব গ্রহণকরেন। তিনি তাঁর পিতা কর্তৃক নিযুক্ত সাম্রাজ্যের পুর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা হাজ্জাজকে তার পদে বহাল রাখেন। হাজ্জজের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলিম সাম্রাজ্য ভারত উপ-মহাদেশে এবং মধ্য-এশিয়ায় বিস্তৃতি লাভ করে। ওয়ালিদ শাসনকার্যে নানারূপ রদবদল করে সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করবার প্রয়াস পান। তিনি তাঁর চাচাত ভাই ওমর ইবন-আবদুল আজীজকে (দ্বিতীয় ওমর) হেজাজের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ধর্মপ্রাণ দ্বিতীয় ওমর খোলাফায়ে রাশেদূনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে শান্তি ও জনকল্যাণকর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি মক্কা-মদিনার আইনজ্ঞ এবং ওলামাদের নিয়ে একটি মন্ত্রণা পরিষদ গঠন করে তাদের পরামর্শক্রমে শাসনকার্য নির্বাহ করতেন। ইয়াজিদ ও আবদুল মালিকের রাজত্বে পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরীদ্বয়ের যে ক্ষতি সাধিত হয় ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়নিষ্ঠ দ্বিতীয় ওমর তার সংস্কার করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। অসংখ্য ইমারত, পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মণ করে তিনি মক্কা ও মদিনাকে সুশোভিত করেন। মদিনা মসজিদটি পুনঃনির্মিত ও সুসজ্জিত করে তার চতুর্দিকে রাসূলে করীমের স্ত্রী ও তাঁর সাহাবীদের যে সমস্ত গৃহাদি ছিল সেগুলোকে এর আওতাভুক্ত করা হয়। এই পুনঃনির্মাণ ও সম্প্রসারণে তিনি সিরিয়া হতে দক্ষ কারিগর সংগ্রহ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, দ্বিতীয় ওমর মদিনা মসজিদের সংস্কারের সময় সর্বপ্রথম এতে ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন একটি বক্র মিহরাব (Concave Mihrab ) নির্মাণ করেন। হজ্ব পালন এবং যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাজধানী দামেস্কের সাথে হেজাজের বিভিন্ন শহরের যোগাযোগ রক্ষাকল্পে বহু কূপ এবং রাস্তাঘাট নির্মিত হয়। দ্বিতীয় ওমরের জনকল্যাণকর কার্যকলাপে তাঁর জনপ্রিয়তাই শুধু বৃদ্ধি পেল না; বরং ইরাক থেকে বহু লোক হাজ্জাজের নির্যাতন হতে অব্যাহতি পাবার জন্য হেজাজে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে।

ওমর-ইবন-আবদুল আজীজ হেজাজের সুযোগ্য শাসনকর্তা হিসাবে অশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং খলিফা ওয়ালিদ তাঁর জনকল্যাণকর কার্যের উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেন। কিন্তু রক্তলোলুপ ও স্বৈরাচারী শাসক হাজ্জাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ইরাক থেকে বহু লোক মক্কা ও মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। দ্বিতীয় ওমর খলিফাকে হাজ্জাজের নির্যাতনের কথা অবহিত করেন; অপরদিকে হাজ্জাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওমরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদিগকে আশ্রয় দানের জন্য খলিফার নিকট অভিযোগ আনেন। ওয়ালিদ হাজ্জাজকে সমর্থন করে ৭০৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ওমরকে হেজাজের শাসনকর্তার পদ থেকে অপসারণ করেন। মক্কা ও মদিনার জন্য দুজন পৃথক শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।

৭০১ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মালিক ইয়াজিদ-বিন মুহাল্লাবকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। হাজ্জাজের সঙ্গে প্রথম দিকে তাঁর সদ্ভাব ছিল কিন্তু মুহাল্লাবের হিমারীয় প্রবণতায় ক্ষমাতলোভী ও সন্ধিগ্ধচিত্ত হাজ্জাজ ক্রুদ্ধ হন। আক্রোশবশত ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জাজ ইয়াজিদ-বিন-মুহাল্লাবকে খোরাসানের শাসনকর্তার পদ হতে অপসারণ করেন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি অপব্যবহারের ভিত্তিহীন অভিযোগে তাঁকে এবং তাঁর ভ্রাতাকে কারারুদ্ধ করেন। খলিফা ওয়ালিদ এবং সুলায়মানের হস্তক্ষেপে ইয়াজিদ-বিন-মুহাল্লাব কারামুক্ত হয়ে প্যালেস্টাইনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইয়াজিদ সুলায়মানের প্রিয়পাত্র থাকায় তাঁর অনুগ্রহে বাস করতে লাগলেন। ইয়াজিদ-বিন-মুহাল্লাবের পদচ্যুতির পর ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জাজ কুতাইবাকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

সাম্রাজ্য বিস্তার

মুসলিম সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের ইতিহাসে খলিফা প্রথম ওয়ালিদ একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন। সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতা হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। হযরত ওমর ও হযরত ওসমানের খিলাফতে মুসলিম রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের যে সূচনা হয় তা খলিফা আবদুল মালিক এবং তদীয় পুত্র প্রথম ওয়ালিদের রাজত্বে ব্যাপক আকার ধারণ করে। সর্বপ্রথম মুসলিম আধিপত্য এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপ মহাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে এবং মুসলিম সীমানা আমূর দরিয়া (Oxus) থেকে আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এই বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় যারা নেতৃত্ব দান করেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হাজ্জাজ, কুতাইবা, মুহাম্মদ-বিন- কাশেম, তারিক এবং মুসা। শৌর্যবীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এই সমস্ত জগদ্বিখ্যাত রণকুশীলগণ যে অপূর্ব বিজয়োন্মাদনার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা খুবই বিরল।

মধ্য-এশিয়া বিজয় : খলিফা ওয়ালিদের সুযোগ্য পূর্বাঞ্চলীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ- বিন-ইউসুফের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলিম সাম্রাজ্য পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত হয়। ইয়াজিদ- ইবন-মুহাল্লাবের স্থলে হাজ্জাজ ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে কুতাইবা-ইবন-মুসলিমকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করলে মধ্য-এশিয়ায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের নবদিগন্ত সূচিত হয়। মধ্য-এশিয়া অথবা ট্রান্সঅক্সিয়ানায় বলখ, তুখারিস্তান, বোখারা, খারিজম প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য অবস্থিত ছিল। তুর্কীরা ঘন ঘন আক্রমণ করে মুসলমানদের অতিষ্ঠ করে তুললে ৭০৬ খ্রিস্টাব্দে এক বিরাট বাহিনীসহ কুতাইবা বলখ, তুখারিস্তান ও ফারগানার দিকে অগ্রসর হন। সেখানকার শাসনকর্তাদের পরাজিত করে তাদেরকে খলিফার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়। এরপর তিনি আমুর দরিয়া বা অক্সাস (Oxus) নদী অতিক্রম করে বোখারা আক্রমণ এবং দখল করেন। এ রাজ্যের সম্রাটের ভ্রাতুষ্পুত্রের নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী কুতাইবার অভিযানে বাধা প্রদান করেন; কিন্তু মুসলমানদের প্রচণ্ড আক্রমণে বুখারার রাজা ওয়ারদান পলায়ন করেন। ৭০৬-৭০৯ খ্রিস্টাব্দে বুখারা মুসলমানদের দখলে আসে।

শীতের আগমনে মুসলিম বাহিনীকে তুখারিস্তানের বিদ্রোহিগণ ব্যতিব্যস্ত করতে থাকলে শত্রু মোকাবিলা করবার জন্য কুতাইবা পারস্য হতে সৈন্য সংগ্রহ করে অভিযান পরিচালনা করেন এবং বিদ্রোহীদের ফারগানা উপত্যকার অভ্যন্তরে বিতাড়িত করেন। শত্রুপক্ষের নেতাসহ ৭০০ বন্দীকে হত্যা করা হয়। এভাবে সমগ্র তুখারিস্তানে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে ৭১০ খ্রিস্টাব্দে কুতাইবা খারিজমের শাহের আমন্ত্রণে অক্সাস নদী পার হয়ে খারিজমে গমন করেন। খারিজমের শাহের সাথে মুসলমানদের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অতঃপর সমরকন্দের রাজাও ভীত হয়ে কুতাইবার নিকট সন্ধির প্রস্তাব করেন। ৭১০ খ্রিস্টাব্দ হতে ৭১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমরকন্দ ও খারিজম অধিকৃত হয়। বিজিত রাজ্য হতে সৈন্য সংগ্রহ করে কুতাইবা ৭১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমরকন্দ ও খারিজম অধিকৃত হয়। বিজিত রাজ্য হতে সৈন্য সংগ্রহ করে কুতাইবা ৭১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খোজান্দা, শাশ এবং ফারগানার অন্যান্য শহর অধিকার করে কাশগড় এবং চীন সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু খলিফা ওয়ালিদের মৃত্যুর সংবাদে কুতাইবা অভিযান বন্ধ করেন। “মুদারীয় বংশসম্ভূত কুতাইবা”, আমীর আলীর মতে, “একজন সুযোগ্য সমরবিদ এবং দক্ষ সেনাপতি” (an able strategist and a consummate general) ছিলেন। কুতাইবার দুর্বার অভিযানে মধ্য-এশিয়ার চীন সাম্রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত মুসলিম প্রভুত্ব বিস্তৃত হয়। ক্রমশ এই সমস্ত অঞ্চলে মুসলিম উপনিবেশ গড়ে উঠে এবং মধ্য-এশিয়া, তুর্কী ও চীনাদের সংস্পর্শে এসে মুসলিম কৃষ্টির উৎকর্ষ সাধিত হয়।

সিন্ধু বিজয় : মুসলমানদের সিন্ধু বিজয় প্রথম ওয়ালিদের রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হযরত ওমরের খিলাফতে পারস্য বিজয় সিন্ধু অভিযানের পথকে সুগম করে। ৬৩৬-৩৭ এবং ৬৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দের প্রাথমিক অভিযান সাফল্যমণ্ডিত না হওয়ায় হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ খলিফা ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে সিন্ধুতে অভিযান প্রেরণ করেন। ওবায়দুল্লাহ এবং বুদায়েলের নেতৃত্বে প্রেরিত অভিযান ব্যর্থ হলে তাঁর জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ-বিন-কাসিম ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ৬০০০ উষ্ট্রারোহী, ৬০০০ সিরীয় অশ্বারোহী এবং ২০০০ ভারবাহী পশুর সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী নিয়ে মেকরান অঞ্চলে প্রবেশ করেন। এই অভিযানের মূলে বিশেষ কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত, খলিফা ওয়ালিদের সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণ নীতি ভারতবর্ষে মুসলিম অভিযানের অন্যতম কারণ। দ্বিতীয়ত, ভারত উপকূলে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ফলে আরব বণিকগণ ভারতবর্ষের ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে অবগত হয় এবং অর্থনৈতিক কারণে সিন্ধুতে অভিযান করে। তৃতীয়ত, ভারতীয় রাজাগণ মুসলিম অগ্রগতিকে বাধা দানের জন্য পারস্য ও কাবুলে সৈন্য প্রেরণ করলে তাদের শাস্তি প্রদান। চতুর্থত, হাজ্জাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বহু ইরাকী সিন্ধু অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করলে হাজ্জাজ সিন্ধুর হিন্দু রাজা দাহিরকে বিদ্রোহীদের প্রত্যর্পণ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। পঞ্চমত, সিংহলের রাজা কর্তৃক খলিফা ওয়ালিদ এবং হাজ্জাজকে প্রেরিত বহু মূল্যবান উপঢৌকন সম্বলিত জাহাজ দেবলের জলদস্যুরা লুণ্ঠন করলে হাজ্জাজ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। এই জাহাজে স্বদেশ যাত্রী বহু আরব বণিকও ছিল। রাজা দাহিরের নিষ্ক্রিয়তার ফলে মুহাম্মদ-বিন-কাসিম তাঁকে সমুচিত শিক্ষা দিবার জন্য যুদ্ধাভিযান করেন।

মুহাম্মদ-বিন-কাসিম মেকরান হয়ে দেবল বন্দরে আগমন করে শহরটি দখল করেন এবং বিনা বাধায় সমরাভিযান পরিচালিত করে নিরুন (হায়দ্রাবাদের নিকট), সিয়ান, সিস্তান অধিকার করেন। অতঃপর রাওয়ারের যুদ্ধে দাহিরের চক্ষু শরবিদ্ধ হলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং দাহিরের সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। দাহিরের পত্নী রাণীবাঈ শত্রুর মোকাবিলা করতে না পেরে অন্তঃপুরীকাগণসহ জহরব্রত পালন করে অগ্নিকুণ্ডে ভস্মীভূত হন। মুহাম্মদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুলতান ও উঁচে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে সমগ্র সিন্ধু ও পাঞ্জাবের কিয়দংশ ইসলামের পতাকাতলে আসে। সন্দেহের বশে খলিফার আদেশে মুহাম্মদ-বিন-কাসিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

ফলাফল : লেনপুল বলেন, “ভারত এবং ইসলামের ইতিহাসে আরবদের সিন্ধু বিজয় একটি উপাখ্যান বিশেষ; এটি একটি নিষ্ফল বিজয়।” রাজনৈতিক ফলাফল বিচারে এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ; কারণ মাত্র ৩০ বছর (৭১২-৪২) সিন্ধু অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য বলবৎ ছিল। খলিফাদের সঙ্কোচন নীতি ও অনুদার মনোভাব, গোত্র- কলহ ও হিন্দু বিরোধিতা প্রভৃতি কারণে সিন্ধু বিজয় নিষ্ফল হলেও এর ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ফলে ব্রাহ্মণদের সকল কার্যে নিযুক্ত করা হয়। সাম্য ও মৈত্রীর বাণী প্রচারে ইসলাম প্রসারতা লাভ করে এবং বর্ণ- বৈষম্যে প্রচণ্ড আঘাত হানলে বহু নিম্নবর্ণের হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করে। মুসলমানগণ সর্বপ্রথম দেবলে (বানবোর) একটি মসজিদ নির্মাণ করে। মুসলিম স্থাপত্য-রীতি প্রাচীন ভারতীয় শিল্প-স্থাপত্যের সংস্পর্শে আসলে মুসলিম ভারতীয় স্থাপত্যের জন্ম হয়। মুসলিম বিজয়ের ফলে বহু পীর, দরবেশ, আওলিয়া এদেশে ইসলাম প্রচারে আসেন এবং সামাজিক পরিবেশের পটভূমি পরিবর্তন করেন। উপরন্তু, আরবগণ সর্বপ্রথম ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, গণিত, ভেষজ, জ্যোর্তিবিদ্যা, লোকগীতি সম্বন্ধে অবগত হন। পরবর্তীকালে আল-বেরুনী ও আবু মা’সার সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করে হিন্দু সংস্কৃতি চর্চা করেন। খলিফা আল-মনসুরের রাজত্বে ব্রহ্মগুপ্তের ‘খাদ্য-খন্দক’ (Khada-Khandyaka) এবং ‘ব্রহ্ম- সিদ্ধান্ত’ (Brahma Siddhanta ) সংস্কৃত থেকে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়।

আফ্রিকা বিজয় : খলিফা ওয়ালিদ ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মুসা-ইবন-নুসায়েরকে হাসান- বিন-নোমানের স্থলে ইফ্রিকা অথবা উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মুয়াবিয়ার খিলাফতে মুসার পিতা পুলিশপ্রধান বা সাহিব-উস-সুরতা ছিলেন। পূর্বাঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তারে হাজ্জাজ যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিনায়ক ছিলেন তেমনি মুসা-ইবন-নুসাইর পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম প্রভূত্ব বিস্তারের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের জনক ছিলেন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ শাসক এবং প্রতিভাবান সমরকুশলী মুসা মিসরের আওতা হতে উত্তর আফ্রিকাকে সরাসরি দামেস্কের অধীনে আনয়ন করেন। শাসনকর্তা নিযুক্ত হবার পর তিনি তার দুই সুযোগ্য পুত্রের সহায়তায় বর্বর বার্বারদের কঠোর হস্তে দমন করেন এবং তাদের অনেকেই ধৃত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। বার্বার ও বায়জানটাইনদের সংঘবদ্ধ অভিযানের মূলে কুঠারাঘাত করে মুসা মরক্কো ও তাঞ্জিয়ারসহ সমগ্র ইফ্রিকাতে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল হতে বায়জানটাইনগণ পুনঃ পুনঃ নৌ-পথে আক্রমণ করে মুসলিম সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে মুসা নৌ- বাহিনীর সাহায্যে মেজকা, মিনকা এবং শক্তিশালী আইভিকা দ্বীপত্রয় জয় করেন। এ সমস্ত অভিযানে মুসাকে সাহায্য করেন দক্ষ যোদ্ধা তারিক-ইবন-জিয়াদ। তারিককে তাঞ্জিয়ারে প্রতিষ্ঠিত করে মুসা রাজধানী কায়রোয়ানে প্রত্যাবর্তন করেন!

স্পেন বিজয় : খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালের একটি চমকপ্রদ ঘটনা ছিল স্পেন বিজয়। মুসা-ইবন-নুসাইর উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল আইবেরিয়ান উপদ্বীপে দৃষ্টি নিবন্ধ করেন। ইসলামের সামরিক ইতিহাসে স্পেন বিজয় সর্বশেষ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। হিট্টি বলেন, “যুদ্ধের ক্ষিপ্র গতিশীলতা এবং বিজয়ের পূর্ণ সাফল্যের জন্য স্পেন অভিযান মধ্যযুগের সামরিক ইতিহাসে এক অনুপম স্থান অধিকার করে আছে।”

প্রাক-মুসলিম স্পেনের অবস্থা

রাজনৈতিক অবস্থা : উচ্চভিলাষী ও অত্যাচারী রডারিক ন্যায়সঙ্গত রাজা উইটিজাকে পদচ্যুত ও নিহত করে বলপূর্বক সিংহাসন অধিকার করেন। প্রাক-মুসলিম আইবেরিয়ান উপদ্বীপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য অনেক স্পেনবাসী আফ্রিকায় আশ্রয় গ্রহণ করে।

সামাজিক অবস্থা : অর্থলোভী এবং অধঃপতিত খ্রিস্টান বিশপগণ, স্বার্থপর ও হৃদয়হীন ভূস্বামীরা স্পেনবাসীকে শোষণ করত। সমাজ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল : (১) সুবিধাভোগকারী অভিজাত সম্প্রদায়, (২) নিম্নশ্রেণীভুক্ত কৃষক এবং (৩) ক্রীতদাসগণ আভিজাত সম্প্রদায়কে কোন প্রকার কর দিতে হত না; নিম্নশ্রেণীভুক্ত কৃষকদের ও ক্রীতদাসদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। কৃষকরা ক্রীতদাসদের (Serfs) পর্যায়ভুক্ত ছিল।

ধর্মীয় অবস্থা : খ্রিস্টানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ইহুদীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না। তারা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত ছিল।

অভিযানের কারণ : স্পেন বিজয়কে মুসলিম সম্প্রসারণবাদের ফলশ্রুতি বলা যায় এবং উত্তর আফ্রিকা বিজয় একে ত্বরান্বিত করে। স্পেনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মুসলিম অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করে। কথিত আছে যে, অত্যাচারী রাজা রডারিক সিউটা দ্বীপের রাজা কাউন্ট জুলিয়ানের দুহিতা ফ্লোরিন্ডার শ্লীলতাহানি করায় আক্রোশবশে জুলিয়ান মুসা-ইবন-নুসাইরকে স্পেন বিজয়ের আমন্ত্রণ জানান।

ঘটনা : খলিফা ওয়ালিদের আদেশক্রমে মুসা ৭১১ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত সেনাপতি তারিক-ইবন-জিয়াদের নেতৃত্বে একটি বিশাল মূর বাহিনী স্পেন অভিযানে প্রেরণ করেন। জিবরাল্টার অথবা জবল-উত-তারিকে অবতরণ করে তারিক স্পেনের মূল ভূখণ্ডে অভিযান পরিচালনা করেন। সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে তিনি রাজধানী টলেডোর দিকে অগ্রসর হন। গোয়াডিলেট নদীর তীরে মুসলিম ও খ্রিস্টান বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। রডারিক শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে নদীগর্ভে নিমজ্জিত হন। বিজয়দীপ্ত তারিক কারমোনার, সিডোনিয়া, ইজিসা দখল করেন। মুসলিম সৈন্যবাহিনীকে চারভাগে বিভক্ত করে মালাগা, গ্রানাডা এবং টলেডোর দিকে প্রেরণ করা হয় এবং গথিক রাজ্যের বহু অঞ্চলে মুসলিম প্রভুত্ব কায়েম হয়।

ঈর্ষাপরায়ণ সেনাধ্যক্ষ মুসা ৭১২ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে স্পেনে আগমন করেন এবং সিডোনিয়া, সিভাইল, মেরিডা, তালাভেরা অধিকার করেন। মুসা এবং তারিকের সম্মিলিত বাহিনী পর্যায়ক্রমে গ্যালিসিয়া, লিওন, অ্যাস্টুরিয়াস, সারাগোসা, আরাগন, ক্যাটালোনিয়া, বার্সিলোনা অধিকার করে উত্তরে পিরেনীজ পর্বতমালা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ৭১২ থেকে ৭১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খ্রিস্টান স্পেনের প্রায় সমগ্র অঞ্চল মুসলিম পতাকাতলে আসে।

ফলাফল : মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের ফলাফল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। স্পেন বিজয়ে শুধু উমাইয়া বংশের প্রভুত্বই বিস্তৃতি লাভ করল না, বরং মুসলিম রাজ্য সম্প্রসারণে ইউরোপে ইসলামের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়। স্পেন বিজয় পক্ষান্তরে ইউরোপ বিজয়ের সুচনা করে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পিরেনীজ পর্বতে দণ্ডায়মান অবস্থায় মুসা এবং তারিক যখন ফ্রান্স তথ ইউরোপে অভিযানে পরিকল্পনায় ব্যস্ত ঠিক তখনই তাঁদের দামেস্কে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেওয়া হয়। এই আদেশের ফলে ইউরোপে ইসলামের বিস্তৃতি ব্যাহত হয়। একথা মনে করা অসঙ্গত নয় যে, যদি মুসা ও তারিক এই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতেন তা হলে হয়ত প্যারিস ও লণ্ডনের গীর্জাগুলোতে ঘণ্টা-ধ্বনির স্থলে আজানের স্বর ধ্বনিত হত। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে আবদুর রহমান গাফেকী দক্ষিণ ফ্রান্সের টু (Tours) শহরে অভিযান করেন কিন্তু চার্লস মার্টেল (Charles Martel)-এর নিকট টুরসের যুদ্ধে (Battle of Tours তিনি পরাজিত হলে “এই শহরটি মুসলিম বিজয়ী সৈন্যবাহিনীর সর্বদূরবর্তী সীমান নির্ধারণ করে।”

স্পেন বিজয় নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করে। এর ফলে সামাজিক বৈষম্য, অসন্তোষ, সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা দূরীভূত হয়ে একটি সুষ্ঠু, সংঘবদ্ধ, শান্তি ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজ গড়ে উঠে। শ্রেণীহীন সমাজ গঠনে ইসলামের অবদান অপরিসীম। সুবিধাভোগকারী ধর্মযাজক ও অভিজাত শ্রেণীর প্রাধান্য লোপ পায় এবং মুসলমান ও অমুসলমান মধ্যবিত্তদের করভার হ্রাস করা হয়। ক্রীতদাসগণ মুক্তহয়ে স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে।

আমীর আলী বলেন, “স্পেনে মুসলিম শাসন থেকে বর্তমান কালের বহু সরকারের শিক্ষা গ্রহণ করবার অনেক বিষয় রয়েছে।” ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইসলামের একটি অমোঘ বিধান। ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলমানগণ জিজিয়া কর প্রদান করে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে এবং নির্বিঘ্নে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে থাকে। খ্রিস্টান এবং ইহুদীদের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হত না। স্পেনে মুসলমানদের উদার ও প্রগতিশীল শাসন-ব্যবস্থার ফলেই সুষ্ঠু ও সুসংহত পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং পক্ষান্তরে স্পেনিশ- মুসলিম কৃষ্টি ও সভ্যতার উন্মেষ হয়।

ডোজী (Dozy) বলেন, “কর্ডোভার মূরগণের বিস্ময়কর সংগঠন মধ্যযুগের একটি অলৌকিক ঘটনা। সমগ্র ইউরোপ যখন বর্বরোচিত অজ্ঞানতা ও দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত তখন কর্ডোভা দুনিয়ার সামনে শিক্ষা ও সভ্যতার উজ্জ্বল ও দীপ্ত মশাল বহন করে।” স্পেনে শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানগণ যে প্রভূত উৎকর্ষ সাধন করে উহার প্রভাব ইউরোপে পরিলক্ষিত হয়।

প্রথম ওয়ালিদের চরিত্র ও কৃতিত্ব

ইসলামের ইতিহাসের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতা প্রথম ওয়ালিদ পিতার সুযোগ্য পুত্র ছিলেন। তিনি উজ্জ্বল, গৌরবর্ণ, দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিলেন। ওয়ালিদ পিতার কূটনৈতিক দক্ষতা ও মৌলিকতার দাবিদার না হলেও তিনি শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠাতা ও বিজেতা হিসেবে পিতার চেয়ে অধিকতর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।

মাসুদী এবং ইবনে-আতির ওয়ালিদকে স্বেচ্ছাচারী, দুরাত্মা ও অত্যাচারী নৃপতি বলে অভিহিত করেন। আরবদের ‘নিরো’ নামে খ্যাত হাজ্জাজকে পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশসমূহের শাসনকর্তা নিযুক্ত করায় ওয়ালিদকে এরূপ দোষারোপ করা হয়। এই নির্যাতন ও নিধনযজ্ঞ হাজ্জাজের কার্যক্রমের একটি নিকৃষ্ট পন্থা ছিল এবং উমাইয়া বংশকে কণ্টকমুক্ত করবার জন্য তাঁকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে, পিতা আবদুল মালিকের মত ওয়ালিদ হাজ্জাজের প্রভাবাধীন ছিলেন না; বরং মাত্রাধিক আতিশয্য প্রকাশ করলে ওয়ালিদ হাজ্জাজকে নিবৃত্ত করতে দ্বিধা করতেন না। বলা বাহুল্য যে, হাজ্জাজকে পদচ্যুত করলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হত এবং মুসলিম আধিপত্য ভারত উপমহাদেশ ও মধ্য-এশিয়ায় বিস্তার লাভ করতে পারত না। আমীর আলী বলেন, “বহু যুগ পরে আমরা কেবল তাঁর উৎকৃষ্ট কার্যাবলি স্মরণ করতে পারি।”

প্রথম ওয়ালিদ পরোপকারী, মহানুভব ও আদর্শ খলিফা হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে অশেষ অবদান রেখে গেছেন। আমীর আলী বলেন, “তিনি যে তাঁর পিতা আবদুল মালিক এবং পিতামহ মারওয়ান অপেক্ষা দয়ালু ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর বংশধরগণের অনেকের চেয়ে তিনি নিশ্চয়ই হৃদয়বান ছিলেন।” তিনি বিচক্ষণ, দূরদর্শী, কর্তব্যপরায়ন, নীতিজ্ঞানসম্পন্ন শাসক ছিলেন। বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও খলিফা প্রথম ওয়ালিদ স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করে স্থূলবুদ্ধির পরিচয় দেন নি। উইল-এর ভাষায়, “যদিও মুসলমান ঐতিহাসিকগণ আল- হাজ্জাজকে সমর্থন করার জন্য তাঁকে (ওয়ালিদ) স্বেচ্ছাচারী বলে অভিহিত করেন, তথাপি আমাদের দৃষ্টিতে তিনি আমিরুল মুমেনীনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও যোগ্যতম ছিলেন।

খলিফা ওয়ালিদ সিংহাসনে আরোহন করবার পর বিদ্রোহ, অসন্তোষ, গোত্রীয় কোন্দল এবং গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সমগ্র রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। মুদ্রারীয় ও হিমারীয় দ্বন্দ্বকে তিনি নির্মূল করেন। শিয়া ও খারিজি বিদ্রোহ দমন করে তিনি উমাইয়া রাজ্যে সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণের উপযোগী সুষ্ঠু ও সুসংহত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেন। মূইর বলেন, “প্রতিদ্বন্দ্বী আরব গোত্রদের মধ্যে তিনি কঠোর হস্তে ভারসাম্য রক্ষা করেন।”

প্রথম ওয়ালিদের রাজত্বকালের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রাজ্য বিস্তার। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি পিতা আবদুল মালিকের নিকট হতে একটি বিশাল সাম্রাজ্য লাভ করেও ক্ষান্ত হন নি। তিনি এমন একটি সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করেন যার ফলে ইসলামের প্রভুত্ব পূর্বদিকে সিন্ধু ও আমুর দরিয়ার তীর থেকে পশ্চিম দিকে আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। খলিফা যে বিশাল ও সুদূর তিনটি মহাদেশব্যাপী বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বীর সীজার, আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ানের পক্ষেও তা সম্ভব হয় নি। মূইর বলেন, “ওমরের খিলাফতসহ এমন কারও শাসনকাল নেই যার আমলে ইসলাম এতদূর সম্প্রসারিত ও সুসংহত হয়।” ঐতিহাসিক গীবন ওয়ালিদকে তৎকালীন ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট’ বলে অভিহিত করেন; কারণ, বিজয় ছিল তাঁর প্রধান ও অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব।

খলিফা ওয়ালিদের সময় নৌ-বাহিনী সুগঠিত হয়। তিনি নৌ-বাহিনীকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেন : (১) সিরীয় বাহিনী; (২) তিউনিসীয় বাহিনী; (৩) আলেকজান্দ্রিয়া বাহিনী; (৪) ব্যাবিলন বাহিনী; (৫) নীল নদের প্রবেশদ্বারে প্রতিষ্ঠিত বাহিনী। এই সমস্ত নৌ- বহর ভুমধ্যসাগর, উত্তর আফ্রিকা, আলেকজান্দ্রিয়া উপকূলে রোমান নৌ-অভিযান প্রতিহত করে মুসলিম সাম্রাজ্যের অখণ্ডত্ব বজায় রাখে। মিসরের জন্য জাহাজ ও যন্ত্র নির্মাণ কারখানা ছিল ব্যাবিলন এবং ক্লিসমায়। প্রত্যেক পোতাশ্রয়ে অসংখ্য রণতরী শত্রুর মোকাবিলা করবার জন্য প্রস্তুত থাকত। ত্রিপলিতে ১৮০০ রণতরী রাখার ব্যবস্থা ছিল।

জনহিতকর কার্যের জন্য ওয়ালিদ চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তিনি অসংখ্য খাল, হাসপাতাল, সেতু, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও কূপ খনন দ্বারা জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করবার চেষ্টা করেন। মধ্যযুগের নৃপতিদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই অন্যতম রাজা যিনি জনসাধারণের জন্য বিনা খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। বৃদ্ধ, পঙ্গু ও অন্ধদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা হয় এবং তাদের জন্য তিনি এতিমখানা ( Vagrant home ) নির্মাণ করেন। বায়তুল মাল থেকে তিনি অক্ষম ও দুর্বল লোকদিগকে নির্দিষ্ট হারে ভাতা প্রদান করতেন। তিনি সুখী, শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর রাষ্ট্র কায়েমের চেষ্টা করেন।

সিরিয়াবাসিগণ প্রথম ওয়ালিদকে সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা বলে অভিহিত করেন। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মতে, ওয়ালিদ ইসলামের ইতিহাসের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন। নিরপেক্ষ বিচারে ওয়ালিদের শ্রেষ্ঠত্ব বহুলাংশে নির্ভর করে তাঁর সিন্ধু বিজয় ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায়। বিদ্বেষভাবাপন্ন আব্বাসীয় ঐতিহাসিকগণ ওয়ালিদকে কুৎসিতরূপে চিত্রিত করলেও তাঁরই রাজত্বে শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারু ও কারুকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উমাইয়া বংশের একটি গৌরবোজ্জ্বল যুগের (Glorious age) সূচনা হয়। এ কারণে তাঁকে মামুনের রাজত্বের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। ওয়ালিদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন শহরে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মিত হয়ে কুরআন ও হাদিসের চর্চা হত এবং ধর্মীয় বিষয়ে গবেষণা ও আলোচনার দ্বারা ইসলামের সূক্ষ্ম ও মৌলিক নীতিগুলোর সুষ্ঠু বিশ্লেষণ করা হত। মক্কা-মদিনা ব্যতীত কুফা ও বসরায় কুরআন এবং হাদিস চর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠে। খলিফা ওয়ালিদের দরবারে বহু মনীষীর সমাগম হত। বহু খ্যাতনামা শিল্পী, দক্ষ কারিগর, প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সঙ্গীত বিশারদ তাঁর দরবারকে অলংকৃত করেন। আরব সঙ্গীত শাস্ত্রে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল মদিনার সঙ্গীতজ্ঞ মা’বাদ (Ma’bad) ওয়ালিদের রাজত্বকালে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। খলিফা কাব্য-প্রিয় ছিলেন এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আল-ফারাজদাক (Al-Farazdaq) রাজকবির সম্মান লাভ করেন।

চারু ও কারুশিল্প : চারু ও কারুশিল্পের উৎকর্ষ সাধনেও প্রথম ওয়ালিদের অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, প্রমোদাগার, দুর্গ প্রভৃতি নির্মাণ করে তাঁর সুকুমার বৃত্তিরই পরিচয় প্রদান করেন। তিনি স্থাপত্যশিল্পের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন। আল-ফারাবী বলেন, “সুলায়মানের আমলে যেমন উৎকৃষ্ট রন্ধন ও সুন্দরী মহিলার আলোচনা এবং ওমর-ইবন-আবদুল আজীজের শাসনকালে যেমন ধর্ম ও কুরআন সম্বন্ধে আলোচনা হত, তাঁর (প্রথম ওয়ালিদ) রাজত্বে দামেস্কের অধিবাসীরা মিলিত হলে সুরম্য স্থাপত্যকীর্তিই আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল।” ওয়ালিদ ধর্মীয় অনুরাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে রাসূলে করীমের মদিনা মসজিদটির সংস্কার এবং পুনঃনির্মাণ করেন। ৭০৭-৭০৯ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া থেকে গ্রীক এবং মিসর থেকে কপটিক কারিগর সংগ্রহ করে হেজাজের শাসনকর্তা ওমর-ইবন-আবদুল আজীজের তত্ত্বাবধানে এই কার্য সম্পন্ন করা হয়। মার্বেলের ব্যবহার দ্বারা এর সংস্কার করা হয় এবং চার কোণায় চারটি মিনার নির্মিত হয়। ওয়ালিদের মদিনা মসজিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এতে সর্বপ্রথম অবতল মিহরাব (Concave Mihrab ) ব্যবহার। খলিফা ওয়ালিদ তদীয় পিতা আবদুল মালিক নির্মিত জেরুজালেমের আল-আক্সা মসজিদটির ( Mosque Al- Aqsa ) সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন। একথা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে যে তাঁর রাজত্বে সর্বপ্রথম মার্বেল স্তম্ভের উপর খিলনারাজি নির্মিত হয়। তিনি জেরুজালেমের হেরেম শরীফে বিভিন্ন সৌধরাজি সংস্কার করে এর ধর্মীয় গুরুত্ব বৃদ্ধি করেন। খলিফার সুযোগ্য শাসনকর্তা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ তাঁর রাজত্বকালে কুফা ও বসরার অনুকরণে ওয়াসিতে ৭০৩-৭০৪ খ্রিস্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

প্রথম ওয়ালিদ ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নির্মাতার খ্যাতি লাভ করেন এবং তাঁর স্থাপত্যকীর্তির অনুপম নিদর্শন হল দামেস্কের জামে মসজিদ। ৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত এই মসজিদটি মুসলমানদের নিকট চতুর্থ আশ্চর্য বস্তু (প্রথম মক্কার বায়তুল হেরেম; দ্বিতীয় জেরুজালেমের বায়তুল মোক্কাদ্দাস; তৃতীয়ত মদিনার মসজিদ) বলে সমাদৃত। ওয়ালিদের আয়তকার মসজিদটি পূর্বে একটি গ্রীক মন্দির এবং পরে সেন্ট জনের গীর্জা ছিল। দামেস্ক বিজয়ের পর সেন্ট জনের গীর্জাটিকে বিভক্ত করে অর্ধাংশে নামাজ পড়বার ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু পরে ওয়ালিদ খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে বাকি অর্ধেক ক্রয় করেন এবং খ্রিস্টানদের অন্যত্র জমি ক্রয় করে গীর্জা নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেন। তিনটি প্রবেশপথসহ মসজিদটির প্রার্থনাগার বা লিওয়ান দুই সারি মার্বেল স্তম্ভ দ্বারা তিনটি আইলে (Aisle) বিভক্ত হয় এবং এদের মধ্যভাগে উত্তর-দক্ষিণে একটি লম্বা লাইন (Transept) প্রধান মিহরাবের দিকে গিয়েছে। ট্রানসেপ্টটির মধ্যভাগে একটি ড্রামবিশিষ্ট গম্বুজ রয়েছে। খলিফা ওয়ালিদ সিরিয়ার গীর্জাগুলোকে ম্লান করবার উদ্দেশ্যে দামেস্কে একটি সুপরিকল্পিত ও সুশোভিত মসজিদ নির্মাণের প্রয়াস পান। দামেস্কের এই মসজিদকে তিনি স্থাপত্যশৈরী, সংস্করণ ও উপকরণের সুষম বণ্টন দ্বারা একটি অতুলনীয় স্থাপত্যকীর্তিতে পরিণত করেন। একথাও অনস্বীকার্য যে, মদিনায় রাসূলে করীমের মসজিদ হতে স্থাপত্যের ক্রমবিকাশ হয়ে দামেস্কের মসজিদে এটি পূর্ণাঙ্গতা এবং চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। দামেস্কের মসজিদ ব্যতীত ওয়ালিদ মরু অঞ্চলে ‘কুশারাইর আমরা’ নামে একটি প্রমোদ- প্রাসাদ (Pleasure castle) নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দেওয়াল চিত্রাবলি (Frescoes)। হিট্টি বলেন, “মুসলিম চিত্রকলার প্রাচীনতম শিল্প নিদর্শনগুলো হচ্ছে কুশাইর আমরার প্রাচীন চিত্রগুলো। এগুলো খ্রিস্টান পদ্ধতির ছাপ বহন করে আছে। ট্রান্সজর্ডানে উমাইয়াদের প্রমোদ প্রাসাদে এবং স্নানাগারে সর্বশেষ স্পেনের ভিজিগথিক শাসক এবং খলিফার শত্রু রডারিকসহ ছয়জন নৃপতির ছবি আছে। অন্যান্য সাংকেতিক চিত্রাবলি, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস এবং কাব্যের ইঙ্গিত দেয়। বন্য গাধাকে আক্রমণরত একটি সিংহের চিত্রও রয়েছে। নর্তকী, গায়িকা এবং আমোদ-প্রমোদকারীদের নগ্ন চিত্রাবলিও রয়েছে।”

খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালকে শান্তি-শৃঙ্খলা, ঐক্য, সংহতি, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, বিজয়, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প, স্থাপত্য, চিত্রকলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষতার জন্য উমাইয়াদের ‘স্বর্ণ-যুগ’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। মূইর বলেন, “প্রথম থেকে শেষ অবধি বিচার করলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, খিলাফতের ইতিহাসে আল- ওয়ালিদ অপেক্ষা অপর কারও খিলাফত গৌরবোজ্জ্বল নয়।” (“Looking at it from first to last, we shall not find in the annals of the Caliphate a more glorious reign than that of Al-Walid.”)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *