প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

চতুর্থ অধ্যায় : আল-মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)

চতুর্থ অধ্যায় – আল-মামুন [৮১৩-৩৩ খ্রি.]

খিলাফত লাভ

৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে আল-মামুন হারুন-অর-রশীদের পারস্য দেশীয় পত্নী মারাজিলের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আবদুল্লাহ্, কুনিয়াত আবু জাফর এবং পিতা প্রদত্ত উপাধি ‘আল-মামুন’। আমীন গৃহযুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত হলে মামুন ৮১৩ খ্রিস্টাব্দে অপ্রতিদ্বন্দ্বী খলিফারূপে সমাদৃত হলেও সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন নি। কারন, তাঁর সিংহাসন লাভ মুসলিম সাম্রাজ্যে অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলার সূচনা করে। আমীর আলীর মতে, “খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে মামুন যদি শাসনভার ফজল-ইবন-সহলের উপর ন্যস্ত না করে মার্ভ হতে বাগদাদ আগমন করতেন তা হলে পরবর্তী কয়েক বছরের অরাজকতা সংঘটিত হতে পারত না।” মামুনের খিলাফতকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে : প্রথম ছয় বছর (৮১৩-১৯ খ্রি.) মামুনের মার্ভে অবস্থান এবং দর্শন ও আধ্যাত্মিকতায় আত্মনিয়োগ এবং বাগদাদে ফজল- ইবন-সহলের রাজকার্য পরিচালনা; পরবর্তী চৌদ্দ বছর (৮১৯-৩৩ খ্রি.) মামুনের স্বহস্তে রাজকার্য পরিচালনা।

ফজলের শাসনকার্য পরিচালনা

উচ্চাভিলাসী এবং ক্ষমতালিপ্সু উজির ফজল-ইবন-সহল স্বহস্তে রাজকার্য পরিচালনার অভিপ্রায়ে খলিফা মামুনের মার্ভে অবস্থানকে সমর্থন করেন। রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করবার জন্য তিনি সিরিয়া, ইরাক এবং রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা মামুনকে অবহিত করতেন না; অপরদিকে জ্ঞানপিপাসু মামুন তাঁর উজিরের উপর শাসনকার্য ন্যস্ত করে বিখ্যাত মনীষীদের সাথে জ্ঞানভান্ডারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় নিমগ্ন থাকতেন।

মেসোপটেমিয়ার বিদ্রোহ : আমীনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই মেসোপটেমিয়ার নসর-ইবন-সাবাস নামে এক ব্যক্তি মামুনের নৃশংসতার বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ ও প্রচারণা শুরু করে। আমীনের মৃত্যু এবং রাজমাতা জুবাইদাকে মসুলে নির্বাসনের ফলে বাগদাদবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে সাময়িকভাবে তাহির-বিন-হুসাইন তাদের অর্থ দ্বারা বশীভূত করেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ আরবদের নেতৃত্ব দান করে নসর আলেপ্পো এবং সুমাইসাতের মধ্যবর্তী অঞ্চল দখল করেন। সিরিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার নব-নিযুক্ত শাসনকর্তা তাহির এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলে নসর পাঁচ বছর এশিয়া মাইনরের সীমান্তবর্তী অঞ্চল শাসন করেন। তাহিরের স্থলে ফজল-ইবন-সহল স্বীয় ভ্রাতা হাসান- বিন-সহলকে ইরাকের শাসনকর্তা নিযুক্ত করলে তিনি ৮১৮ খ্রিস্টাব্দে নসরকে নিরস্ত্র করে খলিফার আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করেন।

আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে আলীর বংশধরগণ বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। পারস্য প্রভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে এবং আলী-সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে আবু-সারাইয়া (Abu-Saraya) নামে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি কুফা অধিকার করে প্রচারণা শুরু করে। আবু-সারাইয়া বাগদাদ হতে প্রেরিত হাসান-বিন-সহলের বাহিনীকে বারংবার পরাজিত করে বসরা এবং মোসোপটেমিয়ার কিয়দংশ দখল করেন। সারাইয়া আলীর বংশ সম্ভূত মুহাম্মদ-ইবন-ইব্রাহিম-ইবন-তাবাতাবাকে অধিকৃত অঞ্চলের শাসকরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তিনি শাসকের নামাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি করেন এবং আরবের সর্বত্র দূত প্রেরণ করেন। তাবাতাবার প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে সারাইয়া তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন এবং আলী পরিবারের এক নাবালককে নেতা মনোনীত করেন। সারাইয়ার প্রভাব এবং ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে উজির ফজল-ইবন-সহল হারসামাকে ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ দমনে পাঠান। সারাইয়া পরাজিত হয়ে ৮০০ জন অনুচরসহ পলায়নকালে ধৃত এবং নিহত হন।

আরব-ভূখণ্ডে অরাজকতা : আবু সারাইয়ার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকালে সমগ্র হেজাজে ইমাম জাফর-আস-সাদিকের এক পুত্রকে খলিফা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলে পারস্য সীমান্ত হতে ইয়েমেন পর্যন্ত বিদ্রোহের বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়। মক্কায় মুহাম্মদ-ইবন-সাদিক, ইয়েমেন ইব্রাহিম, কুফায় ইবন-তাবাতাবার বিদ্রোহ আব্বাসীয়দের প্রতি আলী সম্প্রদায়ের বিরাট চ্যালেঞ্জস্বরূপ ছিল। ফজলের সাথে হারসামার সদ্ভাব না থাকলেও এরূপ ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করবার জন্য তিনি বীরশ্রেষ্ঠ হারসামাকে আরব-ভূখন্ডের বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত করেন। অরাজকতা দূরীভূত হলে তাঁকে আরব এবং সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।

হারসামার হত্যা : আরব ও সিরিয়ার শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বিশ্বস্ত কর্মচারী এবং সুদক্ষ যোদ্ধা হারসামা মার্ভে গমন করে খলিফা আল-মামুনকে রাজ্যের বিশৃঙ্খলার কথা অবহিত করেন। বাগদাদ হতে দূরে রাখবার উদ্দেশ্যেই ফজল হারসামাকে আরব ও সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু তিনি সেখানে গমন না করে মার্ভের দিকে রওয়ানা হলে হারসামার প্রতি ফজলের ঈর্ষাপরায়ণতা এবং সন্দেহপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। হারাসামা খলিফার সাথে সাক্ষাৎ করে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা জানালেন এবং তাঁকে আরও অবহিত করলেন যে, ফজলের স্বৈরাচারী কুশাসনে সাম্রাজ্য দ্রুত ধ্বংস হতে চলেছে। বস্তুত পূর্বাঞ্চলে অবস্থান করায় খলিফা পশ্চিমাঞ্চলের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না। হারসামা মামুনকে বুঝালেন যে, তিনি বাগদাদে প্রত্যাবর্তন না করলে পশ্চিমাঞ্চলের আধিপত্য হারাবেন। বাগদাদের ভাইসরয় ফজল হারসামার দুঃসাহসিক কার্যে বিস্মিত এবং ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন এবং খলিফার সাথে সাক্ষাতের পর হারসামা নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় পথে আততায়ীর হস্তে তাঁকে হত্যা করেন। ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে হারসামার মৃত্যুতে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য একজন দক্ষ শাসক এবং অভিজ্ঞ যোদ্ধা হারায়।

বাগদাদে গোলযোগ : হারসামার মৃত্যতে বাগদাদবাসী বিক্ষুব্ধ এবং দিকভ্রান্ত হয়ে রাজধানীতে প্রচণ্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করতে থাকে। সৈন্যবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে ইরাকের শাসনকর্তা হাসান-ইবন-সহল বাগদাদ হতে মাদাইনে পলায়ন করতে বাধ্য হন এবং ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়াসিতে গমন করে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। বাগদাদের বিদ্রোহীরা হাসানকে পদচ্যুত করে তার স্থলে মনসুর-বিন-মাহদীকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করতে চাহে কিন্তু মামুন স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি শাসনকার্য নির্বাহ করতে স্বীকৃত হলেন না। অবশ্য এক বছর পরে হাসান বেতন এবং ভাতা বিতরণ করে বিদ্রোহীদের ক্ষান্ত করে শাসনভার গ্রহণ করেন।

ইমাম আলী-আর-রাজীর মনোনয়ন : ধর্মপ্রাণ খলিফা মামুন দীর্ঘদিন থেকেই নবী করীমের বংশধরদের খিলাফত প্রত্যর্পণে উদগ্রীব ছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবার জন্য তিনি মদিনা থেকে মুসা-আল-কাজিমের পুত্র তৃতীয় আলী (Ali III) মার্ভে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে ‘আর-রাজী’ (গ্রহণযোগ্য) উপাধিতে ভূষিত করে ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আলী আর-রাজী মামুন অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন, তবুও তাঁর সাথে খলিফা স্বীয় কন্যার বিবাহ দেন এবং আব্বাসীয় প্রতীক-কাল বর্ণের পরিবর্তে রাসূলে করীমের পরিবারের সবুজ বর্ণ রাজকীয় পরিচ্ছদ এবং পতাকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। স্বভাবত শিয়া ইমাম আলী-আর-রাজীর মনোনয়নে সুন্নী-আব্বাসীয়গণের মনে প্রকট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাগদাদে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ শুরু হয় এবং মামুনের পরিবর্তে তার পিতৃব্য ইব্রাহিম-বিন-মাহদীকে খলিফা হিসেবে বরণ করা হয়। খলিফার পক্ষপাত-নীতি এবং অদূরদর্শিতায় আব্বাসীয়গণ রাজধানী এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। চুরি, ডাকাতি ও অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপে নাগরিকদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করা হয়। দক্ষিণ ইরাক এবং হেজাজেও মামুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

মামুনের বাগদাদে আগমন

হযরত আলী বংশীয় ইমাম আলী-আর-রাজীকে খলিফা মনোনীত করায় যে রাজনৈতিক অসন্তোষ এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সূচনা হয় তা খলিফা মামুনকে জানাবার জন্য রাজী স্বয়ং মার্ভে গমন করেন। ফজলের কুশাসন এবং বাগদাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা অবগত হয়ে মামুন ৮১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। মামুন বাগদাদে পৌঁছিবার পূর্বেই ফজল-ইবন-সহল গুপ্তঘাতকের হস্তে নিহত হন। যাত্রাপথে তুস্ নামক স্থানে হারুন-আর-রশীদের সমাধিস্তম্ভের সন্নিকটে মনোনীত খলিফা আর-রাজী আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, মামুনের সঙ্গে ভ্রমণকালে আর-রাজী বিষাক্ত ডালিমের রস (মতান্তরে বিষাক্ত আঙ্গুর) পান করে মৃত্যুমুখে পতিত হন। যে স্থানে আর-রাজী ইন্তেকাল করেন সেই স্থানে সমাধির উপর একটি অতুলনীয় সৌধ নির্মিত হলে একে কেন্দ্র করে খোরাসানে মাসহাদ (শাহাদাতের স্থান) নামে একটি অপূর্ব সুন্দর শহর গড়ে উঠে। ঐতিহাসিক আমীর আলী আর-রাজীর হত্যার ষড়যন্ত্রকে অস্বীকার করেন। শিয়া সম্প্রদায়ের একটি অন্যতম প্রধান তীর্থস্থানস্বরূপ এটি অদ্যাবধি সমাদৃত।[১] মামুন বাগদাদের পথে নাহরাওয়ানে কিছুদিন অবস্থান করেন এবং বাগদাদ ও রাক্কা থেকে আগত তাহির এবং অপরাপর কর্মচারীদের আনুগত্য লাভ করেন। ৮১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রসিদ্ধ আব্বাসীয় নগরী বাগদাদে মামুনের প্রবেশ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, তিনি স্বয়ং শাসনভার পরিচালনা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর আগমনে ইব্রাহিম-বিন-মাহদী পলায়ন করেন। কিন্তু ধৃত হয়ে ক্ষমাপ্রার্থী হলে খলিফা তাকে মার্জনা করেন। অপরাপর বিদ্রোহীদের অনুরূপ ক্ষমা প্রদর্শনে রাজ্যের অসন্তোষ এবং অচলাবস্থার নিরসন হয়।

[১. লেখক ১৯৬৭ সালে মাযার পরিদর্শন করে এর কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হন।]

মামুনের রাজক্ষমতা লাভ (৮১৯-’৩৩ খ্রি.)

৮১৯ খ্রিস্টাব্দে শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করে খলিফা আল-মামুন ইসলামের ইতিহাসের ‘স্বর্ণযুগের’ (Golden age) সূচনা করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সাম্রাজ্যের শান্তি এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। বিদ্রোহে ক্ষতিগ্রস্ত সুরম্য বাগদাদ নগরীকে সংস্কার এবং পুনঃনির্মাণ করে তিনি একে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মধ্যে একটি অতুলনীয় ও সমৃদ্ধশালী শহরে পরিণত করেন। হিট্টি বলেন, “মামুনের রাজধানী ব্যবসা- বাণিজ্য, শিল্প এবং জ্ঞান-চর্চার কেন্দ্ররূপে সমাদৃত হল।”

রাজ্য শাসনের দায়িত্ব নিজ হস্তে গ্রহণ করে খলিফা আল-মামুন মক্কা ও মদিনার শাসনভার হযরত আলীর জনৈক বংশধরের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি তাঁর দুধ-ভাইকে কুফা ও বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তাহির-বিন-হুসাইনকে তিনি খোরাসানে এবং তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে মিসর ও সিরিয়া শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। দুই বছর পরে তাহিরের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র তালহাকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং খলিফার কঠোরতা ও বিচক্ষণতায় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহের মূলোৎপাটিত হয়।

বিদ্রোহ দমন

৮২২ খ্রিস্টাব্দে আবদুল্লাহ-বিন-তাহির মেসোপটেমিয়ার বিদ্রোহী নসর উকায়লীকে পরাজিত করে তাকে খলিফার নিকট প্রেরণ করেন। মামুন দয়াপরবশ হয়ে তাকে ক্ষমা করেন। আবদুল্লাহ অতপর মিসরের গোলযোগ দমনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। ৮১৫ থেকে ৮২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিসরে আমীনের সমর্থক কায়সাইট গোষ্ঠীর সাথে মামুনের সমর্থক কালবাইট গোষ্ঠীর গৃহযুদ্ধ চলে। গোত্রীয় দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষের সুযোগে প্রথম হাকাম কর্তৃক স্পেন হতে বিতাড়িত কর্ডোভাবাসিগণ আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে। আবদুল্লাহ মিসরে অভিযান করে কর্ডোভাবাসীদের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বিতাড়িত করলে তারা ৮২৫-২৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রীট দ্বীপ দখল করে।

মামুনের রাজত্বকালে ইয়েমেন এবং খোরাসানেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইব্রাহিম নামে জনৈক ব্যক্তি ইয়েমেনে বিদ্রোহ করলে মামুন তাকে পরাজিত করে দক্ষিণ আরবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে খারিজিগণ তৎপর হয়ে উঠে এবং আবদুর রহমানের নেতৃত্বে তারা সমগ্র খোরাসানে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে ভ্রাতা তালহার মৃত্যু হলে আবদুল্লাহ-বিন-তাহির খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং কঠোর হস্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করেন। ৮২৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফাকে হত্যার একটি মারাত্মক ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হলে চক্রান্তকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়।

মামুনের রাজত্বকালে সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয় মাজেন্দ্রান, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া অঞ্চলে। এই বিদ্রোহের নেতা ছিল বাবেক যুররাসী। বাবেক ইসলাম, ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাস করত না কিন্তু পুনর্জন্ম বিশ্বাস করত। আমীর আলী তাকে নিহিলিষ্ট (Nihilist) বলে অভিহিত করেন এবং সে মাজেন্দ্রানের মাজিয়ান গোত্রের লোক ছিল। সে দুর্গম গিরিসংকটে একটি দুর্গ স্থাপন করে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে নিয়োজিত হয়। দুর্গম স্থানে অবস্থানের জন্য কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেও তাকে নিরস্ত্র করবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে সে রোমান সম্রাট থিউফিলাসের সাথে হাত মিলায় এবং মুসলিম রাজ্য আক্রমণ করে অবিরাম লুটতরাজ করতে থাকে। দীর্ঘ বিশ বছর পারস্যে মাজিয়ান ধর্ম পুনরুজ্জীবিত করে সে প্রভুত্ব করতে থাকে। পাপিষ্ঠ বাবেকের উপাধি ছিল ‘খুররামিয়া’ অথবা লালাসাগ্রস্ত; কারণ, সে অবৈধ বিবাহ (incestuous marriage) করে। খলিফার নির্দেশে আবদুল্লাহ-বিন-তাহির রোমান এবং বাবেকের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করে। মুসলিম আক্রমণের প্রচণ্ডতায় রোমান সম্রাট সন্ধি করতে বাধ্য হন।

রাজ্য বিস্তার

সম্প্রসারণ নীতির পরিবর্তে শান্তি এবং সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় মামুন কৃতিত্ব অর্জন করেন। বিদ্রোহ দমন করে মুসলিম বাহিনী কতিপয় অঞ্চল দখল করে। ৮২৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা জিয়াদাতুল্লাহ আগলাবিদ তাঁর পার্শ্ববর্তী সিসিলি দ্বীপ অধিকার করেন। স্পেন হতে দ্বিতীয় আবদুর রহমান কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে কতিপয় কর্ডোভাবাসী আলেকজান্দ্রিয়ায় আগমন করে এবং অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে। মিসরের শাসনকর্তা আবদুল্লাহ-ইবন-তাহির তাদেরকে একটি দ্বীপে বিতাড়িত করেন। ৮২৫ খ্রিস্টাব্দের সংঘর্ষে ক্রীটবাসীদের পরাজিত করা হয়। তারা ক্রীট দ্বীপ অধিকার করে বসবাস শুরু করে। এ ছাড়া মুসলমানদের আধিপত্য কাবুল পর্যন্ত প্রসারিত হয় এবং কাবুলের রাজা ইসলামে দীক্ষিত হন।

তাহেরী বংশ

খলিফা মামুনের রাজত্বকালে তাহির-ইবন-হুসাইন খোরসানে খারিজী বিদ্রোহ দমন করে সমগ্র পারস্য অঞ্চলে স্বীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। ৮২১ খ্রিস্টাব্দে পূর্বাঞ্চলীয় শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে তিনি মার্ভ হতে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। খুত্বা হতে খলিফার নাম বাতিল করলেও তিনি মামুনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

বুরানের সাথে মামুনের বিবাহ

খলিফা মামুনের গৌরবোজ্জ্বল রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল তাঁর সাথে ৮২৫ খ্রিস্টাব্দে হাসান-ইবন-সহলের অপূর্ব সুন্দরী তনয়া আঠার বছর বয়স্কা বুরানের বিবাহ। উজির সহলের ওয়াসিতের বাসভবনে এই বিবাহ এরূপ আড়ম্বর এবং জাঁকজমকের সাথে সম্পাদিত হয় যার নজির তৎকালীন সময়ে খুব বিরল ছিল। হিট্টি বলেন, “এই বিবাহে এত অধিক অর্থ ব্যয় করা হয় যা আরব সাহিত্যে সেই যুগের একটি অবিস্মরণীয় ব্যয়বহুল ঘটনা।” মণিমুক্তা খচিত আসনে উপবিষ্ট বর-বধূর মস্তকে সাসানীয় ট্রে থেকে হাজার হাজার বিভিন্ন ধরনের মণিমুক্তা বর্ষণ করা হয়। শত শত প্রদীপ রাত্রিকে দিনে পরিণত করে। এই বিবাহে ৫ কোটি দিরহাম ব্যয়ে বরযাত্রীদের ১৭ দিন মহাসমারোহে আপ্যায়িত করা হয়। রাজকীয় বিবাহের ব্যয় নির্বাহের জন্য মামুন হাসানকে ফারস ও আহওয়াজের এক বছরের রাজস্ব প্রদান করেন।

মনোনয়ন দান

খলিফা মামুন মৃত্যুর পূর্বে ভ্রাতা কাশিম এবং পুত্র আব্বাসকে খিলাফত হতে বঞ্চিত করে তাঁর অপর এক যোগ্য এবং কর্মঠ ভ্রাতা ইসহাক মুহাম্মদকে ‘মুতাসিমবিল্লাহ’ উপাধি দান করে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

মৃত্যু : রোমান আক্রমণ প্রতিহত করে মামুন টুরসাসের ৭০ মাইল উত্তরে তারানা নামক স্থানে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণের আদেশ দেন। এশিয়া মাইনরে অবস্থানকালে তিনি বাদানদুন নদীর তীরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

মামুনের চরিত্র

খলিফা আবদুল্লাহ-আল-মামুন দীর্ঘ সুঠাম দেহ, সুশ্রী এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারার অধিকারী ছিলেন। তাঁকে মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি বলে অত্যুক্তি হবে না। একাধারে তিনি কবি, সাহিত্যিক, আইনজ্ঞ ও দার্শনিক ছিলেন। বাল্যকালে তিনি ব্যাকরণ-বিশারদ খলিল বসরীর নিকট ভাষাতত্ত্ব, ইমাম মালিকের নিকট হাদিস এবং সাহিত্যিকদের নিকট আরবি সাহিত্য শিক্ষা লাভ করেন। মামুন তাঁর মাতা পারস্যবাসী মারাজিলের প্রভাব এবং মাতার মৃত্যুর পর বার্মেকী উজীর জাফরের প্রভাবে বিদ্রোৎসাহী হয়ে উঠেন। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পারস্য সংস্কৃতি মূর্ত হয়ে উঠে। মামুন পবিত্র কুরআন শরীফ কণ্ঠস্থ করেন এবং এর তফসীর (ব্যাখ্যায়) শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। আমীন অপেক্ষা মামুনের চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল অধিক। রাজোচিত গুণাবলি, পাণ্ডিত্যপূর্ণ মনোভাব, কর্মস্পৃহা, বিচক্ষণতা, উপস্থিত বুদ্ধি এবং ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে পিতা হারুন তাঁকে নিজের দ্বিতীয় উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

খলিফা মামুনের স্বভাব ছিল শান্ত এবং সংযত। ন্যায়নিষ্ঠা, মহানুভবতা, বিদ্যোৎসাহিতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং উদারতার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন এবং প্রতি রমজান মাসে পবিত্র কুরআন শরীফ তেত্রিশবার খতম করতেন। একজন ঐতিহাসিক বলেন, “প্রগাঢ় প্রজ্ঞা, দৃঢ়-সংকল্প, অপূর্ব বুদ্ধিমত্তা ও ত্রাস সঞ্চারকারী প্রকৃতি, নির্ভীকতা এবং বদান্যতা প্রভৃতি রাজোচিত গুণের জন্য তিনি আব্বাসীয় বংশের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর অনেক সদগুণ ছিল। তাঁর সম্বন্ধে বহু স্মরণীয় ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে। আব্বাসীয় বংশের মধ্যে তাঁর চেয়ে অধিকতর কোন জ্ঞানী ব্যক্তি খিলাফত লাভ করেন নি।”

আল-মামুনের কৃতিত্ব

অগাস্টান যুগ (Augustan Age) : আমীর আলী বলেন, “মামুনের খিলাফত সারাসিনীয় ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরাবাজ্বল অধ্যায়। যথার্থই একে ইসলামের ‘অগাস্টান যুগ’ বলা হয়েছে। তাঁর বিশ বছরব্যাপী শাসনকাল বুদ্ধিবৃত্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের মানসিক উৎকর্ষের অবিস্মরণীয় কীর্তি রেখে গিয়েছে।” আল-মামুনের শাসনকাল আব্বাসীয় খিলাফতের স্বর্ণযুগের সূচনা করে। মামুনের শাসনকাল সন্দেহাতীতরূপে ইসলামের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ও গৌরবময় যুগ। তৎকালীন বিশ্বে আল-মামুন ছিলেন মনীষী-সম্রাট যার দ্বিধা এবং সঙ্কোচহীন পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং এর প্রভাব তদানীন্তন বিশ্বে পরিলক্ষিত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন ক্ষেত্র ছিল না যাতে মামুনের যুগের কবি, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, অঙ্কশাস্ত্র বিশারদ, আইনজ্ঞ, ধর্মবেত্তা, চিকিৎসক, স্থপতি, চারু ও কারু- শিল্পী, ঐতিহাসিক এবং রাসায়নবিদ প্রমুখ মনীষী অবদান রেখে যান নি।

হিট্টির মতে, “জ্ঞানচর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় দুই খলিফা হারুন এবং মামুনের মধ্যে হারুনের পুত্র মামুন শ্রেষ্ঠ ছিলেন।” হারুনের কবিতা ও সঙ্গীতের প্রতি অধিকতর আকর্ষণ ছিল এবং এটি তাঁর রাজত্বকে আরব্যোপন্যাসের মর্যাদা দান করে। ধীশক্তিসম্পন্ন এবং ব্যুৎপত্তি জ্ঞানের অধিকারী মামুন মানসিক গঠনের দিক হতে দর্শন এবং বিজ্ঞানে অধিক আকৃষ্ট হন। মামুনের ধর্মমত গঠনে তাঁর পারস্য মাতা মারাজিল ও পত্নী বুরান, দুহিতা, শিক্ষক, উপদেষ্টা এবং উজীরের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবং এ সমস্ত সহচর ব্যক্তিদের প্রভাবে তিনি সনাতন গোঁড়া ইসলামী ধর্মমত বর্জন করেন। খিলাফত লাভের পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি পারস্য ও খোরাসানে বসবাস করেন এবং শিয়া মতাবলম্বী হয়েও শিয়া ধর্মে তিনি সন্তুষ্টি লাভ করতে পারেন নি। পরিবর্তনশীল জগতে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং প্রাচীনপন্থীদের মতবাদ সকল প্রকার আধ্যাত্মিক ও মানসিক উন্নতির অন্তরায় মনে করে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়াসী হন। মামুন নিজেও দার্শনিক ছিলেন এবং যুক্তিবাদে তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্তিবাদী মুতাজিলা নীতির (Mutazilism) উদ্ভব হয় এবং রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা লাভ করে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ

আব্বাসীয় খিলাফতে প্রকৃত অর্থে ইসলামী সভ্যতার উন্মেষ এবং ক্রমবিকাশ হয়। উমাইয়া খিলাফতকে বলা হয় আরব যুগ; কিন্তু আব্বাসীয় খিলাফতকে ইসলামী যুগ বলা হয়। রূপকথাখ্যাত বাগদাদ নগরীতে এ সময় বহু জাতি, ধর্ম, গোত্র, কৌলীন্য, মতবাদ নির্বিশেষে মহাজাতি, মহামানবের সমাগম হয়। এ কথা স্মরণ করে হিট্টি বলেন, “বিশ্বের ইতিহাসকে এই যুগ বিশেষভাবে গৌরবোজ্জ্বল করেছে; কারণ, এই যুগে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ এবং চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করে। এই সময়ই ইতিহাস সৃষ্টির সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে।” জোসেফ হেল বলেন, “আরবদের জ্ঞান-চর্চা প্রধান দুটি ধারায় অনুসৃত হয় : (১) আরব জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত কার্যাবলি; যেমন- ধর্মতত্ত্ব, ব্যবহারিক আইন, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, জ্ঞানাহরণের স্পৃহা প্রভৃতি এবং (২) অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত কার্যাবলি; যেমন- দর্শন, অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ফলিত জ্যোতিশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ভূগোল প্রভৃতি।”

বৈদেশিক প্রভাবে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও অনুশীলনের উম্মেষ আব্বাসীয় খিলাফতে শুরু হয়। এর প্রধান কারণ ছিল অনুসন্ধিৎসা, বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি একনিষ্ঠ অনুরাগ, জ্ঞানস্পৃহা ইত্যাদি। মুসলমানগণ আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান- বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, কৃষ্টি, সভ্যতার চরম উৎকর্ষ সাধিত করে কেবল স্বর্ণযুগের (Golden age) সূচনাই করেন নি; বরং অবলুপ্ত প্রাচীন মানব সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে তাঁরা বিশ্বসভ্যতায় অবদান রাখতে সক্ষম হন। এ কারণে হিট্টি তাঁদেরকে প্রাচীন সভ্যজাতির সংস্কৃতির বাহক এবং উত্তরাধিকারী বলে অভিহিত করেন। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর জ্ঞানচর্চা, বুদ্ধিবৃত্তি, কৃষ্টি, সভ্যতার যে বীজ বপন করেন তা তাঁর উত্তরসূরী হারুন-আর-রশীদের প্রযত্নে অঙ্কুরিত হয়ে বৃদ্ধি পায় এবং পরিশেষে মামুনের রাজত্বে সুস্বাদু ও সুবৃহৎ ফলভারে নত মহীরূহে পরিণত হয়। গ্রীক জ্ঞান-ভাণ্ডার হতে উপকরণ আহরণের জন্য মামুন ইবন্-মাসাওয়া ( Ibn Masawayha) এবং হুনাইন- ইবন-ইসহাকের (Hunayn – Ibn Ishaq) নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপল ও সিসিলি হতে গ্রীক ভাষায় লিখিত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। গ্রীক ভাষা ব্যতীত সংস্কৃত, পারস্য, সিরীয় প্রভৃতি ভাষায় লিখিত পুস্তকাদি অনুবাদ করবার জন্য মামুন ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে ‘বায়তুল-হিকমা’ (Baytul – Hikma or A House of Wisdom) নামে একটি অদ্বিতীয় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এই জগৎ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটিতে তিনটি বিভাগ ছিল : গ্রন্থাগার, শিক্ষায়তন এবং অনুবাদ ব্যুরো (Translation Bureau)। প্রখ্যাত মনীষী হুনাইন-ইবন–ইসহাক এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক নিযুক্ত হন।

আমীর আলী মামুনের রাজত্বকালকে “নিঃসন্দেহে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ও গৌরবময় যুগ” বলে অভিহিত করেন। ‘বায়তুল হিকমা’ এই গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক ছিল। এখানে পারসিক, হিন্দু, গ্রীক, খ্রিস্টান, আরবীয় প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মনীষী ও পণ্ডিতগণ শিক্ষামূলক গবেষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, অনুশীলন ও অনুবাদ কার্যে নিয়োজিত থাকতেন। বিভিন্ন অঞ্চল এবং বৈদেশিক রাজ্য হতে দূত এবং প্রতিনিধি মারফত তিনি নানা দেশের জ্ঞানভাণ্ডারে সঞ্চিত পুস্তকের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গ্যালেন (Galen), ইউক্লিড (Euclid), টলেমী (Ptolemy) প্রমুখ মনীষীর বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাবলী এবং বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল ও প্লেটোর পুস্তকগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। মামুন লিউকের পুত্র কোস্টার (Costa, Son of Luke) গ্রীক, সিরীয় ও কালদীয় ভাষায় লিখিত গ্রন্থাবলী; মানকাহ এবং দুবান নামক ব্রাহ্মণ মনীষীদের উপর সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার পুস্তকাবলী এবং ঈশা-বিন-এহিয়া, মুসা-বিন-খালিদ প্রমুখ পণ্ডিতের উপর পারস্য ভাষায় লিখিত গ্রন্থরাজী আরবিতে অনুবাদের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়। খলিফা অনুবাদ কার্যের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতেন এবং এই অনুবাদ-সাহিত্য মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সংযোজন করে। মূইর বলেন, “এ সমস্ত মনীষীদের পরিশ্রমের ফলে মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয় জাতিগুলোর সাথে তাদের নিজস্ব অথচ বিস্তৃত পৈতৃক সম্পদ গ্রীসের বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটে।”

মামুনের রাজদরবারের উজ্জ্বল রত্ন ছিলেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনুবাদক হুনাইন-ইবন- ইসহাক (৮০৯-৭৩ খ্রি.)। তিনি হীরার একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান ছিলেন এবং প্রথম জীবনে চিকিৎসক ইবন-মাসাওয়ার সহকর্মী ছিলেন। গ্রীক ভাষায় শিক্ষা করে তিনি গ্রীক অঞ্চল হতে পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের কার্যে নিয়োজিত হন এবং মামুনের রাজবৈদ্য জিব্রিল- ইবন-বখতিয়াশুর অধীনে চাকরি করেন। মামুন হুনাইনকে নব-প্রতিষ্ঠিত ‘বায়তুল হিকমার’ পরিচালক নিযুক্ত করেন এবং তিনি তাঁর পুত্র ইসহাক এবং ভ্রাতুষ্পুত্র হুবাঈস- ইবন-আল-হাসানের সহায়তায় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রীক পুস্তকগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। ইসা-ইবন-ইয়াহিয়াও এই জ্ঞান-গৃহের সুযোগ্য অনুবাদক হিসেবে কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি গ্রীক হতে সিরীয় ভাষায় এবং তাঁর অধস্তন কর্মচারীগণ সিরীয় ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করতেন। হুনাইন এরিস্টটলের Helmeneutica গ্রন্থটি প্রথমে গ্রীক হতে সিরীয় ভাষায় এবং তার পুত্র ইসহাক একে সিরীয় ভাষা হতে আরবিতে অনুবাদ করেন। হুনাইন গ্যালেন (Galan), হিপোক্রেটস (Hippocrates) এবং ডায়স্করাইডস (Dioscorides), প্লেটো (Republic), এরিস্টটল (Categories, Physics and Magna Moralia)-এর গ্রন্থরাজী অনুবাদ করে অমর হয়ে রয়েছেন। তিনি গ্রীক ভাষায় লিখিত জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর রচিত অবলুপ্ত পুস্তকাদি অনুবাদ করে আরবিতে সংরক্ষিত করেন। মামুন অনুবাদকদের প্রত্যেককে মাসে ৫০০ দিনার পারিশ্রমিক দিতেন এবং বিশেষ করে হুনাইনকে প্রতিটি অনূদিত পুস্তকের ওজনের সমান স্বর্ণমুদ্রা দিতেন।

হাররান স্কুলের অঙ্ক এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের অনুবাদকের পুরোধা ছিলেন আল- হাজ্জাজ-ইবন-ইউসুফ-ইবন-মাতার (৭৮৬-৮৩৩ খ্রি.)। ইউক্লিডের Elements এবং টলেমীর Almagest-এর প্রথম অনুবাদক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। হুনাইনের পূর্বে তিনি হারুন এবং মামুনের জন্য সর্বপ্রথম ইউক্লিডের পুস্তকটি অনুবাদ করেন। আবু আল-ওয়াফা এবং লিউকপুত্র কোস্টাও গ্রীক ভাষা হতে আরবিতে পুস্তক অনুবাদক করে কৃতিত্ব অর্জন করেন।

অনুবাদক সাহিত্য ব্যতীত মামুনের রাজত্বকালে মৌলিক গবেষণা দ্বারা মুসলিম মনীষিগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে যেতে সক্ষম হন। গ্রীক, পারস্য ও ভারতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মীয় অনুভূতির পরিবর্তে বিচার-বুদ্ধি, যুক্তি-তর্ক, প্রগাঢ় অনুশীলন দ্বারা মুসলমানগণ অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, ভূগোলশাস্ত্র, রসায়নবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করেন।

খলিফা মামুনের রাজত্বকালে সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। মৃতপ্রায় ফারসি সাহিত্যও মামুনের উৎসাহ এবং প্রেরণায় নবজীবন লাভ করে। আধুনিক ফারসি কবিতার স্রষ্টা মার্ভবাসী কবি আব্বাস তাঁর সভাকে অলঙ্কৃত করেন। মামুনের সময়ে সাহিত্য চর্চা সীমিত হয় নি; বরং তাঁর দরবারে সাহিত্যিক ও কবিদের যথেষ্ট সমাদর ছিল। ধর্মভীরু এবং নিবেদিত প্রাণ সাহিত্যিক আবু-আল- আতাহিয়া (৭৪৮-৮২৮ খ্রি.) ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় কবিতা রচনা করেন।

খলিফা মামুনের রাজত্বে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস-শাস্ত্র, আইন-শাস্ত্র এবং ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতির চর্চা অবিরাম গতিতে চলতে থাকে। কুরআন শরীফের ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা হতেই ব্যাপক ভাষাতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গবেষণার সূচনা হয়। খলিফা নিজেও হাফেজ ছিলেন এবং কুরআনের তাফসীরে তিনি অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন। একদিকে স্বাধীন-চিন্তার (Free thought) পথিকৃত হিসেবে তিনি মুতাজিলাকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেন, অপরদিকে কুরআন ও হাদিসে তাঁর প্রগাঢ় ভক্তি এবং শ্রদ্ধা ছিল। কথিত আছে যে, প্রতি রমজান মাসে তিনি ৩৩ বার কুরআন শরীফ খতম করতেন। ধর্মতত্ত্ব, ব্যবহারিক আইন, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রেখে গিয়েছেন তাঁরা কুরআন এবং হাদিস দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং তাঁরা সকলেই আরব বংশোদ্ভুত ছিলেন। হাদিস ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্যা সমাধানে শুধু সহায়তাই করত না; বরং এটি মুসলিম চিন্তাধারায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। যে ছয়টি গ্রন্থে বহু হাদিস সংগৃহীত হয়ে আছে তার মধ্যে মুহাম্মদ বিন-ইসমাইল আল-বুখারীর গ্রন্থই সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। পারস্যবাসী আল-বুখারী (৮১০-৭০ খ্রি.) ষোল বছর ধরে পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, হেজাজ এবং মিশর পরিভ্রমণ করে ৬০ লক্ষ সংগৃহীত হাদিস হতে ৭২৭৫ টি হাদিসকে নির্ভুল বলে গ্রহণ করেন এবং নামাজ, হজ্জ্ব এবং যাকাত প্রভৃতি বিষয়ানুসারে তাঁর গ্রন্থ ‘বুখারী শরীফে’ এগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করেন।

খলিফা মামুনের রাজত্বে ইসলামের চতুর্থ মজহাবের প্রবর্তক ইমাম আহমদ বিন- হাম্বলের আবির্ভাব হয় এবং তিনি হাদিসকে ইসলামী আইন শাস্ত্রের প্রধান অঙ্গ বলে মনে করেন। হিট্টি বলেন, “ইবন-হাম্বলের গোঁড়ামি বাগদাদে মুতাজিলাদের নব-প্রবর্তিত নীতিগুলোর প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।” খলিফা মামুন এবং মুতাসিম কর্তৃক ইবন-হাম্বল বন্দী এবং নির্যাতিত হলেও তিনি তাঁর মতবাদ ত্যাগ করেন নি। পরবর্তীকালে ওয়াহাবী আন্দোলনে ইবন-হাম্বালের হাদিসের প্রতি একনিষ্ঠতার প্রতিফলন দেখা যায়।

সুকুমার শিল্পচর্চা আল-মামুনের খিলাফতে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করে। হাম্বলের বাণীগুলো সুন্দর এবং পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ করে মুসলমানগণ হস্তলিখন পদ্ধতির (Lithography) আবিষ্কার করে। মামুনের সময় হস্তলিপি বিশারদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আর-রায়হান। তাঁর নাম অনুসারে একটি লিখন পদ্ধতির নামকরণ হয় ‘রায়হানী’। ইতিহাস রচনায় যাঁরা এই সময় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আল-ওয়াকিদি (Al-Waqidi – ৮২২-২৩ খ্রি.)। মদিনাবাসী আল-ওয়াকিদি ইসলামের বিজয়ের উপর মনোজ্ঞ গ্রন্থ রচনা করেন। প্রাক- ইসলামী যুগের ইতিহাস সম্বন্ধে যারা ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন তাদের মধ্যে হিসাম-আল- কালবী (৮১৯ খ্রি.) কৃতিত্বের দাবিদার।

মামুনের খিলাফতে শিক্ষাদীক্ষা সম্প্রসারণের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক পরিবেশ গঠনের জন্য তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এগুলোর ব্যয়ভারের জন্য অর্থ ও লা-খেরাজ সম্পত্তি দান করেন। ওসনার (Oelsner ) বলেন, “আমরা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম দেখতে পাই যে, একটি ধর্মীয় ও স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সখ্যতার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তার উন্নতি বিধানের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণ করে।” শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান সহায়ক ছিল কাগজ। চীনাদের অনুকরণে মুসলমানগণ প্রথম চীনাদের সাহায্যে সমরকন্দে কাগজের কারখানা নির্মাণ করে এবং পরবর্তীকালে খলিফা হারুন-অর- রশীদের রাজত্বে ৭৯৪-৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রথম কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রভূত পরিমাণ কাগজ উৎপাদিত না হলে কখনই মামুনের সময়ে মুসলমানগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণশিখরে উপনীত হতে পারত না। মামুনের প্রতিষ্ঠিত ‘বায়তুল হিকমা’ শুধু একটি অনুবাদ ব্যুরোই ছিল না; বরং এতে একটি বিশাল গ্রন্থাগার, বিদ্যায়তন এবং মানমন্দির ছিল। পরবর্তীকালে বায়তুল হিকমার অনুকরণে নিজামিয়া এবং মুসতানসারিয়া মাদ্রাসা (বিশ্ববিদ্যালয়) নির্মিত হয়।

মামুনের শাসনকালে শিল্প ও কৃষিকার্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারু ও চারু শিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। জমি জরিপ, খাল খনন ও পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধিত হয়। হিট্টি বলেন, “মহান পিতা এবং পুত্রের রাজত্বকাল পাঁচ শতাব্দীব্যাপী আব্বাসীয় খিলাফতেই নহে; বরং সমগ্র আরব খিলাফতের স্বর্ণযুগ বলে অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত হয়েছে। আল-মামুনের রাজধানী সম্ভবত বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়ন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে গৌরব অর্জন করে, যা উর এবং ব্যাবিলন হতে টেসিফোন পর্যন্ত নির্মিত সমৃদ্ধশালী রাজধানীগুলোর যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিল।” বাগদাদের বিপণিগুলোতে মিসরের লিনেন কাপড়, সিরিয়ার ধাতু- নির্মিত তৈজসপত্র, লেবাননের কাঁচের দ্রব্যাদি, বাহরাইনের মুক্তা, ইয়েমেনের সুগন্ধি দ্রব্য (ফ্রান্‌কিনসিন এবং মশলা); পারস্যের কার্পেট, ব্রকেড ও এমব্রয়ডারী করা বস্ত্রাদি, খোরাসানের সোনা ও রূপার অলঙ্কারাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত। উপরন্তু, বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় রং, ধাবত দ্রব্যাদি, মধ্য এশিয়ার রুবী, ক্রীতদাস-দাসী, বস্ত্রাদি, চীনের মৃৎপাত্রাদি, সিল্ক, মৃগনাভী, রাশিয়া ও স্কেন্ডিনেভিয়ার মধু, ফার, পূর্ব আফ্রিকা হতে কাল ক্রীতদাস এবং সোনার পাত প্রভৃতি আমদানি করা হত। এগুলো সাম্রাজ্যের আন্তঃ এবং বহির্বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতির স্বাক্ষর বহন করে। ফিশারের ভাষায়, “মধ্যপ্রাচ্যের পণ্যদ্রব্যাদি পশ্চিমী রুচির তুলনায় খুবই মূল্যবান এবং উন্নতমানের ছিল এবং ইউরোপীয় দেশসমূহের এর বিনিময়ে কিছুই দিবার ছিল না।

সুতরাং নির্বিবাদে বলা যায় যে, মামুনের খিলাফত শুধু কৃষ্টি ও সভ্যতার ‘চরম’ শিখরে উপনীত হয়ে ‘অগাস্টান যুগ’ (Augustan Age) রূপেই পরিচিত ছিল না, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান ইতিপূর্বে এবং এর পরে এতদূর উৎকর্ষ সাধিত হয় নি। তাই একে ‘মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ’ (Golden Age of Islamic civilization ) বললে অত্যুক্তি হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *